শাওয়াল ১৪৪৬   ||   এপ্রিল ২০২৫

সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য নয়, সুস্থতার পথে হাঁটুন

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সংস্কৃতির প্রভাব অনস্বীকার্য চারপাশে ভালো ও  নেকীর পরিবেশ বিরাজ করলে কোনো ব্যক্তি-মানুষ পূর্ব থেকে ভালো হিসেবে তৈরি না থাকলেও মন্দ মানুষ হিসেবে নিজেকে নামিয়ে নিতে প্ররোচিত হয় না মন্দ পরিবেশ মন্দ ব্যক্তি-মানুষকে আরও মন্দ পথে চলতে উসকানি দেয় পক্ষান্তরে ভালো ও নেক পরিবেশ ভালো মানুষকে তো হিম্মত জোগায়ই, মন্দ মানুষকেও মন্দ পথে হাঁটতে নিরুৎসাহিত করে এজন্যই জাতীয় জীবনে পরিবেশ, জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির ভালো-মন্দকে গুরুত্বের চোখে দেখা হয়; দেখতে হয়

একটি সমাজে তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ প্রকাশ্যে ধূমপান করলে এবং এই ধূমপান নিয়ে বড়াই করার সুযোগ পেলে, ওই সমাজের অপরাপর ধূমপান করা-না করা তরুণ-তরুণীদের বড় একটি অংশের মধ্যে ধূমপান বিষয়ে অ-দূরত্ব কিংবা সহনশীলতার একটি মনোভাব তৈরি হতে থাকে এতে ব্যাপক সামাজিক, নৈতিক, মানবিক ও দ্বীনী ক্ষতির ক্ষেত্র তৈরি হয় একই রকম সমস্যা তৈরি হয় নারী-পুরুষ সম্পর্ক, পোশাকের শালীনতা-অশালীনতা, নেশাদ্রব্যের প্রকাশ্য ব্যবহার, সম্মিলিত হারাম ‘বিনোদন আয়োজন’ এবং নিষিদ্ধ খানাপিনার প্রকাশ্য ও জনসম্মুখের অনুশীলন থেকেও আবার বিপরীত ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি ঘটতে পারে অর্থাৎ যদি কোনো সমাজে নেক কাজ ও কল্যাণকর অনুশীলনের প্রকাশ্য চর্চা হয়, তাহলে ওই সমাজের অন্য মানুষদের মাঝেও সেটি ইতিবাচক মনোভাব ও আগ্রহ গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখে

মোটকথা, মন্দ পরিবেশ ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ মন্দ মনোভাব ও আগ্রহ তৈরি করে, সুস্থ ও নেক পরিবেশ ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ ভালো মনোভাব ও আগ্রহ জাগ্রত করে

দুই.

এজাতীয় ক্ষেত্রে সমাজে সংযম ও ভালোত্বের দায় ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একদমই ঠিক না কারণ, এ প্রক্রিয়ায় মন্দের চর্চা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতার জন্য সেক্যুলারিজম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার চোরাই দরজা অবারিত করার চেষ্টা চালানো হয় আর এ চেষ্টাটা মূলত অনৈতিকতার বাজার গরম করারই একটা সাংস্কৃতিক ও কৌশলী চেষ্টা সম্প্রতি প্রকাশ্যে নারীদের ধূমপান, পোশাক ও সংস্কৃতির তর্কে পাশ্চাত্য জীবনধারা অনুকরণের আকুতি এবং অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা ও সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে মুসলিমপ্রধান একটি দেশ ও সমাজে সাংস্কৃতিক ও জীবন-অনুশীলনের পদ্ধতিতে নৈরাজ্য তৈরি করা হচ্ছে প্রতিদিন এ নৈরাজ্য বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একশ্রেণির মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এজাতীয় সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের ক্ষেত্র উত্তপ্ত করার পেছনে ভূমিকা রাখছে বামপন্থি ও সেক্যুলার রাজনীতির দুষ্ট চতুর লোকেরা না বুঝে প্রবাহিত বাতাসের সঙ্গে তাল দিচ্ছে আরও কিছু বোকা-প্রকৃতির লোকজন মূলত ইসলামী জীবন ও শালীনতাকে আঘাত করার এসব সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের ব্যাপারে সতর্ক, সচেতন ও প্রতিরোধ-প্রয়াসী থাকার কোনো বিকল্প নেই অবশ্য আইন হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা বরাবরই নিরুৎসাহযোগ্য প্রতিরোধ-চেষ্টার জন্য মৌখিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপায়গুলো ব্যবহার করা যায় জনমত ও জনচাপ তৈরি করা যায়

তিন.

একটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুসলিম দেশে সমাজ ও নাগরিক বাস্তবতার কারণেই প্রকাশ্য জনপরিসরে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা মূলত অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যমূলক ও ভারসাম্যহীন পদক্ষেপ সমাজ মনস্তত্ত্ব ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিংবা সংঘাত ও নৈরাজ্য উসকে দেওয়া ছাড়া এসব চেষ্টার পেছনে আর কিছু থাকে না ধরুন, রমযান মাসে ঢাকার রাস্তায় দিনের বেলায় প্রকাশ্যে খানা-খাদ্য খাওয়া এবং খাওয়ানো কিংবা ধূমপান করার কোনো ঘটনা ঘটল এ ঘটনার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না এমন দৃশ্য কিংবা ঘটনার যে চরিত্র, সে অমুসলিম হোক, হোক অসুস্থ-মুসাফির মুসলিম কিংবা এজাতীয় অন্য কেউ, রমযানের গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা নষ্ট করার মূলত কোনো প্রয়োজনই তার নেই দরকার কিংবা অধিকার যাই থাকুক, সে আড়ালে নিয়ে তার খাবার খাওয়ার প্রয়োজনটা সারতে পারে সেটা কঠিন কিংবা অসম্ভব কোনো ব্যাপারই না  এর পরও যখন রমযানের দিনে প্রকাশ্যে খাবার-ধূমপানের কাজটি  কেউ করে, তার মানে হল এদেশে দ্বীন কেন্দ্রিক যে জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি চালু আছে, সেটা সে ভাঙতে চায় কিংবা অযথাই খোঁচাখুঁচি করে নৈরাজ্য তৈরি করতে চায় এ দুটিই অন্যায় এবং জঘন্য অপরাধ

এখানে একটি কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, এহেন কর্ম কোনো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে না কোনো ব্যক্তির নিজস্ব কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা বা কর্ম তার নিজস্ব তখনই থাকে, যখন সে তার নিজস্ব পরিসরে প্রকাশ করে সেখানে সে হারাম বা অবৈধ কিছু করলে তার জবাব সে নিজ স্রষ্টার কাছেই শেষ বিচারে দেবে অথবা বেআইনি কিছু করলে রাষ্ট্র দেখবে কিন্তু যখন সে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছুকে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করে, তখন সেটিকে কু-মতলব এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ বিকৃতিই আখ্যা দিতে হয় এটিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ থাকে না

এজাতীয় নৈরাজ্যের তালিকা কিংবা অঙ্গন এখন খুব ছোট নয় শহরের হারাম ‘বিনোদন’ গ্রামের গহিনে নিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় পোশাক, স্লোগান, ভাষা, খানা-খাদ্য, ইভেন্ট (একদিকে ওয়াজ মাহফিল, আরেকদিকে নাটক-যাত্রা) নিয়ে তুলনা-প্রতিতুলনা দিয়ে জটিলতা ও বিরোধের ক্ষেত্র তৈরি করা হয় এইসব সাংস্কৃতিক ও জীবনধারা এবং পর্ব-অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক নৈরাজ্যের সঙ্গে আবার সঙ্গ দিতে দেখা যায় মুসলিম নামধারী কিছু রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সুশীল শ্রেণির লোকজনকে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের এই নষ্ট উসকানির সঙ্গে থেকে তারা দ্বীনী জীবনধারার কতটুকু ক্ষতি করছে, সেটা বুঝতেই চায় না অথবা বুঝেশুনেও আমলে নিতে চায় না নিঃসন্দেহে চালাকি করে কিংবা মুখ গুঁজে থেকে তারা দায়মুক্ত হতে পারবে না

চার.

ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেক আমলের পাশাপাশি মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, সামাজিক পরিসরে দ্বীনের সহজাত সামাজিক আচরণ ও চর্চাগুলো প্রকাশ্যে অনুশীলন করা একটি মুসলিম সমাজের জন্য দ্বীন কেন্দ্রিক কিংবা দ্বীনবিরোধী নয় এমন সুস্থ জীবন চর্চা ও সংস্কৃতির সচলতা ও বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ইতিবাচক ও নেক সংস্কৃতির দেখাদেখি এবং নেক পরিবেশের পরশে সমাজের আরও দশজন অনুপ্রেরণা বোধ করে, নেক কাজে হিম্মত লাভ করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এজন্য কাউকে কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, জোর খাটানোরও প্রয়োজন হয় না ব্যক্তিগত ও সামাজিক দাওয়াহ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ নেক পরিবেশের আনুকূল্য সমাজে রক্ষা করার চেষ্টা করেই যেতে হবে নেক সংস্কৃতি ও জীবনাচারের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় দুষ্ট লোকের নৈরাজ্য ও উসকানিকে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না বিচ্ছিন্ন ও পতিত জীবনচর্চা যেন বিচ্ছিন্নই থাকে, অপছন্দনীয়ই থাকে সেই দাওয়াতী-ইসলাহী চেষ্টা জারি রাখতে হবে

আর মিডিয়া, প্রশাসন ও রাজনীতিকদের দায়িত্ব, জাতির ধর্মীয় জীবনের সৌন্দর্য এবং জাতীয় জীবনের প্রধানতম ইতিবাচক চেহারাকে সজীব ও আলোকিত রাখা জাতি ও রাষ্ট্রের মৌলিক ইতিবাচকতা ও নেকীর রেওয়াজকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টাকে সন্দেহ ও বিরক্তির চোখে দেখা এগুলো খেয়ালখুশি ও তামাশার বিষয় না এসবের সঙ্গে জাতির প্রধান অংশের দ্বীনী জীবন ও নৈতিকতার চর্চা ও মূল্যায়ন জড়িত জড়িত আগামী প্রজন্মের পছন্দ-অপছন্দের দুনিয়া এবং এসবের পেছনে যুক্ত বিদেশি মদদ ও প্রকল্প এবং অন্তর্ঘাতমূলক রাজনীতির দুষ্ট চক্র

জীবন, পরিবেশ ও সংস্কৃতির চেহারা মলিন হতে দেওয়া কারো জন্যই উচিত নয় হতে পারে, কোনো প্রভাবশালী এক-দুই তিনটি চেয়ার কিংবা রাজনীতির মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ‘মাযুরি’ আছে, ভিন্ন অভ্যাস ও ভুল সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিজস্ব সংযুক্তি আছে, তার জন্যও উচিত জাতীয় জীবনে নৈতিক ও দ্বীনী আলোকদীপ্ত সংস্কৃতির বিকাশের চেষ্টা করা, মন্দটার নয় জাতীয় জীবনের সৌন্দর্যের দায়-দায়িত্বশীলতা জাতীয়; ব্যক্তিগত নয় 

 

 

advertisement