শাওয়াল ১৪৪৬   ||   এপ্রিল ২০২৫

কাদিয়ানিয়াত ও ঈমান-বিরোধী বিভিন্ন ফেতনা ॥
কিছু মৌলিক কথা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الْحَمْدُ لِلهِ، وَسَلَامٌ عَلَىٰ عِبَادِهِ الَّذِينَ اصْطَفَىٰ، وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ، وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه، آخِر الْأَنْبِيَاءِ وَخَاتم الرُّسُلِ، لَا رَسُولَ بَعْدَه وَلَا نَبِيَّ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِه وَصَحْبِه أَجْمَعِينَ. أَمَّا بَعْدُ!!

উম্মতের ওপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যত হক রয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় হক হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর সকল বৈশিষ্ট্য ও মর্র্যাদা সহকারে ঈমান আনা আল্লাহ তাআলার মহব্বতের পরে তাঁর মহব্বতকে সকল জিনিসের ওপর প্রাধান্য দেওয়া

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো একেবারে প্রথম সারির, সেগুলোর কয়েকটি এই

এক.

তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল যে কেউ তাঁর রেসালাতকে অস্বীকার করবে, সে বে-দ্বীন ও বে-ঈমান চাই সরাসরি অস্বীকার করুক, কিংবা তাঁকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসেবে না মানুক, অথবা ইসলামী অর্থ অনুযায়ী তাঁকে ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ (শেষ নবী) হিসেবে বিশ্বাস না করুক, অথবা তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের গণ্ডিকে সংকীর্ণ করে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণিকে তা থেকে আলাদা রাখুক এ ধরনের কাজে যারা লিপ্ত হবে, তারা সকলেই বে-দ্বীন ও বে-ঈমান অনুরূপ যারা তাঁকে আল্লাহর বান্দা মানবে না, বরং তাঁর জন্য আল্লাহ তাআলার খাস ও একান্ত কোনো গুণ ও সিফাত সাব্যস্ত করবে, তারাও বে-ঈমান ও মুশরিক

দুই.

তিনি ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ তিনি সকল নবী-রাসূলের মধ্যে সবার শেষে প্রেরিত হয়েছেন তাঁর আবির্ভাবের পরে কারো জন্য নবুওত ও রেসালাত লাভ করা অসম্ভব সুতরাং যে কোনো ব্যক্তিই হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর নিজের বা অন্যের জন্য নবুওত বা রেসালাতের দাবি করবে, সে চরম মিথ্যুক ও প্রতারক এবং স্পষ্ট বে-ঈমান ও অমুসলিম যে কেউ এমন প্রতারককে সত্যায়ন করবে, সেও স্পষ্ট বে-ঈমান ও অমুসলিম

তিন.

তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ গোটা মানব জাতির জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁকে বাশীর ও নাযীর (সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী) বানিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁর ওপর অবতীর্ণ কুরআন সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘নাযীর’ ও সতর্ককারী জাতি-বর্ণ-ভাষা-ভূখণ্ড নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের জন্য তিনি নবী ও রাসূল তাঁর ওপর ঈমান আনা ও তাঁর শরীয়ত মেনে নেওয়া ব্যতীত কেউ আল্লাহর রহমতেরও উপযুক্ত হতে পারবে না এবং মুমিন-মুসলিমও হতে পারবে না এমনিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি, দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত কিছুই সে লাভ করতে পারবে না

চার.

তিনি সায়্যিদুন্নাস ও সায়্যিদুল মুরসালীন (সমগ্র মানবজাতির সরদার এবং সমস্ত নবী-রাসূলের সরদার) কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের অস্বীকার কেবল মুলহিদ ও ধর্মবিকৃতিকারী কিসিমের লোকই করতে পারে

পাঁচ.

তাঁর ওপর অবতীর্ণ হেদায়েত গ্রন্থ কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব এটি কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই কিতাবই ঈমান ও ইসলামের মাপকাঠি এবং দ্বীন ও শরীয়তের প্রথম দলীল ও প্রথম উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে

এই কিতাবে পূর্বেকার সকল আসমানী কিতাবের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক হেদায়েতসমূহ সন্নিবেশিত আছে এই কিতাব আমাদেরকে এ সংবাদ দিয়েছে যে, পূর্ববর্তী উম্মত তাদের কিতাবের মধ্যে বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধন করেছে ইতিহাস এবং বাস্তবতার আলোকে প্রমাণিত, পূর্ববর্তী উম্মত তাদের আসমানী কিতাবসমূহের আসল কপিও সংরক্ষিত রাখতে পারেনি আর এদিকে আল্লাহ তাআলা ওইসকল কিতাবের শরীয়তকে এই কুরআনের মাধ্যমে রহিত করে দিয়েছেন

সেজন্য যে ব্যক্তি কুরআন কারীমের ওপর ঈমান না এনে নিজেকে পূর্বের কোনো কিতাবের অনুসারী হিসেবে প্রকাশ করবে, সেও আল্লাহর কাছে কাফের ও জাহান্নামী সাব্যস্ত হবে

وَمَنْ يَّكْفُرْ بِهٖ مِنَ الْاَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهٗ .

আর ওইসব দলের মধ্যে যে ব্যক্তি একে অস্বীকার করে, জাহান্নামই তার নির্ধারিত স্থান সূরা হূদ (১১) : ১৭

তেমনিভাবে যে ব্যক্তি এই কিতাবের পরে অন্য কোনো কিতাবকে আসমানী কিতাব বা ওহীর কিতাব বলে দাবি করবে, নিঃসন্দেহে সে মিথ্যুক ও ধোঁকাবাজ সে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলকে এবং কুরআন-হাদীসকে মিথ্যা সাব্যস্তকারী যারাই এ ধরনের দাবিকে সত্য মনে করবে অথবা এমন দাবিদারকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করবে, এরা সকলেই বে-দ্বীন এবং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম

ছয়.

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁকে যে শরীয়ত দেওয়া হয়েছে, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত সর্বশেষ শরীয়ত তা গ্রহণ করা ব্যতীত কেউ মুমিন হতে পারবে না যে ব্যক্তি এই শরীয়তের পরে অন্য কোনো শরীয়তকে আসমানী শরীয়ত মনে করবে বা এই শরীয়ত ছেড়ে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন অথবা মতবাদকে হক মনে করবে, সে ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত সাব্যস্ত হবে

সাত.

তাঁর উম্মত আখেরী উম্মত মর্যাদার দিক থেকে এই উম্মত সামগ্রিক বিচারে পূর্বের সকল উম্মত থেকে অগ্রসর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতকে ছেড়ে যে ব্যক্তি কোনো পুরোনো উম্মত বা কোনো নতুন উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবে, তার ঠিকানাও জাহান্নাম

আট.

তাঁর শরীয়ত অন্য সকল শরীয়তের জন্য নাসেখ অর্থাৎ রহিতকারী যদি হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জীবিত থাকতেন, তাহলে এই শরীয়তেরই অনুসরণ করতেন কিয়ামতের পূর্বে যখন ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর হুকুমে জমিনে অবতরণ করবেন, তখন তিনি ইঞ্জিলের শরীয়তের পরিবর্তে এই শরীয়তেরই অনুসরণ করবেন, এই শরীয়তকেই বাস্তবায়ন করবেন এবং এরই দাওয়াত দেবেন

নয়.

আল্লাহ তাআলা তাঁকে কুরআনের মুআল্লিম ও শিক্ষক এবং মুবায়্যিন ও বাখ্যাকারী বানিয়েছেন তাঁর পবিত্র সীরাত ও সুন্নাহকে (الهدي المحمدي) আল্লাহ তাআলা গোটা মানবজাতির জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ তথা উত্তম ও নির্ভুল আদর্শ বানিয়েছেন সেই উসওয়ায়ে হাসানাহ গ্রহণ করাকে ঈমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অনিবার্য করে দিয়েছেন এজন্য যেসকল লোক তাঁর পবিত্র হাদীসকে দ্বীনের দলীল হিসেবে মানে না, হাদীস থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও উসওয়ায়ে হাসানাহ গ্রহণ করে না এবং সেখান থেকে কুরআনের শিক্ষা, কুরআনের আহকাম ও ঈমানী জিন্দেগীর বাস্তবরূপ গ্রহণ করে না তারা ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত

দশ.

ইসলাম, যা আল্লাহ তাআলার নিকট একমাত্র সত্য ধর্ম, যা ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, এর একমাত্র রাস্তা এখন খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনা, তাঁর ওপর অবতীর্ণ কিতাবের ওপর ঈমান আনা, তাঁকে প্রদত্ত শরীয়ত গ্রহণ করা এবং তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্যকে আবশ্যক মনে করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগমনের পরে এ ছাড়া কারো মুসলিম হওয়ার দ্বিতীয় কোনো রাস্তা অবশিষ্ট নেই

এগারো.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের স্বতঃসিদ্ধ ও ঐকমত্যপূর্ণ পথকে আল্লাহ তাআলা ‘সাবীলুল মুমিনীন’ অর্থাৎ মুমিনদের পথ নাম দিয়েছেন এই স্বতঃসিদ্ধ ও ঐকমত্যপূর্ণ পথ থেকে সরে যাওয়াকে আল্লাহ তাআলা রাসূলের সাথে বিরুদ্ধাচরণ করার মতো জাহান্নাম আবশ্যককারী অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন ইরশাদ হয়েছে

وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدٰي وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰي وَنُصْلِهٖ جَهَنَّمَ وَسَآءَتْ مَصِيْرًا.

আর যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব; যা অতি মন্দ ঠিকানা সূরা নিসা (০৪) : ১১৫

আফসোস, আমাদের সমাজে এবং এই দেশে এমন সব দল রয়েছে, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহকে অস্বীকার করে তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুসলমান হওয়ার দাবি করে ওইসকল দলের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অমুসলিম ও প্রতারক দল হল কাদিয়ানী সম্প্রদায় এরা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে (১৮৩৯/১৮৪০-১৯০৮ ঈ.) মুজাদ্দিদ, মাহদী, মাসীহ এবং নবী মানে (অথচ কেউ কাফের হওয়ার জন্য নবুওতের কোনো মিথ্যা দাবিদারকে মুসলমান বা সত্যবাদী মনে করাই যথেষ্ট) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কালিমা ব্যবহার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেয়াদবি করে তাঁর নবুওত ও খতমে নবুওতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলাম ছেড়ে কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করে তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের জন্য ‘মুসলিম’ নাম ব্যবহার করে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে কাদিয়ানী এবং মির্যাঈ হয়ে মুসলমান হওয়ার দাবি করাটা ইহুদী বা ঈসায়ী হয়ে মুসলমান হওয়ার দাবি করার চেয়েও বড় মিথ্যা এবং বড় কুফর

কাদিয়ানী সম্প্রদায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লেখিত সকল বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে এজন্য তাদের কাফের ও অমুসলিম হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কেউ হয়তো বলতে পারে যে, তারা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর বান্দা মানে উত্তর হল, যেই ফযীলত, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের সাথে তিনি আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহ তাআলা যেই মহব্বতের সাথে তাকে নিজের বান্দা বলেছেন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় সেই অর্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর বান্দা মানে না নতুবা তারা তাঁকে মিথ্যা সাব্যস্ত করত না তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত না তাঁর সাথে গোস্তাখি করত না তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহকে অস্বীকার করত না এবং এই সবকিছু করার পর ঈমানের দাবি করে ধোঁকা, প্রতারণা ও মুনাফেকী করত না

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুনাফেকী তো মুনাফেকদের মুনাফেকী থেকেও ভয়াবহ কারণ মুনাফেকরা তো নিজেদের কুফরকে গোপন করে রাখে; কিন্তু নিজেদের কুফরকে ঈমান এবং ইসলাম নাম দেয় না অথচ কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিজেদের সকল কুফরী আকীদা ও দর্শনকে ইসলাম নাম দেয় ওই কুফরী আকীদা ও দর্শন প্রমাণে কুরআন-হাদীস থেকে (আয়াত ও হাদীসের মর্মকে বিকৃত করে) দলীল পেশ করে এজন্য এই দলটি মুনাফেকদের থেকেও ভয়াবহ কাফের পরিভাষায় এমন কাফেরদের নাম মুলহিদ ও যিন্দীক যাদের ইরতেদাদ ও ধর্মদ্রোহিতা সাধারণ মুরতাদদের থেকে বেশি মারাত্মক ও ভয়ানক

هذا، وصلى الله تعالى  وبارك  وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

 

advertisement