মাগুরার শিশু আছিয়া হত্যাকাণ্ড ॥
সমাজব্যবস্থার এ অধঃপতন হল কী করে?
এখন চলছে রহমত ও মাগফিরাতের মাস রমযানুল মুবারক। মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী সিয়াম ও কিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে ও তাকওয়া অর্জনে মশগুল। একটা সময় ছিল রমযানুল মুবারক আসলে মুসলমানদের মধ্যে অন্যায় ও পাপাচারের প্রবণতা ব্যাপক হারে কমে যেত। এমনকি গণমাধ্যমেও ছবি প্রকাশ এবং তথাকথিত বিনোদন জগতের খবরাখবর প্রকাশে সংযম প্রদর্শনের একটা রীতি ছিল। কিন্তু ক’বছর থেকে পুঁজিবাদের ভোগবাদী আগ্রাসন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখন স্বল্প সময়ের সাহরী বা ইফতার অনুষ্ঠান ছাড়া বাকি সময় বোঝার উপায় থাকে না যে, রমযান মাস চলছে! ছাপানো পত্রিকাগুলো এবং অনলাইন পোর্টালগুলোরও একই দশা। অবশ্য এগুলো আজকের আসল বিষয় নয়।
আজকে আমরা যে বিষয় নিয়ে বলতে চাই, সেটি জুলুম ও পৈশাচিকতার দিক থেকে ভিন্নমাত্রার হলেও এমনিতে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কী কারণে এমন পৈশাচিক ঘটনা বেড়ে চলেছে তার দিকে কিন্তু কেউ নজর দিচ্ছে না। যারা সমাজে প্রভাবশালী, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে প্রভাব খাটায়, যাদের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসে, সেই গোষ্ঠীগুলো আসলে শুধুই লোক দেখানো হাউকাউ করে দু-চার দিন। এই যে আমরা লোকদেখানো বলছি, সেটার জন্য বাড়তি প্রমাণের দরকার নেই। আপনি দেখবেন, কোনো একটি মর্মান্তিক খবর তারা প্রকাশ করছে, সাথেই হয়তো তাদের বিনোদন বাণিজ্যের একটি খবর সুুড়সুড়ি ছবিসহ দিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ ওই ঘটনার খবর প্রকাশ করলেও সেটি যে মানুষকে নাড়া দেবে, এটার কোনো সুযোগও তারা রাখছে না। এমনই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন বর্তমান বিশ্ব এবং মুসলিম বিশ্বও বটে।
আসলে মূল বিষয়ে ঢুকতে গিয়েও বিলম্ব হচ্ছে। কথা বলতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। এমন ঘটনাও বর্তমানে ঘটিয়ে ফেলা হচ্ছে, যা মুখে উচ্চারণ করাও কঠিন। লিখতে গিয়ে কলম চলতে চায় না। এমন নারকীয় পাশবিক কাণ্ডও কোনো মানুষ ঘটাতে পারে? নিষ্পাপ শিশু আছিয়াকে পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে ওই হত্যাকারীর হৃদয়ে কি সামান্য দয়াও আসেনি? আমরা নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের কথা পড়তে গিয়ে আল্লাহ তাআলার কালামে দেখি, তিনি বলেছেন–
اُولٰٓئِکَ کَالْاَنْعَامِ بَلْ هُمْ اَضَلُّ.
তারা পশুর মতো; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। –সূরা আ‘রাফ (০৭) : ১৭৯
মানুষও যে পশু, এমনকি নিকৃষ্ট পশুকেও হার মানিয়ে তার চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যায়– এসব তো তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। শিশু আছিয়া হত্যাকাণ্ড প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে কঠিনভাবে। বিক্ষুব্ধ মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কি হবে? সেই নির্যাতনকারী জালিমরা কি ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবে?
এদেশের বিচারব্যবস্থার যে হাল এবং সমাজব্যবস্থার যে একপেশে অবস্থা– তা দেখে কম মানুষই আশাবাদী হবে। এদেশে তো পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কম ঘটেনি! বিগত ফ্যাসিবাদী হাসিনার দলের নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের (ছাত্রলীগ) একজন তো এই কুকর্মে সেঞ্চুরি করেছে বলেও পত্রিকায় খবর এসেছিল। তার কি কোনো বিচার হয়েছিল? এছাড়া অহরহ চারদিকের এ ধরনের ঘটে যাওয়া জঘন্য কাণ্ডগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কয়টি বাস্তবায়িত হয়েছে এ পর্যন্ত। যেসব বিবেকবান মানুষ সমাজ নিয়ে ভাবেন, তারা জানেন যে, অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা। বিচারহীনতা ও বিচারকার্যে অস্বাভাবিক বিলম্ব অপরাধীদের উৎসাহিত করে থাকে। তারা হয়ে ওঠে লাগামহীন। এক অপরাধীর বিচার না হলে দশ অপরাধী তৈরি হয়। একজন হত্যাকারী বিচার থেকে বেঁচে গেলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অসংখ্য হত্যাকারী।
এদেশে যে সনাতনী বিচারব্যবস্থা বিদ্যমান, তাতে একে তো দরিদ্র লোকদের জন্য কোর্টকাচারির খরচাদি জোগান দেওয়াই কঠিন, অন্যদিকে অযথা বছরের পর বছর এক আদালত থেকে আরেক আদালত, সে আদালত থেকে অন্য আদালতে মামলাগুলো ঝুলে থাকার কারণে একসময় চূড়ান্ত রায় এলেও তার কোনো ভালো প্রভাব সমাজে পড়ে না। এবং ঘটনার পরে মানুষের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনার কারণে বিচারপ্রক্রিয়ায় কিছু দ্রুত তৎপরতা দেখানো হলেও কদিনের মধ্যেই মিডিয়া আরও বহু ইস্যু নিয়ে চলে আসে। মানুষ ভুলে যায় পুরোনো কথা। সে জঘন্য ঘটনাগুলো চলে যায় আড়ালে। এরপর একসময় হয়তো আইনের ফাঁকফোকরে অথবা প্রভাব খাটিয়ে আসামিরা জামিনও পেয়ে যায়; বরং এর চেয়ে জঘন্য ঘটনা ঘটে।
এই কদিন আগেও পত্রিকায় দেখলাম, বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার একজন আসামি হাজত থেকে পালিয়েছে। তো আবরার ফাহাদ হত্যার পর কি দেশে কম আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল? আলকাউসারেও এ বিষয়ে লেখা হয়েছিল (‘আবরার ফাহাদ হত্যা ও ভোলায় রক্তপাত কী বার্তা দেয়’, নভেম্বর ২০১৯)। এমন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড– সত্যিকার অর্থে শুধু ওই ঘটনার কারণেই হাসিনা ও আওয়ামীলীগের পতন হওয়া উচিত ছিল। এখন তো আর তারা ক্ষমতায় নেই। কিন্তু আবরার ফাহাদের হত্যাকারীরা ফাঁসির কাষ্ঠে তো ঝোলেইনি, বরং কেউ কেউ পালিয়েও গেছে।
ইতিমধ্যে অবশ্য ঐ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে। কিন্তু চলমান বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার ধাপগুলো পার হয়ে কবে নাগাদ তা বাস্তবায়িত হবে– কে জানে?
যাইহোক, মাসুম শিশু আছিয়ার কথা বলতে গিয়ে আমরা বারবার এদিক সেদিক চলে যাচ্ছি। আসলে তার হত্যার ঘটনার বর্ণনা দেওয়াটা জটিল। কিন্তু সে তো চলে গেছে, এটাই বাস্তবতা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তার চলে যাওয়া আমাদেরকে কোনো শিক্ষা কি দিয়ে যেতে পেরেছে? তার করুণ মৃত্যু এই সমাজকে কী পরিবর্তন করবে? সংস্কার হবে কি এদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার?
এখন যদি বলা হয়, এ ধরনের নির্যাতনের জন্য ইসলামের কালজয়ী বিধান কার্যকর করা হোক, তাহলে তো অনেকেই চেঁচিয়ে উঠবেন। বিশেষত কায়েমী স্বার্থবাদী ভোগবাদী গোষ্ঠী। যারা গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা তখন আছিয়া এবং তার মতো মজলুমদের কথা ভুলে গিয়ে মজলুম বানিয়ে ফেলবে তাদের ওপর নির্যাতনকারী ও হত্যাকারীদের! আজকে যদি দেশবাসীর মনের আশা অনুযায়ী আছিয়া বেঁচে যেত, তবুও তো ইসলামের ফৌজদারি বিধি-বিধান থাকলে তার ওপর নির্যাতনকারী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত। ইসলামে কোনো বিবাহিত মানুষ এ ধরনের জঘন্য অপরাধে জড়িত হলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার বিধান রয়েছে। কোনো ঝুঁকি না নিয়েও চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যেতে পারে, দু-চারটি পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় যদি নির্যাতনকারীদেরকে স্টেডিয়াম বা বড় কোনো জায়গায় মানুষ জড়ো করে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়, তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই এই ধরনের অপরাধ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে।
কিন্তু কে শুনবে এসব কথা! এখন যারা সরকারে আছে, তারা তো কোনো দলের নন, তারাও শুনবেন? মনে তো হয় না। কারণ তাঁরা সংস্কার শব্দ উচ্চারণ করতে করতেই দিনাতিপাত করছেন। মাসকে মাস পার হয়ে যাচ্ছে, এখনো কোনো সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। বুঝলাম, সংবিধান সংস্কার বা এজাতীয় কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন; কিন্তু অনেক কিছুর মতো বিচারব্যবস্থার সংস্কার কাজ তো অর্ডিনেন্সের মাধ্যমেও করে ফেলা সম্ভব। তা কি করা হয়েছে? হয়নি। কারণ স্পষ্ট– আমরা গতানুগতিকতা থেকে বের হতে পারছি না। যেই লাউ সেই কদুই থেকে যাচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে অনেক কিছু। কার্যক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুফল সামনে আসছে না।
কথা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, হত্যা, ব্যাভিচার, পাশবিক নির্যাতন, প্রকাশ্যে সন্ত্রাস ছিনতাই এবং যে ধরনের জঘন্য অপরাধগুলোর বিচার হওয়া দরকার দ্রুততম সময়ে, যা বিচারিক আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ত্রিশ কার্যদিবসের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং রায়ের পরেই তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
বিগত সময়ে দেখা গেছে, জঘন্য অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দণ্ডের রায় কার্যকর না হওয়ায় পরবর্তীতে তাদের আজ্ঞাবহ সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ক্ষমা করিয়ে তাদেরকে খালাস করিয়ে দিয়েছে। এ যদি হয় কোনো দেশের বিচারব্যবস্থার দশা, তাহলে সে দেশে অপরাধীরা ভয় পাবে কেন? সুতরাং ভবিষ্যতে এ ধরনের নারকীয় কাণ্ড না দেখতে চাইলে অবশ্যই আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মপ্রাণ একদল বিচারক বসিয়ে এ ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের পক্ষে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। যেসকল লোভী ও নীতিহীন উকিল-ব্যারিস্টার অপরাধীদের পক্ষে আদালতে দাঁড়ায়, তাদেরকে সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। না হয় শুধুই কয়েকদিনের আহাজারি ও চেঁচামেচি, এরপর সবকিছু আবার আগের মতোই। এভাবেই চলতে থাকবে।
মাসিক আলকাউসারের মাধ্যমে এ ধরনের কথা আগেও আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। পুরান ঢাকার আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড এবং এধরনের আরও অন্য বিষয় নিয়ে আলকাউসারে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দ পড়ে নিতে পারেন।
দ্বিতীয় যে কথাটি আমরা আরজ করতে চাই, তার দিকে আমরা নিবন্ধের শুরুতেই ইঙ্গিত দিয়েছি। তা হচ্ছে, আমাদের পচন ধরা সমাজব্যবস্থা। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী এবং তাদের এদেশীয় এজেন্টরা পুরো সমাজকে যেভাবে ভোগবাদী ও জাগতিক করে তুলেছে, যেভাবে বেহায়াপনার সয়লাব করে দেওয়া হচ্ছে, মানুষের হাতে হাতে বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগের নামে যত সব আবর্জনাপূর্ণ উপাদান তুলে দেওয়া হয়েছে, নাগরিকদের স্রষ্টাবিমুখ করার এবং প্রবৃত্তির মোহে আচ্ছন্ন করে রাখার যতসব আয়োজন তারা করে রেখেছে– এত কিছুর পর একটি সমাজ ভালো থাকবে কী করে! পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও কি কেউ ভাবত, বাংলাদেশের মতো একটি জায়গায়, পবিত্র রমযান মাসে এমন একটি ঘটনা ঘটবে। তখনো কি কেউ চিন্তা করেছে, রেডিও-টেলিভিশন-পেপার-পত্রিকাগুলো এত বাজে জিনিসে ভরে যাবে? এছাড়া ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক নামে যত জঞ্জাল আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর কুপ্রভাবের কথা তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছে? আগে অন্তত বয়স বেড়ে আসার পর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ধার্মিক হয়ে উঠতেন, আল্লাহমুখী হয়ে উঠতেন, অবসর সময় ধর্মকর্মে ও জনহিতৈষী কাজে ব্যয় করতেন। আর এখন? এখন তাদের অনেকেই ব্যস্ত থাকেন ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক নিয়ে। তো এসবের মধ্যে থেকে কি আমাদের সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে? এখন যে আমরা কেউ কেউ আহাজারি করছি, সমাজটা কেন এত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে গেল? কেন আমরা এত নীচু হয়ে গেলাম? তার জবাবের জন্য তো অনেক গভীরে যাওয়ার দরকার নেই। সমাজে তো ঘুনে ধরেছে অনেক আগেই এবং এর কুপ্রভাব আমরা সকল স্তরেই দেখতে পাচ্ছি।
মানুষের প্রবৃত্তি তো এমনই। সেটি যদি একবার অনৈতিকতা ও পাপমুখী হয়ে ওঠে এবং এর লাগাম টেনে না ধরা হয়, তাহলে সেটি তো নিয়ন্ত্রণহীন হবেই। হাদীসের ভাষা অনুযায়ী–
إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُه، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَه.
বান্দা যখন পাপ করে তখন তার কলবে ছোট একটি কালো দাগ পড়ে যায়। তারপর যদি সে তওবা করে নেয় তখন তা মুছে যায়। কিন্তু যদি সে তওবা না করে পাপ চালিয়ে যেতে থাকে, তখন সেটি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে কলবকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৩৪
তো বর্তমানে পাপীদের তো তওবার সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। যেভাবে বেহায়াপনার সয়লাব ব্যাপক হচ্ছে, পাপকাজে যেভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং যত কুরুচিকর উপাদান মানুষের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে; এরপর কতজন লোক নিজ নফসের সাথে লড়াই করে ভালো থাকতে পারবে?
শুধু কি হত্যা, গুম, পাশবিক নির্যাতন? সুদ, ঘুস, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মুনাফাখোরী, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, মালিক কর্তৃক শ্রমজীবীদের ঠকানো, আবার সুযোগ পেলেই শ্রমজীবীরা কাজে গাফলতি ও ফাঁকি দেওয়া– এ সবই তো একই সূত্রে গাঁথা। এই যে আমরা অফিস আদালতে গিয়ে সেবাদাতা কর্তৃক হেনস্থার শিকার হলেই মন খারাপ করি, কেনাকাটা করতে গিয়ে ভেজাল পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরলে অথবা দরদামে ঠকে গেলে রেগে যাই– এসবেরই বা প্রতিকার কী? সত্যিকারের সমাজচিন্তকরা দ্বিমত করবেন না যে, এ সবই হচ্ছে নৈতিক পদস্খলনের কারণে। আর প্রতিকার হল মানুষের নীতি-নৈতিকতার উন্নতি ঘটানো। যা একমাত্র সৃষ্টিকে স্রষ্টার বিধি-বিধানের অনুগত করার মাধ্যমেই সম্ভব। গণমানুষকে যদি আল্লাহর দ্বীন শিখিয়ে আল্লাহমুখী করা যায়, আমাদের কচিকাঁচা শিশু এবং সর্বস্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের যদি আমরা ইসলামের উন্নত চরিত্র গঠনমূলক সর্বশ্রেষ্ঠ ও কার্যকর শিক্ষাগুলো দিয়ে গড়ে তুলতে পারি, তবেই কেবল সামনের দিনগুলোতে ভালোর প্রত্যাশা করা সম্ভব। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এমন একটি দেশ এমন একটি সমাজ রেখে যেতে হলে এখনই উদ্যোগী হতে হবে– আলেম-উলামা, ইমাম, খতীব, দায়ী, সত্যিকারের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং দেশের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে এমন জ্ঞানী-গুণী মানুষদের।
যে শিশু আছিয়াকে উৎসর্গ করে এ লেখা তার নামটিও কিন্তু অসাধারণ। বহু বহু বছর পূর্বে এ নামেরই একজন মহিয়সী নারী সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সহ্য করেছিলেন তখনকার জালেমদের কঠিন জুলুম ও নির্যাতন। পবিত্র কুরআনের সূরা তাহরীমে সে বর্ণনা এসেছে। সে যুগের মিশরীয় জালেম সম্রাট ফেরাউনের স্ত্রীর কথা আল্লাহ তাআলা কী সুন্দরভাবেই না বলেছেন। আমাদের রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, নারীদের মধ্যে যারা অসাধারণ পরিপূর্ণতা পেয়েছেন তাদের একজন হচ্ছে ফেরাউন-পত্নী আছিয়া। সে আছিয়ার কথাই সূরা তাহরীমের শেষে এভাবে এসেছে–
وَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا امْرَاَتَ فِرْعَوْنَ اِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِیْ عِنْدَكَ بَیْتًا فِی الْجَنَّةِ وَ نَجِّنِیْ مِنْ فِرْعَوْنَ وَ عَمَلِهٖ وَ نَجِّنِیْ مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَ.
আর আল্লাহ মুমিনদের জন্য পেশ করছেন ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত; যখন সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কর্ম থেকে মুক্তি দিন। আর আমাকে নাজাত দিন জালেম সম্প্রদায় থেকে। –সূরা তাহরীম (৬৬) : ১১
তো কাকতালীয়ভাবেই মাগুরায় জালেমদের পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া শিশুটির নামও আছিয়া।
শিশু আছিয়ার আত্মদান যদি আমাদেরকে সে পথে নিয়ে যায়, তবে সেটি বিফলে যাবে না। না হয় আমরা ঘুরেফিরে সেই অপরাধ বৃত্তেই বিচরণ করতে থাকব। আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন।
সবশেষে কামনা করি, শিশু আছিয়ার নির্যাতন ও হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। আছিয়ার মা-বাবা-স্বজনদের আল্লাহ উত্তম ধৈর্যধারণের তাওফীক দিন।
আল্লাহ তাআলা এ দেশ এবং এদেশের মানুষকে রক্ষা করুন। আমরা বংশপরম্পরায় মুসলমান। নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করি। নিজেদের নাম, বিবাহশাদী এবং মৃত্যু-পরবর্তী কাফন-দাফনও ইসলামী তরিকায় হয়। যদি আমাদের জীবন, আমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও একইভাবে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়িত হয়, তবেই আমরা আশা করতে পারব– একটি সুন্দর বাংলাদেশ।