বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী যারা
মাওলানা ফয়জুল্লাহ মুনির
সাহাবীদের মহান জামাতের মধ্যে পরম সৌভাগ্যবান এমন কয়েকজন সাহাবী ছিলেন, যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন সময় এমন ভাব ও অভিমত ঢেলে দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে কুরআনে যেরকম আয়াত নাযিল হয়েছে। এটাও আল্লাহ তাআলার তাওফীক যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তরে এমন কথা ঢেলে দেন, যা স্বয়ং আল্লাহ তাআলার কথা, কুরআন ও সুন্নাহর কথা।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা.
আল্লাহ তাআলা কুরআনে আয়াত নাযিল করার আগেই তার সঙ্গে সাযুজ্য চিন্তা-ভাবনা যাদের মনে সঞ্চার করেছিলেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কুরআনের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি ও ভালবাসা। কুরআনের ঐশ্বরিক আকর্ষণেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। উমর রা. ছিলেন প্রকৃত কুরআনপ্রেমী। তিনি কুরআন কারীমের অনেক বড় বড় খেদমত করেছেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর রা. সম্পর্কে বলেছিলেন–
إِنَّ اللهَ وَضَعَ الْحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ يَقُولُ بِه.
আল্লাহ তাআলা উমরের যবানে সত্য ঢেলে দেন, সে তাই বলে। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৯৬২
কুরআনের প্রতি উমর রা.-এর সীমাহীন মহব্বত ও ভালবাসার বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরে এমন সব কথা ঢেলে দিতেন, যেটা স্বয়ং কুরআনের কথা। আল্লাহর মর্জি ও সন্তুষ্টির কথা। ফলে পরবর্তীতে সে বার্তা নিয়েই কিছু আয়াত নাযিল হয়েছে।
উমর রা. নিজেই তাঁর সেই সৌভাগ্য হাসিলের বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা এখানে তাঁর সেই বর্ণনা হুবহু তুলে ধরছি। উমর রা. বলেছেন–
وَافَقْتُ رَبِّي فِي ثَلَاثٍ: فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَوِ اتَّخَذْنَا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلّى؛ فَنَزَلَتْ: {وَ اتَّخِذُوْا مِنْ مَّقَامِ اِبْرٰهٖمَ مُصَلًّی}، وَآيَةُ الْحِجَابِ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَوْ أَمَرْتَ نِسَاءَكَ أَنْ يَحْتَجِبْنَ فَإِنَّه يُكَلِّمُهُنَّ الْبَرُّ وَالْفَاجِرُ؛ فَنَزَلَتْ آيَةُ الْحِجَابِ، وَاجْتَمَعَ نِسَاءُ النَّبِيِّ ‘ فِي الْغَيْرَةِ عَلَيْهِ، فَقُلْتُ لَهُنَّ: عَسَى رَبُّهُ إِن طَلَّقَكُنَّ أَن يُبَدِّلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنكُنَّ؛ فَنَزَلَتْ هَذِهِ الْآيَةُ.
তিনটি বিষয়ে আমার অভিমত আমার রবের ওহীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা যদি ‘মাকামে ইবরাহীম’কে নামাযের স্থান বানাতে পারতাম। তখন এই আয়াত নাযিল হয়–
وَ اتَّخِذُوْا مِنْ مَّقَامِ اِبْرٰهٖمَ مُصَلًّی.
তোমরা ‘মাকামে ইবরাহীম’কে নামাযের স্থান বানাও। –সূরা বাকারা (০২) : ১২৫
(দ্বিতীয় হল,) পর্দার আয়াত। আমি বলেছিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যদি আপনার স্ত্রীদেরকে পর্দার আদেশ করতেন। কারণ, ভালো-মন্দ সবাই তাদের সাথে কথা বলে। তখন পর্দার আয়াত নাযিল হয়। (তৃতীয়) আরেকবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ নবীজীর ওপর অভিমানবশত পরস্পর একতাবদ্ধ হয়েছিল। তখন আমি তাদেরকে বলেছিলাম, রাসূল যদি তোমাদেরকে তালাক দেন, তবে আল্লাহ তাআলা তোমাদের পরিবর্তে রাসূলকে তোমাদের চেয়েও উত্তম স্ত্রী দান করবেন। পরবর্তীতে সে কথাই আয়াত হিসেবে নাযিল হয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০২
আরেক বর্ণনায় উমর রা. বদর যুদ্ধবন্দিদের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি ছিল এরকম, বদর যুদ্ধে আল্লাহ তাআলার সাহায্যে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে। কাফেররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তাদের সত্তর জন লোক মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। এ বন্দিদের ব্যাপারে কী ফয়সালা হবে– সে বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। আবু বকর রা. বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে তাদের থেকে মুক্তিপণ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। অপরদিকে উমর রা. কাফেরদেরকে হত্যা করে ফেলার অভিমত ব্যক্ত করলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা.-এর পরামর্শ অনুযায়ী ফয়সালা করলেন। পরবর্তীতে উমর রা.-এর মতামতকে সমর্থন করে কুরআন কারীমে আয়াত নাযিল হল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করলেন–
مَا كَانَ لِنَبِیٍّ اَنْ یَّكُوْنَ لَهٗۤ اَسْرٰی حَتّٰی یُثْخِنَ فِی الْاَرْضِ، تُرِیْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْیَا وَ اللهُ یُرِیْدُ الْاٰخِرَةَ وَ اللهُ عَزِیْزٌ حَكِیْمٌ، لَوْ لَا كِتٰبٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِیْمَاۤ اَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِیْمٌ، فَكُلُوْا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلٰلًا طَیِّبًا وَّ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
ভূপৃষ্ঠে ব্যাপকভাবে শত্রুনিধন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নবীর জন্য শত্রুদের বন্দি হিসেবে রেখে দেওয়া সমীচীন নয়। তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি প্রজ্ঞাবান। আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তার জন্য তোমাদের ওপর মহা শাস্তি আপতিত হত। অতএব এখন তোমরা যা গনীমত লাভ করেছ, তা বৈধ এবং কল্যাণকর হিসেবে গ্রহণ করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। –সূরা আনফাল (০৮) : ৬৭-৬৯ (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৬৩)
আরেকবারের ঘটনা। সেই ঘটনার বিবরণও উমর ইবনুল খাত্তাব রা. নিজেই শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, (মুনাফিক সর্দার) আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল যখন মারা যায়, তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানাযার নামাযের জন্য ডাকা হল। রাসূল জানাযার জন্য উঠে দাঁড়ালে আমি দ্রুত গিয়ে রাসূলকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি ইবনে উবাইয়ের জানাযা পড়বেন, অথচ সে অমুক অমুক দিন এটা এটা বলেছে? আমি রাসূলকে তার উক্তিগুলো একে একে শোনাতে লাগলাম। রাসূল মুচকি হেসে বললেন, উমর, সরে যাও। কিন্তু আমি বারবার আপত্তি করতে থাকলে রাসূল একপর্যায়ে বললেন, আমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি তা গ্রহণ করেছি। আমি যদি জানতাম যে, সত্তরবারের অধিক ইস্তিগফার করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন, তবে আমি তাই করতাম। এরপর রাসূল তার জানাযার নামায আদায় করে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সূরা বারাআর দুটি আয়াত নাযিল হল–
وَ لَا تُصَلِّ عَلٰۤی اَحَدٍ مِّنْهُمْ مَّاتَ اَبَدًا وَّ لَا تَقُمْ عَلٰی قَبْرِهٖ اِنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ مَاتُوْا وَ هُمْ فٰسِقُوْنَ.
মুনাফিকদের কেউ মারা গেলে তুমি কখনোই তাদের জানাযার নামায আদায় করবে না। তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং পাপিষ্ঠ অবস্থায় মারা গেছে। –সূরা তাওবা (০৯) : ৮৪
উমর রা. বলেন, পরবর্তীতে আমি রাসূলের সামনে আমার সেদিনকার দুঃসাহসিক আচরণের জন্য নিজের প্রতি আশ্চর্যবোধ করছিলাম। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই সবচেয়ে ভালো জানেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৬৬
এছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রসঙ্গে উমর রা.-এর চিন্তা ও বক্তব্যের সাথে কুরআনের আয়াত মিলে গিয়েছিল। এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর রা. সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন–
إِنَّهُ قَدْ كَانَ فِيْمَا مَضَى قَبْلَكُمْ مِنَ الْأُمَمِ مُحَدَّثُوْنَ، وَإِنَّه إِنْ كَانَ فِيْ أُمَّتِيْ هَذِهِ مِنْهُمْ، فَإِنَّهُ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ.
তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মাঝে ইল্হামপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। আমার এই উম্মতের মধ্যে যদি কেউ থাকে, তবে সে উমর ইবনুল খাত্তাব। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬৯
আবু আইয়ূব আনসারী রা.
উমর রা.-এর মতো এরকম বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী আরেকজন সাহাবী ছিলেন আবু আইয়ূব আনসারী রা.। প্রসিদ্ধ এই আনসারী সাহাবীর বক্তব্য অনুসারেও আয়াত নাযিল হয়েছিল। ঘটনাটি ছিল এরকম– কোনো এক যুদ্ধের সফর থেকে ফেরার পর মুনাফিকরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নামে দুর্নাম রটিয়ে দেয়। ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘ইফকের ঘটনা’ নামে প্রসিদ্ধ। সে সময় অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। কোনো কোনো দুর্বল ঈমানের মুসলমান পদস্খলনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কঠিন মুহূর্তে আবু আইয়ূব আনসারী রা.-এর মতো মজবুত ঈমানের অধিকারী অন্যান্য সাহাবীরা এতটুকুও টলে যাননি। তারা দুর্নাম রটনাকারীদের কথায় কান না দিয়ে আয়েশা রা.-এর পূতপবিত্রতার বিশ্বাসে অটল ছিলেন। আবু আইয়ূব আনসারী রা.-কে যখন তাঁর স্ত্রী দুর্নাম রটনাকারীদের কথা শোনালেন, তখন তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন, হে আল্লাহ, তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। এ বিষয়ে আমাদের কথা বলার কোনো অধিকার নেই। আল্লাহ পবিত্র ও মহান। এ তো এক গুরুতর অপবাদ।
পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে আয়াত নাযিল করলেন–
وَ لَوْ لَاۤ اِذْ سَمِعْتُمُوْهُ قُلْتُمْ مَّا یَكُوْنُ لَنَاۤ اَنْ نَّتَكَلَّمَ بِهٰذَا سُبْحٰنَكَ هٰذَا بُهْتَانٌ عَظِیْمٌ.
তোমরা যখন এই রটনার কথা শুনছিলে তখন কেন বললে না, এ বিষয়ে কথা বলার আমাদের কোনো অধিকার নেই। (হে আল্লাহ,) তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। এ তো এক গুরুতর অপবাদ। –সূরা নূর (২৪) : ১৬ (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩৭০; মুস্তাখরাজে আবি আওয়ানা, হাদীস ১২১৫৭; ফাতহুল বারী ১৩/৩৪৪)
এক নারী সাহাবী
একজন নারী সাহাবীর ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। উহুদ যুদ্ধের সময়ের ঘটনা। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুফাস্সির ইকরিমা রাহ. বলেন, (উহুদ যুদ্ধের সময়) নারী সাহাবীদের নিকট খবর পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল। ফলে তারা সংবাদ নেওয়ার জন্য বের হলেন। তখন বাহনজন্তুর ওপর দুজন সাহাবীকে নিহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। এক আনসারী নারী জিজ্ঞেস করলেন, এরা দুজন কারা?
লোকেরা বলল, অমুক অমুক। তারা সেই নারীর স্বামী এবং তার ভাই বা ছেলের কথা বলল।
আনসারী নারী জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী অবস্থায় আছেন?
লোকেরা বলল, তিনি জীবিত আছেন। আনসারী নারী তখন বললেন, তবে আমি আর কোনো কিছুর পরোয়া করি না। আল্লাহ তাআলা তো তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কতককে শহীদরূপে গ্রহণ করবেনই।
পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা এই নারী সাহাবীর বক্তব্য অনুসারে আয়াত নাযিল করেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন–
اِنْ یَّمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهٗ وَ تِلْكَ الْاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیْنَ النَّاسِ وَ لِیَعْلَمَ اللهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ یَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَآءَ وَ اللهُ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَ.
যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও লেগেছিল। মানুষের মাঝে আমি সেই দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই। আর এই উদ্দেশ্যে, যেন আল্লাহ ঈমানদারদের চিনে নিতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কতককে শহীদরূপে গ্রহণ করেন। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না। –সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৪০ (দ্র. তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম ৩/৭৭৪; আল‘উজাব ফী বায়ানিল আসবাব ২/৭৬০)