রমযানের শেষ প্রহরে ...
রমযানের একেবারে শেষ প্রহরে এসে আমরা অনেকেই আফসোস করে বলি– হায়, রমযান চলে গেল, কিছুই করতে পারলাম না; এই তো আর কয়েক ঘণ্টা বাকি, জানি না, মাগফিরাতের নিআমত লাভ করতে পারলাম কি না। এসময় আমাদের বিশেষভাবে নবীজীর এ হাদীস মনে পড়ে; জাবের রা. থেকে বর্ণিত–
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ، فَلَمّا رَقَى الدّرَجَةَ الْأُولَى قَالَ: آمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّانِيَةَ فَقَالَ: آمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّالِثَةَ فَقَالَ: آمِينَ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، سَمِعْنَاكَ تَقُولُ: آمِينَ ثَلَاثَ مَرّاتٍ؟
قَالَ: لَمّا رَقِيتُ الدّرَجَةَ الْأُولَى جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَه، فَقُلْتُ: آمِينَ...
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! আপনাকে (এভাবে) তিনবার আমীন বলতে শুনলাম? (এর কারণ কী?)
তখন নবীজী বললেন, আমি যখন মিম্বরের প্রথম ধাপে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান মাস পেল এবং রমযান গত হয়ে গেল, কিন্তু তার গুনাহ মাফ হল না। আমি বললাম, আমীন।... –আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৫১
নবীজী তো কখনো আমাদের অকল্যাণ চাইবেন না; এর মাধ্যমে তিনি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন; তিনি চেয়েছেন– মাগফিরাত ও ক্ষমা লাভের এমন অবারিত সুযোগকে যেন আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করি। তাই আসুন, শেষ প্রহরের আফসোস নয়, রমযানের শুরুতেই পরিকল্পনা গ্রহণ করি। রমযানের গুরুত্ব অনুধাবন করে একে যথাযথ কাজে লাগাই।
রমযানের প্রথম রজনীতেই তো জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। নেকীর এমন অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে আমাদেরকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের দিকে আহ্বান করা হয়; আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষক ঘোষণা করে–
يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ.
ওহে কল্যাণ-অন্বেষী! নেকীর পথে তুমি আরো অগ্রসর হও। ওহে অকল্যাণের পথিক! তুমি নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪২
রমযানে কেবল ক্ষমা ও মাগফিরাতের ঘোষণা– রোযা রাখো, পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেব। তারাবী-তাহাজ্জুদ আদায় কর, ক্ষমা লাভে ধন্য হও। লাইলাতুল কদরে ইবাদত কর, মাগফিরাতের সাগরে অবগাহন কর।
ক্ষমা লাভের এমন সুযোগ যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়। এজন্য সতর্ক হব রমযানের শুরুতেই।
রমযান কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হল কুরআন। রমযানে কুরআনের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে– আগে থেকেই রুটিন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করি। পাছে শেষ বেলায় যেন আফসোস করতে না হয়, রমযানে তো যথাযথ কুরআন তিলাওয়াত করতে পারলাম না। যৎসামান্য তিলাওয়াতের ইচ্ছা করেছিলাম, তাও পুরা করতে পারিনি। পুরো রমযানে ইচ্ছা ছিল এক খতম বা দুই খতম বা... তিলাওয়াত করব; কিন্তু অবহেলা-উদাসীনতায় এক খতমও পুরা করতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল, সংক্ষিপ্ত তাফসীরসহ পাঁচ পারা কুরআনের তরজমা পড়ব; কিন্তু এক পারাও শেষ করতে পারিনি। নিয়মিত তারাবীতে তিলাওয়াত শোনা, তাহাজ্জুদে সাধ্যমতো নিজে তিলাওয়াত করা– সবক্ষেত্রেই ছিলাম অলস-উদাসীন। অথচ আমি নবীজীর এই হাদীস শুনেছি–
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ، مَنَعْتُهُ الطّعَامَ وَالشّهَوَاتِ بِالنّهَارِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النّوْمَ بِاللّيْلِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، قَالَ: فَيُشَفّعَانِ.
কিয়ামতের দিন রোযা ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! দিবসে আমি তাকে পানাহার ও (বৈধ) জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, রাতে আমি তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬২৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫০৮১
শেষ দশক যেন হেলায় না কাটে; শবে কদরের কদর করি। আল্লাহ বান্দার জন্য এত বিশাল পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআনে একটি সূরা নাযিল করে এ রাতের মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছেন– একটি রাতের ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাসের চেয়েও বেশি দেব বান্দা! এর পরও যদি আমি অবহেলা-উদাসীনতায় এ ফযীলত থেকে মাহরূম হই, তাহলে রমযানের শেষ প্রহরের আফসোস তো আমারই জন্য। এ মাহরূমীকে নবীজী কেমন হৃদয়স্পর্ষী ভাষায় ব্যক্ত করেছেন লক্ষ করুন–
আনাস রা. বলেন, রমযান এলে নবীজী বলতেন–
إِنّ هূذَا الشّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلّه، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلّا مَحْرُومٌ.
এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হল, সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২১০৬
এই রাতের ফযীলত লাভের জন্য নবীজী যারপরনাই মুজাহাদা-পরিশ্রম করতেন। শুধু নিজে নয়, পরিবারকেও এ মহান ফযীলতে শামিল করার চেষ্টা করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন–
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ، أَحْيَا اللَّيْلَ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهٗ، وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ.
রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২৪
রমযান শেষে আমাদের ভাবা উচিত, রমযানে সারা বছরের জন্য, বরং সারা জীবনের জন্য মহা এক পাথেয় অর্জন করার কথা ছিল আমার; তা কি অর্জিত হয়েছে? এ পাথেয়র কথা স্বয়ং আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যে আয়াতে রোযা ফরয হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, সেই আয়াতেই একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে–
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.
হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৩
রমযানের শেষ দিনগুলোতে আমার কর্ম ও আচরণ বলে দেয়– এ মহান পাথেয় আমার কতটুকু হাসিল হল। রমযান-পরবর্তী আমার আমলের স্পৃহা, গুনাহ থেকে বাঁচার প্রচেষ্টাই বলে দেবে আমার রোযা আমার জন্য তাকওয়ার মাধ্যম হয়েছে কি না।
যদি ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই; আবার নতুন সংকল্পে আগামীর পথচলা শুরু করি। তাকওয়ার পাথেয় আরো মজবুতভাবে ধারণ করি।
শেষ প্রহরের আফসোস থেকে বাঁচার জন্য আরেকটি বিষয়েও সবিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। তা হল, আমরা অনেকে সারা মাস রমযানের আমলগুলো আদায় করার পর শেষ দশকে এসে –যখন নবীজী কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন– ঈদের আয়োজনকে কেন্দ্র করে আমলে অবহেলা করি। এমনকি শপিংয়ের বাহানায় নামায কাযা, তারাবী না পড়া, বেপর্দাসহ রোযার ফযীলত-বরকত বরবাদকারী বিষয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ি। বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবি এবং এ থেকে বাঁচতে পরিকল্পনা গ্রহণ করি। চেষ্টা করি শেষ দশকের আগেই সব সেরে ফেলতে; এবং তা অবশ্যই তারাবী বাদ দিয়ে নয়; দিনের বেলা একটু একটু করে সেরে ফেলি। অগত্যা শেষ দশকে ঈদের কেনাকাটা করতে হলেও আমল-ইবাদতে প্রভাব না পড়ে– এভাবে একটু একটু করে দিনের বেলা কেনাকাটা সেরে ফেলি; রাতে আমলে মগ্ন থাকি। সারা মাসে কষ্ট করে গড়া নেক আমলের প্রাসাদে মাস শেষে নিজ হাতেই আগুন না লাগাই। কুরআনে বর্ণিত ঐ নির্বোধ নারীর কথা স্মরণ করি; যার মতো হতে আল্লাহ আমাদের নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে–
وَ لَا تَكُوْنُوْا كَالَّتِیْ نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْۢ بَعْدِ قُوَّةٍ اَنْكَاثًا.
যে নারী তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে তা রোয়া-রোয়া করে ফেলেছিল, তোমরা তার মতো হয়ো না। –সূরা নাহ্ল (১৬) : ৯২
রমযানের শেষ প্রহরে আরো যে বিষয় আমাদের চিন্তিত করে, তা হল– আল্লাহ আমার রোযা-তিলাওয়াত-তারাবী তথা রমযানের আমলগুলো কবুল করেছেন তো!
এটাই স্বাভাবিক। কারণ বান্দা নিজের ত্রুটি ও দুর্বলতা জানে। তাছাড়া সে নবীজীর এই বাণী শুনেছে–
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهٗ مِنْ صِيَامِهٖ إِلَّا الْجُوعُ، وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهٗ مِنْ قِيَامِهٖ إِلَّا السَّهَرُ.
কতক রোযাদার এমন, রোযা রেখে ক্ষুধাকষ্ট ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না। আবার কতক (রমযানের রাতে) কিয়ামকারী এমন, রাতজাগার কষ্ট ছাড়া তার আর কিছুই লাভ হয় না। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৯০; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৯৯৭
এজন্যই তো সালাফে সালেহীন আমলের সাথে সাথে আমল কবুল হল কি না– এবিষয়ে ফিকিরমান্দ ও সচেতন থাকতেন।
এক বুযুর্গকে দেখা গেল, ঈদের দিন তিনি খুব চিন্তিত। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আজ তো খুশি ও আনন্দের দিন; আপনি চিন্তিত কেন? তিনি উত্তর দিলেন–
صدَقْتُمْ، ولكِنِّي عَبْدٌ أَمَرَنِي مَوْلايَ أَنْ أَعْمَلَ لَهٗ عَمَلًا، فَلَا أَدْرِي أَيَقْبَلُهٗ مِنِّي أَمْ لَا؟
আপনাদের কথা সত্য। আসলে আমি হলাম এক গোলাম, আমার মাওলা আমাকে তাঁর জন্য একটা আমল করার (রোযা রাখার) নির্দেশ দিয়েছিলেন। (আমি তা করেছি। কিন্তু) জানি না, তিনি আমার এ আমল কবুল করেছেন কি না। –লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৫
সবশেষে রমযানের আমল কবুল হওয়ার বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর একটি বাণী দ্বারা শেষ করছি; তিনি ঈদের দিন বলতেন–
مَن هূذَا المَقْبُولُ مِنَّا فَنُهَنِّيهِ، وَمَن هূذَا المَحْرُومُ مِنَّا فَنُعَزِّيهِ، أَيُّهَا المَقْبُولُ هَنِيئًا لَكَ، أَيُّهَا المَرْدُودُ جَبَرَ اللهُ مُصِيبَتَكَ.
জানি না, আমাদের মধ্যে কার রোযা-ইবাদত কবুল করা হয়েছে আর কার আমল কবুল হয়নি। যার আমল কবুল হয়েছে, তোমাকে স্বাগতম! আর হে বঞ্চিত! আল্লাহ তোমার ক্ষতিপূরণ করুন। –লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৫