খোশ আমদেদ মাহে রমযান ॥
মুসলিম ঘরগুলো মোহিত থাকুক ইবাদতের সুবাসে
দেখতে দেখতে রমযান চলে এল। আবার দেখতে দেখতে চলেও যাবে। এভাবে একদিন জীবনপ্রদীপও নিভে যাবে। ক্ষুদ্র এ জীবনে কয়টা রমযান আর ভাগ্যে জোটে! কেউ তো রমযানপ্রাপ্তির পূর্বেই পাড়ি জমায় পরপারে। কেউবা তা পেয়েও হারিয়ে বসে। দেখার বিষয় হচ্ছে– রহমতের এ মাসে মাগফিরাতের কতটুকু হিস্যা মিলল! আর এর শিক্ষা ও তাৎপর্য কতটুকুই বা অর্জিত হল! মূলত তাকওয়ার পথে অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে রমযানের বার্তা।
মুমিন সত্তার আবশ্যকীয় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকওয়ার গুণে ভূষিত হওয়া। ঈমান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মুমিন জীবনে। বস্তুত মহান রাব্বুল আলামীন মাহে রমযানুল মুবারক দান করেছেন তাকওয়া অর্জন করে তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য। তাই গোটা রমযান জুড়েই বিরাজ করতে থাকে তাকওয়া হাসিলের মোক্ষম যত উপলক্ষ।
তাকওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে– পরিবার পরিজনের দ্বীন ঈমানের বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়া। জাহান্নামের পথ পরিহার করে জান্নাতের পথে তাদের পরিচালিত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন–
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِیْكُمْ نَارًا .
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। –সূরা তাহরীম (৬৬) : ৬
আর তাই মহান রাব্বুল আলামীন প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নির্দেশ করেন–
وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَیْهَا .
আপনি নিজ পরিবারে নামাযের আদেশ করুন এবং নিজেও তাতে অবিচল থাকুন। –সূরা ত্ব-হা (২০) : ১৩২
মোটকথা, পরিবারের নামায-রোযা, ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-তিলাওয়াত ইত্যাদি বিষয়গুলোর ব্যাপারে সজাগ ও দায়িত্বশীল হওয়া মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার এ বিধানের উত্তম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রিয় নবীজীর পবিত্র সীরাতে। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় পাওয়া যায়, আলী রা. বলেন– নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের জন্য রাত করে এসে আমাদের ডেকে তুলতেন। খোঁজ-খবর নিতেন– আমি আর ফাতেমা তাহাজ্জুদ পড়েছি কি না। কখনো তাহাজ্জুদ পড়ায় ঢিলেমি দেখলে নবীজী মনঃক্ষুণ্ন হতেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১০৭৫, ৪৪৪৭, ৬৯১৫, ৭০২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭০৫)
রমযানে সপরিবারে ইবাদত
রমযান মাসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারের আমল-ইবাদতের প্রতিও সবিশেষ নযর রাখতেন। তারাও যেন আমলে অগ্রগামী হয়– সে চেষ্টা করতেন। এটিই আজকের নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন–
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ،إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ، أَحْيَا اللّيْلَ، وَأَيْقَظَ أَهْلَه، وَجَدّ وَشَدّ الْمِئْزَرَ.
রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণ রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২৪
একটি পরিবার মানে কয়েকজন সদস্যের অস্তিত্ব। একটি ঘর মানে কয়েক ব্যক্তির উপস্থিতি। যেভাবে কয়েকজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি পরিবার গঠিত হয়, তেমনি সে ঘর সজীবতা লাভ করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এজন্য প্রয়োজন নেক আমল ও কল্যাণের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যগণ একে অন্যকে সহায়তা করা। পবিত্র কুরআনের ভাষায়–
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগিতা কর। পাপকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে কেউ কারো সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ কঠিন শাস্তি প্রদানকারী। –সূরা মায়েদা (০৫) : ০২
এর অপূর্ব দৃষ্টান্ত প্রস্ফুটিত হয় নববী যিন্দেগীতে। নববী তরবিয়ত উম্মতকে সেই দীক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী ইরশাদ করেছেন–
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى، وَأَيْقَظَ امْرَأَتَه، فَإِنْ أَبَتْ، نَضَحَ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ، رَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ، وَأَيْقَظَتْ زَوْجَهَا، فَإِنْ أَبَى، نَضَحَتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ.
আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহম করুন, যে নিজে তাহাজ্জুদ আদায় করে এবং স্ত্রীকে ডেকে দেয়। স্ত্রী যদি উঠতে না চায়, তার চোখে হালকা করে পানি ছিটিয়ে দেয়।
আল্লাহ ওই নারীর প্রতি রহম করুন, যে নিজে তাহাজ্জুদ আদায় করে এবং স্বামীকেও ডেকে দেয়। স্বামী যদি উঠতে না চায়, তার চোখে হালকা পানি ছিটিয়ে দেয়। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪১০
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ইবাদতের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার এ মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্ক তখনই তৈরি হবে, যখন মুসলিম পরিবারগুলো সীরাতের আলোকে দ্যুতিময় হবে। এ তো কোনো আইনের প্রয়োগ নয়, কেবল হাত ধরাধরি করে জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন–
إذا أيقَظَ الرَّجُلُ أهلَه منَ الليل فصلَّيا -أو صلَّى رَكْعتين جميعاً- كُتِبَ في الذَّاكرينَ والذَّاكراتِ.
যখন স্বামী তার স্ত্রীকে তাহাজ্জুদের জন্য ডেকে তুলবে। অতঃপর উভয়ে (যথাসাধ্য) নামায আদায় করবে অথবা কেবল দুই রাকাত নামায আদায় করবে, ঐ স্বামী-স্ত্রী আল্লাহর নিকট সদা যিকিরকারী নারী-পুরুষদের মাঝে গণ্য হবে। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩০৯
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারের এ তরবিয়তগুলো করতেন অত্যন্ত স্নেহ ও মমতার সঙ্গে। উম্মুল মুমিনীন হাফছা রা.-কে নবীজী এক প্রসঙ্গে ছোট ভাই আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর প্রশংসা করে বলেন–
نِعْمَ الرَّجُلُ عَبْدُ اللهِ لَوْ كَانَ يُصَلِّي مِنْ اللَّيْلِ.
আবদুল্লাহ তো অত্যন্ত ভালো মানুষ; তবে সে যদি তাহাজ্জুদের ব্যাপারে আরো যত্নবান হত!
নবীজীর এ মমতাপূর্ণ উক্তি শোনার পর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. রাতে খুব কম সময়ই ঘুমাতেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২২)
সপরিবারে আমল
সাহাবীদের জীবন থেকে
সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতেও আমরা এই নববী তরবিয়তের ছটা দেখতে পাই। উমর রা.-এর জীবনীতে পাওয়া যায়– রাতে দীর্ঘ সময় তিনি তাহাজ্জুদ পড়তে থাকতেন। যখন রাত শেষ হয়ে আসত, তিনি পরিবারের সদস্যদের ডেকে তুলতেন। ‘নামায নামায’ বলে তিনি আওয়াজ করতে থাকতেন। আর তিলাওয়াত করতে থাকতেন–
وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْـَٔلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَ الْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي .
তুমি নিজ পরিবারকে নামাযের আদেশ কর এবং নিজেও তাতে অবিচল থাক। আমি তোমার কাছে রিযিক চাই না। রিযিক তো আমিই দেব। আর শুভ পরিণাম তো তাকওয়ারই। (সূরা ত্ব-হা : ১৩২) –মুআত্তা মালেক, বর্ণনা ৩১১
আমরা আবু হুরায়রা রা.-এর জীবনীতে দেখতে পাই– আবু উসমান নাহদী রাহ. বলেন, আমি আবু হুরায়রা রা.-এর কাছে সাত দিন মেহমান হিসেবে ছিলাম। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও খাদেম রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। একজন নামায পড়ে আরেকজনকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতেন। –মুসনাদে আহমাদ, বর্ণনা ৮৬৩৩
এভাবে পরিবারের সদস্যবৃন্দ একে অপরকে নেক আমলে সহযোগিতা করতেন।
সপরিবারে আমল
সালাফের কিছু নমুনা
সাহাবী-পরবর্তী সালাফের জীবনেও ছিল সেই জ্যোতির্ময় ধারাবাহিকতা। আবদুল্লাহ ইবনে শুবরুমা রাহ. বলেন– যুবায়দ (ইবনে হারিস) ইয়ামী রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। এক ভাগ নিজের জিম্মায়, আরেক ভাগ পুত্র আবদুল্লাহ্র জিম্মায়, আরেক ভাগ অপর পুত্র আবদুর রহমানের জিম্মায়। তিনি রাতের এক তৃতীয়াংশ নামায পড়তেন। তারপর এক ছেলেকে উঠতে বলতেন। সে কখনো অলসতা করলে তার অংশে নিজেই নামায পড়তেন। তারপর অন্য ছেলেকে উঠতে বলতেন। সে অলসতা করলে তার অংশেও নিজেই নামায পড়তেন। এভাবে কখনো কখনো সারা রাত নামাযে কাটিয়ে দিতেন। –আলমুযাক্কিয়াত, পৃ. ২৫২
ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রাহ. বলেন– সালেহ ইবনে হুয়াইয়ের দুই পুত্র আলী, হাসান ও তাদের মা রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। আলী এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়ে বিশ্রাম করতেন। তারপর হাসান এক তৃতীয়াংশ নামায পড়ে বিশ্রাম করতেন। এরপর তাদের মা এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়তেন। মায়ের মৃত্যুর পর দুই ভাই রাতকে দুই ভাগ করে নামায পড়তেন। আলী ইন্তেকাল করলে হাসান একাই পুরো রাত্রি জাগরণ করতেন। –হিলইয়াতুল আউলিয়া ৭/৩২৭
মোটকথা, তারা তাদের ঘরকে যিকরুল্লাহ থেকে শূন্য থাকতে দিতেন না।
এভাবে যুগ পরম্পরায় পরবর্তীতে উম্মতের বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনেও সেই নমুনা পাওয়া যায়।
হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.-এর জীবনীতে পাওয়া যায়– রমযান মাসে কখনো কখনো হযরত ইশার নামায পড়ে ঘরে চলে যেতেন। হাফেজ সাহেবদের নিয়ে দীর্ঘ সময় তারাবী পড়তেন। চার পারা, ছয় পারা এমনকি দশ পারা পর্যন্ত তারাবীতে শুনতেন। দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পড়তে হযরতের পা ফুলে যেত। এভাবে তিনি ঘরকে তিলাওয়াতের গুঞ্জনে মোহিত রাখতেন। (দ্রষ্টব্য : সাওয়ানেহে শাইখুল হিন্দ আছগরী, আকাবির কা রমযান, পৃ. ২৭)
রমযানে ঘরের নারীদের আমল
রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলোর সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের বুযুর্গানে দ্বীনের ঘরের নারীরাও বেশ সচেতন ছিলেন। সাংসারিক যত ব্যস্ততা সব সামাল দেওয়ার পরও তাদের ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার কারগুযারীগুলো শুনলে বাস্তবেই হয়রান হতে হয়।
হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ. নিজের ঘরের মেয়েদের গল্প শোনাতে গিয়ে বলেন, আমাদের মেয়েদেরকে আল্লাহ তাআলা আরো হিম্মত দান করুন। এত বড় সংসারের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা, তারপর সবার কোলে কয়েকটি করে সন্তান, এগুলো সামলানো... এতকিছুর পরও দেখি রমযান মাসে ওরা রাত জেগে জেগে ইবাদত করে। রাতে ছেলেরা তারাবীতে খতম করে, সেখানে তাদের পেছনে ওরাও শরিক হয়। দিনের বেলা কাজ-কর্ম করার পর তারা চৌদ্দ-পনেরো পারা তিলাওয়াত করে। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা চলে– কে কত বেশি তিলাওয়াত করতে পারে। তাদের প্রতি মায়া হয়– রাতে যখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা নামাযে তিলাওয়াতে থাকে। আর দিনের বেলা যখন ওরা ঘুমাতে যায়, বাচ্চাগুলো বিরক্ত করতে থাকে। আল্লাহ তাআলাই কবুল করার মালিক।
হযরত নিজের দাদিজানের ব্যাপারে বলেন– দৈনিক তিনি এক মনযিল করে তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সাত দিনে এক খতম করতেন। এটা হল এগারো মাসের রুটিন। আর রমযান মাসে দৈনিক এক খতম পূর্ণ করে আরো দশ পারা পড়তেন। আর তাসবীহাতের লম্বা ওযীফা তো ছিলই।
হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রাহ. প্রতি রমযানে নিজের বাড়ি কান্ধলায় গিয়ে নিজের মা ও নানি বিবি আমাতুর রহমানকে তারাবী পড়াতেন। তিন দিনে খতম করে আবার চলে আসতেন। তাদের সেই নামায চলত প্রায় রাতব্যাপী। কখনো কখনো হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-ও গিয়ে প্রায় সারা রাত নামায পড়াতেন।
একদিন ছিল ত্রিশতম রোযার তারাবী। বিবি আমাতুর রহমানের পুত্র মাওলানা রউফুল হাসান ছাহেব রাহ. তারাবীর নামাযে প্রথম রাকাতে আলিফ-লাম-মীম থেকে সূরা ফালাক পর্যন্ত পড়লেন। দ্বিতীয় রাকাতে পড়লেন সূরা নাস। এভাবে দুই রাকাতে (বরং বলা যায় এক রাকাতেই) পূর্ণ কুরআন পড়ে বললেন, অবশিষ্ট আঠারো রাকাত আপনারা পড়ে নিন।
সেদিন বিবি আমাতুর রহমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের পেছনে এক রাকাতে পূর্ণ কুরআন শরীফ শুনেছেন।
(সুবহানাল্লাহ, কতই না ভাগ্যবান ওই সকল মা-বাবা, নিজ সন্তানের পিছে যাদের পূর্ণ কুরআন শোনার তাওফীক হয়।)
বিবি আমাতুর রহমান বলেন, আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আব্বাজান বাইআত করে নেন। আব্বাজান আমাদেরকে যিকির-আযকার এবং মাসনূন দুআ-দরূদের সবক দেন। রমযান মাসে ঘরের কোণে ইতিকাফে বসিয়ে দেন। তখন থেকে এ নিয়মই মেনে আসছি।
বিবি ছাহেবা তৎকালীন আকাবিরে দেওবন্দের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। বিশেষ করে হযরত থানভী ও সাহারানপুরী রাহ.-এর। তাঁর পিতা ছিলেন মাওলানা মুযাফফর হুসাইন কান্ধলবী রাহ.। অত্যন্ত উঁচু মাপের মুত্তাকী বুযুর্গ ছিলেন তিনি। রমযান মাসে পুরো রাত ইবাদতে থাকতেন। এক মুহূর্তের জন্যও রাতে বিশ্রাম করতেন না। আল্লাহর ভয়ে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকত। কখনো কখনো চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। আবার আল্লাহ তাআলার রহমান ছিফাতের ফিকিরে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ২২, ৬৩-৬৫; হালাতে মাশায়েখে কান্ধলা, পৃ. ২৮, ৪৬-৪৮)
পরিবারের শিশুদের রোযায় অভ্যস্ত করা
সন্তানদের দ্বীনী তরবিয়তে গড়ে তুলতে এবং আমল-ইবাদতে অভ্যস্ত করতে নারী সাহাবীদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। শরীয়তের বিধানাবলি পালন করার ক্ষেত্রে শিশুদের মনমানস প্রস্তুত করতে তারা ছিলেন সদা তৎপর। তারা ছোট্ট শিশুদের রোযায় অভ্যস্ত করতে বালেগ হওয়ার পূর্বেই তাদের কিছু কিছু রোযা রাখাতেন। তাদেরকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতেন।
বিখ্যাত নারী সাহাবী রুবায়্যি‘ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন– যে আজ সকালে খেয়েছে, সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি, সে যেন রোযা পূর্ণ করে।
ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, শিশুদের ওপর তো ফরয রোযাই ফরয নয়। তবুও ইসলামের একটি বিধানে সন্তানকে অভ্যস্ত করতে খাইরুল কুরূনের মায়েরা কতটা আগ্রহী ও মনোযোগী ছিলেন! সচেতন অভিভাবকবৃন্দের জন্য এসকল ঘটনায় ভাবার যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সন্তানদের দ্বীনী তরবিয়তে গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন।
প্রিয় পাঠক, তাকওয়ার আলোকে একটি ঘর কীভাবে সুসজ্জিত হতে পারে, এরই কিছু নমুনা এখানে উঠে আসল। যিকির-তিলাওয়াত, দুআ-মুনাজাত, ইবাদত-বন্দেগীতে মুসলিম পরিবারগুলো কেমন প্রাণবন্ত থাকত, তারই কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হল মাত্র। আমরা আমাদের ব্যক্তি ও পরিবারকে এ আয়নায় একটু পরখ করে দেখতে পারি। হিসাব মেলাতে পারি– আমরা সেই ঘরগুলোর কতটুকু দূরে, কতটুকু নিকটে! তাই কর্তব্য হচ্ছে– রমযানের প্রতিটি আয়োজনকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। এর বরকত ও রূহ বিনষ্টকারী প্রতিটি পদক্ষেপকে উপেক্ষা করা। গীবত, পরনিন্দা, সময়ের অপচয়, অযথা গল্পগুজব, ফ্যাশন-ভূষণ, ডিভাইস ব্যবহার ইত্যাদি পরিত্যাগ করে ঘরের মধ্যে ইবাদত-বন্দেগী, দুআ-মুনাজাত, যিকির-তিলাওয়াত, দ্বীনী কিতাবের তালীম, তারাবী-তাহাজ্জুদ ইত্যাদি আমলের পরিবেশ তৈরি করা।
একটি পরিবার ঈদ-আনন্দ উদ্যাপন করার ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তা থেকে নিয়ে সকলে যেমন সচেতন থাকে এবং পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করে, রমযানের আমল-ইবাদত, তাকওয়া অর্জনের ক্ষেত্রেও তেমন সচেতন হওয়া এবং সম্মিলিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। পরিবারের সবার ঈদের পোশাক তো হল, তাকওয়ার পোশাক কি সবাই লাভ করতে পারল– এ নিয়ে চিন্তা-ফিকির, মুহাসাবা ও আত্মপর্যালোচনা করা! ঈদ শপিংয়ের নামে রমযানের মূল্যবান মুহূর্তগুলো যেন নষ্ট না হয়– তা নিয়ে পারিবারিক মুযাকারা করা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সর্বোপরি রমযানের খায়ের ও কল্যাণ লাভের প্রতি সম্মিলিত মনোযোগ দেওয়া।
পরিবার-প্রধানের দায়িত্ব
যেমনিভাবে অনেক পরিবারে আমলের পরিবেশ বিরাজ করে, তেমনি কিছু পরিবারে পারিবারিকভাবেই আমলহীনতা ও উদাসীনতার পরিবেশ দেখা যায়। ঘরে সারাদিন টিভি-ডিশ চলতে থাকে। তারাবী-তিলাওয়াতের কেউ ধার ধারে না। কোনোরকম সাহরি খেলেও ফজরের নামায না পড়েই শুয়ে যায় ইত্যাদি। আবার অনেক পরিবারে এমন দেখা যায়, পুরুষ রোযা রাখে, কিন্তু স্ত্রী-সন্তান রোযা রাখে না। কিংবা পরিবারে কেবল স্ত্রী রোযা রাখে, কিন্তু স্বামী-সন্তানেরা রোযা রাখে না। আবার এমনও দেখা যায়, বালেগ সন্তান রোযা রাখতে চায়, কিন্তু পরীক্ষা বা কোনো অজুহাতে মা-বাবা নিষেধ করেন। এধরনের ক্ষেত্রে পরিবার প্রধান অবশ্যই আল্লাহর জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবেন। তাকেই জিজ্ঞাসা করা হবে সবার আগে। সুতরাং দায়িত্বশীল অভিভাবকবৃন্দের কর্তব্য হচ্ছে, নিজে আমল করার সাথে সাথে পরিবারের প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীলতার নযর দেওয়া। শাসন ও সোহাগ দিয়ে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো। কারণ, তাদের দায় তো সবার আগে তার ওপরই এসে বর্তায়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এভাবে–
أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالْأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ، وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلَا فَكُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
জেনে রেখো, তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল; সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গৃহকর্তা স্বীয় ঘরের সদস্যদের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। স্ত্রী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানদের দায়িত্বশীল। সে এগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মালিকের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। সে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। তো স্মরণ রেখো, তোমরা সকলেই (কোনো না কোনো বিষয়ে) দায়িত্বশীল। আর সকলেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮২৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৩৮
নবীজীর এ নির্দেশনার আলোকে আমরা আমাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি ভেবে দেখা দরকার। রমযান মাসেই শুরু হোক তাকওয়ার পথে অভিযাত্রা। মুসলিম ঘরগুলোতে বিরাজ করুক ইবাদত-বন্দেগীর নূরানী এক আবহ। সেই সুবাস থেকে যাক বছরজুড়ে। ছুঁয়ে যাক পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।