রমযান ১৪৪৬   ||   মার্চ ২০২৫

রোযার হেফাজত : সালাফের কর্মপন্থা

মাওলানা আবু রাজী মুহাম্মাদ ইমরান

রমযান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি বিশেষ দান। আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত লাভ, তাকওয়া ও খোদাভীতি অর্জনসহ অসংখ্য ফযীলতের মাস। সেসব ফযীলত লাভের মূলে হচ্ছে, সিয়াম বা রোযা। কাজেই সিয়াম যত সুন্দর ও নিখুঁত হবে, উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ হবে রমযানের খায়ের ও বরকত, ফযীলত ও কল্যাণ তত বেশি অর্জন হবে। তাই সালাফ (পূর্বসূরিগণ) এ বিষয়ে সর্বদা সজাগ থাকতেন। রমযানের সিয়ামকে সুন্দর থেকে সুন্দর করার চেষ্টা করতেন। সিয়ামের মধ্যে ত্রুটি হয় এমন সবকিছু থেকে সযত্নে দূরে থাকতেন এবং আশপাশের সবাইকে সে বিষয়ে সতর্ক করতেন। ত্বালীক ইবনে কাইস রাহ. বলেন, আবু যর গিফারী রা. বলতেন

إِذَا صُمْتَ فَتَحَفَّظْ مَا اسْتَطَعْتَ.

তুমি যখন রোযা রাখবে, সাধ্য মতো রোযাকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করবে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭০

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই মূলত সাহাবায়ে কেরাম রোযা সম্পর্কে এই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আবুল বাখতারী রাহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় জনৈক মহিলা রোযা রাখত। তবে তার যবান কিছুটা অসংযমী ছিল। তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন

مَا صَامَتْ.

সে রোযা রাখেনি।

মহিলা একথা শোনার পর যবান সংযত করল। তা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন

الْآنَ.

এখন সে রোযা রেখেছে।

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৯৭৯; ফাযাইলুল আওকাত, বাইহাকী, হাদীস ৬৪

আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

الصَّوْمُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا.

রোযা ঢাল, যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করা হয়। সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২২৩৩; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৬৯০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৫১৫৩

যাহোক, রোযার পরিপূর্ণ ফযীলত অর্জন করার জন্য এবং রোযার খায়ের ও কল্যাণ পূর্ণরূপে লাভ করার জন্য রোযার হেফাজত করা জরুরি। সালাফ এর প্রতি খুব খেয়াল রেখেছেন। সে লক্ষ্য অর্জনে তাঁরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যেমন

কান, চোখ ও যবানের নিয়ন্ত্রণে অধিক সতর্ক হওয়া

যেসব কারণে সিয়ামের ক্ষতি হয় এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল কানের গুনাহ, চোখের গুনাহ ও যবানের গুনাহ। এসব অঙ্গের গুনাহ, বরং সমস্ত গুনাহ থেকেই দূরে থাকা সবসময়ই ফরয। তবে সময়ের বিবেচনায় রমযান মাসে গুনাহ পরিহার করা আরো অধিক জরুরি হয়ে যায়। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলতেন

إِذَا صُمْتَ فَلْيَصُمْ سَمْعُكَ، وَبَصَرُكَ، وَلِسَانُكَ عَنِ الْكَذِبِ وَالْمَحَارِمِ، وَدَعْ أَذَى الْخَادِمِ، وَلْيَكُنْ عَلَيْكَ وَقَارٌ وَسَكِينَةٌ يَوْمَ صِيَامِكَ، وَلَا تَجْعَلْ يَوْمَ فِطْرِكَ وَصَوْمِكَ سَوَاءً.

তুমি যখন রোযা রাখবে তোমার কান ও চোখও যেন রোযা রাখে, তোমার যবান যেন মিথ্যা থেকে রোযা রাখে, সমস্ত অঙ্গ যেন সর্বপ্রকার হারাম থেকে রোযা রাখে। এবং খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। রোযার দিন যেন তোমার মাঝে গাম্ভীর্য ও শান্তভাব বজায় থাকে।

মোটকথা, রোযার দিন যেন অন্য সাধারণ দিন থেকে (কল্যাণের ক্ষেত্রে) ভিন্ন হয়। আয্যুহ্দ, ইবনুল মোবারক, বর্ণনা ১৩০৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭৩

বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা রাহ.-ও একই ধরনের কথা বলেন

لِيَصُمْ سَمْعُكَ وَبَصَرُكَ، وَلِسَانُكَ، وَبَدَنُكَ، فَلَا تَجْعَلْ يَوْمَ فِطْرِكَ مِثْلَ يَوْمِ صَوْمِكَ، وَاتَّقِ أَذَى الْخَادِمِ.

(রোযার দিন) তোমার কান, চোখ, যবান ও সমস্ত শরীরও যেন রোযা রাখে। তোমার সিয়ামের দিনগুলো যেন সিয়ামবিহীন দিনের মতো না হয়। আর রোযার দিনগুলোতে খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ফাযায়েলে রমযান, ইবনে আবিদ দুনইয়া, বর্ণনা ৪০

গীবত পরিহার করা

গীবত সবসময়ই হারাম। তবে রোযা অবস্থায় গীবত আরো ভয়াবহ। কেননা, এর কারণে রোযার মারাত্মক ক্ষতি হয়। উপরে একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছেরোযা হল ঢাল, যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করা হয়’। যেসকল কাজের দ্বারা রোযা নামক এ ঢাল বিদীর্ণ হয়, তার মাঝে অন্যতম প্রধান হল গীবত। এজন্যই দারেমী রাহ. এ বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন

يَعْنِي بِالْغِيبَةِ.

অর্থাৎ গীবতের দ্বারা এ ঢাল বিদীর্ণ হয়। (সুনানে দারেমী, ১৭৭৩ নং হাদীস দ্রষ্টব্য)

তাই রোযাকে হেফাযত করার লক্ষ্যে আমাদের সালাফ গীবত থেকে দূরে থাকতেন এবং অন্যদের সামনে এর ভয়াবহতা তুলে ধরতেন। হাফসা বিনতে সীরীন রাহ. বলেন

الصِّيَامُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا صَاحِبُهَا، وَخَرْقُهَا الْغَيْبَةُ.

রোযা হচ্ছে ঢাল, যতক্ষণ না রোযাদার তা ভেঙে ফেলে। আর গীবত করার অর্থ তা ভেঙে ফেলা। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭৮৯৫

আবু তালেব মাক্কী রাহ. বলেন

وكانوا يقولون: الغيبة تفطر الصائم.

পূর্বসূরিদের অনেকেই বলতেন, গীবত রোযা ভেঙে দেয়। কূতুল কুলূব ২/১৮৯

মুজাহিদ রাহ. বলেন

خَصْلَتَانِ مَنْ حَفِظَهُمَا سَلِمَ لَهٗ صَوْمُهٗ: الْغِيبَةُ وَالْكَذِبُ.

যে ব্যক্তি দুটি দোষ থেকে দূরে থাকবে, তার রোযা নিরাপদ থাকবে : গীবত ও মিথ্যা। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৮০; ফাযায়েলে আওকাত, বাইহাকী, বর্ণনা ৬৫

আবুল আলিয়া রাহ. বলেন

الصَّائِمُ فِي عِبَادَةٍ، مَا لَمْ يَغْتَبْ.

রোযাদার যতক্ষণ গীবত থেকে দূরে থাকে, ইবাদতের মাঝে থাকে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৮২

মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকে বর্ণনাটি আরো বিস্তারিতভাবে এসেছে। সেখানে এসেছে, আবুল আলিয়া রাহ. বলেছেন

الصَّائِمُ فِي عِبَادَةٍ مَا لَمْ يَغْتَبْ أَحَدًا، وَإِنْ كَانَ نَائِمًا عَلَى فِرَاشِهٖ.

রোযাদার যতক্ষণ গীবত থেকে দূরে থাকে, ইবাদতের মাঝে থাকে; যদিও সে ঘুমিয়ে থাকে।

আছারটি বর্ণনা করার পর হাফসা বিনতে সীরীন রাহ. বলেন

يَا حَبَّذَا عِبَادَةٌ، وَأَنَا نَائِمَةٌ عَلَى فِرَاشِي.

বাহ, কত সুন্দর! আমার ইবাদত হচ্ছে, অথচ আমি বিছানায় শুয়ে! মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭৮৯৫

সুতরাং গীবত থেকে বেঁচে থাকলে রোযার অনেক বরকত হয়। গীবতের মধ্যে জড়িয়ে পড়লে রোযার অনেক ক্ষতি হয়। হাদীস শরীফেও সালাফের এই কথার সমর্থন পাওয়া যায়। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

مَا صَامَ مَنْ ظَلَّ يَأْكُلُ لُحُومَ النَّاسِ.

যে মানুষের গোশত খেতে থাকে (গীবতে লিপ্ত থাকে) সে রোযা রাখেনি। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৯৮৩

মোটকথা, আমরা যখন রোযা রাখব, তখন রোযাকে ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করব। সিয়ামের বরকত ও কল্যাণ নষ্ট হয়, সিয়ামের মধ্যে খুঁত ও ত্রুটি পয়দা হয় এমন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখব। তবেই আমাদের সিয়ামে পূর্ণতা আসবে। সিয়ামের মাধ্যমে আমরা পূর্ণরূপে খায়ের ও কল্যাণ লাভ করব।

মিথ্যা ও অনর্থক কথা পরিত্যাগ করা

যেসব কারণে রোযার ক্ষতি হয় এর তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে মিথ্যা ও অন্যায় কথা বলা এবং অহেতুক ও বেহুদা কথাবার্তা বলা। তাই আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ মিথ্যার সাথে সাথে অনর্থক কথা ও অনর্থক বিষয়ও পরিত্যাগ করতেন। এসব পরিহার করাকে রোযাদারের জন্য আবশ্যক মনে করতেন। যেমন উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন

لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ وَحْدَهٗ، وَلَكِنَّهٗ مِنَ الْكَذِبِ وَالْبَاطِلِ وَاللَّغْوِ وَالْحَلِفِ.

সিয়াম (রমযানের সংযম) শুধু খাদ্য আর পানীয় থেকে বিরত থাকার নাম নয়; বরং মিথ্যা ও বাতিল পরিহার করা এবং অনর্থক কথা-কাজ ও অর্থহীন কসম থেকেও বিরত থাকা। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭৫, ৮৯৭৮

এই কথা আলী রা. থেকেও বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন

إِنَّ الصِّيَامَ لَيْسَ مِنَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ، وَلَكِنْ مِنَ الْكَذِبِ وَالْبَاطِلِ وَاللَّغْوِ.

সিয়াম (রমযানের সংযম কেবল) খাদ্য আর পানীয় থেকে নয়: বরং মিথ্যা, বাতিল ও অনর্থক বিষয় থেকেও। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭৭

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন

كَانُوا يَقُولُونَ : الْكَذِبُ يُفْطِرُ الصَّائِمَ.

সাহাবী ও তাবেয়ীগণ বলতেন, মিথ্যা রোযাকে ভেঙে দেয়। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৮১

কাউকে কষ্ট না দেওয়া

মানুষকে কষ্ট দেওয়া, কারো প্রতি অবিচার করা সবসময়ই অন্যায়। মুমিন তো সর্বদাই এ থেকে দূরে থাকবে। তবে রমযানে এ ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হবে। যাতে তাঁর সিয়ামের ফায়দা ও উপকারিতা পূর্ণতা লাভ করে। সিয়ামের দ্বারা যেন ঈমান ও তাকওয়া উত্তমরূপে অর্জন হয়। আবু হুরায়রা রা. বলেন

إِذَا كُنْتَ صَائِمًا فَلَا تَجْهَلْ، وَلَا تُسَابَّ، وَإِنْ جُهِلَ عَلَيْكَ، فَقُلْ: إِنِّي صَائِمٌ.

তুমি যখন রোযা রাখবে, (কারো সাথে) মূর্খতাসূলভ আচরণ করবে না। (কাউকে) গালমন্দ করবে না। তোমার সঙ্গে যদি মূর্খতার আচরণ করা হয়, তবে তুমি বলবে, আমি রোযাদার। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭৪৫৬

সালাফের আমল ও বক্তব্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অনুসরণ। কেননা, তিনি বলেছেন

إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ ، فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَسْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهٗ أَحَدٌ، أَوْ قَاتَلَهٗ، فَلْيَقُلْ: إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ.

তোমাদের কেউ যেদিন রোযা রাখবে সেদিন অশ্লীল আচরণ করবে না এবং শোরগোল করবে না। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া বাঁধায় তাহলে সে বলবে, আমি রোযাদার। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৭৬; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪

আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ অশ্লীল আচরণ, কাউকে গালমন্দ করা, কারো সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ তো দূরের কথা, রমযান মাসে তাঁরা নিজের খাদেমকে, নিজের মালিকাধীন গোলামকেও  কষ্ট দিতেন না। আগে বিশিষ্ট তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। তার বক্তব্যের শেষ বাক্যটি হচ্ছে

وَاتَّقِ أَذَى الْخَادِمِ.

এবং (সিয়ামের সময়) তোমার খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে দূরে থাকবে। ফাযায়েলে রমযান, ইবনে আবিদ দুনইয়া, বর্ণনা ৪০

খাদেম থেকে এমন খেদমত গ্রহণ করবে না, যা তার জন্য ভারী হয়, আঞ্জাম দেওয়া তার জন্য কষ্টকর হয়। অর্থাৎ খাদেমের দায়িত্বের মধ্যে পড়লেও রমযান মাসে তার থেকে এ ধরনের ভারী কাজ নেবে না, যার কারণে তার জন্য রোযা রাখা কষ্টকর হয়ে যায় বা রোযা অবস্থায় যে কাজ তার জন্য কষ্টকর হয়। লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, আমাদের সালাফ যেখানে খাদেমের ব্যাপারে এতটা সতর্ক থাকতেন, সেখানে অন্য মানুষের ব্যাপারে কেমন সতর্ক থাকতেন। আর কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকেই যখন দূরে থাকতেন, তখন কারো প্রতি জুলুম ও অত্যাচার করা থেকে কত দূরে থাকতেন তা তো সহজেই অনুমেয়।

মোটকথা, রমযানের রোযা সংরক্ষণ করার জন্য রোযার সময় তাঁরা খাদেমকেও কষ্ট দিতেন না। ইফতারির প্রস্তুতি বা অন্য কোনো খেদমতের জন্য খাদেমের ওপর ভারী ও কষ্টকর কাজ চাপিয়ে দিতেন না। 

মসজিদে অবস্থান করা

রোযার যেন ক্ষতি না হয়, রোযার সওয়াব ও ফযীলত যেন পূর্ণরূপে অর্জন হয়, সেজন্য সালাফের অনেকেই রোযার সময় মসজিদে অবস্থান করতেন। আবুল মুতাওয়াক্কিল নাজী রাহ. বলেন

أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ وَأَصْحَابَهٗ كَانُوا إِذَا صَامُوا جَلَسُوا فِي الْمَسْجِدِ.

আবু হুরায়রা রা. ও তাঁর সাথীবর্গ যখন রোযা রাখতেন, মসজিদে বসে থাকতেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭৪

তারা কেন মসজিদে অবস্থান করতেন, এর উত্তর পাওয়া যায় এই আসারেরই অন্য বর্ণনায়। সেখানে এসেছে

أَنَّ أبا هريرة رضي الله عنه كَانَ إِذَا صَامَ جَلَسَ فِي الْمَسْجِدِ وَقَالَ نُعِفُّ صِيَامَنَا

আবু হুরায়রা রা. যখন রোযা রাখতেন মসজিদে বসে থাকতেন। তিনি বলতেন, এর দ্বারা আমরা আমাদের রোযাকে নিরাপদ ও ত্রুটিমুক্ত রাখি। মুসনাদে মুসাদ্দাদ, আলমাতালিবুল আলিয়া, বর্ণনা ১০১৭

সুতরাং রোযাকে হেফাযত করার লক্ষ্যে সালাফের অনেকেই মসজিদে অবস্থান করতেন। তবে অনেক লোক একত্র হলে মসজিদেও অনর্থক ও বেহুদা কথাবার্তার আশঙ্কা দেখা দেয়। বিষয়টি তাঁদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তাই মসজিদের সময়টা যেন ফলদায়ক হয়, সেখানে যেন অনর্থক কিছু না হয়, সে ব্যাপারে তাঁরা সতর্ক থাকতেন। রমযান মাসে উমর রা. উপদেশমূলক বক্তব্য প্রদান করতেন। সেখানে এই ব্যাপারেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি বলতেন

وَأَقِلُّوا اللَّغْوَ فِي مَسَاجِدِ اللهِ.

মসজিদসমূহে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বেশি বলবে না। ফাযায়েলে রমযান, ইবনে আবিদ দুনইয়া, বর্ণনা ৩১; মুসনাদে মুসাদ্দাদ, মুসনাদুল ফারূক, ইবনে কাছীর, বর্ণনা ২৫৩

ঘর থেকে বের না হওয়া

রোযার হেফাজতের একটি উপায় হল মানুষের সাথে মেলামেশা কম করা। আর এজন্য একটি উত্তম পন্থা হচ্ছে, নিজের ঘরে অবস্থান করা। পারতপক্ষে ঘর থেকে বের না হওয়া। সালাফের মধ্যে কেউ কেউ রোযার হেফাজতের জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। আবু যর রা.-এর নসীহতে এসেছে, তিনি বলতেন, ‘তুমি যখন রোযা রাখবে, সাধ্যমতো রোযার হেফাজত করার চেষ্টা করবে’। এই নসীহতটি বর্ণনা করেছেন ত্বালীক ইবনে কাইস রাহ.। তার শিষ্য আবু সালেহ আলহানাফী রাহ. বলেন

فَكَانَ طَلِيقٌ إذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِهِ دَخَلَ فَلَمْ يَخْرُجْ إِلاَّ لِصَلاَةٍ.

আবু যর রা.-এর উপদেশ শোনার পর থেকে ত্বালীক ইবনে কাইস রাহ. যেদিন রোযা রাখতেন, সেদিন তিনি (ফজর নামাযের পর) ঘরে প্রবেশ করতেন। এরপর নামাযের প্রয়োজন ছাড়া আর বের হতেন না। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৭০

অন্য মাস থেকে রমযান মাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া

প্রিয় পাঠক! আশা করি, লক্ষ করেছেন, সাহাবী জাবের রা. ও তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা রাহ. উভয়ের বাণীতে একটি কথা রয়েছে যে, 'তোমার সিয়ামের দিন যেন সিয়ামবিহীন দিনের মতো না হয়'। উদ্দেশ্য হল কান, চোখ, যবান ও অন্যান্য অঙ্গের সিয়াম ও সংযম। সিয়ামের সৌন্দর্য ও পূর্ণাঙ্গতার জন্য এবং সিয়ামের খায়ের, বরকত ও কল্যাণ পূর্ণরূপে লাভ করার জন্য আরো বিষয়ের প্রতিও লক্ষ রাখতে হবে, একটা একটা করে সবগুলো বলা সম্ভব নয়; তাই সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, তোমার সিয়ামের সময় যেন অন্য সময় থেকে অধিক সুন্দর হয় এবং ঈমান, আমল ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে সিয়ামের দিন যেন অন্য দিন থেকে আরো বেশি উত্তম হয়।

তুমি মুসলিম। সব সময় আল্লাহকে মেনে চল। রাসূলকে অনুসরণ করে চল। গুনাহ-খাতা ও নাফরমানি পরহেয করার চেষ্টা করে থাক। রমযান মাস এলে এসব বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগী হও। আরো বেশি পরিমাণে আল্লাহ-অভিমুখী হও। তাকওয়া-তাহারাত, ইবাদত-বন্দেগি, ইখলাস-একনিষ্ঠতা, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, হাম্দ-সানা, তিলাওয়াতে কুরআন, কিয়ামুল লাইল ইত্যাদির প্রতি আরো বেশি যত্নবান হও। সব ধরনের হারাম ও অন্যায় সম্পূর্ণরূপে বর্জন কর। গল্প গুজব, অনর্থক কথাবার্তা, অহেতুক কাজকর্ম থেকে সযত্নে দূরে থাক। এমনকি তুলমামূলক কম ফায়দা, কম সওয়াব হয়, সেসব কাজকর্মও পরিহার কর। ঐ সব আমলে মনোনিবেশ কর, যাতে ফায়দা বেশি হয়, সওয়াব বৃদ্ধি পায়।

ইমাম বাইহাকী রাহ. বলেন

وَكَمَا يَحْتَرِزُ فِي صِيَامِهٖ عَمَّا لَا يَلِيقُ بِهٖ، يَجْتَهِدُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ فِي طَاعَةِ اللهِ مَا أَمْكَنَهْ.

রোযাদার ব্যক্তি রোযার সময় যেমন অসঙ্গত বিষয়গুলো পরহেয করবে, তেমনি যথাসম্ভব আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে খুব মনোযোগী হবে। ফাযাইলুল আওকাত, বাইহাকী, পৃ. ১৮৯, বর্ণনা ৬৫

 

 

advertisement