রমযানুল মুবারকের কদর করি ॥
উদাসীনতা পরিহার করি
রমযানুল মুবারক তাকওয়া হাসিলের মাস। এ মাসের রোযা আমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে, যেন আমরা তাকওয়া হাসিল করতে পারি। কুরআনে পাকের এ আয়াতটি আমাদের প্রায় সকলেরই কাছেই পরিচিত—
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.
হে মুমিনেরা! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হল, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে পার। –সূরা বাকারা (২) : ১৮৩
একজন মুমিনের তাকওয়া আল্লাহ তাআলার দরবারে তার নৈকট্য ও মর্যাদা হাসিলের মানদণ্ড। যে যত বেশি তাকওয়ার অধিকারী, সে আল্লাহ তাআলার নিকট ততটাই মর্যাদাপ্রাপ্ত, সম্মানিত। তাকওয়াবান যে মুমিন, তার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা—তার কোনো ভয় নেই, কোনো দুঃখ-দুশ্চিন্তাও নেই, সে সফল এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগত হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর রমযানের রোযা আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন এ তাকওয়া হাসিলের জন্য। সমীকরণ তো খুবই সহজ—এ রমযানের মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য হাসিল করতে পারি, জীবনটাকে নির্ভয়-নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারি, নিজেদেরকে সফল ও হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
রমযান মাস গুনাহ মাফের মাস। এ মাস আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের বিলীন করে দেওয়ার মাস। ইবাদতের ভরা মৌসুম এ মাস। হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهٖ.
যে ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮
এ তো রমযানের রোযার ফযীলত—এর মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নেওয়া যায়। গুনাহ মাফের আরো রকমারি আয়োজন ছড়িয়ে আছে এ মাস জুড়ে। এ মাসের একটি বিশেষ ইবাদত—রাত জেগে তারাবীর নামায আদায় করা। এ নামাযের একটি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে এভাবে—
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهٖ.
যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কিয়ামে রমযান আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭
রমযান মাস যখন আসে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই তখন এমন কিছু আয়োজন চলতে থাকে, যা মুমিন বান্দাদের তাকওয়ার পথে চলতে সহায়তা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ، وَمَرَدَةُ الجِنِّ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ، وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الجَنَّةِ، فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ، وَيُنَادِي مُنَادٍ : يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ، وَلِلهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ، وَذٰلكَ كُلُّ لَيْلَةٍ.
রমযান মাসের প্রথম রাত যখন আসে, তখন শয়তানদের ও বিদ্রোহী জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, একটিও খোলা রাখা হয় না; জান্নাতের দরজাগুলো সব খুলে দেওয়া হয়, একটিও বন্ধ রাখা হয় না। একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে—হে কল্যাণের সন্ধানী, তুমি সামনে এগিয়ে চলো; আর হে অকল্যাণের সন্ধানী, তুমি থেমে যাও।
আর আল্লাহ তাআলা বেশ কিছু মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এভাবে প্রতি রাতেই চলতে থাকে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২
এ তো আমাদের চোখে দেখা বাস্তবতা—রমযান মাস যখন আসে, তখন মুসলমানদের সমাজ জুড়ে একটা ইবাদতের পরিবেশ বিরাজ করে। সারা দিনের কষ্টকর রোযা রাখার পরও নানারকম ইবাদতে প্রাণবন্ত থাকে এ মাসটি। নফল নামায, তিলাওয়াত, যিকির-ইস্তিগফার ইত্যাদির পাশাপাশি প্রতি রাতের বিশ রাকাত তারাবীর নামায—রমযান ছাড়া বছরের অন্য কোনো সময় এমন দৃশ্য অকল্পনীয়।
রমযানের প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন, এমনকি প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মাস যখন আসত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত-বন্দেগি ও দান-সদকায় অনেক বেশি মনোযোগী হতেন। আর শেষ দশকে তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে—
إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ، أَحْيَا اللَّيْلَ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهٗ، وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ.
(রমযানের) শেষ দশক যখন আসত, তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন, তাঁর পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে কোমর বেঁধে (ইবাদতে) নেমে পড়তেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭৪
রমযানের একটি বিশেষ রাত লাইলাতুল কদর। রাতটি অনির্দিষ্ট, আমাদের অজানা। শেষ দশকের বা শেষ সাত দিনের যে কোনো এক বেজোড় রাতে। এ একটি রাত সম্পর্কে সরাসরি কুরআনের ঘোষণা, দ্ব্যর্থহীনভাবে—
لَیْلَةُ الْقَدْرِ خَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ.
লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ! –সূরা কদর (৯৭) : ৩
রমযানের সাহরি-ইফতারও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, ফযীলতের। ইফতারের পূর্বক্ষণে দুআ কবুল হয়। বিশেষত মাগফিরাত ও ক্ষমার দুআ শেখানো হয়েছে আমাদের। আর সাহরিকে হাদীসে বরকতময় বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগলে কয়েক রাকাত তাহাজ্জুদের নামায আর শেষ রাতের দুআ-কান্নাকাটি সহজ হয়ে যায় সবার জন্যই।
এই হচ্ছে রমযান। রমযান মাস গুনাহ মাফের মাস, তাকওয়া হাসিলের মাস, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য হাসিলের মাস, পরকালীন সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার মাস, সফলতা অর্জনের মাস। শুধু তাই নয়, রমযানের বরকতময় দিনগুলোতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের জন্য নেক কাজের নানা ধরনও সহজ করে দিয়েছেন। তাকওয়া ও তাঁর নৈকট্য হাসিলের পথ উন্মোচন করে দিয়ে যেন বান্দাদের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইছেন তাদের পরম সফলতার দিকে। অসীম রহমতের অধিকারী যিনি, তাঁর রহমত ও দয়ার নমুনা তো এমনই হবে!
রমযান মাস যেহেতু একটি বিশেষ সময়, বলা যায় ইবাদতের মৌসুম, নানামুখী ফযীলত দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেওয়া হয়েছে এ মাসটিকে, তাই এ মাস এলেই আমাদের অন্য সময়ের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হওয়া উচিত। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার বিষয়েও কাম্য অধিকতর সতর্কতা। আর এ কথা তো স্বীকৃত—ফরয আমলগুলো যথাযথ আদায় করার জন্য যেমন সেসবের সুন্নত ও আদবগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি, একইভাবে হারাম থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকতে চাইলে অনেক অনুত্তম ও ক্ষেত্রবিশেষে বৈধ কাজ থেকেও দূরে থাকা জরুরি।
আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে, রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলো আমরা কাটিয়ে দিই অবহেলায়, উদাসীনতায়। ইবাদতের যখন ভরা মৌসুম চলতে থাকে, তখনো আমরা রমযানে কী করব—তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সময় কাটিয়ে দিই। চিন্তা ও পরিকল্পনায় থাকতেই থাকতেই আমাদের রমযান পেরিয়ে যায়। এভাবে একের পর এক রমযান আমাদের জীবনে আসে ঠিকই, কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা ও উদাসীনতার কারণে রমযানের কাক্সিক্ষত সুফল আমরা অর্জন করতে পারছি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কী হৃদয়ছোঁয়া উপদেশ—
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
তুমি পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়কে গনিমত মনে করো—বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, দরিদ্রতার পূর্বে তোমার সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে এবং মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে। –মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬
এখানেও একই কথা। হাদীসটি যদিও জীবনের প্রতিটি ধাপকে, প্রতিটি মুহূর্তকে শামিল করে, কিন্তু রমযানকে সামনে রেখে এ হাদীসটির প্রতি আমাদের বিশেষ মনোযোগী হওয়া উচিত। এবারের রমযানে আমি যতটা সচ্ছল, যতটা সুস্থ, যতটা প্রাণবন্ত, যতটা অবসর, আগামী রমযানে এমনটা নাও থাকতে পারি। আগামী রমযানে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাই আছে কতটুকু! তাই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে সুযোগ থাকতেই। আরেকটি হাদীস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغ.
দুটি নিআমত এমন, যেগুলোতে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়—সুস্থতা আর অবসর। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২
রমযানের এ মহান নিআমতের কদর যে করবে না, গুনাহ মাফের এতশত আয়োজনের মধ্য দিয়েও যে গুনাহ মাফ করাতে পারবে না, নানামুখী ইবাদতে মশগুল হয়ে নেকীর পাল্লা ভারি করে নিতে পারবে না, তার জন্য স্বতন্ত্র হুঁশিয়ারীও উচ্চারিত হয়েছে হাদীস শরীফে। জাবের রা.-এর বর্ণনা—একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করছিলেন। মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, আমীন। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও বললেন, আমীন। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও বললেন, আমীন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা আপনাকে পরপর তিনবার আমীন বলতে শুনলাম। কী এর রহস্য!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন–
لَمَّا رَقِيتُ الدَّرَجَةَ الْأُولَى جَاءَنِي جِبْرِيلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَهٗ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمَّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمَّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ ذُكِرْتَ عِنْدَهٗ وَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ، فَقُلْتُ: آمِينَ.
আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে উঠলাম, জিবরাঈল আমার কাছে এসে বললেন, যে বান্দা রমযান মাস পেল, এরপর রমযান চলেও গেল, কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হল না, সে ধ্বংস হোক!
আমি তখন বললাম, আমীন।
এরপর তিনি বললেন, যে বান্দা তার বাবা-মা উভয়কে কিংবা তাদের একজনকে পেল ঠিক, কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করায়নি (অর্থাৎ তাদের সেবা করে সে নিজেকে জান্নাতের উপযুক্ত করতে পারেনি), সে ধ্বংস হোক।
আমি বললাম, আমীন।
এরপর তিনি বললেন, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল, কিন্তু সে আপনার ওপর দরূদ পাঠ করল না, সেও ধ্বংস হোক।
আমি বললাম, আমীন। –আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৬৪৪
রমযান পেয়েও যদি কেউ নিজের গুনাহগুলো মাফ করাতে না পারে, তাহলে সে যে কতটা হতভাগা—তা কি ভাবা যায়! তার জন্য ধ্বংসের দুআ করেছেন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, সে দুআয় আমীন বলেছেন সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আর স্বাভাবিক কথা, গুনাহ মাফের সুযোগ পেয়েও যে গুনাহ মাফ না করায়, সে তো শাস্তিরই উপযুক্ত।
লাইলাতুল কদরের ফযীলতের কথা আমরা বলে এসেছি। হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি রাত—এমন বরকতময় রাত এ উম্মতের ভাগ্যেই জুটেছে। কিন্তু নেকী হাসিলের এমন দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েও যদি কেউ রাতটি কাটিয়ে দেয় অবহেলায়, অযত্নে, বছরের অন্য রাতগুলোর মতোই, তার তো আফসোসের সীমা থাকার কথা নয়। আনাস রা. বর্ণনা করেন, একবার রমযান মাস এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهٗ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُومٌ.
এই তো, মাসটি তোমাদের কাছে চলে এসেছে। তাতে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রাতেও যে মাহরূম থাকবে, সে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই মাহরূম থাকবে। এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে প্রকৃত অর্থেই বঞ্চিত। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৪
আমাদের দুর্ভাগ্যই বলা চলে, রমযানের যথাযথ কদর আমরা করি না। রমযান এলে দিনের খানাপিনা থাকে না ঠিক, কিন্তু ইফতারের বাহারি আয়োজনে কাটিয়ে দিই প্রচুর সময়। রমযান এলে যেখানে আমাদের ইবাদতের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হওয়ার কথা, যাবতীয় ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে কদিন যেতে না যেতেই আমরা নেমে যাই ঈদের প্রস্তুতিতে। মার্কেট-শপিংমলের দৃশ্য তখন ঈদের আগমনের কথা মনে করিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু মাসটি যে নেকী হাসিলের, ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেওয়ার– তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। অথচ একটু সচেতন হলে রমযান আসার আগেই সেরে নেওয়া যায় ঈদের যাবতীয় প্রস্তুতি। এমনকি স্বাভাবিক কাজকর্ম একটু গুছিয়ে এনে রমযানের সময়টুকু অধিক ইবাদতে কাটানোও কঠিন নয়। প্রয়োজন শুধু একটু হিম্মত, একটু সদিচ্ছা।
সময় কাজে লাগানো এবং ইবাদতে মশগুল হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা আধুনিক যুগের উন্নত নানা প্রযুক্তি। এগুলো আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে ঠিক, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াসহ ইন্টারনেটের যত ব্যবহার, দিনশেষে যদি আমরা হিসাব করি—এর পেছনে আমরা যতটা সময় ব্যয় করি, এর কতটা ভালো ও উপকারী কাজে ব্যয় হল আর কতটা অর্থহীন ও গুনাহের কাজে, তাহলে কি আমরা সন্তোষজনক ফল পাব? ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে এটা গোপন কিছু নয়—এগুলো একপ্রকার নেশা। নেশার মতোই টেনে ধরে রাখে একটার পর একটা বিষয় দিয়ে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব বা ওয়েব ব্রাউজিং-এ উপকারী কিছু নেই, আমি সেটা বলছি না। কথা হচ্ছে, যতটুকু সময় আমরা এগুলোতে কাটাচ্ছি, তা আসলে উপকারী কি না। অর্থহীন যদি হয়, তাহলে উপরোক্ত হাদীসগুলো আমাদের জন্য কড়া সতর্কবার্তা। মুমিনের চরিত্র কেমন হবে—এ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস–
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهٗ مَا لَا يَعْنِيهِ.
মুসলিমের অন্যতম সৌন্দর্য—সে অর্থহীন কাজ পরিহার করে চলে। –মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ১৬০৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৮
ইন্টারনেট ব্যবহারে শুধু যে সময়ের অপচয় হয়—এমন নয়, বরং হরেক রকম গুনাহের ছড়াছড়ি এ জগতে। সচেতনদের কাছে এ বিষয়টি মোটেও অস্পষ্ট নয়। ছোট একটি উদাহরণ দিই। ফেসবুকে বা ইন্টারনেটে নানা রকম ভিত্তিহীন সংবাদ দেখা যায়। আমরা অনেকেই দেখামাত্র এর সত্যতা যাচাই না করে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিই। ভিত্তিহীন এসব সংবাদ এরপর কখনো জনমনে ছড়িয়ে দেয় আতঙ্ক, কখনো হতাশা, কখনো আবার উসকে দেয় কারো বিরুদ্ধে। এমনকি অনলাইনের ভিত্তিহীন তথ্য জ্বালিয়ে দিতে পারে দাঙ্গার আগুন! যাচাইবিহীন কোনো সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদেরকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছি, তা কি ভেবে দেখেছি! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.
একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট—সে যা শুনবে তা-ই বলে বেড়াবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫
আর চোখের গুনাহে জড়িয়ে পড়া তো এ ময়দানে খুবই মামুলি বিষয় হয়ে পড়েছে। আমরা ভুলে যাই—যাকে সরাসরি দেখা যায় না, তাকে মোবাইলের পর্দায়ও দেখা যাবে না। এভাবেই আটকে যাই কুদৃষ্টির ভয়াবহ গুনাহের জালে। দৃষ্টি হেফাজতের আদেশ তো সরাসরি আল্লাহর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুমিন নারী ও মুমিন পুরুষ—উভয়কে ভিন্ন ভিন্ন আয়াতে নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখা ও লজ্জাস্থান হেফাজতের আদেশ করেছেন। [দ্রষ্টব্য : সূরা নূর (২৪) : ৩০-৩১]
রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলোতে আমাদের তাই প্রয়োজন অনেক বেশি সতর্কতা। সহজলভ্য ইন্টারনেটের নেশায় আটকে গিয়ে আমরা যদি আমাদের রমযানকে এভাবে অবহেলায় কাটিয়ে দিই, তাহলে দিনশেষে অর্থহীন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এর বিপরীতে যদি সংযমের মাস রমযানে আমরা যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে এবং অর্থহীন কাজ থেকেও, বিশেষত ইন্টারনেটের এ জগতে বিচরণের ক্ষেত্রে সংযম অবলম্বন করি, তাহলে রমযান পরবর্তী সময়ের জন্য তা একটি প্রশিক্ষণ হয়ে যেতে পারে। বছরের বাকি মাসগুলোও তখন আমাদের আরো সুন্দর কাটবে। উপকারী ও নেকীর কাজে কাটবে আমাদের জীবন। কিন্তু যদি এ বিষয়ে সতর্ক না হই, তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সতর্কবাণীও আমাদের মনে রাখতে হবে—
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهٖ فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهٗ وَشَرَابَهٗ.
যে (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও পাপ কাজ ছাড়তে পারেনি, সে পানাহার বর্জন করুক—এরও কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৩