রোযা ও সাদাকাতুল ফিতর : জরুরি মাসায়েল
[রমযান সামনে রেখে অনেকেই রোযার মাসায়েল সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সাধারণ মানুষ যেন এক জায়গায় সহজে রোযার প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলো পেতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে আগেও একাধিকবার রোযার গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল আলকাউসারে ছেপেছে। এবারও আগের আলোচনাগুলো সামনে রেখে কিছু সংযোজন ও নতুন বিন্যাসসহ রোযা ও সাদাকাতুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল উপস্থাপন করা হল।]
চাঁদ দেখা সংক্রান্ত মাসআলা
মাসআলা : রমযান শুরু হওয়া যেহেতু চাঁদ দেখা ও প্রমাণিত হওয়ার ওপর নির্ভরশীল, তাই মুসলমানদের জন্য রমযানের চাঁদ অন্বেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। হাদীস ও ফিকহের কিতাবে রমযানের চাঁদ অন্বেষণের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব এসেছে। রমযানের চাঁদ অন্বেষণের জন্য শাবান মাসের তারিখ গণনা ও হিসাব রাখার তাকীদ এসেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম চাঁদ অন্বেষণের ব্যাপারে খুবই যত্নবান ছিলেন। হাদীস শরীফে এসেছে–
أَحْصُوا هِلاَلَ شَعْبَانَ لِرَمَضَانَ.
রমযানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখ। –সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ২১৭৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮৭
মাসআলা : শাবানের ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলেই রমযানের রোযা শুরু হবে। নতুবা শাবানের ৩০ দিন পূর্ণ করার পর রোযা শুরু হবে। অর্থাৎ আকাশ পরিষ্কার না থাকার কারণে চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করে রমযানের রোযা রাখা শুরু হবে। এক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অন্য কোনো উপায়ে চাঁদ দেখার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে চাঁদ দেখা না গেলে ঐ দিন রোযা শুরু হবে না। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে–
لا تَصُومُوا حَتى تَرَوُا الْهِلَالَ، وَلَا تُفْطِرُوا حَتى تَرَوْهُ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدِرُوا لَه.
তোমরা (রমযানের) চাঁদ দেখার আগে রোযা শুরু করো না এবং (ঈদের) চাঁদ দেখার আগে রোযা ছেড়ো না। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখা না যায়), তাহলে মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৬
মাসআলা : শাবান মাসের ২৯ ও ৩০তম দিন রোযা রাখবে না, রমযানের নিয়তেও না, নফলের নিয়তেও না। অবশ্য যে ব্যক্তি আগ থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিনে নফল রোযা রেখে আসছে এবং ঘটনাক্রমে ২৯ ও ৩০ তারিখে ওই দিন পড়েছে, তার জন্য এই তারিখেও নফল রোযা রাখা জায়েয।
হাদীস শরীফে আছে–
لَا يَتَقَدَّمَنَّ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلَّا أَنْ يَكُوْنَ رَجُلٌ كَانَ يَصُوْمُ صَوْمَه، فَلْيَصُمْ ذلِكَ الْيَوْمَ.
তোমাদের কেউ যেন রমযান মাসের এক দিন বা দুই দিন আগে থেকে রোযা না রাখে। তবে কারো যদি আগে থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিন রোযা রাখার অভ্যাস থাকে এবং ঘটনাক্রমে সে দিনটি ২৯ ও ৩০ শাবান হয়, তাহলে সে ওই দিন রোযা রাখতে পারে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯১৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮৪; ইলাউস সুনান ৯/১২৪
যাদের ওপর রোযা রাখা ফরয
রমযানের চাঁদ উদিত হওয়ার পর প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষ ও নারীর ওপর পূর্ণ মাস রোযা রাখা ফরয।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ .
অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা রাখে। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৫
মুসাফিরের রোযা
মাসআলা : মুসাফির ব্যক্তির জন্য সফর অবস্থায় রোযা রাখা জরুরি নয়। সফর অবস্থায় রোযা না রেখে পরে রাখারও সুযোগ রয়েছে। তবে বেশি কষ্ট না হলে মুসাফিরের জন্য সফর অবস্থায়ও রোযা রাখা উত্তম।
আসেম রাহ. বলেন, আনাস রা.-কে সফরের হালতে রোযা রাখার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, মুসাফিরের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে রোযা রাখা উত্তম। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯০৬৭
মাসআলা : সফর অবস্থায় যদিও রোযা না রাখার সুযোগ রয়েছে তথাপি কেউ রোযা রাখলে বিনা ওযরে তা ভাঙা জায়েয নয়। সফর অবস্থায় কেউ রোযা রেখে ভেঙে ফেললে গোনাহগার হবে। তবে এ কারণে কাফফারা আসবে না। শুধু কাযা করতে হবে। –রদ্দুল মুহতার ২/৪৩১
মাসআলা : সফরের কারণে রোযা না রাখার সুযোগ তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন কেউ দিনের শুরু তথা সুবহে সাদিকের সময় মুসাফির থাকবে। অতএব সুবহে সাদিকের সময় নিজ এলাকায় বা অন্য কোথাও মুকীম থাকলে সেক্ষেত্রে দিনের বেলা সফর করার পূর্ণ ইচ্ছা থাকলেও সফরের অযুহাতে রোযা না রাখার সুযোগ নেই। এমনিভাবে মুকীম অবস্থায় রোযা রেখে সুবহে সাদিকের পর সফর করলে শরয়ী কোনো ওযর ছাড়া রোযা ভেঙে ফেলা জায়েয নেই।
মাসআলা : মুসাফির ব্যক্তি যদি সফরের কারণে রোযা না রাখে; কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই সে মুকীম হয়ে যায়, তাহলে সে দিনের অবশিষ্ট সময় রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে আহার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। আর পরবর্তী সময়ে এ রোযার কাযা করে নেবে।
হাসান বসরী রাহ. বলেন, যে মুসাফির রমযানের দিনে (সফরের হালতে) খাবার খেয়েছে, সে মুকীম হয়ে গেলে দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকবে। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৪৩৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪২৮
হায়েয ও নেফাসগ্রস্ত মহিলার রোযা
মাসআলা : রমযানের দিনে হায়েয ও নেফাসগ্রস্ত মহিলা রোযা থেকে বিরত থাকবে এবং পরবর্তীতে ঐ দিনগুলোর রোযা কাযা করে নেবে।
মাসআলা : রমযানের দিনে হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র হলে অবশিষ্ট দিন রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা আবশ্যক এবং পরবর্তী সময়ে এ দিনের রোযারও কাযা করতে হবে। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১, হাদীস ৯৪৩২; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪২৮
অসুস্থ ব্যক্তির রোযা
মাসআলা : অসুস্থ ব্যক্তি যদি রোযা রাখলে রোগ বৃদ্ধি বা আরোগ্য-লাভে বিলম্ব হওয়ার প্রবল আশঙ্কা হয়, তাহলে এ অবস্থায় তার রোযা না রাখার সুযোগ রয়েছে। সুস্থ হওয়ার পরে সে রোযাগুলোর কাযা করে নেবে। তবে হালকা বা সাধারণ অসুস্থতার অযুহাতে রোযা না রাখা বা রেখে ভেঙে ফেলার সুযোগ নেই। সেজন্য এসব ক্ষেত্রে কোনো বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ মোতাবেক আমল করাই নিরাপদ। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২২
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলার রোযা
মাসআলা : গর্ভবতী মহিলা রোযা রাখলে যদি তার বা সন্তানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অনুরূপভাবে স্তন্যদানকারী মা রোযা রাখলে দুগ্ধজাত সন্তানের কষ্ট হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে এ অবস্থায় তাদের রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে পরে ওই রোযা কাযা করে নেবে। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে–
إِن اللهَ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ الصَّوْمَ وَشَطْرَ الصَّلَاةِ وَعَنِ الْحَامِلِ وَالْمُرْضِعِ الصَّوْمَ.
আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের জন্য রোযার হুকুম শিথিল করেছেন এবং আংশিক নামায কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীর জন্যও রোযার হুকুম শিথিল করেছেন। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৭১৫; রদ্দুল মুহতার ২/৪২২
দুর্বল বৃদ্ধ ব্যক্তির রোযা
মাসআলা : বার্ধক্য বা জটিল কোনো রোগের কারণে যার রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করার সামর্থ্য ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই, এমন ব্যক্তির রোযা রাখার প্রয়োজন নেই। রোযার পরিবর্তে সে ফিদইয়া প্রদান করবে।
নাবালেগ বাচ্চাদের রোযা
মাসআলা : নাবালেগ বাচ্চাদের ওপর যদিও রোযা রাখা জরুরি নয়; তথাপি বাচ্চারা যখন শারীরিকভাবে রোযা রাখতে সক্ষম হয়, তখন থেকে তাদেরকে দুয়েকটি করে রোযা রাখতে উৎসাহিত করবে। আর বালেগ হওয়ার পরই যেহেতু রোযা রাখা আবশ্যক হয়ে যায়, তাই সে বিষয়টি লক্ষ রেখে বালেগ হওয়ার কাছাকাছি বয়সে ছেলে-মেয়েদেরকে রোযার প্রতি অভ্যস্ত করে তুলবে।
সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁদের সন্তানদেরকে রোযা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। রুবায়্যি‘ বিনতে মুআওয়াজ রা. বলেন, আমরা নিজেরা আশুরার রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য পশমের তৈরি খেলনা রাখতাম। যখন বাচ্চাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদত তখন তাকে খেলনা দিতাম, এভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেত। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০
রোযার নিয়ত
মাসআলা : রোযার নিয়ত করা ফরয। নামায-রোযা ও অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে অন্তরের সংকল্পই হল নিয়ত। মুখে উচ্চারণ করে বলা জরুরি নয়। তবে অন্তরের নিয়তের সাথে সাথে মুখে উচ্চারণ করে বললেও অসুবিধা নেই। –উমদাতুল কারী ১/৩৩; শরহুল মুনইয়া ২৫৪; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪১৫
মাসআলা : রোযার উদ্দেশ্যে সাহরি খেলে সেটিও রোযার নিয়তের জন্য যথেষ্ট। এর দ্বারাই রোযা সহীহ হয়ে যাবে। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৫৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৫; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৫
মাসআলা : রোযার নিয়তের নির্দিষ্ট কোনো শব্দ-বাক্য নেই। প্রচলিত আরবী নিয়ত হাদীস-আছার বা শরীয়তের কোনো দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ ধরনের আরবী নিয়ত জরুরিও নয় বা এভাবে নিয়ত করা উত্তমও নয়; বরং এসব আরবী নিয়তের পেছনে না পড়াই ভালো। এটা অনেকের জন্যই অহেতুক পেরেশানীর কারণ হয়।
মাসআলা : রমযানের রোযার নিয়ত রাতে করাই উত্তম। তবে কেউ রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য ঢলার আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে। এর চেয়ে বিলম্বে নিয়ত করলে সে রোযা সহীহ হবে না।
আবদুল কারীম জাযারী রাহ. বলেন, কিছু লোক সকালে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল, তখন উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. বললেন, যে ব্যক্তি (ইতিমধ্যে কিছু) খেয়েছে, সে বাকি দিন খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। আর যে খায়নি, সে বাকি দিন রোযা রাখবে। –আলমুহাল্লা ৪/২৯৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৬; মাবসূত, সারাখসী ৩/১৩৫; রদ্দুল মুহতার ৩/৩৭৭
সাহরি ও ইফতার
মাসআলা : সাহরি খাওয়া সুন্নত। পেট ভরে খাওয়া জরুরি নয়; এক ঢোক পানি পান করলেও সাহরির সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাহরি খাও। কেননা, সাহরিতে বরকত রয়েছে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৫
অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, সাহরি খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। তোমরা সাহরি খাও, যদিও এক ঢোক পানি হয়। কারণ যারা সাহরি খায়, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দুআ করেন। –সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪৭৬
মাসআলা : সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত বেশি দেরি করা উচিত নয় যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
আবদুল্লাহ ইবেন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সকল নবীকে (সময় হয়ে গেলে দেরি না করে) তাড়াতাড়ি ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে এবং সাহরি সময়ের শেষদিকে খেতে বলা হয়েছে। –আলমুজামুল আওসাত, তবারানী ২/৫২৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৩৬৮
আমর ইবনে মাইমুন আলআওদি রাহ. বলেন, সাহাবায়ে কেরাম (সময় হয়ে যাওয়ার পর) তাড়াতাড়ি ইফতার করে নিতেন আর সাহরি সময়ের শেষদিকে খেতেন। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯০২৫
মাসআলা : সূর্যাস্তের পর দেরি না করে ইফতার করা মুস্তাহাব।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যতদিন মানুষ দেরি না করে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৫৭
মাসআলা : খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার শুরু করবে।
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যার কাছে খেজুর আছে সে খেজুর দ্বারা ইফতার করবে। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কেননা পানি হল পবিত্র। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৪
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব নামায পড়ার আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর দ্বারা, তা-ও না পেলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯২
মাসআলা : ইফতারের সময় দুআ কবুল হয়। তাই এ সময় বেশি বেশি দুআ-ইস্তিগফার করা উচিত।
হাদীসে এসেছে, ইফতারের সময় রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (দ্র. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩)
রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ
যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি
মাসআলা : রমযানে রোযা রেখে শরীয়তসম্মত কোনো ওযর ছাড়া ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে কাযা-কাফফারা দুটোই জরুরি।
হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন, সে যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাটজন মিসকীনকে খাবার খাওয়ায়। –সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১; মাবসূত, সারাখসী ৩/৭৩; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০৯-৪১০
মাসআলা : রমযানে রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপর কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হয়।
একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি।
নবীজী তাকে কাফফারা আদায়ের আদেশ দেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭০৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭২৪
মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে (যে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সঙ্গে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছেন। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৪৬১
মাসআলা : সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জেনেও আযান শোনা যায়নি অথবা ভালোভাবে আলো ছড়ায়নি– এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে কাযা ও কাফফারা দুটোই জরুরি হবে।
মাসআলা : রমযানের রোযা রেখে বিনা ওযরে ইচ্ছাকৃত ভঙ্গ করলে কাফফারা ওয়াজিব হয়। আর যদি রমযানের কোনো রোযা একেবারেই নাই রাখে তাহলে এ কারণে কাফফারা ওয়াজিব হবে না; তাকে শুধু ঐ রোযাটি কাযা করতে হবে। যদিও শরয়ী ওযর ছাড়া রমযানের রোযা না রাখা ভয়াবহ কবীরা গুনাহ। –রদ্দুল মুহতার ২/৩৮০; হাশিয়াতুত তাহতাবী পৃ. ২৪৩
যেসব কারণে শুধু কাযা ওয়াজিব হয়
মাসআলা : রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অসাবধানতাবশত কোনো খাদ্য বা পানীয় গলার ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা করতে হবে। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৭১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০২
মাসআলা : ওযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙে যাবে এবং শুধু কাযা করতে হবে।
সুফিয়ান সাওরী রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রোযা অবস্থায় (ওযু করার সময়) কুলি করতে গিয়ে (অনিচ্ছাকৃতভাবে) গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙে যাবে এবং তার কাযা করতে হবে। চাই ওযু ফরয নামাযের জন্য হোক বা নফল নামাযের জন্য। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৩৮০; কিতাবুল আছল ২/১৫০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৩৭৮, ৩৮৮
মাসআলা : যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা করতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও ইকরিমা রাহ. বলেন, (পেটে) কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভেঙে যায়। কোনো কিছু বের হওয়ার দ্বারা রোযা ভাঙে না। –সহীহ বুখারী ১/২৬০ (তা‘লীক); বাদায়েউস সানায়ে ২/২৫৫; রদ্দুল মুহতার ২/৪১০
মাসআলা : হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙে যাবে। এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।
হাদীস শরীফে কামেচ্ছা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকাকে রোযার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার জান! রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয় (আল্লাহ তাআলা বলেন,) রোযাদার আমার জন্য পানাহার করা থেকে এবং কামেচ্ছা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকে। –সহীহ বুখারী ১/২৫৪; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭২; ফাতাওয়া শামী ২/৩৯৯
মাসআলা : রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙে যাবে। পরে তা কাযা করে নেবে।
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় নারীদের লক্ষ করে বললেন–
...أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ، قُلْنَ: بَلى، قَالَ: فَذلِكِ مِنْ نُقْصَانِ دِينِهَا.
...নারীরা কি ঋতুস্রাবের সময় রোযা ও নামায থেকে বিরত থাকে না।
নারীরা বলল, অবশ্যই।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই তাদের দ্বীনের অসম্পূর্ণতা। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৪; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪০; আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া, পৃ. ১০০
মাসআলা : দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায়, তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙে যাবে। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬
মাসআলা : দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা ছোলা পরিমাণ বা তার অধিক পরিমাণ খাবার গিলে ফেললে রোযা ভেঙে যাবে এবং শুধু কাযা করতে হবে। –মাবসূত, সারাখসী ৩/৯৩-৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০২
মাসআলা : ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করলে রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা করতে হবে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৭২০; কিতাবুল আছল ২/২০২; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩২৬
মাসআলা : মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫
মাসআলা : আগরবাতি ইত্যাদির ধোঁয়া ইচ্ছাকৃত গলার ভেতরে টেনে নিলে রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা করতে হবে। –রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫
মাসআলা : সুবহে সাদিকের পর সাহরির সময় বাকি আছে ভেবে পানাহার অথবা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙে যাবে। তেমনি ইফতারের সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
আউন রাহ. থেকে বর্ণিত, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. রাত বাকি আছে ভেবে সাহরি খেলেন। তারপর জানতে পারলেন, তিনি সুবহে সাদিকের পর সাহরি করেছেন। তখন তিনি বললেন, আমি আজ রোযাদার নই। (অর্থাৎ আমাকে এ রোযার কাযা করতে হবে।) –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯
আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে উমর রা.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিত লোকদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুআযযিন আওয়াজ দিল, আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডোবেনি।
তখন উমর রা. বললেন, যারা ইফতার করে ফেলেছে, তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতার করেনি, তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০
মাসআলা : রোযা অবস্থায় ভুলবশত পানাহার করার পর রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে। –ফাতাওয়া খানিয়া ১/২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০১-৪০২; হাশিয়াতুত তাহতাবী, পৃ. ৩৬৮
যেসব কারণে রোযা ভাঙে না; কিন্তু অনেকে রোযা ভেঙে গেছে বলে মনে করে
মাসআলা : কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে এতে রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযার কথা স্মরণ হওয়া মাত্র তা পরিহার করতে হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
مَنْ نَسِيَ وَهُوَ صَائِمٌ فَأَكَلَ أَوْ شَرِبَ فَلْيُتِم صَوْمَهُ، فَإِنمَا أَطْعَمَهُ اللهُ وَسَقَاهُ.
যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহ্ই তাকে পানাহার করিয়েছেন। –সহীহ মুসলিম হাদীস ১১৫৫; কিতাবুল আছল ২/১৫০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০২
মাসআলা : স্বপ্নদোষের কারণে রোযা ভাঙে না।
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ ভরে বমি হল। তিনি তখন বললেন, তিনটি বস্তু রোযা ভঙ্গের কারণ নয়– বমি, শিঙা লাগানো ও স্বপ্নদোষ। –সুনানে কুবরা, বাইহাকী ৪/২৬৪; কিতাবুল আছল ২/১৪৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৯৬
মাসআলা : অনিচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি হলেও রোযা ভাঙবে না।
হাদীসে এসেছে–
مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ الْقَضَاءُ.
অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তাকে সে রোযার কাযা করতে হবে না। (অর্থাৎ রোয়া ভাঙবে না)। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৭২০
তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙবে না। –রদ্দুল মুহতার ২/৪১৪
মাসআলা : রতিক্রিয়া ছাড়া শুধু কল্পনার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙে না। তবে রোযা অবস্থায় কু-চিন্তা অবশ্যই গর্হিত কাজ। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪
মাসআলা : কামভাবে কোনো মহিলার দিকে দৃষ্টিপাতের কারণে রতিক্রিয়া ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙবে না। তবে রোযা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টিতে তাকানো অনুচিত।
হাদীসে আছে, জাবের ইবনে যায়েদ রা.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সাথে তাকিয়েছে, ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে, তার রোযা কি ভেঙে গেছে?
তিনি উত্তরে বললেন, না। সে যথারীতি রোযা পূর্ণ করবে। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৬২৫৯; সহীহ বুখারী ১/২৫৮; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪
বলাবাহুল্য যে, কুদৃষ্টি গোনাহের কাজ। আর রোযা অবস্থায় তা আরো ভয়াবহ গোনাহ। এটি ব্যক্তিকে রোযার ফযীলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত করে দেয়।
মাসআলা : দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা ছোলার দানার চেয়েও কম পরিমাণের খাবার গিলে ফেললে রোযা ভাঙবে না, তবে মাকরূহ হবে। তবে ছোলার চেয়ে পরিমাণে কম খাবারও মুখ থেকে বের করে পুনরায় গিলে ফেললে রোযা ভেঙে যাবে এবং কাযা ওয়াজিব হবে। –মাবসূত, সারাখসী ৩/৯৩-৯; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০২
মাসআলা : ধোঁয়া অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর চলে গেলে রোযা ভাঙবে না। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৩
মাসআলা : মশা-মাছি অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর চলে গেলে রোযা ভাঙবে না।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোযা ভাঙবে না। –সহীহ বুখারী ১/২৫৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৩
মাসআলা : মাথায় বা শরীরে তেল ব্যবহার করলে রোযার ক্ষতি হয় না। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৯৫
মাসআলা : চোখের পানি দুই-এক ফোঁটা মুখে চলে গেলে রোযার ক্ষতি হয় না। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৩
মাসআলা : সাহরির সময় পান খেলে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে নিতে হবে। যাতে পান-সুপারির কোনো অংশ মুখে না থাকে। এর পরও থুথুতে লালচে ভাব থাকলে, এর কারণে রোযা ভাঙবে না। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ২/২০৩
মাসআলা : সুস্থ অবস্থায় রোযার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায়, তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৮; আলমাবসূত ৩/৮৮
মাসআলা : লিপস্টিক বা লিপজেল লাগালে রোযা নষ্ট হয় না। তবে রোযা অবস্থায় এগুলো ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ মুখে চলে গেলে রোযা মাকরূহ হয়ে যাবে। আর গলার ভেতর চলে গেলে রোযা ভেঙে যাবে। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৯
মাসআলা : কানে পানি প্রবেশ করলে বা কোনো কারণে পানি প্রবেশ করালে এর দ্বারা রোযা ভাঙবে না। –ফিক্হুন নাওয়াযিল ২/২৯৭; যাবিতুল মুফাত্তিরাত, পৃ. ৫৮
রোযা অবস্থায় যা করা মাকরূহ এবং যা মাকরূহ নয়
মাসআলা : রোযা অবস্থায় ওযু ছাড়া অন্য সময়ও কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া যায়। এতে অসুবিধা নেই। –রদ্দুল মুহতার ২/৪১৯
তবে কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকের নরম অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছানো মাকরূহ।
লাকীত ইবনে সাবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
بَالِغْ فِي الِاسْتِنْشَاقِ، إِلَّا أَنْ تَكُونَ صَائِمًا.
(ওযু-গোসলের) সময় ভালোভাবে নাকে পানি দাও, তবে রোযাদার হলে নয়। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৬৬; সুনানে আবু দাউদ ১/৩২২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৮৪৪; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৩৯৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৯
মাসআলা : রোযা অবস্থায়ও শরীর শীতল করার জন্য গোসল করা যাবে। এতে বাধা নেই। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৯
মাসআলা : রোযা অবস্থায় প্রয়োজনে জিহ্বা দ্বারা কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া কিংবা বাচ্চাদের জন্য খাদ্য চিবানো মাকরূহ নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যেন স্বাদ গলার ভেতরে চলে না যায়।
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. রোযাদার মহিলা বাচ্চার জন্য খাদ্য চিবানোকে দোষের বিষয় মনে করতেন না। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০৭; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৬; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৬
তবে প্রয়োজন ছাড়া খাবার-জাতীয় কোনো কিছু চিবানো বা স্বাদ নেওয়া মাকরূহ।
মাসআলা : রোযাদারের জন্য এমন কাজ করা মাকরূহ, যা দ্বারা রোযাদার নিতান্ত দুর্বল হয়ে যায় এবং রোযা ভেঙে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয়। –আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৬
মাসআলা : বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। তবে কামভাবের সাথে চুমু খাওয়া যাবে না। আর তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে, তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন যুবক এল এবং প্রশ্ন করল, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোযা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি?
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না।
এরপর এক বৃদ্ধ এল এবং একই প্রশ্ন করল।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ।
আমরা তখন অবাক হয়ে একেঅপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একেঅপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। –মুসনাদে আহমাদ ২/১৮০, ২৫০
আবু মিজলায রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এক বৃদ্ধ রোযা অবস্থায় চুমু খাওয়ার মাসআলা জিজ্ঞাসা করল; তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর এক যুবক এসে একই মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৮৫; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০
মাসআলা : রোযা অবস্থায় কাপড় পরা থাকলে এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর আলিঙ্গন করা মাকরূহ নয়। তবুও রোযা অবস্থায় এসব থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। আর বিবস্ত্র অবস্থায় এমনটি করা মাকরূহ। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৭২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০
মাসআলা : ইচ্ছাকৃত মুখে থুথু জমা করে তা গিলে ফেলা মাকরূহ। তবে জমা না করে এমনি থুথু বা লালা গিলে ফেলা মাকরূহ নয়। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৯
মাসআলা : রাতে গোসল ফরয হয়েছে, কিন্তু গোসল করা হয়নি। এ অবস্থায় সুবহে সাদিক হয়ে গেছে, এতে রোযার ক্ষতি হবে না। অবশ্য রোযা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ অপবিত্র থাকা উচিত নয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১০৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০
মাসআলা : রোযা অবস্থায় গীবত করা, গালি-গালাজ করা, বে-পর্দা চলা, সিনেমা দেখা, গান-বাদ্য শ্রবণ করা এবং যে কোনো বড় গোনাহে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ। আর এ কাজগুলো যে সর্বাবস্থায় হারাম, তা তো বলাই বাহুল্য।
হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন–
إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفَثْ وَلَا يَصْخَبْ.
তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে, তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে এবং শোরগোল না করে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪
মাসআলা : রোযাদারের জন্য সুরমা লাগানো বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৭৮; মাবসূত, সারাখসী ৩/৬৭
মাসআলা : রোযা অবস্থায়ও মিসওয়াক করা সুন্নত। এমনকি কাঁচা ডাল দ্বারা মিসওয়াক করাও মাকরূহ নয়।
আমের ইবনে রবীয়া রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি রোযার হালতে অসংখ্যবার মিসওয়াক করতে দেখেছি। –সহীহ বুখারী ১/২৫৯; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০০
হাসান রাহ.-কে রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই। মিসওয়াক পবিত্রতার মাধ্যম। অতএব দিনের শুরুতে এবং শেষেও মিসওয়াক কর। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, রোযা অবস্থায় দিনের শুরু ও শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই। –প্রাগুক্ত ৪/২০৩
মুজাহিদ রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করা দূষণীয় মনে করতেন না।
সুফিয়ান সাওরী রাহ. থেকেও অনুরূপ বক্তব্য বর্ণিত আছে। –প্রাগুক্ত ৪/২০২; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৯; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮১
মাসআলা : গাছের কাঁচা ডাল কিংবা পানিতে ভেজানো ডালের স্বাদ মুখে অনুভূত হলেও তা দ্বারা মিসওয়াক করা জায়েয।
উরওয়া রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করে মিসওয়াকের সুন্নত আদায় করতেন। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৪৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯২৬৪
মাসআলা : রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথপেস্ট বা মাজন দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা কোনো কোনো আলেমের মতে মাকরূহ। কিন্তু অনেক মুহাক্কিক আলেমের মতে রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথপেস্ট বা মাজন ব্যবহার করা জায়েয আছে, মাকরূহ নয়। আর যেহেতু মতভেদ রয়েছে, তাই রমযানে টুথপেস্ট বা মাজন ব্যবহার করতে চাইলে সুবহে সাদিকের আগে করে নেওয়াই নিরাপদ। অবশ্য কখনো রাতে করা না গেলে সেক্ষেত্রে কোনো কোনো আলেমের মতে যেহেতু তা মাকরূহ নয়; তাই দাঁত ময়লা না রেখে দিনের বেলায় টুথপেস্ট বা মাজন দিয়ে হলেও দাঁত ব্রাশ করে নেবে। –মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী ১০/২/৪৫৪
মাসআলা : কুলির পর মুখে লেগে থাকা আর্দ্রতা বা ভেজাভাব পানির হুকুমে নয়। সুতরাং কুলির পরে থুথুর সাথে তা গিলে ফেললে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। আর এই আর্দ্রতা দূর কারার জন্য বারবার থুথু ফেলারও প্রয়োজন নেই; বরং এটা অহেতুক কাজ। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২৩৮; ফাতহুল কাদীর ২/২৫৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৩; ফাতাওয়া বায্যাযিয়া ৪/১০০
রমযানে চিকিৎসা গ্রহণ ও ওষুধ ব্যবহার
মাসআলা : যত ধরনের ওষুধ সরাসরি মুখের ভেতর দিয়ে গ্রহণ করতে হয় এবং তা গলার ভেতর প্রবেশ করে, এসব ওষুধের দ্বারা যে রোযা ভেঙে যাবে তা তো স্পষ্ট। তবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের পরামর্শে এ ধরনের ওষুধ দিনে গ্রহণ করা একান্ত জরুরি হলে তা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে উক্ত রোযাটি কাযা করে নিতে হবে।
মাসআলা : রোযা অবস্থায় কানের ভেতর তেল, ড্রপ বা অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। এর দ্বারা রোযা ভাঙবে না। –মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী (দশম সংখ্যা) ২/৪৪৪, ৩৬৫; আলমাওসূআতুত তিব্বিয়া আলফিকহিয়্যা, পৃ. ৬২৪
মাসআলা : রোযা অবস্থায় চোখে ড্রপ-ওষুধ ব্যবহার কিংবা সুরমা লাগালে রোযার ক্ষতি হয় না। সেই ওষুধের স্বাদ গলায় অনুভব করলেও রোযা ভাঙবে না।
মাসআলা : রোযা অবস্থায় নাকে ড্রপ, স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ নাকে ড্রপ ব্যবহারের পর যদি ওষুধ গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোযা ভেঙে যাবে। আর নাকে ওষুধ দিলে তা সাধারণত গলার ভেতর চলেই যায়। –মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী (দশম সংখ্যা) ২/৪৫৪; আলমাওসূআতুত তিব্বিয়া আলফিকহিয়া, পৃ. ৬২৪
মাসআলা : পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরবর্তীতে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২
মাসআলা : রোযা অবস্থায় অক্সিজেন নিলে রোযা ভাঙবে না। –ফিকহুন নাওয়াযিল ২/৩০০
ক্যাথেটার লাগানো
মাসআলা : পুরুষ বা মহিলার পেশাবের রাস্তায় কিংবা মহিলাদের জরায়ুতে কোনো ধরনের ওষুধ বা ক্যাথেটার কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কোনো যন্ত্র ইত্যাদি প্রবেশ করালে রোযা ভাঙবে না। –মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী (দশম সংখ্যা) ২/৩৬৫, ৪৫৪; যাবিতুল মুফাত্তিরাত, পৃ. ১৭৬
ঢুশ বা সাপোজিটরি ব্যবহার
মাসআলা : রোযা অবস্থায় ঢুশ বা সাপোজিটরি ব্যবহার করলে রোযা ভেঙে যাবে। –মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী (দশম সংখ্যা) ২/৩৪৪; যাবিতুল মুফাত্তিরাত, পৃ. ১৭৪
রক্ত দেওয়া-নেওয়া
মাসআলা : রোযা অবস্থায় রক্ত দেওয়া-নেওয়া দুটোই জায়েয। এর কারণে রোযা ভাঙবে না। –ফিকহুন নাওয়াযিল ২/৩; মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী ১০/২/৪৬৪
ডায়ালাইসিস
মাসআলা : রোযা অবস্থায় ডায়ালাইসিস করা যাবে। এর দ্বারা রোযা ভাঙবে না। কারণ ডায়ালাইসিসে শুধু রক্ত বের করা ও প্রবেশ করানো হয়। আর রক্ত বের করা ও প্রবেশ করানোর কারণে রোযা ভাঙে না। –ফিক্হুন নাওয়াযিল ২/৩০০
ইনজেকশন ও ইনসুলিন
মাসআলা : ইনজেকশন বা ইন্সুলেনের কারণে রোযা ভাঙে না। রোযা অবস্থায় তা নিতে অসুবিধা নেই। অবশ্য যেসকল ইনজেকশন খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, জটিল ওযর ছাড়া তা নিলে রোযা মাকরূহ হবে। –ফাতহুল কাদীর ২/২৫৭; যাবিতুল মুফাত্তিরাত পৃ. ৬৯; জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৩৬৯; মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী ১০/২/৪৫৪
ইনহেলার
মাসআলা : রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা ভেঙে যায়। তাই সাহরির শেষ সময় এবং ইফতারের প্রথম সময় ইনহেলার ব্যবহার করলে যদি তেমন অসুবিধা না হয়, তবে রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কিন্তু অসুস্থতা বেশি হওয়ার কারণে যদি দিনেও ব্যবহার করা জরুরি হয়, তাহলে তখন ব্যবহার করতে পারবে।
সেক্ষেত্রে করণীয় হল–
১. উক্ত ওযরে দিনের বেলা ইনহেলার ব্যবহার করলেও অন্যান্য পানাহার থেকে বিরত থাকবে।
২. পরবর্তীতে যথাসম্ভব তা কাযা করে নেবে।
৩. আর ওযর যদি আজীবন থাকে, তাহলে ফিদইয়া আদায় করবে। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৪; মাজমাউল আনহুর ১/৩৬৬; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫; মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহীল ইসলামী ১০/২/৩১-৬৫
টিকা নেওয়া
মাসআলা : যেসব টিকা ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় পুশ করে গ্রহণ করা হয়, এসবের দ্বারা রোযা ভাঙে না। তাই রোযা অবস্থায় এ ধরনের টিকা গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। –ফাতহুল কাদীর ২/২৫৭; যাবিতুল মুফাত্তিরাত পৃ. ৬৯; জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৩৬৯; মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী ১০/২/৪৫৪
তবে যেসব টিকা মুখে ব্যবহার করা হয় এবং তা গলার ভেতর চলে যায়, তা দ্বারা রোযা ভেঙে যাবে। তাই রোযা অবস্থায় এ ধরনের টিকা নেওয়া যাবে না।
সুগার মাপা
মাসআলা : ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য যে রক্ত নেওয়া হয়, এটিও রোযা ভঙ্গের কারণ নয়। –কিতাবুল আছল ২/১৪৬; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৪৩৭; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬
প্যাথলজি পরীক্ষা ও টেস্টের নমুনা সংগ্রহ
মাসআলা : বিভিন্ন প্যাথলজি পরীক্ষা ও টেস্টের জন্য রক্ত পেশাব ও শ্লেষ্মা বা এজাতীয় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসবের কারণে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। শরীর থেকে কোনো কিছু বের হলে বা বের করা হলে এ কারণে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। –কিতাবুল আছল ২/১৪৬; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৪৩৭; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬; মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী ১০/২/৪৬৫
ওষুধের মাধ্যমে মহিলাদের মাসিক নিয়ন্ত্রণ
মাসআলা : ওষুধ খেয়ে মাসিক বন্ধ রেখে যেসকল রোযা রাখা হয়, সেগুলো আদায় হয়ে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে না। তবে এ ধরনের পদ্ধতি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি না– তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত। –সুন্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২১৯; আলমুহীতুল বুরহানী ১/৩৯৯; জামিই আহকামিন নিসা ১/১৯৮; ফিকহুন নাওয়াযিল ২/৩০৮
ফিদইয়া ও কাফফারা
কাফফারা আদায়ের পদ্ধতি ও এসংক্রান্ত কিছু মাসআলা
মাসআলা : রোযার কাফফারা হচ্ছে, একটি রোযার পরিবর্তে ধারাবাহিক দুই মাস বা ৬০ দিন রোযা রাখা। ধারাবাহিক দুই মাস রোযা রাখার সামর্থ্য না থাকলে ৬০ জন মিসকীনকে দুই বেলা তৃপ্তিসহকারে খাবার খাওয়ানো অথবা এর মূল্য প্রদান করা। লাগাতার দুই মাস রোযা রাখার শক্তি-সামর্থ্য থাকলে রোযাই রাখতে হবে। রোযা রাখার সামর্থ্য থাকা অবস্থায় ৬০ জনকে খাওয়ালে কাফফারা আদায় হবে না। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৩৭; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৪১৯
মাসআলা : চান্দ্রমাসের পহেলা তারিখ থেকে কাফফারার রোযা শুরু করলে দুই মাস রোযা রাখলেই চলবে। যদিও উভয় মাস বা কোনো এক মাস ২৯ দিনের হয়। আর যদি চাঁদের পহেলা তারিখ থেকে শুরু করা না হয়, তাহলে ৩০ দিনে এক মাস ধরে ধারাবাহিক ৬০টি রোযা রাখতে হবে। –ফাতহুল কাদীর ৪/২৩৮; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬১; রদ্দুল মুহতার ৩/৪৭৬
মাসআলা : দুই মাস রোযা রাখতে গিয়ে কোনো ওযরেও (যেমন, ঈদ কিংবা অসুস্থতার কারণে) যদি ধারাবাহিকতা ছুটে যায়, তাহলে নতুন করে রোযা রাখা শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসেবে ধর্তব্য হবে না।
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, যার ওপর কাফফারা হিসেবে দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখা জরুরি, সে যদি মাঝে অসুখের কারণে রোযা ভেঙে ফেলে, তাহলে নতুন করে রোযা রাখা শুরু করবে। –আলমুহাল্লা ৪/৩৩১
মাসআলা : মহিলাদের হায়েযের কারণে কাফফারার রোযার ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে শুরু করতে হবে না। তারা পবিত্র হওয়ার পরপরই আবার রোযা শুরু করে দেবে। তবে নেফাসের (সন্তান প্রসব-পরবর্তী স্রাব) কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে নতুন করে শুরু করতে হবে। –কিতাবুল আছল ২/১৫৮-১৬০; রদ্দুল মুহতার ২/৪১২
মাসআলা : খাবার দিয়ে কাফফারা আদায়ের ক্ষেত্রে ৬০ জন মিসকীনকে দুই বেলা তৃপ্তিসহকারে খাওয়াতে হবে। অনুরূপ একজন মিসকীনকে ৬০ দিন দুই বেলা তৃপ্তিসহকারে খাওয়ালেও কাফফারা আদায় হয়ে যাবে। –কিতাবুল আছল ২/২৪৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫১৩
মাসআলা : খাবারের মূল্য দ্বারা কাফফারা আদায় করলে একজনকে এক দিনে শুধু দুই বেলা খাবারের মূল্য দেওয়া যাবে। তাই যদি পুরো কাফফারা শুধু একজনকে দিতে চায়, তাহলে এভাবে মোট ৬০ দিনে প্রদান করতে হবে। –কিতাবুল আছল ২/২৪৭; মাবসূত, সারাখসী ৮/১৫৪
মাসআলা : রমযানের একাধিক রোযা ভঙ্গ করলে প্রতিটির জন্য একটি করে কাযা করতে হবে। তবে সবকটি রোযার জন্য একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। একত্রে ভিন্ন ভিন্ন রমযানের একাধিক রোযা হলেও বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী সবক’টির জন্য একটি কাফফারা যথেষ্ট হবে। –কিতাবুল আছল ২/১৫৩; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ২/১৬০; ১/২৬০; খিযানাতুল আকমাল ১/৩২১; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ১/১০২; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৩
ফিদইয়া আদায়ের পদ্ধতি ও এসংক্রান্ত মাসআলা
মাসআলা : একেবারে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, যার রোযা রাখার শারীরিক সক্ষমতা নেই; এবং পরবর্তীতে সক্ষমতা ফিরে পাবে– এমন সম্ভাবনাও নেই; অনুরূপ এমন অসুস্থ ব্যক্তি, যার রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করতে পারবে– এমন সম্ভাবনাও নেই, এমন ব্যক্তিই কেবল রোযার পরিবর্তে ফিদইয়া প্রদান করবে। [দ্র. সূরা বাকারা (০২) : ১৮৪]
মাসআলা : উপরোক্ত দুই শ্রেণির মানুষ ছাড়া (অর্থাৎ দুর্বল বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ব্যক্তি, যার ভবিষ্যতে রোযার শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।) আরো যাদের জন্য রোযা ভাঙা জায়েয আছে, (যেমন, মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারী) তারা রোযা না রাখলে রোযার ফিদইয়া দেবে না; বরং পরে কাযা করবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, গর্ভবতী নারী ও শিশুকে স্তন্যদানকারীর রমযানে রোযা না রাখার অবকাশ রয়েছে। তারা ফিদইয়া আদায় করবে না; বরং রোযাগুলো কাযা করে নেবে। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৬৪
মাসআলা : মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারী যদি ঐ রমযানের ভেতরই মারা যায়, কিংবা রমযানের পরও ওযর বাকি থাকে এবং ওযরের হালতেই মৃত্যুবরণ করে এবং রোযাগুলো কাযা করার সময় না পায়, তাহলে তার ওপর কাযা ও ফিদইয়া কিছুই ওয়াজিব হবে না। অবশ্য যদি রমযানের পর এবং ওযরের হালত শেষ হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করে এবং কাযা করার সময় পেয়েও কাযা না করে, তাহলে সেক্ষেত্রে ফিদইয়া প্রদানের ওসিয়ত করে যেতে হবে। –আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩, ৪২৪; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫
মাসআলা : ছুটে যাওয়া রোযা কাযা করা সম্ভব না হলে মৃত্যুর পূর্বে ফিদইয়া দেওয়ার ওসিয়ত করে যাওয়া জরুরি। ওসিয়ত না করে গেলে ওয়ারিসরা মৃতের পক্ষ থেকে ফিদইয়া দিয়ে দিলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন। তবে মৃতব্যক্তি ওসিয়ত না করে গেলে সেক্ষেত্রে মিরাসের ইজমালী সম্পদ থেকে ফিদইয়া দেওয়া যাবে না। একান্ত দিতে চাইলে বালেগ ওয়ারিসগণ তাদের অংশ থেকে দিতে পারবে। –রদ্দুল মুহতার ২/৪২৪-৪২৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭
মাসআলা : একটি রোযার পরিবর্তে একটি ফিদইয়া ফরয হয়।
ফিদইয়া হল, কোনো মিসকীনকে দুই বেলা পেট ভরে খাবার খাওয়ানো অথবা এর মূল্য প্রদান করা।
সায়ীদ ইবনে মুসায়্যিব রাহ. বলেন–
وَ عَلَی الَّذِیْنَ یُطِیْقُوْنَهٗ فِدْیَةٌ طَعَامُ مِسْكِیْنٍ.
[আর যাদের রোযা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদইয়া তথা একজন মিসকীনকে খাবার প্রদান করবে। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৪]
এই আয়াত রোযা রাখতে অক্ষম বৃদ্ধের জন্য প্রযোজ্য। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭৫৮৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৬
মাসআলা : যাদের জন্য রোযার পরিবর্তে ফিদইয়া দেওয়ার অনুমতি রয়েছে, তারা রমযানের শুরুতেই পুরো মাসের ফিদইয়া দিয়ে দিতে পারবে। –আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৭
মাসআলা : রোযার ফিদইয়াও যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত গরিব মিসকীনদের দিতে হবে। যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত নয়, এমন কাউকে রোযার ফিদইয়াও দেওয়া যবে না। মসজিদ, মাদরাসা বা এরকম কোনো সামাজিক কাজেও ফিদইয়ার টাকা দেওয়া যাবে না। –আলহাবিল কুদসী ১/৩০০; রদ্দুল মুহতার ২/৩৩৯
মাসআলা : একটি রোযার ফিদইয়া একজন মিসকীনকে দেওয়া উত্তম। তবে একাধিক ব্যক্তিকে দিলেও ফিদইয়া আদায় হয়ে যাবে। তেমনিভাবে একাধিক ফিদইয়া এক মিসকীনকেও দেওয়া জায়েয। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৬৭
মাসআলা : অক্ষম বৃদ্ধ ও মৃত্যুমুখে পতিত রোগী যদি সুস্থতা ফিরে পায় এবং পুনরায় রোযা রাখতে পারে, তাহলে আগে ফিদইয়া আদায় করে থাকলেও ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর কাযা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে আগের আদায়কৃত ফিদইয়ার জন্য সদকার সওয়াব পাবে। –আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭
মাসআলা : যার রোযা রাখার ও ফিদইয়া আদায়েরও সামর্থ্য নেই, সে ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে তওবা-ইস্তিগফার করবে। তবে ভবিষ্যতে রোযাগুলোর ফিদইয়া দেওয়ার সামর্থ্য হলে ফিদইয়া আদায় করে দেবে। –আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৮; আননাহরুল ফায়েক ২/৩২; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৬
সাদাকাতুল ফিতর
যাদের ওপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব
মাসআলা : প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যার মালিকানায় মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার ওপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন অথবা বুঝমান-বালেগ হওয়া কিংবা মুকীম হওয়া শর্ত নয়। অবুঝ-নাবালেগ, মুসাফির এবং মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিও নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাদের ওপরও সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে।
হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট-বড় সকলের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। নাবালেগ, মানসিক ভারসাম্যহীনের সম্পদ থেকে তার অভিভাবক সদকায়ে ফিতর আদায় করবেন। –রদ্দুল মুহতার ২/৩৫৯
মাসআলা : সাদাকাতুল ফিতরের নেসাবের ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা, সোনা- রুপা, অলংকার, ব্যবসায়িক পণ্যের সাথে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, বসবাসের অতিরিক্ত বাড়ি, অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র– এসব কিছুও হিসাবযোগ্য। এসব মিলে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তাহলেও সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে।
সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাবের ওপর বছরপূর্তি জরুরি নয়; ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। তবে কেউ যদি ঋণগ্রস্ত হলে সে ঋণ বাদ দিয়ে নেসাবের হিসাব করবে।
মাসআলা : কেউ রমযানের রোযা রাখতে না পারলেও নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। –বাদায়েউস সানায়ে ২/১৯৯
মাসআলা : ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। সুতরাং যে সন্তান ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের পর জন্মগ্রহণ করবে, তার পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে না। অনুরূপ কেউ যদি ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের আগে মারা যায়, তাহলে তার ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় না। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৬; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৭৫
যাদের পক্ষ থেকে ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব
মাসআলা : সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব এমন প্রত্যেকে তার নিজের পক্ষ থেকে এবং নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে (যদি সন্তানের নেসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে) সাদাকাতুল ফিতর আদায় করবে। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৩
মাসআলা : পিতা-মাতা, স্ত্রী ও বালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তারা নিজেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাদের ওপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। –ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৩; মারাকিল ফালাহ, পৃ. ৩৯৫
মাসআলা : মা সামর্থ্যবান হলেও নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব নয়। –কিতাবুল আছল ২/১৭৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৩
মাসআলা : সামর্থ্যবান দাদার ওপর নাতি-নাতনিদের সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। পিতা জীবিত না থাকলে এবং দাদা নাতি-নাতনিদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আঞ্জাম দিলেও দাদার ওপর তাদের সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা জরুরি নয়। অবশ্য কোনো কোনো আলেমের মতে, এক্ষেত্রে দাদার ওপর নাতির সদকা আদায় করা জরুরি। তাই এমন ক্ষেত্রে দাদা যদি নাতি-নাতনিদের সদকা আদায় করে দেন তাহলে সেটি ভালো হয়। –কিতাবুল আছল ২/১৭৭; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২৮; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৩
মাসআলা : বালেগ সন্তানাদি ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে।
নাফে‘ রাহ. বলেন–
كَانَ ابْنُ عُمَرَ يُعْطِيهِ عَمَّنْ يَعُولُ مِنْ نِسَائِهِ.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে সদাকাতুল ফিতর প্রদান করতেন। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৪৫৫
বিষয়টি প্রচলিত হওয়ায় তাদের অনুমতি জরুরি নয়। তবে আদায়ের আগে তাদেরকে বলে নেওয়া ভালো। আর স্ত্রীর দায়িত্ব হল, সদাকাতুল ফিতর নিজেই আদায় করা অথবা তার পক্ষ থেকে আদায় করা হয়েছে কি না– এর খোঁজ রাখা। –আলমাবসূত, সারাখসী ৩/১০৫; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২৮; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৬১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৫২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৩
মাসআলা : নেসাবের মালিক নাবালেগ ছেলে-মেয়ের সাদাকাতুল ফিতর তার সম্পদ থেকেই আদায় করা নিয়ম। তাই অভিভাবক বাচ্চার সম্পদ থেকে ফিতরা আদায় করে দেবে। তবে পিতা ইচ্ছা করলে নিজ সম্পদ থেকেও তা আদায় করে দিতে পারেন। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৩/৬৩; সহীহ বুখারী ১/২০৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৯৯; আলবাহরুর রায়েক ২/৪৩৯-৪৪০; আলমাবসূত, সারাখসী ৩/১০৪; হেদায়া ২/২২১; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৭৩;
সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ
মাসআলা : হাদীসে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা : ১. যব, ২. খেজুর, ৩. পনির, ৪. কিশমিশ ৫. গম।
এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনির ও কিশমিশ দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে চাইলে মাথাপিছু এক সা‘ পরিমাণ দিতে হবে। কেজির হিসাবে যা ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আধা সা‘ দিতে হবে। কেজির হিসাবে ১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম। এটা ওজনের দিক দিয়ে তফাৎ। আর মূল্যের পার্থক্য তো আছেই।
উল্লেখ্য, হাদীসে এ পাঁচটি দ্রব্যের যে কোনোটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোনোটি দ্বারা তা আদায় করতে পারেন। তাই এক্ষেত্রে উচিত হল, যার উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য আছে, তার জন্য ওই হিসাবেই দেওয়া। যার সাধ্য পনির হিসাবে দেওয়ার, তিনি তাই দেবেন। এরচেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিশমিশের হিসাব গ্রহণ করতে পারেন। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন, তিনি আদায় করবেন গম দ্বারা।
আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে, কুরআনের নির্দেশনা–
مَنْ تَطَوَّعَ خَیْرًا فَهُوَ خَیْرٌ لَّهٗ.
[অবশ্য কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে (এবং নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেয়) তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। [সূরা বাকারা (০২) : ১৮৪]
–এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বড় বড় বিত্তশালী ব্যক্তিগণ যদি সাধারণ সম্পদশালীদের মতো একই মানের সাদাকাতুল ফিতর আদায় না করে হাদীসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্য থেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেন, তবে তা-ই উত্তম হবে।
তবে এটি ভিন্ন কথা যে, কোনো ব্যক্তি হাদীসে বর্ণিত যেকোনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করলে তার সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে।
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের পদ্ধতি
মাসআলা : হাদীসে বর্ণিত দ্রব্যগুলো দ্বারা যেমন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যায়, তেমনি এগুলোর মূল্য দ্বারাও আদায় করা যাবে।
কুররা রাহ. বলেন–
جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ : نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إنْسَانٍ ، أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ.
আমাদের কাছে উমর ইবনে আবদুল আযিয রাহ.-এর ফরমান পৌঁছেছে যে, সাদাকাতুল ফিতর হচ্ছে প্রত্যেক (সামর্থ্যবান) ব্যক্তির পক্ষ হতে অর্ধ সা‘ (গম) কিংবা তার মূল্য হিসাবে অর্ধ দিরহাম প্রদান করা। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১০৪৭০
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ইসহাক রাহ., যিনি ত্রিশেরও অধিক সাহাবী থেকে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন–
أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطّعَامِ.
আমি তাদেরকে (সাহাবা-তাবেয়ীগণকে) খাবারের মূল্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে দেখেছি। –সহীহ বুখারী ১/১৯৪; উমদাতুল কারী ৯/৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১০৪৭২; কিতাবুল আছল ২/১৮০; ইখতিলাফুল উলামা, মারওয়াযী পৃ. ১০৯; আলমাবসূত, সারাখসী ২/১৫৬; বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৫
মাসআলা : চাল বা অন্যান্য খাদ্যশস্য দ্বারাও সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। সেক্ষেত্রে ১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম গম অথবা ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম খেজুর বা যবের মূল্যের সমপরিমাণ চাল দিতে হবে। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৪৭২; কিতাবুল আছল ২/১৮০; আলমাবসূত, সারাখসী ৩/১১৪; ফাতাওয়া ওয়ালওয়ালিজিয়্যা ১/২৪৭; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৫৫
মাসআলা : একজন গরিবকে পূর্ণ একটি ফিতরা দেওয়া উত্তম। অবশ্য এক ফিতরা কয়েকজনকে ভাগ করে দেওয়াও জায়েয আছে। এমনিভাবে একাধিক ফিতরা এক ব্যক্তিকেও দেওয়া জায়েয। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৬৭
মাসআলা : বিদেশে অবস্থানরত কারো পক্ষ থেকে দেশে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে চাইলে ঐ দেশের হিসাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবে অবস্থানরত কেউ এ দেশে তার সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে চাইলে সৌদি আরবের নির্ধারিত ন্যূনতম সদকায়ে ফিতরের মূল্য যদি আট শ টাকা হয়ে থাকে, তাহলে তার পক্ষ থেকে এ দেশে সদকায়ে ফিতর আট শ টাকা আদায় করতে হবে। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৮; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২৫০; রদ্দুল মুহতার ২/৩৫৫
মাসআলা : অধীনদের সদকায়ে ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রেও আদায়কারীর অবস্থানস্থল ধর্তব্য হবে। সুতরাং যারা প্রবাসে থাকেন, তাদের না-বালেগ সন্তান দেশে থাকলেও প্রবাসের মূল্য হিসাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করবেন। –বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৮; আলবাহরুর রায়েক ২/২৫০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৬২; ফাতাওয়া বায্যাযিয়া ৬/২৮৯
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের সময়
মাসআলা : সাদাকাতুল ফিতর ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে আদায় করা উত্তম।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজন ঈদের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫০৯
অবশ্য কোনো কোনো সাহাবী থেকে ঈদের কয়েকদিন পূর্বেও ফিতরা আদায়ের কথা প্রমাণিত আছে। যেমন নাফে‘ রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ঈদের দু-একদিন পূর্বেই তা (ফিতরা) আদায় করে দিতেন। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬০৬
আর নাফে‘ রাহ. থেকে অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ঈদের দুই-তিনদিন পূর্বে ফিতরা উসূলকারীর নিকট সাদাকাতুল ফিতর পাঠিয়ে দিতেন। –মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদীস ৩১৬
সুতরাং সাদাকাতুল ফিতর রমযানের শেষ দিকেই আদায় করা উচিত। এতে গরিব লোকদের জন্য ঈদের সময়ের প্রয়োজন পূরণেও সহায়তা হয়। –আলবাহরুর রায়েক ২/২৫৫; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২৩২; বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৭; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৭
মাসআলা : সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় না করলে পরবর্তীতে তা আদায় করা আবশ্যক। তাই পরে হলেও তা আদায় করে দিতে হবে। –কিতাবুল আছল ২/২০৭, ২১১; ফাতহুল কাদীর ২/২৩১; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৫২; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৮
সাদাকাতুল ফিতর যাদেরকে দেওয়া যাবে
মাসআলা : যাকাত প্রদানের খাতই সাদাকাতুল ফিতরেরও খাত। তাই যাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়, এমন কাউকেই সাদাকাতুল ফিতর দিতে হবে। কেউ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত না হলে তাকে সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না। –আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৬৮
আত্মীয়স্বজনকে সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া
মাসআলা : নিজের পিতামাতা, দাদা-দাদি প্রমুখ ঊর্ধ্বতন এমনিভাবে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি প্রমুখ অধস্তন আত্মীয়স্বজন গরিব হলেও তাদেরকে সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না। অনুরূপ স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ফিতরা দিতে পারবে না। তবে এর বাইরে অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যেমন, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাগনে, চাচা-মামা, ফুফু-খালা শ্বশুর-শাশুড়ি ইত্যাদি গরিব অসহায় হলে তাদেরকে সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে। –কিতাবুল আছল ২/১৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৬২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৬৮
মাসআলা : সদকায়ে ফিতর শুধু গরিব মুসলিমদের হক। তাই কোনো অমুসলিমকে সদকায়ে ফিতরের টাকা দেওয়া যাবে না। তবে তাদেরকে নফল সদকা দেওয়া জায়েয এবং এতে সওয়াবও রয়েছে। –মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫১২; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৬১; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৯
[সংকলনে :
মাওলানা তাহের বিন মাহমুদ]