রমযান ১৪৪৬   ||   মার্চ ২০২৫

রমযানুল মুবারক হোক নতুন জীবনের সূচনা

মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

আজ আমি প্রথমে আপনাদেরকে এরপর আমাকেও মোবারকবাদ জানাচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আবার একটি রমযানের চাঁদ দেখিয়েছেন এবং মহিমান্বিত এই মাস নসীব করেছেন। আমাদের কত পরিচিতজন, আপনজন, ঘনিষ্ঠজন এই মুবারক মাস আসার আগেই চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তারা হয়তো আমাদের চেয়েও উত্তম। তাদের মর্যাদা হয়তো আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের চেয়েও বেশি। তবুও তারা যদি কবরে বুঝতে পারে যে, আমাদের মাঝে রমযান এসেছে, তাহলে খুব আফসোস করবে। রমযান পাচ্ছে না ভেবে তাদের অনেক অক্ষেপ হবে।

রমযানের কোনো বিকল্প নেই

নিঃসন্দেহে সব মাসই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। তিনিই দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। সময় সৃষ্টি করেছেন।

যামানা সৃষ্টি করেছেন। সেই যামানার মাঝে পরিবর্তন আসে। একের পর এক সময় আসে, দিন আসে, মাস আসে। তন্মধ্যে রমযানের বৈশিষ্ট্য এই যে, তার সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ .

রমযান মাস; যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য (আদ্যোপান্ত) হেদায়েত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং (সত্য ও মিথ্যার মাঝে) চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। সূরা বাকারা (০২) : ১৮৫

সুতরাং এ মাসের কোনো বদল বা বিকল্প নেই। এই মাসের কোনো তুলনা নেই।

রমযানের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফযীলত

এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের স্বভাব হল আমরা যেসকল বিষয় খুব সহজেই হাতের নাগালে পাই এবং যেসকল বিষয় প্রতিনিয়ত ঘটতে দেখি, সেগুলোর প্রতি আলাদা কোনো আকর্ষণ থাকে না। যে পথ দিয়ে আমরা নিয়মিত হেঁটে চলি সে পথের দুপাশে মনোযোগ দেওয়া হয় না। সব সময় যেসব কথা শুনি, তার প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ থাকে না। এমনকি আযানের গভীর মর্মসমৃদ্ধ বাক্যগুলোর দিকেও আমরা আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করি না।

আল্লাহ তাআলা বলছেন, রমযান হল এমন মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এটা অনেক বড় মর্যাদার কথা। যে সময়ে এবং যে জায়গায় কুরআন নাযিল হয়েছে, সেই সময় ও জায়গা তুলনাতীত মর্যাদাবান। যত সময় আছে, যত মাস আছে এবং যত স্থান আছে, তন্মধ্যে যে সময় ও স্থানে কুরআন নাযিল হয়েছে, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় ও স্থান দ্বিতীয়টি নেই।

দুর্লভ সুযোগ

আপনি মোবারকবাদ গ্রহণ করুন যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে পুনরায় রমযান মাস দান করেছেন। অতীতের রমযানগুলোতে যে ত্রুটি-অবহেলা হয়েছে, সময় কাজে না লাগানো এবং নিজের উন্নতির ক্ষেত্রে যে অসাবধানতা ঘটে গেছে, আবার রমযান দিয়ে তা পূরণ করার সুযোগ দিয়েছেন। এ দুর্লভ সুযোগ সবার ভাগ্যে বারবার আসে না। অতএব এই মহা সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন।

এখন শীতকাল চলছে। কঠিন শীত। সেজন্য সওয়াবও তো সেই হিসাবে হবে। এই সময়ে রোযা রাখার সওয়াব আল্লাহ তাআলা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবেন। এই সময়ে রোযা রাখা, শীত সহ্য করা এবং রমযানের অন্যান্য আমলগুলো আদায় করার সওয়াব ইনশাআল্লাহ কষ্ট অনুপাতে হবে। (গরমের ক্ষেত্রেও একই কথা।)

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের আগ্রহ

এক্ষেত্রে প্রথমে যে কথাটি মনে রাখা এবং হৃদয়ে অঙ্কিত করে রাখা উচিত, সেটা হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه.

যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা  রাখে, তার অতীত জীবনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সহীহ বুখারী, হাদীস ২০১৪

আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাঁর ওয়াদার প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রতি আগ্রহ নিয়ে রোযা রাখা, এমনিভাবে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করা এসব আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই প্রিয়। আল্লাহর রাসূলের কাছেও প্রিয়। মনে রাখতে হবে, সওয়াবের আশায় রোযা রাখবে! অন্য কোনো জযবায় নয়। কেবল রোযার সংখ্যা পুরা করা কিংবা শুধু রমযান মাস পার করা জন্য নয়।

অনেকে রোযা রাখে এবং রোযা রাখার তৃপ্তি-আনন্দও উপলব্ধি করে। কিন্তু রমযানের মর্যাদা, ফযীলত এবং রোযার সওয়াব ও প্রতিদানের কথা দিল দেমাগে উপস্থিত রাখে না। ফলে এসব বিষয় তার রোযা রাখার প্রেরণা ও উৎসাহের কারণ হয় না।

অনেকে রোযা রাখে কেবল অভ্যাসবশত কিংবা প্রথা পালনের উদ্দেশ্যে, কেউ রোযা রাখে সবাই রাখে এজন্য, কেউ রোযা রাখে বংশীয় ঐতিহ্যের কারণে।

এ ব্যাপারে আমার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। লখনৌ রেডিও স্টেশন থেকে রমযানের প্রথম দিন প্রচার করার জন্য আমার থেকে একটি লেখা নিল। এরইমধ্যে আমি এক দীর্ঘ সফরে বের হলাম। দ্বীনী কাজেই পেশোয়ার কোয়েটা ও কান্দাহার হয়ে আফগানিস্তানের কাছাকাছি যাওয়া হল। আমরা যখন কোয়েটায়, তখন রমযানের চাঁদ দেখা গেল।

সেদিন এক সেনা অফিসার আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিংবা দাওয়াত দিয়েছিলেন বড় কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি, সেখানে একজন সেনা অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। সেই সেনা অফিসার মূলত ছিলেন হিন্দুস্তানের। তিনি সেদিন লখনৌ রেডিও থেকে প্রচারিত আমার সেই লেখাটির পাঠ শুনে এসেছিলেন। (অবশ্য আমার সেটি শোনার সুযোগ হয়নি।) তিনি বললেন, হযরত! আমরা লখনৌ রেডিও থেকে আজ আপনার একটি লেখা শুনলাম। আপনি সেখানে রমযান মাসের অনেক ফযীলত উল্লেখ করেছেন। রমযানের অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেননি। ইফতার করতে যে কী মজা সেই প্রসঙ্গটি বলেননি। আসলে ইফতারী খেতে যে স্বাদ ও মজা, অন্য কোনো কিছুতে সেই স্বাদ ও মজা পাওয়া যায় না। গরমের মৌসুমে পানি, অন্য মৌসুমে অন্যান্য খাবার। ইফতারের সময় এসব খেতে যে স্বাদ লাগে, দুনিয়ার অন্য কোনো নিআমতের মাঝে সেই স্বাদ ও মজা নেই। সত্য কথা হল, আমি শুধু এই স্বাদটা পাওয়ার জন্যই রোযা রাখি।

তিনি পরিষ্কার বলে দিলেন যে, আমি রোযা রাখি শুধু সেই স্বাদটা পাওয়ার জন্যই। কারণ ইফতারের সময় যা খাই, তাতেই এত স্বাদ পাই, যা দুনিয়ার অন্য কোনো খাবারে, কোনো ফলমূলে কিংবা অন্য কোনো কিছুতে পাই না! 

রোযা অভ্যাসগত বিষয় নয়, ইবাদত

এটা সত্যিই অনেক বড় পরীক্ষার বিষয়। সারা দুনিয়ার জন্য এবং দুনিয়ার সকল মুসলমানের জন্য। কারণ এখানে ইবাদত ও মানবীয় বিষয় একসাথে মিশে আছে। এজাতীয় ক্ষেত্রে পার্থক্য করতে না পারলে অধিকাংশ সময় ইবাদত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। ফলে সেই আমলটি করতে গিয়ে মনে থাকে না কী জন্য এই কাজ করছি, কার জন্য করছি! যেমন কারো যখন নামাযের মতো মহান ইবাদত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, তখন এই অনুভূতি হারিয়ে যায় যে, কী মহান ইবাদত আমি করছি! কার সামনে দাঁড়াচ্ছি! মসজিদে যাওয়ার সময় মনে থাকে না যে, আমার প্রতি কদমে কদমে সওয়াব হচ্ছে, মর্যাদা বুলন্দ হচ্ছে। মসজিদে প্রবেশের সময়ও বিরাট সওয়াব ও মর্যাদা বুলন্দির কথা মনে থাকে না। এমনকি মসজিদে প্রবেশের দুআ পড়ার সময়ও মনে থাকে না যে, আমি আল্লাহ তাআলার কাছে কী চাচ্ছি! অনুভূতিতে আসে না যে, আমি আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করছি! অসীম রহমত ও বরকতের জায়গায় উপস্থিত হয়েছি! এগুলো তখন কেবলই অভ্যাসজাত কাজের মতো মনে হয়। সবকিছুকেই খুব সাধারণ মনে হয়। ফলে অন্যমনস্কতা থাকে। খামখেয়ালি থাকে।

এমনিভাবে অন্যান্য দ্বীনী কাজের ক্ষেত্রেও একই কথা। সবকিছুই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে কেবল আদায় করা হচ্ছে। তাতে অনুভূতি জাগরূক থাকছে না। হৃদয় ও মনের উপস্থিতি থাকছে না।

রোযা আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম

প্রথম কথা হল, হৃদয়ে একথা জাগরুক রাখতে হবে যে আমি রোযা রাখছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য না এবং প্রথা পালনের জন্যও না। এমনকি এজন্যও না যে, রোযা না রাখলে মানুষ বলবে এই লোক তো রোযা রাখে না। বরং সব সময় মনে রাখতে হবে আমি রোযা রাখছি কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য।

শবে কদরের ক্ষেত্রেও একই কথা এসেছে হাদীস শরীফে

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه.

যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সহীহ বুখারী, হাদীস ২০১৪

মোটকথা, নিয়ত হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সে কথা হৃদয়ে জাগরূক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে রোযা একটি ফরয বিধান। আমি এই বিধান পালন করছি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে খুশি করার জন্য। আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য।

আল্লাহর রহমতের প্রকাশ

রমযানের মধ্যে আল্লাহ তাআলা অনেক বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। অনেক বরকত রেখেছেন। রমযান মাসে আল্লাহর রহমতে জোশ আসে। চারিদিকে রহমত ছড়িয়ে পড়ে। কঠিন থেকে কঠিন গুনাহও ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বড় থেকে বড় পাপাচারীকেও মাফ করে দেওয়া হয়। এজন্য দরকার নিয়তের উপস্থিতি এবং সজাগ অনুভূতি। প্রয়োজন মনকে একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং মনে মনে একথা বলা যে, আমি আল্লাহ তাআলাকে খুশি করার জন্য রোযা রাখছি। প্রথা পালন, নিয়ম রক্ষা করা কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। 

তিলাওয়াতের মৌসুম

রমযান মাসে নিজেকে যত বেশি ইবাদতে মগ্ন রাখা সম্ভব, রাখবে। বেশি পরিমাণে নফল নামায আদায় করবে। এরপর নিজের স্বাস্থ্য-সুস্থতার প্রতি খেয়াল রেখে, সময় ও সুযোগ হিসেবে অধিক পরিমাণে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করবে। অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত অনেক বেশি হওয়া উচিত। আল্লাহর অনেক বান্দা এ মাসে দৈনিক এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করেন।

হযরত শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ.-ও সম্ভবত দৈনিক এক খতম তিলাওয়াত করতেন। তার সঙ্গে আমারও কয়েকটি রমযান অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় রমযানে তার কাছে হাজির হয়েছি।

যাইহোক, এক খতম না হলেও রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। রমযান আল্লাহ তাআলার প্রিয় মাস। এ মাসে কুরআন তিলাওয়াতের যে সওয়াব, অন্য মাসে তা হয় না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আদব ও বিনয়ের সাথে, বিশেষ নিআমত মনে করে, রমযান মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের তাওফীক দান করুন।

ইবাদত ও আনুগত্যের মাস

দ্বিতীয় বিষয় হল, এ মাসে যেন আমাদের বেশিরভাগ সময় কাটে ইবাদত, মুজাহাদা, যিকির, তওবা, ইস্তিগফার, দুআ, মোনাজাত ও কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের মধ্যে। কথাবার্তা যথাসম্ভব কম বলা এবং কোনো গীবত যেন না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। সব সময় যেমন আত্মীয়-ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়, আশপাশের বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়, দেশের খবর, রাজনীতির খবর, আবহাওয়া ও ঋতু-প্রকৃতির খবর এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়, কিংবা নিছক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে সাধারণ কথাবার্তা হয়, গল্প গুজব হয় রমযান মাসে যথাসম্ভব এসব পরিহার করা উচিত। বেশি থেকে বেশি ইবাদতে এবং কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতে কাটানো উচিত। অন্যথায় বিশ্রামে বা মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে অবস্থানের চেষ্টা করা উচিত।

রমযানের শেষ দশক ছাড়াও যে কোনো সময় মসজিদে গিয়ে ইতিকাফের নিয়তে থাকা যায়। উদাহরণস্বরূপ যোহর নামাযের পর থেকে আসর পর্যন্ত কিংবা আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে থাকা যায়। এছাড়া খুব সামান্য সময়ের জন্যও ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা যায়।

বান্দার হকের ফিকির

রমযান মাসে আরেকটি বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। বিভিন্নজনের যেসমস্ত হক আমাদের ওপর রয়েছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করা এবং এ মাসের মধ্যেই সেগুলো আদায়ের চেষ্টা করা। সেইসঙ্গে বর্তমানেও আমাদের কাছে যার যা হক রয়েছে, সেগুলো যত্নের সাথে আদায়ের ফিকির করা। এক্ষেত্রে যে অবহেলা বা বেখেয়ালি হয়ে গেছে, সেগুলোর জন্য তওবা-ইস্তিগফার করা।

নতুন জীবনের সূচনা

রমযানকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবনের নতুন নকশা তৈরি করা উচিত।

জন্ম থেকে মানুষের একটি জীবন শুরু হয়। একটি জীবন শুরু হয় বালেগ হওয়ার পর থেকে। এমনিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা সমাপ্ত হলে আরেকটি জীবন শুরু হয়। হজে¦র পর থেকে শুরু হয় আরেক জীবন। এভাবে রমযান থেকে নতুন একটি জীবন শুরু হতে পারে। আপনি নিয়ত করুন যে, এই রমযান থেকে নামাযের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নিব। আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ ও ধ্যান-খেয়ালের সাথে নামায আদায় করব। আগে কখনো জামাত ছুটে যেত, কখনো বেশি দেরি হয়ে যেত, কখনো রাতে নামায না পড়েই ঘুমিয়ে পড়তাম, এখন নতুন সংকল্প করলাম। এখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করব। এখন থেকে জীবনকে নতুন করে সাজাব। এমন ইচ্ছা ও সংকল্প হতে পারে রমযানকে কেন্দ্র করে।

অন্যের হকের প্রতি খেয়াল রাখা

এমনিভাবে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যেসব হক রয়েছে আপনার ওপর, যেমন মীরাস বা উত্তরাধিকার সম্পত্তি, জমিজমা বা যৌথ ব্যবসার হিসাব, সেসব বিষয়েও এই রমযানে সংকল্প হতে পারে যে ইনশাআল্লাহ এই হকসমূহ আর অবশিষ্ট রাখব না। এই রমযানেই সেগুলো আদায় করে দেব।

তালিবুল ইলম, উলামায়ে কেরাম ও নেককারদের সাহচর্য

সেইসঙ্গে এই সংকল্পও করা উচিত, এই রমযানের পর থেকে আমি দ্বীন সম্পর্কে অনেক বেশি পরিমাণে জানার চেষ্টা করব। দ্বীনী কিতাব পড়ব। দ্বীনদার লোকদের সান্নিধ্য-সাহচর্য অবলম্বন করব। তাবলীগে যাব কিংবা উলামায়ে কেরামের মজলিসে বসব। অথবা আল্লাহর নেক বান্দাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য যাব।

রমযান বিপ্লবের মাস

রমযানকে কেন্দ্র করে যদি এজাতীয় সংকল্প করা যায়, তাহলে ইনশাআল্লাহ এই রমযান আপনার জীবনে আশ্চর্য বিপ্লব বয়ে আনবে। এখন থেকে বিপ্লবময়, সংকল্পশীল এক নতুন জীবন শুরু হবে। বাস্তবেই রমযান থেকে নতুন জীবন শুরু হওয়া উচিত।

সহীহ নিয়ত ও ইখলাস

সেইসঙ্গে খুব জরুরি হল, নিয়ত সহীহ করা এবং হাদীসে যে বলা হয়েছে

إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا.

আল্লাহর ওয়াদার ওপর বিশ্বাস রেখে, সওয়াবের আশায়। এই চিন্তা মন ও মস্তিষ্কে জাগরূক রাখলে ইনশাআল্লাহ সওয়াব অনেক বেশি হবে।

অটোমেটিক ওযু ও স্বয়ংক্রিয় নামায

হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রাহ. বলতেন মানুষ ওযু করে, কিন্তু ওযুতে মনোযোগ থাকে না। অথচ ওযু কত গুরুত্বপূর্ণ আমল। হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা যখন ওযুতে হাত ধোয় তখন হাত ধোয়া পানির সাথে হাতের সব গুনাহ বের হয়ে যায়। বান্দা যখন মুখ ধোয়, চোখের গুনাহ ও যবানের গুনাহ সেই পানির সাথে বের হয়ে যায়।

কিন্তু এসব যেন কারো মনেই থাকে না। মেশিনে যেমন অটোমেটিক কাজ হয়, আমাদের ওযুও তেমনি অটোমেটিক হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করুন আমাদের অনেকের নামাযও এমন হয়ে গেছে; স্বয়ংক্রিয় নামায। এসে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহু আকবার বলে নামায শুরু করে। কিন্তু কোন্ নামায পড়ছে, নামাযে কার সামনে দাঁড়াচ্ছে কিছুই মনে থাকে না। নামাযের কী সওয়াব, কী প্রতিদান কিছুই জানা থাকে না।

উচিত হল, প্রত্যেক নামাযের সময় এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখা। তাতে নামাযের গুরুত্ব বাড়বে। নামাযে মনোযোগ আসবে। একাকী নামাযে যখন কেরাত পড়বে, তাতে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে। জাহরী নামাযে ইমামের পেছনে মনোযোগ ও উপলব্ধির সাথে কুরআন তিলাওয়াত শুনবে।

কিন্তু না। এই সবকিছু একেবারেই অভ্যাসগত, স্বভাবজাত ও স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে।

অন্তত এই রমযানকে ওসিলা করে এখন থেকেই জীবনে পরিবর্তন আনার ফিকির করা উচিত। সকল ইবাদতে এবং পুরো জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির জোয়ার আসা উচিত।

দায়েরা শাহ আলামুল্লাহর পয়গাম

আপনারা এখন যেখানে আছেন, সেখানের পয়গাম তো এমনই ছিল। আল্লাহ তাআলা এখানে এমন কিছু বান্দা সৃষ্টি করেছেন, যারা পুরো হিন্দুস্তানে দ্বীনী চেতনা ও দ্বীনী মানসিকতার পরিবেশ তৈরি করেছেন। যাদের মেহনতের বদৌলতে মানুষের মধ্যে আল্লাহর মহব্বত ও ইশক, কুরবানীর জযবা, শিরক ও বিদআতের প্রতি ঘৃণা ও ভীতি ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়ে গেছে।

হযরত সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রাহ.-এর হাতে যারা হাত রেখেছেন, তাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে, তার সঙ্গে হাত মিলানোর পরপরই শিরক-বিদআতের প্রতি হৃদয়ে ঘৃণা তৈরি হয়ে গেছে। নামাযের গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে। নামাযের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করেছে। আল্লাহর যিকির করতে শুরু করেছে। সেইসাথে জিহাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

সুতরাং আপনাদের মনে রাখা উচিত, আপনারা এমন জায়গায় আছেন, যেখান থেকে পুরো হিন্দুস্তানে হকের পয়গাম ছড়িয়েছে। এখান থেকেই পুরো হিন্দুস্তানে নতুন এক বাসন্তী হাওয়া প্রবাহিত হয়েছে। দ্বীনী চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জযবা তৈরি হয়েছে।

পূর্বসূরি মনীষীদের হক

শেষ কথা হল, একটা আমল যদিও ফরয বা ওয়াজিব নয়; তবে তা করলে আপনাদেরও ফায়দা, এখানেরও ফায়দা। তা হল এখানে যেসকল বুযুর্গ মনীষী সমাধিস্থ আছেন; বরং আল্লাহ তাআলার যত বান্দা, বিভিন্ন বংশের যত লোক এবং বাইরে থেকে আসা যত মানুষ এই গোরস্থানে শায়িত আছেন, তাদের জন্য আপনারা কুরআন মাজীদ থেকে কিছু পড়ে ইসালে সওয়াব করবেন। অন্তত সূরা ফাতিহা পড়বেন এটা আপনাদের ওপর এখানকার মৃতদের, এই চিরনিদ্রায় শায়িত ব্যক্তিদের হক। 

ঈসালে সওয়াবের বরকত

মাশাআল্লাহ এখানে এত মানুষ রোযা রাখছে, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করছে, তাহাজ্জুদ পড়ছে, কিন্তু এখানের লোকদের তাতে কোনো অংশ নেই। এমন না হওয়া উচিত। তাদেরও কিছু অংশ থাকা উচিত।

এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদেরকেও সওয়াব দেবেন, আপনাদেরও অনেক ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ। আপনাদের আমল-ইবাদতে উন্নতি ও অগ্রগতি হবে। আরো বেশি পরিমাণে নেক আমলের তাওফীক হবে। যিন্দেগীতে বরকত হবে। সেটা এজন্য যে, তারা অত্যন্ত সৎ ও মুখলিস বান্দা ছিলেন। তাদের মাধ্যমে দ্বীনের অনেক কাজ হয়েছে।

এটাই হয়তো জীবনের শেষ রমযান!

আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদেরকে এই রমযানের কদর করার তাওফীক দান করুন। এ রমযানের পরও আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে আরো রমযান দান করুন। তবে একথা যেন মনে না আসে যে, রমযান তো আরো আসবেই। এই রমযান না হয় একটু অবহেলায় কাটল!

বরং এমনভাবে রমযান যাপন করুন, যেন মনে হয় এ রমযানের পর হয়তো জীবনে আর কোনো রমযান আসবে না। এখানে শুধু রমযান পাওয়া আর হায়াত পাওয়ার বিষয় নয়। এখানে সুস্থ থাকার বিষয় রয়েছে। বিপদ-আপদ ও ঘটনা-দুর্ঘটনার বিষয় রয়েছে। দুআ করি আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে এসব থেকে হেফাজত করুন। আপনাদেরকে আরো রমযান দান করুন। তবে এই রমযানকেও খুব কদর করুন। এ সময়গুলোতে যত বেশি সম্ভব ইবাদত করে নিন।

বেশি পরিমাণে দরূদ পাঠ

বেশি থেকে বেশি সময় মুনাজাতে কাটান। বেশি বেশি ইস্তিগফার করুন। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করুন। ঈসালে সওয়াব করুন এবং বেশি পরিমাণে দরূদ পড়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দিন। এ সময় নামায ও তিলাওয়াতের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত দরূদ শরীফের বিষয়ে। কমপক্ষে এখনই একবার দরূদ পড়ে নিন।

সকল মুমিনের জন্য দুআ

এ সময়গুলোতে সকল ঈমানদারদের জন্য দুআ করুন। কুরআন মাজীদের এই দুআটি বারবার পড়ুন

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ وَ لَا تَجْعَلْ فِیْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ.

হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা করুন আমাদেরকে এবং আমাদের সেই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে। এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কেনো হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু। সূরা হাশর (৫৯) : ১০

তাছাড়া এ দুআটিকেও নিজেদের ওযীফার অন্তর্ভুক্ত করে নিন

اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ، الأَحْيَاءِ مِنْهُمْ وَالأَمْوَاتِ.

হে আল্লাহ আপনি জীবিত-মৃত সকল মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে ক্ষমা করে দিন।

আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সবাইকে এসব দুআ ও এসব নেক আমল আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দান করুন। এই রমযান যেন আমাদের জীবনে বাস্তবিক অর্থেই বিপ্লব আনয়নকারী রমযান হয় আল্লাহ তাআলা সেই ফয়সালা করুন।

 

[সূত্র : মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক মূলতানীকৃত ‘খুতুবাতে শাবান ও রমযান’, পৃষ্ঠা : ১৫৯-১৬৭

অনুবাদ : মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব]

 

 

advertisement