কুরআনের মাস ও কুরআন নাযিলের রাত
পবিত্র রমযান মাস শুরু হতে চলেছে। এটি হিজরী বর্ষের নবম মাস। রমযান মাস হল মুমিন বান্দার নিজেকে পরিশুদ্ধ করা, নেকী অর্জন করা এবং আল্লাহর নৈকট্যের দিকে অগ্রযাত্রার শ্রেষ্ঠ সময়। তাই আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া ও দৃঢ় সংকল্প করা দরকার, যেন এই মূল্যবান সময় ও সুবর্ণ সুযোগের যত বেশি সম্ভব সদ্ব্যবহার করতে পারি। রমযানের শুরু থেকেই প্রতিটি মুহূর্ত নেকী ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ব্যয় হয়। আর রমযানে নিজেকে সংশোধন ও পরিশোধনের যে চর্চা হয়ে থাকে এবং আল্লাহর নৈকট্যের দিকে যে পথ চলা শুরু হয়, তা যেন সারা বছর অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান থাকে।
অনেক কারণেই রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। এই মাস ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাস। রোযার বিধান দেওয়ার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই হল বান্দা যেন তাকওয়া অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমেও সে কথা বলেছেন। এই মাস মহাগ্রন্থ আলকুরআন নাযিলের মাস, যা কিয়ামত পর্যন্ত আগত পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যে রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি। এই মাসে সমস্ত নেক আমলের সওয়াব আল্লাহ তাআলা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন, তাই এ মাস বেশি বেশি নেক আমল ও সব ধরনের গুনাহ থেকে সংযম সাধনের মাস। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ ও সময় অত্যন্ত মূল্যবান। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীতে এ মাসের বিভিন্ন সময় ও অবস্থা সম্পর্কে অনেক মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক কারণে রমযান মহিমান্বিত একটি মাস। তাই স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রমযানে নফল ইবাদত ও নেক আমলের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিতেন। হাদীসের ভাষ্য হল, নবীজী রমযান মাসে বিশেষ করে শেষ দশকে নেক আমলের জন্য কোমর বেঁধে নামতেন।
রমযান : কুরআন নাযিলের মাস
পবিত্র কুরআন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের প্রতি আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ নিআমত। কুরআন এমন আলো, এমন পাথেয় ও সম্বল, এমন সঙ্গী ও পথনির্দেশক, যার অনুগামী না হলে বান্দা পথ হারাবেই, যা সাথে না রাখলে মুমিন নিঃস্ব ও রিক্ত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চলতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন কারীম নাযিল করেছেনই এজন্য, যাতে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত জায়গায় যত মানুষ জন্মগ্রহণ করবে, সবাই আখেরী নবীর অনুসরণ করে এই কুরআনের আলোয় পথ চলে এবং এর বিধানাবলির ওপর আমল করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়াসাল্লামও জীবনভর মানুষকে কুরআনের বার্তা ও বিধান বুঝিয়ে গেছেন। আর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই কুরআন ও তাঁর হাদীসকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরতে। মানবজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্বল মহাগ্রন্থ আলকুরআন আল্লাহ তাআলা রমযান মাসেই নাযিল করেছেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে–
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ .
রমযান মাস; যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য (আদ্যোপান্ত) হেদায়েত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৫
মুমিনের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন কুরআন কারীমের প্রতি মুমিনের অনেক হক রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম হল সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত শেখা। কুরআন তিলাওয়াত শেখা তো সকল মুসলমানের জন্যই ফরয। কোনো মুসলিমের জীবন কুরআন শেখা ছাড়া চলতেই পারবে না। মুমিন-মুসলমানের প্রতি সবচেয়ে বড় বিধান ‘নামায’– কুরআন না শিখলে আদায় করা সম্ভব নয়। কাজেই অন্ততপক্ষে নামায আদায় করা যায়– এই পরিমাণ অংশ তো শিখতেই হবে। এছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর জীবনে আমরা দেখতে পাই, তারা কত বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর রমযান মাসে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এর পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিতেন। হাদীসে এ-ও বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানে পরস্পরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬, ৩২২০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬১৬, ৩৫৩৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত ও তিলাওয়াতকারীর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে–
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ، وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ، لَه أَجْرَانِ.
যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াতে পারদর্শী, সে অতি মর্যাদাবান পুণ্যবান ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবে। আর যে কষ্ট করে আটকে আটকে কুরআন তিলাওয়াত করে, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৯৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৬৬৭, ২৫৩৬৫
এ হাদীসে যে ব্যক্তি ভালোভাবে কুরআন পড়তে পারে, তার জন্য যেমন বিশাল সুসংবাদ রয়েছে, তেমনিভাবে কষ্ট করে ঠেকে ঠেকে যে পড়ে, তার জন্যও দ্বিগুণ সওয়াবের ঘোষণা রয়েছে। এক সওয়াব হল, কুরআন তিলাওয়াতের, আরেক সওয়াব তার কষ্টের বিনিময়ে। যেখানে বান্দার কর্তব্যই হল কুরআন শেখা, তাকে এটা শিখতেই হবে, সেখানে আল্লাহ তাআলা তার এই কষ্টের জন্যও আবার আলাদা করে সওয়াব দিচ্ছেন। এছাড়া আরো বহু হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতকারী আখেরাতে কী বিপুল নিআমত লাভ করবে, কুরআন তাকে আখেরাতের দুর্দশা থেকে কীভাবে বাঁচাবে সে সকল কথা বর্ণিত হয়েছে।
কুরআন নাযিলের এই বরকতময় মাসে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, যারা সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারি না, অবশ্যই কুরআন পড়া শিখব। এমনিই তো কুরআন শেখা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য, তথাপি শিখতে গিয়ে কষ্ট হলে এর প্রতিদানস্বরূপ এবং এই মাসের বরকতে আল্লাহ তাআলা দ্বিগুণ থেকে বহু গুণে বাড়িয়ে সওয়াব দেবেন ইনশাআল্লাহ। আর যারা ইতিমধ্যেই কুরআন পড়তে শিখেছি, আমরা যত বেশি সম্ভব কুরআন তিলাওয়াত করব। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম ও হাজার বছর ধরে আমাদের সালাফে সালেহীনের রমযান মাসের অন্যতম প্রধান আমল ছিল বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা ও শোনা। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
কুরআন কারীমের প্রতি বান্দার আরেকটি হক হল কুরআনের হেদায়েত গ্রহণ করা ও বিধিবিধানের ওপর আমল করা। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন–
وَ لَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ.
বস্তুত আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। সুতরাং আছে কি কেউ, যে উপদেশ গ্রহণ করবে? –সূরা কমার (৫৪) : ১৭
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে–
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوْرِ وَ هُدًی وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ.
হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হেদায়েত ও রহমত। –সূরা ইউনুস (১০) : ৫৭
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমকে উপদেশ গ্রহণের জন্য অনেক সহজ করে দিয়েছেন। শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করতে চায় এমন প্রত্যেকে সহজেই কুরআন থেকে উপদেশ নিতে পারবে। এমনকি অমুসলিমরাও চাইলে এই কুরআন থেকে উপদেশ নিতে পারবে। মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য কুরআনে হেদায়েত রয়েছে। অপার বিস্ময়কর এ গ্রন্থ বান্দা যত পড়বে, তত তার ঈমান ও আল্লাহর প্রতি ভরসা বাড়তে থাকবে। আল্লাহ তাআলা এ কথাও কুরআন কারীমে বলে দিয়েছেন। [দ্র : সূরা আনফাল (৮) : ২]
পূর্বে উল্লেখিত সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীম নাযিল সম্পর্কে বলেছেন–
هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ.
অর্থাৎ এই কুরআন সকলের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফয়সালাকারী। কোন্টা আমার করণীয় আর কোন্টা বর্জনীয়, কোন্টা হক, কোন্টা বাতিল এবং হক ও সত্যের পথে চলা কেন অপরিহার্য, আর এসবের পরিণাম-পরিণতিই বা কী– সেসকল নির্দেশনা আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে কুরআন কারীমে দিয়েছেন। অতএব দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা পেতে চাইলে অবশ্যই জীবনে কুরআনের উপদেশ ও বিধানাবলি মেনে চলতে হবে। আর যারা তা মানবে না, আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে তাদেরকে ‘জালেম’ বলেছেন।
তবে মনে রাখতে হবে, কুরআনের নির্দেশিত করণীয় ও বর্জনীয় বিধানাবলি কীভাবে করতে ও ছাড়তে হবে, সেসকল পন্থা ও পদ্ধতিও কুরআন-হাদীস থেকে শিখতে হবে এবং তা শিখতে হবে উলামায়ে কেরামের কাছে।
আমরা যদি সিরাতে মুস্তাকীমের ওপর অটল-অবিচল থাকতে চাই এবং উভয় জাহানে প্রকৃত সফলতা লাভ করতে চাই, তাহলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, এখন থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কুরআনের অনুসরণে কাটাব। কুরআনের প্রাণ-প্রাচুর্যে সতেজ সজীব হব। আল্লাহ করুন, পবিত্র কুরআনের হেদায়েতে আমাদের হৃদয় ও জীবন সুরভিত ও সুশোভিত হয়ে উঠুক।
শবে কদর : কুরআন নাযিলের রাত
শবে কদর বা কদরের রাত-এর আরবী শব্দ হল লাইলাতুল কদর। এই রাত কুরআন নাযিলের রাত। এই রাত হাজার মাসের চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। কুরআন কারীমে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত সম্পর্কে একটি সূরা রয়েছে। তাতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ، وَ مَاۤ اَدْرٰىكَ مَا لَیْلَةُ الْقَدْرِ، لَیْلَةُ الْقَدْرِ خَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ، تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ الرُّوْحُ فِیْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ، سَلٰمٌ هِیَ حَتّٰی مَطْلَعِ الْفَجْرِ.
নিশ্চয়ই আমি এটা (অর্থাৎ কুরআন) শবে কদরে নাযিল করেছি। তুমি কি জানো, শবে কদর কী? শবে কদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি– ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত। –সূরা কদর
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে–
حٰمٓ، وَ الْكِتٰبِ الْمُبِیْنِ، اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةٍ مُّبٰرَكَةٍ اِنَّا كُنَّا مُنْذِرِیْنَ.
হা-মীম। শপথ কিতাবের, যা (সত্যের) সুস্পষ্টকারী। আমি এটা নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে। (কেননা) আমি মানুষকে সতর্ক করার ছিলাম। –সূরা দুখান (৪৪) : ১-৩
উক্ত আয়াতে মুবারক রাত বলে ‘শবে কদর বা কদরের রাত’ বোঝানো উদ্দেশ্য। কদরের রাত হল কুরআন নাযিলের রাত। এ রাতেই কুরআন মাজীদকে লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে নাযিল করা হয়। তারপর সেখান থেকে অল্প-অল্প করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠানো হতে থাকে।
তবে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী কদরের রাত কোন্টি– তা সুনির্দিষ্ট নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কদরের রাত কোন্টি তা জানানো হয়েছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামকে জানানোর আগেই আবার আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ হেকমতের কারণে এই ইলম উঠিয়ে নেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, হতে পারে, এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। এখন তোমরা এ রাতের বরকত ও ফযীলত রমযানের পুরো শেষ দশকেই অন্বেষণ কর। (দ্র : সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯, ২০২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৭২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৩৬৭৯)
আল্লাহ তাআলার কাজের হেকমত তো আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে এই ফায়েদা তো স্পষ্ট যে, এখন মুমিন বান্দা পুরো দশকেই কদরের কল্যাণ ও বরকত লাভের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ও মনোযোগী হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে কদরের রাত তালাশ করতে এবং প্রতি রাতেই ইবাদতে কাটাতে বলেছেন, যেন কদরের রাতের বরকত ছুটে না যায়। একাধিক হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী শেষ দশকের বেজোড় রাতে কদরের রাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কাজেই রমযানের শেষ দশকের পুরো সময়টাতে বিশেষত বেজোড় রাতগুলোতে বেশি বেশি নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, দুআ ও ইস্তিগফারে রত থাকা উচিত। এজন্য জরুরি হল দুনিয়াবি কাজের ব্যস্ততা যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে ইবাদতে মনোযোগী হওয়া। কোনো মুমিন বান্দার জন্য এটা কাম্য নয় যে, এই অতি মূল্যবান সময়ে দুনিয়াবি কোনো অহেতুক কাজে লিপ্ত হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه.
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ২০১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬০
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে–
قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ، افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَه، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا، فَقَدْ حُرِمَ.
তোমাদের কাছে বরকতময় রমযান মাস এসেছে। আল্লাহ তোমাদের ওপর এ মাসে রোযা রাখা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে শেকলবন্দি করে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বাস্তবিকই বঞ্চিত। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১৪৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৯৫৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২১০৬
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে রাত, কুরআন নাযিলের সেই রাতে আমরা যেন কিছুতেই বঞ্চিতের সারিতে পড়ে না থাকি। আল্লাহ তাআলার সমস্ত রহমত বরকত ও নিআমতের অন্বেষণকারী হই। তিনি যেন তাঁর দয়া ও করুণার বারিধারায় আমাদেরকে পরিপ্লুত করেন। যাদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে, সেই নেক বান্দাদের কাতারে আমাদেরকেও শামিল করে নেন।
লাইলাতুল কদরে যে কোনো দুআ, দরূদ, যিকর, ইস্তিগফার এবং যত বেশি সম্ভব কুরআন তিলাওয়াত ও নফল নামায আদায় করা যেতে পারে। এ রাতের সুনির্দিষ্ট কোনো আমল নেই। তবে সহজপাঠ্য একটি দুআ উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি।
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি আমি শবে কদর পেয়ে যাই, তাহলে কী দুআ করব?
নবীজী তখন তাকে এই দুআ শেখালেন যে–
اَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ، تُحِبُّ الْعَفْوَ، فَاعْفُ عَنِّيْ.
হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন, সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫১৩
আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিলের মাসে কুরআনকে আমাদের হৃদয়ের বসন্ত ও অন্তরের আলো বানিয়ে দিন। আমাদের দেহমনের সকল দুঃখ-কষ্টের বিদূরক ও উপশম বানিয়ে দিন।