রমযানুল মুবারক ॥
সংযম সাধনা ও সংকল্পের মাস
বছর ঘুরে আবারো হাজির হয়েছে পবিত্র মাহে রমযান। ১৪৪৬ হিজরীর এই রমযানুল মুবারকেও বিশ্ব মুসলিমের বিগত বছরগুলো থেকে তেমন পরিবর্তন হয়নি। অনেক বছর থেকেই মুসলমানরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নিপীড়িত, নির্যাতিত। এমনকি মুসলিম জনপদেও, মুসলিম জনসাধারণ জালেম শাসকদের দ্বারা নিষ্পেষিত। তারা একপ্রকার বৈষম্যপূর্ণ ও ইনসাফহীন জীবনযাপন করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই দুর্দশার পেছনে একদিকে যেমন শাসকগণ দায়ী; যে শাসকগণ নিজেদের ঈমানী সম্পদ, যাবতীয় বৈশিষ্ট্য জলাঞ্জলি দিয়ে, আল্লাহর দেওয়া ইনসাফপূর্ণ বিধিবিধান ও ভারসাম্যপূর্ণ নিয়মনীতি এবং সুষম বণ্টনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিহার করে ভিনজাতীয় ও ভিনদেশীয় তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে দেশ চালাচ্ছে।
অন্যদিকে মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ থেকে যাচ্ছে ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা ও তাহযীব-তামাদ্দুনের বাইরে। তারা বংশ পরম্পরায় মুসলিম হলেও, নাম ইসলামী হলেও, ইসলামী শিক্ষা থেকে তাদের অনেকেই বঞ্চিত। ইসলামের আখলাক ও আদব তাদের কাছে নেই। যে কারণে মুসলমান হওয়ার যে স্বাদ, মুসলমান হওয়ার যে শান্তি, একজন মুমিন-মুসলিমের জীবনে যে অনাবিল প্রশান্তি পাওয়ার কথা, একটি মুসলিম জনপদ যেমন শান্তিময় থাকার কথা– সেটা পৃথিবীর অনেক মুসলিম অঞ্চলেই দেখা যায় না।
আসন্ন রমযানুল মুবারকে আমাদেরকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। শাসকরা বদলি হোক বা না হোক, তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসুক বা না আসুক, আমরা মুসলিম সমাজ, মুসলিম জনগণ আগে নিজেদের সংস্কার এবং নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। আমরা পরিবর্তন হলে এর প্রভাব অবশ্যই শাসকদের ওপর পড়বে। রমযানুল মুবারক হোক আমাদের এ সংকল্পের মাস। সংযম ও সাধনা শুরু হোক এই রমযান থেকেই।
আমরা জানি, রমযান সংযমের মাস। কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টভাবে সেগুলো বলা হয়েছে। এই সংযম পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে যেমন হবে, তেমনিভাবে সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি দমনের মাধ্যমেও সে সংযমে উদ্যোগী হতে হবে। পুরো রমযানুল মুবারকে পরিপূর্ণ সাধনার মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। আমি একা ঠিক হলেই হবে না। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কুরআন পড়ার তাওফীক দিয়েছেন, যাদেরকে ইসলামের শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সে অনুযায়ী চলার তাওফীক দিয়েছেন, তারা নিজ পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, পরিজনকেও ইসলামী শিক্ষাদীক্ষার সুশীতল ছায়ায় আনার চেষ্টা করতে হবে এবং এ রমযান থেকেই করতে হবে। কারণ রমযানে মুসলিম মাত্রই মন কোমল থাকে। সে স্রষ্টার দিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে। জীবনের ভুলভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আবার শান্তির ছায়ায় আসতে চায়। সুতরাং তাকে এই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার শ্রেণিকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। অন্যদেরকেও এই সাধনা ও সংযমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সাহায্য করতে হবে।
সাথে সাথে মুসলিম সমাজকে এই রমযান মাসেই ভবিষ্যতের জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। যেন রমযানের সংযম সাধনার প্রভাব আমাদের সামনের জীবনেও থাকে। রমযান পরবর্তী মাসগুলোও যেন আমাদের জীবনে ইসলামের কালজয়ী শিক্ষাদীক্ষার নমুনা থাকে। আমরা হয়ে উঠতে পারি সত্যিকারের মুসলিম। তবেই রমযানের হক আদায় হবে যথাযথ পন্থায় এবং বিশ্বে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর শাসন।
وَقُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَزَہَقَ الۡبَاطِلُ اِنَّ الْبَاطِلَ کَانَ زَہُوْقًا.
এবং বল, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা এমন জিনিস, যা বিলুপ্ত হওয়ারই। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮১
ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলের খায়েশ ॥ <br> ভদ্রলোকের সাধারণ জ্ঞান নিয়েই প্রশ্ন!
সম্প্রতি (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ঈসায়ী) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎকালে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা দখলে নিয়ে নেবেন। গাজাবাসীকে আশপাশের দেশে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর গাজা পুনর্নির্মাণ করবেন। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু এটিকে ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’ বলেছেন। ট্রাম্পকে সাহসী ও সংগ্রামী বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কেবল এই ঘোষণার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন বোমা ফাটাননি। এভাবে ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে অভিষেকের পর থেকেই একের পর এক নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছেন। যেগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী হাসাহাসি হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। এরই মধ্যে তিনি গাজা সংক্রান্ত এ বক্তব্য দেন। অনেকেই এই বক্তব্য হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। অনেকে আবার গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু যারা পৃথিবীর ভৌগোলিক জ্ঞান রাখেন এবং আঞ্চলিক রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, তারা বলছেন, ট্রাম্পের এ ঘোষণা ফিলিস্তিন অঞ্চলের হাল-হাকীকত সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল। তারা বলছেন, ট্রাম্প যেমনটি ভাবছেন এত সহজ নয়। তিনি এমন কোনো উদ্যোগ নিলে নিশ্চিতভাবেই বুমেরাং হবে। তাকে করুণ পরাজয়ের গ্লানি পোহাতে হবে।
ট্রাম্পের এ ধরনের ঘোষণার পর গাজা উপত্যকায় এতদিন ধরে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হামাসও বিবৃতি দিয়েছে। তারাও এটিকে নির্বুদ্ধিতা ও গাজাবাসী সম্পর্কে তার ধারণা ও জ্ঞানের অভাব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হামাস নিজেদের ভূমি শত্রুমুক্ত রাখার বিষয়ে প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ৭ অক্টোবর ২০২৩ ঈসায়ী হামাস পরিচালিত তূফানুল আকসা শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইল এই পনেরো-ষোলো মাস যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, এটি আসলে ইসরাইলের একক যুদ্ধ ছিল না; এখানে আমেরিকার যুদ্ধও ছিল, যা ময়দানে পরিচালিত করেছে ইসরাইল। কারণ এই যুদ্ধের জন্য যত প্রকার সমর্থন দরকার– আর্থিক, সামরিক সব রকম সমর্থনই তারা দিয়েছে। যেমন, তারা তাদের ডুবোজাহাজ ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করে রেখেছিল। যেন প্রয়োজনে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। তারা সকল প্রকার যুদ্ধবিমানসহ সবকিছুরই ব্যবস্থা রেখেছিল। যুদ্ধে শুধু ইসরাইলী সেনাদের লড়তে দেখা গেলেও এটি প্রকৃতপক্ষে জো বাইডেন ও আমেরিকার যুদ্ধও ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে দেখা হলে ট্রাম্প তো আর নতুন কেউ নন; তিনিও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। তার আগেও জো বাইডেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টই ছিলেন। তিনিও পনেরো-ষোলো মাসের যুদ্ধে সমান অংশীদার ছিলেন। গাজার একেকটি শিশু হত্যা, একেকজন নারী হত্যা, একেকজন নিরীহ মানুষ হত্যায় যেমনিভাবে ইসরাইলের কালো হাত রয়েছে, সমানভাবে আমেরিকার কালো হাতও রয়েছে। এসবকিছু বিশ্ববাসী ভালো করেই জানে।
গাজায় ইহুদীদের নির্মম কর্মকাণ্ড থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক যত চেষ্টা হয়েছে, সবগুলোতে বাঁধ সেধেছে আমেরিকা। জাতিসংঘে কতবার ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাশ হয়েছে, কিন্তু আমেরিকা ভেটো দিয়ে অকার্যকর করেছে। কয়দিন আগে আবার দেখা গেল, ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে নিষিদ্ধ করেছেন। তা তো করবেনই। কারণ তারা অপরাধ করতে থাকবে, তাদের বন্ধু ইসরাইল অপরাধ করতে থাকবে, সে অপরাধ কেউ ধরলে জবাব দেওয়ার মতো মুখ তো তাদের নেই। সে মুখ না থাকার কারণে তারা চিন্তা করেছে, আদালতটাই তাহলে বন্ধ করে দেই।
ট্রাম্প এখন গেঁয়ো সরদারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন; যে কোনো যুক্তির কথা শুনতে চায় না। যার কাছে ইনসাফ-চুক্তি-আইন-আদালত সবকিছুই অর্থহীন। শুধু তার বক্তব্যটাই মুখ্য। দেখা যাক, ট্রাম্পের যুগে আমেরিকার মোড়লি কোথায় গিয়ে পৌঁছায়। মাত্র তো দুই মাস হল। আগামী চার বছরে আমেরিকাকে ট্রাম্প কোথায় নিয়ে পৌঁছান, এটা দেখার জন্য বিশ্ববাসীকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
ট্রাম্পের গাজা দখলের অভিলাষ নিছক কথার কথাই থেকে যাবে। আগেও দুয়েকবার বলেছি, তাদের আসলে লজ্জা নেই। তারা ইউটার্ন নিতেও দেরি করে না। কথা ঘোরাতেও সময় নেয় না। কারণ বিশ্বের মোড়ল হওয়ার জন্য সম্ভবত এগুলো দরকার হয়। তখন হয়তো তারা ভুলে যাবে বা তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াও ভিন্ন কথা বলবে। না হলে এটা ইতিহাসে লেখা থাকত, বিশ্বের একটা প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা বিফলে গেছে।
ইনশাআল্লাহ গাজা ফিলিস্তিনীদেরই থাকবে। কোনো শক্তিই গাজাকে তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এ প্রত্যয় যেমন গাজাবাসীর, এ প্রত্যয় যেমন হামাসের, তেমনি এই দুআ পুরো বিশ্বের মুসলমানের মুখে ও মনে রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনকে, ফিলিস্তিনের জনগণকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দান করুন। এই পবিত্র ভূমি পরিপূর্ণভাবে মুসলমানদের ফিরিয়ে দিন– আমীন।