শাবান ১৪৪৬   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৫

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার ॥
যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে নীরবে

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো সমাজে রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব ভয়াবহ হয়ে থাকে। রাজনৈতিক আগ্রাসনের ফলে হয়তো কিছু আন্দোলন হয়, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, বিবাদ-বিসংবাদ বাড়ে কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে একেকটি জাতি ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছে।

এ সমাজে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী একটি মাধ্যম হল স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ এবং প্রায় পুরো বিশ্ব এখন এই আগ্রাসনের তীব্র ধাক্কায় বেসামাল। উত্তরণহীন অধঃপতনে মুমূর্ষু।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ক্ষতি বহুমুখী এবং বহু বিস্তৃত। এত ব্যাপক ক্ষতি ও আগ্রাসনের পেছনে সবচে বড় কারণ হল জীবনের সাথে স্মার্টফোনের ওতপ্রোত সংযুক্তি। জগৎ ও জাগতিক বিষয়ের সাথে ইন্টারনেটের ঘন সংমিশ্রণ। প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের যে আশ্চর্য সম্পৃক্তি তৈরি হয়েছে ইন্টারনেটে, সত্যিই তা নজিরবিহীন।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ক্ষতি তালিকাবদ্ধ করতে গেলে উল্লেখযোগ্য শিরোনামে আসবে সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয়, চোখের গোনাহ, দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি, শারীরিক-মানসিক চাপ, চরিত্র ও চিন্তা-চেতনার বিপর্যয় এবং ঈমানের ভয়াবহ অধঃপতন। এছাড়া কত ঘর-সংসার যে এর মাধ্যমে টুকরো টুকরো হয়েছে, কত জীবন যে বিপন্ন হয়েছে, কত মা-বাবা সন্তান হারিয়েছেন, কত সন্তান হারিয়েছে তার ভবিষ্যৎ এবং কতভাবে কত মানুষ কত ভয়ংকর জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে সেই ফিরিস্তি শেষ হবার নয়।

দেখা যায় অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট প্রয়োজনীয় কাজের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়। এমনকি যারা কঠিনভাবে নিয়ম মেনে চলেন, মজবুত রুটিন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেন, তারাও এখানে সময় বাঁচাতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হন কেবল প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যেই তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে। না চাইলেও এতে বিপুল সময়ের অপচয় হয়, লক্ষ্যমুখী কাজে বিঘ্ন ঘটে।

এটা তো হল সময়-সচেতন ও লক্ষ্যে অবিচল মানুষের ক্ষেত্রে। যারা অসচেতন কিংবা অসতর্ক তারা যে কত রকমের ক্ষতির শিকার হয়, হিসাব করে বের করা যাবে না।

ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলোর একটি হল, চোখের গোনাহ। নেট ব্যবহার করেও এ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে এমন মানুষ বোধহয় হাজারে একজন পাওয়া দুষ্কর হবে। কারণ এখানে সর্বব্যাপী আয়োজনটাই এমন যে, এই গোনাহমুক্ত হয়ে থাকা সম্ভব নয়। ফলে বার বার গোনাহটি করতে করতে একসময় খুব সহজ হয়ে যায় এবং এটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। অথচ হাদীস শরীফে কত কঠিন কথা বলা হয়েছে এ প্রসঙ্গে

زِنَا العَيْنِ النَّظَرُ.

দৃষ্টি নিক্ষেপ হল চোখের যিনা। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৪৩

চোখের গোনাহের যেসকল ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মনোজগতে পড়ে, এখানেও তা পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।

খুব তিক্ত হলেও সত্য যে, এর দ্বারা সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে সমাজের দ্বীনদার শ্রেণি এবং পর্দানশীন পরিবারগুলো। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে, দ্বীনী পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা এবং পর্দানশীন নারীরা আগে অন্তত এই গোনাহে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পেত না। বাবা, স্বামী, ভাই এবং মা ও সংসারের অন্য অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানেই তাদের জীবন পরিচালিত হত। সম্পূর্ণ ঘরোয়াভাবে থাকার কারণে গায়রে মাহরাম কোনো পুরুষকে দেখা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু এই মোবাইল ইন্টারনেটের কারণে এখন আর কোনো তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ কিংবা কোনো নজরদারি তাদের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

এক্ষেত্রে মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত অজুহাত সবচে বড় ভূমিকা পালন করে। আর ভূমিকা পালন করে ‘ইসলামিক ভিডিও’ ও ‘ইসলামী সংগীত’ দেখার অজুহাত। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, এইসব অজুহাত কতটা অনর্থ! এইসব অজুহাতের নামে শয়তান আমাদেরকে কত মারাত্মক ধোঁকায় ফেলছে! একটু দরদের সাথে, পর্দানশীন নারীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিভাবকগণ কি বিষয়টি ভেবে দেখবেন?

ইন্টারনেটের ক্ষতিকে আরো বাড়িয়ে দেয় তার সহজলভ্যতা ও অভিভাবকদের সহজ দৃষ্টি। হাতের নাগালে স্মার্টফোন থাকার কারণে ছোট-বড় যে কেউ যে কোনো সময় তা ব্যবহার করতে পারে। যে কোনো সুযোগে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে তার ক্ষতির দিকসমূহে। পরিবারের ছোট থেকে ছোট কোনো সদস্যও হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা মেসেঞ্জারের ছুঁতোয় নেটে প্রবেশ করতে পারে। অভিভাবকগণও এটাকে সহজভাবে নেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখেন। অথচ এর মাধ্যমেই কত বড় বড় ক্ষতির শিকার হয়ে যায় তারা।

দ্বীনদার অনেক মা-বাবার মুখেও শোনা যায়, শিশুরা নাকি ইউটিউবে মজার ভিডিও আর কার্টুন না দেখে খাবারই খেতে চায় না! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! একটু শান্তভাবে ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে কী দুঃখজনক পরিস্থিতির পরিণতি এটা কিংবা এটা কত ভয়ংকর ক্ষতির পূর্বাভাস!

শুধু এক ইন্টারনেটের মাধ্যমেই দ্বীনদার বা দ্বীনদার নন এমন কত পরিবারের কত সদস্যের চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটেছে এবং কতজনের জীবন ও ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়েছে তা কি হিসাব করে বের করা সম্ভব?

এজন্য প্রথম কাজ হল, যথাসম্ভব ঘরকে ইন্টারনেট মুক্ত রাখা। অন্তত সন্তানের সামনে মা-বাবার দীর্ঘ সময় নিয়ে নেট ব্যবহার ও মোবাইল ফোন দেওয়া থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করা।

মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট এক বিষধর সাপ। এর এক ছোবলে যে কারো প্রাণনাশ হতে পারে। এর ছোবল থেকে বেঁচে থাকা তো সবার সাধ্যের বিষয় নয়! 

 

 

advertisement