তূফানুল আকসা ॥
যেভাবে ঘুমন্ত আরব যুবকদের জাগিয়ে তুলছে
মাওলানা হুযাইফা জাফর
মুসলিম উম্মাহর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গাফলত ও উদাসীনতার অন্ধকার যখন এ উম্মাহর দিগন্তে ছেয়ে যায়, হীনম্মন্যতা ও হতাশা তাকে গ্রাস করতে থাকে, তখন রাব্বে কারীমের দয়ার কিরণ তাকে পথ দেখায়, খোদায়ী রহমতের সঞ্জীবনী স্পর্শ তাকে উজ্জীবিত করে। তেমনই একটি সঞ্জীবনী মুহূর্ত ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর মহান বিপ্লব ‘তূফানুল আকসা’।
বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলিম বিশ্বের –বিশেষত আরববিশ্বের– যুবকদের মাঝে ব্যাপক ও মারাত্মকভাবে উদাসীনতা ও দ্বীনবিমুখতা, পশ্চিমান্ধতা ও প্রবৃত্তিপূজা, অবাধ বিনোদন ও মোবাইলাসক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আরব যুবকদের মাঝে উদ্বেগজনক হারে ইরতিদাদ, ইলহাদ, ধর্মবিদ্বেষ, সংশয়বাদ ও সেক্যুলারিজম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন সময়ে তূফানুল আকসা আরব যুবকদের মাঝে বড় জাগরণ ও অসাধারণ বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।
আরব যুবক যখন দেখে, একটি নিঃস্বম্বল ও নিপীড়িত জাতি –যারা যুগ যুগ ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে বন্দি– যখন অভাবনীয়ভাবে তথাকথিত ‘দুর্ভেদ্য’ ও ‘অজেয়’ অপশক্তির দম্ভ চূর্ণ করে দিল, যার ভয় আরব যুবকের দিল-দেমাগে গেঁথে গিয়েছিল, তখন সে ঈমানী শক্তির সামনে বস্তুশক্তির অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। মুজাহিদীন ও গাজার ভাইদের সবর ও অবিচলতা তাকে আলোড়িত করে। গাজার শিশুদের কান্না তার ভেতরের প্রতিবাদিসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। মুজাহিদ আবু উবাইদার অগ্নিঝরা ভাষণগুলোর একেকটা পংক্তি যেন তার রক্তে দ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়। তার ঘুমন্ত চেতনায় তূফান সৃষ্টি করে! আবু উবাইদা যখন–
))يا أمتنا الإسلامية، يا أحرار العالم (( !
(হে আমার মুসলিম উম্মাহ! হে বিশ্বের মুক্তিকামীরা!!)
–বলে ডাক দেন, তখন তার হৃদয় পচাগান্দা জাতীয়তাবাদের আবর্জনা থেকে পবিত্র হয়ে উজ্জীবিত হয় ‘এক উম্মাহ’ ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনায়।
তিনি যখন বলেন–
))إنه لجهاد، نصر أو استشهاد ((!
(এ তো জিহাদ, হয় বিজয়, নয়তো শাহাদাত!)
–তখন তার ভেতর মৃতপ্রায় জিহাদী চেতনা জীবন ফিরে পায়, যাকে যুগ যুগ ধরে সুকৌশলে হত্যা করা হচ্ছিল!
রণাঙ্গনের বীর ভাই ও গাজাবাসীদের মুখে যখন সে কুরআনের আয়াত শোনে, আয়াতের শব্দ সে হয়তো অনেকবার পড়েছে বা শুনেছে, কিন্তু গাজাবাসীর যবানে আয়াতের যে ব্যঞ্জনা ও মর্ম, তা তাকে অসাধারণভাবে শিহরিত করে। যখন সে ফিলিস্তিন ইস্যুতে পাশ্চাত্যের কপটতা ও দ্বৈতনীতি দেখে, তখন পশ্চিমান্ধ আরব যুবক তথাকথিত ‘মানবাধিকার’ ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’ ও ‘শান্তি’র ফেরিওয়ালা ও ধ্বজাধারীদের প্রকৃত চেহারা দেখতে পায়, ফলে সে পশ্চিমা ব্যবস্থাকে ঘৃণা করতে শুরু করে।
আলজাজিরার একটি প্রতিবেদন এ জাগরণের সাক্ষী। গত বছরের অক্টোবরে আলজাজিরা তার ওয়েবসাইটে ইসলামী জাগরণ ও দ্বীনের পথে আগমনে তূফানুল আকসার ভূমিকা বিষয়ে একটি প্রবন্ধসমগ্র প্রকাশ করে। যার শিরোনাম–
طوفان الأقصى والتدين: يقظة إسلامية جديدة.
এ সমগ্রে সাতটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটি ছিল–
))من معذبي الأرض إلى أحباب الله: كيف عاد الشباب العربي إلى سؤالي الإيمان والتدين بعد السابع من أكتوبر؟((
(ভ্রষ্ট বিতাড়িত জাতি বনাম আল্লাহর প্রিয় বান্দা : ৭ অক্টোবরের পর যেভাবে আরব যুবক ঈমান ও দ্বীনদারীর পথে ফিরে আসে) প্রবন্ধটি লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস হাশেমী। ৭ অক্টোবর থেকেই প্রায় আট মাস ধরে তিনি বহু আরব যুবকের ওপর জরিপ চালান। ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী বিভিন্ন শ্রেণির যুবক-যুবতীর সাক্ষাৎকার নেন, যারা ৭ অক্টোবরের পর নিজেদের জীবন ও চিন্তায় আমূল পরিবর্তন অনুভব করেছে। দ্বীন-ঈমানের পথে ফিরে আসার বিষয়ে তাদের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের, তবে সবার মাঝে যে বিষয়টি এক, তা হল কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। নিম্নে উক্ত প্রতিবেদন থেকে কয়েকজন যুবক-যুবতীর অনুভূতি সংক্ষেপে পেশ করছি।
। এক।
মু‘তায। ৩৪ বছর বয়সী একজন মিশরী কমেডিয়ান ও সাবেক মিশরী সেনা সদস্য। বাল্যকাল থেকেই মাদকাসক্ত। মাদক ছাড়া কাটত না তার দিন। ৭ অক্টোবরের পর তার অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া–
‘৭ অক্টোবর বিশ্বকে নিজের সামনেই নগ্ন করে দিয়েছে। সব ধরনের ওজর-বাহানার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সবার সামনে একটাই প্রশ্ন, তুমি ফিলিস্তিনের জন্য কী করেছ? যখন আমি নিজেকে গাজার যুবকদের সঙ্গে তুলনা করি, নিজেকে অথর্ব মনে হয়। আমি সার্থক হতে চাই। তাই ৭ অক্টোবর থেকে মাদক ছাড়ার কঠিন ব্রতে লেগে আছি। ছোটবেলায় যখন মায়ের রেকর্ডারে সূরা ওয়াকিয়া শুনতাম, এর প্রভাবে এক-দুদিন সেবন বন্ধ থাকত। শয়তানের ধোঁকায় আবার জড়িয়ে পড়তাম। তাই কুরআন শোনা থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। সেদিন এক বন্ধু তিলাওয়াতের রেকর্ড শোনাল, যখন হৃদয়বিদারী কন্ঠে–
قُلْ یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.
[বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার ওপর জুলুম করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। –সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩]–আয়াতটি কানে এল, চোখ অশ্রুসিক্ত হল, হৃদয় বিগলিত হল। সেদিনই বন্ধুর সাথে মসজিদে ফজরের নামায পড়লাম।’
। দুই।
ফাতেমা (৩৯ বছর) একজন মিলিয়নিয়ার আরব ব্যবসায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। সেখানে বড় একটি বিনিয়োগ কোম্পানির মালিক। তিনি বলেন–
‘৭ অক্টোবর আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এখন আমি বুঝে শুনে সম্পদের পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তা আমার এবং আমার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট।’
সম্পদ উপার্জনই ছিল যার দিবানিশির চিন্তা ও জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, এখন তিনি জীবন ও জীবিকাকে অর্থবহ করার জন্য দ্বীনের পথে আসতে চান।
। তিন।
নাদীম (২৮ বছর) একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। রাষ্ট্রীয় ও সামরিক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করেন। একটি দ্বীনদার আরব পরিবারে তার জন্ম হলেও শৈশব থেকেই তার ভেতর ধর্মবিদ্বেষ গজিয়ে ওঠে। নিজ পরিবার ও সমাজ তার নিকট চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। ২০ বছর বয়স থেকে আরব জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীদের লেখা পড়তে ও তাদের চিন্তা লালন করতে থাকেন। আরবের সংকট উত্তরণে বামপন্থীদের সমাধানগুলোই আওড়াতেন। ইসলামপন্থীদের লেখা পশ্চাৎপদ মনে হত। সঙ্গে যৌবনের মৌবনে ও অবাধ যৌনতায় মত্ত ছিলেন। তিনি বলেন–
‘৭ অক্টোবরের পর আমার চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন এল। যখন আমি ইসরাইলী ‘মিরকাভা’ ট্যাংকের ওপর ফিলিস্তিনী পতাকা পতপত করে উড়তে দেখলাম, আমার অন্তরে লিবারেলিজমের সব দেয়াল ধসে পড়ল! নিজেকে হামাস ও ইসলামী আন্দোলনের একজন গর্বিত সন্তান মনে হল। আরব বিশ্বের সংকট নিরসনে আমাদের চিন্তাবিদদের সমাধানগুলো অনর্থক ও পঙ্গু মনে হতে লাগল। আরব সুশীলদের ইসরাইলপ্রীতি ও হামাসবিদ্বেষ আমাকে ব্যথিত করল। তথাকথিত গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ আমার কাছে মিছে মরীচিকা ও আঁধার ভবিষ্যৎ মনে হতে লাগল। সংকট নিরসনে যে কার্যকরী সমাধানের খোঁজে ছিলাম, মনে হল ৭ অক্টোবর তার দিশাই আমাদের দিয়েছে। ৭ অক্টোবরের পূর্বে আমি দ্বীন-ধর্ম ও আল্লাহকে –নাউযুবিল্লাহ– গালমন্দ করতাম, কুফরি কথা আমার মুখে নির্দ্বিধায় উচ্চারিত হত! ৭ অক্টোবরের পর যেন আমার মুখে লাগাম পড়ে যায়। কেননা আমি গাজায় আল্লাহর কুদরত দেখেছি! ফেরেশতাদেরকে যুদ্ধ করতে দেখেছি!! গাজার সামরিক অবস্থান সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা রয়েছে। এ অসম যুদ্ধ অলৌকিক বৈকি! পূর্বে বাবা যখন বদর-উহুদের উপমা টানতেন, তখন আমি ব্যঙ্গ করে এ বলে উড়িয়ে দিতাম, তখন তির-তরবারির যুগ ছিল, এখন আধুনিক যুগে এসব চলবে না! কিন্তু ৭ অক্টোবর আমার স্মৃতিপটে বদর-উহুদকে হাযির করে দিয়েছে। আগে নেপোলিয়নের কথায় বিশ্বাস করতাম, ‘কামান যার বড়, খোদা তার সঙ্গে!’, এখন আমি বিশ্বাস করি–
اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ.
[নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে –সূরা বাকারা (০২) : ১৫৩]
২০১৫ থেকে নামাযের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই! ১৮ই অক্টোবর ২০২৩ ঈ. অনেকদিন পর সর্বপ্রথম নামায পড়ি। নামাযের পর মুসহাফ খুলে শুরু থেকে পড়তে থাকি। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটি আয়াতে এসে থমকে যাই–
وَ اِذَا قِيْلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِي الْاَرْضِ قَالُوْۤا اِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَ.
[যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী! –সূরা বাকারা (০২) : ১১]
এ আয়াত আমার পূর্বের সমস্ত চিন্তাবিভ্রাটের যথার্থ মূল্যায়ন করেছে! আয়াতটি বারবার পড়লাম, অঝোরে কান্না করলাম। এটাই তো আমার আয়াত, এ আয়াতই তো আমি খুঁজছিলাম– একথা ভাবতে ভাবতে আমার হৃদয়মনে আশ্চর্য এক প্রশান্তি ছেয়ে গেল! এভাবে জীবনের প্রথম পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করলাম। এখন আলহামদু লিল্লাহ, কোনো নামায আর ছোটে না। যখনই কুরআন পড়ি, হৃদয়ে মর্যাদাবোধ ও গৌরবের অনুভূতি জাগে। আমি মনে করি, ৭ অক্টোবর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট নিদর্শন, বার্তা এবং পরীক্ষা।’
। চার।
দীমা (৩২ বছর) এক ফিলিস্তিনী জরুরি স্বাস্থ্যসেবিকা। ফিলিস্তিনী জমিদার শ্রেণির ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম। যারা লিবারেল চিন্তা লালন করে, হামাস ও সশস্ত্র প্রতিরোধকে ঘৃণা করে। তিনি বলেন, ‘যখন হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে, তখন স্বাধীনতাযুদ্ধের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা বুঝলাম, যা আমার মতো ফিলিস্তিনীরা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। মুজাহিদদের নিতান্ত সাদামাটা পোশাকে লড়াই করা, অনেকের কুরআনের হাফেয হওয়া, তাদের শাহাদাতে তাদের পরিবারের প্রতিক্রিয়ার ভাষা ও ভঙ্গি, বোমাবারুদের মৃত্যুপুরীতেও ‘এখন আমাদের রবের হক আদায় করতে হবে’ বলে নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া– সবকিছুই আমার কাছে অপরিচিত ও অনন্য ছিল। যে হামাসকে এতদিন ঘৃণা করতাম, তাদের ভালবাসতে শুরু করলাম। নামায আদায় ও কুরআন পড়া শুরু করলাম। এই প্রথম নামাযে ইমামের মুখে সূরা যিলযাল শুনে আমার শরীরে ‘যালযালা’ (কম্পন) হল! কুরআন শেখার মজলিসে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম। দ্বীনের মাধ্যমে জীবনের নতুন দিগন্ত পেলাম।’
সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, গাজার এমন বিভীষিকা ও বিপর্যয়, জায়োনিস্টদের এমন গণহত্যা ও জাতিনিধন দেখে কি আপনার এ ঈমানী অনুভূতি লোপ পায়নি?
দীমা জবাবে বলেন, ‘না। কারণ ৭ অক্টোবরের পর আমার দিলে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে, আমাদের বিজয় অবধারিত। এবং এর জন্য কুরবানী ও ত্যাগ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই!’
। পাঁচ।
সালমা (২৫) একজন শিল্পকলার ছাত্রী। পশ্চিমতীরে ইসরাইলের অধীনে থাকা একটি ফিলিস্তিনী পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। বলেন, ‘আমরা ইসরাইলকে স্থায়ী ভাগ্য ও অনস্বীকার্য বাস্তবতা ভাবতাম, ইসরাইলের অধীনে থেকেই নিজেদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ কল্পনা করতাম। কিন্তু ৭ অক্টোবর আমাদের ধারণার সমীকরণ পাল্টে দিল। আমার ভাইয়েরা ইসরাইলের বুকে ঢুকে তাদের বুকে বন্দুক তাক করছে– এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছিল! তা দেখে হতাশার দিগন্তে আশার ভোর উঁকি দিল। আসলে লিবারেলিজম ও জাতীয়তাবাদের চেতনা ও শিক্ষাগুলো আমাদের কোনো কার্যকরী সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ইসলামকে অন্য সব ইজমের কাতারে দাঁড় করানো। ইসলাম এসবের চেয়ে অনেক অনেক মহান। এতেই একমাত্র আমার এবং আমাদের মুক্তি!
ঘটনার পর নামায ধরলাম। প্রথম নামাযে জায়নামাযে বসে অঝোরে কাঁদলাম। এমন মমতার আশ্রয় ও শান্তির উৎস আমার এত নিকটে থেকেও আমি এর ব্যাপারে কতটা উদাসীন ছিলাম!
। ছয়।
সামির (২৭) একজন সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক। পশ্চিমা সাহিত্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন দিবানিশি। বিকৃত যৌনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ৭ অক্টোবরের পর তার বক্তব্য, ‘ফিলিস্তিন কখনো মিষ্টি কথায় এবং শান্তিপূর্ণ চেষ্টায় স্বাধীন হওয়ার নয়।’ তার পরিবার ও সমাজ এতদিন তাকে দ্বীন থেকে দূরে রেখেছে, তাই তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এখন জার্মানিতে নিয়মিত কুরআনের দরসে বসেন। প্রতিদিন তিলাওয়াত করেন। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের ‘মুনাফিক’ ও ভণ্ড মনে করেন। বলেন, ‘যখন মিছিলে বের হই, ঈমান আমাকে এক ঐশী নিরাপত্তাবোধ দান করে, সব ভয় দূর করে দেয়।’ আরো বলেন, ‘এখন আমি বিয়ে করতে চাই, সন্তানের বাবা হতে চাই, যাতে তাদের একথা শেখাতে পারি, ‘সীন’-এ ‘সিলাহ’ (অস্ত্র), ‘মীম’-এ ‘মুকাওয়ামা’(জিহাদ)!
। সাত।
ওয়াফা (৩১) এক ফিলিস্তিনী নারী শিল্পী। পশ্চিমা শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর ইসলামের প্রতি বিরাগী হয়ে ওঠেন এবং সংশয়বাদীতার অন্ধকারে ডুবে যান। নারী সংক্রান্ত বিধানের কারণে নাউযুবিল্লাহ সূরা আহযাবকে ঘৃণা করতেন। জীবনের সাতটি বছর কাটান দ্বীন-ধর্ম থেকে বহু দূরে! তার জীবনে পরিবর্তনের সূত্রপাত তূফানের পূর্ব থেকেই। যখন তিনি সন্তানের মা হলেন, মনে প্রশ্ন জাগল, তাকে কোন্ আদর্শে লালন করবেন? একবার স্পেন ভ্রমণে যান, গারনাতা ও কুরতুবার (গ্রানাডা ও কর্ডোভার) মুসলিম স্থাপনাগুলো দেখে প্রভাবিত হন, নিজেকে এই মহান আদর্শের সন্তান ভেবে পুলকিত হন এবং নিজ সন্তানের জন্য এ আদর্শই বেছে নেন। তূফানের পর এই পরিবর্তন আরো বেগবান হয়। বলেন, ‘যখন পুরো বিশ্ব আমাদের দমনে একজোট হয়ে গেল, তখন সে সূরা আহযাবই আমার কাছে প্রিয় সূরা হয়ে উঠল! কারণ এতে শত্রু ও মুনাফিকদের চরিত্র খুলে খুলে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ইসরা ও মুনাফিকূনের আয়াতও আমি বাসায় টাঙিয়ে রেখেছি। এখন আমি পশ্চিমা সবকিছুকে ঘৃণা ও অস্বীকার করি। পশ্চিমা সভ্যতার সারকথা হল–
باطل بني على باطل
(মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা।)
ইসলাম এ বস্তাপচা সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে কখনো যায় না। ‘উদার চিন্তা’, ‘গ্লোবাল সিটিজেনশিপ’ (বিশ্বনাগরিকত্ব) ইত্যাদি যা কিছু আমরা এতদিন পূজা করে এসেছি, সবই কেবল মিছে দেবতা। আসলে পৃথিবীর বাস্তবতা হল এখানে একজন শোষক, অপরজন শোষিত। আর এসব শ্লোগান হল শোষণের মন্ত্র’!
তিনি বলেন, ‘অসলো চুক্তি আমাদের পশ্চিমতীরবাসিদের ধ্বংস করে দিয়েছে! আমাদেরকে অর্থ ও দুনিয়ার পেছনে লেলিয়ে দিয়ে, পশ্চিমা সভ্যতার দাস বানিয়ে আমাদের জাতিসত্তাকে নিধন করেছে।’
আরো বলেন, ‘এখন আমার কাছে পর্দা ও নেকাব মধুর মতো প্রিয়!’
। আট।
নাওয়াল (৩৮) পশ্চিম তীরের একজন নারী। আমেরিকা ছিল যার স্বপ্নের রাজ্য। ২০১৬-এ তিনি সেখানে যান। একজন নওমুসলিম আমেরিকানকে বিয়ে করে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পান। স্বামীর সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইউটা রাজ্যে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর সবকিছু যেন পাল্টে গেল! বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে সবাই আমাকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে মানসিক নির্যাতন করতে শুরু করল। আমি তাদের ভালবাসতাম, কিন্তু ঘটনার পর তারা আমাকে শত্রু মনে করে, রাস্তায় এক ব্যক্তি তো ‘সন্ত্রাসী’ বলে আমার ওপর হামলাও করে বসে। মনে হল যেন শত্রুদেশে বাস করছি! তাদের প্রকৃত চেহারা দেখলাম। আমাদের ভাইদের হতাহতের ছবি দেখলে তা তাদের একটুও স্পর্শ করে না। অথচ ইসরাইলী হতাহতের ব্যাপারে মিডিয়ার মিথ্যা সংবাদে কুম্ভীরাশ্রু ঝরায়। গাজার পক্ষে কথা বলায় অনেককে চাকরি হারাতে হয়, কোথায় গেল তাদের ‘বাকস্বাধীনতা’! মূলত তাদের বিদ্বেষ শুধু ফিলিস্তিনের সঙ্গে নয়; ইসলামের সঙ্গে। আমার বুঝে এল, একমাত্র ঈমানই আমার সম্বল। তাই আমেরিকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ পাপিষ্ঠ অর্থনীতিকে এক পয়সাও দিতে চাই না। এমন দেশে যেতে চাই, যেখানে সন্তানদের দ্বীনী মূল্যবোধে গড়তে পারব। আগে আমি গর্ভধারণে আগ্রহী ছিলাম না, এখন একের পর এক সন্তান প্রসব করে তাদের দ্বীনী তরবিয়ত দিতে চাই। নিজেও দ্বীনের কাজে নিয়োজিত হতে চাই। আমাদের শত্রুরা ব্যবসার মাধ্যমে পরস্পরের সহযোগিতা করে, আমাদেরও নিজ উম্মাহর এভাবে সহযোগিতা করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যবসায়িক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়া উচিত।’
এ তো গেল মুসলিম যুবকদের কথা; এছাড়াও তূফানুল আকসার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বহু অমুসলিমের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন এবং ইসলামের মহাদৌলত দান করেছেন, যাদের নিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধে আলোচনা হতে পারে।