সিরিয়া : বিদ্রোহ ও বাশার আলআসাদের পতন
মাওলানা আনাস চৌধুরী
খলীফা উমর রা.-এর শাসনামলের প্রথম দিকে প্রখ্যাত সাহাবী আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.-এর নেতৃত্বে সিরিয়া অঞ্চলটি মুসলমানরা জয় করে। কালের পরিক্রমায় অঞ্চলটি শাসন করেছেন উমাইয়া, আব্বাসীসহ অনেক শাসক। একপর্যায়ে ১৫১৬ সালে মামালিকদের থেকে উসমানীরা সিরিয়া জয় করে। তারপর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে দেখা দেয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ।
এই ধারাবাহিকতায় ১৯১৬ সালে উসমানীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় আরব বিদ্রোহ। এর দুই বছর পর আমীর ফয়সাল হুসাইনের নেতৃত্বে আরব বাহিনী সিরিয়া দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে তারা ঘোষণা করে ‘সিরিয়ান আরব সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার। এভাবে সিরিয়া থেকে উসমানীদের শাসন বিলুপ্ত করা হয়। পুরো কাজটা ঘটেছিল ব্রিটিশদের পরিকল্পনা, সমর্থন ও সহযোগিতায়।
কিন্তু `সিরিয়ান সাম্রাজ্য' ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এই অঞ্চল দখল করে নেয় ফরাসীরা। অবশ্য সিরিয়ায় ফরাসী আধিপত্যের পেছনে একটি ঐতিহাসিক গোপন চুক্তি ক্রিয়াশীল ছিল। চুক্তিটি হয়েছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। ১৯১৬ সালের মে মাসে। ইংরেজ কূটনীতিবিদ মার্ক সাইকস ও ফরাসী কূটনীতিবিদ জর্জ পিকোর নেতৃত্বে এটি সম্পন্ন হয়েছিল বলে একে `সাইকস-পিকো চুক্তি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উসমানীদের শাসনাধীন বিস্তৃত অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও সেখানকার মৌলিক সংকটগুলো বোঝার ক্ষেত্রে এই গোপন চুক্তিটি সম্পর্কে জানা জরুরি।
যাহোক, ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স সিরিয়াকে নিজেদের কলোনি হিসেবে দখল করে রেখেছিল। বিভিন্ন সময় সিরিয়ার জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। অবশেষে ১৯৪৬ সালে ফরাসীদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে সিরিয়ানরা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
১৯৪৯ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত সিরিয়া মিশরের সাথে একীভূত হয়ে যায়। `আরব কমিউনিস্ট বাথ পার্টি'র অভ্যুত্থানে এই ঐক্য ভেঙে সিরিয়া আবার আলাদা হয়ে যায়। ১৯৬৩ সালে এই কমিউনিস্ট পার্টিটি দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং জরুরি অবস্থা জারি করে। বাথ পার্টির নিয়ন্ত্রণ মূলত আলাবী শিয়া আর্মি অফিসারদের হাতে ছিল। এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেও কয়েকবার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
আলাবী সম্প্রদায় ও সিরিয়ান আর্মি সম্পর্কে মৌলিক কথা
সিরিয়ার চলমান প্রেক্ষাপট বোঝার ক্ষেত্রে সিরিয়ান আর্মি সম্পর্কে একটি মৌলিক বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। ফরাসীরা এই দেশটি দখল করে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিশেষ আনুকূল্য দান করেছিল। বিশেষত দুরুয ও ইসমাঈলী শিয়াদের মধ্যে নুসাইরিদেরকে সেনাবাহিনীতে অধিক পরিমাণে সুযোগ দেয়। এই নুসাইরিদের নাম পরিবর্তন করে `আলাবী' (হযরত আলী রা.-এর দিকে সম্বন্ধিত) নামটি তারাই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছে। ফরাসীরা যখন সিরিয়া ছেড়ে চলে যায়, তখন সেখানে যে সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, এর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবটাই আলাবীদের হাতে আসে, যারা ফরাসীদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ও তাদের তৈরি। যদিও বাহিনীতে মুসলিমদের অংশগ্রহণ ছিল, কিন্তু অফিসার পর্যায়ে আলাবীদেরই আধিক্য ছিল।
আলাবীদের ধর্মবিশ্বাস কী? বস্তুত অন্যান্য শিয়াদের চেয়ে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের আকীদা-বিশ্বাস ধর্মীয় কাজ-কর্ম সবকিছু গোপনীয়। একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছার পরই আলাবী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি সেই গুপ্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। এর বাইরে অন্য কারো কাছে এগুলো প্রকাশ করে না গুপ্ত সম্প্রদায়টি। তবে তারা মুসলিম নয়; বরং চরম ইসলামবিদ্বেষী। সত্য হচ্ছে, তাদের মধ্যে নাস্তিকতার বিস্তার ভয়াবহ পর্যায়ে। ইসলাম ও ইসলামে সম্মানিত এমন যে কোনো বিষয়ে উপহাস-বিদ্রুপ করা আলাবী আর্মি ও অফিসারদের নিত্য রুটিন।
হাফেজ আসাদের ক্ষমতা দখল
১৯৭০ সালে বাথ পার্টির নেতা, আর্মি অফিসার হাফেজ আসাদ অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেন। তার পার্টির চিন্তা দর্শন সিরিয়ান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন। মানুষের স্বাধীনতা ও সম্মান ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয় তার হাতে। এক পার্টির দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ইসলামপন্থীদের তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮০ সালে `আইন-৪৯' জারী করে ইখওয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন প্রত্যেককে ফাঁসির আদেশ দেন। তখন জেল, জুলুম ও দেশান্তরের মাত্রা চূড়ান্তরূপ ধারণ করে। ১৯৮২ সালে `হামায়' হাফেজ বাহিনী ঘটায় বর্বর ট্রাজেডি। সেখানে তারা ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করে।
১৯৭৩ সালে সিরিয়ান আর্মি লেবাননের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ২০০৫ সালে রফীক হারীরীর হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সিরিয়া সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
বাশারের ক্ষমতা গ্রহণ
২০০০ সালে হাফেজ আসাদের মৃত্যু হলে সংবিধান পরিবর্তন করে তার ছেলে বাশার আসাদকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। বিরোধী পক্ষকে দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে বাশার তার পিতার পথ থেকে সরে আসেননি।
সে বছর সেপ্টেম্বরে `নাগরিক সমাজ' রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ও জরুরি অবস্থা অবসানের দাবি উত্থাপন করে। ২০০৫ সালে `দামেস্ক ঘোষণা' পেশ করে বিরোধী দল ও ব্যক্তিবর্গ। এটিই ছিল প্রকাশ্যে সরকার-বিরোধী প্রথম কার্যক্রম। কিন্তু পরিণতিতে এর সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের শিকার হতে হয় দমন-পীড়নের।
২০১০ সালে তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে আরব বসন্ত শুরু হলে এর ঢেউ সিরিয়ায়ও আছড়ে পড়ে। ২০১১ সালের শুরুর দিকে ঘটে যায় কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ১৭ ফেব্রুয়ারি একজন পুলিশ সিরিয়ান নাগরিককে মারধর করে। ২২ ফেব্রুয়ারি কিছু যুবক দামেস্কে অবস্থিত লিবিয়ান দূতাবাসে গাদ্দাফি বিরোধি বিদ্রোহের সমর্থনে স্লোগান দেয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে দারআ`র আরবাঈন স্কুলের কয়েকজন কিশোর, যাদের বয়স দশ থেকে চৌদ্দ বছর, দেয়ালে বাশারের পতন চেয়ে স্লোগান লেখে, `ডাক্তার, এবার আপনার পালা এসে গেছে!'
ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ান সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। কিশোরদেরকে গ্রেফতার করে। ছাড়িয়ে আনতে গেলে কিশোরদের অভিভাবকদের অপমান করে আসাদের গোয়েন্দা অফিসার। এই কথা বলে তাদের ফিরিয়ে দেয়, `এই বেয়াদব বাচ্চাদের কথা ভুলে যাও, তোমরা নতুন বাচ্চা জন্ম দাও, না পারলে তোমাদের নারীদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিও, আমরা...।'
১৫ মার্চ মধ্য দামেস্কে অবস্থিত `মুহাইমিদিয়া' বাজারে স্বাধীনতার দাবিতে প্রথম মিছিল হয়। ১৮ মার্চ `জুমআতুল কারামাহ' নামে দামেস্ক, হিমস, দারআ প্রভৃতি অঞ্চলে জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। দারআর মিছিল ছিল সবচে বড়। হুসাম আয়্যাশ ও মাহমুদ জাওয়াবিরা শহীদ হন। এতদিন পর্যন্ত সিরিয়ানদের দাবি ছিল সংস্কার, স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা। কিন্তু গুলি বর্ষণ ও সীমাহীন নিপীড়নের ফলে বাশার সরকারের পতনের দাবি শুরু করে রাজপথের বিদ্রোহী জনতা।
শহরে নগরে জনসাধারণের অংশগ্রহণে বিভিন্ন কমিটি গড়ে ওঠে। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করত। ১৮ আগস্ট ২০১১ সিরিয়ান বিদ্রোহের `আলহাইআতুল উলইয়া' গঠিত হয়। ৪০টি দল এতে অংশগ্রহণ করে, যাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা।
সিরিয়ান আর্মি যখন নির্বিচারে জনসাধারণের ওপর গুলি শুরু করে, তখন থেকেই কিছু ভাঙন দেখা দেয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের মধ্যে। এপ্রিল মাসে ওয়ালিদ কাশয়ামি, জুনে আবদুর রাযযাক তাল্লাস ও হুসাইন হরমুশ ঘোষণা দিয়ে সরকারি বাহিনী ত্যাগ করেন। ৩ আগস্ট কর্ণেল রিয়াদ আসআদ অন্যদেরকে সাথে নিয়ে `স্বাধীন সিরিয়ান বাহিনী' গঠন করেন। এই বাহিনীর লক্ষ্য ছিল বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করা। পরে অবশ্য তারা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করে। ইদলিব, রীফ হালাব, রীফ হামা, হিমস, গৌতা ও দারআর কিছু অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
অনেকে মনে করেন, সিরিয়ান বিদ্রোহকে `কলঙ্কিত' করতে বাশার ইরাক ফেরত বন্দি মুজাহিদদের বড়ো একটি অংশকে সিদনায়া কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। যাতে করে তারা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সম্মুখ সারিতে চলে আসে আর বিশ্বকে দেখানো যায়, `আমরা তো `ইসলামিস্টদের' দমন করছি!' কারণ যাইহোক, বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামী পক্ষগুলো শুরু থেকেই সিরিয়ান বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
নুরুদ্দীন যিঙ্কি ব্রিগেড গঠিত হয় পহেলা নভেম্বর ২০১১। শায়েখ তাওফীক শিহাবুদ্দীন এর নেতৃত্ব দেন।
১১ নভেম্বর ২০১১ গঠিত হয় `হারাকাতু আহরারিশ শাম'। তারা ইদলিব ও হালাব কেন্দ্রিক সক্রিয় হয়। হাসসান আব্বুদ ছিলেন এর কমান্ডার।
হিমসে গঠিত হয় `জাবহাতুন নুসরাহ' ২০১১-এর শেষ দিকে। ২৪ জানুয়ারি ২০১২ আবু মুহাম্মাদ (আহমদ শারা) আলজোলানি আনুষ্ঠানিকভাবে এর ঘোষণা দেন। এছাড়া ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হাতে আরো অনেক বাহিনী গড়ে উঠে, যারা স্বশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ করে।
সিরিয়ান সরকার মিছিল ও বিক্ষোভ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে খাদ্য ঔষধ বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। শহরে নগরে পাড়ায় মহল্লায় আক্রমণ করে। ফলে `নবগঠিত সেনাবাহিনী' আত্মসমর্পণ করে বা চুক্তিতে যায়। এভাবে খালেদিয়া, বাবা আমর, কাসীর, হালাব, গৌতা প্রভৃতি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে নেয় বাশার বাহিনী।
বিরোধীদের দমনের লক্ষ্যে ২০১২ সালের মার্চ থেকে বিমান হামলা শুরু করে। নাগরিকদের ঘরবাড়ির বাইরে স্কুল হাসপাতালসহ সর্বত্র নির্বিচারে বোম্বিং করে। এক সূত্রমতে ২২২ বার ‘ক্যামিক্যাল বোমা’ ব্যবহার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গৌতায় ২১ আগস্ট ২০১৩ গণহত্যা চালায় বাশার বাহিনী।
সিরিয়ান বিদ্রোহের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য ২০১১ সালের শেষ দিকে `সিরিয়ান জাতীয় পরিষদ' গঠন করা হয়। পরিষদ প্রধান হয়েছিলেন বুরহান গালইউন। এতে অংশ নিয়েছিল সরকার বিরোধী বিভিন্ন পক্ষ থেকে ৩১০ জন প্রতিনিধি। কিন্তু এটি সিরিয়ানদেরকে প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। ২০১২ সালের নভেম্বরে কাতারের দোহায় একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে 'আলই`তিলাফ আলওয়াতানী' গঠিত হয়। এর প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন রিয়াদ সাইফ (লিবারেল)। প্রথমে এর সদস্য ছিল ৬৩ জন। পরে ১১৩ জনে উন্নীত হয়। আমেরিকাসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র একে সিরিয়ান নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এই পরিষদেরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩০ জুন ২০১২ সালে জেনেভায় প্রথম কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়া ও চীন বাশারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, তুরস্কসহ অনেক দেশই অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি জানায়। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সাতটি কনভেনশন হলেও মাঠ পর্যায়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বন্ধ হয়নি হত্যাযজ্ঞও।
বাশারের পক্ষে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ
বাশারের হয়ে তিনটি বিদেশি পক্ষ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে :
এক. শিয়া মিলিশিয়া। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান, ইরাক, লেবানন ও আফগানিস্তানের শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী যুদ্ধ করতে থাকে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হিজবুল্লাহ সরাসরি অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়।
দুই. ইরান। যদিও ইরান বাশারের পুরোনো পরীক্ষিত বন্ধু দেশ এবং সে হিসেবে অর্থ অস্ত্র দিয়ে শুরু থেকেই সিরিয়া সরকারের পাশে থেকেছে। তবে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ইরানী অফিসাররা সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনায় জড়িত হয়।
তিন. বাথ পার্টি। তারা কমিউনিস্ট হওয়ায় রাশিয়ার সাথে হাফেজ আসাদ ও বাশার আসাদের সাথে আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল। সর্বাত্মক সহযোগিতার পাশাপাশি ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। এই রুশ হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দুটি দাবি করে রাশিয়া :
এক. সিরিয়ার একটি বৈধ সরকারকে তারা সহযোগিতা করছে।
দুই. সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে নিরাপত্তা পরিষদের `সিদ্ধান্ত-২২৪৯' অনুযায়ী।
সিরিয়ায় আইএস ও নুসরা ফ্রন্টের লড়াই এবং নুসরার আধিপত্য
`নুসরা ফ্রন্ট' শুরুতে আইএসের সাথে থাকলেও দ্রুত সময়ের ভেতরে নিজেকে আলাদা করে নেয়। ২০১৪ সালে আলকায়েদার আইমান আলজাওয়াহিরীর হাতে বাইআত গ্রহণ করে তারা। এভাবে আইএসের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে একসময় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছিল। আইএসের প্রভাব সিরিয়াতে কমে নুসরা ফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য পক্ষ নুসরাকে সাহায্য করেছিল। তবে আলকায়েদা সংশ্লিষ্টতার কারণে নুসরা ফ্রন্টকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত করে আমেরিকাসহ অনেকেই। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেও সমস্যা হচ্ছিল। একারণে ২৪ জুলাই ২০১৬ সালে নুসরা প্রধান আবু মুহাম্মাদ জোলানি (আহমদ শারা) আলকায়েদার সাথে তার বাহিনীর সম্পর্ক না থাকার ঘোষণা দেন। একইসাথে ‘নুসরা ফ্রন্টে’র পরিবর্তে দলের নাম রাখেন `ফাতহুশ শাম ফ্রন্ট'।
আস্তানা চুক্তি ও `হাইআতু তাহরীরিশ শাম' গঠন
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের উদ্যোগে একটি সংলাপের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধানত এই তিন দেশ, বাশার সরকার ও বিদ্রোহীদের বড় একটি অংশ শরীক হয়। উদ্দেশ্য ছিল ইদলিবসহ আরো কিছু অঞ্চলে যুদ্ধ বিরতিতে যাওয়া এবং দায়েশ ও নুসরা ফ্রন্টের মতো গোষ্ঠীদের দমন করা।
জোলানিসহ সিরিয়ায় জিহাদরত অনেকেই এই সংলাপকে ষড়যন্ত্র ও গাদ্দারি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশেষত এতে রাশিয়ার অগ্রণী ভূমিকার কারণে। এদিকে নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষও কমানো দরকার। এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ সালে একটি সামরিক মোর্চা গঠন করা হয়। নাম, হাইআতু তাহরীরিশ শাম (সংক্ষেপে HTS )। এতে অংশ নেয় :
১. ফাতহুশ শাম ফ্রন্ট
২. নূরুদ্দীন যিঙ্কি ব্রিগেড
৩. আনসারুদ্দীন ফ্রন্ট
৪. লিওয়াউল হক
৫. জাইশুস সুন্নাহ প্রভৃতি।
এই সামরিক জোট অন্যান্য দল-উপদলের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেয়। ২০১৮ সালে যিঙ্কি ব্রিগেড তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে তারাও আক্রমণের শিকার হয়। হাইআর প্রধান নির্বাচিত হন হাশেম শায়েখ (আবু জাবের)। তাদের প্রধান টার্গেট বাশারের পতন নিশ্চিত করা। হাইআ একক ও স্বতন্ত্র সত্তাসহ নিজেকে পেশ করে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা চিন্তাকে অবলম্বন করেনি। তা স্বত্ত্বেও আমেরিকা ও তুরস্ক হাইআকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে।
আলফাতহুল মুবীন অপারেশন রোম
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এটি গঠিত হয়। এতে হাইআর সাথে অংশ নেয় আহরারুশ শাম, জাতীয় ফ্রন্ট ও হিযব তুরকিস্তানীর কিছু গ্রুপ। তারা সে বছরই `ওয়ালা তাহিনূ' অপারেশনের ঘোষণা দেয় বাশার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে নতুন সামরিক বিন্যাসের ঘোষণা দেয় হাইআ।
২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর উক্ত বাহিনীগুলো নিয়েই আরেকটি সামরিক জোট তৈরি করা হয়। সে দিনই হাসান আব্দুল গনী `রাদউল উদওয়ান' অপারেশনের ঘোষণা দেন। এই অপারেশনের কমান্ডার ইন চীফ হলেন আহমদ শারা (আবু মুহাম্মাদ জোলানি)। ঘোষণার বারো দিনের মাথায় ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারা দামেস্ক বিজয় করেন। আলহামদু লিল্লাহি হামদান কাসীরা। এক্ষেত্রে হাইআতু তাহরীরিশ শাম সবচে বড় ভূমিকা পালন করে।
সিরিয়ান বিদ্রোহীদের এই অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে কোনো দেশ (তুরস্ক বা আমেরিকা) সহযোগিতা করেনি। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, কোনো দেশ এই অপারেশন সম্পর্কে আগে থেকে অবগতই ছিল না।
কাসাদ (কুর্দি) ও সিরিয়ায় আমেরিকান স্বার্থ
২০১২ সালের জুলাইয়ে কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয়। তারা কুর্দিদের অঞ্চলে স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ফলে কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই বাশার বাহিনী সেখান থেকে সরে আসে।
১০ অক্টোবর ২০১৫ সালে হাসাকা অঞ্চল থেকে `কাসাদ' বা সিরিয়ান গণতান্ত্রিক বাহিনী গঠনের ঘোষণা আসে। মূলত কুর্দি বিদ্রোহীদের সংগঠন এটি। যদিও তারা সকল সিরিয়ানদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে আসছে। অনেকের মতে, এখানে মাত্র ৩% আরব আছে। আমেরিকা এদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। বিশেষত দায়েশের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্রও দিয়েছে। আবার রাশিয়াও তাদের সহযোগিতা করেছে স্বাধীন সিরিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। বাশারের সাথেও তাদের সম্পর্ক অনেকটাই ভালো ছিল। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাশারের কাছে তারা তেল বিক্রি করত। মূলত সিরিয়ার তেল গ্যাস ও কৃষিতে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এখানেই আমেরিকান স্বার্থ স্পষ্ট।
তবে তুরস্ক কাসাদকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। বাশারের পতনের পরও তাদের কর্তৃত্ব বহাল রয়েছে। নতুন সরকারের সাথে তারা প্রায়ই লড়াই করে থাকে।
সিরিয়ান বিদ্রোহে ক্ষয়-ক্ষতি
সিরিয়ান মানবাধিকার নেটওয়ার্কের তথ্য মতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩০ হাজার ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ২৭২ জনকে শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাশিয়া হত্যা করেছে ৭ হাজার মানুষ। এর মধ্যে শিশু আছে ২ হাজার জন। ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮১৬ জনকে বন্দি করা হয়েছে বা নিখোঁজ রয়েছে। ১৪ মিলিয়ন মানুষ ঘড়ছাড়া হয়েছে।
বাশারের পতনের পর
বাশারের পতনের পর ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ আহমদ শারা-এর নেতৃত্বে মুহাম্মাদ আলবাশীরকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। যার মেয়াদ হবে তিন মাস। মন্ত্রী পরিষদে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা প্রায় সবাই হাইআর সদস্য এবং ইদলিব অঞ্চলে গঠিত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাশারের পতনে কেন এত দেরি হল?
মূল কারণ তো একমাত্র আল্লাহ তাআলারই জানা। তবে এখানে বাহ্যিক কয়েকটি কারণের দিকে ইঙ্গিত করা যেতে পারে। প্রথমত, সিরিয়া বিদ্রোহ চূড়ান্তে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়। ফলে এই সময়ে বিদ্রোহীদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়। বেড়ে যায় সন্দেহ অবিশ্বাস ও দূরত্ব। তাছাড়া বাশারের পতনের পর কেমন সরকার আসবে– পরিপূর্ণ ইসলামী, সেক্যুলার, নাকি মাঝামাঝি কোনো সরকার গঠিত হবে– এ নিয়েও তৈরি হয় চরম বিতর্ক। অথচ তখন দরকার ছিল একতাবদ্ধ হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করা যায় তা হচ্ছে, বিদ্রোহীদের সিংহভাগ ছিলেন বয়সে তরুণ। অনেকেই ছিলেন শিক্ষানবিশ। তারা বেড়ে উঠেছেন বাশারের একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে। একরকম আবদ্ধ সমাজে। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা ছিলই না বলা যায়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মিলে একসাথে কাজ করার দক্ষতারও অভাব ছিল। অথচ বিদ্রোহকে সফল করতে এগুলোর প্রয়োজন প্রশ্নাতীত।
আরেকটি বিশেষ কারণ হচ্ছে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো চিন্তা ও কর্মকৌশলগত দিক থেকে নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। খোদ ইসলামপছন্দ দলগুলোর মধ্যে এই বিভাজন তৈরি হয়েছে। এমনকি তারা একে-অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র পর্যন্ত হাতে নিয়েছিল। এভাবে তাদের শক্তি চরমভাবে খর্ব হচ্ছিল। অপরদিকে বাশার বাহিনীতে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ছিল একক নেতৃত্ব। মতানৈক্য ও বিভাজন বলতে গেলে ছিলই না।
এই ছিল বিদ্রোহীদের দিক থেকে কিছু কারণ। এর বাইরে আরো কিছু কারণ আছে। যেমন, বাশার সরকারের পক্ষে ইরান ও রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে; কিন্তু বিদ্রোহীদের পক্ষে লড়াই করার জন্য কোনো দেশই সরাসরি আসেনি। হাজার হাজার মানুষকে বাশার, রাশিয়া ও ইরান মিলে হত্যা করে। বিশ্ব সমাজ কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি গোষ্ঠীকে নিজ স্বার্থে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। অথচ বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠীটির কারণেও বিদ্রোহীদের সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে।
[সূত্র, আলজাযিরা ও সিরিয়ান গবেষক সাংবাদিক আহমদ দাদুশের বিশ্লেষণ ও অন্যান্য]