‘হেযবুত তওহীদ’ ॥
মতবাদ, ভ্রান্তি ও অপকৌশল : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
মাওলানা ফয়জুল্লাহ মুনির
প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির সাথে অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি সংগঠনের নাম ‘হেযবুত তওহীদ’ । বহুরূপী এই সংগঠনটির কার্যক্রম দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যার দরুন অনেক সরলমনা মুসলমান না বুঝেই তাদের দলে যোগ দিয়ে বসছেন। অনেকেই তাদের চটকদার কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এসব দেখে ও শুনে কোনো কোনো সচেতন ভাই উলামায়ে কেরামের দ্বারস্থ হয়েছেন। জানতে চাইছেন, এরা কারা? কী তাদের উৎস? কেমন তাদের আকীদা-বিশ্বাস? আর ইসলামের নামে তারা যেসব কথা বলছে, এগুলোর বাস্তবতাই বা কতটুকু?
আমরা একেবারে গোড়া থেকে শুরু করছি।
হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠা ও উৎস
হেযবুত তওহীদ দলটির প্রতিষ্ঠাতা টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। যিনি ছিলেন কলেজপড়ুয়া একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। আরবী ভাষা সম্পর্কে তার তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না। আর কুরআন-হাদীসের ভাষায় তিনি ছিলেন একেবারেই নিরক্ষর। এ কথা তিনি নিজেও কোনো কোনো বক্তব্যে স্বীকার করেছেন। (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৫৫) তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি যে ইসলামের নামে এত কিছু লিখেছেন বা বলেছেন, তা তিনি কোথায় পেলেন?
এর উত্তর তালাশ করতে আমরা পন্নী সাহেবের জীবনী আগাগোড়া পাঠ করেছি। সেখান থেকে আমরা যেটা খুঁজে পেয়েছি তা হল, পন্নী সাহেব কোলকাতা থাকাকালীন ‘তেহরিক-এ-খাকসার’ নামক একটি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান মাশরেকী। তার নিজস্ব কিছু ভ্রান্ত চিন্তাধারা ছিল। যেগুলোর ব্যাপারে তৎকালীন প্রায় সকল উলামায়ে কেরাম কুফর ও ভ্রান্তির ফতোয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু পন্নী সাহেব মাশরেকীর সেই চিন্তাগুলোকেই আপন করে নেন। এগুলোকে তিনি এতটাই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন যে, ১৯৪৭-এর পর ‘খাকসার আন্দোলন’ বিলুপ্ত করা হলেও তিনি এগুলোকে ছাড়তে পারেননি; বরং তিনি নিজ এলাকায় এসে এগুলোকে নতুন রূপ দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। যা পরবর্তীতে আরো ডালপালা ছড়িয়ে ১৯৯৫ সনে ‘হেযবুত তওহীদ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবেই শুরু হয় এই সংগঠনটির কার্যক্রম।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, পন্নী সাহেব তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা মাশরেকী থেকে গ্রহণ করলেও ‘হেযবুত তওহীদ’ গঠন করার পর তিনি তার অনুসারীদের কাউকে তা বুঝতে দেননি। এমনকি তিনি তার কোনো লেখায় বা বক্তৃতায় মাশরেকীর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন না। পক্ষান্তরে এগুলোকে তিনি নিজের কাশ্ফ ও ইল্হাম বলে চালিয়ে দিতে চাইতেন। (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৫৪) যে আন্দোলনের গোড়াতেই এরকম মিথ্যাচার ও কপটতার আশ্রয় নেওয়া হয়, তার ভবিষ্যৎ আর কীইবা হতে পারে!?
এবার আসুন আলোচনা করা যাক হেযবুত তওহীদের মৌলিক কিছু মতবাদ ও আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে।
হেযবুত তওহীদের মৌলিক কিছু কুফুরী মতবাদ
হেযবুত তওহীদের লোকদের কথাবার্তা শুনে সাধারণ মানুষ হয়তো ভাববেন, এরা তো ভালো কথাই বলছে। সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলাপ করছে। জাতীয় বিষয়াদির ব্যাপারে আওয়াজ তুলছে। তাহলে তাদের সমস্যাটা কোথায়? এর উত্তর জানার আগে প্রথমেই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, একজন মুসলিমের নিকট যে কোনো কিছু মাপার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে শরীয়ত; কুরআন ও সুন্নাহ। তাই কোনো দল বা সংগঠন আমাদেরকে দাওয়াত দিলে প্রথমেই আমাদেরকে দেখতে হবে, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তাদের আকীদা-বিশ্বাস ঠিক আছে কি না? তাদের ঈমান ঠিক আছে কি না?
হেযবুত তওহীদ দলটি নিয়ে যদি আমরা একটু গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলেই বুঝতে পারব, এসব ভালো ভালো কথা বলার জন্য তারা আলাদা একটি সংগঠন তৈরি করেনি; বরং এর পেছনে তাদের ভিন্ন একটি উদ্দেশ্য আছে। আর তা হল, মাশরেকী সাহেব থেকে ধার করা এমন কিছু মারাত্মক মতবাদ তারা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার কোনো একটিকেও যদি কেউ সমর্থন করে, তবে তার ঈমান শেষ হয়ে যাবে। আমরা এখানে সংক্ষেপে তাদের এজাতীয় মৌলিক কিছু কুফুরী মতবাদ তুলে ধরছি–
এক. সব ধর্মই সত্য এবং যে কোনো ধর্ম পালনে মুক্তি আছে বলে মনে করা
এটি হেযবুত তওহীদের অন্যতম একটি কুফুরী চিন্তা। তারা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পরও অন্যান্য ধর্মগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা মতে, সব ধর্মই সত্য। সকল ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মপ্রবর্তকগণ আল্লাহর প্রেরিত। তাই মানুষ এগুলোর যে কোনোটি মেনে চলতে পারে। হেযবুত তওহীদ মানুষকে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের দিকে আহ্বান করে না। আমরা তাদেরই প্রকাশিত বইপুস্তক থেকে এজাতীয় কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি–
হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘মানবসমাজে ধর্ম-অধর্ম ও শান্তি-অশান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে– “প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এর যে কোনটি মানুষ মেনে চলতে পারে।”
এমনিভাবে তাদের প্রকাশিত ‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক একটি সংকলনের ৮৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “মানবজাতির ঐক্যই স্রষ্টার কাম্য। তাই সকল ধর্মেই আছে ঐক্যের শিক্ষা। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকেই বিভেদের প্রাচীর বানিয়ে রেখেছে। তারা অন্য ধর্মগুলোকে মিথ্যা এবং সেই ধর্মের অনুসারীদেরকে জাহান্নামী, কাফের বলে গালিগালাজ করে। অথচ সকল ধর্মই আল্লাহর প্রেরিত, ধর্ম প্রবর্তকগণও তাই।”
‘সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঐক্যের আহ্বান’ নামক আরেকটি পুস্তিকার ৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে– “আমরা কাউকে এসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা ইহুদি ইত্যাদি কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছি না। আমাদের কথা হচ্ছে, যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার কাছে।”
এরকম আরো ভুরি ভুরি বক্তব্য তাদের লেখা ও বক্তৃতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অথচ মুসলিম মাত্রই জানেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতপ্রাপ্তির পর পূর্ববর্তী সকল আসমানী ধর্মও রহিত হয়ে গেছে। একমাত্র ইসলামকেই আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন। খোদ কুরআন কারীমে সেই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন–
اِنَّ الدِّیْنَ عِنْدَ اللهِ الْاِسْلَامُ.
নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র (মনোনীত) দ্বীন। –সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন–
وَ مَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ، وَ هُوَ فِی الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.
আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে, তা তার কাছ থেকে কিছুতেই কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। –সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮৫
আর হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো একেবারে সুস্পষ্ট ভাষায় শপথ করে বলে গেছেন–
وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يَسْمَعُ بِيْ أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُوْدِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِيْ أُرْسِلْتُ بِهِ، إِلّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ.
সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, এই উম্মতের ইহুদী বা নাসারা যেই আমার দাওয়াত পাবে, অতঃপর আমার আনীত দ্বীনের ওপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, সে হবে জাহান্নামী। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৩
দুই. ইসলামকে বিকৃত আখ্যায়িত করা
হেযবুত তওহীদের লোকেরা অন্যান্য সকল বাতিল ধর্মগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করলেও ইসলামের ব্যাপারে তারা বলে, ইসলাম নাকি সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, যুগপরম্পরায় চলে আসা এই ইসলাম আল্লাহ-রাসূলের ইসলাম নয়। এটি প্রকৃত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি ধর্মবিশ্বাস। পন্নী সাহেব তার এই কুফুরী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ নামে ৪০০ পৃষ্ঠার একটি স্বতন্ত্র বই লিখেছেন। আমরা হেযবুত তওহীদের বইগুলো থেকে এজাতীয় কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি–
‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক সংকলনটির ২৭ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “আমরা দুনিয়াময় ইসলাম নামে যে ধর্মটি দেখতে পাচ্ছি সেটা আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া ইসলাম নয়, এটা একটি বিকৃত ও বিপরীতমুখী ধর্মবিশ্বাস।”
‘এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব’ নামক আরেকটি পুস্তিকার ৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “অতীতের সবগুলি ধর্মই যেমন কাল পরিক্রমায় বিকৃত হোয়ে গেছে, এসলামও ১৩০০ বছরে বিকৃত হোতে হোতে একেবারে বিপরীতমুখী হোয়ে গেছে।”
পন্নী সাহেব তার ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইয়ের ৪০-৪১ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন– “যেসব বিকৃতি আসার ফলে পূর্ববর্ত্তী অন্যান্য ধর্ম বাতিল করে আল্লাহ নতুন নবী পাঠিয়েছেন সেই সব বিকৃতি এই শেষ দীনেও এসে গেছে।”
‘ইসলামকে বিকৃত আখ্যায়িত করা’ এটি প্রায় সকল বাতিলপন্থীদের অন্যতম একটি মৌলিক এজেন্ডা। কারণ, অন্ধকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেরকম আলোকে দূরে সরিয়ে দিতে হয়, ঠিক তেমনি বাতিলপন্থীরা নিজেদের মনগড়া ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রকৃত ইসলামকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। অথচ তারা এটা ভেবে দেখে না যে, তাদের এই প্রচেষ্টা কখনো সফল হওয়ার নয়। অতীতেও হয়নি এবং ভবিষ্যতেও কখনোই তা হবে না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিজে ইসলামের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। এজন্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ করেছেন–
لَنْ يَزَالَ أَمْرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ مُسْتَقِيْمًا حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ.
কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত এই উম্মাহর অবস্থা সঠিক ও সরল থাকবে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩১২
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন–
لَنْ يَبْرَحَ هَذَا الدِّيْنُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ.
এই দ্বীন সদা সর্বদা সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং একদল মুসলিম কিয়ামত পর্যন্ত এই দ্বীনের জন্য জিহাদ করতে থাকবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯২২
তিন. পৃথিবীর সকল মুসলমানকে কাফের সাব্যস্ত করা
এটি হেযবুত তওহীদের আরেকটি মারত্মক কুফুরী আকীদা। তারা নিজেদের দলের লোক ছাড়া পৃথিবীর আর সকল মুসলমানকে কাফের ও মুশরিক মনে করে। মুসলমানদেরকে তারা ‘অভিশপ্ত’ ও ‘লা‘নতপ্রাপ্ত’ বলে গালাগাল করে। আমরা তাদের বইগুলো থেকে এ ধরনের কয়েকটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি–
‘আসমাউ ওয়া আত্তাবেয়্যু’ নামক একটি পুস্তিকার ৪২ নং পৃষ্ঠায় হেযবুত তওহীদের কর্মীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে– “ভুলে যেও না আমরা শেরক ও কুফরের মহাসমুদ্রের মধ্যে মাত্র এক ফোঁটা হেদায়াহ।”
এমনিভাবে ‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক সংকলনটির ১৫ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে– “এই জাতি তার সমস্ত নামাজ, যাকাত, হজ্ব রোযা সব সুদ্ধ বেঈমান অর্থাৎ কাফের, মোশরেক।”
‘ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা’ নামক পুস্তিকার ১৩ নং পৃষ্ঠায় এভাবে বলা হয়েছে– “এই জাতি এখন আল্লাহর লা’নতের ও গযবের বস্তু, এর অবস্থা এখন অতীতের অভিশপ্ত ইহুদি জাতির চেয়েও নিকৃষ্ট।”
এভাবেই তারা পুরো উম্মতে মুসলিমাহর বিরুদ্ধে নিজেদের ভেতরে পুষে রাখা ক্ষোভ ও ঘৃণা উগরে দেয় এবং কোনো দলীল-প্রমাণ ছাড়াই তারা সমস্ত মুসলমানদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে। অথচ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কোনো একজন মুসলমানকে কাফের বলার ব্যাপারেও কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِه.
কোনো মুমিনকে কুফুরীর অপবাদ দেওয়া তাকে হত্যা করার সমতুল্য। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১০৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন–
أَيُّمَا امْرِئٍ قَالَ لِأخِيْهِ: يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا، إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ، وَإِلّا رَجَعَتْ عَلَيْهِ.
যে কেউ তার ভাইকে কাফের বলবে, সেটা তাদের দুজনের কোনো একজনের ওপর বর্তাবে। যদি সে যা বলেছে তা বাস্তব হয় তবে তো হল। অন্যথায় তার নিজের ওপরই তা বর্তাবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬০
চার. নামাযসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোতে বিকৃতি সাধন ও ইবাদত হওয়ার অস্বীকৃতি
ইসলামকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য হেযবুত তওহীদের লোকেরা ইসলামের সর্বপ্রধান ভাগ ইবাদতে হাত দিয়েছে। তারা ইসলামের ইবাদতগুলোকে ইবাদত স্বীকার করতেই রাজি না। এগুলোকে তারা বিভিন্ন নাম দিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। আর নামায যেহেতু ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, এজন্য নামাযের মধ্যে তারা বিকৃতি ঘটিয়েছে সবচেয়ে বেশি। পন্নী সাহেব নামাযের এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা গত চৌদ্দ শ বছরে পন্নী সাহেব এবং তার গুরুরা ছাড়া আর কেউ হয়তোবা তা কল্পনাও করেনি। অথচ ইসলামের ইবাদতের কোনো একটি অংশকে অস্বীকার করা কিংবা এগুলোর কোনোটির মাঝে কোনো ধরনের বিকৃতি সাধন করা সুস্পষ্ট কুফর। প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ততার কথা বিবেচনা করে আমরা এখানে তাদের এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। কেবল উদাহরণস্বরূপ তাদের বইপুস্তক থেকে এ ধরনের অল্প কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি–
‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক সংকলনটির ৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “এবাদত হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত করা, কিন্তু ভুল করে নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে।”
একই সংকলনের ১০৪ নং পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছে– “আমাদের বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোযা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের মূল কাজ নয়।”
এমনিভাবে পন্নী সাহেব তার ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইয়ের ১৯ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন– “দীনের আর বাকি যেটুকু আছে নামায, রোযা, ইত্যাদি হাজারো কাজ, সব আনুষাঙ্গিক, গৌণ।”
পাঁচ. ইসলামী শরীয়ত ও রাসূলের সুন্নাহ্কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
ইবাদতকে বিকৃত করার পাশাপাশি হেযবুত তওহীদের লোকেরা ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করে। তারা রাসূলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ ও সুন্নাহকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। রাসূলের বিভিন্ন সুন্নাহকে তারা এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা কোনো মুমিনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ, মুমিন তো বলাই হয় এমন ব্যক্তিকে, যার আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণ ভক্তি, আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে। পক্ষান্তরে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের উৎসই হচ্ছে ঘৃণা ও অবিশ্বাস। কেবল বাস্তবতা বোঝার স্বার্থে এখানে আমরা তাদের এজাতীয় কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি–
‘ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে?’ নামক বইয়ের ৬১ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে– “আজ যে ইসলাম চলছে তা যে মুসলিম উৎপাদন করে তাদের আকীদা হলো এই যে ... রসুলাল্লাহকে পাঠানো হয়েছিল মানুষকে টাখনুর উপর পাজামা পরার মত, মাথায় টুপি দেবার মত, দাড়ি রাখানোর মত, দাঁত মাজার মত, কুলুখ নেয়ার মত, ডান পাশে শোয়ার মত তুচ্ছ ব্যাপার শেখাতে।”
‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইয়ের ৯২ নং পৃষ্ঠায় পন্নী সাহেব লিখেছেন– “কার্যতঃ মোশরেক হয়ে মাথা ন্যাড়া করে, মোছ কামিয়ে, টুপি পাগড়ী মাথায় দিয়ে কাঁধে চেক রুমাল ফেলে, টাখনুর উপর পাজামা পড়ে আর পাঁচবার মসজিদে দৌড়ে এরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন এই ভেবে যে, তারা শুধু উম্মতে মোহাম্মদী নন, একেবারে নায়েবে নবী।”
একই বইয়ের ২২৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “আসল জান্নাতী ফেরকার সুন্নাহর সাথে বাকি বাহাত্তর ফেরকার সুন্নাহর আসমান-যমিন তফাৎ। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হল দাঁত মেসওয়াক করা।”
উক্ত বইয়ের ২৬৫ নং পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছে– “দাঁড়ি, টুপি, মোজা, পাজামা, টাখনু, তসবিহ, তাহাজ্জুদ, কুলুখ, যিকর, ছোট খাট সহজ অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুন্নাহ, ডান পা প্রথমে ফেলে মসজিদে ঢোকা, ডান পাশে শোওয়া, নফল নামায, নফল রোযা, মেসওয়াক ইত্যাদি নিয়ে এই জাতি মহাব্যস্ত।”
ছয়. বিভিন্ন হারাম বিষয়াদির সমর্থন ও বৈধতা দান করা
ইসলামের ইবাদতগুলোকে অস্বীকার, বিকৃতি ও বিদ্রুপ করার পাশাপাশি হেযবুত তওহীদের লোকেরা বিভিন্ন হারাম বিষয়াদির সমর্থন করে। কুরআন-সুন্নাহ্য় সুস্পষ্ট হারাম, এমন অনেক বিষয়কে তারা বৈধ মনে করে। বিভিন্ন কবিরা গুনাহের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শন করে। নাচ-গান, নাটক-উৎসব ইত্যাদি বিষয়কে তারা কেবল জায়েয নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ইবাদততুল্য গণ্য করে। এমনিভাবে তারা নারীদের পর্দাহীনতাকে সমর্থন করে ইসলামের পর্দার বিধানকে কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করতেও ছাড়ে না। অথচ এ কাজগুলোর প্রত্যেকটিই মারাত্মক গোমরাহী ও কুফর। আমরা তাদের বইপুস্তক থেকে এজাতীয় অল্প কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি–
‘প্রিয় দেশবাসী’ নামক একটি বইয়ের ১২৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে– “যে গান, নৃত্য, চিত্রকলা, সাহিত্য, নাটক ইত্যাদি শিল্পচর্চা মানবজাতির কল্যাণে সহায়ক হবে ... সেগুলো কেবল বৈধ নয়, আমরা মনে করি সেগুলো ইবাদততুল্য।”
এমনিভাবে ‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক সংকলনটির ৯৪ নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে– “নবান্ন উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি কোনো উৎসবই শরিয়ত পরিপন্থী হতে পারে না।”
‘পাশ্চাত্যের মানসিক দাসত্ব দূরীকরণে গণমাধ্যমের করণীয়’ নামক আরেকটি পুস্তিকার ৬৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “নারীকে একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ধর্মের দোহাই দিয়ে, পর্দার অজুহাতে, তাদের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার অজুহাতে মিথ্যে ফতোয়ার বেড়াজালে বন্দি করে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত কিম্ভূতকিমাকার অবলা প্রাণীতে পরিণত করে রেখেছে।”
সাত. মু‘জেযার দাবি ও আল্লাহ তাআলার ওপর মিথ্যারোপ
এতকিছু করেও হেযবুত তওহীদের লোকেরা ক্ষান্ত হয়নি; বরং পন্নী সাহেব ২০০৮ সালে উদ্ভট কিছু বানোয়াট ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজের জন্য মু‘জেযার দাবি করে বসেন। পন্নী সাহেবের ১০ মিনিটের একটি ভাষণ চলাকালীন নাকি সেই মু‘জেযা ঘটেছিল। প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ততার কথা বিবেচনা করে আমরা তাদের সেই উদ্ভট মু‘জেযার বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। এখানে কেবল এতটুকু বলে রাখছি যে, মুসলিম মাত্রই জানেন, নবী-রাসূল ছাড়া অন্য কারো হাতে মু‘জেযা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নয়। আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের মধ্য দিয়ে সেই ধারা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর আর কোনো নতুন নবী আসবেন না। তাই এখন কারো জন্য মু‘জেযার দাবি করা সুস্পষ্ট গোমরাহী ও কুফর। (দ্র. আশ্শিফা বিতারীফি হুকুকিল মুস্তফা ২/২৮৬) তাছাড়া যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মু‘জেযার দাবি করা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পুরো ঘটনাটা ছিল তাদের সাজানো নাটকমাত্র।
অথচ পন্নী সাহেব কেবল এই মু‘জেযার দাবি করেই বসে থাকেননি; বরং তিনি আরো আগ বেড়ে সরাসরি আল্লাহ তাআলার ওপর মিথ্যারোপ করে বলেছেন– “সেদিন আল্লাহ তিনটা জিনিস ঝরমহধঃঁৎব কোরলেন- হেযবুত তওহীদ হক্, এমাম হক্ এবং হেযবুত তওহীদ দিয়ে সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হবে।” (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৬৬) অর্থাৎ এখন থেকে হেযবুত তওহীদের নামে যা বলা হবে, হেযবুত তওহীদের এমাম যা কিছু বলবেন, সব সত্য বলে মেনে নিতে হবে। নাউযুবিল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা এরকম মিথ্যাচারকারীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারী দিয়ে ইরশাদ করেছেন–
وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰی عَلَی اللهِ كَذِبًا اَوْ قَالَ اُوْحِیَ اِلَیَّ وَ لَمْ یُوْحَ اِلَیْهِ شَیْءٌ.
ঐ ব্যক্তি থেকে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করে, অথবা বলে, আমার নিকট ওহী করা হয়েছে, অথচ তার নিকট কোনো কিছু ওহী করা হয়নি। –সূরা আন‘আম (৬) : ৯৩
পরিশেষে পন্নী সাহেবের এই মু‘জেযা সম্পর্কে তার ও তার দলের লোকদের আকীদা কী, তা বোঝার জন্য আমরা এখানে তাদের কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি–
হেযবুত তওহীদের বর্তমান নেতা হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম সাহেব লিখেছেন– “এমামের এই ঐতিহাসিক ভাষণ লক্ষ্য কোরলে বোঝা যায় যে এটা মহান আল্লাহর বাণী যা তিনি মাননীয় এমামুয্যামানের মুখ দিয়ে বোলিয়েছেন। আমরা যেন আল্লাহর এ বাণী হৃদয়ঙ্গম কোরতে পারি তাই তিনি এই মহা-গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের সময়ে চৌদ্দশ’ বছর পরে আবার মো’জেজা ঘটালেন।” (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৮১)
পন্নী সাহেব নিজেও তার মু‘জেযা সম্পর্কে বলেছেন– “এর চেয়ে বড় রহমত আর কি হোতে পারে? যে মো’জেজা তিনি নবীদের সময়ে ঘটাতেন একটা একটা কোরে, এখন তিনি নিজে এক সাথে ৮টা মো’জেজা ১০ মিনিটের মধ্যে ঘোটিয়ে দিলেন।” (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৬৭)
পন্নী সাহেব আরো বলেছেন– “হেযবুত তওহীদের এ মো’জেজাও অনেকেই বিশ্বাস কোরবে না, এমন কি আমার মনে হয় যারা ঘটনাস্থলে ছিল তাদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস কোরবে না। তাদের মুক্তি নাই।” (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৬২)
এভাবে একের পর এক হেযবুত তওহীদের লোকেরা যেন কুফর ও ভ্রান্তির পসরা সাজিয়ে বসেছে। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ খুব কম বিষয়ই এমন আছে, যেগুলোতে তারা কোনো ধরনের বিকৃতি বা কটুবাক্য ব্যবহার করেনি। আল্লাহ তাআলা, কুরআন কারীম ও নবীদের ব্যাপারে বেয়াদবিমূলক কথাবার্তা বলা, রাসূলের শানে গোস্তাখি করা, হাদীস অস্বীকার করা, ফেরেশতাদের ব্যাপারে বিকৃত আকীদা পেশ করা, সাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফে সালেহীনের মন্দ সমালোচনা করা, দাজ্জালের ব্যাপারে বানোয়াট কথা বলা ইত্যাদি লম্বা এক ফিরিস্তি। সব একত্র করা হলে হয়তোবা নাতিদীর্ঘ একটা বই তৈরি হয়ে যাবে।
হেযবুত তওহীদের কিছু অপকৌশল
হেযবুত তওহীদের এসব ভ্রান্ত ও কুফুরী মতবাদ দেখার পর স্বভাবতই একজন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে, এতসব কুফুরী মতবাদ সত্ত্বেও কীভাবে তারা মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে? কোন্ কৌশলে তারা সরলমনা মুসলমানদের ঈমান হরণের পাঁয়তারা করছে? সামনের আলোচনায় আমরা তাদের এজাতীয় কয়েকটি অপকৌশল ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
১. উলামায়ে কেরামের সমালোচনা
যে কোনো ভ্রান্তি ছড়ানোর পেছনে প্রধান বাধা উলামায়ে কেরাম। তাই হেযবুত তওহীদের লোকেরা কথায় কথায় উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করে। ‘ধর্মব্যবসায়ী’ বলে গালি দেয়। তাদের নামে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। জনমানুষের মনে উলামায়ে কেরামের প্রতি বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে তারা যেন বদ্ধ পরিকর। অথচ যে কেউ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, বাস্তবিকই যদি তাদের ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য থাকত, তবে উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
২. কথার মারপ্যাঁচ
এটি তাদের ভ্রান্তি ছড়ানোর অন্যতম একটি কৌশল। অনেকগুলো ভালো ভালো কথার মাঝখানে তারা দুয়েকটা ভ্রান্তির কথা ঢুকিয়ে দেয়। কিংবা কুফুরী মতবাদগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, সরলমনা মুসলমানগণ তা ঠিক ধরতে পারেন না। তাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে যান। বিষয়টা বোঝার জন্য আমরা একটি উদাহরণ টানছি। ‘সব ধর্মের লোকেরাই জান্নাতে যেতে পারবে’ এমন ভ্রান্ত মতবাদকে বাস্তবায়ন করার জন্য ‘দৈনিক দেশেরপত্র সংকলন, সংখ্যা– ২৪’-এর ২৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “এখানেই প্রশ্ন, এসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাওয়ার পরও এসলাম গ্রহণ না করে, পূর্ববর্তী বিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবেন? এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বোলে বিশ্বাস কোরতে হবে।”
যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, উপরিউক্ত কথার প্রথম অংশ দ্বিতীয় অংশের সম্পূর্ণ বিপরীত। শেষ নবী ও কুরআনকে বিশ্বাস করে কারো পক্ষে পূর্ববর্তী বিশ্বাসে স্থির থাকা সম্ভব নয়। আবার পূর্ববর্তী ধর্মে বহাল থেকে কারো জন্য আখেরী নবী ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনাও সম্ভব নয়। অথচ এভাবে কথার মারপ্যাঁচেই তারা সরলমনা মানুষদের ধোঁকা দিয়ে থাকে।
৩. কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা
ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে স্বভাবতই হেযবুত তওহীদের লোকদেরকে কুরআনের বহু আয়াত এবং বহু হাদীসের মধ্যে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেসবের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখানে কেবল বোঝার জন্য আমরা মাত্র একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। হেযবুত তওহীদের লোকেরা ‘ইসলাম বিকৃত এবং সকল মুসলমান কাফের’ এই কুফুরী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দলীল হিসেবে একটি হাদীস উল্লেখ করে। হাদীসটি হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
عُمْرُ أُمَّتِيْ مِنْ سِتِّيْنَ سَنَةً إِلَى سَبْعِيْنَ سَنَةً.
আমার উম্মতের সদস্যদের বয়স (বা আয়ু) হবে ৬০ থেকে ৭০ বছর। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩১
এই হাদীসে পুরো উম্মতের বয়সের কথা বলা হয়নি; বরং উম্মতের সদস্যদের গড় আয়ুর কথা আলোচনা করা হয়েছে যে, এই উম্মতের অধিকাংশ লোক ৬০/৭০ বছরের বেশি বাঁচবে না। যেমনটা এই হাদীসেরই আরেকটি বর্ণনায় একেবারে সুস্পষ্ট শব্দে এসেছে–
أعْمَارُ أُمَّتيْ مَا بَيْنَ السِّتِّيْنَ إِلَى السَّبْعِيْنَ، وَأَقَلُّهُمْ مَنْ يَجُوْزُ ذূلِكَ.
আমার উম্মতের সদস্যদের বয়স ৬০ থেকে ৭০ এর মাঝামাঝি। তাদের মধ্যে কম লোকই এমন থাকবে, যারা এই বয়স পার করবে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৫০
হাদীসের অর্থ ও মর্ম এরকম সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও হেযবুত তওহীদের লোকেরা এই হাদীসটিতে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে। ‘ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা’ নামক বইয়ের ৪৮ নং পৃষ্ঠায় উপরিউক্ত হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে– “অর্থাৎ তাঁর প্রকৃত উম্মাহ পৃথিবীতে থাকবে ৬০/৭০ বছর, তারপর যেটা থাকবে সেটা নামে মাত্র উম্মতে মোহাম্মদী, সেটা প্রকৃত পক্ষে উম্মতে মোহাম্মদী নয়।”
৪. জাল হাদীস
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বানোয়াট হাদীস চালিয়ে দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হেযবুত তওহীদের লোকেরা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে বারবার এ কাজটি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয়, হাদীসগুলো তারা নিজেরাই জাল করেছে। এবং সেগুলো করেছে নিজেদের দল ও মতবাদের স্বার্থে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। আমরা এখানে দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
এক. পন্নী সাহেব তার ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ নামক বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন– “রসুলাল্লাহ (দ.) একদিন আসরের নামাযের পর হঠাৎ পূর্ব দিকে চেয়ে খুশী হয়ে হাসলেন। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন তিনি অমন করে হাসলেন কেন? জবাবে বিশ্বনবী (দ.) বললেন- ভবিষ্যতে ইসলাম বিকৃত হয়ে যাবার পর হিন্দের (ভারতের) পূর্বে একটি সবুজ দেশ থেকে প্রকৃত ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করবে।”
নানানভাবে তালাশ করেও এরকম কোনো হাদীস আমরা খুঁজে পাইনি। আর এরকম কোনো হাদীস হওয়াও সম্ভব নয়। কারণ, রাসূলের যামানায় ভারতের পূর্বে আলাদা সবুজ কোনো দেশের অস্তিত্বই ছিল না; বরং তখন বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলটাকেই ‘হিন্দ’ বলা হত। অথচ পন্নী সাহেব অন্যান্য জায়গায় হাদীসের সাথে কিতাবের নাম উল্লেখ করলেও এখানে কোনো কিতাবের নাম লেখেননি; বরং তিনি তার এই বানোয়াট হাদীসকে নিজের বানোয়াট মু‘জেযা দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এজন্য ২০০৮ সালে মু‘জেযা দাবি করার পর তিনি এই হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন– “০২/০২/২০০৮ তারিখের মো’জেজার মাধ্যমে আল্লাহ এ হাদীসটিরও সত্যায়ন কোরলেন।” (দ্র. আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৮৬)
দুই. ‘মহাসত্যের আহ্বান’ নামক সংকলনটির ১৯ নং পৃষ্ঠায় আরেকটি জাল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে– “বিশ্বনবী বলেছেন, “অভিশপ্ত দাজ্জালকে যারা প্রতিরোধ করবে তাদের মরতবা বদর ও ওহুদ যুদ্ধে শহীদের মরতবার সমান হবে।”
এরপর ‘বুখারী’ ও ‘মুসলিম’ এই দুই কিতাবের নাম লেখা আছে। অথচ বুখারী ও মুসলিম শরীফ তো দূরের কথা, কোনো হাদীসের কিতাবেই আমরা তা খুঁজে পাইনি। কিন্তু হেযবুত তওহীদের লোকেরা তাদের নিজেদের বানানো এই হাদীসের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের দলের ব্যাপারে তারা দাবি করে– “হেযবুত তওহীদ ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউই দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনছেন না, সুতরাং তাকে প্রতিরোধও করছেন না। কাজেই বিশ্বনবীর হাদিস মোতাবেক হেযবুত তওহীদের প্রত্যেক অকপট মোজাহেদ মোজাহেদা জীবিত অবস্থাতেই দুই জন করে শহীদের সমান।” (দ্র. মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১৯-২০)
৫. ইতিহাসের বিকৃতি
এটিও একটি ঘৃণ্যতম কাজ। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা। কিন্তু হেযবুত তওহীদের লোকেরা এ কাজটিও অনেকবার করেছে। আমরা এখানে দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
এক. আমরা সবাই হয়তোবা জানি, হাবশার বাদশাহ নাজাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান এনে মুসলমান হয়েছিলেন। এজন্য রাসূল তার জানাযার নামাযও আদায় করেছেন। ইতিহাসের এটি একটি স্বীকৃত ঘটনা। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৪৫; আলইসাবাহ, ইবনে হাজার ১/৩৪৭-৩৪৮) অথচ হেযবুত তওহীদের লোকেরা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে এই ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। ‘দৈনিক দেশেরপত্র সংকলন, সংখ্যা– ২৪’-এর ২৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে– “নাজ্জাশী মুসলিম না হয়েও শেষ নবীকে আত্মা থেকে বিশ্বাস করে তাঁর সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহায্য করার জন্য জান্নাতবাসী হয়েছেন। সুতরাং একই কথা হিন্দু-বৌদ্ধ-ইয়াহুদীসহ সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।”
দুই. সাহাবা যুগের মুসলমানগণ কোনো অবস্থাতেই নামায ছাড়তেন না। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ও তাদের জন্য সালাতুল খাওফের বিধান ছিল। [দ্র. সূরা নিসা (০৪) : ১০১-১০২; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৪২] সাহাবা যামানার পুরো ইতিহাস থেকে কেউ এটা দেখাতে পারবে না যে, সাহাবীগণ যুদ্ধের জন্য নামায ছেড়ে দিতেন। কখনো কখনো হয়তোবা বিশেষ পরিস্থিতিতে নামায কাযা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অবশ্যই তা আদায় করে নিয়েছেন। অথচ পন্নী সাহেব এই বিষয়ে কী বলেছেন দেখুন। পন্নী সাহেব তার ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইয়ের ২৫৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন– “যুদ্ধ যখন এসে যেত তখন মুসলিমরা নামায পড়তেন না, এটা ইতিহাস এবং একবারের ইতিহাস নয়, বহুবারের ইতিহাস।”
নাউযুবিল্লাহ। এরকম আরো কত ঘৃণ্য কৌশলেই না তারা মুসলমানদের ঈমান হরণ করে নিচ্ছে। ধোঁকা দিয়ে একে একে সরলমনা মুসলমানদের নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে। মাশরেকী থেকে ধার করে আনা কুফুরী মতবাদকে তারা ধীরে ধীরে এদেশের মাটিতে পাকাপোক্ত করে তুলছে। অথচ আমরা যদি তাদের চিন্তা ও মতবাদগুলোর দিকে একটু গভীরভাবে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, এটি এমন একটি কুফুরী মতবাদ, যেখানে ধর্মের কোনো বালাই নেই। যেখানে ইসলামের আলাদা কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। মুসলমানরা যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত ও অভিশপ্ত। ইসলামের নামায, রোযা, হজ্ব ও অন্যান্য ইবাদত যেই মতবাদে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। রাসূলের সুন্নাহ যেখানে ঠাট্টা ও বিদ্রুপের পাত্র। পক্ষান্তরে নাচ-গান, নাটক-উৎসব যেখানে কেবল বৈধই নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ইবাদততুল্য।
এগুলো দেখার পরও কি হেযবুত তওহীদের লোকদেরকে মুসলমানদের দলভুক্ত মনে করার কোনো অবকাশ আছে? আশ্চর্যের বিষয় হল, তারা নিজেরাও নিজেদেরকে মুসলমানদের দলভুক্ত মনে করে না। হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে তাদের সদস্য হওয়ার যেই অঙ্গীকারপত্র, সেখানে চতুর্থ নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে– “আমি বিশ্বাস করব যে, আমি নিজে এবং এ আন্দোলনের অন্যান্য সদস্য-সদস্যারা হেদায়াতপ্রাপ্ত ... এই হেদায়াতে যারা নেই, অর্থাৎ বাকী দুনিয়ার সমস্ত মানুষ থেকে আমি ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন। ওদের মধ্যে বাস করলেও আমি ওদের একজন নই। ... আমি তাদের সাথে কোন এবাদত করব না। আমি এবাদত করব শুধু এই আন্দোলনের ভাই ও বোনদের সঙ্গে।”
শেষ কথা
এনায়েতুল্লাহ মাশরেকীর খাকসার আন্দোলনে তৎকালীন যুগে অনেক মুসলমান এ কথা ভেবে যোগদান করতেন যে, এরা তো বিভিন্ন ভালো ভালো সামাজিক কাজকর্ম করছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বর্তমানের হেযবুত তওহীদ আন্দোলনেও বাংলার অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান এসব ভেবে যোগ দিয়ে বসছেন। তাদেরকে আমাদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে, ভাই, ঈমান সবার আগে। ঈমানের মূল্য সবচেয়ে বেশি। ঈমানের কোনো বিনিময় হতে পারে না। দুনিয়াবি কোনো সফলতা অর্জন করতে গিয়ে যদি আমি ঈমান হারিয়ে বসি, তবে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েও কখনোই এই ক্ষতি আমি পুষিয়ে উঠতে পারব না।
পাশাপাশি আমাদের নিজেদের মধ্যেও সচেতনতা গড়ে তোলা উচিত। কারণ, প্রতিটি ফেতনার গোড়ায় রয়েছে আমাদের নিজেদের গাফলত ও ঈমানী দুর্বলতা। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজেদের ভেতরে ঈমানী গায়রত ও ইসলামী মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। পরস্পর বেশি বেশি ঈমান ও আমলের মুযাকারা করা। পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরে ফরযে আইন ইলমকে ব্যাপক করতে সচেষ্ট হওয়া। তবেই আশা করা যায় যে, আমাদের প্রিয় এই দেশ এজাতীয় সুদূরপ্রসারী কুফুরী ফেতনা থেকে রক্ষা পাবে ইনশাআল্লাহ।
টীকা
১। উল্লেখ্য, সংগঠনটির নাম এবং তাদের বক্তব্যগুলো উল্লেখের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে তাদের বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
২। ওয়েবসাইট লিংক :
https://bit.ly/4gSGosW
৩। ওয়েবসাইট লিংক : https://www.hezbuttawheed.org/contact