শাবান ১৪৪৬   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পঞ্চাশ বছর পর মেজর ডালিমের আত্মপ্রকাশ

আবুন নূর

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এদেশের সচেতন ও বুঝমান যারা ছিলেন তারা জানেন, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। সেইসঙ্গে যোগ হয় সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। একইসাথে আওয়ামী বাকশালী গোষ্ঠীর অকথ্য নির্যাতনে মানুষের যে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, ১৫ আগস্টের পর দেশের হালত যতটুকুই পরিবর্তন হোক না কেন, মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তি কাজ করেছিল। আমরা গ্রামেও এমন পরিস্থিতি দেখেছি। তখন বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জারি কবিতা বের হত। আট পৃষ্ঠায় ছাপানো কবিতা মাইকিং করে বিক্রি করা হত। আমার মনে আছে, বাজারে গোল হয়ে জমে ওঠা মজমায় কবিতা বিক্রি হচ্ছিল। সেখানে খন্দকার মুশতাক, মেজর ডালিম ও তাঁর সঙ্গীরা কীভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং মানুষের মাঝে কেমন স্বস্তি ফিরে এসেছে সে বিবরণ ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, পরবর্তীতে ইতিহাসেও পড়েছি, দেশের বিভিন্ন স্তরের গুণীজনদের মুখেও শুনেছি, ১৫ আগস্টের ঘটনায় সারা দেশে একটি স্বস্তির হাওয়া বিরাজ করেছিল। তৎকালীন ও তৎপরবর্তী প্রজন্মের মাঝে মেজর ডালিম ও তাঁর সঙ্গীরা দেশের জন্য বড় কিছু করেছেন বলে পরিচিতি লাভ করেন।

যদিও মেজর ডালিম রাষ্ট্র চালাননি, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান বলি বা হত্যাকাণ্ড বলি, যে যাই বলুক, আমরা কোনো কিছুকে সার্টিফাই করতে চাই না। ইতিহাসই এটার বিচার করবে। মেজর ডালিম এই সেদিনও বললেন, ‘এটা তো হত্যা ছিল না, সেনা অভ্যুত্থান ছিল।’ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, শেখ মুজিব ইস্তফা দিয়ে দিলে এটা ঘটত না। গোলাগুলি যেহেতু উভয় পক্ষ থেকে হয়েছে, তাই এটা ঘটেছে। সে যাই হোক, যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, কাছ থেকে ঘটনা দেখেছেন, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। যাঁরা দূরে ছিলেন তাঁদের জন্য বলা মুশকিল। কিন্তু শরীফুল হক ডালিমের বিষয়টা অন্য কারণে প্রচার পেয়েছে বেশি। তিনি অভ্যুত্থানও ঘটিয়েছেন, সেইসঙ্গে দেশবাসীকে খবরও জানিয়েছেন। ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ বলে রেডিওতে দেশে সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন। দেশবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল ডালিমের পক্ষ থেকে প্রথম খবরটি শোনার পরে।

জারি কবিতায় সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল কী আশা নিয়ে, তিন চার বছরে কী কী ঘটেছে, মানুষ কীভাবে আশাহত হয়েছে, রক্ষীবাহিনীসহ বাকশালীরা মানুষের ওপর কী কী অত্যাচার করেছে, কীভাবে দুর্নীতিকে প্রসারিত করা হয়েছে, কীভাবে মানুষের গলা টিপে ধরা হয়েছে, গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করা হয়েছে, মিডিয়া, পেপার-পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে, একটা বাদে সব দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ১৫ আগস্টের পরে কীভাবে সব বদলে গেছে, কীভাবে একটি দেশের কাছে বাংলাদেশকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ থাকা মুসলিম দেশটিকে কীভাবে মুসলিম দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, আবার ১৫ আগস্টের পরে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক করেছে, কীভাবে মানুষ দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছে এসব বিষয়ই জারি গানে লেখা ছিল।

যারা সে সময় ছোট ছিল তারা এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর আবার ডালিমের কথা শুনতে পাবে, ডালিম বেঁচে থাকার সংবাদ পাবে এটা তাদের জন্য বিস্ময়কর বিষয়। এর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তো অবশ্যই। কারণ এ প্রজন্ম থেকে সে ইতিহাস ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। গত এক যুগ বা তারও বেশি সময় থেকে এ দেশে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করা হয়েছে। ধরাকে সরা বানানো হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে একজনকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বানানো হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত বিশেষ পরিবারের লোকজনকে হিরো বানানো হয়েছে। তাদের গোষ্ঠীর লোকেরা কেমন ছিল, তা তো এ সময়ের মানুষও দেখতে পেয়েছে। যারা ঢাকার মেয়র ছিল, যাদেরকে বিদ্যুতের বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে, এমন গোষ্ঠীদের দেখলেই তো বোঝা যায়, তাদের পূর্বসূরি যারা ছিল, তারা কী ঘটিয়েছে। অথচ বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে শিক্ষিত দালাল লোকদের দিয়ে নতুন নতুন ইতিহাস বানানো হয়েছে। কথিত জেন-জি নামের প্রজন্মটা জানতই না আসলে কী ঘটেছিল। জুলাই বিপ্লবের পর সেটা অনেকটা উন্মোচিত হচ্ছে। যদিও এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ খুবই দুঃখজনক। যেখানে বিএনপি-জামাতের এসব প্রচার করা দরকার ছিল, সেখানে তারা কথাও বলতে চায় না। তারা রাখঢাক করতে চায়। মিথ্যাকে পরাজিত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা তারা নিতে চায় না।

এমনই সময়ে সাংবাদিক ইলিয়াস হুসাইন এদেশের মানুষের সামনে মেজর ডালিমকে নিয়ে এসেছেন। তাঁর কথা মানুষকে শুনিয়েছেন। মেজর ডালিম ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটগুলো তুলে ধরেছেন। বর্তমান প্রজন্ম, তার পূর্বের প্রজন্ম, তারও আগের প্রজন্মের জন্য এটা ভালো দৃষ্টান্ত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকার থেকে এ প্রজন্ম জানতে পেরেছে, এখানে হিরো নেই, জাতির জনক বলে কোনো কথা নেই। বাংলাদেশকে সত্যিকারার্থে এগিয়ে নিতে হলে, জনগণকে প্রকৃত অর্থে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে এসব লেজুড়বৃত্তি ও মিথ্যা ইতিহাস থেকে দূরে সরাতে হবে।

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ হয়েছিল ন্যায়-ইনসাফ, অধিকারের সমতা, বিশেষভাবে ভোটাধিকার, যার জেরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে একজনকে, কিন্তু তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এককথায় বৈষম্যহীনতা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিও এটাই ছিল। অথচ চেতনার নাম দিয়ে মূল কথা থেকে সরে গিয়ে হাবিজাবি নানান মিথ্যা ও অহেতুক বিষয়বস্তুর প্রলেপে স্বাধীনতা যুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। যে দলের কোনো বড় নেতা স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেননি; বরং দলবেঁধে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, সে দলের প্রধান ব্যক্তি হয়ে যান স্বাধীনতার মহানায়ক।

অথচ যুদ্ধকালীন পুরো সময়টাতেই তিনি বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এখানে কী হচ্ছে তার কিছুই তার জানা ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে মিয়াজির আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সব কিছুই হয়েছে তার অগোচরে। তিনি তো দেশে এসেছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে। আর দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। তবুও তার নামে এত কিছু বানানো হয়েছে।

 আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে অগ্রাহ্য করছি না, তবে বাস্তবতা হল শেখ মুজিব বিদেশে বন্দি ছিলেন। তবে তাঁর দলের একেবারে তৃণমূলের যারা, তাদের অনেকেই হয়তো সাধারণ জনগণের সাথে যুদ্ধ করেছে।

যুদ্ধের সময় তাঁর এই অনুপস্থিতি সম্পর্কে সবাই জানে। বিদেশি পত্রিকাগুলোতে তো এভাবে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, সর্বপ্রথম বাবুর্চি এসে তাঁকে খবর দেয় যিনি ছিলেন আসলে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্যার, আপনার দেশ তো পৃথক হয়ে গেছে।

তিনি অবাক হয়ে বলেন, কী বলো, সত্যি?

তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আর এখন তাকেই বানিয়ে ফেলা হয়েছে একমাত্র হিরো। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে আসলেই যাদের অবদান রয়েছে, তাদের নামগন্ধ নেই। জেনারেল ওসমানীসহ আরো যারা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাদেরও তেমন আলোচনা পাওয়া যায় না। শুধু আওয়ামী লীগের লোকদেরকেই দেখানো হয়েছে। তাদেরকেই বড় বড় অবস্থান ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মিথ্যাচারকে অবশ্যই দমাতে হবে। সেইসাথে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারা ক্ষমতায় গিয়ে যে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল, ৭২ সনের সংবিধান কীভাবে রচিত হল, এই সংবিধানে কী কী অযাচিত কথা ঢোকানো হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে ঢুকল, তথাকথিত সমাজতন্ত্র কীভাবে ঢুকে গেল ইত্যাদি বিষয় তদন্ত করার মতো। এগুলো কি মুক্তিযোদ্ধাগণ আদৌ চেয়েছিলেন!? এ পর্যন্ত তো অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার, বই ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু তারা তো বলেননি যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এগুলো কীভাবে এই দেশের সংবিধানে ঢুকল তা উন্মোচিত হওয়া দরকার এবং এর পরে ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫ -এর অর্ধেক সময়; দেশে একবার সংসদীয় পদ্ধতি, আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি, আবার একদলীয় শাসন কারা বানাল? কেন বানাল? কেন রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছিল? কেন দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল? কেন ডাস্টবিনে কুকুর ও মানুষ একত্র হয়েছিল একমুঠো খাবারের জন্য? কেন এই কথা প্রচারিত হয়েছিল, শেখ মুজিব নিজের কম্বলটাও পাননি? দুর্নীতির জেরে অন্যদেরটা তো গেছেই, খোদ রাষ্ট্রপতির কম্বলও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি! কেন এগুলো প্রচারিত হয়েছিল?

এইসব ইতিহাস জাতির সামনে আসা দরকার। এখন যে বলা হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আসবে। আমরা মনে করি, সে ইশতিহারে অবশ্যই এগুলোর স্বতন্ত্র আলোচনা এবং পৃথক গবেষণা হওয়া দরকার। সঠিক ইতিহাস লেখা হোক। এতদিন যে মিথ্যা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের খরচে, যে সিনেমা বানানো হয়েছে, মিথ্যা চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে, প্রশংসার স্তূপ দিয়ে যে মিথ্যা বইপত্র লেখা হয়েছে, মিউজিয়াম বানানো হয়েছে, অবশ্যই এগুলোর হিসাব-নিকাশ নেওয়া হোক এবং বন্ধ করে দেওয়া হোক। অন্যথায় একটা জাতি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারে না।

যদি এমনটি করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরেক দল এসে অন্য কাউকে হয়তো এ রকম মিথ্যা হিরো বানিয়ে ফেলবে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের মতো রাষ্ট্র ও জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় নিয়োগ দেবে অনেক উচ্চ শিক্ষিত দালালগোছের শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী ও প্রতিষ্ঠানকে। আবার শুরু হতে পারে মিথ্যা ইতিহাস।

যাহোক, এমনই এক প্রেক্ষাপটে মেজর ডালিমের বক্তব্য সামনে আসাকে দেশের আপামর জনগণ ইতিবাচকভাবেই দেখছে। শুনেছি, সাক্ষাৎকারটি লাইভ প্রচারের সময় আট লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি তা দেখেছে ও শুনেছে। যা নাকি একটি রেকর্ড। আর এরপর এক-দুই দিনের মধ্যেই নাকি তার ভিউ দাঁড়িয়েছে দেড় কোটির মতো। ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবে নেওয়া যেতে পারে। চাই মেজর ডালিমের নাম আসুক বা না আসুক, কিন্তু সত্যটা সবার সামনে আসুক। এতদিন যা মিথ্যা বলা হয়েছে, এগুলো উন্মোচিত হোক। জাতির জন্য সেটাই কল্যাণকর হবে। মিথ্যার ওপর যেন জাতি দাঁড়িয়ে না থাকে। 

 

 

advertisement