শাবান ১৪৪৬   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঈমানের ডাক (২)॥
আল্লাহ তাআলার নিকট হতে সাহায্য প্রাপ্তির উপায়

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার

أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ،  بِسْمِ الله الرَّحْمن الرَّحِيْمِ ،

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ  وَ الصَّلٰوةِ  اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.

ওহে, তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে থাকেন।

সূরা বাকারা (০২) : আয়াত ১৫৩

প্রিয় পাঠক! স্মরণ করুন আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা.-এর কথা। তিনি বলেছিলেন, যখন তুমি শুনবে, আল্লাহ তাআলা বলছেন يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا  (ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ!) তখন তুমি তোমার কান খাড়া করে দেবে এবং মনোযোগী হয়ে শুনবে, তিনি কী বলছেন। কেননা, এইরূপ সম্বোধনের পর তিনি হয়তো কল্যাণকর কোনো বিষয়ের আদেশ করেন অথবা অকল্যাণকর কোনো বিষয় নিষিদ্ধ করেন। 

প্রিয় পাঠক! স্মরণ করুন যে, আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আপনাকে ও আমাকে মুমিন বলে সম্বোধন করণ আমাদের জন্য পরম মর্যাদার বিষয়। আর এই মর্যাদাকর সম্বোধন একমাত্র আমাদের ঈমানের কারণেই। নতুবা আমরা কে বা আমরা কী যে, মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সম্বোধন করবেন এবং আমাদেরকে লক্ষ করে কথা বলবেন? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সম্বোধন করে আমাদেরকে মর্যাদা দান করেছেন কেবলমাত্র আমাদের ঈমানের কারণে। আমরা ঈমান এনেছি তাঁর প্রতি, তাঁর ফেরেশতা ও তাঁর রাসূলদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর কাযা ও কদরের প্রতি, তাঁর সঙ্গে আখেরাতে আমাদের সাক্ষাৎ হবে এই বিষয়ের প্রতি। এইসব বিষয়ে ঈমানের কারণে তিনি আমাদেরকে মুমিন বলে সম্বোধন করে মহা মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। কেননা, ঈমান মানুষের জন্য রূহস্বরূপ। অতএব মুমিনই প্রকৃতপক্ষে জীবনের অধিকারী আর কাফের বাহ্যত জীবন্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে মৃত। অতএব, ঈমান এক মহা নিআমত।

আমাদের উচিত, এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা। শুকরিয়া আদায় হবে আল্লাহ তাআলার প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে। আর পরিপূর্ণ তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করে। সে হয়ে ওঠে আল্লাহর ওলী। আল্লাহ তাআলা বলেন

اَلَاۤ اِنَّ اَوْلِیَآءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَلَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ، الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا یَتَّقُوْنَ، لَهُمُ الْبُشْرٰی فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَفِی الْاٰخِرَةِ لَا تَبْدِیْلَ لِكَلِمٰتِ اللهِ ذٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُالْعَظِیْمُ.

জেনে রাখ, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নাই এবং তারা  দুঃখিতও হবে না। তারা সেইসব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও। আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তন নাই; এটাই মহা সাফল্য। সূরা ইউনুস (১০) : ৬২-৬৪

প্রিয় পাঠক! তাকওয়া হল, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। তাঁরা যেসব বিষয় আদেশ করেছেন তা কাজে পরিণত করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার ভীতি অন্তরে পোষণ করা, তাঁর প্রতি অন্তরে ভালবাসা পোষণ করা। কোন্ কাজে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন, কোন্ কাজে অসন্তুষ্ট হন সে বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থেকে জীবন পরিচালনা করা।

দ্বীন ও দুনিয়ার সকল প্রয়োজনে মানুষ সাহায্য প্রার্থনা করবে কার নিকট এবং কীভাবে

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে উপদেশ দান করেছেন, মানুষের প্রতিটি প্রয়োজনে সে যেন আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করে। প্রয়োজনের কোনো প্রকার বা ধরন আল্লাহ তাআলা নির্দিষ্ট করে দেননি। অনির্দিষ্ট রেখেছেন। অতএব মানুষ তার জীবনের সকল প্রয়োজনে আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করবে। তা সে প্রয়োজন দ্বীন সংক্রান্ত হোক কিংবা পার্থিব জীবন সংক্রান্ত হোক। সে প্রয়োজন হোক বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজনেও আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর সাহায্য প্রার্থনা করার উপায়ও আল্লাহ তাআলা ব্যক্ত করে দিয়েছেন। বলেছেন, সবর ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর।

সবরের স্বরূপ

কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষা অনুযায়ী সবর শব্দটি ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। সবরের মূল অর্থ নিজেকে আয়ত্তে আনয়ন এবং মন্দ প্রবৃত্তির বিরোধিতা করণ। বাংলায় এর অর্থ হতে পারে ‘সংযম’। মন্দ প্রবৃত্তি আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন পছন্দ করে না। মন্দ প্রবৃত্তির কারণে আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করতে, তাঁর ইবাদত করতে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করত তাঁর জীবন-পদ্ধতি অবলম্বন করতে মানুষ অনিচ্ছুক হয়; বরং কখনো কখনো কষ্ট বোধ করে। সে ক্ষেত্রে মন্দ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করত এবং প্রবৃত্তির বিরোধিতা করত আল্লাহ তাআলার ইবাদতে লিপ্ত হওয়া এবং সকল আদেশ পালনে বদ্ধপরিকর হওয়া একপ্রকার সবর বা সংযম।

তদ্রূপ, মন্দ প্রবৃত্তির কারণে পাপ কাজ করতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়, সে গুনাহকর্ম করতে পছন্দ করে, গুনাহকর্মে সে স্বাদ ও মজা অনুভব করে, আনন্দ লাভ করে; ফলে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের নিষেধাজ্ঞার প্রতি তার দৃষ্টি যায় না। তাঁদের নিষেধাজ্ঞা তার অন্তরে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না। এ ক্ষেত্রে মন্দ প্রবৃত্তিকে বশীভূত করণ এবং গুনাহকর্ম হতে নিজেকে নিবৃত্ত করণ একপ্রকার সবর ও সংযম।

ঠিক একইভাবে বিপদাপদ ও শোক দুঃখে মানুষের প্রবৃত্তি মানুষকে অস্থির করে তোলে। তার কথাবার্তা ও কাজকর্মে তখন অসংলগ্নতা প্রকাশ পায় এবং শরীয়ত-নিষিদ্ধ পন্থায় সে নিজের শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে। আল্লাহ তাআলার তাকদীরের ফয়সালাকে সে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে যায়। বরং অনেক সময় সে আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিপদাপদকে আল্লাহ তাআলার ফয়সালা জ্ঞান করত আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া এবং বিপদাপদ ও দুঃখ বেদনাকে সওয়াব প্রাপ্তির একটি উপলক্ষ জ্ঞান করা একপ্রকার সবর।

সাধারণত মানুষ তৃতীয় প্রকার সবরকেই সবর বলে মনে করে থাকে। কিন্তু উপরিউক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং শরীয়ত-নির্দেশিত পথ অবলম্বন করতে পারে, সে-ই মূলত প্রকৃত সবরকারী ও প্রকৃত সংযমী। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা আয়াতের উপসংহারে বলেছেন

اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.

(নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে থাকেন।)

এটি একটি মহা সুসংবাদ। কেবলমাত্র তৃতীয় প্রকার সবরের কারণে এত বড় সুসংবাদ ব্যক্তি লাভ করতে পারে না বলেই অনুমিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনের ধার ধারে না, আল্লাহ তাআলার নিষেধাজ্ঞারও ধার ধারে না, ইবাদত ও পুণ্যকর্ম হতে বিরত থাকে, পাপকার্যে নিমজ্জিত থাকে আর বিপদের সময় শুধু সবর করে এবং ধৈর্য ধারণ করে, তার জন্য এত বড় সুসংবাদ বেমানান বলেই অনুমিত হয়।

সবরের ব্যাপকার্থ অনুযায়ী সালাতও সবরের অন্তর্ভুক্ত। এতদসত্ত্বেও সালাতকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সালাতের অপরিসীম গুরুত্বের কারণে। অসাধারণ বিশেষত্বের কারণে। সাহাবী হুযাইফা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি অভ্যাসের কথা বর্ণনা করে বলেন

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا حَزَبَه أَمْرٌ صَلّٰى.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে যখন কোনো সংকট দেখা দিত তখন তিনি সালাত আদায় করতেন। সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ২৯১২

সালাতের মাধ্যমে তিনি সংকট হতে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতেন। সালাতকে তিনি সংকট হতে মুক্তি লাভ করার অন্যতম একটি উপায় বলে গণ্য করতেন। এমনকি পূর্ববর্তী নবীগণ সম্পর্কেও এই তথ্য পাওয়া যায় যে, তাঁরাও সংকটকালে সালাতের আশ্রয় নিতেন, সালাত আদায় করতেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য নবীদের সম্পর্কে বলেন

وَكَانُوْا يَفْزَعُوْنَ إِذَا فَزِعُوْا إِلَى الصَّلَاةِ.

এবং নবীগণ যখন ভীতিকর কোনো অবস্থায় নিপতিত হতেন তখন তাঁরা সালাতের দিকে ধাবিত হতেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৯৩৭

অর্থাৎ কোনো সংকট ও ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তাঁরা সালাত আদায়ের প্রতি মনোনিবেশ করতেন।

একইজাতীয় আয়াত

আরো একটি আয়াতে সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন

وَاسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوةِ وَاِنَّهَا لَكَبِیْرَةٌ اِلَّا عَلَی الْخٰشِعِیْنَ.

এবং তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর সবর ও সালাতের মাধ্যমে। আর সালাত অবশ্যই কঠিন বলে মনে হয়, তবে তাদের পক্ষে (কঠিন) নয়, যারা খুশু‘ (তথা ধ্যান ও বিনয়)-এর অধিকারী। সূরা বাকারা (০২) : ৪৫

খোদ সালাত ও সবরই সাহায্য প্রার্থনা

আয়াতটিতে সাহায্য প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে সালাত ও সবরের মাধ্যমে। এর অর্থ এই যে, সালাত আদায় ও সবর অবলম্বন করলে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভ করা যায়। এর অর্থ এই নয় যে, সালাত ও সবর কর, অতঃপর আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর, দুআ কর।

দুআ স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রয়োজনে ও সংকটে আল্লাহর নিকট দুআ করেছেন। সুতরাং দুআর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট নিজের আর্জি পেশ করা এবং প্রার্থনা করাও মুমিনের বৈশিষ্ট্য। দুআ করাও একটি স্বতন্ত্র ও মাকসূদ ইবাদত, কাম্য ইবাদত। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে সালাত ও সবরকেই প্রার্থনা বলা হয়েছে। সালাত ও সবরও সাহায্য প্রার্থনার একটি রূপ। অতএব, আয়াতটির তরজমা এভাবেও করা যেতে পারে তোমরা সালাত ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট হতে সাহায্য লাভ কর। শিরোনামে আমি তাই লিখেছি আল্লাহর নিকট হতে সাহায্য লাভের উপায়।

আল্লাহ সঙ্গে থাকলে কী হয়

আয়াতটিতে সবরকারীদের জন্য একটি মহা সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সবরকারীদের সঙ্গে থাকেন।  আর আল্লাহ তাআলা কারো সঙ্গে থাকলে কী হয় তার দুটো নজির আমরা কুরআন থেকে উল্লেখ করতে পারি। 

এক. খাতামুন্নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশে হিজরতের জন্য রওয়ানা করে পথিমধ্যে গারে ছাওরে আশ্রয় নিলেন। মক্কার কাফেররা তাঁর সন্ধানে মক্কার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। একপর্যায়ে তাদের কয়েকজন ছাওর পাহাড়েও পৌঁছে গেল। এমনকি যে গার বা গুহায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই গুহার কাছে পৌঁছে গেল। সঙ্গে ছিলেন হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু। হযরত আবু বকর রা. আতঙ্কিত হলেন। নিজের জন্য নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য। তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন এ কথা বলে যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা যদি মাথা নিচু করে পা বরাবর পাশে তাকায়, তাহলে আমাদেরকে দেখে ফেলবে, আমরা ধরা পড়ে যাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে এবং চূড়ান্ত আস্থার সঙ্গে বললেন

لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا.

[চিন্তা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। সূরা তাওবা (০৯) : ৪০]

এর পরের ঘটনা বিস্ময়কর! অনুসন্ধানী কাফেরদলের মস্তিষ্কে ঐ গুহার দিকে তাকানোর চিন্তাই আসেনি। তাদের মস্তিষ্ককে আল্লাহ তাআলা বোধশূন্য করে দিয়েছিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছাওর পাহাড়ে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রা.-কে সাথে নিয়ে সেখান থেকে নির্বিঘ্নে মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা করলেন এবং নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন। 

দুই. তদ্রূপ, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের দাসত্ব ও জুলুম হতে মুক্ত করার জন্য তাদেরকে নিয়ে শামের  উদ্দেশে রওয়ানা করলেন, তখন ফেরাউন তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও বনী ইসরাঈলের পিছু নিল। মিশর থেকে শামে যেতে হলে পূর্ব-উত্তরমুখী পথ ধরে যাওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু উত্তরমুখী পথে আসতে আসতেই পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দিক থেকে ফেরাউনের সৈন্যদল হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও বনী ইসরাঈলকে ঘিরে ফেলল। ফলে তিন দিকে ছিল ফেরাউনের সেনাদল আর সামনে ছিল লোহিত সাগর। এই অবস্থাদৃষ্টে বনী ইসরাঈল যারপরনাই হতাশার সুরে বলল

اِنَّا لَمُدْرَكُوْنَ .

[এখন আমরা নির্ঘাত ধরা পড়ব। দ্র. সূরা শুআ‘রা (২৬) : ৬১]

আরবী বাক্যে اِنَّلَ যুক্ত করে বাক্যের বক্তব্যকে জোরালো করা হয়। এখানে উভয়টিই যুক্ত করে তারা জোরালোভাবে তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করল যে, তারা ফেরাউনের সেনাবাহিনীর হাতে অবশ্যই ধরা পড়ে যাবে। এবং তাদের এরূপ নিশ্চিত ধারণা পার্থিব উপায়-উপকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলও ছিল না। কারণ, তারা তিন দিক দিয়ে ছিল ফেরাউনের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিবেষ্টিত আর সামনে ছিল লোহিত সাগর। পার্থিব উপায়-উপকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে বনী ইসরাঈলের রক্ষা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে তারা ঐরূপ উক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু আল্লাহর নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাদের ধারণাকে খণ্ডন করে ততধিক নিশ্চয়তা সহকারে বললেন

كَلَّا اِنَّ مَعِيَ رَبِّيْ سَيَهْدِيْنِ.

[কখ্খনো নয়আমার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে আমার রব্ব আছেন, তিনি অবিলম্বে আমাকে পথ দেখাবেন। সূরা শুআ‘রা (২৬) : ৬২]

এরপরের কাহিনী ছিল অদ্ভুত, মহা বিস্ময়কর। কুরআন সেই বিস্ময়কর কাহিনীর বর্ণনা প্রদান করেছে এইভাবে

فَاَوْحَیْنَاۤ اِلٰی مُوْسٰۤی اَنِ اضْرِبْ بِّعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانْفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِیْمِ.

সুতরাং আমি মূসার কাছে ওহী পাঠালাম তুমি তোমার লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত কর। ফলে সাগর বিদীর্ণ হল এবং প্রত্যেক ভাগ বড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে গেল। সূরা শুআ‘রা (২৬) : ৬৩

মূসা আ. কর্তৃক লাঠি দ্বারা সাগরকে আঘাত করার পর সাগরের পানি হয়ে গেল বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগ পাহাড়সম উঁচু ও নিশ্চল হয়ে গেল। পানির স্বাভাবিক ধর্ম হল প্রবহমানতা। আল্লাহ তাআলা পানির এই ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যকে কিছুক্ষণের জন্য রহিত করে দিলেন। সাগরের পানির তারল্য বজায় থাকল, কিন্তু তার প্রবহমানতা নিষ্ক্রিয় হওয়ায় তা হয়ে গেল স্থিরনিশ্চল ও নিষ্প্রবহ। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলকে নিয়ে নিরাপদে সাগরের পূর্ব প্রান্তে চলে আসলেন। ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনীর হাত থেকে বনী ইসরাঈল রক্ষা পেয়ে গেল।

পক্ষান্তরে ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী যখন সাগরের অভ্যন্তরে পথ দেখল এবং দেখল যে, বনী ইসরাঈল নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেছে তখন সে তার সেনাবাহিনীসহ বনী ইসরাঈলের পিছু নিতে সেই পথে নেমে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা পানিকে তার প্রবহমানতা ফিরিয়ে দিয়ে আদেশ করলেন মিশে যেতে। সাগরের পানি তার পূর্বরূপে ফিরে গেল। পানি তার প্রবহমানতা ফিরে পেল এবং বিভক্ত পানি একসঙ্গে মিশে গেল। ফলে ফেরাউন তার সেনাবাহিনীসহ পানিতে ডুবে মরল।

তো আল্লাহ তাআলা যদি সঙ্গে থাকেন, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম হয় না। সকল সংকট থেকে আল্লাহ তাআলা ব্যক্তিকে মুক্ত করে দেন। সকল অকল্যাণ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করেন। পার্থিব জীবনেও এবং পরকালীন জীবনেও।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাঁর আদেশ নিষেধ পালনে পরিপূর্ণ তাওফীক দান করুন এবং তাঁর মাই‘য়্যাত ও নৈকট্য দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন! 

 

 

advertisement