একটি বই, একটি চিঠি ॥
সালাতে হাত বেঁধে কোথায় রাখবে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নাভির নিচে হাত রাখা
নাভির নিচে হাত বাঁধার দলীল : ১
হযরত আলী রা. বলেন—
السنة وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.
أخرجه أبو داود (৭৫৬ في رواية ابن الأعرابي وابن داسة)، وأحمد ১/১১০ (৮৭৫)، وابن أبي شيبة (৩৯৬৬)، والدارقطني (১১০২، ১১০৩)
অর্থ : সুন্নত হল, নামাযে তালুর ওপরে তালু রেখে নাভির নিচে রাখা।
হাদীসটি আলী রা.-এর উক্তি হলেও পরোক্ষভাবে তা মারফূ হাদীস। কেননা, কোনো সাহাবী যখন কোনো আমলকে সুন্নত বলে আখ্যায়িত করেন তখন তা মারফূ হুকমী বা পরোক্ষ মারফূ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি হাদীসশাস্ত্রের একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি। হাদীসটি একাধিক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসটির সনদে একজন রাবী আছেন আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক। তিনি যঈফ রাবী। তবে ইমাম তিরমিযী রাহ. তার স্মৃতিশক্তির বিষয়ে আপত্তি রয়েছে— এ তথ্য দেওয়া সত্ত্বেও তার কোনো কোনো রেওয়ায়েতকে তিনি 'হাসানুন গরীবুন' বলেছেন। বিষয়টি হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. তার আলকাওলুল মুসাদ্দাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ দেখুন : জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৭৪১, ২০৫২, ৩৪৬২, ৩৫৬৩।
এই স্তরে আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক নামে দুইজন বর্ণনাকারী আছেন। একজন আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক আলকুরাশী আলমাদানী। আরেকজন আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক আবু শাইবা আলওয়াসিতী আলকূফী। আমাদের এখানে আলোচ্য ব্যক্তি হলেন আবু শাইবা আলওয়াসিতী আলকূফী। জামে তিরমিযীতে উভয়জনেরই বর্ণনা রয়েছে। তবে আমরা যে হাদীসগুলোর ক্রমিক নম্বর উল্লেখ করেছি, সেগুলো আবু শাইবা আলওয়াসিতী আলকূফীর বর্ণনাকৃত। যেমন—
৭৪১ নং হাদীসে আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন নুমান ইবনে সা'দ থেকে। তাহযীবুত তাহযীবে (১০/৪৫৩) নুমান ইবনে সা'দের জীবনীতে আছে—
روى عنه ابن أخته أبو شيبة عبد الرحمن بن إسحاق الكوفي، ولم يرو عنه غيره فيما قال أبو حاتم.
২০৫২ নং হাদীসে উল্লেখিত আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক দ্বারা যে আবু শাইবা আলওয়াসিতী উদ্দেশ্য— তা একাধিকজন বলেছেন। এমনকি লা-মাযহাবী আলেম শায়েখ আবদুর রহমান মুবারকপুরী রাহ.-ও তার তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থে (৬/২১০) বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
৩৪৬২ নং হাদীসটি সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. নাতাইজুল আফকার গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন—
وأخرجه الترمذي عن عبد الله بن أبي زياد، عن سيار...، وقال: حسن غريب من هذا الوجه.
قلت: وحسَّنه لشواهده، ومن ثم قيد الغرابة، وإلا فعبد الرحمن بن إسحاق ضعفوه، وهو أبو شيبة الواسطي، وله شيخ آخر يقال له عبد الرحمن بن إسحاق، قريب الطبقة من هذا، وهو مدني موثق.
৩৫৬৩ নং হাদীসটিতে আবদুর রহমান ইবনে ইসহাকের শায়েখ হলেন সাইয়ার আবুল হাকাম। কারো কারো ধারণা ছিল, সাইয়ারের শাগরিদ যে আবদুর রহমান ইবনে ইসহাক, তিনি হলেন কুরাশী। কিন্তু ইমাম মিযযী রাহ. তাদের এই ধারণা খণ্ডন করেছেন। তিনি তাহযীবুল কামালে কুরাশীর জীবনীতে (১৬/৫১৯-৫২০) টীকায় বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। কুরাশীর মাশায়েখের তালিকায় একজন আছেন সুহাইল ইবনে আবী সালেহ। তার নামের ওপর ইমাম মিযযী রাহ. যে টীকা লিখেছেন, সেটি তাহযীবুল কামালের মুহাক্কিক শায়েখ বাশশার উদ্ধৃত করেছেন এই শব্দে—
جاء في حواشي النسخ تعليق للمصنف، يتعقب فيه صاحبَ) الكمال(، نصه:
))كان فيه:)وسيار أبي الحكم(، وكذلك ذكره ابن أَبي حاتم، وتابعه أبو القاسم على ذلك. وهو وهم. إنما الذي يروي عن سيار أبي الحكم : عبد الرحمن بن إسحاق أبو شَيْبَة الواسطي، جاء ذلك بينا في سنن أَبِي دَاود في باب وضع الكف على السرة((.
قلت: هو في سنن أبي داود (৭৫৮) .
আলী রা.-এর আসারের আরেকটি সূত্র
আলী রা. থেকে এ আসারটি আরেকটি সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে, যেটি ইমাম দারাকুতনী রাহ. স্বীয় আলগারাইব ওয়াল আফরাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দারাকুতনী রাহ.-এর এ কিতাবটি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে ছাপা হয়নি। তবে এ কিতাবের একটি সংক্ষিপ্ত ও সুবিন্যস্ত সংস্করণ প্রস্তুত করেছেন ইমাম আবুল ফযল মুহাম্মাদ ইবনে তাহের মাকদিসী (৫০৭ হি.) রাহ., যিনি ইবনুল কায়সারানী নামে পরিচিত। এটি 'কিতাবু আতরাফিল গারাইবি ওয়াল আফরাদ লিদদারাকুতনী' নামে ১৪২৮ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা সেখান থেকে ইমাম দারাকুতনী রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি—
حَدِيث : قَالَ عَليّ : من السُّنة وضع الأكف على الأكف فِي الصَّلَاة تَحت السُّرَّة.
غَرِيب من حَدِيث عون بن أبي جُحَيْفَة، عَن أَبِيه. تفرد بِهِ الْقَاسِم بن الحكم، عَن النَّضر بن إِسْمَاعِيل، عَن عبد الْكَرِيم، عَن عون، عَن أَبِيه.
অর্থ : হাদীস : আলী রা. বলেন, সুন্নত হল নামাযে তালুর ওপরে তালু রেখে নাভির নিচে রাখা।
'আউন ইবনে আবী জুহায়ফাহ, তার পিতার সূত্রে'— এই সনদে হাদীসটি গরীব। এটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন কাসেম ইবনুল হাকাম— নযর ইবনে ইসমাঈল থেকে, তিনি আবদুল কারীম থেকে, তিনি আউন থেকে, তিনি তার পিতা আবু জুহায়ফাহ থেকে (আর আবু জুহায়ফাহ আলী রা. থেকে)।
এই সনদে আবদুল কারীম নামে এক রাবী আছেন। এ স্তরে আবদুল কারীম নামে দুইজন রাবী প্রসিদ্ধ। একজন আবদুল কারীম ইবনে মালিক জাযারী, আরেকজন আবদুল কারীম ইবনে আবিল মুখারিক। জাযারী হলেন সিকাহ (বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য) আর ইবনে আবিল মুখারিক যয়ীফ; অর্থাৎ স্মৃতিশক্তির দিক থেকে দুর্বল। তবে মুহাদ্দিসগণ ইবনে আবিল মুখারিকের রেওয়ায়েত শাহেদ (সমর্থক বর্ণনা) হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমন হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. আলআমালিল মুতলাকাহ গ্রন্থে এক হাদীস প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন—
رُوَاتُه مُوَثَّقُونَ إِلَّا عَبْدَ الْكَرِيم، وَهُوَ أَبُو أُمَيَّةَ بْنُ أَبِي الْمَخَارِقِ، فَإِنَّه ضَعِيفٌ، لكِنَّه شَاهِدٌ جَيِّدٌ لِلْحَدِيثِ الْمَاضِي.
অর্থ : এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, কেবল আবদুল কারীম ব্যতীত। তিনি আবু উমাইয়া ইবনু আবিল মুখারিক। তিনি যয়ীফ। তবে এটি পূর্ববর্তী হাদীসের উত্তম শাহেদ।
মোটকথা আলোচ্য সনদে আবদুল কারীম দ্বারা যদি জাযারী উদ্দেশ্য হন, তাহলে সনদটি হাসান। আর ইবনে আবিল মুখারিক উদ্দেশ্য হলে তা পূর্ববর্তী সনদের শাহেদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
যাহোক আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত আসারটি দলীলযোগ্য। কারণ—
ক. তা ভিন্ন ভিন্ন দুটি সনদে বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে।
খ. এটি শায বা মুনকারের আওতায় পড়ে না।
গ. এর সমর্থনে আমলে মুতাওয়ারাস রয়েছে। অর্থাৎ সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে নাভির নিচে হাত বাঁধার বিষয়টি প্রমাণিত আছে এবং যুগ-পরম্পরায় এটি চলে আসছে। (আমলে মুতাওয়ারাস সম্পর্কে সামনে আলোচনা আসছে।)
একটি আপত্তি ও তার খণ্ডন
আলী রা.-এর এ আসারের ওপর কোনো কোনো লা-মাযহাবী আলেম এই আপত্তি উত্থাপন করেছেন যে, আলী রা. থেকে তো এর বিপরীত আমলও বর্ণিত আছে। সুনানে আবু দাউদে আছে—
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ قُدَامَةَ يَعْنِي ابْنَ أَعْينَ، عَنْ أَبِي بَدْرٍ، عَنْ أَبِي طَالُوتَ عَبْدِ السَّلَامِ، عَنِ ابْنِ جَرِيرٍ الضَّبِّيِّ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: رَأَيْتُ عَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يُمْسِكُ شِمَالَه بِيَمِينِه عَلَى الرُّسْغِ فَوْقَ السُّرَّةِ.
অর্থাৎ ইবনে জারীর যাব্বী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি আলী রা.-কে নাভির ওপরে কবজির ওপর ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরতে দেখেছি।
কিন্তু তাদের এ আপত্তি যথার্থ নয়। কারণ—
প্রথমত আবু তালুত আবদুস সালাম থেকে রেওয়ায়েতটি একাধিক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন। যেমন—
১. আবু বদর শুজা' ইবনুল ওয়ালীদ।
২. ওয়াকী ইবনুল জাররাহ।
৩. মুসলিম ইবনে ইবরাহীম।
কিন্তু فوق السرة (নাভির ওপরে) এই অতিরিক্ত অংশটি কেবল আবু বদরের বর্ণনাতেই আছে; অপর দুই রাবীর বর্ণনাতে তা নেই। ওয়াকী ইবনুল জাররাহ হলেন ইমাম। মুসলিম ইবনে ইবরাহীমও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য রাবী। পক্ষান্তরে আবু বদর এতটা শক্তিশালী রাবী নন যে, ওয়াকী ও মুসলিম ইবনে ইবরাহীমের বর্ণনার বিপরীতে তার বর্ণনা গ্রহণ করা হবে। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. তাকরীবুত তাহযীবে আবু বদর সম্পর্কে বলেন—
صدوق ورع له أوهام.
(তিনি সত্যবাদী, মুত্তাকী। তবে তার বর্ণনাকৃত রেওয়ায়েতসমূহে কিছু ত্রুটি রয়েছে।)
এ কারণে আল্লামা নিমাবী (১৩২২ হি.) রাহ. বলেছেন—
وزيادة)) فوق السرة ((غير محفوظة.
অর্থাৎ فوق السرة (নাভির ওপর) এই অতিরিক্ত অংশটি সংরক্ষিত নয়।
দ্বিতীয়ত যদি فوق السرة (নাভির ওপর) এই অতিরিক্ত অংশটিকে সহীহও ধরে নেওয়া হয়, তবুও এ আপত্তি যথার্থ নয়। কারণ تحت السرة (নাভির নিচে)-এর বর্ণনাটি হল আলী রা.-এর বক্তব্য, যেখানে তিনি হাত রাখার সুন্নাহসম্মত স্থান কোন্টি তা ব্যক্ত করেছেন। আর فوق السرة (নাভির ওপর)-এর বর্ণনাটি হল তার ব্যক্তিগত আমলের বিবরণ, যেটা তার শাগরিদ ও সহচর জারীর যাব্বী রাহ. বর্ণনা করেছেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মাঝে মূলত কোনো বৈপরীত্য নেই। কারণ নাভির নিচে হাত বাঁধা হল সুন্নত, যেমনটি আলী রা. বলেছেন। কিন্তু হতে পারে, কোনো সময় তিনি ওযরের কারণে নাভির ওপরে হাত রেখেছেন। কারণ তার জীবনীতে আছে, একটা পর্যায়ে তিনি অনেক স্থূলোদরী হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো এই কারণেই তিনি নাভির নিচে হাত বাঁধতে পারতেন না; তাই নাভির ওপরে হাত বাঁধতেন।
নাভির নিচে হাত রাখার দলীল : ২
বিশিষ্ট ফকীহ তাবেয়ী ইবরাহীম নাখাঈ (৯৬ হি.) রাহ.-এর ফতোয়া, যিনি কুরআন, হাদীস ও ফিকহ সকল ক্ষেত্রেই ইমাম ছিলেন এবং বিশেষভাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর ইলমের ওয়ারিস ও ধারক-বাহক ছিলেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আ'মাশ (৬১-১৪৮ হি.) রাহ. বলেন—
كَانَ إِبْرَاهِيمُ صَيْرَفِيَّ الْحَدِيثِ، فَكُنْتُ إِذَا سَمِعْتُ الْحَدِيثَ مِنْ بَعْضِ أَصْحَابِنَا عَرَضْتُهُ عَلَيْهِ.
ইবরাহীম নাখাঈ ছিলেন হাদীসের খাজাঞ্চি। আমি আমাদের কারো থেকে কোনো হাদীস শুনলে সেটা তার সামনে পেশ করতাম।
বিশিষ্ট তাবেয়ী সাঈদ ইবনে জুবায়ের (৯৫ হি.) রাহ. সম্পর্কে তার শাগরিদ আবদুল মালিক ইবনে আবী সুলায়মান বলেন, আমার উপস্থিতিতে সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হল। তখন তিনি বললেন—
تَسْتَفْتُونِي وَفِيكُمْ إِبْرَاهِيمُ النَّخَعِيُّ؟
তোমরা আমাকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করছ, অথচ তোমাদের মাঝে ইবরাহীম নাখাঈ আছেন?
ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন—
وَكَانَ بَصِيْرًا بِعِلْمِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ، وَاسِعَ الرِّوَايَةِ، فَقِيْهَ النَّفْسِ، كَبِيْرَ الشَّأْنِ، كَثِيْرَ المَحَاسِنِ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى.
তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর ইলমের বিষয়ে অভিজ্ঞ, হাদীস বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী, স্বভাবজাত ফকীহ এবং মহান ব্যক্তিত্ব ও বহু গুণাবলির অধিকারী।
ইবরাহীম নাখাঈ রাহ.-এর ফতোয়াটি বর্ণনা করেছেন ইবনে আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফে এই সনদে এইভাবে—
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ رَبِيعٍ، عَنْ أَبِي مَعْشَرٍ، عَنْ إبْرَاهِيمَ، قَالَ: يَضَعُ يَمِينَه عَلى شِمَالِه فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّة.
ইবরাহীম নাখাঈ বলেন, নামাযে বাম হাতের ওপর ডান হাত রেখে নাভির নিচে রাখবে।
এটির সনদ হাসান পর্যায়ের।
নাভির নিচে হাত রাখার দলীল : ৩
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু মিজলায (১০৬ হি.) রাহ.-এর ফতোয়া। ফতোয়াটি বর্ণিত হয়েছে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় এই সনদে—
حَدَّثَنَا يَزِيْدُ بْنُ هَارُوْنَ، قَالَ: اَخْبَرَنَا الْحَجَّاجُ بْنُ حَسَّانُ، سَمِعْتُ أَبَا مِجْلَزٍ أَوْ سَأَلْتُه، قَالَ: قُلْتُ : كَيْفَ يَضَعُ؟ قَالَ: يَضَعُ بَاطِنَ كَفِّ يَمِيْنِه عَلٰى ظَاهِرِ كَفِّ شِمَالِه، وَيَجْعَلهَا أَسْفَلَ مِنَ السُّرَّةِ.
অর্থ : ইয়াযীদ ইবনে হারূন আমাদের নিকট বর্ণনা করে বলেন, হাজ্জাজ ইবনে হাসসান আমাদেরকে জানিয়েছেন, আমি আবু মিজলায রাহ.-কে বলতে শুনেছি, অথবা হাজ্জাজ বলেছেন, আমি আবু মিজলাযকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে হাত রাখবে? তিনি বললেন, ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠের ওপর রেখে নাভির নিচে রাখবে।
ফতোয়াটির সনদ সহীহ। কিন্তু মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তা উল্লেখ করার পর 'তাহক্বীক্ব' শিরোনামে লিখেছেন—
'উক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর সনদ বিচ্ছিন্ন। যদিও কেউ তাকে 'সুন্দর সনদ' বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ছহীহ হাদীছের বিরোধী হলে কিভাবে তাকে সুন্দর সনদ বলা যায়?'
এখানে তিনি একাধিক ভুল ও অবাস্তব কথা বলেছেন—
ক. তিনি এর সনদকে বিচ্ছিন্ন বলেছেন এবং টীকায় আওনুল মা'বুদ গ্রন্থের বরাত দিয়েছেন। আওনুল মা'বুদ গ্রন্থের লেখক বলেছেন—
مقْطُوْعٌ لِأنَّ اَبَا مِجْلَزٍ تَابِعِيٌ
(বর্ণনাটি মাকতূ', কেননা আবু মিজলায তাবেয়ী।)
তো মুযাফফর সাহেব এখানে মাকতূ' শব্দটির অর্থ বুঝেছেন বিচ্ছিন্ন সনদ-বিশিষ্ট। এটা স্পষ্ট ভুল।
'বিচ্ছিন্ন সনদ' বোঝাতে মুহাদ্দিসগণ সাধারণত 'মুনকাতি'' শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। হাঁ, 'বিচ্ছিন্ন সনদ' বুঝানোর জন্য মাকতূ' শব্দও কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়েছে। তবে কোন তাবেয়ীর উক্তি ও কর্মকেও মাকতূ' বলা হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি বা কর্মসম্বলিত বর্ণনাকে বলা হয় মারফূ এবং সাহাবীর উক্তি বা কর্মসম্বলিত বর্ণনাকে বলা হয় মাওকুফ। তবে মাকতূ' শব্দটি কোথায় কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা কথকের কথার পূর্বাপর দেখে বুঝে নিতে হয়।
আওনুল মা'বুদ গ্রন্থের লেখক বর্ণনাটি মাকতূ' কেন তার কারণ বর্ণনা করে বলেছেন যে, কেননা আবু মিজলায তাবেয়ী।
আওনুল মা'বূদ গ্রন্থের গ্রন্থকারের এই উক্তি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি বিচ্ছিন্ন সনদ হওয়ার কারণে এখানে মাকতূ' শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি মাকতূ' শব্দের ব্যবহার করেছেন এটি একজন তাবেয়ীর উক্তি হওয়ার কারণে। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব যদি কথাটি নিয়ে একটু ভাবতেন, তাহলে তিনি এখানে মাকতূ' শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন বলে মনে করতেন না। কারণ তাবেয়ী হওয়াটা সনদ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো কারণ হতে পারে না। সনদ বিচ্ছিন্ন হয় দুইজন বর্ণনাকারীর মাঝখানে একজন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতির কারণে। এটি একজন তাবেয়ীর উক্তি এবং সেই উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া অবিচ্ছিন্ন সনদে।
আবু মিজলাযের ফতোয়াটির সনদ সম্পর্কে শায়েখ আলবানী রাহ. বলেছেন—
وَاِسْنَادُه صَحِيْحٌ، وَقَالَ اِبْنُ التُّرْكمَانِيْ جَيِّدٌ.
(এর সনদ সহীহ। ইবনুত তুরকুমানী বলেছেন, উত্তম।)
তো মুযাফফর সাহেব তার বক্তব্য 'যদিও কেউ তাকে 'সুন্দর সনদ' বলে মন্তব্য করেছেন'-এর টীকায় শায়েখ আলবানীর যয়ীফু সুনানি আবী দাউদ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, কিন্তু তার মন্তব্য উল্লেখ করেননি। কেন উল্লেখ করলেন না ভাই! শায়খ আলবানী তো সনদটিকে স্পষ্ট ভাষায় সহীহ বলেছেন। আর সনদটি যে সহীহ তার সমর্থনেই ইবনুত তুরকুমানীর মন্তব্যের তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, ইবনুত তুরকুমানী বলেছেন, হাদীসটির সনদ জায়্যিদ।
খ. মুযাফফর সাহেব লিখেছেন—
'কিন্তু ছহীহ হাদীসের বিরোধী হলে কিভাবে তাকে সুন্দর সনদ বলা যায়?'
অদ্ভুত! অদ্ভুত কথা! বিরোধী হওয়ার সাথে হাদীসের সনদ সুন্দর অসুন্দর হওয়ার বা সহীহ ও যঈফ হওয়ার কী সম্পর্ক? বহু সহীহ হাদীসের মধ্যে পারস্পরিক বাহ্য বিরোধ দেখা দেয়। তখন কি শুধু বিরোধের কারণে মুহাদ্দিসগণ কোনো হাদীসের সনদকে যঈফ বলে দেন?
ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. ও আবু মিজলায রাহ.-এর ফতোয়ার ওপর দুইটি আপত্তি এবং সেগুলোর খণ্ডন
মুযাফফর সাহেব নিজের দাবির সমর্থনে ৭৯৯ ও ৮০১ নং টীকায় দুটি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন— আওনুল মা'বুদ ও মির'আতুল মাফাতীহ। আওনুল মা'বুদের লেখক হলেন শায়েখ মুহাম্মাদ শামসুল হক আযীমাবাদী (১২৭৩ হি.-১৩২৯ হি.)। আর মির'আতুল মাফাতীহের লেখক হলেন শায়েখ আবুল হাসান উবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২৭ হি.-১৪১৪ হি.)। দুইজনই লা-মাযহাবী আলেম। এবং জন্ম-মৃত্যুসন থেকে স্পষ্ট, তারা কাছাকাছি সময়ের মানুষ; এরপরও মুযাফফর সাহেব তাদের কথাকেই দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যাহোক তাদের কথার খোলাসা হল, এখানে দুইটি আপত্তি রয়েছে—
ক. এগুলো তাবেয়ীদের বক্তব্য। আর তাবেয়ীদের বক্তব্য দলীল হিসেবে পেশ করা যাবে না।
খ. তাদের বক্তব্য সহীহ হাদীসের বিপরীত। সুতরাং সেগুলো অগ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয় আপত্তিটির জবাব আগে দিচ্ছি। আমাদের পূর্বের আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বুকের ওপর হাত বাঁধার পক্ষে সহীহ ও দলীলযোগ্য কোনো হাদীস অথবা কোনো সাহাবী, তাবেয়ী ও ইমামের বক্তব্য বা আমল আমরা পাইনি এবং এখন পর্যন্ত কোনো লা-মাযহাবী আলেম তা দেখাতে পারেননি। সুতরাং ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. ও আবু মিজলায রাহ.-এর ফতোয়া সহীহ হাদীসের বিরোধী হল কীভাবে? শুধু দাবি করলেই তো হবে না, প্রমাণ করতে হবে।
প্রথম আপত্তির জবাব— শায়েখ আযীমাবাদী ও উবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী রাহ. কেবল তাবেয়ীদের বক্তব্য হওয়ার কারণে যেভাবে এককথায় সেগুলোকে নাকচ করে দিলেন, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। মনে রাখতে হবে, ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. ও আবু মিজলায রাহ. কোনো সাধারণ তাবেয়ী ছিলেন না; বরং তারা তাদের যুগেও আহলে ইলমের নিকট ইমাম হিসেবে বরেণ্য ছিলেন। অত্যন্ত আস্থাভাজন ও মান্যবর ছিলেন। আর তাদের এই বক্তব্যদুটি কেবলই বক্তব্য নয়, বরং এগুলোকে তারা ফতোয়া হিসেবে পেশ করেছেন, যার পেছনে অবশ্যই দলীল রয়েছে। খোদ সাহাবায়ে কেরামও তাবেয়ীদের মধ্যে যারা বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, তাদের ফতোয়াকে গুরুত্ব দিতেন এবং অন্যদেরকে তাদের ফতোয়া অনুসরণের আদেশ করতেন। খালেদ ইবনে রিয়াহ থেকে বর্ণিত, একবার আনাস বিন মালিক রা.-কে একটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন—
عَلَيْكُمْ مَوْلانَا الْحَسَنَ، فَسَلُوهُ.
তোমরা হাসান (অর্থাৎ হাসান বসরী)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে এক ব্যক্তি ফারায়েয তথা মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি বণ্টন সম্পর্কিত একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করল। তখন আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বললেন—
سَلْ عنها سعيدَ بن جبير، فإنه يعلم منها ما أعلم، ولكنه أَحسَب مني.
তুমি এ সম্পর্কে সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে জিজ্ঞেস কর। কারণ সে এ সম্পর্কে তা-ই জানে, যা আমি জানি। তবে হিসেবে সে আমার চেয়ে অভিজ্ঞ।
সাহাবায়ে কেরাম এভাবেই তাবেয়ীগণের ইলম ও ফিকহের মূল্যায়ন করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে কূফার অধিবাসী কেউ কোনো মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন—
أَلَيْسَ فِيكُمُ ابْنُ أُمِّ الدَّهْمَاءِ؟ (يعني سعيد بن جبير)
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে কি সাঈদ ইবনে জুবায়ের নেই?
একটু আগেই পড়েছি, এই সাঈদ ইবনে জুবায়েরকেই যখন ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি বললেন, 'তোমাদের মাঝে ইবরাহীম নাখাঈ থাকা সত্ত্বেও তোমরা আমার কাছে ফতোয়া জানতে চাইছ?'
অতএব যারা তাবেয়ীগণের ফতোয়াসমূহকে মূল্যায়ন করে না, তারা নিঃসন্দেহে ভুলের মধ্যে রয়েছে।
তো আমরা দেখতে পেলাম যে, নাভির নিচে হাত বাঁধার পক্ষে যদিও সরাসরি কোনো মারফূ হাদীস নেই; কিন্তু আলী রা.-এর একটি বক্তব্য রয়েছে, যেটিকে মুহাদ্দিসগণ পরোক্ষ মারফূ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। সেই হিসেবে একটি মারফূ হাদীস আছে বলে অবশ্যই দাবি করা যায়। সেইসঙ্গে ইরবাহীম নাখাঈ ও আবু মিজলায রাহ.-এর মতো দুইজন ফকীহ তাবেয়ীর ফতোয়াও রয়েছে।
নাভির নিচে হাত রাখার দলীল : ৪
আমলে মুতাওয়ারাস একটি শক্তিশালী দলীল
নাভির নিচে হাত বাঁধার পক্ষে হানাফীগণের একটি শক্তিশালী দলীল হল, আমলে মুতাওয়ারাস। অর্থাৎ সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে যুগ পরম্পরায় অবিচ্ছিন্ন ধারায় চলে আসা আমল।
আমলে মুতাওয়ারাস শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী দলীল। কেননা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল আমাদের নিকট পৌঁছেছে দুইভাবে—
এক. সাহাবী ও তৎপরবর্তীগণের মৌখিক বর্ণনাসূত্রে।
দুই. কর্মের ধারাবাহিকতায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজীর আমল ও কর্ম দেখে দেখে তাঁর আমল শিক্ষা করেছেন ও গ্রহণ করেছেন। অতঃপর তাবেয়ীগণ সাহাবীগণ থেকে গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে নবীজীর শিক্ষাকে গ্রহণ করেছেন। নবী-শিক্ষার এই প্রকারটিকে পরিভাষায় 'আমলে মুতাওয়ারাস' বা 'সুন্নতে মুতাওয়ারাসা' বলে।
ওযু থেকে শুরু করে নামাযের সালাম ফেরানো পর্যন্ত নামায-সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ নিয়ম ও রীতি-নীতি সাহাবায়ে কেরাম শিখেছেন মৌলিকভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযু ও নামায দেখে দেখে। এতদসংক্রান্ত বিখ্যাত হাদীসটির কথা তো প্রায় সকলেই জানে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ اُصَلِّيْ.
অর্থাৎ 'আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখ, তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর।'
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিজে সালাত আদায়ের মাধ্যমে সালাতের পদ্ধতি ও কার্যাবলি দেখিয়ে দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন সময় মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমেও সালাতের পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মৌলিকভাবে সালাত আদায়ের পদ্ধতি তুলে ধরেছেন নিজেরা সালাত আদায় করে দেখানোর মাধ্যমে। সেইসঙ্গে তাঁরা সালাতের রীতি-নীতি সংক্রান্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কওল ও ফে'লের তথা তাঁর উক্তি ও কর্মের বর্ণনাও দান করেছেন। তবে সালাতের যাবতীয় রীতি-নীতি ও নিয়ম-কানুনের শিক্ষা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বর্ণনার মাধ্যমে দেননি; বরং নিজে সালাত আদায়ের মাধ্যমে এর পদ্ধতিগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরামও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সালাত আদায়ের পদ্ধতি তুলে ধরেছেন মৌলিকভাবে নিজেরা সালাত আদায় করে দেখানোর মাধ্যমে। এরপর সাহাবায়ে কেরাম থেকে যারা নামায শিখেছেন তারাও তাদের পরবর্তীদেরকে নিজেরা নামায পড়ে দেখিয়েছেন। এভাবে প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম নামায শিখেছে তাদের পূর্ববর্তীদের দেখে দেখে।
সালাত ছাড়া আরো বহু বিষয়ে নববী নির্দেশনা পরবর্তীদের কাছে পৌঁছেছে এভাবেই।
সুতরাং যেসব নববী শিক্ষা ও নির্দেশ পরবর্তীদের কাছে পৌঁছেছে এই কর্মের ধারাবাহিকতায়, সেসব শিক্ষা-নির্দেশনা যদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যে তালাশ করা হয়, তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়তো এ ব্যাপারে কোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায় না বা পাওয়া গেলেও সনদের দিক থেকে তা হয় যঈফ। আর তখনই স্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প-বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায় না, তখন নবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা সূত্রের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত হয়ে আছে। এজন্যই ইমাম মালেক রাহ.বলেন—
اَلْعَمَلُ اَثْبَتُ مِنَ الْأَحَادِيْثِ.
অর্থাৎ কর্মের মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয় সনদভিত্তিক মৌখিক বর্ণনা অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী।
তো সালাতের রীতি-নীতির মধ্য হতে হাত বেঁধে তা কোথায় রাখতে হবে এই বিষয়টিও এইরূপ একটি বিষয়, যে বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে মৌখিক বর্ণনায় আসেনি; বরং তা এসেছে কর্মের ধারাবাহিকতায় এবং সাহাবায়ে কেরামের শেখানোর মাধ্যমে। ইমাম তিরমিযী রাহ. (মৃত্যু ২৭৯ হি.) যেমনটা আমাদের জানিয়েছেন। তিনি হাত বাঁধা সংক্রান্ত হুলব রা.-এর হাদীসটি উল্লেখ করার পর কী বলেছেন দেখুন—
عَنْ قَبِيصَةَ بْنِ هُلْبٍ، عَنْ أَبِيْهِ، قَالَ: كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَؤُمُّنَا، فَيَأْخُذُ شِمَالَه بِيَمِيْنِه.
قَالَ: وَفِيْ الْبَابِ عَنْ وَائِلٍ بْنِ حُجْرٍ، وَغُطَيْف بْنِ الْحَارِثِ، وَاِبْنِ عَبّاسٍ، وَاِبْنِ مَسْعُوْدٍ، وَسَهْلِ بْنِ سَعْدٍ.
قَالَ أَبُوْ عِيْسٰى: حَدِيْثُ هُلْبٍ حَدِيْثٌ حَسَنٌ.
وَالْعَمَلُ عَلٰى هٰذَا عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالتَّابِعِيْنَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ؛ يَرَوْنَ اَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ يَمِيْنَه عَلٰى شِمَالِه فِي الصَّلَاةِ.
وَرَأٰى بَعْضُهُمْ أَنْ يَّضَعُهُمَا فَوْقَ السُّرَّةِ، وَرَأٰى بَعْضُهُمْ أَنْ يَضَعُهُمَا تَحْتَ السُّرَّةِ، وَكُلُّ ذٰلِكَ وَاسِعٌ عِنْدَهُمْ.
'ওয়ায়েল ইবন হুজ্র রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে আমাদের ইমামতি করতেন। তো তিনি তাঁর ডান হাতকে বাম হাত দ্বারা ধরতেন।'
এরপর ইমাম তিরমিযী এতদসংক্রান্ত হাদীস আর কারা বর্ণনা করেছেন তার বিবরণ তুলে ধরেছেন। অতঃপর বলেছেন—
'সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তীগণের আমল এইরূপই। তাঁরা ডান হাতকে বাম হাতের ওপর রাখার পক্ষে ছিলেন।'
এর পরে তিনি প্রসঙ্গত ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে শরীরের কোন্ জায়গায় রাখতে হবে সে সম্পর্কে দুটো মত তুলে ধরেছেন। শেষের লাইনটি দেখুন। সেখানে তিনি বলছেন—
'কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হাতদুটোকে নাভির ওপরে রাখবে এবং কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হাতদুটোকে নাভির নিচে রাখবে। এই উভয়টিই তাঁদের নিকট ছিল গ্রহণযোগ্য।'
লক্ষণীয় যে, ইমাম তিরমিযী রাহ. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মধ্যে এবং ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর যুগের আহলে ইলমগণের মধ্যে পরিপালিত দুটি আমলের কথা তুলে ধরেছেন— নাভির ওপরে হাত বাঁধা এবং নাভির নিচে হাত বাঁধা। তৃতীয় কোনো আমলের কথা তথা বুকের ওপর হাত বাঁধার কথা তাঁর বক্তব্যে আমরা পাচ্ছি না। সুতরাং বোঝা গেল, নাভির নিচে হাত বাঁধার পদ্ধতিটি প্রমাণিত একটি পদ্ধতি। পদ্ধতিটি সাহাবী ও তাবেয়ীগণের আমলের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে, যা মূলত নবীজী কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা থেকেই গৃহীত। আল্লাহ আমাদেরকে সব বিষয় যথাযথ বোঝার তাওফীক দান করুন।
শায়েখ আলবানীর স্বীকারোক্তি
শায়েখ আলবানীও প্রকারান্তরে স্বীকার করেন যে, বুকের ওপর হাত বাঁধার আমল সাহাবী ও তাবেয়ী যুগে ছিল না। কারণ, তিনি ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে বলেছেন—
وَاَسْعَدُ النَّاسِ بِهٰذِهِ السُّنَّةِ الصَّحِيْحَةِ اَلْاِمَامُ اِسْحَاقُ ابْنُ رَاهَوَيْه، فَقَدْ ذَكَرَ الْمَرْوَزِيُّ فِي (الْمَسَائِلِ): كَانَ اِسْحَاقُ يُوْتِرُ بِنَا... وَرَفَعَ يَدَيْهِ فِي الْقُنُوْتِ، وَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوْعِ، وَيَضَعُ يَدَيْهِ عَلٰى ثَدْيَيْهِ أَوْ تَحْتَ الثَّدْيَيْنِ.
অর্থাৎ এই সহীহ সুন্নতটির ওপর আমল করে সর্বাধিক ধন্য হয়েছিলেন ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ্। কেননা, মারওয়াযী তাঁর 'আলমাসাইল' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইসহাক রাহ. আমাদেরকে নিয়ে বিতির পড়তেন... এবং তিনি কুনূতে হাতদুটো ওপরে ওঠাতেন এবং রুকুর পূর্বেই কুনূত পাঠ করতেন এবং হাতদুটো রাখতেন তাঁর বুকের ওপরে কিংবা বুকের নিচে।
শায়েখ আলবানীর এই বক্তব্য দ্বারা এটা তো পরিষ্কার যে, তিনি ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (১৬১-২৩৮ হি.)-এর আগে এমন কাউকে পাননি, যার দিকে তিনি বুকের ওপর হাত রাখার বিষয়টি সম্বন্ধ করতে পারেন। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা জানতে পেরেছি যে, বুকের ওপর হাত বাঁধার আমলটির পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই। যা আছে তা যঈফ। যদি সহীহ হাদীসও বিদ্যমান থাকত, তাহলেও শুধু সাহাবী ও তাবেয়ী এবং তৎপরবর্তীযুগে সে অনুযায়ী আমল না থাকাটা একটা প্রশ্নের জন্ম দিত। কারণ, সহীহ হাদীস বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সাহাবী, তাবেয়ী ও তৎপরবর্তীযুগে সেই সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমল না থাকাটা এই বিষয়টি নিশ্চিত করত যে, নিশ্চয়ই সহীহ হাদীসটি কোনো কারণে আর আমলযোগ্য নেই। সুতরাং বুকের ওপর হাত বাঁধার পক্ষে শুধু যঈফ হাদীস বিদ্যমান থাকা এবং সাহাবী, তাবেয়ী ও তৎপরবর্তী যুগে সে অনুযায়ী আমল না থাকাটা তো আরও বড় দলীল হয়ে দাঁড়ায় এই কথার পক্ষে যে, বুকের ওপর হাত বাঁধার আমলটি কোনো কালেই সুন্নতের অংশ ছিল না।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, শায়েখ আলবানী যে ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর দিকে বুকের ওপর হাত বাঁধার বিষয়টি সম্বন্ধ করলেন, তা বাস্তবসম্মত কি না? এবং তিনি ইসহাক রাহ.-এর উক্ত বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা সঠিক কি না? সামনে আমরা এ দুটি বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
নামাযে হাত বাঁধার বিষয়ে ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ্ রাহ.-এর মাযহাব
শায়েখ আলবানীর দাবি, ইসহাক রাহ.-এর মাযহাব হল বুকের ওপর হাত বাঁধা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, শায়েখ আলবানীর দাবির বিপরীত স্বয়ং ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহরই একটি বক্তব্য আমরা পাই খোদ এই মারওয়াযীর ঐ কিতাবেই, যে কিতাব থেকে শায়েখ আলবানী ইসহাক সম্পর্কে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। কিতাবটির পূর্ণ নাম হচ্ছে মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক ইবন রাহাওয়াইহ। সেখানে ২১৪নং মাসআলায় মারওয়াযী ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর নিম্নোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। ইসহাক রাহ. বলেন—
تَحْتَ السُّرَّةِ اَقْوٰى فِي الْحَدِيْثِ وَاَقْرَبُ اِلَى التَوَاضُعِ.
অর্থাৎ নাভির নিচে হাত বাঁধা হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের অধিকতর নিকটবর্তী।
এতে বোঝা যায় যে, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর মাযহাব ছিল নাভির নিচে হাত বাঁধা।
শুধু এই গ্রন্থেই নয়, বরং অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর মাযহাব ছিল নাভির নিচে হাত বাঁধা। আলআওসাত গ্রন্থে ইবনুল মুনযির, আততামহীদ গ্রন্থে ইবনে আবদিল বার, মুসলিম শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে ইমাম নববী রাহ., আলমাআনিল বাদীআ গ্রন্থে জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ রায়মী, নায়লুল আওতার গ্রন্থে শায়েখ শাওকানী রাহ. প্রমুখ উল্লেখ করেছেন যে, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর মাযহাব ছিল নাভির নিচে হাত বাঁধা।
ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর বক্তব্যের যথার্থ মর্মটি কী?
এবার প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, তাহলে শায়েখ আলবানী কর্তৃক উদ্ধৃত আলমাসাইল গ্রন্থের উপরিউক্ত বক্তব্যের অর্থ কী? শায়েখ আলবানী কিন্তু পূর্বাপরসহ পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেননি। আমরা প্রথমে আলমাসাইল গ্রন্থ থেকে পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করব—
وكان إسحاق يوتر بنا، فربما قرأ في أول ركعة بالأعراف، ويصادف وتره الصبح.
قال إسحاق بن منصور: هذا كله كتبته عن إسحاق بن إبراهيم بنيسابور.
وكان إسحاق يرى قضاء الوتر بعد الصبح ما لم يصل الفجر، ويرفع يديه في القنوت الشهر كله، ويقنت قبل الركوع، ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين، ويقرأ بالسورتين، ويقرأ في كل واحدة : بسم الله الرحمن الرحيم، ثم يدعو ويؤمن من خلفه. يدعو للمؤمنين والمسلمين، ويدعو على الكافرين، ويصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، ويدعو بدعاء الحسن بن علي رضي الله عنهما، ويقرأ بآخر البقرة، ثم يسكت ساعة، ثم يركع.
অর্থ : ইসহাক রাহ. (রমযান মাসে) আমাদের নিয়ে বিতির পড়তেন। কখনো তিনি প্রথম রাকাতে সূরা আ'রাফ তিলাওয়াত করতেন। ফলে বিতির শেষ হতে হতে সুবহে সাদিক হয়ে যেত।
ইসহাক ইবনে মানসুর (আলকাওসাজ মারওয়াযী) বলেন, এই সবকিছু আমি ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (ইবনে রাহাওয়াইহ) থেকে লিখেছি নিশাপুরে অবস্থানকালে।
ইসহাক রাহ.-এর মত হল, (কারো বিতির ছুটে গেলে) সে সুবহে সাদিকের পর ফজর নামাযের আগে তা কাযা করতে পারবে। তিনি পুরো (রমযান) মাস কুনূতের সময় হাত ওঠাতেন। তিনি কুনূত পড়তেন রুকুর পূর্বে এবং হাতদুটি বুকের ওপর কিংবা বুকের নিচ পর্যন্ত ওঠাতেন। তিনি দুটি সূরা পড়তেন আর প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়তেন। অতঃপর তিনি দুআ করতেন আর তার পেছনে মুসল্লিরা আমীন বলতেন। তিনি মুমিন-মুসলিমদের জন্য দুআ করতেন, কাফেরদের ওপর বদদুআ করতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ করতেন এবং হাসান ইবনে আলী রা.-এর দুআটি পড়তেন আর সূরা বাকারার শেষাংশটি পড়তেন। এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুকুতে যেতেন।
বিতিরের নামাযে দুআয়ে কুনূত পাঠের সময় দুই হাত কি অন্যান্য সময়ের মতো বাঁধা থাকবে, নাকি মুনাজাতে হাত ওঠানোর মতো দুই হাত ওঠানো থাকবে— এ বিষয়ে ইমামগণের মধ্যে ইখতিলাফ আছে এবং উভয় দিকেই দলীল রয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস-আসার ও ফিকহের কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এখানে মারওয়াযী রাহ. ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ রাহ. বিতির নামায ও তাতে দুআয়ে কুনূত কীভাবে পড়তেন, তার বিবরণ দিলেন। তিনি বললেন, ইসহাক রাহ. কুনূত পাঠের সময় দুই হাত উঠিয়ে রাখতেন এবং সেগুলো বুকের ওপর কিংবা বুকের নিচ পর্যন্ত উত্তোলন করতেন। বক্তব্যের পূর্বাপর থেকে এই অর্থই নির্ধারিত। শায়েখ আলবানী রাহ. এ বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা স্পষ্ট ভুল। সেজন্য আলমাসাইল গ্রন্থের টীকাকার এই বক্তব্যের ওপর টীকা লিখেছেন—
مَعْنٰى كَلَامِ الْكَوْسَجِ أَنَّ إِسْحَاقَ بْنَ رَاهَوَيْهِ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي حَالِ الْقُنُوْتِ بِإِزَاءِ ثَدْيَيْهِ أَوْ بِإِزَاءِ تَحْتِهِمَا، أَيْ أَنَّهُ يَرْفَعُهُمَا إِلٰى صَدْرِهِ، لَا أَنَّهُ يَضَعُهُمَا مُبَاشَرَةً عَلٰى الثَّدْيَيْنِ أَوْ تَحْتَهُمَا. بِدَلِيْلِ أَنّ ابْنَ قُدَامَةَ فِي الْمُغْنِي: ২/৫৮৪ ذَكَرَ رَأْيَ الْإٍمَامِ أَحْمَدَ فِيْ هٰذِهِ الْمَسْألة، وَهُوَ أَنَّهُ يَرْفَعُ يَدَيْهِ في القنوت إلى صدره، ثم قال: وبه قال إسحاق.
ولأن إسحاق رحمه الله لا يرى وضع اليدين على الصدر، حتى ولا في حال القيام في الفريضة، بل يرى وضعهما تحت السرة، كما روى ذلك عنه الكوسج في المسألة رقم (২১৪) قال: قال إسحاق: كما قال، تحت السّرّة أقوى في الحديث، وأقرب إلى التواضع.
وعلى هذا فقول الألباني رحمه الله في إرواء الغليل ২/৭১، ৭২:)والذي صح عنه صلى الله عليه وسلم في موضع وضع اليدين إنما هو الصدر، وفي ذلك أحاديث كثيرة ... وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق بن راهويه، فقد ذكر المروزي في المسائل ص ২২২: كان إسحاق يوتر بنا ... ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع، ويضع يديه على ثدييه، أو تحت الثديين (. فيه نظر ولا يساعد عليه السياق، والله أعلم.
অর্থ : কাওসাজের ('মাসাইলুল ইমাম আহমাদ ওয়া ইসহাক' গ্রন্থের রচয়িতা ইসহাক ইবনে মানসুর আলমারওয়াযী আলকাওসাজ। যাকে আমরা পূর্বে সংক্ষেপে মারওয়াযী বলে উল্লেখ করেছি।) কথার অর্থ হল, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ্ কুনূতে তাঁর হাতদুটোকে ওঠাতেন তাঁর বুক বরাবর বা তার বুকের নিচ বরাবর অর্থাৎ তাঁর বুক অবধি হাত ওঠাতেন। তাঁর কথার অর্থ এই নয় যে, তিনি হাতদুটোকে বুকের ওপর বা বুকের নিচে রাখতেন। আর এই অর্থ গ্রহণের প্রমাণ এই যে, ইবনে কুদামা তাঁর 'আলমুগনী' গ্রন্থে এই মাসআলার ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের অভিমত উল্লেখ করেছেন। আর তা হল, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল কুনূতে তাঁর হাত দুটোকে ওঠাতেন বুক পর্যন্ত। অতঃপর ইবনে কুদামা উল্লেখ করেছেন যে, ইসহাকও অনুরূপ মত পোষণ করেন।
এর আরেকটি প্রমাণ এই যে, বুকের ওপর হাত রাখাটা ইসহাক রাহ.-এর মাযহাব নয়, এমনকি ফরয নামাযে দাঁড়ানো অবস্থাতেও নয়। বরং তাঁর মাযহাব হল, দুই হাত নাভির নিচে রাখা। যেমনটি কাওসাজ রাহ. ২১৪নং মাসআলায় তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন— 'নাভির নিচে হাত বাঁধা হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের অধিকতর নিকটবর্তী।'
সুতরাং শায়েখ আলবানী রাহ. ইরওয়াউল গলীল গ্রন্থে ২/৭১-৭২ যা বলেছেন (শায়খ আলবানীর বক্তব্য আমরা পূর্বে উদ্ধৃত করেছি), তাতে আপত্তি রয়েছে এবং আলোচনার পূর্বাপর তার কথাকে সমর্থন করে না।
শায়েখ আলবানী কি يَضَعُ শব্দ দেখেই ধোঁকা খেয়ে গেলেন?
ভাবলে অবাক লাগে, এমন স্পষ্ট ভুল শায়েখ আলবানী রাহ. কীভাবে করলেন? তিনি কি يَضَعُ শব্দ দেখেই ধোঁকা খেয়ে গেলেন? হয়তো তিনি—
وَيَضَعُ يَدَيْهِ عَلٰى ثَدْيَيْهِ أَوْ تَحْتَ الثَّدْيَيْنِ.
কথাটি পূর্বাপরের সঙ্গে মিলিয়ে গভীরভাবে পড়েননি। যদি পড়তেন তাহলে নিশ্চয় বুঝতেন, এখানে يَضَعُ শব্দটি হাত রাখা বা বাঁধা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং হাত তোলা বা হাত ওঠানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এটি আরবী ভাষায় অপরিচিত কোনো ব্যবহার নয়। হাত তোলা বা হাত ওঠানো অর্থে يَضَعُ শব্দের ব্যবহার আমরা আরেকটি হাদীসেও পাই। হাদীসটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার ২৪২২ নং হাদীস। হাদীসটিতে আবু হুরায়রা রা. তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত তোলার ক্ষেত্রে মানুষ যে সুন্নত-পদ্ধতি ও অসুন্নত-পদ্ধতি নির্বিশেষে যার যেমনটি মনে চায় হাত তোলে— তার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন—
مِنْكُمْ مَنْ يقُوْلُ هٰكَذَا، وَرَفَعَ سُفْيَانُ (ابن عيينة) يَدَيْهِ حَتّٰى تَجَاوَزَ بِهِمَا رَأْسَه، وَمِنْكُمْ مَنْ يَقُوْلُ هٰكَذَا، وَوَضَعَ يَدَيْهِ عِنْدَ بَطْنِه، وَمِنْكُمْ مَنْ يَقُوْلُ هٰكَذَا، يَعْنِيْ حَذْوَ مَنْكِبَيْهَ.
অর্থ : তোমাদের কেউ এমন করে, সুফইয়ান ইবন উয়াইনা তাঁর হাতদুটো মাথার ওপর নিয়ে গিয়ে দেখালেন। আর কেউ এমন করে, সুফইয়ান পেট পর্যন্ত হাত তুললেন, আর কেউ এমন করে অর্থাৎ কাঁধ বরাবর হাত তোলে।
এখানে পেট পর্যন্ত হাত তোলার বিষয়টি বর্ণনা করতে وضع শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ সম্পর্কে যে বলা হয়েছে—
وَيَضَعُ يَدَيْهِ عَلٰى ثَدْيَيْهِ اَوْ تَحْتَ ثَدْيَيْهِ.
এর অর্থ হবে, তিনি বুক বরাবর হাত ওঠালেন বা বুকের নিচ পর্যন্ত হাত ওঠালেন। এই অর্থ নয় যে, তিনি বুকের ওপর হাত রাখলেন।
শায়েখ আলবানী রাহ. ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ সম্পর্কে মারওয়াযীর বক্তব্য বুঝতে গিয়ে তিনটি বিষয়কে উপেক্ষা করে গেছেন—
এক. তিনি মারওয়াযীর বক্তব্যটি পূর্বাপরসহ গভীরভাবে লক্ষ করেননি।
দুই. তিনি হাত রাখার ক্ষেত্রে ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহর মাযহাব ও মত কী ছিল সেদিকে দৃষ্টি দেননি। ইসহাক রাহ.-এর স্পষ্ট বক্তব্যকে পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন।
তিন. মারওয়াযী কর্তৃক বক্তব্যের অংশবিশেষের দিকে তিনি দৃষ্টি দিয়েছেন, অবশিষ্ট অংশকে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, এখানে বুকের ওপর বা বুকের নিচে উভয় কথাই আছে। তো যদি يضع শব্দের অর্থ 'হাত রাখা' হয় তাহলে বুকের নিচে হাত রাখার কথাটি কেন তিনি এড়িয়ে গেলেন?
নামাযে বুকের ওপর হাত বাঁধার মতটি একটি বিচ্ছিন্ন মত
আমরা দেখেছি যে, বুকের ওপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত কোনো মারফূ হাদীস সহীহ সনদে পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যায় তা শুধু যঈফ নয়, বরং শায ও মুনকার। বুকের ওপর হাত বাঁধা সালাফের কারো আমল ছিল বলেও আমরা পাই না।
'বুকের ওপর হাত বাঁধা' যে সালাফ বা পূর্বসূরিগণের কারো আমল ছিল না— তা ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য থেকে আমরা স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছি।
তাছাড়া ইখতিলাফুল আইম্মা গ্রন্থে ইমাম তাহাবী (মৃত্যু ৩২১ হি.) ও আলআওসাত গ্রন্থে ইমাম ইবনুল মুনযির (মৃত্যু ৩১৯ হি.)-এর আলোচনা থেকেও স্পষ্ট হয় যে, বুকের ওপর হাত বাঁধার আমলটি সালাফের কারো থেকে প্রমাণিত নয়।
তদ্রƒপ ইমাম ইবনে হাযম যাহিরী (মৃত্যু ৪৫৬ হি.) তাঁর আল মুহাল্লা গ্রন্থে বুকের ওপর হাত বাঁধার প্রতি ইঙ্গিত পর্যন্ত করেননি। পূর্বেকার কারো আমল সেরূপ ছিল বলেও বলেননি।
ইবনু আবদিল বারও (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) তাঁর তামহীদ গ্রন্থে নাভির নিচে ও ওপরে হাত বাঁধার আমলের কথা উল্লেখ করেছেন; কিন্তু বুকের ওপর হাত বাঁধার কথা উল্লেখ করেননি।
ইমাম বাগাবী রাহ. (মৃত্যু ৫১৬ হি.) তাঁর শরহুস সুন্নাহ গ্রন্থে সাহাবা ও তাবেয়ীগণের আমল তুলে ধরেছেন, কিন্তু বুকের ওপর হাত বাঁধার আমল সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
ইবনে হুবায়রা শাইবানী (মৃত্যু ৫৬০ হি.) তাঁর ইখতিলাফুল আইম্মাতিল উলামা গ্রন্থে পূর্বসূরি আলেম ও ইমামগণের মতামত ও আমল উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বুকের ওপর হাত বাঁধার আমলের প্রতি কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত করেননি। শুধু নাভির নিচে ও ওপরে হাত বাঁধার আমলের কথা তুলে ধরেছেন।
বিগত শতকের লা-মাযহাবী ঘরানার শীর্ষ আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান (মৃত্যু ১৩০৭ হি.) শাওকানী রাহ.-এর আদদুরারুল বাহিয়্যাহ গ্রন্থের ভাষ্য আররাওযাতুন নাদিয়্যাহ গ্রন্থে (১/২৬৫) লিখেছেন—
وَوَضْعُ الْيَدَيْنِ تَحْتَ السُّرَّةِ وَفَوْقَهَا مُتَسَاوِيَانِ لِأنَّ كُلًّا مِنْهُمَا مَرْوِيٌّ عَنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থাৎ নাভির নিচে ও ওপরে হাত রাখা দুটিই সমপর্যায়ের । কেননা, দুটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ হতে বর্ণিত হয়েছে।
এরপর তিনি তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য ও ইবনুল হুমামের মন্তব্য উল্লেখ করেছেন।
এসবের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নামাযে হাত বাঁধার সুন্নাহসম্মত জায়গা দুইটি— নাভির নিচে এবং নাভির ওপরে। এটি تنوّع السنة (একই বিষয়ে একাধিক সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি)-এর অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে বুকের ওপর হাত বাঁধার মতটি দলীলবিহীন একটি বিচ্ছিন্ন মত। তাই এটিকে নামাযে হাত বাঁধার মাসনূন জায়গা দাবি করা ভুল ও দলীল পরিপন্থী। আল্লাহু আ'লাম।
(উল্লেখ্য, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তাঁর বইয়ের ['জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছালাত', ২য় সংস্করণ, প্রকাশকাল : অক্টেবর ২০১৩] ২২৪ পৃষ্ঠায় 'ইমাম তিরমিযী ও ইবনু কুদামার মন্তব্য ও পর্যালোচনা' শিরোনামে যা লিখেছেন তার পৃথক জবাব আমি লিখিনি। কারণ, এই লেখাটির সম্পূর্ণটি পাঠ করলে তাঁর ঐ বক্তব্যসমূহের জবাব কী— তা পাঠকবৃন্দ অনায়াসেই উপলব্ধি করতে পারবেন।)