রজব ১৪৪৬   ||   জানুয়ারি ২০২৫

গণমাধ্যম : স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

তথ্য সংগ্রহ ও জানানোর মাধ্যমটা হচ্ছে গণমাধ্যম বা মিডিয়া। তবে গণমাধ্যমের 'তথ্য' ধারণাটি এতটা নিরীহ কিংবা নির্দিষ্ট নয়। গণমাধ্যম সংগৃহীত খবর ও তথ্য প্রচারের পাশাপাশি মতামত, আইডিয়া, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিও প্রচার করে। অনেক ক্ষেত্রে নিরেট তথ্যের চেয়ে তথ্যের পারিপার্শ্বিক এই আয়োজন ও পরিষেবার মাত্রাটিই থাকে বেশি এবং এই ক্ষেত্রটিতেই গণমাধ্যমের ইতিবাচক-নেতিবাচক চেহারাটা অনেক বড় আঙ্গিকে ফুটে ওঠে। একইসঙ্গে জনসমাজ ও জনমনস্তত্ত্বে তার ভালোমন্দ প্রভাবের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এছাড়া গণমাধ্যমের সংবাদ বা তথ্য উপস্থাপন-ধরন নিয়েও একটি কৌশল বা পলিসি চালু থাকে। তথ্যের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি বা নেরেটিভ ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া গণমাধ্যমের কাজের পরিমাণ খুব কমই। তথ্যের কোন্ অংশটিকে মূল অংশ বানানো হবে; শুরুর অংশ, নাকি প্রতিক্রিয়ার শেষ অংশএ নিয়েও গণমাধ্যমের নিজস্ব কৌশল, বুদ্ধিমত্তা কিংবা কারসাজি সক্রিয় থাকে। আর এসব কারণেই গণমাধ্যমের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠতা, দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার প্রশ্নগুলো উচ্চারিত হয়। ইতিবাচকতার পথ বাদ দিয়ে কোনো গণমাধ্যম যদি ধর্ম, সভ্যতা ও দেশের সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে বাঁকা পথে হাঁটতে থাকে তখন তার সর্বনাশা প্রভাবে সমাজ ও মানুষের নানা রকম ক্ষতি হয়। অপরদিকে স্বৈরাচারী শাসকমহল কিংবা জাতির প্রতি মমতাহীন ক্ষমতাসীনেরা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করারও চেষ্টা করে থাকে। অনেক সময় শাস্তি দেয়, বন্ধ করে দেয় এবং নিজেদের দুষ্কর্মের পক্ষে গণমাধ্যমকে থাকতে বাধ্য করে। কোনো কোনো গণমাধ্যম নিজের স্বার্থে ও 'সুখে-আনন্দে'ই শাসকদের জুলুম-নির্যাতনের বন্দনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ইস্যুতে গণমাধ্যমের নিজস্ব নেতিবাচক এজেন্ডার কারণে জনসমাজেও ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া  তৈরি হয়। গণমাধ্যমের পুঁজিপতি মালিকেরাও কখনো কখনো তাদের ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক স্বার্থে গণমাধ্যমকে জনস্বার্থ বিরোধী কাজে লাগায়।

দুই.

এজন্যই গণমাধ্যমের প্রভাব, জনমত ও জনমনস্তত্ত্ব তৈরিতে তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, পর্যালোচনা এবং সমর্থন-প্রতিবাদের ধারাটি বজায় থাকে। নির্দিষ্ট গণমাধ্যমের পক্ষ-বিপক্ষ বলয় গড়ে ওঠে। কখনো কখনো প্রতিক্রিয়ার এই পর্যায়গুলো খুব দরকারিও হয়ে যায়। কারণ আধুনিক সময়ে একটি সমাজ ও প্রজন্মকে গণমাধ্যম অনেক গভীরভাবে প্রভাবিত করার সামর্থ্য রাখে।

গণমাধ্যমের নেতিবাচকতা যদি প্রবল হয়, তাহলে সেই সমাজ ও প্রজন্মের ওপর মন্দ প্রভাব বড় হয়ে পড়তে বাধ্য। ইতিবাচক গণমাধ্যম সমাজের জন্য উপকারী এবং দরকারি। সম্প্রতি গণমাধ্যম ইস্যুতে দেশে কয়েকটি ঘটনা ও দৃশ্য চোখে পড়েছে। ৫ আগস্ট স্বৈর-শাসকের বিদায়ের পর জুলুমবাজ সরকারের মদদপুষ্ট ও স্তাবক শ্রেণির কিছু সাংবাদিক নামধারীকে গ্রেফতার হতে দেখা গিয়েছে। বেশ কিছু ফ্যাসিবাদ-তোষক সাংবাদিকের এক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি সংবিধান, নির্বাচন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠনের ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে।

অপরদিকে দেশের প্রভাবশালী অথচ নেতিবাচক এজেন্ডাধারী একটি গণমাধ্যম কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী অবস্থানের ওপর পুলিশি অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। আবার দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফেইক ইস্যুতে ভারতীয় গণমাধ্যমের ডাহা মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের গণমাধ্যমগুলোর যথাযথ ভূমিকা থাকা না-থাকা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যমের দায় ও ভূমিকার বড় একটি বিশ্লেষণ ও চ্যালেঞ্জের জায়গা দখল করেছে অনলাইন সামাজিক মাধ্যম। দশ-বারো বছর আগের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের একক মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য এবং এজেন্ডাভিত্তিক প্রোপাগান্ডা জনসমাজে আগের মতো প্রভাব তো রাখতে পারছেই না; উল্টো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের দায়-দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে মোটা কিছু কথা আমরা আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়াটা দরকার মনে করি। মনে করি, আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমর্থন-সমালোচনার কারণগুলো খুঁজে দেখা দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব।

তিন.

গণমাধ্যমের তরফ থেকে কিংবা গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে সামনে আসে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি। অর্থাৎ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেন অক্ষুণ্ন ও  অবারিত থাকে, স্বৈরশাসক কিংবা বিরোধীশক্তির দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয়সে বিষয়টি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়। সন্দেহ নেই, গণমাধ্যমের জন্য স্বাধীনতা একটি জরুরি বিষয়। বাধা কিংবা চাপ গণমাধ্যমকে সাহসী কাজ তুলে ধরতে দেয় না। ফ্যাসিবাদী শাসক শক্তি গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে, হামলা করে, গ্রেফতার-জুলুম করেও স্বাধীনতা নষ্ট করে থাকে। এদেশে গত ১৫ বছরের আওয়ামী ইতিহাসে এমন ঘটনা বহু ঘটেছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সম্ভবত এসব নিয়েই কাজ করবে। ডিজিটাল সাইবার সিকিউরিটি আইন কিংবা গণমাধ্যমকে দমন ও শাস্তি দেওয়ার মতো উপাদান দূর করার নীতিমালা ও সুপারিশ পেশ করবে। ইতিবাচক গণমাধ্যমের পথচলায় স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষা করা নিয়ে কাজ করাটা দরকারি। এজাতীয় পদক্ষেপের জন্য কমিশনের প্রতি অগ্রিম সমর্থন ও মোবারকবাদ।

কিন্তু গণমাধ্যম তো বিশাল একটি প্রভাবক শক্তিও; সেজন্য তার বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়িত্বশীলতার বিষয়টি, স্বাধীনতার পাশাপাশি স্বাধীনতার অপপ্রয়োগ ও জবাবদিহিতার প্রসঙ্গটিও যেন কঠোরভাবে বিবেচনা করা হয়আমরা সেটিও অত্যন্ত দরকারি মনে করি। অনেক গণমাধ্যম তো বিগত বছরগুলোতে নিজেই নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছিল। অনেক গণমাধ্যম দুষ্ট শাসক শক্তির জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের জুলুমবাজির মাত্রা এতটাই প্রকট ছিল যে, জুলুমবাজির যেসব পদক্ষেপ শাসকরা প্রথমেই নিতে সাহস করত না, গণমাধ্যম সেসব ক্ষেত্রে উসকানিও দিত। কাকে গ্রেফতার করতে হবে, কাকে নিষিদ্ধ করতে হবে, আঙুল তাক করে করে গণমাধ্যমই দুঃশাসকদের বলে দিত। মজলুমের কষ্ট ও যন্ত্রণা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একশ্রেণির গণমাধ্যমের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হত।

আর ধর্ম, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের জায়গাগুলোতেও শত্রুর ভূমিকায় নেমে যেতে এদেশের নামজাদা কিছু গণমাধ্যমকে বরাবর অতি উৎসাহী ভূমিকায় দেখা গেছে। দ্বীনের বিধি-বিধান, আদর্শ, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রাকে আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করাই তাদের কথিত 'উদার তথ্যপ্রবাহ' কিংবা 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা'য় পরিণত হয়েছে। মূলত এ বিষয়গুলোই উদ্বেগ ও প্রতিকারের, মনোযোগ ও বিবেচনার। স্বাধীনতার পাশাপাশি তাই গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা, দায়িত্বশীলতা, ন্যায়ানুগতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিষয়ে সচেতনতার ইস্যুগুলো নিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। গণমাধ্যম যেন দুষ্ট স্বৈরাচার ও দুঃশাসকের লাঠিয়াল কিংবা ইসলামোফোব শয়তানের ভূমিকায় নামার সাহস না পায়, জাতির পবিত্র বিশ্বাস, আদর্শ ও সংস্কৃতি নিয়ে কুৎসিত খেলায় লিপ্ত হতে না পারেবিপ্লবোত্তর 'নতুন স্বাধীনতার' পর গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সেদিকে সচেতন মনোযোগ দেবেএই দাবি ও আশাবাদ আমরা পোষণ করতে চাই।

চার.

গণমাধ্যমকে জনগণের থাকতে হবে এবং ইতিবাচক থাকতে হবে। এজন্য স্বাধীনতার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতা সংশ্লিষ্ট ন্যূনতম কয়েকটি বিষয়ের বিবেচনা থাকা জরুরি। প্রথম বিষয় হচ্ছে, খবর বা সংবাদ প্রচারে পরিপূর্ণ বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা। এটি খবরের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই থেকে নিয়ে উপস্থাপন/পরিবেশনের ভঙ্গি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে রক্ষা করা জরুরি। ঘটনা বর্ণনায় বস্তুনিষ্ঠতার ঘাটতি রাখা কিংবা মতাদর্শিক পক্ষপাতের রেশ তৈরি করা গণমাধ্যমের জন্য অপরাধ। এতে অনেক মানুষ অবিচারের শিকার হন, অপমানিত হন এবং অনেক অপরাধী পার পেয়েও যায়। দুষ্ট গণমাধ্যমের এই প্রবণতা ও অসৎ কৌশলের বিষয়টি বহুল চর্চিত একটি বিষয়। অথচ এটা করা একদমই উচিত নয়।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْۤا اَنْ تُصِیْبُوْا قَوْمًۢا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوْا عَلٰی مَا فَعَلْتُمْ نٰدِمِیْنَ.

হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়। সূরা হুজুরাত (৪৯) : ০৬

গণমাধ্যমের শক্তি ও প্রভাবের অপব্যবহারের কারণে জনগণের বড় একটি অংশের মনে ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। দুঃশাসকের জুলুমবাজির পথ মসৃণ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বিভিন্ন সময় ভূমিকা রাখার কারণে কিছুদিন আগে ঢাকার কারওয়ানবাজারে একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং অবস্থানের ঘটনাও ঘটেছিল। অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু কর্তার সঙ্গে ওই গণমাধ্যমের বিশেষ সম্পর্ক থাকায় বিক্ষোভরতদের প্রতিবাদের ভাষা ও কথা শুনতে না চেয়ে তাদের ওপর পুলিশি মারধর চালানো হয়েছে। অথচ প্রতিবাদ একটি ন্যায়সঙ্গত কর্মপন্থা এবং পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের নজির বিদ্যমান। জানা গেছে, খবরের বিকৃতি, বস্তুনিষ্ঠতার অভাব, মতাদর্শিক দুষ্টামি এবং দুঃশাসকদের জুলুমবাজির সঙ্গদানের জন্যই ছিল মানুষের এই ক্ষোভ ও প্রতিবাদ। গণমাধ্যম যেন জালেমের সহযোগী লাঠিয়াল কিংবা 'কুকুরে' পরিণত না হয়সেটির বিবেচনা থাকা দরকার। এই বিবেচনা গণমাধ্যমের লোকজনেরও থাকা দরকার, নবগঠিত কমিশনেরও থাকা দরকার। এমনকি গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক সাধারণ মানুষের মধ্যেও থাকা দরকার প্রশ্নশীল সচেতন বিবেচনা। গণমাধ্যম যেন জুলুমবাজির হাতিয়ার হতে না পারেসবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

وَ لَا تَرْكَنُوْۤا اِلَی الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَ مَا لَكُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ مِنْ اَوْلِیَآءَ ثُمَّ لَا تُنْصَرُوْنَ.

এবং (হে মুসলিমগণ!) তোমরা জালেমদের দিকে একটুও ঝুঁকবে না, অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকেও স্পর্শ করবে এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো রকমের বন্ধু লাভ হবে না আর তখন কেউ তোমাদের সাহায্যও করবে না। সূরা হূদ (১১) : ১১৩

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি অনেক দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। বিরাজমান রাষ্ট্রধারণায় গণমাধ্যমকে বলা হয়, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অন্তত গণমাধ্যমের প্রভাব ও শক্তি যে  জনমত গঠন ও নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেসেটি স্বীকৃত। সেজন্য গণমাধ্যমের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে ইনসাফ ও ন্যায়ানুগতা বজায় রাখা। খবর, মতামত, ফিচার ও ফলোআপে সব সময় ইনসাফের সজাগ চোখ খুলে না রাখলে গণমাধ্যম হয়তো স্বাধীন হতে পারে, স্বাধীনতার কারণে স্বেচ্ছাচারীও হতে পারে, দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারবে না। আর দায়িত্বহীন কোনো মাধ্যমকে শক্তি ও প্রভাব নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়াটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয় হয়ে থাকবে। নতুন নতুন ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দেবে। সেজন্যই গণমাধ্যমকে ইনসাফ চর্চায় অভ্যস্ত হতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে দল-মত-পথের ভিন্নতা থাকলেও ইনসাফের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِیْنَ لِلهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ وَلَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوْا اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی وَاتَّقُوااللهَ اِنَّاللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। সূরা মায়িদা (০৫) : ০৮

সমাজ ও মানুষের মধ্যে নৈতিকতা চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, ধর্মদ্রোহ এবং যৌন বিশৃঙ্খলার প্রতি নিরুৎসাহ ও নিস্পৃহা জাগ্রত করা গণমাধ্যমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অথচ প্রচলিত ও প্রভাবক গণমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগের ভূমিকাই এর বিপরীত। হিজাবের প্রতি অনীহা তৈরি কিংবা অশ্লীলতার ব্যাপক প্রচার এবং অনৈতিক-অশ্লীল জীবনের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টির চেষ্টায় তাদের পাতার পর পাতা খরচ হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সম্প্রচার হয়।  এতে সব বয়সী মানুষেরই নৈতিকতার ক্ষতি হয়। বিশেষত নতুন প্রজন্মের জীবনে নেমে আসে নানামাত্রিক বিশৃঙ্খলা ও অন্ধকার। দায়িত্বশীল ও ইতিবাচক গণমাধ্যম এই নষ্ট পথে হাঁটতে পারে না।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

اِنَّ الَّذِیْنَ یُحِبُّوْنَ اَنْ تَشِیْعَ الْفَاحِشَةُ فِی الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ وَ اللهُ یَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.

স্মরণ রেখ, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। সূরা নূর (২৪) : ১৯

পাঁচ.

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা, গণমাধ্যমের প্রতি জুলুমের প্রতিবাদ-ক্ষোভ ও অস্বস্তি নিয়ে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আওয়াজটা বেশি ওঠানো হয় এবং একতরফাভাবে গণমাধ্যম 'দমন-পীড়নের' ইস্যুটাই সামনে আনা হয়। গণমাধ্যম তো তাদের নিজেদের সুবিধার কথা; স্বেচ্ছাচারিতা যুক্ত থাকলেও, নিজেদের প্লাটফর্মে বলবেই। কিন্তু গণমাধ্যম কমিশনের কাজ গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা-দায়িত্বশীলতা-জবাবদিহিতা ও স্বাধীনতার বিষয়গুলোকে সমন্বয় করা। তা না হলে গণমাধ্যম নিজেই স্বেচ্ছাচারী শক্তি হিসেবে এবং জাতীয় স্বার্থ ও মূল্যবোধ বিনাশী হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে দ্বিধা করবে না। 'সংখ্যালঘু নির্যাতনের' ফেইক/ক্ষুদ্র কিংবা রহস্যজনক কোনো ঘটনা নিয়ে পুরো দেশ ও মুসলিম জাতিসত্তা-বিরোধী প্রচারে নেমে পড়াটা এখানকার অনেক গণমাধ্যমেরই চরিত্র। ইসলাম অবমাননার মূল ঘটনাকে 'গুজব' আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার ইস্যুকে বড় করে দেখানো, প্রতিবেশী দেশের হিন্দুত্ববাদী আস্ফালন, এদেশেও হিংস্র হিন্দুত্ববাদের বিস্তার নিয়ে চুপচাপ থাকা, ভিন্ন ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান সংস্কৃতিকে পঁচাশিভাগ মুসলিমের এ দেশে জনপ্রিয় করার চেষ্টা, 'ইবলিস' শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদেরকে ইতিবাচক ইমেজে পরিচিত করানো এবং প্রতিবেশী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির আগ্রাসী আচরণের সহযোগিতা কিংবা সাফাই পেশ করার নানারকম ঘটনা এদেশের একশ্রেণির গণমাধ্যমের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেন এটাই তাদের নীতি ও বৈশিষ্ট্য। অনেক সময় মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ধান্ধা এবং মালিকের দেশি-বিদেশি ধান্ধার বন্ধুদের স্বার্থেও গণমাধ্যমকে গণশত্রুর ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়। গণমাধ্যমের এসব দুষ্ট খাসলতে হাত না দিয়ে শুধু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করলে সেটি হবে স্বেচ্ছাচারিতার নতুন পাটাতন তৈরিতে ভূমিকা রাখা। নিয়ন্ত্রণ কিংবা শাস্তির কথা বলব না, বলব স্বাধীনতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠতা, ইনসাফ ও দায়িত্বশীল ইতিবাচকতার দৃঢ় একটি নীতি ও পন্থা নির্মাণই  গণমাধ্যম কমিশনের যথাযথ কাজ।

এদেশের গণমাধ্যমকে পশ্চিম কিংবা ভারত-আনুগত্য, সেক্যুলার দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠে দেশ, ধর্ম, ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার ও সুস্থ সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকাটাই কাংক্সিক্ষত। দায়িত্বশীল ইতিবাচক গণমাধ্যমকে ধর্মপ্রাণ মানুষের দুশমনির জায়গা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। দোষী বানানোর জন্য ট্যাগিং ও ঢালাওকরণের অশুভ চর্চা থেকে বের হতে হবে। এদেশে ১৫ শতাংশের মতো ভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষেরা রয়েছেন, মুসলিম বংশোদ্ভূতদের মধ্যেও ভিন্ন চিন্তা ও মতের নাগরিক রয়েছেন, রয়েছেন বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত কিছু লোকও। বুঝি, সবকিছু পূর্ণাঙ্গ শুদ্ধ ও সুস্থ এখনই হয়তো হবে না, একরকমও হবে না। কিন্তু ইনস্টিটিউশন হিসেবে গণমাধ্যমকে শুদ্ধতার, দ্বীনের, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দুশমনি থেকে মুক্ত এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে প্রশ্নহীন-দ্বিধাহীন ইতিবাচক অবস্থান বজায় রাখতে হবে। সঠিকতা ও ভালোত্বের প্রাবল্য ধরে রাখতে হবে।

গণমাধ্যম বড় শক্তি। এ শক্তি সততা ও ইতিবাচকতার পক্ষে থাকুক, স্খলন বিভ্রান্তি জুলুম ও বিদ্বেষের বাহন না হোক।

 

 

advertisement