ফেরাউনের যাদুকরগণ ॥
জালেমের সামনে সত্য প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন যারা
মূসা আলাইহিস সালামের যুগের ফেরাউন ছিল প্রতাপশালী স্বৈরাচারী দাম্ভিক একজন শাসক। সে বনী ঈসরাইলের ওপর অকথ্য জুলুম-নির্যাতন করত। হঠকারিতা ও সীমালঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে সে পৌঁছে গিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা মূসা আ.-কে পাঠালেন তার কাছে। সঙ্গে হারূন আলাইহিস সালামকেও। বড় বড় নিদর্শনাবলিসহ। এগুলো দেখে যেন ফেরাউন সুপথে ফিরে আসে। আল্লাহ তাআলাকে রব বলে মেনে নেয়। মূসা আ.-এর আনুগত্য করে। কিন্তু সে আরো অবাধ্য হয়ে উঠল। মূসা আ.-কে যাদুকর বলে অভিহিত করল। আর বলল, আমরাও অনুরূপ যাদু প্রদর্শন করব। অতএব মোকাবেলার স্থান ও দিনক্ষণ ঠিক হল।
ফেরাউন দক্ষ যাদুকরদের সমবেত করে ঘোষণা করল, বিজয়ী হতে পারলে তাদেরকে বিরাট পুরস্কার দেওয়া হবে। লোক সমাগম হল। যথারীতি কার্যক্রম শুরু হল। প্রথমেই যাদুকরদের পালা। তারা তাদের রশি ও লাঠি মাটিতে ফেলল। যাদুর প্রভাবে মনে হল, সেগুলো সাপ হয়ে ছোটাছুটি করছে। সমবেত লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে অভয় দিলেন এবং আশ্বস্ত করে বললেন, এসব কারসাজি যাদুকরদের ভেল্কিমাত্র। আর যাদুকর কখনোই সফল হয় না। আল্লাহ তাআলা এবার মূসা আ.-কে নির্দেশ দিলেন, হাতের লাঠি নিক্ষেপ করতে। মূসা আ. হাতের লাঠিটি ছুড়ে ফেললেন, অমনি তা সাপ হয়ে যাদুকরদের মিথ্যা বানোয়াট বস্তুগুলোকে গ্রাস করে ফেলল। এভাবে সত্যের বিজয় হল এবং মিথ্যা পরাস্ত হল।
এসব দেখে যাদুকরদের হুঁশ ফিরে এল। হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। তাদের অন্তরগুলো ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল আর বলে উঠল—
اٰمَنَّا بِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ رَبِّ مُوْسٰی وَ هٰرُوْنَ.
আমরা ঈমান আনলাম রাব্বুল আলামীনের প্রতি, যিনি মূসা ও হারূনের প্রতিপালক। —সূরা আ'রাফ (০৭) : ১২১-১২২
অহংকারী ফেরাউন এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠল। শুরু করল হম্বিতম্বি। হুংকার দিয়ে বলল, আমি তোদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব। তারপর শূলিতে চড়াব।
কিন্তু আল্লাহ যাদের অন্তরে ঈমানের আলো দিয়ে দেন, যারা ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান হয়, তারা কখনো এসব হুমকি ধমকিতে ভয় পায় না। কুফরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সদ্য ঈমানের আলো লাভ করা সেই যাদুকররাও ফেরাউনের শাসানিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন—
لَنْ نُّؤْثِرَكَ عَلٰی مَا جَآءَنَا مِنَ الْبَیِّنٰتِ وَ الَّذِیْ فَطَرَنَا فَاقْضِ مَاۤ اَنْتَ قَاضٍ اِنَّمَا تَقْضِیْ هٰذِهِ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا اِنَّاۤ اٰمَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغْفِرَ لَنَا خَطٰیٰنَا وَ مَاۤ اَكْرَهْتَنَا عَلَیْهِ مِنَ السِّحْرِ وَ اللهُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی .
যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, সেই সত্তার কসম! আমাদের কাছে যে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি এসেছে তার ওপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দিতে পারব না। সুতরাং তুমি যা করতে চাও কর। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করতে পার। আমরা তো আমাদের প্রতিপালকের ওপর ঈমান এনেছি, যাতে তিনি ক্ষমা করে দেন আমাদের গুনাহসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে যাদু করতে বাধ্য করেছ তাও। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী। —সূরা ত্ব-হা (২০) : ৭২-৭৩
(বিস্তারিত জানার জন্য আরো দ্রষ্টব্য : সূরা আ'রাফ ১০৩-১২৬; সূরা ত্ব-হা ৪৩-৭৩)
কী অসীম সাহস! জালেমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্যের ওপর অটল-অবিচল থাকার কী অসাধারণ শক্তি! ঈমানের দাবি পূরণে যিন্দেগীর নযরানা পেশ করার আশ্চর্য এক উপাখ্যান।
মুমিনকে তো এমনই হতে হয়। ইস্পাত কঠিন সীসাঢালা প্রাচীরের মতো সুদৃঢ়। পার্থিব জীবন মুমিনের কাছে সবসময়ই তুচ্ছ। পরকালীন সফলতাই তার কাক্সিক্ষত গন্তব্য। ফলে সে আখেরাতকেই সর্বদা প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনাই থাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে যদি কখনো দুনিয়াবী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে হয়, তাতেও সে কোনো দ্বিধা করে না।
হক-বাতিলের লড়াইয়ে, সত্য-মিথ্যার সংঘাতে এক বিন্দুও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় না। বাতিলের সামনে মাথা নত করে না। হকের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখে। হক কথা বলার কারণে যদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়, তাহলে সাদরে গ্রহণ করে, আল্লাহর রেযামন্দির আশায়, সুখময় স্বপ্নীল জান্নাতের প্রত্যাশায়।
যারা এমন মজবুত ঈমান লালন করে, সত্যের আওয়াজ বুলন্দ করতে সদা নির্ভীক থাকে, কারো চোখ রাঙানির ভয় পায় না, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ভালবাসা প্রাপ্তির মহা সুসংবাদ। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে—
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَنْ یَّرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِیْنِهٖ فَسَوْفَ یَاْتِی اللهُ بِقَوْمٍ یُّحِبُّهُمْ وَ یُحِبُّوْنَهٗۤ اَذِلَّةٍ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اَعِزَّةٍ عَلَی الْكٰفِرِیْنَ یُجَاهِدُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ لَا یَخَافُوْنَ لَوْمَةَ لَآىِٕمٍ ذٰلِكَ فَضْلُ اللهِ یُؤْتِیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ اللهُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ .
হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি নিজ দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। —সূরা মায়েদা (০৫) : ৫৪
বিখ্যাত সাহাবী উবাদা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
بَايَعْنَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ، وَالْمَنْشَطِ وَالْمَكْرَهِ، وَعَلى أَثَرَةٍ عَلَيْنَا، وَعَلى أَنْ لَا نُنَازِعَ الْأَمْرَ أَهْلَه، وَعَلَى أَنْ نَقُولَ بِالْحَقِّ أَيْنَمَا كُنَّا، لَا نَخَافُ فِي اللهِ لَوْمَةَ لَائِمٍ.
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ মর্মে বায়আত গ্রহণ করেছি যে, সুখে-দুঃখে, সন্তোষে-অসন্তোষে সর্বাবস্থায় তাঁর কথা শুনব এবং তাঁর আনুগত্য করব। আমাদের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দেওয়া হলে সেক্ষেত্রেও। আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হব না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, সদা হক কথা বলব, আল্লাহর পথে কোনো নিন্দাকারীর নিন্দার ভয় করব না। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭০৯
আরেক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জালেম বাদশাহর সামনে হক কথা বলাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিহাদ বলেছেন। —দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮৩০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪২০৯
ফেরাউন কঠোর শাস্তির হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও তার সামনে সেই যাদুকরদের হক ও ঈমানের প্রতি নির্ভীক ও অবিচল থাকার যে সাহসী উচ্চারণ, তা যুগে যুগে সত্যের অনুসারী মুমিনদের জন্য আদর্শ ও প্রেরণাদায়ক। আমরাও যেন সকল পরিস্থিতিতে ঈমান ও সত্যের ওপর সদা অনঢ় থাকতে পারি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এটাই প্রত্যাশা।