অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কাটুক যিকির-ইস্তিগফারে
অনেক সময় কিছু কথা হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করে। জীবনকে করে সুন্দর ও অর্থবহ। এই তো ক’দিন আগে শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসামানী দামাত বারাকাতুহুমের স্বহস্তে লিখিত একটি চিরকুট দৃষ্টিগোচর হল। ৫ মুহাররম ১৪৩৯ হিজরী তারিখে লেখা সংক্ষিপ্ত একটি উপদেশবাণী। হযরত তাতে লেখেন—
بسم اللہ الرحمن الرحیم
زندگی کے لمحات بڑے قیمتی ہیں، انہیں تول تول کر اللہ تعالی کی رضا کے کاموں میں صرف کریں۔
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
জীবনের মুহূর্তগুলো অত্যন্ত মূল্যবান। মেপে মেপে সেগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে ব্যয় করুন।
মাত্র দুটি বাক্যের একটি উপদেশ। জীবনকে সফল করার জন্য হয়তো এরচে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই।
যদি প্রশ্ন করা হয় জীবন কাকে বলে? উত্তর হবে— কিছু মুহূর্তের সমষ্টি। যার সূচনা হয় জন্মগ্রহণের মাধ্যমে আর সমাপ্তি ঘটে মৃত্যু দিয়ে। এই জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী মুহূর্তগুলোর সমষ্টির নামই হচ্ছে জীবন। তবে সীমিত এই সময়ের মধ্যে অর্জন করতে হয় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, সঞ্চয় করতে হয় পরকালের পাথেয়। করে যেতে হয় ভালো কিছু কাজ। আর এটাই আল্লাহ তাআলা দেখতে চান বান্দার জীবনে। যে বান্দা ক্ষুদ্র এই জীবনে রবের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারল, সেই সফল হল। এজন্য প্রয়োজন জীবনের সময়গুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যয় হচ্ছে কি না— সেদিকে সতর্ক লক্ষ রাখা।
অনেক সময় আলস্য ও অবহেলায় কেটে যায় আমাদের বহু সময়। তেমনি অপেক্ষায় অপেক্ষায়ও চলে যায় জীবনের অনেক খুচরো মুহূর্ত। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সিরিয়ালে রয়েছি, বাসের অপেক্ষায় বসে আছি, গাড়িতে চলন্ত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছার অপেক্ষায় রয়েছি... ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের খণ্ড খণ্ড সময়গুলো অতিবাহিত হতে থাকে। এ সময়গুলোতে আমরা কী করতে পারি। কীভাবে এসকল খুচরো সময়কে ফলপ্রসূ ও কল্যাণপ্রসূ করতে পারি— তা নিয়েই আজকের ভাবনা।
আরবে ডাক্তারের চেম্বার বা এজাতীয় অপেক্ষার স্থানে একটি বাক্য চোখে পড়ে—
دَقَائِقُ الْاِنْتِظَار امْلَأْهَا بِالْاِسْتِغْفَار.
অপেক্ষার শূন্য মুহূর্তগুলো পূর্ণ করো ইস্তিগফারে।
অত্যন্ত মূল্যবান একটি উক্তি। অপেক্ষার প্রহরগুলো কেমন যেন আমলনামায় শূন্য থেকে যাচ্ছে অথবা অনর্থক বা গোনাহের কাজে ব্যয় হচ্ছে; এই শূন্যস্থানটুকু তুমি ইস্তিগফারের মাধ্যমে পূর্ণ কর।
কোথাও কোথাও সাথে ইস্তিগফারের এই বাক্যটিও লেখা থাকে—
أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لَا إِلهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ.
প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জীবনে এমন অসংখ্য পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে একটি কাজের জন্য দীর্ঘ সময় অলস বসে থাকতে হয়। কাজেই অবসরের সেই সময়টুকু যদি আমি দুআ-দরূদ, যিকির-তিলাওয়াত ও তওবা-ইস্তিগফারে অর্থবহ করে তুলি, তখন আমলনামার সেই শূন্যস্থানগুলো পুণ্যে পুণ্যে পূর্ণ হয়ে উঠবে। আর বান্দা তার রবের নৈকট্য ও ক্ষমা লাভ করতে থাকবে।
এমনিতেই আমাদের প্রাত্যহিক রুটিনে দুআ-দরূদ, যিকির-তিলাওয়াত ও তওবা-ইস্তিগফারের ওযীফা থাকা বাঞ্ছনীয়। মুমিন বান্দা সকাল-সন্ধ্যার দুআগুলোর ব্যাপারে যত্নবান থাকবে। নিয়মিত যিকির-তিলাওয়াত এবং দুআ-মুনাজাত করবে। এতে তার ঈমানী তারাক্কী ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হবে।
এছাড়া চব্বিশ ঘণ্টায় টুকরো টুকরো যে মুহূর্তগুলো এমনি এমনি কেটে যায়, সেগুলোও যথার্থ কাজে লাগাবে। হয়তো ইস্তিগফার করবে, যিকির-তিলাওয়াত করবে। অথবা দরূদ শরীফের আমল করবে। এছাড়া কুরআন-হাদীস থেকে সুন্দর কোনো দুআ পড়বে।
এভাবে আরো অনেকভাবে সময়গুলোকে অর্থবহ করা যায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন কিছুটা অনুশীলন এবং কিঞ্চিত মনোযোগ। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা সময়কে মেপে মেপে কাজে লাগাতে অভ্যস্ত হব।
মূল কথায় ফিরে আসি। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের প্রচুর সময় অলসভাবে কেটে যায়। যেমন ধরুন, কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরতে আবার ঘর থেকে কর্মস্থলে যেতে রাস্তায় চলে যায় অনেক সময়। আর নগর জীবনের অব্যবস্থাপনার কথা কী বা বলার! যানজটে রুদ্ধশ্বাস এ জাতি এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কেবল রাজধানী ঢাকাতেই ২০২২ সালে সড়কে দৈনিক ৮০ লাখের বেশি কর্ম-ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্ম-ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। (দৈনিক ইত্তেফাক, ০৪ জুন ২০২২)
এ হল সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় যাকে কর্ম-মুহূর্ত বলে, তার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা। কিন্তু এছাড়া যে সাধারণ সময়গুলো রয়েছে, তাদের মতে যা কর্ম-ঘণ্টা নয়, তার হিসাব কে কষবে! একজন মুমিনের কোনো মুহূর্তই তো বেকার নষ্ট হবার নয়!
এটা তো শুধু সড়কে ভেসে যাওয়া সময়গুলোর একটি জরিপ। এছাড়া আরো কতভাবে যে আমাদের মূল্যবান সময়গুলো চলে যায় তা আমরা সবসময় খেয়ালও করি না।
শপিংয়ের নামে শপিংমলে অযথা ঘোরাঘুরিতে নষ্ট হয় আমাদের প্রচুর সময়। এক্ষেত্রে অর্থ ও সময়ের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের মার্জিনটাও সতর্কতার সাথে বিবেচনায় রাখা কাম্য।
বন্ধুদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ একটি ভালো কাজ। তবে তা যদি আড্ডার রূপ নেয়, তাহলে কত সময় নষ্ট হয়! এসব ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে নবীজীর বাণী—
إِنَّ مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ المَرْءِ تَرْكَه مَا لَايَعْنِيه.
ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য অনর্থক বিষয় পরিহার করা। —জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৮
এ মুহূর্তে সময়খেকো যে ঘাতকের প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তা হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। প্রযুক্তির এ যুগে ডিভাইস আমাদের মূল্যবান জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কেড়ে নিচ্ছে। এর যতটুকু না প্রয়োজন, তার চেয়ে বহুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদেরকে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
ডিভাইসকে অনেকে বলেন, ‘টাইম কিলার’। বাস্তবে তা কেবল সময় নষ্টকারীই নয়; বরং সময়, অর্থ, চরিত্র সবকিছু বরবাদ করে দিচ্ছে। বিভিন্ন ডিভাইস এবং এর মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবহার বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে আমাদের ও আমাদের আগামী প্রজন্মকে। ঘুণ পোকা যেভাবে একটি বাঁশকে ভেতর থেকে খেয়ে ফাঁপা করে দেয় আক্ষরিক অর্থেই ডিভাইস আমাদের দেহ মনকে সর্বস্বান্ত করে কেবল খোলস রেখে দিচ্ছে। এরচে নীরব ঘাতক আর কী হতে পারে!
আফসোসের কথা হল, অপ্রয়োজনীয় এই কার্যকলাপগুলোর জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় রাতকে। অথচ এই রাত আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন বিশ্রামের জন্য। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম সেরে শেষপ্রহরে আল্লাহর যিকিরে মশগুল হওয়ার জন্য। ডিভাইসে বুঁদ হয়ে সেই রাতটাই কাটিয়ে দিচ্ছে অনর্থক কাজে বা আল্লাহর নাফরমানীতে। আর ফজর কাযা দিয়ে শুরু করছে দিবস।
যেখানে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে সারাদিনের হিসাব কষে শয্যা গ্রহণ করা উচিত, সেখানে শয্যা গ্রহণ করা হয় ডিভাইসের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে। হাদীসে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন দুআ পড়ার কথা আছে। সেগুলো বাদ দিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় এটা সেটা দেখতে দেখতে চোখ বুজে আসে!
এই ডিভাইস আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, মানসিক অবসাদ, চিন্তা ও নৈতিকতার অবক্ষয়সহ জাগতিক নানা ক্ষতি করার পাশাপাশি আত্মিক যে ক্ষতি সাধন করছে, গুনাহে গুনাহে জর্জরিত করছে— তার হিসাব কজন রাখি!
বর্তমান পৃথিবী গুনাহকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের ভাবনাকে স্তিমিত করে দিয়েছে। মনের ভেতরের পাপবোধকে হালকা করে দিয়েছে। না চাইতেই অনেক কিছু সামনে নিয়ে আসে। মনের অজান্তেই ব্যবহারকারীকে আটকে দেয় পাপের চোরাবালিতে। ফলে দিল ও দেমাগ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। তবে বিস্ময়ের বিষয় হল, একে সে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে। কাজেই প্রয়োজন ছাড়া ডিভাইস থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই আমাদের জন্য নিরাপদ। প্রয়োজন শেষ করে দ্রুত ফিরে আসাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের পরিচয়।
মোটকথা, সময়ের মূল্য সম্পর্কে যদি আমরা সংবেদনশীল হই তবেই জীবন সার্থক হবে। বিশেষ করে জীবনের অবসর সময়গুলোর ব্যাপারে যদি সচেতন হই, তাহলে নানা অনিষ্ট থেকে রেহাই মিলবে। নবীজী বলেন—
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
দুটি নিআমত এমন রয়েছে, যে ব্যাপারে অসংখ্য মানুষ প্রতারিত হয়। এক. সুস্থতা; দুই. অবসর। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৪৯
কাজেই সুস্থতা ও অবসরকে কাজে লাগিয়ে আমরা জীবনটাকে সার্থক করতে পারি।
হাদীস শরীফে ছোট ছোট দুআ-যিকির শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা খুব সহজেই পড়া যায়। খুচরো সময়গুলোতে সেসব দুআ-যিকির পড়ার অভ্যাস করা যায়। মনে মনে সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লা—ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ইত্যাদি যিকির করা যায়। দরূদ শরীফের আমল করা যায়। ছোট কোনো সূরা যেমন সূরা ইখলাস ইত্যাদি তিলাওয়াত করতে থাকা যায়। নেক ও কল্যাণের কোনো বিষয়ে ফিকির করা যায়। আল্লাহ তাআলার কুদরত ও বড়ত্বের কথা চিন্তা করা যায়।
নেট দুনিয়ায় অনর্থক বিচরণ না করে সময়কে এভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে ব্যয় করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এ বিষয়টি আমার জন্য তখনই সহজ হবে, যখন আমি জীবন সম্পর্কে সচেতন ও দায়িত্বশীল হব। নিছক ভোগবাদী জীবনধারা পরিহার করে আখেরাতমুখী জীবনযাপন করব। যখন আমার মস্তিষ্কে জাগরুক থাকবে আখেরাতে জবাবদিহিতার কথা।
জীবন তো বহতা নদীর মতোই বয়ে চলেছে। জীবন-তরী ভেসে চলেছে আখেরাতের ঘাটের দিকে। সচেতন থাকি আর উদাসীন— তা বয়ে চলবেই; তরী ঘাটে ভিড়বেই। দেখার বিষয় হল, আমি আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করছি, না উদাসীনতা ও নাফরমানীতে ডুবে আছি। কবি চমৎকার বলেছেন—
وَإِنَّا لَفِي الدُّنْيَا كَرَكْبِ سَفِيْنَةٍ
نظَنُّ وُقُوْفًا وَالزَّمَانُ بِنَا يَجْرِيْ!
وإِنَّا لَنَفْرَحُ بِالْأَيَّامِ نَقْطَعُهَا
وَكُلُّ يَوْمٍ مَضَى يُدْنِي مِنَ الْأَجَلِ!
الْوَقْتُ أَنْفَسُ مَا عُنِيْتَ بِحِفْظِه
وَأَرَاهُ أَسْهَلَ مَا عَلَيْكَ يَضِيْعُ!
দুনিয়ার জীবনে আমরা যেন জাহাজের একদল আরোহী।
মনে হয় স্থির অথচ সময় আমাদের নিয়ে বয়ে চলেছে।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছে বলে আমরা কতই না আনন্দিত!
অথচ প্রতিটি চলে যাওয়া দিন আমাদেরকে মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দিচ্ছে।
তুমি যা কিছু সযত্নে সংরক্ষণ করবে, তার মধ্যে সময়ই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।
অথচ এটাই তোমার কাছে সবচেয়ে মূল্যহীনভাবে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।