বিএনপি’র মুজিব প্রীতি ॥
প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা কর্তৃক একটি ভালো কাজ করা হয়েছে। বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। এটি ছিল বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি যুগান্তকারী কাজ। এমনিতেই ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সাধারণ মানুষই সারা দেশ থেকে ছবি-প্রতিকৃতি ও মূর্তি সরানোর কাজ করেছে চরম ক্ষোভ থেকে, মহোৎসবে। তবুও যেহেতু এখনো রাষ্ট্রপতি পদে ফ্যাসিবাদী সরকারের খাস লোকই আসীন রয়েছে, তাই বঙ্গভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আগের মতোই বহাল ছিল। অবশেষে কোনো কোনো উপদেষ্টার উদ্যোগে তাও অপসারিত হল। এতে দেশপ্রেমিক জনগণ স্বভাবতই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ এ ব্যক্তিটির নাম ব্যবহার করে বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর কতই না জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে তার দলটি। কিন্তু এসবের মধ্যেও উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। সংবাদটি পেয়েই তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন— ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুরের ছবি নামিয়ে ফেলা ঠিক হয়নি।’ (বণিক বার্তা, ১২ নভেম্বর ২০২৪)
আহা কী সুন্দর শোনা গেল! নিরপেক্ষ এবং দিল-দরিয়া বিএনপি!!
এটা শুধু আজকে না, বিগত দশ-এগারো বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির চিন্তা-চেতনা বদলে গেছে। বিশেষত যখন থেকে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়েছেন, অনিবার্যভাবেই তার কর্তৃত্ব দলের ওপর কমেছে, মির্জা ফখরুল এবং রিজভীর মতো লোকেরা নেতৃত্বে এসেছেন, তখন থেকে বরাবরই এদেশের জনগণ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করে আসছে যে, বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতো হয়ে গেছে। ক্ষমতাই যাদের মূল বিষয়। বিগত সময়েও দেখা গেছে, বিএনপি ক্ষমতার জন্য বিদেশীদের কাছে কীভাবে ধরনা দেয়। ভারতের কাছে কীভাবে নমনীয় হয়। দেশের জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক না গড়ে বিদেশীদের কাছে ধরনা দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। যে সমস্ত কারণে বিএনপি এবং এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এদেশের জনগণের মনে জায়গা করে নিয়েছিল, সেগুলো থেকে তারা কিন্তু দূরে সরে যাচ্ছে দিন দিন। বিএনপির এখন এমন হাবভাব যে, তারা এখন অনেক বুদ্ধিজীবী, তারা এত এত আন্তর্জাতিক চিন্তা-ভাবনা লালন করেন, তারা খোলামনের অধিকারী।
সাম্প্রতিক এমন অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। শুধু দু-চারটা পেপার-পত্রিকায় এসেছে। যে এস আলমকে নিয়ে সারা দেশে বিশাল কাণ্ড, তাদের লুটপাটের বিষয় ফ্যাসিবাদী আমলেই আলোচনার বিষয় ছিল। আর তাদের বিদায়ের পর তো এ গোষ্ঠীটির লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের খবর এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। সেই এস আলমের সাথে তাদের নেতাদের দহরম-মহরম, তাদের গাড়ি ব্যবহার করার সংবাদ পত্রিকাগুলোতে এসেছে। যে আওয়ামী লীগের লোকজন বছরের পর বছর দেশের আনাচে-কানাচে খুন-গুম-ধর্ষণ করেছে, তাদেরকে বাঁচাতেই বিএনপির একশ্রেণির নেতা উঠে পড়ে লেগেছে। এখনো হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বিএনপির ঘরে অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা লুকিয়ে আছে। বিএনপির ক্ষমতার লোভ, আদর্শহীন রাজনীতির পরিচয়— ইদানীং তারা সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে বারবার।
একবার দেখা গেল, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বিএনপি জোরালো ভূমিকা রেখেছে রাষ্ট্রপতিকে বহাল তবিয়তে রাখতে। তারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার দাবি জানায়। বিএনপি বিশাল সংবিধান বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে এদেশে। বিএনপির কোন্ কোন্ নেতা সংবিধান বিশেষজ্ঞ— আমরা তা দেখতে পাইনি। বর্তমান যে সরকার বসেছে, তারাই বা কোন্ সাংবিধানিক। বিপ্লবকে কেন সংবিধানের সাথে জড়াচ্ছে— সেটা বোধগম্য নয়। বিএনপির জন্য বড় সুযোগ ছিল, তারা রাষ্ট্রপতিকে অবৈধ বানাবে, এই ধারাবাহিকতায় তারা যদি ২০১৪-এর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারত, নতুন সংবিধানে এসব বিষয় ঢুকিয়ে দিতে পারলে বিএনপির জন্য স্থায়ী সাফল্য আসত। দেশের জনগণও এটা ভালোভাবে নিত। তাদের জোরালোভাবে বলা দরকার ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটাই তো সম্পূর্ণ অবৈধ। যে পরিমাণ আসন পেলে একটি সরকারই গঠিত হয়ে যায় অর্থাৎ ১৫১ সদস্যকে তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ লিখে দেওয়া হয়েছিল।
তখন কিন্তু অনেকেই পত্রিকায় লিখেছেন, এ সংসদ ভবিষ্যতে আইনগতভাবে টিকবে না। বিএনপির সে পথে অগ্রসর হওয়া দরকার ছিল— সেটাকে অবৈধ বানানো গেলে ২০১৪ থেকে এই পর্যন্ত করা অপকর্মগুলোর জন্য ফ্যাসিবাদের দোসরদের ধরা যেত। আমরা মনে করি, বিএনপি সেখানে বড় সুযোগ হাতছাড়া করেছে। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করলে কী হত? এখন যেমন অস্থায়ী সরকার আছে তখন একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বসত। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার এলে এটাকে বৈধতা দিত। রাষ্ট্রপতিকে বসিয়ে রেখে বিএনপি কিন্তু ফ্যাসিবাদের ধারাবাহিকতাকেই চালু রাখার একটি সুযোগ করে দিয়েছে। বিগত সরকারের বৈধতাকে স্বীকার করার একটি রাস্তা তারা রেখে দিয়েছে। বিএনপির হয়তো ভয়— নতুন করে যদি রাষ্ট্রপতি আসে আর এ সরকার দীর্ঘমেয়াদী হয়ে যায়! আবার না আর্মিরাই ক্ষমতায় বসে যায়!
তাদের কি এতটুকু আকল-বুদ্ধি নেই, রাষ্ট্রপতি বসুক আর না বসুক— এ রাস্তা কিন্তু খোলা থাকছেই। নতুন রাষ্ট্রপতি আসুক আর সাহাবুদ্দীনই রাষ্ট্রপতি থাকুক— বিএনপির এটা ঠেকানোর মুরোদ আছে? বিএনপি কি এত বছর ফ্যাসিবাদকে সরাতে পেরেছে? তারা তো কেবল বিদেশীদের দ্বারস্থ হওয়ার ধান্দায় ছিল। সংগঠনকে মজবুত করার চিন্তা তো কখনোই বিএনপির ছিল না। না মিডিয়ার ওপর তাদের কন্ট্রোল ছিল, না নিজেদের কোনো মিডিয়া ছিল। তাদের মুরোদ কিন্তু এদেশের লোকেরা জেনে গেছে আগেই। ফ্যাসিবাদী সরকার নামতে না নামতেই বিএনপির একশ্রেণির লোক যেভাবে বিভিন্ন সেক্টরে চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে, সেটা জনগণের কাছে তাদের ভাবমূর্তি হালকা করছে, না ভারি করছে?
এরই ধারাবাহিকতায় রিজভী সাহেব যে মুডের সাথে শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে বক্তব্য দিলেন, তা খুবই অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও বিবেক বিবর্জিত কাণ্ড হয়েছে। জানি না, এটা তার দলীয় সিদ্ধান্ত, না তার ব্যক্তিগত কথা। (অবশ্য সংবাদটি অনলাইন গণমাধ্যমে আসার পর রিজভীর একই দিনে তাতে সংশোধনী দেওয়ায় মনে হচ্ছে, এমন কথা বলে তারা চাপে পড়েছিল। তাই দলীয় হাই কমান্ড থেকে তাকে ব্যাখ্যা দিতে ও দুঃখপ্রকাশ করতে বলা হয়েছে।) শেখ মুজিবের ছবি দরবার হলে থাকবে কেন? কী কারণে থাকতে হবে? খন্দকার মুশতাক নামিয়েছেন, জিয়াউর রহমান উঠিয়েছেন— সে কথা তিনি বলেছেন। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমানের সময়ের শেখ মুজিব আর এখনকার সময়ের শেখ মুজিব এক নয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার আগে শেখ মুজিব ও তার দল সাড়ে তিন বছর একাই দেশ চালিয়েছেন। শেষ সময়ে এসে পাকাপোক্ত একনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। জিয়া সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসেছেন। সামরিক কর্মকর্তাদের দেশের নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। এছাড়া পরিবারের লোকজনসহ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডেও হয়তো জিয়াউর রহমান মর্মাহত হয়েছিলেন। সেই সূত্র থেকে জিয়া তার ছবি লাগিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪— এসময়ে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে সামনে রেখে, শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করে এদেশে যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছে, সে শেখ মুজিব কি আগের শেখ মুজিব থেকেছে? সে শেখ মুজিবের ছবির জন্য এত লালায়িত কেন বিএনপি? কেন মনে করে, এই শেখ মুজিবকে এদেশের জনগণের শ্রদ্ধা করে যেতে হবে? বিএনপি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইলে তাদের দলীয় অফিসে শেখ মুজিবের ছবি টানিয়ে দিক। বঙ্গভবন, দরবার হল বিএনপির নয়। এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কার্যালয়। সংবিধান অনুযায়ী যার মালিক জনগণ। এদেশের জনগণ এটি চায় কি না?
আমরা মনে করি, বিএনপিকে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদ সরে যাওয়ার অনিবার্য ফল বিএনপি ক্ষমতায় বসে যাওয়া নয়। এ বিপ্লব বিএনপি ঘটায়নি। যেহেতু এটা ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সেখানে ছাত্র ছিল। জনতা ছিল। জনতার কাতারে বিএনপির লোকজনও ছিল। দলীয়ভাবে না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে ছিল। আন্দোলন তো বিএনপি একা করেনি। শিরোনামও হয়নি। সুতরাং বিএনপির অধিকার নেই, বঙ্গভবনের দরবার হলে শেখ মুজিবের ছবি থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার।
এছাড়া বিএনপিকে যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হয়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই এদেশের মানুষের মনের কথা বুঝতে হবে। ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বৈদেশিক নীতি— সকল ক্ষেত্রে ইসলাম এবং মুসলমানদের স্বকীয়তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া ও ভবিষ্যতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সংকল্প করা ছাড়া বিএনপি তাদের একসময়কার ভোট ব্যাংক পুনরায় উদ্ধার করতে পারবে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রতি নমনীয়তা বা জনস্বার্থবিরোধী যেকোনো তথাকথিত অধিকার বা আদর্শের পক্ষে যাওয়া বাংলাদেশের সাথে একতরফা মোড়লগিরির আচরণ করে আসা ভারতের সাথে বাড়তি বন্ধুত্বপূর্ণভাব বিএনপির ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার পথে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।