একটি বই, একটি চিঠি ॥
সালাতে হাত বেঁধে কোথায় রাখবে
[মাসিক আলকাউসারের প্রিয় পাঠকবৃন্দ! আপনারা অনেকেই আমাকে সাক্ষাতে এবং কেউ কেউ ফোনযোগে ‘একটি বই একটি চিঠি’ শিরোনামে জনাব মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর ছালাত’ বইয়ের জবাবে আমার লেখার পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়েছেন। হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব হাফিযাহুল্লাহও বারবার তাগিদ দিয়েছেন পরবর্তী অংশ লিখতে। আমি অতীব দুঃখিত যে, নানাবিধ কারণে পরবর্তী লেখাটি সম্পন্ন করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এর জন্য সবচে বেশি দায়ী আমার অবহেলা। আপনাদেরকে অপেক্ষায় রেখে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ইতিপূর্বে লেখাটির আটটি কিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক আলকাউসারের আগস্ট, ডিসেম্বর ২০১৪; ফেব্রুয়ারি, মার্চ ২০১৫ এবং ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও আগস্ট ২০১৭ সংখ্যায়।
—আপনাদের দুআর মুহতাজ আবদুল গাফফার]
সালাতে হাত বাঁধার ক্ষেত্রে বিষয় দুটো—
এক. হাতদুটো কীভাবে বাঁধবে।
দুই. হাতদুটো বেঁধে দেহের কোন্ জায়গায় রাখবে।
জনাব মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব প্রথম বিষয়টির ওপর স্বতন্ত্র কোনো শিরোনাম উল্লেখ করেননি। তবে বিষয়টি তাঁর আলোচনায় প্রসঙ্গত এসেছে। আমরা দুটো বিষয় নিয়েই স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করব। প্রথমে আলোচনা করব তিনি যে বিষয়ে স্বতন্ত্র শিরোনাম দাঁড় করিয়েছেন সেই বিষয় নিয়ে। অর্থাৎ হাতদুটো বেঁধে দেহের কোন্ জায়গায় রাখবে।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তার বইয়ের ২১৩ পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন—
‘ছহীহ হাদীসের দাবি হল বুকের ওপর হাত বেঁধে ছালাত আদায় করা। নাভীর নীচে হাত বেঁধে ছালাত আদায় করার পক্ষে কোনো ছহীহ হাদীছ নেই। এর পক্ষে যত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সবই ত্রুটিপূর্ণ।’
এর পরে তিনি নাভির নিচে হাত বাঁধা সংক্রান্ত বেশকিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। অতঃপর তিনি বুকের ওপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বুকের ওপর হাত বাঁধাই সহীহ হাদীসের দাবি।
আমি সর্বপ্রথম বুকের ওপর হাত বাঁধা সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখ করে আলোচনা-পর্যালোচনা করব, অতঃপর নাভির নিচে হাত বাঁধা সংক্রান্ত কী কী হাদীস আছে তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে চেষ্টা করব।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব ২১৯ পৃষ্ঠায় ‘বুকের ওপর হাত বাঁধার ছহীহ হাদীছসমূহ’ শিরোনামে প্রথমে লিখেছেন—
‘রাসূল (ছাঃ) সর্বদা বুকের ওপর হাত বেঁধে ছালাত আদায় করতেন। উক্ত মর্মে একাধিক ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি পেশ করা হল :’
অতঃপর তিনি হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন। আমি সেগুলো উল্লেখ করছি।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ১
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ اليُمْنٰى عَلٰى ذِرَاعِهِ الْيُسْرٰى فِي الصَّلَاةِ، قَالَ اَبُوْ حَازِمٍ لَا اَعْلَمُه إِلَّا يَنْمِىْ ذٰلِكَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হত, মুছল্লী যেন ছালাতের মধ্যে তার ডান হাত বাম হাতের বাহুর ওপর রাখে। আবু হাযেম বলেন, এটা রাসূল (ছাঃ)-এর দিকেই ইঙ্গিত করা হত বলে আমি জানি। (মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের অনুবাদ)
এটি বুখারী শরীফের হাদীস। পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, দাবি ও দলীলের মাঝে কোনো মিল নেই। দাবি হল, ‘বুকের ওপর হাত বাঁধার ছহীহ হাদীছসমূহ’, আর দলীলে ব্যক্ত হয়েছে কীভাবে হাতদুটো বাঁধবে সেই কথা। দুটো ভিন্ন বিষয়। আমি পূর্বেই তা উল্লেখ করেছি।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব এরপর বলেছেন—
‘ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيُمْنٰى عَلَى الْيُسْرٰى ‘ছালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা অনুচ্ছেদ’। উল্লেখ্য যে, ইমাম নববী (রহঃ) নিম্নোক্ত মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন— ‘তাকবীরে তাহরীমার পর ডান হাত বাম হাতের ওপর স্থাপন করে বুকের নীচে নাভীর উপরে রাখা’। অথচ হাদীছে ‘বুকের নীচে নাভীর উপরে’ কথাটুকু নেই। মূলতঃ পুরো ডান হাতের ওপর বাম হাত রাখলে বুকের ওপরই চলে যায়। যেমন উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে শায়েখ আলবানী (রহঃ) বলেন—
وَمِثْلُه حَدِيْثُ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ كَانَ يَضَعُ الْيُمْنٰى عَلٰى ظَهْرِ كَفِّهِ الْيُسْرٰى وَالرُّسْغِ وَ السَّاعِدِ رَوَاهُ اَبُوْ دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ بَسَنَدٍ صَحِيْحٍ، وَهٰذِهِ الْكَيْفِيَّةُ تَسْتَلْزِمُ أَنْ يَكُوْنَ الْوَضْعُ عَلَى الصَّدْرِ اِذَا أَنْتَ تَأَمَّلْتَ ذٰلِكَ وَعَمِلْتَ بِهَا فَجَرِّبْ إِنْ شِئْتَ وَمِمَّا يَنْبَغِيْ أَنْ يُعْلَمَ أَنَّهُ لـَمْ يَصِحَّ عَنْهُ صلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْوَضْعُ عَلٰى غَيْرِ الصَّدْرِ كَحَدِيْثِ ’وَالسُّنَّةُ وَضْعُ الْكَفِّ فِي الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ‘.
‘অনুরূপ ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) ডান হাত বাম হাতের পাতা, হাত ও বাহুর ওপর রাখতেন। যা ছহীহ সনদে আবু দাঊদ ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন। এই পদ্ধতিই আমাদের জন্য অপরিহার্য করে যে, হাত রাখতে হবে বুকের ওপর। যদি আপনি এটা বুঝেন এবং এর প্রতি আমল করেন। অতএব আপনি চাইলে যাচাই করতে পারেন। আর এ সম্পর্কে যা জানা উচিত তা হল, বুকের ওপর ছাড়া অন্যত্র হাত বাঁধার বিষয়টি রাসূল (ছাঃ) থেকে ছহীহ হিসাবে সাব্যস্ত হয়নি। যেমন একটি হাদীছ, ‘সুন্নাত হল ছালাতের মধ্যে নাভীর নীচে হাতের পাতা রাখা।’ (মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের অনুবাদ)
বুখারী শরীফের হাদীসে বুকের ওপর হাত রাখার কথা বলা হয়নি
আমার বক্তব্য : আলোচ্য হাদীস দ্বারা হাত রাখার স্থান সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় না। হাত বাঁধার পদ্ধতি সম্পর্কে শুধু নির্দেশনা পাওয়া যায়। এইজন্যই ইমাম বুখারী রাহ. হাদীসটির ওপর শিরোনাম স্থাপন করেছেন এই কথা বলে, ‘অনুচ্ছেদ : ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।’ এই কথা বলেননি যে, ‘অনুচ্ছেদ : বুকের ওপর হাত রাখা’। বুখারী শরীফের যত ভাষ্যগ্রন্থ এ যাবৎ রচিত হয়েছে তার কোনোটিতেই কেউ বলেননি যে, ইমাম বুখারী কর্তৃক রচিত ঐ অনুচ্ছেদের শিরোনাম দ্বারা ইমাম বুখারী বুকের ওপর হাত রাখার কথা বোঝাতে চেয়েছেন। তারা তা বলবেনই বা কী করে? হাদীসে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখার কথা বোঝানো হয়েছে। আর এই কথাটিই ইমাম বুখারী রাহ. অনুচ্ছেদের শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। তো ইমাম বুখারী কর্তৃক রচিত অনুচ্ছেদের শিরোনাম উল্লেখ করে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব কী বুঝাতে চাইলেন? কোনো গ্রন্থের বরাত দিয়ে এক বা একাধিক আরবী বাক্য উদ্ধৃত করে দিলেই কি দাবি প্রমাণিত হয়ে যায়? এটা কি পাঠকবৃন্দের সাথে একধরনের প্রতারণা হয়ে গেল না? আর এভাবে পাঠকবৃন্দকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস ভালো কোনো প্রয়াস নয়। এটা গর্হিত ও নিন্দনীয়।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব ইমাম নববী রাহ.-এর ওপর আপত্তি করেছেন যে, হাদীসে ‘বুকের নিচে নাভির উপরে’ কথাটুকু নেই। কিন্তু হাদীসে তো বুকের ওপর হাত বাঁধার কথাও নেই। সেটা তো মুযাফফর সাহেবদের নিজস্ব গবেষণা, যেটা তারা জোরজবরদস্তি করে হাদীসের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। নতুবা তিনি এ কথা কীভাবে বলেন যে, ‘পুরো বাম হাতের ওপর ডান হাত রাখলে বুকের ওপরই চলে যায়’? হাদীসে কি ‘পুরো বাম হাতের ওপর’ কথাটা আছে? এটা মুযাফফর সাহেবের নিজের কথা। নিজের বুঝ। মূলত মুযাফফর সাহেবরা এভাবেই নিজেদের বুঝ ও বক্তব্যকে হাদীসের নির্দেশনা বলে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেন। এরপর কেউ সেই বুঝ ও বক্তব্যকে গ্রহণ না করলে তাকে সরাসরি সহীহ হাদীস অমান্যকারী আখ্যা দিয়ে দেন।
আর শায়েখ আলবানী রাহ. যা বলেছেন তাও যথার্থ নয়। কারণ, প্রথমত হাদীসটিতে ডান হাতের বাহুকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখতে বলা হয়নি। হাদীসের শব্দ হল—
أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ اليُمْنٰى عَلٰى ذِرَاعِهِ الْيُسْرٰى.
অর্থাৎ ডান হাত বাম হাতের বাহুর ওপর রাখবে। প্রশ্ন হল, এখানে ডান হাত দ্বারা কি পুরো ডান হাত উদ্দেশ্য, নাকি ডান হাতের অংশবিশেষ। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, এখানে পুরো ডান হাত উদ্দেশ্য নয়। বরং এখানে ডান হাতের অংশবিশেষকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখতে বলা হয়েছে।
এই দাবির পক্ষে যুক্তি আছে। দেখুন, বাম হাতের ক্ষেত্রে হাদীসে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে عَلٰى ذِرَاعِهِ الْيُسْرٰى অর্থাৎ বাম বাহু। পক্ষান্তরে ডান হাতের ক্ষেত্রে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে اَلْيَدَ الْيُمْنٰى অর্থাৎ ডান হাত। হাত শব্দের বিপরীতে বাহু শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করে যে, ডান হাত বলে হাতের তালু বোঝানো হয়েছে। উভয় হাতের বাহু বোঝানো উদ্দেশ্য হলে উভয় ক্ষেত্রেই যিরা‘ বা বাহু শব্দ ব্যবহৃত হত। সুতরাং বোঝা গেল যে, ডান হাতের বাহুকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখতে বলা হয়নি। ডান হাতের তালুকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখতে বলা হয়েছে। আর ডান হাতের তালুকে বাম হাতের বাহুর ওপর রাখতে গেলে বাম হাতের বাহুর অংশবিশেষের ওপরই রাখতে হবে। বাম হাতের পুরো বাহুর ওপর রাখা সম্ভব হবে না। কারণ, বাম হাতের পুরো বাহু জুড়ে ডান হাত রাখতে গেলে ডান হাতের বাহুকে বাম হাতের বাহুর ওপর বিছিয়ে দিতে হবে। আর হাদীসে তা বলা হয়নি।
দ্বিতীয়ত ডান হাতের পুরো বাহুকে বাম হাতের বাহুর ওপর বিছিয়ে রাখলে শায়েখ আলবানী রাহ.-এর পরার্মশ মোতাবেক আমি পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেছি যে, তখন হাতদুটো চলে যাবে ঠিক নাভি বরাবর জায়গায়, কিংবা নাভির একটু ওপরে; বুকের ওপর কিছুতেই নয়। বুকের ওপর হাতদুটোকে নিতে হলে বেজায় কসরত করতে হবে এবং দুই বাহুর গোড়া ও দুই কাঁধের বাহুসংলগ্ন অংশকে উঁচু করতে হবে। যা অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করবে এবং এইরূপে হাত বেঁধে মুসল্লি যখন বুকের ওপর হাতদুটো রাখবে তখন তার আকৃতি দাঁড়াবে এক অদ্ভুত রকমের।
কথা আরো আছে। শায়েখ আলবানী রাহ. সাহল ইবনে সা‘দ রা.-এর হাদীস উল্লেখ করার পর ওয়ায়েল ইবনে হুজ্রের হাদীস টেনে নিয়ে এসেছেন এবং বলেছেন— وَمِثْلُه حَدِيْثُ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ... । কিন্তু না, সাহল ইবনে সা‘দ রা.-এর হাদীসে বাম হাতের ক্ষেত্রে শুধু ذراع শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে— على كفه اليسرى والرسغ والساعد (বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর ওপর) ওয়ায়েল ইবনে হুজ্রের হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, বাম হাতের পুরো বাহুর ওপর নয়, বরং বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর ওপর। এবং এই হাদীসটিই সাহল ইবনে সা‘দ রা.-এর হাদীসে ব্যবহৃত ذراع শব্দের ব্যাখ্যা করে জানান দেয় যে, যিরা‘ বলে পাতা কব্জি ও বাহুর অংশবিশেষকে বুঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-ও তেমনটিই বলেন। তিনি সাহল ইবনে সা‘দ রা.-এর হাদীসে ব্যবহৃত যিরা‘ শব্দটি উল্লেখ করে বলেন—
أُبْهِمَ مَوْضِعُهُ مِنَ الذِّرَاعِ وَفِيْ حَدِيْثِ وَائِلٍ عِنْدَ أَبِيْ دَاودَ والنَّسَائِيْ: ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى ظَهْرِ كَفِّهِ الْيُسْرٰى وَالرُّسْغِ والسَّاعِدِ
অর্থাৎ ডান হাতের তালু বাম যিরা‘র কোথায় রাখবে— তা এখানে অস্পষ্ট। তবে ওয়ায়েল রা.-এর হাদীসে ব্যক্ত হয়েছে যে, অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাতটিকে তাঁর বাম হাতের পাতার ওপর, কব্জি ও বাহুর ওপর রাখলেন।
আসলে এ ধরনের হাদীস থেকে সালাফে সালেহীনের কেউই এটা বোঝেননি যে, পুরো ডান হাত পুরো বাম হাতের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে। বরং ‘ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা’— এ কথার দ্বারা তারা এটাই বুঝেছেন যে, ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও কব্জি সংলগ্ন বাহুর ওপর রাখবে। শাওকানী রাহ.-ও একথা বলেছেন। নাইলুল আওতার গ্রন্থে তিনি লিখেছেন—
قَوْلُه: (عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى) أُبْهِمَ هُنَا مَوْضِعُه مِنْ الذِّرَاعِ، وَقَدْ بَيَّنَتْهُ رِوَايَةُ أَحْمَدَ وَأَبِي دَاود فِي الْحَدِيثِ الَّذِي قَبْلَ هذَا.
অর্থাৎ ‘হাদীসের শব্দ হল, ‘বাম বাহুর ওপরে’। বাহুর কোন্ জায়গায়— তা এখানে অস্পষ্ট। আহমাদ ও আবু দাউদে বর্ণিত পূর্বের হাদীসটিতে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।’
আহমাদ ও আবু দাউদে বর্ণিত পূর্বের হাদীসটির অলোচনায় তিনি বলেন—
وَالْمُرَادُ أَنَّه وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى كَفِّ يَدِهِ الْيُسْرَى وَرُسْغِهَا وَسَاعِدِهَا. وَلَفْظُ الطَّبَرَانِيِّ: وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى ظَهْرِ الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ قَرِيبًا مِنْ الرُّسْغِ.
উদ্দেশ্য হল, তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর ওপরে রেখেছেন। তবারানী রাহ.-এর বর্ণনায় এসেছে— তিনি নামাযে তাঁর ডান হাত বাম হাতের পিঠের ওপর কব্জির কাছাকাছি রেখেছেন।
তিনি আরো বলেন—
وَالْحَدِيثُ يَدُلُّ عَلى مَشْرُوعِيَّةِ وَضْعِ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ.
হাদীসটি থেকে এ বিধান প্রমাণিত হয় যে, (ডান) হাতের পাতা (বাম) হাতের পাতার ওপর রাখবে।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ২
عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ لَأَنْظُرَنَّ إِلٰى صَلَاةِ رَسُوْلِ اللهِ صلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَيْفَ يُصَلِّى فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَقَامَ فَكَبَّرَ وَرَفَعَ يَديْهِ حَتّٰى حَاذَتَا بِأُذُنَيْهِ ثُـمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى كَفِّهِ الْيُسْرٰى وَالرُّسْغِ وَالسَّاعِدِ فَلَمَّا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ رَفَعَ يَدَيْهِ مِثْلَ ذلِكَ...
ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ) বলেন, আমি অবশ্যই রাসূল (ছাঃ) এর ছালাতের দিকে লক্ষ্য করতাম, তিনি কিভাবে ছালাত আদায় করেন। আমি তাঁর দিকে লক্ষ্য করতাম যে, তিনি ছালাতে দাঁড়াতেন অতঃপর তাকবীর দিতেন এবং কান বরাবর দুই হাত উত্তোলন করতেন। তারপর তাঁর ডান হাত বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর ওপর রাখতেন। অতঃপর যখন তিনি রুকু করার ইচ্ছা করতেন তখন অনুরূপ দুই হাত উত্তোলন করতেন। ... (মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের অনুবাদ।)
অনুবাদের ভুল
হাদীসটির অনুবাদ আমি করলে এভাবে করতাম : ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. বলেন, (আমি মনে মনে বললাম) আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে সালাত আদায় করেন— তা দেখব। তো আমি দেখলাম, তিনি দাঁড়ালেন, অতঃপর তাকবীর দিলেন এবং তাঁর হাতদুটো উত্তোলন করলেন, এমনকি হাতদুটো তাঁর কান বরাবর হয়ে গেল। অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাতকে রাখলেন তাঁর বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর ওপর। অতঃপর যখন তিনি রুকু করার ইচ্ছা করলেন তখন অনুরূপ হাতদুটো উত্তোলন করলেন।...
ক্রিয়াপদসমূহের অনুবাদে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব ভুল করেছেন। কী ভুল করেছেন একটু লক্ষ করলেই পাঠকবৃন্দ তা বুঝতে পারবেন। সাধারণ অতীতকালের ক্রিয়াপদগুলোকে তিনি অনুবাদ করেছেন এমনভাবে, যদ্দ্বারা মনে হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্ত আমলটি হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. নিয়মিত প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সেটির বিবরণ দান করেছেন। অথচ হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. তাঁর দেখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ ঐ দিনের আমলের বিবরণ দান করেছেন। ‘করতেন’ আর ‘করলেন’ ক্রিয়াপদদুটির মধ্যে অর্থগত দিক থেকে অনেক ব্যবধান। ‘করতেন’ ক্রিয়াপদটি অতীতকালের অভ্যাসগত কাজকে বোঝায় আর ‘করলেন’ ক্রিয়াপদটি অতীতকালে একবার সংঘটিত কাজকে বোঝায়।
হাদীসটির ভিত্তিতে লেখকের ইজতিহাদ
এরপর মুযাফফর সাহেব লিখেছেন—
‘সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, রাসূল (ছাঃ) ডান হাতটি পুরো বাম হাতের ওপর রাখতেন। এমতাবস্থায় হাত নাভীর নীচে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এইভাবে হাত রেখে নাভীর নীচে স্থাপন করতে চাইলে মাজা বাঁকা করে নাভীর নীচে হাত নিয়ে যেতে হবে, যা উচিত নয়। ’
আমাদের বক্তব্য
‘বাম হাতের ওপর রাখতেন’ নয়, বরং বলা উচিত ছিল ‘বাম হাতের ওপর রেখেছিলেন’। যা হোক, এই হাদীসটিও স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডান হাতটি পুরো বাম হাতের ওপর রেখেছিলেন। কারণ, এই হাদীসেও ডান হাতের বিপরীতে বাম হাতের তালু, কব্জি ও বাহু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বোঝা যায় যে, পুরো ডান হাত নয়, বরং ডান হাতের কিছু অংশ তথা ডান হাতের তালুকে বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর ওপর রাখার কথা বলা হয়েছে।
তাছাড়া হাদীসটিতে হাত বাঁধার পদ্ধতি ব্যক্ত হয়েছে শুধু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতদুটো কোথায় রেখেছিলেন— হাদীসটিতে তা ব্যক্ত হয়নি। বুকের ওপর রাখার কথাটি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব নিজস্ব একটা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁর উচিত ছিল যুক্তি নয়, এরূপ কোনো হাদীস পেশ করা, যাতে বুকের ওপর হাত রাখার কথা স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয়েছে। এই হাদীসে তা ব্যক্ত হয়নি। ব্যক্ত হয়নি বলেই তিনি ইজতিহাদ করেছেন। বলেছেন—
‘তাহলে নাভীর নীচে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এইভাবে হাত রেখে নাভীর নীচে নিতে চাইলে মাজা বাঁকা করে নাভীর নীচে হাত নিয়ে যেতে হবে।’
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের কাছে প্রশ্ন হল, আপনি এই ইজতিহাদ কেন করতে গেলেন? আপনাদের দাবি তো এই যে, আমল করতে হবে হাদীস অনুযায়ী; কারো ইজতিহাদ ও ব্যক্তিগত মতামত অনুযায়ী নয়। তাহলে আপনি আপনার ব্যক্তিগত ইজতিহাদ ও মত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন কেন ভাই?
এই প্যারার শেষে তিনি লিখেছেন—
‘আমরা এবার দেখব রাসূল (ছাঃ) তাঁর দুই হাত কোথায় স্থাপন করতেন।’
চমৎকার! এবার তিনি দেখবেন। আগে তিনি দেখেননি। তাঁর এ কথাই প্রমাণ করে যে, প্রথমে যে হাদীসদুটি তিনি উপস্থাপন করেছেন, তা দ্বারা বুঝা যায় না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতদুটি কোথায় রাখতেন। তাই না? তিনি এখানে এমন এক ফাঁদে পড়ে গেছেন, যা তাঁরই কর্তৃক সৃষ্ট।
এই কথার পরে তিনি তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা সেগুলোও দেখে নিই।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ৩
عَنْ طَاووسٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى يَدِهِ الْيُسْرٰى يَشُدُّ بَيْنَهُمَا عَلٰى صَدْرِهِ وَهُوَ فِي الصَّلَاةِ.
ত্বাঊস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাতের মধ্যে তাঁর ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখতেন এবং উভয় হাত বুকের ওপর শক্ত করে ধরে রাখতেন। (মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের অনুবাদ)
হাদীসটির ভিত্তিতে শায়েখ আলবানীর বক্তব্য
হাদীসটি উল্লেখ করার পর মুযাফফর সাহেব লিখেছেন—
‘উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছকে অনেকে নিজস্ব গোঁড়ামী ও ব্যক্তিত্বের বলে যঈফ বলে প্রত্যাখ্যান করতে চান। মুহাদ্দিছগণের মন্তব্যের তোয়াক্কা করেন না। নিজেকে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ বলে পরিচয় দিতে চান। অথচ আলবানী উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেন,
رواه أبو داود بإسناد صحيح عنه.
‘আবু দাঊদ ত্বাঊস থেকে এই হাদীসকে ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি অন্যের দাবি খণ্ডন করে বলেন,
وَهُوَ وَاِنْ كَانَ مُرْسَلًا فَهُوَ حُجَّةٌ عِنْدَ جَمِيْعِ الْعُلَمَاءِ عَلٰى اِخْتِلَافِ مَذَاهِبِهِمْ في الْمُرْسَلِ لِأَنَّه صَحِيْحُ الْاِسْنَادِ اِلَى الْمُرْسَلِ وَقَدْ جَاءَ مَوْصُوْلًا مِنْ طُرُقٍ كَمَا أَشَرْنَا اِلَيْهِ آنِفًا فَكَانَ حُجَّةً عِنْدَ الْجَمِيْعِ
‘ত্বাউস যদিও মুরসাল রাবী তবুও তিনি সকল মুহাদ্দিছগণের নিকট দলীলযোগ্য। কারণ তিনি মুরসাল হলেও সনদের জন্য ছহীহ। তাছাড়াও এই হাদীছ মারফু‘ হিসাবে অনেকগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি আমি এই মাত্রই উল্লেখ করলাম। অতএব তা সকল মুহাদ্দিছের নিকট দলীলযোগ্য ।’ (মুযাফফর সাহেবের অনুবাদ)
যাঁরা এই হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করেন, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী তারা মুহাদ্দিসগণের মন্তব্যের তোয়াক্কা করেন না। তো মুযাফফর সাহেবের উচিত ছিল, মুহাদ্দিসগণের মধ্য হতে কমপক্ষে দুইজনের মন্তব্য তুলে ধরা। তাহলেই ‘মুহাদ্দিসগণ’ বহুবাচক শব্দটির সাথে তার কথা সঙ্গতিপূর্ণ হত। তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন হাদীস গবেষক শায়েখ আলবানীর কথা উদ্ধৃত করেছেন, যিনি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের ধারণায় একজন বড় মুহাদ্দিস। যা হোক, আমরা শায়েখ আলবানীর মন্তব্যেরও ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ভুল হরকত ভুল অনুবাদ
হাদীসটি সহীহ কি না বা শায়েখ আলবানী রাহ.-এর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কি না— সে বিষয়ে আলোচনার পূর্বে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব কর্তৃক উদ্ধৃত আরবী পাঠ (ইবারত) ও তার তরজমার দিকে পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। এখানে লেখক একাধিক ভুল করেছেন। প্রথমত তিনি আরবী পাঠে হরকত দিতে গিয়ে—
صَحِيْحُ الْاِسْنَادِ اِلَى المُرْسِل
-এর মাঝে الْمُرْسِلِ শব্দটির সীন অক্ষরটিতে যবর দিয়ে শব্দটিকে বানিয়েছেন মুরসাল, অথচ শব্দটি হবে মুরসিল। এই শব্দটির পূর্বে একই বর্ণচতুষ্টয় দ্বারা গঠিত আরো দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সেই দুটি শব্দ হবে মুরসাল। কিন্তু আলোচ্য শব্দটি মুরসাল নয়, মুরসিল।
দ্বিতীয়ত هُوَ সর্বনামটির তরজমা তিনি করেছেন ‘তিনি’। সর্বনামটিকে মুযাফফর সাহেব হাদীসের রাবী তাঊসের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে বলে বুঝেছেন, অথচ সর্বনামটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘হাদীস’-এর পরিবর্তে। রাবী বা বর্ণনাকারী মুরসাল হয় না, মুরসিল হয়। মুরসাল হয় ঐ হাদীস, যা ইরসাল করে বর্ণিত হয়েছে।
তৃতীয়ত ‘সহীহুল ইসনাদ’ কথাটির তরজমা করেছেন সনদের জন্য সহীহ। সম্পূর্ণ ভুল তরজমা, অর্থহীন তরজমা। কথাটির তরজমা হবে, মুরসিল পর্যন্ত হাদীসটির সনদ সহীহ।
সঠিক অনুবাদ
ইবারতটুকুর তরজমা হবে এইরূপ : ‘হাদীসটি মুরসাল হলেও সকল মুহাদ্দিসের মতানুসারে তা দলীলযোগ্য, যদিও মুরসালের (দলীলযোগ্যতার) ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। (হাদীসটির দলীলযোগ্যতার) কারণ, মুরসিল (তথা তাঊস) পর্যন্ত হাদীসটির সনদ সহীহ। এ ছাড়া হাদীসটি একাধিক সনদে মাউসুল—মুত্তাসিলরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমনটা এইমাত্র আমি উল্লেখ করলাম।...’
নিজের একান্ত ভরসাস্থল শায়েখ আলবানীর এই সহজ আরবী ইবারতটুকুও যিনি বুঝলেন না, এই সামান্য ইবারতটুকুর তরজমা করতে গিয়ে যিনি লেজে গোবরে করে ফেললেন, আরবী ভাষা-জ্ঞানে তাঁর যোগ্যতা যে কী পরিমাণ— তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
এরপর হাদীস-সংশ্লিষ্ট জটিল শাস্ত্রাদি? সে তো এক মহাসাগর। সে সাগরের মণি—মুক্তা আহরণ তো দূরের কথা, সে সাগরের কিঞ্চিৎ জলও তিনি তাঁর পাত্রে সংরক্ষণ করতে পেরেছেন কি না— তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর অনুসারীদেরকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব।
শায়েখ আলবানী রাহ.-এর বক্তব্যের পর্যালোচনা
হাদীসটি সম্পর্কে শায়েখ আলবানী রাহ. উপরিউক্ত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি মুরসিল পর্যন্ত সহীহুল ইসনাদ। অর্থাৎ তাঊস পর্যন্ত হাদীসটির সনদ সহীহ। কিন্তু তাঁর এখানকার এই দাবি অন্যত্র ব্যক্তকৃত তাঁর বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, হাদীসটিতে একজন রাবী আছেন সুলাইমান ইবনে মূসা। তাঁর সম্পর্কে আলবানী সাহেব তাঁর ‘আসলু সিফাতিস সালাহ’ গ্রন্থে বলেছেন— صَدُوْقٌ فِيْ حَدِيْثِه بَعْضُ لِيْنٍ (সত্যপরায়ণ, তার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে।) আর ‘ইরওয়াউল গালীল’ গ্রন্থে একটি হাদীসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—
اِنَّ الْحَدِيْثَ رِجَالُه كُلُّهُمْ ثِقاتٌ رِجَالُ مُسْلِمٍ إِلَّا اَنَّ سُلَيْمَانَ بْنَ مُوْسٰى مَعَ جَلَالَتِه فِي الْفِقْهِ فَقَدْ قَالَ الذَّهَبِي فِي الضُّعَفَاءِ: صَدُوْقٌ قَالَ الْبُخَارِي: عِنْدَهُ مَنَاكِيْرُ، وَقَالَ الْحَافِظُ فِي التَّقْرِيْبِ: صَدُوْقٌ فَقِيْهٌ، فِي حَدِيْثِه بَعْضُ لِيْنٍ وَخُوْلِطَ قَبْلَ مَوْتِه بِقَلِيْلٍ. وَعَلٰى هٰذَا فَالْحَدِيْثُ حَسَنُ الْاِسْنَادِ، وَاَمَّا الصِّحَّةُ فَهِيَ بَعِيْدَةٌ عَنْهُ.
অর্থাৎ হাদীসটির সকল রাবী বিশ্বস্ত, সহীহ মুসলিমের রাবী। তবে সুলাইমান ইবনে মূসা ফিকহের ক্ষেত্রে উচ্চমান সম্পন্ন হলেও যাহাবী তাঁর ‘যুআফা’ গ্রন্থে তার সম্পর্কে বলেছেন, সাদূক; বুখারী বলেছেন, তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে; ‘তাকরীব’ গ্রন্থে হাফেজ বলেছেন, তিনি সাদূক বা সত্যপরায়ণ, ফকীহ। তার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তাঁর স্মৃতি-বিভ্রাট দেখা দিয়েছিল। হাদীসটি হাসানুল ইসনাদ তথা হাসান-সনদ-বিশিষ্ট। বাকি রইল সহীহ হওয়ার বিষয়, তো তা হাদীসটি থেকে অনেক দূরে। (অর্থাৎ হাদীসটি সহীহ হওয়ার ধারে কাছেও নেই।)
আমাদের বক্তব্য
আমরা দেখতে পেলাম যে, শায়েখ আলবানী রাহ. সুলাইমান ইবনে মূসার কারণে এখানে সনদটিকে হাসান-সনদ বলছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় সনদটির সহীহ হওয়ার বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়েছেন। অথচ তাঊসের মুরসাল হাদীসটির সনদে সুলাইমান ইবনে মূসা থাকা সত্ত্বেও সনদটিকে তিনি সহীহ সনদ-বিশিষ্ট বলছেন। বিচিত্র নয় কী? একই ব্যক্তি ও তাঁর বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে একস্থানে একরকম বক্তব্য এবং বুকের ওপর হাত বাঁধা বিষয়ে ঐ ব্যক্তি কর্তৃক বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে অন্যরকম বক্তব্য দ্বিবিধ কারণে হতে পারে—
এক. শায়েখ আলবানী রাহ. বুকের ওপর হাত বাঁধার পক্ষে প্রমাণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ঐ ব্যক্তি কর্তৃক বর্ণিত তাঊসের মুরসাল হাদীসের সনদকে সহীহুল ইসনাদ বলেছেন।
দুই. এখানে এসে তাঁর স্মৃতিবিভ্রাট ঘটেছে।
কোন্টি সঠিক তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
সুধী পাঠক, হাদীসটি মুরসাল। আর মুরসাল হাদীসকে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ দলীলযোগ্য মনে করেন না। সুতরাং হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করা মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের জন্য সঠিক হয়নি। তবে হানাফীদের মতে যেহেতু মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য, তাই এ হাদীস তাঁদের নীতি অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে যায়। তাঁরা হাদীসটিকে গ্রহণ করেননি। কেন গ্রহণ করেননি? তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল যে, যাঁরা শর্তসাপেক্ষে মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন, তাঁদের নিকট তো বটেই, যাঁরা শর্তনিরপেক্ষভাবে মুরসাল হাদীসকে গ্রহণ করেন, তাঁদের মতেও মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য একটি শর্ত অপরিহার্য। আর তা হল, মুরসিল পর্যন্ত হাদীসটির সনদ সহীহ হওয়া। আর এখানে শর্তটি পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ, সুলাইমান ইবনে মূসা। শায়েখ আলবানী তাঁর দুর্বলতা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে কয়েকজনের মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। ঐসকল ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য ছাড়াও ইমাম নাসাঈ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, لَيْسَ بِالْقَوِىِّ ‘তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নন।’
আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, مَطْعُوْنٌ عَلَيْهِ ‘সমালোচিত ও অভিযুক্ত রাবী।’ ইমাম বুখারীর ন্যায় আসসাজী রাহ.-ও বলেছেন, عِنْدَهُ مَنَاكِيْرُ‘তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে।’ হাকেম আবু আহমাদ বলেছেন, فِىْ حَدِيْثِهِ بَعْضُ الْمَنَاكِيْرِ ‘তার হাদীসে কিছু কিছু আপত্তিকর বিষয় আছে।’ আবু হাতেম রাযী বলেছেন, مَحَلُّهُ الصِّدْقُ وَفِىْ حَدِيْثِهِ بَعْضُ الْاِضْطِرَابِ ‘তিনি সত্যনিষ্ঠমানের, তবে তার হাদীসে কিছু ইযতিরাব বা অসঙ্গতি রয়েছে।’ ইবনুল জারূদ তাকে যু‘আফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বুঝা যায়, তাঁর দৃষ্টিতেও সুলাইমান ইবনে মূসা যঈফ ছিলেন। আর ইমাম বুখারী ও হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর মন্তব্য তো খোদ শায়েখ আলবানীর উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতেই উপস্থাপিত হয়েছে।
এতদ্ব্যতীত, ইবনে হিব্বান তাঁর ‘মাশাহীরু উলামাইল আমসার’ গ্রন্থে তাঁকে মুদাল্লিস বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. তাঁর গ্রন্থ ‘তারীফু আহলিত তাকদীস বি মারাতিবিল মাওসূফীন বিত-তাদলীস’ গ্রন্থে সুলাইমান ইবনে মূসা সম্পর্কে ইবনে হিব্বানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এবং খণ্ডন করেননি। ফলে সুলাইমান ইবনে মূসার মুদাল্লিস হওয়ার বিষয়টি আল্লামা ইবনে হাজারের নিকটও স্বীকৃত বলে বুঝা যায়। আর মুদাল্লিস রাবীর বর্ণনা যখন عن শব্দযোগে হয় তখন তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। সুলাইমান ইবনে মূসা হাদীসটিকে সুফিয়ান হতে বর্ণনা করেছেন عن শব্দযোগে। হানাফীগণ সুলাইমান ইবনে মূসার ওপর এতসব আপত্তি থাকা অবস্থায় হাদীসটি সহীহ হতে পারে না বলে মনে করেন। আর এ কারণেই তাঁরা হাদীসটিকে গ্রহণ করেন না।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ৪
عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ رَضِيَ الله عَنْهُ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى يَدِهِ الْيُسرٰى عَلٰى صَدْرِه.
ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করলাম। তো (দেখলাম) তিনি ডান হাতকে বাম হাতের ওপর রেখে বুকের ওপর রাখলেন।
হাদীসটি উল্লেখ করে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব হাদীসটি সম্পর্কে শায়েখ আলবানীর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। সহীহ ইবনে খুযাইমাহর টীকায় শায়েখ আলবানী রাহ. বলেন—
اِسْنَادُهُ ضَعِيْفٌ لِأنَّ مُؤَمَّلًا وَهُوَ اِبْنُ اِسْمَاعِيْلَ سَيِّئ الْحِفْظِ لٰكِنَّ الْحَدِيْثَ صَحِيْحٌ جَاءَ مِنْ طُرُقٍ اُخْرٰى بِمَعْنَاهُ وَفِى الْوَضْعِ عَلَى الصَّدْرِ أَحَادِيْثُ تَشْهَدُ لَه.
হাদীসটির সনদ যঈফ। কেননা, মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের স্মৃতিশক্তি খারাপ ছিল। তবে হাদীসটি সহীহ। আরো কিছু সনদে হাদীসটি সমার্থক শব্দে বর্ণিত হয়েছে। এবং বুকের ওপর হাত রাখার বিষয়ে আরো কিছু হাদীস আছে, যা এই হাদীসের বক্তব্য সমর্থন করে।
পর্যালোচনা
হাদীসটির একজন রাবী মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈল সম্পর্কে আলজারহু ওয়াত্ তা‘দীলের ইমামগণের পক্ষ থেকে বহু নেতিবাচক বক্তব্য পাওয়া যায়। সেসব বক্তব্য দ্বারা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের কারণে যঈফ। আমি সেসব বক্তব্য ও মন্তব্য উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ, বুকের ওপর হাত বাঁধার কট্টর প্রবক্তা খোদ শায়েখ আলবানী রাহ. মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের কারণে এই হাদীসের সনদকে যঈফ বলেছেন। তবে যঈফ বলার পর তিনি দাবি করে বলেছেন, ‘তবে হাদীসটি সহীহ’। অর্থাৎ সহীহ লিগাইরিহী। এর কারণ ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি দুইটি কথা বলেছেন—
ক. বুকের ওপর হাত বাঁধার কথাটি মুআম্মালের সনদ ব্যতীত অন্য একাধিক সনদেও বর্ণিত হয়েছে।
খ. বুকের ওপর হাত বাঁধা প্রসঙ্গে আরো কিছু হাদীস রয়েছে, যেগুলো এই হাদীসের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
উসূলে হাদীসের পরিভাষায় সাধারণত প্রথম প্রকারের হাদীসগুলোকে বলা হয় মুতাবে‘ (متابع) আর দ্বিতীয় প্রকারের হাদীসগুলোকে বলা হয় শাহেদ (شاهد)। শায়েখ আলবানী রাহ. বলতে চাইছেন, মুআম্মালের সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি যদিও মুআম্মালের কারণে যয়ীফ, তবে হাদীসটির একাধিক মুতাবে‘ ও শাহেদ আছে বিধায় তা সহীহ।
কিন্তু আমাদের পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হবে যে, শায়েখ আলবানীর এই দুই দাবির কোনো দাবিই সঠিক নয়। অর্থাৎ মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈল ব্যতীত অন্য যেসব সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তার কোনোটিতেই ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি নেই এবং সেসব সনদে এর সমার্থক কোনো শব্দও নেই। সুতরাং এটি সম্পূর্ণ ভুল দাবি যে, মুআম্মাল ব্যতীত অন্যান্য সনদে হাদীসটি সমার্থক শব্দে বর্ণিত হওয়ার কারণে হাদীসটি সহীহ। আর এই হাদীসের পক্ষে যেসব শাহেদ হাদীসের কথা তিনি বলেছেন, সেগুলোর কোনোটাই শাহেদ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। শাহেদ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। তার পূর্বে আমরা হাদীসটির مُتَابِع সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করব।
হাদীসটির আদৌ কোনো মুতাবে‘ আছে কি না?
শায়েখ আলবানী রাহ.-এর দাবি তো হল, এ হাদীসের একাধিক মুতাবে‘ আছে। অর্থাৎ মুআম্মালের সূত্র ব্যতীত অন্য একাধিক সূত্রেও বুকের ওপর হাত বাঁধার কথা বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং হাদীসটি সহীহ। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। আর তা হল, হাদীসটি শুধু যঈফ নয়, হাদীসটি শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম তাঁর ই‘লামুল মুওয়াক্কিয়ীন গ্রন্থে হাদীসটি সম্পর্কে বলেন—
رَوَاهَا الْجَمَاعَةُ عَنْ سُفْيَانَ الثَّوْرِي عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ اَبِيْهِ عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى يَدِهِ الْيُسْرٰى عَلٰى صَدْرِه وَلـمْ يَقُلْ (عَلٰى صَدْرِه) غَيْرُ مُؤَمَّلِ بْنِ اِسْمَاعِيْلَ.
‘একদল মুহাদ্দিস হাদীসটি বর্ণনা করেছেন সুফইয়ান ছাওরী থেকে, তিনি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে, ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করলাম। তো তিনি তাঁর ডান হাতটাকে বাম হাতের ওপর বুকের ওপর রাখলেন।
عَلٰى صَدْرِه বা ‘বুকের ওপর’ কথাটি মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈল ব্যতীত কেউ বলেনি।’
অন্যত্র ইবনুল কায়্যিম বলেন—
قَالَ (الْإمَامُ أَحْمَدُ) فِيْ رِوَايَةِ الْمُزَنِي أَسْفَلَ السُّرَّةِ بِقَلِيْلٍ وَيُكْرَهُ أَنْ يَجْعَلَهُمَا عَلَى الصَّدْرِ وَذٰلِكَ لِمَا رُوِىَ عَنِ النَّبِيِّ أَنَّه نَهٰى عَنِ التَّكْفِيْرِ وَهُوَ وَضْعُ الْيَدِ عَلَى الصَّدْرِ، مَؤَمَّلٌ عَنْ سُفْيَانَ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ وَائِلٍ أَنَّ النَّبِيَّ (وَضَعَ) يَدَه عَلٰى صَدْرِه فَقَدْ رَوٰى هٰذَا الْحَدِيْثَ عَبْدُ اللهِ بْنُ الْوَلِيْدِ عَنْ سُفْيَانَ لَمْ يَذْكُرْ ذٰلِكَ .
মুযানীর বর্ণনা অনুযায়ী (ইমাম আহমাদ) বলেন, (হাত রাখবে) নাভির সামান্য নিচে। হাতদুটোকে বুকের ওপর রাখা মাকরূহ। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি ‘তাকফীর’ করতে নিষেধ করেছেন। আর তাকফীর হল, বুকের ওপর হাত রাখা। মুআম্মাল সুফইয়ান থেকে, সুফইয়ান আসেম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তাঁর পিতা ওয়ায়েল রা. থেকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত বুকের ওপর রাখলেন। অথচ হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদও সুফইয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি এই কথাটি (তথা বুকের ওপর রাখলেন) বলেননি।
হাদীসটি শায কেন তা বুঝতে হলে আরো যেসব সনদে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সনদগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এই—
(১) আহমাদ বর্ণনা করেন আবদুস সামাদ থেকে, তিনি যায়েদাহ থেকে, যায়েদাহ আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(২) আবু দাঊদ বর্ণনা করেন হাসান ইবনে আলী থেকে, তিনি আবুল ওয়ালীদ থেকে, তিনি যায়েদা থেকে, যায়েদা আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৩) নাসাঈ বর্ণনা করেন সুওয়াইদ ইবনে নাসর থেকে, তিনি ইবনে মুবারক থেকে, তিনি যায়েদা থেকে, আর যায়েদা আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৪) আবু দাঊদ বর্ণনা করেন মুসাদ্দাদ থেকে, তিনি বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল থেকে, আর বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৫) ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেন আলী ইবনে মুহাম্মাদ থেকে, তিনি বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল ও ইবনে ইদরীস থেকে আর তারা আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৬) ইবনে খুযাইমাহ বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ থেকে, তিনি ইবনে ইদরীস থেকে, ইবনে ইদরীস আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৭) ইবনে খুযাইমাহ বর্ণনা করেন হারূন ইবনে ইসহাক থেকে, তিনি ইবনে ফুদাইল থেকে, ইবনে ফুদাইল আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৮) আহমাদ বর্ণনা করেন ইউনুস ইবনে মুহাম্মাদ থেকে, তিনি আবদুল ওয়াহিদ থেকে, আবদুল ওয়াহিদ আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(৯) আহমাদ বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালিদ থেকে, তিনি সুফইয়ান থেকে, সুফইয়ান আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(১০) আহমাদ বর্ণনা করেন আসওয়াদ ইবনে আমের থেকে, তিনি যুহাইর থেকে, যুহাইর আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
(১১) আহমাদ বর্ণনা করেন আসওয়াদ ইবনে আমের থেকে, তিনি শু‘বা থেকে, আর শু‘বা আসেম ইবনে কুলাইব থেকে
এই এগারোটি সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে আসেম ইবনে কুলাইবের সূত্রে তাঁর পিতা থেকে আর তাঁর পিতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে। এগুলোতে যায়েদাহ, বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল, ইবনে ইদরীস, ইবনে ফুদাইল, আবদুল ওয়াহিদ, সুফইয়ান, যুহাইর ও শু‘বা— এই আটজন নির্ভরযোগ্য রাবী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আসেম ইবনে কুলাইব থেকে। তাঁরা সকলেই ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা বা ধরার কথা বলেছেন। তাঁদের কারো বর্ণনাতেই বুকের ওপর রাখার কথাটি নেই।
এ ছাড়াও হাদীসটির নিম্নোক্ত সনদগুলো দেখুন—
(১২) মুসলিম যুহাইর থেকে, তিনি আফফান থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ থেকে, তিনি আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি আলকামাহ ও তাদের মাওলা থেকে, তাঁরা দুইজন ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৩) আহমাদ আফফান থেকে, তিনি হাম্মাম থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ থেকে, তিনি আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি আলকামাহ ও তাদের মাওলা থেকে, তাঁরা দুইজন ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৪) আহমাদ ইয়াহইয়া ইবনে আবী বুকাইর থেকে, তিনি যুহাইর থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৫) আহমাদ ওয়াকী থেকে, তিনি মূসা ইবনে উমাইর থেকে, তিনি আলকামাহ ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৬) আহমাদ ওয়াকী থেকে, তিনি মাসঊদী থেকে, তিনি আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি তাঁর পরিবারের লোকজন থেকে, তারা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৭) আহমাদ মুহাম্মাদ ইবনে জা‘ফর থেকে, তিনি শু‘বা থেকে, তিনি সালামাহ ইবনে কুহাইল থেকে, তিনি হুজর আবুল আনবাস থেকে, তিনি আলকামাহ থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৮) আহমাদ হাসান ইবনে মূসা থেকে, তিনি যুহাইর থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
(১৯) দারেমী (হাদীস নং ১২৪১) আবু নুআইম থেকে, তিনি যুহাইর থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আলকামাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে
এসব সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে আলাকামাহ-এর সূত্রে তাঁর পিতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে অথবা আবদুল জাব্বারের সূত্রে তাঁর পিতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে।
অর্থাৎ যায়েদা, বিশর ইবনুল মুফাদ্দালসহ আটজন রাবী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আসিম ইবনে কুলাইবের সূত্রে। আর মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ, আবু ইসহাক সাবিঈ ও মাসঊদী— এই তিনজন হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে। আর হুজর আবুল আনবাস ও মূসা ইবনে উমাইর দুইজন বর্ণনা করেছেন আলকামা থেকে। মোট ১৩জন রাবী, যাঁদের অধিকাংশই হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমাম, তাঁদের কারো বর্ণনাতেই ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি নাই। শুধু মুআম্মালের বর্ণনাতেই তা রয়েছে। এমনকি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে সুফইয়ানের বরাতে বর্ণনাকারী মুআম্মালের দুজন সঙ্গী মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ফিরইয়াবী ও আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদের বর্ণনাতেও বুকের ওপর কথাটি নেই। শুধু মুআম্মালের বর্ণনাতেই কথাটি রয়েছে। একে তো মুআম্মাল যঈফ রাবী। সুতরাং তার বর্ণিত হাদীস দুর্বল। উপরন্তু তিনি এই বর্ণনায় নিঃসঙ্গ হওয়ার কারণে তা মুনকার বা অত্যন্ত দুর্বল ও আপত্তিকর।
শায়েখ আলবানী রাহ.-এর একটি ভুল
এবার আসুন, আমরা শায়েখ আলবানী রাহ.-এর একটি বিভ্রান্তি নিয়ে সামান্য পর্যালোচনা করি।
উপরের আলোচনা থেকে এটা একদম স্পষ্ট যে, হাদীসটি ওয়ায়েল রা. থেকে বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের সূত্র ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে বুকের ওপর হাত বাঁধার কথাটি নেই। কিন্তু শায়েখ আলবানী রাহ. তার সহীহ আবী দাঊদ কিতাবে দাবি করেছেন, ওয়ায়েল রা. থেকে নাকি অন্য আরেকটি সূত্রেও বুকের ওপর হাত রাখার কথাটি বর্ণিত হয়েছে।
পূর্বে বর্ণিত (৩নং হাদীস) তাঊসের মুরসাল হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন—
ثُمَّ اِنَّ الْحَدِيْثَ مُرْسَلٌ لِأنَّ طَاووسًا تَابِعِيٌّ لٰكِنَّهُ حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ فَإِنَّه قّدْ جَاءَ لَهُ شَاهِدَانِ مَوْصُوْلَانِ مِنْ وَجْهَيْنِ آخَرَيْنِ.
اَحَدُهُمَا: عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ اَخْرَجَه اِبْنُ خُزَيْمَةَ فِي صَحِيْحِهِ مِنْ طَرِيْقِ مُحَمَّدِ بْنِ جُحَادَةَ عَنْ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلٍ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ عَنْ اَبِيْهِ ....فِيْ حَدِيْثِ حِكَايَتِه لِصَلَاةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَ فِيْهِ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى يَدِهِ الْيُسْرٰى عَلٰى صَدْرِه نَقَلْنَاهُ فيما تقدم عَنْ ابْنِ حَجَرٍ عند الحديث (৭১৪)...
وَاَمَّا الْحَدِيْثُ الْآخَرُ فَهُوَ عَنْ قَبِيْصَةَ بْنِ هُلْبٍ عَنْ اَبِيْهِ .
অতঃপর কথা হল, হাদীসটি মুরসাল। কেননা, তাঊস একজন তাবিঈ। তবে হাদীসটি সহীহ। কেননা, এর দুটো সাক্ষী আছে, যেগুলো মাওসুল-মুত্তাসিলরূপে ভিন্ন ভিন্ন দুটি সনদে বর্ণিত হয়েছে।
একটি হল ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে। ইবনে খুযাইমাহ যেটিকে তাঁর সহীহ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহর সূত্রে আবদুল জাব্বার থেকে, আর আবদুল জাব্বার আলকামাহ ইবনে ওয়ায়েল থেকে আর আলকামাহ ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের পদ্ধতি বর্ণনায়। হাদীসটিতে আছে, তাঁর ডান হাতটিকে তাঁর বাম হাতের ওপর, বুকের ওপর রাখলেন। হাদীসটি আমি উদ্ধৃত করেছি ইবনে হাজার থেকে।
আর আরেকটি হাদীস হল, কাবীসাহ ইবনে হুল্ব থেকে বর্ণিত, যেটি তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর পিতা থেকে।
পাঠকের জানা থাকা দরকার, عَلٰى صَدْرِه (বুকের ওপর) সম্বলিত বর্ণনাটি সহীহ ইবনে খুযাইমাহতেও মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের সূত্রেই বর্ণিত। কিন্তু শায়েখ আলবানী রাহ. একদম অনুমানের ভিত্তিতে বলছেন যে, হাদীসটি সহীহ ইবনে খুযাইমাহ্য় মুহাম্মাদ ইবনে জাহাদাহ্র সূত্রে আবদুল জাব্বার থেকে, তিনি আলকামা ইবনে ওয়ায়েল থেকে, তিনি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে। আর তাতে বুকের ওপর হাত বাঁধার কথা আছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? বিলকুল নয়। একটু বিস্তারিত শুনুন।
শায়েখ আলবানীর কথা থেকে স্পষ্ট যে, এই কথা লেখার সময় পর্যন্ত তিনি নিজে সরাসরি সহীহ ইবনে খুযাইমাহ থেকে হাদীসটি দেখেননি; বরং ইবনে হাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি এইরূপ দাবি করেছেন। আমাদের দেখতে হবে, সহীহ ইবনে খুযাইমায় কী আছে আর ইবনে হাজার রাহ. আসলে কী বলেছেন।
ইবনে হাজার রাহ. যা বলেছেন তা এই—
حَدِيْثُ وَائِلِ بْنِ حُجْر: اَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَبَّرَ ثُمَّ أَخَذَ شِمَالَه بِيَمِيْنِه.
أَبُوْ دَاوُدَ وَاِبْنُ حِبَّانَ مِنْ حِدِيْثِ مُحَمَّدِ بْنِ جُحَادَةَ عَنْ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلٍ قَالَ: كُنْتُ غُلَامًا لَا أَعْقِلُ صَلَاةَ أَبِي، فَحَدَّثَنِي عَلْقَمَةُ بْنُ وَائِلٍ عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، قَالَ: صَلَّيْتُ خَلْفَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَكَانَ إذَا دَخَلَ فِي الصَّفِّ رَفَعَ يَدَيْهِ وَكَبَّرَ، ثُمَّ الْتَحَفَ فَأَدْخَلَ يَدَه فِي ثَوْبِه، فَأَخَذَ شِمَالَه بِيَمِينِهِ، فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ أَخْرَجَ يَدَيْهِ وَرَفَعَهُمَا وَكَبَّرَ، ثُمَّ رَكَعَ فَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنْ الرُّكُوعِ رَفَعَ يَدَيْهِ وَكَبَّرَ، وَسَجَدَ، ثُمَّ وَضَعَ وَجْهَه بَيْنَ كَفَّيْهِ.
وَقَالَ ابْنُ جُحَادَةَ: فَذَكَرْتُ ذلِكَ لِلْحَسَنِ، فَقَالَ: هِيَ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَه مَنْ فَعَلَه، وَتَرَكَه مَنْ تَرَكَه. وَأَصْلُه فِي صَحِيْحِ مُسْلِم.
وَرَوَاهُ النَّسَائِيُّ بِلَفْظِ: رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ قَائِمًا قَبَضَ بِيَمِيْنِهِ عَلٰى شِمَالِهِ.
وَرَوَاهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ بِلَفْظِ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنٰى عَلٰى يَدِهِ الْيُسْرٰى عَلٰى صَدْرِه.
ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীস : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর বললেন। অতঃপর ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরলেন।
(হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) আবু দাঊদ ও ইবনে হিব্বান মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর সূত্রে আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে...।
এর মূল বক্তব্যটি সহীহ মুসলিমে বিদ্যমান।
নাসাঈ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এই শব্দে : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম, যখন তিনি দণ্ডায়মান হলেন তখন তাঁর ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরলেন।
এবং ইবনে খুযাইমাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এই শব্দে : ডান হাত রাখলেন বাম হাতের ওপর, বুকের ওপর।
ইবনে হাজার রাহ. ইবনে খুযাইমার উদ্ধৃতিতে ওয়ায়েল রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত হাদীসের পাঠ উল্লেখ করেছেন, সনদ উল্লেখ করেননি। তাহলে আলবানী রাহ. ইবনে হাজার রাহ.-এর আলোচনা থেকে কীভাবে বুঝলেন যে, ইবনে খুযাইমাতে এ রেওয়ায়েতটির সনদ কী? বোঝার কোনো সূত্র নেই। শুধু رَوَاهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ (এটি ইবনে খুযাইমা বর্ণনা করেছেন) শব্দ থেকেই অনুমান করে পুরো একটি সনদ বানিয়ে নিলেন আর তা ইবনে হাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে খুযাইমার ওপর চাপিয়ে দিলেন! শুধু رواه থেকে এতকিছু আবিষ্কার করে ফেলা সত্যিই বিস্ময়কর। ইলমুত তাখরীজের নিয়মনীতি এবং তাখরীজের কিতাবসমূহের উসলুব যাদের জানা আছে, তাদের থেকে এমন ভুল হওয়ার কথা নয়। এটা যদি তার বোঝার ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এটাকে তিনি নিজের বুঝ হিসেবে পেশ করতে পারতেন। তা না করে আবু দাঊদ ও ইবনে হিব্বানের উদ্ধৃতিতে ইবনে হাজার রাহ. যে সনদ উল্লেখ করেছেন সেটাকে নিছক আন্দাজের ভিত্তিতে ইবনে খুযাইমার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন আর বলেছেন, এ সনদ নাকি সহীহ ইবনে খুযাইমায় বর্ণিত ঐ হাদীসের, যাতে عَلى صَدْرِه (বুকের ওপর) অংশটি রয়েছে! এভাবে মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের মতো দুর্বল বর্ণনাকারীর একটা বিচ্ছিন্ন বর্ণনার জন্য একটি সহীহ সনদ আবিষ্কার করে ফেললেন। কারো ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়; কিন্তু শাস্ত্রীয় বিচারে এ ধরনের ভুল আসলেই জঘন্য। আর এই ভুল বিষয়ের উপস্থাপন যেভাবে হয়েছে তা আরো বিস্ময়কর।
কথা আরো আছে। আলবানী রাহ.-এর সহীহ আবী দাঊদের কথা পড়ে বোঝা যাচ্ছে, এটি লেখার সময় তার সামনে সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ছিল না। তবে পরবর্তীতে তিনি নিজেই সহীহ ইবনে খুযাইমার তা‘লীক তথা টীকা লিখেছেন, যা ১৪০০ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছাপার পর প্রায় বিশ বছর তিনি জীবিত ছিলেন; কারণ তার ওফাত হয়েছিল ১৪২০ হিজরীতে। এর মানে সহীহ ইবনে খুযাইমার সে হাদীস পরবর্তীতে তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। তখনই তার উচিত ছিল, সহীহ আবী দাউদের উক্ত কথাটি সংশোধন করে নেওয়া। কিন্তু তিনি তা করেননি। এরপর যখন সহীহ আবী দাঊদ ছেপে আসল তখন প্রকাশকের তো কর্তব্য ছিল, অন্তত টীকায় এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া; অথচ সেটাও করা হয়নি। এমনকি ‘আসলু সিফাতিস সালাত’, ‘সিফাতুস সালাত’ কোনোটাতেই এ কাজটি করা হয়নি। ‘আহকামুল জানাইয’ (যার সর্বশেষ সংস্করণ ১৪১২ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে) এর মধ্যেও তিনি এ হাদীসটি এনেছেন। সেখানেও তিনি এ ভুলটি ঠিক করে দিতে পারতেন; কিন্তু তা করেননি। ইলমী বিষয়ে এমন অসর্তকতা —সেটা যার থেকেই হোক— কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এখন আমরা সরাসরি সহীহ ইবনে খুযাইমাতেই দেখতে চাই সেখানে আসলে কী আছে।
আমরা বাস্তব অনুসন্ধানে দেখতে পাই যে, ইবনে খুযাইমাহ রাহ. মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর সূত্রে যে হাদীসটি সংকলন করেছেন তাতে عَلى صَدْرِه (বুকের ওপর) এই অতিরিক্ত কথাটি নেই। এই অতিরিক্ত কথাটি আছে মুআম্মালের সূত্রে তিনি যে রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন, সেখানে। সহীহ ইবনে খুযাইমায় মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির সনদ-মতন এই—
ثنا عِمْرَانُ بْنُ مُوسَى الْقَزَّازُ، ثنا عَبْدُ الْوَارِثِ، ثنا مُحَمَّدُ بْنُ جُحَادَةَ، نا عَبْدُ الْجَبَّارِ بْنُ وَائِلٍ قَالَ: كُنْتُ غُلَامًا لَا أَعْقِلُ صَلَاةَ أَبِي،فَحَدَّثَنِي وَائِلُ بْنُ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ، عَنْ أَبِي وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ فِي الصَّلَاةِ رَفَعَ يَدَيْهِ، ثُمَّ كَبَّرَ، ثُمَّ الْتَحَفَ، ثُمَّ أَدْخَلَ يَدَيْهِ فِي ثَوْبِه، ثُمَّ أَخَذَ شِمَالَه بِيَمِينِه، ثُمَّ ذَكَرَ الْحَدِيثَ.
قَالَ أَبُو بَكْرٍ: هذَا عَلْقَمَةُ بْنُ وَائِلٍ لَا شَكَّ فِيهِ، لَعَلَّ عَبْدَ الْوَارِثِ، أَوْ مَنْ دُونَه شَكَّ فِي اسْمِهِ وَرَوَاهُ هَمَّامُ بْنُ يَحْيَى، ثنا مُحَمَّدُ بْنُ جُحَادَةَ، حَدَّثَنِي عَبْدُ الْجَبَّارِ بْنُ وَائِلٍ، عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ، وَمَوْلًى لَهُمْ، عَنْ أَبِيهِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ.
আর মুআম্মালের সূত্রে বর্ণিত রেওয়ায়েতটির সনদ-মতন এই—
نا أَبُو مُوسَى، نا مُؤَمَّلٌ، نا سُفْيَانُ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ: صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى عَلى صَدْرِه.
যাহোক মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর বর্ণনায় عَلى صَدْرِه (বুকের ওপর) বাক্যাংশটি বিদ্যমান থাকার ধারণাটি যে ভুল, এর বিভিন্ন প্রমাণ ও আলামত রয়েছে।
প্রথমত আমরা বাস্তব অনুসন্ধানে দেখতে পেলাম যে, সহীহ ইবনে খুযাইমায় মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর বর্ণনায় عَلى صَدْرِه (বুকের ওপর) এই অতিরিক্ত কথাটি নেই। এই অতিরিক্ত কথাটি আছে মুআম্মালের বর্ণনায়।
দ্বিতীয়ত ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন, মূল হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বিদ্যমান। আমরা দেখি যে, মুসলিম শরীফে হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাতে ‘বুকের ওপর’ এই অতিরিক্ত কথাটি নেই।
মুসলিম শরীফে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে—
حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا عَفَّانُ، حَدَّثَنَا هَمَّامٌ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جُحَادَةَ، حَدَّثَني عَبْدُ الْجَبَّارِ بْنُ وَائِلٍ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ وَمَوْلًى لَهُمْ أَنَّهُمَا حَدَّثَاهُ عَنْ أَبِيهِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، أَنَّه رَأَى النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم- رَفَعَ يَدَيْهِ حِينَ دَخَلَ في الصَّلاَةِ كَبَّرَ- وَصَفَ هَمَّامٌ حِيَالَ أُذُنَيْهِ- ثُمَّ الْتَحَفَ بِثَوْبِه، ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى.
আমাদেরকে যুহাইর ইবনে হারব বলেন, আমাদেরকে আফফান বলেন, আমাদেরকে হাম্মাম বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ বলেন, আমাকে আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল বলেন আলাকামাহ ও তাদের একজন মাওলা থেকে, আলকামাহ ও মাওলা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে বর্ণনা করেন যে, ওয়ায়েল ইবনে হুজর দেখলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর হাতদুটো উত্তোলন করলেন —হাম্মাম হাত দুটো উত্তোলনের বর্ণনায় দেখালেন, দুই কান পর্যন্ত— আল্লাহু আকবার বললেন। এরপর তিনি তাঁর কাপড় জড়িয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখলেন।
ইমাম মুসলিম ছাড়াও আবু দাঊদ, নাসাঈ-সহ অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটি আলোচ্য সনদে স্ব স্ব গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন, কিন্তু কারো বর্ণনাতেই বুকের ওপর রাখার কথাটি নেই।
তৃতীয়ত পূর্বে আমরা ইবনুল কায়্যিমের বক্তব্য পাঠ করেছি। তাঁর বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, মুআম্মাল ব্যতীত আর কেউ ওয়ায়েলের হাদীসে ‘বুকের ওপর’ কথাটি বর্ণনা করেননি।
চতুর্থত আমরা ওয়ায়েল রা.-এর হাদীসটি যেসব সনদে বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলো উল্লেখ করে দেখিয়েছি যে, একমাত্র সুফইয়ানের সূত্রে মুআম্মাল ব্যতীত আর কেউ বুকের ওপর রাখার কথাটি বর্ণনা করেননি। এমনকি মুআম্মালের সহপাঠী আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদ এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ফিরইয়াবীও সুফইয়ানের সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তাঁদের বর্ণনায় এই অতিরিক্ত কথাটুকু নেই।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ৫
আরেকটি সনদে ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীসে ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি পাওয়া যায়। হাদীসটি এই—
أَخْبَرَنَا أَبُو سَعْدٍ أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ الصُّوفِي، أَخْبَرَنَا أَبُو أَحْمَدَ بْنُ عَدِىٍّ الْحَافِظُ،حَدَّثَنَا ابْنُ صَاعِدٍ،حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ سَعِيدٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ حُجْرٍ الْحَضْرَمِيُّ، حَدَّثَنِي سَعِيدُ بْنُ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أُمِّه عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ: حَضَرْتُ رَسُولَ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- نَهَضَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَدَخَلَ الْمِحْرَابَ، ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ بِالتَّكْبِيرِ، ثُمَّ وَضَعَ يَمِينَه عَلى يُسْرَاهُ عَلى صَدْرِه.
আমাদেরকে আবু সা‘দ আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আস-সূফী বলেন, আমাদেরকে আবু আহমাদ ইবনে আদী বলেন, আমাদেরকে ইবনু সা‘য়েদ বলেন, আমাদেরকে ইবরাহীম ইবনে সাঈদ বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনে হুজর আল-হাদরামী বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করেন সাঈদ ইবনে আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল তার পিতা থেকে, তার পিতা তার মাতা থেকে, আর তার মাতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. থেকে। ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি মসজিদের দিকে উঠে গেলেন এবং মিহরাবে প্রবেশ করলেন। অতঃপর আল্লাহু আকবার বলে হাতদুটো ওঠালেন। অতঃপর তাঁর ডান হাতকে তাঁর বাম হাতের ওপর বুকের ওপর রাখলেন।
একাধিক কারণে হাদীসটি দুর্বল।
(১) মুহাম্মাদ ইবনে হুজর আলহাদরামী দুর্বল রাবী। তাঁর সম্পর্কে ইমাম বুখারী রাহ. বলেছেন, فِيْهِ نَظْرٌ অর্থাৎ তাঁর ব্যাপারে আপত্তি আছে। উকাইলী এবং ইবনে আদীও তাঁর সম্পর্কে ইমাম বুখারীর মন্তব্য উল্লেখ করে সমর্থন করেছেন। আবু আহমাদ আলহাকেম বলেছেন— لَيْسَ بِالْقَوِيِّ عِنْدَهُمْ অর্থাৎ তিনি মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে শক্তিশালী নন। মীযান ও মুগনী উভয় গ্রন্থে আল্লামা যাহাবী বলেছেন, له مَنَاكِيْرُ অর্থাৎ তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা রয়েছে। আর ‘আলমুকতানা ফী সারদিল কুনা’ গ্রন্থে যাহাবী বলেছেন, لَيِّنٌ অর্থাৎ দুর্বল। হায়সামী বলেছেন, وَهُوَ ضَعِيْفٌ অর্থাৎ তিনি দুর্বল। আর ইবনে হিব্বান তাঁর ‘আলমাজরূহীন’ (সমালোচিত রাবী-চরিত) গ্রন্থে বলেছেন—
يَرْوِيْ عَنْ عَمِّهِ سَعِيْدِ بْنِ عَبْدِ الْجَبَّارِ، عَنْ أَبِيْهِ عَبْدِ الْجَبَّارِ، عَنْ أَبِيْهِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ بِنُسْخَةٍ مُنْكَرَةٍ مِنْهَا أَشْيَاءُ لَهَا أُصُوْلٌ مِّنْ حَدِيْثِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَيْسَتْ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، وَمِنْهَا أَشْيَاءُ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ مُخْتَصَرَةٌ جَاءَ بِهَا عَلَى التَّقَصِّي وَأَفْرَطَ فِيْهَا، وَمِنْهَا أَشْيَاءُ مَوْضُوْعَةٌ لَيْسَ مِنْ كَلَامِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، لَا يَجُوْزُ الْاِحْتِجَاجُ بِه.
অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদ ইবনে হুজর (আলহাদরামী) তার চাচা সাঈদ ইবনে আবদুল জাব্বার থেকে, তিনি তার পিতা আবদুল জাব্বার থেকে, তিনি তার পিতা ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে— আপত্তিকর একটি কপি বর্ণনা করে থাকেন। এর মধ্যে কিছু হাদীস এমন আছে, যার মূল তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে পাওয়া যায়, কিন্তু তা ওয়ায়েল রা. কর্তৃক বর্ণিত নয়। আর কিছু হাদীস এমন আছে, যা ওয়ায়েল রা. থেকে সংক্ষিপ্তরূপে বর্ণিত, কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে হুজর আলহাদরামী তাতে বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিস্তারিত আকারে বর্ণনা করেছেন। আবার কিছু হাদীস আছে সম্পূর্ণ জাল; যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নয়। তাকে (তথা মুহাম্মাদ ইবনে হুজরকে) প্রমাণস্বরূপ পেশ করা বৈধ হবে না।
(২) মুহাম্মাদ ইবনে হুজ্রের চাচা সাঈদ ইবনে আবদুল জাব্বারও সমালোচিত রাবী। তার বিষয়েও আপত্তি রয়েছে। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেন, فيه نظر অর্থাৎ তার বিষয়ে আপত্তি আছে। শায়েখ আলবানী রাহ. নাসাঈকে উদ্ধৃত করেছেন যে, নাসাঈ বলেছেন, তিনি শক্তিশালী নন। ইবনে মাঈন বলেছেন, لَمْ يَكُنْ بِثِقَةٍ অর্থাৎ তিনি নির্র্ভরযোগ্য ছিলেন না।
(৩) শায়েখ আলবানী রাহ. বলেছেন যে, বর্ণনাটিতে তৃতীয় আরেকটি দোষ আছে। আর তা হল, আবদুল জাব্বারের মাতা মাজহুল।
(৪) পূর্বে আমরা হাদীসটির সনদগুলোকে বিস্তারিত আকারে উল্লেখ করেছি। সেখানে দেখেছি যে, আবদুল জাব্বার ইবনে ওয়ায়েল থেকে সাঈদ ইবনে আবদুল জাব্বারের তিনজন সহপাঠী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এক. মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ, দুই. আবু ইসহাক সাবিঈ, তিন. আলমাসঊদী। এই তিনজনের কেউই ‘বুকের ওপর’ কথাটি বর্ণনা করেননি। সুতরাং এটি যঈফ রাবী কর্তৃক নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার কারণে মুনকার বর্ণনা।
চারটি কারণ আপাতত পাওয়া গেল। দুর্বলতার এতগুলো কারণ পাওয়া যাওয়ার পর হাদীসটিকে কী করে প্রমাণ হিসেবে তাঁরা গ্রহণ করেন তা বোধগম্য নয়।
শায়েখ আলবানী রাহ.-এর একটি ভুল দাবি
শায়েখ আলবানী রাহ. হাত বুকের ওপর রাখার বিষয়ে তাঊসের মুরসাল হাদীসটিকে মূল প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং হাদীসটির দুটি সমর্থক হাদীস আছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন—
وَهُوَ وَإِنْ كَانَ مُرْسَلًا فَهُوَ حُجَّةٌ عِنْدَ الْجَمِيْعِ، أَمَّا مَنْ يَحْتَجُّ مِنْهُمْ بِالْمُرْسَلِ إِطْلَاقًا فَظَاهِرٌ - وَهُمْ جُمْهُوْرُ الْعُلَمَاءِ، وَأَمَّا مَنْ لَا يَحْتَجُّ بِه إِلَّا إِذَا رُوِىَ مَوْصُوْلًا، أَوْ كَانَ لَه شَوَاهِدُ، فَلِاَنَّ لِهٰذَا شَاهِدَيْنِ: اَلْاَوَّلُ عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ:، أَنَّهُ رَأٰى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَضَعُ يَمِيْنَه عَلٰى شِمَالِه ثُمَّ وَضَعَهُمَا عَلٰى صَدْرِهِ. رَوَاهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ فِي صَحِيْحِهِ وَأَخْرَجَهُ الْبَيْهَقِيُّ فِي سُنَنِه (২/৩০) مِنْ طَرِيْقَيْنِ عَنْهُ يُقَوِّيْ أَحَدُهُمَا الْاٰخَرَ. اَلثَّانِي: عَنْ قَبِيْصَةَ بْنِ هُلْبٍ عَنْ أَبِيْهِ.... فَهٰذِه ثَلَاثَةُ أَحَادِيْثَ فِي أَنَّ السُّنَّةَ اَلْوضْعُ عَلى الصَّدْرِ. وَلَا يَشُكُّ مَنْ وَقَفَ عَلٰى مَجْمُوْعِهَا فِي أَنَّهَا صَالِحَةٌ لِلْاسْتِدْلَالِ عَلٰى ذٰلِكَ.
অর্থাৎ হাদীসটি মুরসাল হলেও সকলের নিকট তা প্রমাণযোগ্য। যারা শর্তহীনভাবে মুরসাল হাদীসকে প্রমাণযোগ্য বলে গ্রহণ করে থাকেন তাদের মতে তো এটির প্রমাণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তাঁরা হলেন অধিকাংশ আলেম। আর যাঁরা মুরসাল হাদীসকে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত না হলে কিংবা অন্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত না হলে গ্রহণ করেন না, তাঁদের নিকটও এই মুরসাল হাদীসটি গ্রহণযোগ্য। কেননা, এ হাদীসটির দুটি সাক্ষ্যমূলক বর্ণনা রয়েছে।
এক. ওয়ায়েল ইবনে হুজর-এর হাদীস। যেখানে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, ডান হাতকে বাম হাতের ওপর রাখতে, অতঃপর তিনি হাতদুটোকে রাখলেন বুকের ওপর। হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে খুযাইমাহ তাঁর সহীহ গ্রন্থে। এবং বায়হাকী তার সুনানে (২/৩০) ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. থেকে হাদীসটি দুটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন, যেগুলোর একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে।
দুই. কাবীছাহ ইবনে হুলব কর্তৃক তাঁর পিতা হতে বর্ণিত। ....। তো এই হল তিনটি হাদীস— এই বিষয়ের প্রমাণে যে, সুন্নত হল, বুকের ওপর হাত রাখা। এ তিনটি হাদীস যিনি একত্রে বিচার করবেন তিনি সন্দেহমুক্ত হবেন যে, এগুলো প্রমাণ হিসেবে পেশ করার যোগ্য।
এ মাসআলাতে এসে শায়েখ আলবানী রাহ. মুরসালকে যত গুরুত্বের সাথে পেশ করলেন, আসলেই কি তার নিকট মুরসালের মান এমনই? তা যাই হোক, এ বিষয়ে বাস্তব কথা হল—
প্রথমত যারা মুরসাল হাদীসকে এককভাবে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং যারা অন্যান্য প্রমাণ সাপেক্ষে গ্রহণ করেছেন তারা সকলেই একমত যে, মুরসাল হাদীস তখনই প্রমাণ বা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয়, যখন তার সনদ তাবিঈ পর্যন্ত সহীহ হয়। তাঊসের মুরসাল হাদীসকে এ পর্যায়ের ‘সহীহ মুরসাল’ বলে গণ্য করা যায় না। তার কারণ, সুলাইইমান ইবনে মূসা। বুকের ওপর হাত বাঁধা, হাদীস নং ৩ -এর আলোচনায় আমরা বিশদভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করে এসেছি।
দ্বিতীয়ত অন্য যে দুটো হাদীসকে শায়েখ আলবানী এই হাদীসের সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেছেন সে হাদীসদুটোও শায হওয়ার কারণে অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য। এজন্য এদুটো হাদীস শাহেদ হিসাবেও গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এই তিনটি হাদীস (একত্রে হলেও) গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয় না।
শায়েখ আলবানী রাহ. সাক্ষ্যমূলক যে দুটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর একটি তো হল ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত হাদীস। এ সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আরেকটি হল কাবীছাহ ইবনে হুলব কর্তৃক বর্ণিত হাদীস। সামনে আমরা কাবীছাহ ইবনে হুলব কর্তৃক বর্ণিত হাদীস নিয়ে পর্যালোচনা করব।
বুকের ওপর হাত বাঁধা
হাদীস নং ৬
حَدَّثَنَا عَبْدُ الله، حَدَّثَنِيْ أَبِىْ، ثَنَا يَحْيٰى بْنُ سَعِيْدٍ عَنْ سُفْيَانَ، حَدَّثَنِيْ سِمَاكٌ عَنْ قَبِيْصَةَ بْنِ هُلْبٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْصَرِفُ عَنْ يَمِيْنِهِ وَعَنْ يَسَارِهِ، وَرَأَيْتُهُ قَالَ: يَضَعُ هٰذِهِ عَلٰى صَدْرِهِ، وَصَفَ يَحْيٰى اَلْيُمْنٰى عَلَى الْيُسْرٰى فَوْقَ الْمِفْصَلِ
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব হাদীসটির তরজমা করেছেন এইভাবে : ক্বাবীছাহ বিন হুল্ব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেছেন, আমি রাসূল (ছাঃ)- কে ডান ও বামে ফিরতে দেখেছি এবং হাতকে বুকের ওপর রাখার কথা বলতে শুনেছি। অতঃপর ইয়াহইয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির ওপর রাখেন।
বাঁকা ও বোল্ড করা বর্ণে লিখিত তরজমাংশটি ভুল। সম্পূর্ণ ভুল তরজমা। এরূপ ভুল তরজমা করে মানুষকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করা চরম অন্যায়। কারণ, এই তরজমা দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতকে বুকের ওপর রাখতে বলেছেন আর হুল্ব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কথাটি বলতে শুনেছেন। অথচ হাদীসটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো উক্তি বর্ণিত হয়নি। তাঁর কর্ম বর্ণিত হয়েছে। কর্মটি হুল্ব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করতে দেখেছিলেন বলে হাদীসটিতে বর্ণিত হয়েছে।
رَأَيْتُه قَالَ বাক্যটির তরজমা তিনি করেছেন, ‘আমি তাকে বলতে শুনেছি।’ ভুল তরজমা। আসলে قَالَ ক্রিয়াপদটি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করেছে। তিনি মনে করেছেন, ক্রিয়াপদটির কর্তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ফলে رَأَيْتُه (আমি তাকে দেখলাম)-কে তিনি বানিয়ে ফেলেছেন سَمِعْتُه (আমি তাকে শুনলাম)। হাদীসের মূল পাঠ (Text) সম্পর্কে মোটাদাগের আনাড়ি না হলে এইরূপ ভুল কেউ করে না। প্রশ্ন হল, তাহলেقَالَ ক্রিয়াপদের কর্তা কে? উত্তর হল, এর কর্তা হল, হুল্ব রা. এবং ক্রিয়াপদটির উচ্চারণকর্তা হচ্ছে কাবীছাহ ইবনে হুল্ব। قَالَ শব্দটি হাদীসের পাঠের অংশ নয়। বর্ণনাকারী কাবীছাহকে পাঠের মাঝখানে শব্দটি কোনো কারণে বলতে হয়েছে। উলূমুল হাদীসের صِيَغُ الْأَدَاء বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বিষয়টি বুঝে থাকবেন। এর একটি কারণ এমন হতে পারে, হুল্ব রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ম কোন্ শব্দমালায় ব্যক্ত করেছেন তা কাবীছাহর হুবহু স্মরণে ছিল না। তাই তিনি যে এখানে হাদীসের পাঠ بالمَعنَى রেওয়ায়েত করছেন অর্থাৎ মূল বিষয়টি ধরে বর্ণনা করছেন, সেদিকে ইঙ্গিত করার জন্য قَالَ শব্দ যুক্ত করেছেন।
তরজমাটি হবে এইরূপ : কাবীছাহ ইবনে হুল্ব তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর পিতা বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি (নামায শেষে) ডানদিকে বা বামদিকে উঠে যেতে। এবং আমি তাঁকে দেখেছি (হুল্ব বলেছেন,) এটাকে বুকের ওপর রাখতে। বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ব্যাখ্যা করে দেখালেন, ডান হাতকে বাম হাতের ওপর, কব্জির ওপর।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব এরপর লিখেছেন—
‘উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ উক্ত হাদীছকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। কিন্তু তাদের দাবি সঠিক নয়। কারণ রাবী ক্বাবীছার ব্যাপারে কথা থাকলেও এর পক্ষে অনেক সাক্ষী রয়েছে। ফলে তা হাসান।’
৮২৯ নং টীকায় উপরিউক্ত কথার বরাত দিয়েছেন— ‘আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ১১৮’। কিন্তু শায়েখ আলবানীর পুরো বক্তব্য তিনি টীকায় উল্লেখ করেননি। আমি শায়েখ আলবানীর পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করছি। শায়েখ আলবানী বলেন—
أَخْرَجَه أَحْمَدُ (৫/২২৬) بِسَنَدٍ رِجَالُه ثِقَاتٌ رِجَالُ مُسْلِمٍ غَيْرُ قَبِيْصَةَ هٰذَا، وَقَدْ وَثَّقَهُ الْعِجْلِيْ وَاِبْنُ حِبَّان، لٰكِنْ لَمْ يَرْوِ عَنْهُ غَيْرُ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ، وَقَالَ اِبْنُ الْمَدِيْنِي وَالنَّسَائِيُّ: (مَجْهُوْلٌ)، وَفِيْ (التَّقْرِيْبِ): أَنَّه مَقْبُوْلٌ. قُلْتُ: فَمِثْلُه حَدِيْثُه حَسَنٌ فِيْ الشَّوَاهِدِ، وَلِذٰلِكَ قَالَ التِّرْمِذِيُّ بَعْدَ أَنْ خَرَّجَ لَه مِنْ هذا الْحَدِيْثِ: أَخْذَ الشِّمَالِ بِالْيَمِيْنِ: (حَدِيْثٌ حَسَنٌ).
অর্থাৎ ‘হাদীসটি সংকলন করেছেন আহমাদ (৫/২২৬) এরূপ এক সনদে যার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য, সহীহ মুসলিমের রাবী। এই কাবীছাহ ব্যতীত। তবে ইজলী ও ইবনে হিব্বান তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। কিন্তু সিমাক বিন হারব ব্যতীত আর কেউ তার থেকে বর্ণনা করেননি। ইবনুল মাদীনী ও নাসাঈ তাকে মাজহুল আখ্যায়িত করেছেন। তাকরীব গ্রন্থে আছে যে, তিনি মাকবূল। আমার বক্তব্য হল, তো এইজাতীয় রাবীর হাদীস সমর্থক হওয়ার ক্ষেত্রে হাসান। এবং এই কারণেই ইমাম তিরমিযী এ হাদীসে বর্ণিত ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরার অংশটি বর্ণনা করার পরে বলেছেন, হাসান হাদীস।’
শায়েখ আলবানীর উপরিউক্ত বক্তব্যে পাঠকবর্গ লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই যে, স্বয়ং আলবানী সাহেব বলছেন, ‘সিমাক বিন হারব ব্যতীত আর কেউ কাবীছাহ থেকে বর্ণনা করেননি।’ ফলে তিনি মাজহুল বলে গণ্য হন। এইজন্যই ইবনুল মাদীনী ও ইমাম নাসাঈ তাঁকে মাজহুল আখ্যায়িত করেছেন।
কখনো কখনো এরূপ হয় যে, অন্যান্যরা কোনো হাদীস দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেন আর লা-মাযহাবী ভাইয়েরা কোনো রাবীকে মাজহুল বলে হাদীসটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে উড়িয়ে দেন। যদিও সেই রাবী বাস্তবে মাজহুল নয় বা তার সমর্থন অন্য হাদীস দ্বারা পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে আমরা দেখলাম, দুইজন বড় ইমাম কাবীছাহকে মাজহুল বলে আখ্যায়িত করা সত্ত্বেও এবং খোদ আলবানী সাহেব তা স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও হাদীসটিকে তিনি দলীল হিসেবে গ্রহণ করছেন। বিস্ময়কর নয় কি?
কাবীছাহ যদি শুধু মাজহুল হতেন তাহলেও হয়তো শায়েখ আলবানীর মতানুসারে আমরা হাদীসটিকে হাসান বলে মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা শুধু কাবীছাহর মাজহুল হওয়া নয়। বরং হাদীসটিতে আরো একটি বড় সমস্যা বিদ্যমান। আর তা হল হাদীসটি শায।
কোনো হাদীস যদি অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য রাবী একভাবে বর্ণনা করেন আর তাঁদের বিপরীতে একজন নির্ভরযোগ্য রাবী অন্যরূপ বর্ণনা করেন, তবে হাদীসটিকে শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা বলা হয়। আর শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ বিষয়ে আমরা পূর্বেও আলোচনা করে এসেছি।
এই হাদীসটির ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে, হাদীসটি সুফইয়ান ছাওরী ছাড়াও সিমাক থেকে বর্ণনা করেছেন—
(১) শারীক
(২) শু‘বা
(৩) আবুল আহওয়াস
(৪) যায়েদাহ
(৫) আসবাত ইবনে নাসর
(৬) যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া
(৭) হাফস ইবনে জামী
এই সাতজনের কারো বর্ণনাতেই বুকের ওপর রাখলেন কথাটি নেই। এতে প্রমাণ হয় যে, হাদীসটিতে ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি সিমাক ইবনে র্হাব বলেননি।
সিমাক ইবনে হারব থেকে সুফইয়ান ছাওরীর একটি বর্ণনায় কথাটি পাওয়া যায়। কিন্তু বর্ণনাটি একমাত্র ইয়াহইয়ার সূত্রে। সুফইয়ান ছাওরীর অন্যান্য ছাত্রগণ এই কথাটি বর্ণনা করেননি। সুফইয়ান থেকে হাদীসটি ইয়াহইয়া ছাড়াও আর যারা বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেন—
(১) ওয়াকী‘
(২) আবদুর রহমান ইবনে মাহদী
(৩) হুসাইন ইবনে হাফস
(৪) আবদুর রাযযাক
দেখা যাচ্ছে যে, হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমাম ও নির্ভরযোগ্য রাবী ওয়াকী‘, আবদুর রহমান ইবনে মাহদী, হুসাইন ইবনে হাফস এবং আবদুর রাযযাক হাদীসটির বর্ণনায় ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি বলেননি। সুফইয়ানের বরাত দিয়ে কথাটি এসেছে শুধু ইয়াহইয়ার সূত্রে। এতে প্রমাণ হয় যে, সুফইয়ান ছাওরী আসলে হাদীসটির বর্ণনায় ‘বুকের ওপর রাখলেন’ কথাটি বলেননি। অতএব যদি বাস্তবেই ইয়াহইয়া এভাবেই বলে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, ইয়াহইয়া তাঁর বর্ণনায় ভুলক্রমে কথাটি সংযুক্ত করেছেন। হাদীসের নির্ভরযোগ্য অনেক রাবীর বিপরীতে তাঁর বর্ণনাটি নিঃসঙ্গ বর্ণনা বিধায় তাঁর বর্ণিত হাদীসটি হাদীসের পরিভাষায় শায ও দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা।
সারকথা দাঁড়াল এই যে, সিমাক থেকে তাঁর কোনো ছাত্রই ‘বুকের ওপর হাত রাখলেন’ কথাটি হাদীসটিতে বলেননি। আর সুফইয়ানের সূত্রে যাঁরা সিমাক থেকে বর্ণনা করেছেন তাঁদের কেউই কথাটি বলেননি। শুধু ইয়াহইয়ার সূত্রে কথাটি এসেছে।
এখন আমরা দেখাতে চাচ্ছি, বাস্তবে ইয়াহইয়া রাহ.-ও عَلٰى صَدْرِه (বুকের ওপর) শব্দটি বলেননি। বরং এটি অনুলেখকের ভুলের ফসল, যেমনটি আমরা আগে ইঙ্গিত করেছিলাম। এর একটি দলীল হল, এ হাদীসটি স্বয়ং ইয়াহইয়া রাহ.-এর সূত্রেই হবহু এই সনদে ইমাম আবু আলী আততূসী (৩১২ হি.) রাহ. তার মুখতাসারুল আহকাম (মুসতাখরাজুত তিরমিযী) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেখানেও عَلٰى صَدْرِه (বুকের ওপর) কথাটি নেই। এ কিতাব থেকে হাদীসের পুরো সনদ-মতন দ্রষ্টব্য—
بَابُ مَا جَاءَ فِي وَضْعِ الْيَمِينِ عَلَى الشمَال فِي الصَّلَاة
أنا بُنْدَارٌ مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، قَالَ: نَا يَحْيَى وَهُوَ ابْنُ سَعِيدٍ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ سِمَاكٍ، عَنْ قَبِيصَةَ بْنِ الْهُلْبِ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْصَرِفُ عَنْ شِقَّيْهِ، عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ يَسَارِهِ، وَيَضَعُ يَده الْيُمْنَى على الْيُسْرَى.
অনুচ্ছেদ : নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা
আমাদের বর্ণনা করেছেন বুনদার মুহাম্মাদ ইবনে বাশ্শার, তিনি বলেন, আমাদের বর্ণনা করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ, সুফিয়ান থেকে, তিনি সিমাক থেকে, তিনি কাবীছাহ ইবনে হুল্ব থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে— তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি (নামায শেষে) উভয় দিকে উঠে যেতে; ডানদিকে ও বামদিকে। এবং (তাঁকে দেখেছি) ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখতে।
তাহলে বোঝা গেল, আসলে ইয়াহইয়াও কথাটি বলেননি। এটি মুসনাদে আহমাদের অনুলেখকের ভুলের ফসল। এর বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আসলে কথাটি ছিল এইরূপ— يَضَعُ هٰذِه عَلٰى هٰذِه অর্থাৎ এই হাতকে এই হাতের ওপর রাখলেন। ইয়াহইয়া যখন ব্যাখ্যা করে দেখাতে গেলেন তখন তিনি তাঁর ডান হাতকে বাম হাতের ওপর তথা বাম হাতের কব্জির ওপর রাখলেন। এটিই প্রমাণ করে যে, কথাটি আসলে এইরূপই ছিল। একটু চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, মুসনাদে আহমাদের কপিতে কথাটি যেভাবে আছে তা অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, يَضَعُ هٰذِه عَلٰى صَدْرِهِ কথাটির অর্থ হল, এই হাতটিকে বুকের ওপর রাখলেন। বুকের ওপর তো এক হাত রাখার কথা নয়। রাখলে দুই হাতই রাখার কথা। তাই বোঝা যাচ্ছে, লিপিকার عَلٰى هٰذِه (এই হাতের ওপর)-এর স্থলে ভুলক্রমে লিখে ফেলেছেন—عَلٰى صَدْرِه (বুকের ওপর)।
আল্লামা নিমাবী রাহ. এই সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বলেন—
وَيَقَعُ فِي قَلْبِي أَنَّ هٰذَا تَصْحِيْفٌ مِنَ الْكَاتِبِ وَالصَّحِيْحُ يَضَعُ هٰذِه عَلٰى هٰذِه فَيُنَاسِبُه قَوْلُه: وَصَفَ يَحْيٰى اَلْيُمْنٰى عَلَى الْيُسْرٰى فَوْقَ الْمِفْصَلِ وَيُوَافِقُه سائِرُ الرِّوَايَاتِ.
অর্থাৎ আমার মনে হয় যে, এটা লিপিকারের ভুল। সঠিক হল يَضَعُ هٰذِه عَلٰى هٰذِه (এই হাতটিকে এই হাতের ওপর রাখলেন।) এরূপ হলেই এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় ইয়াহইয়া কর্তৃক ডান হাত বাম হাতের ওপর কব্জির ওপর রেখে ব্যাখ্যা করে দেখানো। আর তখন এর সাথে অন্যান্য বর্ণনারও ঐক্য সৃষ্টি হয়।
এটা যে লিপিকারের ভুল এবং ইমাম আহমাদ যে ইয়াহইয়ার সূত্রে ‘বুকের ওপর’ কথাটি বর্ণনা করেননি, এর বিভিন্ন আলামত রয়েছে—
১. যখন প্রমাণিত হল, ইয়াহইয়ার বর্ণনাতে ‘বুকের ওপর’ কথাটি নেই এবং এটি একটি দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা, তখন ইমাম আহমাদ ইয়াহইয়া থেকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এমন ভুল যে করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি বুনদার মুহাম্মাদ বিন বাশ্শারের মতোই ইয়াহইয়ার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য শিষ্য।
২. এ বিষয়ে ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মাযহাব হল, তিনি বুকের ওপর হাত রাখাকে মাকরূহ বলে মনে করতেন।
ইমাম আবু দাঊদ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের বিভিন্ন ফিকহী মত তাঁর কাছ থেকে শুনে একটি সংকলন তৈরি করেন ‘মাসাইলুল ইমাম আহমাদ’ নামে। সেই সংকলনে ইমাম আবু দাঊদ বলেন—
سَمِعْتُهُ يَقُوْلُ يُكْرَهُ اَنْ يَكُوْنَ يَعْنِىْ وَضْعَ الْيَدَيْنِ عِنْدَ الصَّدْرِ.
‘আমি তাঁকে (ইমাম আহমাদকে) বলতে শুনেছি, হস্তদ্বয় বুকের নিকট রাখা মাকরূহ।’
৩. বর্ণনাটি এসেছে সুফইয়ান ছাওরী রাহ.-এর মাধ্যমে। তার মাযহাবও ছিল উভয় হাত বেঁধে নাভির নীচে রাখা।
৪. মুসনাদে আহমাদের যেসব হাদীস হাদীসের ছয় কিতাব থেকে অতিরিক্ত রয়েছে, ওই হাদীসগুলো ইমাম নূরুদ্দীন হাইসামী রাহ. মাজমাউয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। কিন্তু সেখানে এ হাদীসটি নেই। যদি এ হাদীসের মধ্যে মুসনাদে আহমাদে على صدره (বুকের ওপর) অংশটি বিদ্যমান থাকত, তাহলে এটি ছয় কিতাবে নেই— এমন একটি বর্ণনা হত। আর সে করাণে তা মাজমাউয যাওয়ায়েদে থাকা আবশ্যক ছিল। এতে বোঝা যায়, ইমাম নূরুদ্দীন হাইসামীর কাছে মুসনাদে আহমাদের যে পাণ্ডুলিপি ছিল, তাতে يضع هذه على هذه ছিল। আর এই পাঠ হিসেবে এটি মুসনাদে আহমাদের বিশেষ হাদীস নয়, বরং তা ছয় কিতাবের বিভিন্ন গ্রন্থে রয়েছে। সেজন্য এটিকে তিনি মাজমাউয যাওয়ায়েদে সংকলন করেননি।
কাবীছাহ কর্তৃক বর্ণিত হাদীস
এবার আমরা কাবীছাহ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব কী বলেছেন— তা আরেকবার দেখে নিই। তিনি বলেছেন—
‘উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ উক্ত হাদীছকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। কিন্তু তাদের দাবি সঠিক নয়। কারণ রাবী কাবীছার ব্যাপারে কথা থাকলেও এর পক্ষে অনেক সাক্ষী রয়েছে। ফলে তা হাসান।’
প্রথমত হাদীসের পাঠের মধ্যেই على صدره (বুকের ওপর) কথাটি নেই। যেমনটি উপরে বিস্তারিত বলা হল।
দ্বিতীয়ত কাবীছাহ যদি শুধু মাজহুল হতেন, তাহলে হয়তো কোনো কথা বলতাম না, কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কাবীছাহ্র সূত্রে বর্ণিত ‘বুকের ওপর’ অংশটি শায ও দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা। আর দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা প্রকারান্তরে অস্তিত্বহীন বর্ণনা।
তৃতীয়ত তিনি বলেছেন, এর পক্ষে অনেক সাক্ষী রয়েছে। ফলে তা হাসান। সেই সাক্ষীগুলো কোন্ কোন্ হাদীস তা তিনি বলেননি।
চতুর্থত উপরে আমরা বিস্তারিত আলোচনাপূর্বক দেখেছি যে, শায়েখ আলবানীর কথাও যথার্থ নয়। কারণ, কাবীছাহ মাজহুল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সূত্রে বর্ণিত ‘বুকের ওপর’ অংশটি শাযও বটে। সুতরাং তা মূল দলীল হিসেবে হোক বা সমর্থক হিসেবে হোক, কোনোভাবেই গ্রহণীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
সারকথা
ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.-এর সূত্রে যে বর্ণনায় বুকের ওপর রাখার কথা আছে তা শায। তদ্রূপ কাবীছাহ ইবনে হুল্বের সূত্রে বর্ণিত ওই বাক্যাংশটিও (বুকের ওপর) শায। আর কোনো হাদীস শায হওয়ার অর্থ হল তা অস্তিত্বহীন, যা কোনো রাবীর বা লিপিকারের ভুলের ফসল। হাদীস যঈফ হলেও অনেক সময় তা সাক্ষ্য ও সমর্থক হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে, কিন্তু শায হাদীসের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। কারণ, কোনো হাদীস শায হওয়া অস্তিত্বহীনতার নামান্তর। আর তাঊসের মুরসাল হাদীসটিও ঐ পর্যায়ের নয়, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। সুতরাং বুকের ওপর রাখা সংক্রান্ত কোনো হাদীসকেই আমরা দলীলযোগ্য বলে বিবেচনা করতে পারছি না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
টীকা
১. ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর ছালাত’, ২য় সংস্করণ, প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০১৩
২. মূলত বিষয়টি এমন নয়। সালাফের ফকীহগণ ও মুজতাহিদ ইমামগণের কেউই এমনটি বোঝেননি। আমাদের জানা মতে তাদের কারো থেকেই নামাযে বুকে হাত রাখা প্রমাণিত নয়। ফিকহের অনুসৃত চার মাযহাবের কোনো মাযহাবেই এমন আমল নেই। বিস্তারিত জানতে দেখুন— কিফায়াতুল মুগতাযী ফী শারহি জামিইত তিরমিযী, শায়েখ আবদুল মতিন ৩/১১-২৫ (বি. স.)
৩. সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৪০
৪. বইয়ে এমনই আছে। এটা সম্ভবত লেখার ভুল। তিনি হয়তো লিখতে চেয়েছিলেন— ‘পুরো বাম হাতের ওপর ডান হাত রাখলে’।
৫. মিশকাত হা/৭৯৮-এর টীকা দ্রঃ, ১/২৪৯ পৃঃ
৬. ফাতহুল বারী, খণ্ড ১, হাদীস নং ৭৪০-এর ব্যাখ্যা।
৭. শাওকানী, নাইলুল আওতার ২/১৮৭
৮. নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৯; আবু দাঊদ, হাদীস নং ৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮৯০; সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস ৪৮০; ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৮৬০
৯. আবু দাঊদ, হাদীস ৭৫৯
১০. ইরওয়াউল গালীল ২/৭১
১১. পৃ. ২২২-২২৩
১২. আসলু সিফাতি সালাতিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫২৮
১৩. ইরওয়াউল গালীল, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৪৬
১৪. যাহাবী, আলকাশেফ
১৫. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস নং ৪৭৯; সুনানে বায়হাকী, হাদীস নং ২৪৩০; তাবাকাতুল মুহাদ্দিসীন বি আসবাহান, আবুশ শায়েখ আলআসবাহানী, হাদীস নং ৪৩২
১৬. ই‘লামুল মুওয়াক্কিয়ীন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০০ প্রকাশক দারুল জাবাল, বৈরূত ১৯৭৩
১৭. বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৬০১, প্রকাশক মাকতাবা নাযযার মুসতাফা আলবায ১৯৯৬
১৮. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৭৫
১৯. সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং ৭২৭
২০. সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৯
২১. সুনানে আবু দাঊদ হাদীস নং ৭২৬
২২. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৮১০
২৩. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস নং ৪৭৭
২৪. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস নং ৪৭৮
২৫. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৫৫
২৬. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৭৬
২৭. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৮১
২৮. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৮৪
২৯. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৩
৩০. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৭১
৩১. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৭৮
৩২. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৫১
৩৩. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৫৭
৩৪. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৫৯
৩৫. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৮১
৩৬. সুনান আদ-দারেমী, হাদীস নং ১২৪১
৩৭. আল মু‘জামুল কাবীর লিত-তাবারানী খণ্ড ২২, পৃষ্ঠা ৩৩, হাদীস নং ৭৮
৩৮ . মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৮৮৯১ (খণ্ড ৪ পৃষ্ঠা ৩১৮
৩৯ . আলবানী, সহীহ আবী দাঊদ ৩/৩৪৪-৩৪৫
৪০. আততালখীসুল হাবীর, হাদীস নং ৩৩১
৪১. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস ৯০৫, কিতাবুস সালাত, অনুচ্ছেদ ৩৪৬
৪২. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস ৪৭৯, কিতাবুস সালাত, অনুচ্ছেদ ৮৯
৪৩. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৩, ভারতীয় ছাপা কিতাবের খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৩
৪৪. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৮৮৯১; নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৯
৪৫ . আলমু‘জামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস নং ১৭৫৪৬
৪৬. সুনানে বায়হাকী, হাদীস নং ২৪২৯; আলমু‘জামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস নং ১৭৫৮৪
৪৭ . আততারীখুল কাবীর, ভুক্তি নং ১৬৪
৪৮. লিসানুল মীযান ৭/৫৭, ভুক্তি নং ৬৬৩৩
৪৯. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং ১১৭৮, ১৬০০৪
৫০. আলমাজরূহীন ২/২৭৩
৫১. আততারীখুল কাবীর, ভুক্তি নং ১৬৫১
৫২. সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ওয়াল মাওযুআ‘, আলবানী ১/৬৪৩
৫৩. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৩
৫৪. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৭৮, ১৯০৮১
৫৫. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৯০৫৭
৫৬. সূত্রদ্বয়ের একটি মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈলের সূত্র আরেকটি মুহাম্মাদ ইবনে হুজ্রের সূত্র। উভয় সূত্র সম্পর্কেই আমরা আলোচনা করেছি এবং দেখিয়েছি যে, উভয়টি সূত্রই মুনকার বা অত্যন্ত দুর্বল ও দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা, যেগুলো কোনোভাবেই বর্ণনাযোগ্য নয়। অতএব, শায়েখ আলবানী রাহ.-এর দাবি ভিত্তিহীন।
৫৭. আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃষ্ঠা ১৫০, মাকতাবাতুল মাআরিফ, প্রকাশকাল ১৪১২ হি.
৫৮ . শায়েখ মুকবিল ও খালিদ শাই‘, আলই‘লাম, পৃষ্ঠা ১৪-১৭, ১৯
৫৯. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৭
৬০. বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, হাদীসের মূল পাঠ هذه على صدره নয় বরং هذه على هذه। অর্থাৎ হুল্ব রা. ইশারা করে দেখিয়েছিলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিকে এটির ওপর রেখেছেন, অর্থাৎ ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখেছেন। বিষয়টি বিস্তারিত সামনে আসছে। তবে প্রথমে আমরা যেভাবে মুসনাদে আহমাদের মুদ্রিত কপিতে উদ্ধৃত হয়েছে, সে হিসেবে আলোচনা করব। তারপর মূল পাঠ সম্পর্কে আলোচনা করব।
৬১. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৯
৬২. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০২৩
৬৩. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০২৪, ২২০২৬
৬৪. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০৩৩
৬৫. তবারানী, আলমু‘জামুল কাবীর, হাদীস নং ১৭৮৭৭
৬৬. তবারানী, আলমু‘জামুল কাবীর, হাদীস নং ১৭৮৮১
৬৭. তবারানী, আলমু‘জামুল কাবীর, হাদীস নং ১৭৮৭৮
৬৮. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৮; সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং ১১০০
৬৯. দারা কুতনী, হাদীস নং ১১০০
৭০. বায়হাকী, হাদীস নং ৩৭৫৬
৭১. মুসান্নাফে আবদির রাযযাক, হাদীস নং ৩২০৭
৭২. মুখতাসারুল আহকাম (মুসতাখরাজুত তিরমিযী), আবু আলী আততূসী, হাদীস ২৩৪, খ. ২, পৃ. ৯৬
৭৩. আসারুস সুনান, নিমাবী, পৃষ্ঠা ১০৮
৭৪. আবু দাঊদ, মাসাইলুল ইমাম আহমাদ, পৃষ্ঠা ৪৮
৭৫. ইবনে আবদুল বার, আততামহীদ ২০/৭৫