জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৬   ||   ডিসেম্বর ২০২৪

সৃষ্টির বৈচিত্র্যে স্রষ্টার পরিচয়

মাওলানা মুহাম্মাদ আফজাল হুসাইন

বৈচিত্র্যময় আমাদের পৃথিবী। বিচিত্র সব সৃষ্টি দিয়ে নিপুণভাবে সাজানো এই বসুন্ধরা। আল্লাহর সৃষ্টিরাজির সর্বত্রই রয়েছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদ ও জড়জগৎ সবখানেই ছড়িয়ে আছে রূপ ও বর্ণের বিচিত্রতা। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন

وَ مَا ذَرَاَ لَكُمْ فِی الْاَرْضِ مُخْتَلِفًا اَلْوَانُهٗ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّذَّكَّرُوْنَ.

এমনিভাবে তিনি তোমাদের জন্য রংবেরঙের যে বস্তুরাজি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা তাঁর নির্দেশে কর্মরত আছে। নিশ্চয়ই যারা শিক্ষাগ্রহণ করে, সেইসব লোকের জন্য এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। সূরা নাহ্ল (১৬) : ১৩

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে

وَ مِنَ الْجِبَالِ جُدَدٌۢ بِیْضٌ وَّ حُمْرٌ مُّخْتَلِفٌ اَلْوَانُهَا وَ غَرَابِیْبُ سُوْدٌ.

আর পাহাড়ের মধ্যেও আছে বিচিত্র বর্ণের অংশ সাদা, লাল ও নিকষ কালো। সূরা ফাতির (৩৫) : ২৭

মানুষ ও প্রাণীজগতে বৈচিত্র্য

মানুষ আল্লাহ তাআলার অন্যতম বৈচিত্র্যময় এক সৃষ্টি। পৃথিবী সৃষ্টির পর অদ্যাবধি আল্লাহ তাআলা কত লক্ষ কোটি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। একই উপাদানে সৃষ্ট সকল মানুষ। তবুও রূপে-গুণে, আকারে-বৈশিষ্ট্যে একজন অপরজন থেকে কত ভিন্ন। সম্পূর্ণ অভিন্ন দুটি মানুষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিটি নবজাতকই কোনো না কোনো বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মে।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বাকশক্তি দান করেছেন। কিন্তু সুর-স্বর, বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণের বিচারে প্রত্যেকের কথার ধরন ভিন্ন্ন। আর ভাষারও যে কত রূপ-প্রকৃতি তা তো বলাই বাহুল্য। বর্তমান পৃথিবীতে কেবল রাষ্ট্রীয় ভাষাই আছে দুই শতাধিক। জানা না থাকলে এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার মানুষের কোনো কথাই বুঝতে পারে না। একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও অঞ্চলভেদে ভাষার কত বিস্তর পার্থক্য! এসব কিছু মহান সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র নিদর্শন! যার কুদরত অপরিসীম। তার পরেও কি মানুষ তাদের চিন্তাশক্তি কাজে লাগাবে না! উপদেশ গ্রহণ করবে না! আল্লাহ তাআলা বলেন

وَ مِنْ اٰیٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَ اَلْوَانِكُمْ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّلْعٰلِمِیْنَ.

তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জ্ঞানবানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন। সূরা রূম (৩০) : ২২

অন্যান্য জীব-জন্তুর মধ্যেও রয়েছে বর্ণ-বৈচিত্র্য। আল্লাহ তাআলা জলে-স্থলে কত শত আকৃতি ও প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন

وَ مِنَ النَّاسِ وَ الدَّوَآبِّ وَ الْاَنْعَامِ مُخْتَلِفٌ اَلْوَانُهٗ كَذٰلِكَ.

এবং মানুষ, পশু ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও আছে অনুরূপ বর্ণ-বৈচিত্র্য। সূরা ফাতির (৩৫) : ২৮

অন্যত্র ইরশাদ করেন

وَ مِنَ الْاَنْعَامِ حَمُوْلَةً وَّ فَرْشًا.

তিনি গবাদি পশুর মধ্যে (সৃষ্টি করেছেন) কিছু ভারবহনকারীরূপে আর কিছু খর্বাকৃতির। সূরা আনআম (৬) : ১৪২

মৌমাছি আল্লাহ তাআলার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। মৌমাছি বাগান-উদ্যান ও শস্যখেতে বিচরণ করে। সর্বত্র চষে বেড়িয়ে ফুল-ফল থেকে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করে। এর ফলে তার পেটে মধু সৃষ্টি হয়, যা মানুষের জন্য মহৌষধ। সে মধুও স্বাদে-বর্ণে কত রকম! ছোট্ট মৌমাছির পেটে কীভাবে তৈরি হয় এত ধরনের মধু! অসীম ক্ষমতাশীল ও প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তাআলা মৌমাছিকে এই অভাবনীয় শক্তি দিয়েছেন। কুরআন কারীমে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে

وَ اَوْحٰی رَبُّكَ اِلَی النَّحْلِ اَنِ اتَّخِذِیْ مِنَ الْجِبَالِ بُیُوْتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعْرِشُوْنَ،   ثُمَّ كُلِیْ مِنْ كُلِّ الثَّمَرٰتِ فَاسْلُكِیْ سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا یَخْرُجُ مِنْۢ بُطُوْنِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ اَلْوَانُهٗ فِیْهِ شِفَآءٌ لِّلنَّاسِ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّتَفَكَّرُوْنَ.

আর আপনার প্রতিপালক মৌমাছিকে আদেশ করেছেন, তুমি ঘর তৈরি কর পাহাড়-পর্বতে, গাছে এবং মানুষ যে মাচান তৈরি করে তাতে। তারপর সব রকম ফল থেকে নিজ খাদ্য আহরণ কর। তারপর চল আপন রবের উম্মুক্ত-বাধাহীন পথসমূহে। তার পেট থেকে বের হয় নানা রঙের পানীয়, যাতে আছে মানুষের জন্য রোগমুক্তি। নিশ্চয়ই এসবের মধ্যে নিদর্শন আছে সেই সকল লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। সূরা নাহ্ল (১৬) : ৬৮-৬৯

উদ্ভিদজগতের বৈচিত্র্য

মহান আল্লাহর সৃষ্ট উদ্ভিদজগতেও রয়েছে বিচিত্র সমাহার। ভূবনজুড়ে রকমারি গাছপালা, তরুলতা, ফল-ফলাদি, পুষ্পরাজি, শস্য ও ফসলাদি সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অনন্য ও বিস্ময়কর বৈচিত্র্য। এসবের কোনোটা মাচায় চড়ানো থাকে, কোনোটা মজবুত কাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে আর কিছু হল লতানো গাছ, যেগুলো মাটিতে ছড়িয়ে যায়।

তিনি সৃষ্টি করেছেন কত রকমের ফলমূল। প্রত্যেক প্রকার ফলের স্বাদ ও ঘ্রাণ যেমন ভিন্ন, উপকারিতাও একেক রকম। আবার ফুল বাগানে ও জঙ্গলে ফুটে থাকে কত হাজারো রকমের রঙবেরঙের ফুল। প্রতিটা ফুলের কী অপূর্ব ঘ্রাণ, মনমাতানো সৌরভ।

তিনি আমাদের জন্য কত শত প্রকারের শস্য ও সবজি সৃষ্টি করেছেন। সেগুলো খেয়ে আমাদের কত রকম উপকার হয়। সবগুলো একই পানি, একই মাটি ও বাতাস, একই আবহাওয়ায় উৎপন্ন; তবুও প্রতিটির মধ্যে কত বিস্তর পার্থক্য। আল্লাহ তাআলা চান, বান্দা যেন সৃষ্টিকূলের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করে সৃষ্টিকর্তার যথাযথ পরিচয় লাভের চেষ্টা করে। তাই কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন

اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللهَ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخْرَجْنَا بِهٖ ثَمَرٰتٍ مُّخْتَلِفًا اَلْوَانُهَا.

তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। তারপর আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফল-ফলাদি উৎপন্ন করি। সূরা ফাতির (৩৫) : ২৭

অন্যত্র ইরশাদ করেন

وَ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْشَاَ جَنّٰتٍ مَّعْرُوْشٰتٍ وَّ غَیْرَ مَعْرُوْشٰتٍ وَّ النَّخْلَ وَ الزَّرْعَ مُخْتَلِفًا اُكُلُهٗ وَ الزَّیْتُوْنَ وَ الرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَّ غَیْرَ مُتَشَابِهٍ.

আল্লাহ তিনি, যিনি উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন, (যার মধ্যে) কতক (লতাযুক্ত, যা) মাচা আশ্রিত এবং কতক মাচা আশ্রিত নয়। এবং (সৃষ্টি করেছেন) খেজুর গাছ, বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য, যায়তুন ও আনার, যা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ এবং সাদৃশ্যবিহীনও। সূরা আনআম (৬) : ১৪১

দিবা-রাত্রির পরিবর্তন

নিকষ কালো রাতের অবসান হলে ভোরের উদয় হয়। সকালের হৃদয় জুড়ানো স্নিগ্ধ কোমল আলো-হাওয়া পুরো জগতে সৃষ্টি করে এক কর্মচাঞ্চল্য। ধীরে ধীরে সূর্য কিরণ ছড়াতে থাকে। দিনভর আলোকজ্জ্বল চারপাশ। তারপরে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। দিনের শেষ ভাগে প্রকৃতি আবার হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম। সন্ধ্যা নেমে আসে, আঁধার ছেয়ে যায়, পুনরায় রাতের আগমন হয়। দিবারাত্রির এই অল্প সময়ের মধ্যে কত পরিবর্তন, কত বৈচিত্র্য। আবার বছর জুড়ে ঋতুর কত বিবর্তন। প্রকৃতিতে কী অপরূপ নৈপুণ্যের ছোঁয়া। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর কুদরতের অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে রেখেছেন প্রকৃতির পরতে পরতে। বান্দাকে কতভাবে তা দেখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন

وَاخْتِلَافِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَاۤ أَنْزَلَ اللهُ مِنَ السَّمَآءِ مِنْ رِّزْقٍ فَأَحْيَا بِهِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَتَصْرِيْفِ الرِّيٰحِ ا ٰيٰتٌ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ.

(তাছাড়া) রাত-দিনের পরিবর্তনের মধ্যে, আল্লাহ আকাশ থেকে জীবিকার যে মাধ্যম অবতীর্ণ করেছেন, তারপর তা দ্বারা ভূমিকে তার মৃত্যুর পর নতুন জীবন দান করেছেন, তার মধ্যে এবং বায়ু পরিবর্তনের মধ্যে বহু নিদর্শন আছে সেইসব লোকের জন্য, যারা বোধশক্তিকে কাজে লাগায়। সূরা জাছিয়া (৪৫) : ৫

অন্যত্র ইরশাদ করেন

اِنَّ فِیْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الَّیْلِ وَ النَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ.

নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে ও রাতদিনের পালাক্রমে আগমনে বহু নিদর্শন আছে বুদ্ধিমানদের জন্য। সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০

সুতরাং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হল, সৃষ্টির বিচিত্র-বিস্ময় দেখে স্রষ্টার যথাযথ পরিচয় লাভের চেষ্টা করা। ঈমানকে মজবুত করে তোলা। সৃষ্টিকর্তার নিআমতরাজি দেখে তাঁর ক্ষমতা ও মহত্বের আশ্রয় গ্রহণ করা। আর সর্বোপরি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর সকল বিধিবিধান পরিপূর্ণরূপে পালনে যত্নবান হওয়া। 

 

 

advertisement