ওজনে হেরফের ॥
আমি কি আল্লাহর সামনে দাঁড়াব না?
কুরআন কারীমের ৮৩ নম্বর সূরার নাম ‘সূরা মুতাফ্ফিফীন’। এর আরেকটি নাম ‘সূরা তাতফীফ’। এ সূরার প্রথম নয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কুরআন কারীমের শাশ্বত শৈলীতে—
وَیْلٌ لِّلْمُطَفِّفِیْنَ، الَّذِیْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَی النَّاسِ یَسْتَوْفُوْنَ، وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَ، اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓىِٕكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ، لِیَوْمٍ عَظِیْمٍ، یَّوْمَ یَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ، كَلَّاۤ اِنَّ كِتٰبَ الْفُجَّارِ لَفِیْ سِجِّیْنٍ، وَ مَاۤ اَدْرٰىكَ مَا سِجِّیْنٌ، كِتٰبٌ مَّرْقُوْمٌ.
দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়, আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়।
তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে এক মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে?
কখনো এটা সমীচীন নয়। নিশ্চয়ই পাপিষ্ঠদের আমলনামা আছে সিজ্জীনে।
তুমি কি জানো, ‘সিজ্জীন’ (-এ রক্ষিত আমলনামা) কী?
তা এক লিপিবদ্ধ দফতর। —সূরা তাতফীফ (৮৩) : ১-৯
নবী শুআইব আ. ও তাঁর জাতির ঘটনা কুরআন কারীমের বিভিন্ন জায়গায় এসেছে। তাঁর জাতির চারিত্রিক কিছু দোষ বিভিন্নভাবে তুলে ধরে আমাদের সতর্ক করা হয়েছে। যার শীর্ষে রয়েছে ওজনে গরমিল ও হেরফের এবং অন্যের হক নষ্ট করা।
ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন, শুআইব আ.-কে যে জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে কুফরীর সঙ্গে আরেকটা বড় অপরাধ ছিল ওজনে হেরফের করার প্রবণতা। কারো থেকে কিছু কেনার সময় এমন পাত্র দিয়ে ওজন করত, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি আঁটে। বিক্রি করার সময় এমন পাত্র দিয়ে ওজন করত, যেখানে পরিমাণের চেয়ে কম আঁটে। তাদেরকে এহেন গর্হিত কাজ পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। (দ্র. তাফসীরে কুরতুবী ৯/৮৫)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
وَ اِلٰی مَدْیَنَ اَخَاهُمْ شُعَیْبًا قَالَ یٰقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَیْرُهٗ قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاَوْفُوا الْكَیْلَ وَ الْمِیْزَانَ وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْیَآءَهُمْ وَ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِ بَعْدَ اِصْلَاحِهَا ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ.
আর মাদ্ইয়ানবাসীদের কাছে তাদের ভাই শুআইবকে (পাঠালাম)। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবূদ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। সুতরাং মাপ ও ওজন ঠিকভাবে দেবে এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দেবে না আর দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর অশান্তি বিস্তার করবে না। এটাই তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর পথ, যদি তোমরা (আমার কথা) মেনে নাও। —সূরা আ‘রাফ (৭) : ৮৫
আরো ইরশাদ হয়েছে—
وَ یٰقَوْمِ اَوْفُوا الْمِكْیَالَ وَ الْمِیْزَانَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْیَآءَهُمْ وَ لَا تَعْثَوْا فِی الْاَرْضِ مُفْسِدِیْنَ.
হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা পরিমাণ ও ওজন ন্যায়সঙ্গতভাবে পূর্ণ করবে। মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দেবে না এবং পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে বেড়াবে না। —সূরা হূদ (১১) : ৮৫
উল্লিখিত আয়াতসমূহে মানুষের হক সম্পর্কিত বহু বিষয়ের বিধান ছোট একটি বাক্যে বলে দেওয়া হয়েছে। ‘মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দেবে না।’
অথচ আমরা দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে কতভাবে মানুষকে তাদের প্রাপ্য থেকে কম দিয়ে থাকি। কখনো দাঁড়িপাল্লা বা পরিমাপযন্ত্রে বিশেষ কৌশল খাটিয়ে ওজনে কম দিয়ে, কখনো পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে বা পণ্যের দোষ গোপন করে, কখনো কমদামি পণ্য বেশি দামে বিক্রি করে, আরো কতশত উপায়ে। এ সবই ‘আকলুল মাল বিল বাতিল’ তথা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাসের শামিল।
ওজন ও পরিমাপে ঠকানো বা কম দেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম দাঁড়িপাল্লা বা মাপযন্ত্র সঠিক না হওয়া বা না রাখা। ফলে আল্লাহ তাআলা সঠিকভাবে পরিমাপের নির্দেশের সাথে সাথে সঠিক মাপযন্ত্র ব্যবহারের প্রতিও স্বতন্ত্রভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
اَوْفُوا الْكَیْلَ وَ لَا تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُخْسِرِیْنَ، وَزِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِیْمِ، وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْیَآءَهُمْ وَ لَا تَعْثَوْا فِی الْاَرْضِ مُفْسِدِیْنَ.
তোমরা মাপে পুরোপুরি দিয়ো। যারা মাপে ঘাটতি করে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। ওজন করো সঠিক দাঁড়িপাল্লায়। মানুষকে তাদের মালামাল কমিয়ে দিয়ো না এবং যমীনে অশান্তি বিস্তার করে বেড়িয়ো না। —সূরা শুআরা (২৬২৬) : ১৮১-১৮৩
আরো ইরশাদ হয়েছে—
وَ اَوْفُوا الْكَیْلَ اِذَا كِلْتُمْ وَ زِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِیْمِ، ذٰلِكَ خَیْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِیْلًا.
যখন পরিমাপ পাত্র দ্বারা কাউকে কিছু মেপে দাও, তখন পরিপূর্ণ মাপে দিয়ো আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট। —সূরা ইসরা (১৭) : ৩৫
সুতরাং সঠিক মাপযন্ত্রের প্রতি সবিশেষ নযর দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
অন্যান্য উম্মতের মতো শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতকেও আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে—
وَ اَقِیْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تُخْسِرُوا الْمِیْزَانَ.
আর তোমরা ইনসাফের সাথে ওজন ঠিক রাখ এবং পরিমাপে কম দিয়ো না। —সূরা আররাহমান (৫৫) : ৯
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে—
وَ اَوْفُوا الْكَیْلَ وَ الْمِیْزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا.
আর পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ানুগভাবে পরিপূর্ণ করবে। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেই না। —সূরা আনআম (৬) : ১৫২
ওজনে গরমিল করার পরিণতি বড় ভয়াবহ! আখেরাত তো বটেই; দুনিয়াতেও এর জন্য রয়েছে কঠিন বিপদ ও মসিবত! এই প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীসের অংশবিশেষ উল্লেখ করছি। বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—
وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ، إِلَّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ، وَشِدَّةِ الْمَؤُونَةِ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ.
যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কম দেয়, তখন তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ নেমে আসে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায় আর তাদের ওপর জালেম শাসক চাপিয়ে দেওয়া হয়। —সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪০১৯
এই পৃথিবীতে কেউ চিরকাল থাকবে না, থাকতে পারবেও না। মৃত্যুর পর দাঁড়াতে হবে আল্লাহর সামনে। ইচ্ছাকৃতভাবে ওজনে অণু পরিমাণ কম দিলেও তার হিসাব দিতে হবে। এ তো লাভ মনে করে নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া; যা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
আসুন, আল্লাহকে ভয় করি, ওজনে কম দেওয়াসহ মানুষের হক নষ্ট করার সকল পথ থেকে নিজেকে দূরে রাখি। আল্লাহ্ই তাওফীকদাতা।