জুমাদাল উলা ১৪৪৬   ||   নভেম্বর ২০২৪

ইলম ও আমলে নূরানিয়াত ও গভীরতা আনার চেষ্টা করি

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

সময়ই হল যিন্দেগীর رأس المال বা মূলধন। সময় যাচ্ছে মানে আমার যিন্দেগীও শেষ হচ্ছে। তাই আকলমান্দের কাজ হল সময়ের সঠিক মূল্যায়ন। শুধু সময়ের অপচয় থেকে বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয়, বরং আমাদেরকে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে এবং তার إثمارإنتاج -ও করতে হবে। আর তা হতে পারে নিম্নোক্ত পন্থাগুলো অবলম্বন করলে

১.  ইখলাস

যে কোনো কাজ আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার জন্য এবং কাজের মধ্যে নূর ও বরকত আনার জন্য প্রথম শর্তই হল নিয়ত সহীহ করা এবং নিজের মধ্যে ইখলাস পয়দা করা।

ইলম আল্লাহ তাআলার অতি গুরুত্বপূর্ণ মহা নিআমত। যাকে আল্লাহ তাআলা এ নিআমত দান করেন, তাকে তিনি বিশেষ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। এই ইলম কেবলই আল্লাহর জন্য; অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়। সুতরাং আমি ইলম অর্জন করব, যাতে আমি আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করতে পারি, তাঁর বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধ জানতে পারি, তাঁর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি বুঝতে পারি এবং সীরাতে মুস্তাকীমের ওপর থাকতে পারি।

আমি ইলম অর্জন করব; কারণ ইলমের দ্বারা আল্লাহ তাআলার কালাম ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বোঝার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। ইলমের মাধ্যমে নিজের ও অন্যের সব ধরনের জাহালাত ও মূর্খতা দূর করা যায়। কোন্টা হেদায়েত আর কোন্টা গোমরাহী তা পার্থক্য করা যায়। সর্বোপরি ইলম দ্বারা আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় দ্বীন ও শরীয়তের দাওয়াত এবং দ্বীনের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার কাজ আঞ্জাম দেওয়া যায়।

দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিলের চিন্তা যেন আমার মাথায় না থাকে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কঠিন ধমকি ও সতর্কবাণী রয়েছে।

অতএব একজন তালিবে ইলমের প্রথম কর্তব্য, নিজের মধ্যে ইখলাস পয়দা করা এবং নিয়ত সহীহ করা। সেইসঙ্গে নিয়তের তাজদীদ করতে থাকা। তাজদীদে নিয়তের একটি সহজ উপায় আমাদের মুরব্বিগণ বাতলে দিয়েছেন। উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) বলতেন, 'প্রতিদিন সকালে যখন কাজ শুরু করবে তখন নতুন করে নিয়ত বিশুদ্ধ করবে।' উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমও এই নসীহত করেছেন। ১৪৩০ ও ১৪৩১ হি.-এর বাংলাদেশ সফরে তিনি তালিবে ইলমদের খাস মজলিসে বলেছিলেন

'প্রতিটি দিনের শুরু এভাবে করুন যে, সকালে অতি বিনয় ও কাতরতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করবেন হে আল্লাহ! আপনি দয়া করে আমাকে আরো একটি দিন দান করেছেন।

হে আল্লাহ! এ দিনটিকে আপনার মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন।

হে আল্লাহ! আমি নিয়ত করেছি, এই দিনটি আপনার মর্জি মোতাবেক কাটাব; আপনার কোনো নাফরমানী করব না। হে আল্লাহ আপনি তাওফীক দান করুন।'

নিয়ত সহীহ রাখার জন্য আরেকটি বিষয় জরুরি। তা হল, এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো সর্বদা স্মরণে থাকা চাই। নিম্নে এ ধরনের কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল

জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

لَا تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ، وَلَا تُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ، وَلَا تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ، فَمَنْ فَعَلَ ذلِكَ فَالنَّارَ النَّارَ.

তোমরা ইলম এজন্য অর্জন করো না যে, এর মাধ্যমে তোমরা আলেমদের সাথে গর্ব করবে বা মূর্খদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে কিংবা মজলিসের অধিকর্তা হবে। যে এমন করবে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭৭

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِه وَجْهُ اللهِ، لَا يَتَعَلَّمُه إِلَّا لِيُصِيبَ بِه عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

যে ইলম দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়, সে ইলম যে ব্যক্তি পার্থিব কোনো উদ্দেশ্য লাভের আশায় অর্জন করবে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৪৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৬৪

আর ওই হাদীসটি তো খুবই প্রসিদ্ধ। তা হল, হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির বিচার করা হবে। তাদের একজন সম্পর্কে বলা হয়েছে

وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَه وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِه فَعَرَّفَه نِعَمَه فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُه وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِه فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِه حَتّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ.

আরেক ব্যক্তি, যে ইলম শিখেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিআমতসমূহের কথা তার সামনে তুলে ধরবেন এবং সে সবগুলো স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন, তুমি এতসব নিআমতের বিনিময়ে কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি আপনার জন্য ইলম শিখেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন পড়েছি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। বরং তুমি ইলম শিখেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয় এবং কুরআন পড়েছ, যাতে তোমাকে কারী বলা হয়। আর তোমাকে তো  দুনিয়াতে এরকম বলা হয়ে গেছে। তারপর আল্লাহ তাআলা ওর ব্যাপারে আদেশ করবেন; তখন তাকে চেহারা মাটিতে হেঁচড়িয়ে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৫

২. ইত্তিবায়ে সুন্নত

জীবনকে অর্থবহ ও বরকতপূর্ণ করতে ইত্তিবায়ে সুন্নতের বিকল্প নেই। সেজন্য ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাক এককথায় যিন্দেগীর সকল ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও আদর্শ কী তা জানা সকল মুসলমানের জন্য জরুরি।

এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মুতালাআর জন্য পড়া যেতে পারে হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ.-এর কিতাব

 اسوۂ رسول اکرم صلی الله علیہ وسلم এবং শায়েখ সালেহ আহমাদ শামী হাফিযাহুল্লাহর مِن مَعِينِ الشمائل

৩. ইহসান

হাদীসে জিবরীলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّه يَرَاكَ.

অর্থাৎ ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে নাও দেখ, তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮

নবীজীর এই ইরশাদের সারমর্ম হল, মুমিন যেন তার ইবাদতে (সেইসঙ্গে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে) আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে। সর্বাবস্থায় তার অন্তরে যেন এই কথা জাগ্রত থাকে যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন, শুনছেন এবং তার প্রতিটি কর্ম পর্যবেক্ষণ করছেন

وَ هُوَ مَعَكُمْ اَیْنَ مَا كُنْتُمْ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ.

তোমরা যেখানেই থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা যা-কিছুই কর, তিনি তা দেখেন। সূরা হাদীদ (৫৭) : ৪

৪. ইতকান

যে কোনো কাজ সুন্দরভাবে ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ সুন্নত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে

إِنَّ اللهَ يُحِبُّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلاً أَنْ يُتْقِنَه.

আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে, সে যেন তা নিখুঁতভাবে করে। মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪৩৮৬

সেজন্য একজন তালিবে ইলমের কর্তব্য, তার দৈনন্দিনের সমস্ত কাজ সুন্দরভাবে  করা। দরস, মুতালাআ, তাকরার, তামরীন, ইজরা, এমনিভাবে নিজের ও মাদরাসার সাফাই এবং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইন্তেযামী কাজ ও দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া। মনে রাখতে হবে, অলসতা, গুরুত্বহীনতা ও যেনতেনভাবে কাজ করা কোনো তালিবে ইলমের চরিত্র হতে পারে না।

৫. জিদ্দিয়্যাত ও নাশাত

মুমিনের যিন্দেগীতে জিদ্দিয়্যাত ও নাশাত অত্যন্ত জরুরি। মুমিনকে হতে হবে  جادّنشيطতার প্রতিটি কাজ হবে সুচিন্তিত ও উদ্দীপনাপূর্ণ।

জিদ্দ-এর বিপরীত হল হায্ল। হায্লের যিন্দেগী মানে যে যিন্দেগীতে কোনো ফিকির নেই, মুহাসাবা নেই, মুরাকাবা নেই। মাঝিবিহীন নৌকার মতো। চলছে তো চলছেই; কোনো লক্ষ্য নেই।

অর্থাৎ লাগামহীন যিন্দেগী। গাফলত ও উদাসীনতার যিন্দেগী।

কাজেই হায্লের যিন্দেগী পরিহার করতে হবে এবং জিদ্দিয়্যাত ও নাশাতের যিন্দেগী গ্রহণ করতে হবে। সবকিছুকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে এবং নিয়মিত হিসাব নিতে হবে আমি করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করছি কি না? আমার নামায, ইবাদত, তিলাওয়াত, দরস, তাকরার, তামরীন, মুতালাআ, খেদমত, আদব-আখলাক ইত্যাদি ঠিক আছে কি না? এরপর কেথায় কোথায় দুর্বলতা ও ত্রুটি আছে সেগুলো চিহ্নিত করে সংশোধন করতে হবে। প্রয়োজনে উস্তাযের সঙ্গে মশওয়ারা করতে হবে।

গাফলত ও উদাসীনতা অনেক বড় রোগ। এই রোগ মানুষকে একদম অথর্ব করে দেয়। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো এই দুআ বেশি বেশি পড়তে হবে

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ، وَالْكَسَلِ، وَالْجُبْنِ، وَالْبُخْلِ، وَالْهَرَمِ، وَعَذَابِ الْقَبْرِ.

اَللّٰهُمَّ آتِ نَفْسِيْ تَقْوَاهَا، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا.

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ، وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ، وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ، وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا.

সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২২

সকাল-সন্ধ্যায় এই দুআর ইহতিমাম করা

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ، وَقَهْرِ الرِّجَال.ِ

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৫৫

এগুলোর সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যার আরো যেসব দুআ রয়েছে সেগুলোর প্রতিও যত্নবান হওয়া।

هزل এর একটা খতরনাক দিক হল, শুধু শেখার জন্য শেখা এবং অর্জিত ইলমকে নিজের জিন্দেগীতে বাস্তবায়ন না করা। আমাদের আসলাফ ও আকাবিরের জিন্দেগী এমন ছিল না। হাসান বসরী (১১০ হি.) রাহ. বলেন

كَانَ الرَّجُلُ يَطْلُبُ العِلْمَ، فَلاَ يَلْبَثُ أَنْ يُرَى ذَلِكَ فِي تَخَشُّعِهِ، وَزُهْدِهِ، وَلِسَانِهِ، وَبَصَرِهِ.

অর্থাৎ পূর্বেকার মনীষীগণের অবস্থা ছিল, তাদের কেউ কোনো ইলম হাসিল করলে সঙ্গে সঙ্গে সেটির প্রভাব তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও চাহনিতে প্রকাশ পেত। সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, খ. ৪ পৃ. ৫৮৩

৬. হিলম ও আনাত

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশাজ্জ রা.-এর প্রশংসা করে বলেছেন

إِنَّ فِيكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ: الْحِلْمُ، وَالْأَنَاةُ.

তোমার মধ্যে দুটি গুণ আছে, যা আল্লাহর পছন্দ সহনশীলতা ও ধীরস্থিরতা। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭

তালিবে ইলমের মধ্যে এ দুটি গুণ থাকা অপরিহার্য। কারণ ইলম হাসিলের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল তাসাব্বুত। তাসাব্বুত অর্থ, যাচাই-বাছাই করে সঠিক বিষয় পর্যন্ত পৌঁছা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক বিষয়ের ওপর অবিচল থাকা। আর এর জন্য জরুরি হল ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা এবং ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে সঠিক বিষয় পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করা।

অস্থিরতা ও ত্বরাপ্রবণতা নিন্দনীয়। এই প্রবণতা যার মধ্যে থাকে, সাধারণত তার কাজে কোনো না কোনো অসঙ্গতি বা ভুল থেকেই যায়। তাই তালিবে ইলমকে এ বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে এবং হিল্ম ও আনাত এ দুটি গুণ হাসিল করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।

৭. ইনহিমাক

আলমু'জামুল ওয়াসীতে ইনহিমাক শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে

(اِنهَمَكَ) فلَانٌ فِي الْأَمر : جَدَّ وثَابَرَ فِيهِ برَغبةٍ وحِرصٍ.

অর্থাৎ আগ্রহ, উদ্দীপনা ও অনুরাগের সঙ্গে কোনো কাজে অনুক্ষণ ডুবে থাকা।

আর এর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হল, কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকা। একেই বলে ইনহিমাক।

অতএব ইনহিমাকের জন্য দুটি বিষয় জরুরি

১. কাজের প্রতি অন্তরে ভালবাসা ও আগ্রহ থাকা।

২. কাজে বা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন যে কোনো জিনিস থেকে বিরত থাকা।

যার মধ্যে ইনহিমাক থাকবে, সে-ই ইলমের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে এবং ইলমের বরকত সে-ই হাসিল করতে পারবে।

ইমাম বুখারী রাহ.-এর কাছে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির উপায় জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন

لاَ أَعْلَمُ شَيْئاً أَنْفَعَ لِلْحفظِ مِنْ نَهْمَةِ الرَّجُلِ، وَمُدَاومَةِ النَّظَرِ.

প্রচণ্ড আগ্রহ ও অখণ্ড অভিনিবেশের চেয়ে অধিক উপকারী কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, যাহাবী ১২/৪০৬

এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা রাহ.-কে জিজ্ঞেস করেছিল

بِمَ يُستعان على الفقه حتى يُحفظ؟

এমন কী উপায় আছে, যার মাধ্যমে ফিকহ হাসিল করা যাবে, এমনকি তা আত্মস্থ হয়ে যাবে?

তিনি বললেন

بِجَمْع الهَمِّ.

একাগ্রচিত্ত হওয়ার মাধ্যমে।

লোকটি বলল

وبِمَ يُستعان على جَمْع الهَمِّ؟

একাগ্রচিত্ত হওয়ার উপায় কী?

তিনি বললেন

بِحَذْفِ العَلائق.

বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মাধ্যমে।

সে বলল

وبِمَ يُستعان على حَذْفِ العَلائق؟

প্রতিবন্ধকতা দূর হবে কীভাবে?

তিনি বললেন

بِأخذِ الشيئِ عندَ الحاجة، ولا تَزِدْ.

কোনো কিছু কেবল প্রয়োজনের সময় গ্রহণ করবে, এর বেশি নয়। আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী, সায়মারী, পৃ. ২২

৮. ইলমের প্রতি অনির্বাণ তৃষ্ণা

ইমাম বুখারী রাহ. এটাকেই ব্যক্ত করেছেন نَهْمَة শব্দ দিয়ে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে

مَنْهُومَانِ لا يَشْبَعَانِ طَالِبُ عِلْمٍ وَطَالِبُ دُنْيَا.

দুই লোভাসক্ত কখনো তৃপ্ত হয় না ইলম অন্বেষী এবং দুনিয়া অন্বেষী। মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৪৮৮০; আলকামিল, ইবনে আদী ৭/৫৫৮

পার্থিব বিষয়ে অল্পেতুষ্টি কাম্য। পক্ষান্তরে ইলমের ক্ষেত্রে চাই অনির্বাণ তৃষ্ণা।  'তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়' কিতাবে এ সম্পর্কে একাধিক লেখা রয়েছে। আশাকরি তালিবে ইলম ভাইগণ কোনো এক অবসরে সেগুলো পুনরায় পড়ে নেবেন।

৯. আসাতিযায়ে কেরামের সোহবত থেকে শিক্ষাগ্রহণ

আরবীতে বলা হয় صُحبةٌ مُدرِكةٌঅর্থাৎ এমন সোহবত, যে সোহবতের মাধ্যমে শাগরিদ উস্তায থেকে দ্বীনের সমঝ, সহীহ ফিকির ও মেযাজ, আদব-আখলাক এবং ফন্নী যওক হাসিল করে।

এ বিষয়েও ইতিপূর্বে এ বিভাগে একাধিকবার লেখা হয়েছে। 'তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়' কিতাবেও এ বিষয়ক মাকালা রয়েছে।

১০. ইহতিসাব ও ইনাবাত

احتساب মানে আল্লাহর কাছে সওয়াবের প্রত্যাশা করা। আর إنابة মানে আল্লাহমুখী হওয়া। ইহতিসাব মানুষকে আল্লাহমুখী করে। ইহতিসাব না থাকলে উজ্ব ও আত্মতুষ্টি তৈরি হয়, যা মানুষকে আল্লাহ-বিমুখ করে দেয়; ফলে সে আল্লাহর রহমত ও নুসরত থেকে দূরে সরে যায়। সে জন্য আমাদের মেহনতও করতে হবে, আবার আল্লাহর দরবারে দুআ-ইস্তিগফার ও কান্নাকাটি-রোনাজারিও করতে হবে। অন্তরে আল্লাহর কাছে সওয়াবের প্রত্যাশা রাখতে হবে।

১১. তাকওয়া  ও তাহারাত

যিন্দেগীকে বরকতপূর্ণ করা ও বেবরকতী থেকে রক্ষা করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল তাকওয়া আল্লাহ তাআলার ভয়। তাকওয়া অবলম্বনের দ্বারা যিন্দেগী সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন

وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ اَمْرِهٖ یُسْرًا.

যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তার কাজ সহজে সমাধান করে দেন। সূরা তালাক (৬৫) : ৪

আরো বলেন

وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا، وَّ یَرْزُقْهُ مِنْ حَیْثُ لَا یَحْتَسِبُ وَ مَنْ یَّتَوَكَّلْ عَلَی اللهِ فَهُوَ حَسْبُهٗ اِنَّ اللهَ بَالِغُ اَمْرِهٖ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَیْءٍ قَدْرًا.

যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দেবেন, যা তার ধারণারও বাইরে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, আল্লাহ্ই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কাজ পূরণ করবেনই। আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।

সূরা তালাক (৬৫) : ২-৩

তালিবে ইলমের জন্য তো তাকওয়া ও খোদাভীতি অত্যন্ত জরুরি। কারণ তার ইলম ও মেহনতে বরকতই হবে না, যদি সে গুনাহ থেকে না বাঁচে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকে।

ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (১৯৭ হি.) রাহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ, তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। একবার ইমাম আলী ইবনে খাশরাম (২৫৭ হি.) রাহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হিফযশক্তি বৃদ্ধির কোনো ওষুধ আছে কি না? তিনি বললেন

إِنْ عَلَّمْتُكَ الدَّوَاءَ، اسْتَعْمَلتَه؟

আমি যদি তোমাকে হিফযশক্তি বৃদ্ধির ওষুধ শিখিয়ে দিই, তুমি কি তা ব্যবহার করবে?

তিনি বললেন

إِيْ وَاللهِ.

আল্লাহর কসম, অবশ্যই!

তখন ওয়াকী রাহ. বললেন

تَرْكُ المَعَاصِي، مَا جَرَّبْتُ مِثْلَه لِلْحِفْظِ.

সেই ওষুধ হল, গুনাহ বর্জন। আমার অভিজ্ঞতায় হিফযশক্তির জন্য এর মতো কার্যকরী কোনো কিছু নেই। সিয়ারু আ'লামিন নুবালা ৯/১৫১

গুনাহের কারণে ইলমের নূর শেষ হয়ে যায়। ইমাম মালেক রাহ. তাঁর শাগরিদ ইমাম শাফেয়ী রাহ.-কে নসীহত করেছিলেন

إنّ الله عز وجل قد أَلْقَى على قلبك نورًا، فلا تُطْفئه بالمعصية.

আল্লাহ তাআলা তোমার অন্তরে আলো দান করেছেন। তুমি গুনাহ করে সেটাকে নিভিয়ে দিয়ো না। মানাকিবুশ শাফেয়ী, বায়হাকী, পৃ. ১০৪

অতএব আমাদেরকে সবধরনের গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে। বিশেষত চোখের গুনাহ, কানের গুনাহ ও যবানের গুনাহের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা-ইস্তিগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। কারণ তওবাবিহীন হালতে বারবার গুনাহ করতে থাকা বরবাদীর কারণ। তাই কোনো গুনাহের ক্ষেত্রে যদি এমন অবস্থা হয় যে, সেটা থেকে নিজে নিজে বেঁচে থাকা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই নিজের উস্তাযের সঙ্গে পরামর্শ করবে। সমস্যা নিজের ভেতরে রেখে বসে থাকবে না; এতে সমস্যা আরো বড় আকার ধারণ করে।

তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা জাওয়াল থেকে নিজেদের দূরে রাখুন।

দেখুন, জাওয়ালের একটা খারাবি তো হল, এর দ্বারা চোখ ও কানের গুনাহসহ বিভিন্ন ধরনের গুনাহ হয়। তালেবে ইলমদের ইনহিমাক ও তলবে ইলমের মাদ্দাহ নষ্ট হয়। তবে এর আরেকটা বড় খারাবি হল, এর দ্বারা খেয়ানতদারি এবং মাদরাসার সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের গুনাহ হয়। আমার জানামতে, সব মাদরাসাতেই তালিবে ইলমদের জন্য জাওয়াল ব্যবহার নির্ষিদ্ধ। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছাত্ররা এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েই দাখেলা নেয় যে, তারা জাওয়াল ব্যবহার করবে না। কিন্তু এর পরও যদি কোনো ছাত্র মাদরাসায় জাওয়াল ব্যবহার করে হোক সেটা সাধারণ জাওয়াল তাহলে নিঃসন্দেহে সে  খেয়ানতদারিতে লিপ্ত হল এবং মাদরাসার সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করল। সুতরাং একথা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে, আমি তো জাওয়ালে গুনাহের কিছু করি না। কারণ মাদরাসায় বেআইনীভাবে জাওয়াল রাখাটাই একটা অপরাধ ও গুনাহ। আর এই গুনাহে একজন ভাবলেশহীনভাবে লিপ্ত থাকবে আর তার ইলম ও আমল এবং সময় ও মেহনতেও বরকত হতে থাকবে এমনটা ভাবা ভুল। তাই তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজেদের হাতে নিজেদের যিন্দেগীর বরকত নষ্ট করবেন না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমাদের সকল কাজে রহমত ও বরকত নাযিল করুন। আমাদের সকল কাজে নূরানিয়াত ও গভীরতা দান করুন এবং উপরের  বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

১১-০৩-১৪৪৬ হি.

 

 

advertisement