দ্বীনদার মুসলিমের পথে যত বাধা
এ মুসলিমপ্রধান দেশে তার সংস্কার হবে কি?
নতুন বাংলাদেশে, নতুন প্রেক্ষাপটে চারিদিকে সংস্কার সংস্কার রব। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি থেকে নির্বাচনব্যবস্থা, শিক্ষানীতি থেকে সংস্কৃতি, ব্যবসানীতি থেকে বাজারব্যবস্থা ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই বইছে সংস্কারের হাওয়া।
মুসলিমপ্রধান দেশে সংস্কারের এ যাত্রায় দ্বীনদার মুসলিম হিসেবে চলতে পথের যত বাধা তার সংস্কার হবে কি?
এক্ষেত্রে কিছু বিষয় তো এমন, যা ফ্যাসিবাদের দোসর ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার শ্রেণি কর্তৃক আরোপিত ছিল এবং কিছু বিষয় স্বৈরাচারের স্বার্থে ইচ্ছাকৃত তৈরি করা হয়েছিল; যাতে দ্বীনদার শ্রেণি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কিছু বিষয় এমন ছিল ও আছে, যা এদেশের সিস্টেমগত সমস্যা। প্রথম প্রকার তো সরকারের সদিচ্ছার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব; কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার সংস্কার ছাড়া দূর করা সম্ভব নয়। উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকরি দৃষ্টি দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সংস্কার কাম্য।
এর প্রয়োজনীয়তা যথাযথ অনুভব করতে আমাদেরকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে স্বৈরাচারের বিগত ১৫ বছরে; এদেশে একজন দ্বীনদার মুসলিম হিসেবে চলতে বিগত দিনগুলোতে কত বাধারই না সম্মুখীন হতে হয়েছে! শিক্ষা ও সংস্কৃতি, অর্থ ও অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও রাজনীতি, আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, দ্বীনী উদ্যোগ ও কর্মশালা, পোশাক ও ধর্মীয় বেশভূষা, হিজাব ও পর্দা ইত্যাদি কত ক্ষেত্রেই না কত রকম বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়েছে মুসলিমের জীবনে। মুসলিমপ্রধান দেশে কত প্রকার বৈষম্যেরই না শিকার হয়েছেন মুসলিমেরা। তাই তো বলতে হয়, 'সংখ্যালঘু' বলে যে একটা শব্দ আছে, বাস্তব অর্থে তা কি এদেশে বসবাসরত স্বল্পসংখ্যক অমুসলিমের জন্য প্রযোজ্য ছিল, নাকি সংখ্যাগুরু মুসলিমদের জন্য!
শেষের কথাটি কারো কাছে অতিরঞ্জন মনে হতে পারে; কিন্তু বিগত ১৫ বছরের প্রতি যদি দৃষ্টি দেওয়া হয় এবং ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা এবং সামাজিক পরিবেশের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলেই সে বিষয়টি যথাযথ উপলব্ধি করতে পারবে; কতটা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছিল দ্বীনদার মুসলিমের পথচলা এবং কতটা বাধার সম্মুখীন হয়েছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম। অপরদিকে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ-বিরোধী ভিনধর্মী বা ইসলামবিদ্বেষীদের কর্মকাণ্ডকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাপোর্ট ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল।
একজন দ্বীনদার মুসলিমকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন তথা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলতে সর্বদা ইতস্তত থাকতে হয়েছে। দ্বীনী ভূষণ গ্রহণ এমনকি আমল-ইবাদতও করতে হয়েছে সংকুচিত হয়ে। না জানি কোন্ ট্যাগ লেগে যায়, কোন্ ঝামেলায় পড়তে হয়। দাড়ি-টুপি ও মসজিদে গমনের ভিত্তিতে বৈষম্য ও শোষণের শিকার হতে হয়েছে। এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি কর্তৃক 'জঙ্গি' ট্যাগ দেওয়া হয়েছে কোনো কোনো বাহিনীর দ্বীনদার শ্রেণিকে। ফলে তাদের পেছনে গোয়েন্দা নজরদারিও করা হয়েছে।
তরুণ-তরুণীরা নিজেদের দ্বীনী উন্নতি নিয়ে সন্ত্রস্ত থেকেছে। কেউবা হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এমনকি এই মুসলিমপ্রধান দেশে সন্তানের দ্বীনী উন্নতি দেখে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে মা-বাবা চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়েছেন; না জানি বুকের ধন কোন্ বিপদে পড়ে। এক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার-নাস্তিকদের সাথে সাথে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বৈষম্যবাদী ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়াগুলো। বরং শীর্ষস্থানীয় কিছু মিডিয়া এ কাজে ছিল এক কাঠি সরেস। এভাবে একজন দ্বীনদার মুসলিমের পথচলাকে করা হয়েছিল সতত ইতস্তত ও সংকুচিত।
ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দ্বীনদার মুসলিমগণ কেমন বৈষম্য, হেনস্তা ও জুলুম-নিপীড়নের শিকার ছিলেন– নিচের সংবাদগুলো থেকে তা কিছুটা আঁচ করা যায়–
এক.
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) দুই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ধর্মীয় পোশাকের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হেনস্তার অভিযোগে স্থায়ী অব্যাহতির দাবি জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
...নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৫ তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, ...একজন শিক্ষার্থীকে ভাইভা বোর্ডে ফেইল করে দিয়েছেন হিজাব না খোলার কারণে। ...স্যার আমাদের অনেক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে হিজাব পরে আসার কারণে হেনস্তা করেছেন। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন।
এছাড়া এই দুইজন অধ্যাপক ধর্মীয় পোশাকের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করেছেন।” [দৈনিক ইত্তেফাক (অনলাইন), ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সংবাদ র্শিরোনাম : ঢাবির আইইআর এর ২ অধ্যাপকের অব্যাহতির দাবি শিক্ষার্থীদের]
দুই.
“ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) পোশাক পরার বিষয়ে কথিত নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হাঙ্গামার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এম আলিমুল্লাহ মিয়া অভিযোগ করেছেন যে, উগ্র জঙ্গিবাদীরাই এ জন্য দায়ী। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধেও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনেন।...
...আইইউবিএটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পায়জামা-পাঞ্জাবি, বোরকার মতো পোশাক পরে আসায় বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে দুই শতাধিক ব্যক্তি বিক্ষোভ করছিলেন।
...পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে আইইউবিএটি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তরার ডিসি বিধান ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্থানীয় ব্যক্তিদের একাংশের একটি বিরোধ রয়েছে। তবে আইইউবিএটির এক শিক্ষক তাঁদের এক ছাত্রীর হিজাব খুলে ফেলেছেন এমন অভিযোগও পুলিশের কাছে এসেছে। পাঞ্জাবি পরায় বাধা দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ করে এখানকার ২০০ শিক্ষার্থী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন।
(প্রতিবাদকারীদের ভিসি জঙ্গি বলেছেন; এ প্রেক্ষিতে–) ডিসি বিধান ত্রিপুরা আরও বলেন, যাঁদের জড়িত থাকার কথা বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।” [দৈনিক প্রথম আলো (অনলাইন), ০২ ডিসেম্বর ২০১৫, সংবাদ র্শিরোনাম : আইইউবিএটিতে পোশাক বিতর্ক]
তিন.
“সম্প্রতি দেশের ১৫টি জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বোরকা পরায় হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে।
...বোরকা বা হিজাব পরায় হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠা ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ১. নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ... উচ্চ বিদ্যালয় ২. সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ... উচ্চ বিদ্যালয়... (১৫টি বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে)।
...এদিকে রিট আবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এমন ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়।” [দৈনিক সময়ের আলো (অনলাইন), ৩ জুন ২০২২, শিরোনাম : আইনজ্ঞদের অভিমত : পোশাকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ফৌজদারি অপরাধ]
এ হল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আমলে দ্বীনদার মুসলিমের হেনস্তা ও নিপীড়নের হাজারো ঘটনার দু-একটি। এভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিস-আদালতে, প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীতে দ্বীন পালনের কারণে বৈষম্য ও নিগ্রহের শিকার হন দ্বীনদার মুসলিমগণ। একারণে মুসলিমপ্রধান এ দেশে মুসলিম পরিচয় হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আওয়ামী সরকারের গত ১৫ বছর যেন আমরা ফেদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ.-এর ঐ কথারই বাস্তব রূপ প্রত্যক্ষ করলাম, যা তিনি ১৯৯৬-এর নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের এক সফরে বলেছিলেন। উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ.-এর জীবনীতে লেখেন–
'হযরত (মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ.) এটাও শুনিয়েছিলেন যে, ১৯৯৬ ঈ.-এর নির্বাচনের আগে কোনো একদিন গুলশানের এক বাড়িতে ফেদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ.-এর সঙ্গে হযরত মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রাহ., হযরত মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রাহ. ও হযরত রাহ. নিজেও ছিলেন। তখন হযরত ফেদায়ে মিল্লাত এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন–
اگر عوامي ليگ اقتدار پر آئے تو يہاں کے مسلمانوں کا ديني تشخص ختم ہو جائے گا۔
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয় চূড়ান্ত হুমকির সম্মুখীন হবে।' (মাসিক আলকাউসার, জানুয়ারি ২০২১, পৃ. ০৫)
হাঁ, এই পনেরো বছর মুসলিম পরিচয় ভুলিয়ে দেওয়ার এবং মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া আগামী প্রজন্মকে ইসলাম-বিমুখ সেক্যুলারে রূপান্তরের সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। মুসলিম মানস গঠনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম মানস গঠনে যেখানে সবচে বড় ইতিবাচক ভূমিকা থাকে শিক্ষাব্যবস্থার, সেখানে একেই হাতিয়ার বানানো হয়েছিল তা ধ্বংস করার। শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে হওয়ার কথা ছিল ঈমানের পাহারাদার ও রক্ষক সেখানে একেই করা হয়েছিল ঈমান-ধ্বংসী রাসায়নিক বিষ-বোমা।
সবচেয়ে বড় কথা হল, ঈমানদার, আল্লাহ-বিশ্বাসী মুসলিম শিক্ষার্থীরা কী পড়বে– তা নির্ধারণ ও প্রণয়ন করবে ঈমানবিরোধী, ইসলামবিদ্বেষীরা। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থার এহেন দশার কারণে দ্বীনদার মুসলিমকে শতবার ভাবতে হয়েছে, দ্বিধান্বিত হতে হয়েছে– সন্তানকে এ সেক্যুলার দ্বীনবিমুখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাবে কি না! এর সাথে আগে থেকে চেপে থাকা সহশিক্ষাব্যবস্থার কারণে সন্তানের পবিত্র ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিটি দ্বীনদার মুসলিমই উদ্বিগ্ন।
শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম শিক্ষার অবস্থা নিয়ে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে প্রথমেই এর সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে বলতে হয়। ইসলাম শিক্ষার জন্য প্রতিদিন একটি ঘণ্টা ও ক্লাস বরাদ্দ থাকলেও এখান থেকে শিক্ষার্থীদের অর্জন সামান্যই বলতে হয়। প্রয়োজন তো ছিল ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী আলেমদের মাধ্যমে এমন সিলেবাস প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী আকীদা-বিশ্বাস থেকে নিয়ে আমল-ইবাদত, হালাল-হারাম, আচার-আখলাক তথা দ্বীনী জীবনের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক ফরয ইলম অর্জন করতে পারবে। উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নাস্তিকতা থেকে নিয়ে ঈমান হেফাজতের জন্য সমসাময়িক ফেতনা সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হল, ইসলাম শিক্ষার সিলেবাস বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে করা হয় না; এমনকি ভ্রান্ত মতবাদের মানুষকেও বসিয়ে দেওয়া হয় ইসলাম শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বা সম্পাদনায়। সিলেবাসও তেমন সুপরিকল্পিত ও সমৃদ্ধ নয়, আবার যতটুকুই আছে, নিছক একটি সাবজেক্ট হিসেবে দায়সারাভাবে পড়া-পড়ানো হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী দ্বীনী জ্ঞানের একেবারে শিশু স্তর কুরআন শুদ্ধ করে পড়াও শিখতে পারছে না এ ব্যবস্থা থেকে। কেবল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলা উচ্চারণে সূরা মুখস্থ করছে। ইসলাম শিক্ষার ক্লাস থেকে তারা ইসলাম শিখতে পারছে না; ফলে ইসলাম সম্পর্কে খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকৃত ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের মুসলিম শিক্ষার্থীরা।
আর যিনি ইসলাম শিক্ষা সাবজেক্ট পড়ান, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তিনি আলেম তো ননই, ধর্মীয় তেমন জ্ঞানও রাখেন না; দাড়ি-টুপি থাকাতে তাকে এই সাবজেক্ট পড়াতে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে হিন্দু শিক্ষকও ইসলাম শিক্ষা পড়ান বলে মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে।
এখন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা যদি এসকল বিষয়ের প্রতি মনোযোগ না দিই, এখনো যদি শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলারদের হাতেই থাকে, শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বীন-ঈমানের ক্ষতিসাধনকারী বিষয়গুলো যদি এখনো বহাল থাকে, তাহলে আমাদের স্বাধীনতারই বা কী অর্থ থাকে, রক্তদানেরই কী মূল্য থাকে!
মিডিয়ার বৈষম্যের বিষয়ে যদি বলি, তাহলে বলতে হয়, ইসলাম ও দ্বীনদার মুসলিমদের প্রতি যত ধরনের বৈষম্যের বিষয় ঘটেছে, এর সবচেয়ে উপরে অবস্থান করছে মিডিয়ার বৈষম্য। বিগত ১৫ বছরে তা 'অনন্য উচ্চতায়' পৌঁছেছে। যে কোনো মুসলিম স্বার্থকে কোনো না কোনোভাবে নেতিবাচক ভঙ্গিতে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে কিছু দালাল মিডিয়া। অপরদিকে মুসলিম ও ইসলাম-বিদ্বেষীদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। মুসলিম স্বার্থকে আঘাত করা যায়– এমন সামান্য বিষয়কে তিল থেকে তাল বানিয়ে পেশ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ প্রচারসংখ্যার দাবিদার দৈনিকটি তো মুসলিম স্বার্থকে আঘাত করা যায় বা ইসলামের বদনাম করা যায়– এমন সামান্য বিষয় নিয়েও সিরিজ প্রতিবেদন করেছে এবং এখনো সে পথেই হাঁটছে। 'গুজব'-এর বাহানা করে ইসলামবিদ্বেষীদের কত বাস্তব অন্যায় ঘটনাকে উল্টিয়ে দিয়েছে। সিরিজ প্রতিবেদন করে করে দায়ীদের আড়াল করে ফেলেছে এবং প্রতিবাদকারী মুসলিমদের বানিয়ে ফেলেছে মূল আসামী। এমনভাবে প্রতিবেদন করে গেছে যে, বাস্তব অন্যায় ঘটনা চাপা পড়ে গেছে এবং 'অন্যায়ের প্রতিবাদ করা'কে মূল অন্যায় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি 'গুজব' বলে মূল অন্যায়কে ভ্যানিশ করে দেওয়া হয়েছে।
'ভালো'র সাথে থাকার দাবিদার পত্রিকাটির হলুদ সাংবাদিকতা ও বৈষম্যের সাম্প্রতিক উদাহরণ হল, ভারত কর্তৃক আরোপিত ২০২৪-এর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দুর্গতদের পাশে আলেম-দ্বীনদার শ্রেণির ভূমিকাকে ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া। সারা বাংলাদেশ থেকে আলেম-মুসল্লিগণ বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান। কোটি কোটি টাকার ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা। ১০০ কোটি টাকার ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেয় আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন; কোনো কোনো মিডিয়া এটা নিয়ে নিউজ করলেও তাদের কাছে এটা কোনো নিউজই নয়; কারণ এটা ইসলামপন্থিদের কাজ! নিউজ করলে তো ইসলামপন্থিদের ইমেজ বাড়বে, প্রভুরা অখুশি হবে এবং তাদের মিশন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অপরদিকে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী যে কোনো ইস্যু প্রমোট করা ও ব্যাপক প্রচার দেওয়ার ক্ষেত্রে এজাতীয় মিডিয়ার ভূমিকা কার অজানা। ইসলাম-বিরোধী সামান্য সামান্য ইস্যুও সিরিজ আকারে সামনে আনা হয়। তেমনি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তির বক্তব্যকেও খুব ফলাও করে প্রচার দেওয়া হয় এবং সে ব্যক্তিকেও এমনভাবে ফলাও করা হয়, যেন সে জাতির কর্র্ণধার। আর ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের কর্মপন্থা ঠিক এর উল্টো; বড় বড় বিষয়কে এমনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, যেন কিছু ঘটেইনি। কোনো সূত্রে তা সামনে আনলেও গুরুত্বহীনভাবে প্রকাশ করা হয়, কিংবা সাথে এমন মন্তব্যধর্মী বাক্য জুড়ে দেওয়া হয় যে, পজেটিভ প্রতিবেদন থেকেও পাঠক নেগেটিভ বার্তা পেয়ে যায়। তেমনি মুসলিমদের মুখপাত্র পর্যায়ের মনীষী ব্যক্তিদের জাতীয় পর্যায়ের বক্তব্যকেও কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এসকল বৈষম্য যদি আমরা দূর করতে না পারি, তাহলে কী অর্থ থাকে 'বৈষম্যবিরোধী অন্দোলন'-এর! কী অর্থ থাকে স্বাধীনতার!!
এ স্বাধীন নতুন বাংলাদেশে এখনো স্বৈরাচারের দোসর সেসকল হলুদ মিডিয়ার অন্যায় আস্ফালন দেখে দ্বীনদার মুসলিমশ্রেণি যারপরনাই চিন্তিত ও ব্যথিত।
ফ্যাসিবাদের আমলে প্রশাসন ও বিভিন্ন মিডিয়া কর্তৃক মুসলিমদের দ্বীনী কার্যকলাপকে সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে পদে পদে। আর দায়ীদের বিভিন্ন কার্যক্রমকেও জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এদেশে যেখানে খ্রিস্টান মিশনারী ও কাদিয়ানী সম্প্রদায় বিনা বাধায়, বরং প্রশাসনের সহযোগিতায় মুসলিমদের ঈমানহারা করার কার্যক্রম পরিচালিত করে যাচ্ছে; সেখানে সাধারণ মুসলিমদের ঈমানহারা হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য যেসকল দাঈ কাজ করছেন, তাদেরকে বিভিন্ন হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। কখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে, এর চেয়ে বেশি চিহ্নিত কিছু মিডিয়ার পক্ষ থেকে। জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে জেল-জুলুমের শিকার পর্যন্ত করা হয়েছে তাদেরকে।
স্বৈরাচারের আমলে মুসলিমদের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বাধা দেওয়া হয়েছে ওয়াজ-মাহফিলে; কোথাও অনুমতিই দেওয়া হয়নি আর অনুমতি দিলেও প্রতিটি এলাকার নেতাদের মাধ্যমে অঘোষিত সেন্সরশীপ চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে ভিনধর্মীদের বিতর্কিত সংগঠনগুলোকেও অবাধে ও উন্মুক্ত পরিবেশে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়া, প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উন্মূক্ত পূজা ও হোলির অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সীরাত মাহফিল, ইফতার মাহফিল, হামদ-নাত ও কুরআন তিলাওয়াতের অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি।
মুসলিমপ্রধান এদেশে দ্বীনদার মুসলিমের চলার পথে এমন আরো কত শত বাধা যে ছিল এবং রয়েছে, যার অপসারণ ও সংস্কার প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নয়, মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করা! ধর্ম পালনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এবং সকল প্রকার ধর্মীয় উদ্যোগের ক্ষেত্রে কার্যকরি সহায়তা করা এবং এক্ষেত্রে পথের যত বাধা তা অপসারণ করা!
সুতরাং আমরা আশা করব– দ্বীনদার মুসলিম হিসেবে চলতে পথের যত বাধা– হোক তা ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার কর্তৃক আরোপিত বা সিস্টেমগত– তার সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও পরবর্তী নির্বাচিত সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করবে। যাতে আগামী বাংলাদেশে দ্বীনী কোনো কার্যক্রম বা উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত না হয়; বরং সরকার, প্রশাসন ও মিডিয়ার সহায়তা লাভ করে। কোনো মুসলিমকে যেন ধর্মীয় কারণে বৈষম্য ও জুলুমের শিকার হতে না হয়। প্রতিটি মুসলিম যেন নির্বিঘ্নে দ্বীন-ঈমানের পথে অগ্রসর হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা যেন মুসলিম শিক্ষার্থীদের দ্বীন-ঈমানের রক্ষক হয়। মুসলিম বাবা-মা যেন নিশ্চিন্তে তাদের সন্তানকে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার হাওয়ালা করতে পারে; তাদেরকে যেন সন্তানের ঈমান ও চারিত্রিক অবক্ষয় নিয়ে শঙ্কিত থাকতে না হয়। শিক্ষকরূপী কোনো ইসলামবিদ্বেষীর পক্ষ থেকে যেন দ্বীনদার শিক্ষার্থীরা কোনো প্রকার বৈষম্য বা হেনস্তার শিকার না হয়। তারা যেন শিক্ষার্থীদের ঈমানহারা করতে না পারে, সেজন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠদান পদ্ধতিতে এবিষয়ক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পদক্ষেপ থাকা বাঞ্ছনীয়। তরুণ-তরুণীরা যেন দ্বীনী উন্নতির পথে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের আনুকূল্য ও সহযোগিতা লাভ করে। দ্বীনী লেবাস ও পর্দার ভূষণ যেন তাদের সম্মানের আসনে আসীন করে। একারণে যেন তাদের কোনো প্রকার হেনস্তা বা বৈষম্যের শিকার হতে না হয়। মিডিয়া যেন ইসলামবিদ্বেষীদের পৃষ্ঠপোষক না হয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের সকল দ্বীনী ও দাওয়াতী কার্যক্রমে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। মুসলিমরা যেন সকল প্রকার দ্বীনী মাহফিল ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পারে। মোটকথা, দ্বীনী কর্ম-উদ্যোগ যেন নির্বিঘ্ন ও সহযোগিতাপ্রাপ্ত হয়।
শিক্ষা কারিকুলাম থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইসলামবিরোধী বিষয়গুলো সরানো এবং দেশের মুসলমান নাগরিকদের জীবন-আচরণ ও ধর্মচর্চার পেছনের বাধাগুলো দূর করার জন্য আরো কী কী বিষয় সংস্কার করা প্রয়োজন সেসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের নির্ভরযোগ্য ও বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ নেবেন বলে আমরা আশা করি।
আল্লাহ এদেশের মুসলিমদের হেফাজত করুন। তাদেরকে পাক্কা মুসলিম ও সাচ্চা ঈমানদার হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে দিন ও সকল বাধা-বিপত্তি দূর করে দিন। ইসলাম ও মুসলিমের সকল প্রকার শত্রুদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিন। পরবর্তী প্রজন্মকে দ্বীন-ঈমানের ওপর অটল-অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন– আমীন।