জুমাদাল উলা ১৪৪৬   ||   নভেম্বর ২০২৪

আলজাজিরার প্রতিবেদন
সংগ্রামী বীর মুজাহিদ ইয়াহইয়া সিনওয়ার রাহ.
শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি

হামাসের প্রধান নেতা ইয়াহইয়া আসসিনওয়ার। জন্ম ১৯৬২। ইসরাইল বেশ কয়েকবার তাঁকে কারাবন্দি করেছে। ২০১১ সালে এক বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় মুক্তি দেওয়ার আগে মোট চারবার তাঁর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ইসরাইল। পরে তিনি (হামাসের সামরিক শাখা) ইযযুদ্দিন আলকাসসাম ব্রিগেডের সক্রিয় নেতৃত্বে ফিরে আসেন।

যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২১ সালে গাজা স্ট্রিপে হামাসের প্রধান নির্বাচিত হন। ইসরাইল তাঁর পূর্বসূরি ইসমাইল হানিয়াকে শহীদ করার পর ২০২৪ সালে সিনওয়ার হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান নির্বাচিত হন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর “তূফানুল আকস'' অপারেশনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ইসরাইল সিনওয়ারকেই গণ্য করে। যে অপারেশন তাদের জনশক্তি ও সামরিক উভয় খাতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ঘটিয়েছে। বিশ্ব দরবারে ইসরাইলের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর চিত্রকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছে। একারণে ইসরাইল ঘোষণা দিয়েছে, তূফানুল আকসার জবাবে গাজা স্ট্রিপে চালানো অপারেশন 'লৌহ তরবারি'র অন্যতম টার্গেট হচ্ছে ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে খতম করা।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

গাজা স্ট্রিপের দক্ষিণে অবস্থিত খান ইউনুস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াহইয়া ইব্রাহীম হাসান আসসিনওয়ার। দিনটি ছিল ১৯৬২ সালের ১৯ অক্টোবর। তাঁর পরিবার ছিল গাজার উত্তর পূর্বাঞ্চলের শহর মাজদালের। ১৯৪৮ সালে 'নাকবা'র পর শহরটি ইসরাইল দখল করে নেয়। এর নাম বদলে রাখে 'আশকালুন' (আসকালান)। তখন তাদের পরিবারকে মাজদাল থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

সিনওয়ার পড়াশোনা করেন খান ইউনুস মাধ্যমিক বালক স্কুলে। তারপর 'ইসলামিক ইউনিভার্সিটি গাজা'য় ভর্তি হন। সেখানে এরাবিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি কঠিন ও প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। ইসরাইলী দখলদার বাহিনী শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারীদের ওপর যে বিরামহীন নিপীড়ন চালাত, সময়ে সময়ে কঠোরতা আরোপ করত, সিনওয়ার শৈশবে এসব ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

২০১১ সালের ২১ নভেম্বর তিনি সামার মুহাম্মদ আবু যুমারকে বিয়ে করেন। তিনি গাজার অধিবাসী একজন নারী। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি গাজা থেকে উসূলে ফিকহের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। সিনওয়ারের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। তার নাম ইবরাহীম।

রাজনৈতিক কার্যক্রম

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ছাত্র সংগঠনে তার বিশেষ অংশগ্রহণ ছিল। তিনি ইসলামী ফ্রন্টের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এটি ছিল ফিলিস্তিনে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ছাত্র শাখা।

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি গাজার ছাত্র সংসদের 'আর্ট পরিষদ'-এ তারপর 'ক্রীড়া পরিষদ'-এ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর তিনি ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি হয়েছেন। পরে তিনি এই সংসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই 'ছাত্র এক্টিভিট' বিশেষ দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জনে তাকে বিশেষ সাহায্য করেছে। এর ফলে তিনি নেতৃত্বের যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৮৭ সালে 'পাথর বিপ্লব'-এর সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়া হামাসে নেতৃত্বমূলক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তার 'ছাত্র এক্টিভিটি'র ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

তিনি ১৯৮৬ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ আহমাদ ইয়াসীনের নির্দেশে, খালিদ হিন্দী ও রূহি মুশতাহার সাথে মিলে একটি নিরাপত্তা সেল গঠন করেন। যার নামকরণ করেন, 'মুনাযযামাতুল জিহাদ ওয়াদ দাওয়াহ'। সংক্ষেপে যাকে 'মাজদ' বলা হয়।

এই সংগঠনের কাজ ছিল ইসরাইলী দালাল ও গোয়েন্দাদের বের করা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাশাপাশি গোয়েন্দা অফিসার ও ইসরাইলী নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর খোঁজ খবর রাখা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই সংগঠনটি হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার 'ফার্স্ট নিউক্লিয়াস'-এ পরিণত হয়।

বারবার কারাবন্দি ও জেলজীবন

১৯৮২ সালে সিনওয়ার তার ছাত্র এক্টিভিটির কারণে প্রথমবার কারাবন্দি হন। তখন তার বয়স ছিল বিশ বছর। তখন (বিনা অভিযোগে) 'প্রশাসনিক আটক' ব্যবস্থায় তাকে চার মাস কারাবন্দি করে রাখা হয়। চার মাস পর মুক্তি লাভ করার এক সপ্তাহ পর আবার আটক করা হয়। কোনো বিচার ছাড়াই ছয় মাস কারাগারে বন্দি থাকেন। ১৯৮৫ সালে আবার গ্রেফতার করা হয়। তাকে আট মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি পুনরায় বন্দি করা হয়। এবার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ দিয়ে মামলা করা হয়। যেমন : অপহরণের নেতৃত্ব প্রদান, দুইজন ইসরাইলী সৈনিককে হত্যা এবং এমন চারজন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা, যাদের ব্যাপারে ধারণা করা হত, তারা ইসরাইলের সাথে সহযোগিতা করে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে চারবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। (যার সময়কাল দাঁড়ায় ৪২৬ বছর।)

কারাবন্দি থাকাকালে তিনি দুই টার্মে 'কারান্তরীণ হামাসের সদস্য বিষয়ক সর্বোচ্চ তেতৃত্ব পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ধারাবাহিক অনেকগুলো অনশনে তিনি জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ১৯৯২ সালের অনশন, ১৯৯৬ সালের অনশন, ২০০০ ও ২০০৪ সালের অনশন।

অনেকগুলো জেলে তিনি কারাজীবন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাজদাল, হাদারিম, সাবাআ ও নাফহা জেল। জেলজীবনে তাকে চার বছর নির্জন কারাবাসে কাটাতে হয়েছে। এসময় তিনি পাকস্থলীতে নানারকম ব্যথায় আক্রান্ত হন। কারাগারের নিঃসঙ্গ জীবনে একসময় তিনি রক্ত বমি করা শুরু করেন।

জেল থেকে দুইবার পালানোর চেষ্টা করেন- প্রথমবার; যখন তিনি আসকালানের মাজদাল জেলে ছিলেন। দ্বিতীয়বার পালাতে চেষ্টা করেন রামলা (রামাল্লা) জেল থেকে। তবে তার চেষ্টাগুলো সফল হয়নি।

মাজদাল জেলে সিনওয়ার সেলের দেয়ালে একটি গর্ত খুঁড়তে সক্ষম হয়েছিলেন ছোট একটি লোহার করাত ও তারের সাহায্যে। দেয়ালের বাইরের আবরণটুকু শুধু বাকি ছিল। সে সময় আবরণটুকু খসে পড়ে যায়। এভাবে তার পলায়ন চেষ্টা ধরা পড়ে যায়। এর শাস্তি হিসেবে তাকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়।

রামলা জেলে থাকতে তিনি জানালার লোহার তৈরি গ্রিল কাটতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি লম্বা রশিও প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে এসে সব ফাঁস হয়ে যায়।

কারাগারে থাকাকালে তিনি স্বাস্থ্যজনিত নানাবিধ সমস্যার শিকার হয়েছিলেন। যেমন, স্থায়ী মাথাব্যথা, শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা। বন্দিদের পক্ষ থেকে বিপুল চাপ প্রয়োগের পর তার চেকআপ করানো হয়। এতে তার মস্তিষ্কে একটি জমাট রক্ত টুকরার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। তখন সাত ঘণ্টাব্যাপী মস্তিষ্কে একটি অস্ত্রপচার করা হয়।

কারাবন্দির সময়ে তাকে পারিবারিক দেখা-সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। যেদিন তিনি কারামুক্তি লাভ করেন, তার ভাই বলেছিলেন, দখলদার গোষ্ঠী তাকে ইয়াহইয়ার সাক্ষাৎ থেকে আঠারো বছর বাধা দিয়ে রেখেছে। তাঁর পিতা তেরো বছরে মাত্র দুইবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন।

কারগারের রচনাবলি

ইয়াহইয়া তার ২৩ বছরের কারাজীবনকে অধ্যয়ন, জ্ঞান আহরণ ও লেখালেখির কাজে ব্যয় করেছেন। এ সময়ে তিনি হিব্রু ভাষা শিখেছেন। ইসরাইলী মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করতে গভীর মনোনিবেশ করেছেন। তাছাড়া রাজনীতি, নিরাপত্তা ও সাহিত্য বিষয়ে মৌলিক রচনা ও অনুবাদ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হচ্ছে-

  'আশশাবাক বাইনাল আশিল্লা'র অনুবাদ। মূল লেখক কারমি জিলুন। বইটি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আশশাবাক নিয়ে লেখা।

  'আলআহযাব আলইসরাইলিয়্যা আম ১৯৯২' বইটির অনুবাদ। এটি ইসরাইলের ঐসময়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়, তাদের প্রোগ্রাম, চিন্তা ও দর্শন সম্পর্কে লিখিত।

  'আশশাওক ওয়াল কারানফুল' উপন্যাস। বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে 'ইনতিফাদাতুল আকসা' পর্যন্ত ফিলিস্তিনী সংগ্রামের গল্প বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসটিতে।

  'হামাস : আততাজরিবা ওয়াল খাতা'। এতে উঠে এসেছে হামাসের অভিজ্ঞতা ও যুগের পরিক্রমায় তার বিভিন্ন অবস্থা ও আবর্তন।

  'আলমাজদ' এটি ২০১০ সালে প্রকাশিত। এতে রয়েছে জায়নবাদি 'আশশাবাক' সেল কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে, এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার পদ্ধতি কী, মানসিক ও দৈহিক কোন্ কোন্ বর্বর হিংস্র পদ্ধতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়- এর বিবরণ। পাশাপাশি বইটি আলোকপাত করেছে জিজ্ঞাসাবাদের ধারণা, এর বিভিন্ন পদ্ধতি, সীমারেখা এবং বিভিন্ন সময়ে এতে তৈরি হওয়া জটিলতাগুলো সম্পর্কে।

কারামুক্তির পর রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রম

২০১১ সালে ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে কারামুক্তি দেওয়া হয়। গিলাড শালিত (Gilad Shalit) নামক এক ইসরাইলী সৈনিকের বিনিময়ে এক হাজারেরও বেশি বন্দি মুক্ত করা হয়েছিল। এই বন্দি বিনিময়ের নাম দেওয়া হয়েছিল 'ওয়াফাউল আহরার'। সিনওয়ার ছিলেন তাদের একজন।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এই বিনিময় চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এ পাঁচ বছর শালিত বন্দি অবস্থায় গাজায় ছিল। তাকে বন্দিত্ব থেকে উদ্ধার করতে ২০০৮ সালের শেষ দিকে গাজায় ইসরাইল হামলা করেছিল। কিন্তু এতে তারা ব্যর্থ হয়।

জেল থেকে বের হওয়ার পর সিনওয়ার হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর একজন সদস্য নির্বাচিত হন ২০১২ সালে হামাসের অভ্যন্তরীণ ভোটের মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি তিনি সামরিক শাখা ইযযুদ্দীন আলকাসসাম ব্রিগেডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো ও ব্রিগেডের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বও পালন করেন।

২০১৪ সালে ইসরাইল যখন গাজায় হামলা চালিয়েছিল তখন হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক এই উভয় অংশের মধ্যে সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

ইসরাইলের আক্রমণ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি মাঠপর্যায়ে নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে তদন্ত করেন এবং তাদের কাজের সামগ্রিক মূল্যায়ন করেন। এর ফলাফল হিসেবে বড় বড় দায়িত্বশীলদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২০১৫ সালে হামাসের কাছে থাকা ইসরাইলী বন্দিদের ব্যাপারে সিনওয়ারকে দায়িত্বশীল নিয়োগ করা হয়। হামাসের পক্ষ থেকে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, বন্দিদের ব্যাপারে ইসরাইলী দখলদারদের সাথে সংলাপ করতে। এই বছরই যুক্তরাষ্ট্র সিনওয়ারকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ব্যক্তিদের' তালিকাভুক্ত করে। একইভাবে ইসরাইলও তাকে গাজার সেসব ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, যাদেরকে তারা খতম করার জন্য খুঁজছে।

২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গাজা স্ট্রিপে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন ইসমাইল হানিয়ার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে।

এ সময় তিনি গাজার হামাস ও পশ্চিম তীরে ফাতাহের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন সরকারের মধ্যে সুন্দর ও সুসংসহত সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেন। যাতে করে জাতীয় একটি বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভক্তির ইতি ঘটে। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

তিনি মিশরের সাথেও সুসম্পর্ক তৈরি করতে কাজ করেছেন। এর অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে কায়রোতে মিশরীয় গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীলদের সাথে বৈঠক করেছেন নেতৃস্থানীয় ও নিরাপত্তা প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে। জীবিকা, নিরাপত্তা, মানবিক পরিস্থিতি ও সীমান্ত- এসকল বিষয়ে একাধিক চুক্তিতে তারা একমতও হন।

২০২১ সালের মার্চে তিনি হামাসের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো গাজায় হামাস প্রধান নির্বাচিত হন।

তাঁর বাড়ি কয়েকবার ইসরাইলী বিমান হামলার শিকার হয়। ২০১২ সালে তাঁর বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। ২০১৪ সালেও তার ঘরে বোমা হামলা হয়। ২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইলী বিমান হামলার সময়গুলোতো বারবার বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।

সিনওয়ার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একজন সতর্ক ব্যক্তি। খুব একটা কথা বলেন না। প্রকাশ্যে খুব কমই বের হন। এমনিভাবে তাঁর রয়েছে নেতৃত্বের বিরাট দক্ষতা। হামাস সদস্যদের ওপরও আছে তার বিপুল প্রভাব।

ইয়াহইয়া সিনওয়ার ও তূফানুল আকসা

৭ অক্টোবর অপারেশন 'তূফানুল আকসা'র পর ইসরাইলের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছেন সিনওয়ার। এর সাথে আছেন ইযযুদ্দীন আলকাসসাম ব্রিগেডের সেনাপ্রধান মুহাম্মাদ আদদাইফ।

'লৌহ তরবারি' নামে গাজা স্ট্রিপে ইসরাইল যে সামরিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তার সর্বোচ্চ টার্গেটে পরিণত হয়েছে এই হামাস নেতা। কারণ ইসরাইলী দায়িত্বশীলরা এই সিনওয়ারকেই ২০২৩ -এর ৭ অক্টোবর হামলার মাস্টারমাইন্ড মনে করে।

২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার কয়েকজন হামাস নেতার ওপর শাস্তি আরোপ করে, যার মধ্যে ছিল তাদের সম্পদ ফ্রিজ করা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। তাদের মধ্যে সিনওয়ারও একজন।

৩০ নভেম্বর ২০২৩-এ ফরাসি সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যাতে সিনওয়ারের সম্পদ ছয় মাসের জন্য ফ্রিজ করার কথা উল্লেখ করা হয়।

এই যুদ্ধের সময় সিনওয়ার প্রকাশ্যে বের হননি। 'হারেৎজ' পত্রিকা লিখেছে, সিনওয়ার কয়েকজন ইসরাইলী বন্দির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, যখন তারা গাজায় আটক ছিল। তিনি বিশুদ্ধ হিব্রু ভাষায় তাদের জানিয়েছেন, তারা সবচে নিরাপদ জায়গায় রয়েছে। এখানে মন্দ কোনো কিছুর শিকার হবে না।

৬ ডিসেম্বর ২০২৩-এ ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছিল, ইসরাইলী সৈন্যবাহিনী সিনওয়ারের ঘর ঘেরাও করেছে, তবে তাকে পায়নি। সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীলরা মনে করে, সিনওয়ার হামাসের অন্যান্য সামরিক নেতাদের সাথে টানেলের ভেতর থেকে অপারেশনগুলো পরিচালনা করে থাকেন। এই টানেলগুলো আলকাসসাম ব্রিগেড মাটির নিচে তৈরি করেছে।

গ্রেফতারি পরোয়ানা

২০ মে ২০২৪ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এ্যাটর্নি জেনারেল কারীম খান আদালতের কাছে বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ট ও হামাসের তিন নেতা- সিনওয়ার, আদদাইফ ও হানিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। কারণ তারা ২০২৩ সালের অক্টোবরের ঘটনার পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত।

এই প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে হামাস নেতা সামী আবু যুহরি রয়টার্সকে বলেন, ফিলিস্তিনী সংগঠনের তিন নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন 'জল্লাদ ও আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সমতা' বিধানের শামিল।

তিনি আরো বলেন, আদালতের এই প্রজ্ঞাপন ইসরাইলকে 'গণহত্যা' চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে।

হানিয়ার পর হামাস নেতা হিসেবে সিনওয়ার

৩১ জুলাই ২০২৪ হামাস ঘোষণা করে, হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরাইল হত্যা করেছে। তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থান করছিলেন, ইসরাইল সেখানে বোমা হামলা করেছে।

হানিয়া তেহরান গিয়েছিলেন হামাসের প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে ইরানী প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য।

কাতারের রাজধানী দোহায় হানিয়াকে দাফন করার পর হামাস অভ্যন্তরীণ নির্বাচন শুরু করে হানিয়ার উত্তরসূরি নির্ধারণ করার জন্য। ৬ আগস্ট ২০২৪ রোজ মঙ্গলবার হামাস ঘোষণা করে, শুরা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হামাসের নতুন প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচন করেছে।

শাহাদাত

১৭ অক্টোবর ২০২৪ বৃহস্পতিবার ইসরাইলী সেনাবাহিনী ও 'শাবাক' একটি যৌথ বিবৃতি দেয়। এতে জানানো হয়, গাজায় একটি অপারেশনে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে সিনওয়ার থাকতে পারেন, এই সম্ভাবনাটি ইসরাইলী সেনাবাহিনী ও শাবাক যৌথভাবে খতিয়ে দেখছে। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিচয় এই মুহূর্তে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

ইসরাইলী সেনারা রেডিওতে ঘোষণা করে, গাজায় সেনাবাহিনী (IDF) সিনওয়ারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। রেডিও আরো জানায়, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে ধারাবাহিক কাজ করে যাচ্ছে ইসরাইলী বিভিন্ন বাহিনী। এই হামাস নেতার ডিএনএ কারাবন্দিকালীন সময় থেকে সংরক্ষিত রয়েছে ইসরাইলের কাছে।

সেনাবাহিনীর বরাতে কয়েকটি ইসরাইলী গণমাধ্যম জানিয়েছে, 'রাফাহ শহরে যে অপারেশনে সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে। একটি বিল্ডিংয়ে কাসসামের তিন সদস্যের উপস্থিতি লক্ষ করে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য। তখন তারা তাদের সাথে লড়াই শুরু করে। একপর্যায়ে তারা নিহত হয়। ধারণা করা হয় তাদের মধ্যে সিনওয়ার রয়েছেন।'

১৮ অক্টোবর শুক্রবার হামাস সংগঠনটির প্রধান সিনওয়ারের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করে এবং তাঁর শাহাদাতের বিষয়টি নিশ্চিত করে। হামাস নেতা খলীল আলহাইয়া আলজাজিরায় প্রচারিত রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায় বলেন, দখলদার বাহিনীর সাথে এক সম্মুখ লড়াইয়ে সিনওয়ার শাহাদাত বরণ করেছেন।

আলহাইয়া জানান, হামাস তাঁর পথে অবিচল রয়েছে। দখলদার বাহিনীকে হটানোর আগ পর্যন্ত লড়াই চলমান থাকবে। তিনি বলেন, সিনওয়ার বুক টান করে পিছু না হটে শহীদ হয়েছেন। তিনি লড়াই করেছেন সম্মুখ সারিতে থেকে, বিচরণ করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।

তিনি আরো বলেন, গাজায় যুদ্ধ বিরতি, সেখান থেকে পরিপূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার এবং আমাদের বন্দিদের মুক্তির বিনিময়েই কেবল ইসরাইলী বন্দিরা ছাড়া পাবে। কমান্ডার সিনওয়ার ও তাঁর পূর্বসূরিদের শাহাদাত আমাদের আন্দোলনের শক্তি ও দৃঢ়তাই বৃদ্ধি করছে।

[আলজাজিরা (১৮ অক্টোবর ২০২৪) থেকে

অনুবাদ : মাওলানা আনাস চৌধুরী]

 

 

advertisement