জুমাদাল উলা ১৪৪৬   ||   নভেম্বর ২০২৪

বান্দা জানে নাকীসে তার কল্যাণ

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

সূরা বাকারার ২১৬নং আয়াত জিহাদের বিধানের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলছেন, জিহাদ তোমাদের কারো কারো কাছে ভারী মনে হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।

তবে আয়াতটির বার্তা অনেক ব্যাপক। শরীয়তের বহু বিধান সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য। শরীয়তের কোনো বিধান যদি আমার অপছন্দ বা কষ্টকর মনে হয়, তাহলে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহ তাআলার দেওয়া বিধান, কাজেই আমার ভালো লাগুক আর না লাগুক, এতেই আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে।

যেমন, রোযার বিধান; কারো মনে হতে পারে, পুরো এক মাস সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকা আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর হয়ে যাবে। অথচ জাগতিক দৃষ্টিতেও যে রোযা কত উপকারী, তা তো এখন সকলেরই জানা আর আখেরাতের বিপুল সওয়াব তো রয়েছেই। তাছাড়া রোযায় এক মাসব্যাপী আত্মসংযমের যে চর্চা হয়ে থাকে, তা যে কারো জীবনকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

পর্দার বিধানও কারো কাছে কষ্টকর মনে হতে পারে। অথচ এ বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলছেন-  ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ  (এটা তাদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র পন্থা।) যে সমাজে এ বিধান যত বেশি পালিত হয়েছে, সে সমাজ তত বেশি নিরাপদ হয়ে উঠেছে। আমাদের সোনালি ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়।

যাকাত দেওয়া ও দান-সদকা করা কারো কাছে কষ্টকর লাগতে পারে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করে কেউ মনে করতে পারে, এতে তো আমার সম্পদ কমে যাবে। অথচ যাকাত ও দান-সদকা সম্পদ কমায় না; বরং সম্পদ বাড়ায়। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে দান-সদকা করার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন-

مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْۢبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِیْ كُلِّ سُنْۢبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ وَ اللهُ یُضٰعِفُ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ اللهُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ.

যারা আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন একটি শস্য দানা সাতটি শীষ উদ্গত করে (এবং) প্রতিটি শীষে এক শ দানা জন্মায়। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (সওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ। -সূরা বাকারা (২) : ২৬১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ، وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ، إِلّا عِزًّا، وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلهِ إِلّا رَفَعَهُ اللهُ.

সদকা সম্পদ কমিয়ে দেয় না। কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ বান্দার সম্মান বাড়িয়ে দেন। আর যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২০২৯

এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ সম্মান বাড়িয়ে দেন। অনেক সময় আমাদের মনে হতে পারে, কাউকে ক্ষমা করলে আমার ভীরুতা ও হীনম্মন্যতা প্রকাশ পাবে। এতে আমার সম্মান নষ্ট হবে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, এতে সম্মান তো কমবেই না; বরং আরো বেড়ে যাবে।

তেমনিভাবে মনে হতে পারে, বিনয় প্রদর্শন করতে গেলে আমি অন্যদের কাছে ছোট হয়ে যাব। কারো কাছে আমার কোনো মর্যাদা থাকবে না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন- বিনয়ী হলে আল্লাহ তাআলা মর্যাদা আরো বড়িয়ে দেন।   

দান-সদকার বিপরীতে সুদের লেনদেন কারো কাছে লাভজনক মনে হতে পারে। কেউ ভাবতে পারে, সুদ নিলে তো সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে সুদকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আখেরাতে সুদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। সেইসঙ্গে বলেছেন-

وَ مَاۤ اٰتَیْتُمْ مِّنْ رِّبًا لِّیَرْبُوَاۡ فِیْۤ اَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا یَرْبُوْا عِنْدَ اللهِ وَ مَاۤ اٰتَیْتُمْ مِّنْ زَكٰوةٍ تُرِیْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ.

তোমরা যে সুদ দাও, যাতে তা মানুষের সম্পদে (যুক্ত হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক, তো যারা তা দেয়, তারাই (নিজেদের সম্পদ) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে নেয়। -সূরা রূম (৩০) : ৩৯

এভাবে শরীয়তের বিভিন্ন বিধানের ক্ষেত্রে আমাদের কুপ্রবৃত্তি আমাদেরকে ওয়াসওয়াসা দেয় এবং অন্যায়ের দিকে প্ররোচিত করে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

عَسٰۤی اَنْ تَكْرَهُوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ  وَ عَسٰۤی اَنْ تُحِبُّوْا شَیْـًٔا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَ اللهُ یَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.

হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে ভারী মনে কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা-ই কল্যাণকর। আবার এটাও হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে পছন্দ কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা অকল্যাণকর। আর (প্রকৃত বিষয় তো) আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। -সূরা বাকারা (২) : ২১৬

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, তার সবটাই ভালো। আমাদের দুর্বল বিবেচনায় তার কোনো কোনো কল্যাণ ধরা নাও পরতে পারে, কিন্তু তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার সবটাই কল্যাণকর।

এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী নিয়ে এসেছেন?

জবাবে তিনি বললেন-

لَمْ آتِكُمْ إِلّا بِخَيْرٍ.

তোমাদের কাছে নিয়ে এসেছি, যা কিছু কল্যাণকর। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩১২৭; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১০৮৪

অতএব আল্লাহ তাআলা ও রাসূলের যত বিধিবিধান রয়েছে, তার সবকিছুই মানুষের জন্য চিরকল্যাণকর।

কুরআন কারীমের উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের বিধানাবলির অনুসরণ এবং জীবন সম্পর্কে কী চমৎকার একটি নির্দেশনা দিয়েছেন! চিন্তা-চেতনায় কুরআনের এ শিক্ষা জাগরুক রাখলে কুরআন-সুন্নাহ্র পথে চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে। পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে এ বার্তা স্মরণ রাখলে আমাদের জীবন সুখী ও শান্তিময় হতে পারে এবং অনেক পেরেশানী ও মনোবেদনা কুরআনের কেবল এই একটি বাক্যেই ঘুচে যেতে পারে।

আমরা প্রত্যেকেই জীবনে বহু পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে জাগতিক সাফল্য লাভে ব্যর্থ হই, তাহলে মন খারাপ করে হতাশ হয়ে বসে পড়ি। আবার অনেক সময় কোনো একটা বিষয় অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর মনে হয়, তা থেকে বাঁচার জন্য সবরকম চেষ্টা করি, তারপর যখন সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টির সম্মুখীন হতেই হয়। তখন সাধারণত মনে হয়, আমার তো বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে এবং মানসিকভাবে এমন ভেঙে পড়ি, যেন জীবন শেষ হয়ে গেছে। অথচ হতেই পারে যে, বিষয়টির বাস্তব কল্যাণ আমার বাহ্যিক দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে বলে আমি তা বুঝতে পারছি না। সেক্ষেত্রে কুরআনের উক্ত আয়াতের বার্তাটি মনে রাখা দরকার, আয়াতটির বার্তা হল, 'তোমার প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণ কীসে- তা তুমি জান না, আল্লাহ তাআলা জানেন। তুমি যা কামনা করছ, বাস্তবে তা তোমার জন্য দুঃখজনকও হতে পারে, আর যা অপছন্দ করছ, তা হতে পারে প্রভূত সুফলবাহী। কাজেই তোমার কর্তব্য-করণীয়র ফয়সালা আল্লাহ তাআলার ওপর ছেড়ে দাও এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চল। আর তাকদীর অনুযায়ী যা ঘটে তাতেই খুশি ও সন্তুষ্ট থাক।'

অন্ততপক্ষে ইসলামের এই শিক্ষা তো সবসময়ই মনে রাখা দরকার যে, মুমিন বান্দার জীবনে কষ্টকর যা কিছু ঘটে, তাতে যদি সে সবর করে, তাহলে আখেরাতে সেজন্য সে মহাপ্রতিদান পাবে।

নবীগণের জীবনেও এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, বাহ্যিকভাবে যেটা খুব দুঃখজনক ছিল, কিন্তু পরিণতিতে সেটা তাদের জীবনের জন্য অভূতপূর্ব কল্যাণকর হয়ে দেখা দিয়েছিল। যেমন, ফেরাউন যখন বনী ইসরাঈলের নবজাতক পুত্রদেরকে হত্যা করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল, তখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তার মাকে আল্লাহ তাআলা এই প্রত্যাদেশ পাঠালেন, মূসা আলাইহিস সালামকে যেন একটি বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মূসা আলাইহিস সালামের মায়ের জন্য এটা কত কষ্টের বিষয় ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মেনে তিনি তাই করলেন। পরবর্তী ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে, কীভাবে ফেরাউনেরই ঘরে থেকে মূসা আলাইহিস সালামের জীবন রক্ষা হল।

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তার ভাইয়েরা হিংসার বশবর্তীতে ষড়যন্ত্র করে কূপে ফেলে দিয়েছিল। সেখান থেকে এক বণিকদল তাকে উঠিয়ে নিয়ে গোলাম হিসেবে মিশরের বাজারে বিক্রি করে দিয়েছিল। ছিলেন নবী-পুত্র, অথচ বিক্রি হয়ে গেলেন গোলাম হিসেবে, তাও ফিলিস্তিন থেকে সুদূর মিশরের বাজারে। বালক বয়সী ইউসুফ আলাইহিস সালামের জন্য যে তা কত হৃদয়বিদারক ছিল, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এরপরে আল্লাহ তাআলা তাকে সেই মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলেন। যেখানে তিনি শৈশবে গোলাম হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন। ভাইদের সাথে পরবর্তীতে যখন আবার দেখা হল, ভাইয়েরা তাকে চিনতেই পারেনি। কারণ, তাদের কল্পনাতেও ছিল না, যে কিশোরকে তারা ভুলিয়ে ভালিয়ে কূপে ফেলে দিয়েছিল, সে বড় হয়ে মিশরের মতো বিরাট সাম্রাজ্যের মন্ত্রী হতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা আছে। ষষ্ঠ হিজরীতে মক্কার কাফেরদের সঙ্গে যখন মুসলমানদের হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়েছিল, তখন সন্ধির শর্তনামা বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্য কিছুটা অবমাননাকরই ছিল বৈকি। একে তো এত বছর পরে মক্কার কাছাকাছি এসেও পবিত্র কা'বাকে এক নজর না দেখেই ফিরে যেতে হচ্ছে। তার ওপর সন্ধির কিছু শর্ত এমন ছিল যে, 'মুসলমানরা পরের বছর ওমরা পালন করতে এসে মাত্র তিন দিন থাকতে পারবে। আসতে হবে নিরস্ত্র হয়ে, সঙ্গে কোনো হাতিয়ার থাকতে পারবে না। আর সন্ধি বলবৎ থাকা অবস্থায় কুরাইশের কেউ যদি মুসলমানদের কাছে চলে যায়, তাহলে মুসলমানরা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু কোনো মুসলমান যদি কাফেরদের কাছে চলে যায়, তাহলে কাফেররা তাকে ফেরত দেবে না।'

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সকল শর্তই মেনে নিলেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এমন শর্তে সন্ধি করতে অপছন্দ করছিলেন। কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আপত্তিও জানিয়েছিলেন। বাহ্যিক বিচারে সন্ধির এই শর্তগুলোকে অপছন্দ করা ও আপত্তিজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ সন্ধিকেই فتح مبين  তথা 'সুস্পষ্ট বিজয়' বলে কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন। কারণ এ সন্ধির ফলে ইসলাম প্রচার আরো সহজ হয়ে গেল। মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে ব্যস্ত থাকায় অন্যান্য অঞ্চলে যথাযথভাবে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হচ্ছিল না। হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণে যেহেতু যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল, তাই আরবের বাইরে ইসলামের দাওয়াত প্রচারে পূর্ণ মনোনিবেশ করা গেল। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দিকে দিকে দূত পাঠালেন। এ সময়েই রোম সম্রাট কিসরাসহ ব্যাপকভাবে অন্যান্য রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের কাছে চিঠি পাঠানো হল।

হুদায়বিয়া সন্ধির আগে মক্কা-মদীনার বাইরে সর্বত্র ইসলাম প্রচারের সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এ সন্ধির কারণে ব্যাপকভাবে তা করার সুযোগ মিলেছে। ফলে হুদায়বিয়া সন্ধির সময় যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল চৌদ্দ শ'র মতো। এর মাত্র দুই বছর পরে মক্কা বিজয়ের সময় সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। ইসলামের প্রচারই তো হল মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য সাধন হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এটাই তো হল আসল বিজয়। তাছাড়া এ সন্ধি মক্কা বিজয়ের পথ আরো সুগম করে দিয়েছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়েছিল ষষ্ঠ হিজরীতে। আর এর মাত্র দুই বছর পরে অষ্টম হিজরীতে মুসলমানগণ মক্কা বিজয় করেন। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো কাছে যে সন্ধি অপছন্দনীয় মনে হয়েছিল, আল্লাহ তাআলা সেটাকেই মসলমানদের বিজয়ের প্রথম পদক্ষেপ বানিয়েছিলেন।

কুরআন কারীমে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে এমন আরো অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলোতে দেখা যায়, কোনো একটা বিষয় শুরুতে অপছন্দনীয় মনে হয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাআলা সেটাতেই কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন অনেক ব্যাপার ঘটে, যেখানে আমরা নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে, নিজের পছন্দমতো কিছু অর্জিত না হলে, খুব হতাশ হয়ে পড়ি। মনে করি আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল, কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমার বুঝে আসুক আর না আসুক, আমার কীসে ভালো আর কীসে মন্দ, তা আল্লাহ তাআলাই জানেন। তিনিই তো জানবেন, কারণ তিনিই সৃষ্টিকর্তা।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান তাঁর বিধান ও ফয়সালাকে যথাযথ বিচার করতে পারবে না। অতএব সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার বিধিনিষেধ মেনে চলা ও তাঁর ফয়সালার প্রতি সবর ও শোকর করাই মুমিন বান্দার কাজ।          

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জীবনেও এ বিষয়ে অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ ও বিধান তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পালন করেছেন। তাঁর স্ত্রী-সন্তানগণও তাঁর যথাযথ অনুসরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে নির্দেশ দিলেন, মক্কার জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে রেখে আসতে। তিনি নির্দ্বিধায় তা পালন করলেন। যখন তাদেরকে একাকী রেখে চলে যাচ্ছিলেন, তাঁর স্ত্রী বললেন, আমাদেরকে এভাবে রেখে চলে যাচ্ছেন যে! তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। তার স্ত্রী বারবার প্রশ্ন করছিলেন, কিন্তু তিনি কিছুই বলছিলেন না। একসময় তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন-

آللهُ الَّذِي أَمَرَكَ بِهذا؟

আল্লাহ্ই কি আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন?

তিনি বললেন, হাঁ।

তার স্ত্রী তখন বললেন-

إِذَنْ لَا يُضَيِّعُنَا

তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে বিনাশ করবেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৬৪

ইবরাহিম আ. তো দ্বিধাহীনচিত্তে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেনই। স্ত্রীকেও যখন বললেন, হাঁ, এটা আল্লাহর নির্দেশ।

সাথে সাথে তাঁর স্ত্রীও পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচয় দেখালেন। তাঁর সমস্ত পেরেশানী দূর হয়ে গেল। তিনি বললেন, যদি আল্লাহর নির্দেশ হয়ে থাকে, তাহলে তো আমাদের আর চিন্তার কিছু নেই। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের অকল্যাণ করবেন না।

আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন- স্বয়ং ছেলেকে কুরবানী করতে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছেলেকে কুরবানী করতে নিয়ে গেলেন। যখন ছেলেকে তা জানালেন, ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন-

یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِیْنَ.

আব্বাজী! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি তা করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। -সূরা সফ্ফাত (৩৭) : ১০২

যেমন পিতা, তেমনই সন্তান। এই হল আল্লাহর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসের পরিচয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেছেন-

اِنَّ اِبْرٰهِیْمَ كَانَ اُمَّةً قَانِتًا لِلهِ حَنِیْفًا وَ لَمْ یَكُ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ، شَاكِرًا لِّاَنْعُمِهٖ اِجْتَبٰىهُ وَ هَدٰىهُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ.

নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিল এক আদর্শপুরুষ আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সে আল্লাহর নিআমতের কৃতজ্ঞতা আদায়কারী ছিল। আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে সরল পথে পরিচালিত করেছিলেন। -সূরা নাহল (১৬) : ১২০-১২১

আমাদের কর্তব্য ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মতো ঈমান ও ইসলাম ধারণ করা। নিজের প্রবৃত্তিগত যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা বিচার না করে কুরআন-সুন্নাহ্র আলোয় দেখা এবং পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা। আর সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও ফয়সালার ওপরই ভরসা রাখা। 

 

 

advertisement