বাবরি মসজিদ-৩
[সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান সংকলিত ‘বাবরী মসজিদ তারীখী পাস্-মানযার আওর পেশ-মানযার কী রৌশনী মেঁ’ কিতাবের ধারাবাহিক অনুবাদ। অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ]
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আইনে আকবরিতে অযোধ্যা
একজন ইতিহাসবিদের কাছে এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুপ্রবেশেরন আগে অযোধ্যার গুরুত্ব কতটুকু ছিল এবং মসজিদ-মন্দির সংক্রান্ত বিতর্ক ও বিবাদ ঐ সময়ও ছিল কি না। আবুল ফযল ‘‘আইনে আকবরি’’র প্রথম জিলদের দ্বিতীয় হিস্যায় অযোধ্যার কথা বলেননি। তবে আওয়াধ সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘আওয়াধ হিন্দুস্তানের বড় শহরগুলির একটি। প্রাচীনকালে এর জনবসতি দৈর্ঘ্যে ১৪৮ ক্রোশ ও প্রস্থে ২৬ ক্রোশ বিস্তৃত ছিল। এটি একটি পবিত্র স্থান। শহরের আশপাশের জমি খনন করলে সোনা পাওয়া যায়। এটি ছিল রাজা রামচন্দ্রের আবাসভূমি, যাকে মনে করা হয় ত্রেতা-যুগের* নেতা ও আধ্যাত্মিক গুরু। শহরের অদূরে সাত গজ ও ছয় গজ লম্বা দু’টি কবর আছে। জনশ্রুতি হল, তা হযরত শীছ আ. ও হযরত আইয়ুব আ.-এর কবর। কবর দু’টি সম্পর্কে অনেক আশ্চর্য কথা প্রচলিত আছে। আরো বলা হয়, রতনপুরে একজন সিকান্দার লোধির আমলের সাধু পুরুষ কবীর দাশের কবর আছে। লোকে বলে, আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে সে সংসারত্যাগী হয়েছিল এবং ধর্মের বিধান থেকেও স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। হিন্দিতে কবীর দাশের কিছু কবিতা আছে, যা তার বৈরাগ্য ও স্রষ্টার-অন্বেষণের উত্তম দৃষ্টান্ত।-আইনে আকবরী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা : ৭৮ (উল্লেখ্য, রতনপূরে কবীরের কবর নেই)
এখানে কোথাও বলা হয়নি যে, বাদশাহ বাবর রামমন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। অথচ বাবরের শাসনামলের আগেই অযোধ্যায় মুসলিম-বসতি স্থাপিত হয়েছিল।
অযোধ্যায় মুসলমানদের বসবাস
আইনে আকবরির উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের ধারণা, এখানে হযরত শীছ আ. ও হযরত আইয়ুব আ.-এর কবর আছে। এই ধারণা বাস্তব কি অবাস্তব তা ভিন্ন প্রসঙ্গ তবে এটুকু বোঝা যায় যে, এই স্থানের সাথে মুসলমানদেরও আবেগ ও ভক্তি জড়িয়ে আছে।
হযরত শীছ আ.-এর কবরের চারপাশে আছে অনেক অলি-আওলিয়ার কবর। আরো আছে সালার মাসউদ গাযী রাহ.-এর মুজাহিদ সাথীদের কবর, বখশী বাবা রাহ., হযরত লা’ল শাহ বায কলন্দর রাহ., হযরত সাইয়্যেদ আলাউদ্দীন খোরাসানি রাহ., হযরত জামালুদ্দীন কাযি কুদওয়াহ রাহ., হযরত সুলতান মূসা আশেকান রাহ. এবং পীর কুশাবি রাহ.-এর কবর। এঁদের জীবনী থেকে বোঝা যায়, বাবরের আগেই এঁরা অযোধ্যায় এসে বসতি স্থাপন করেছেন এবং আমমানুষকে ফুয়ূয ও বারাকাত দ্বারা ধন্য করেছেন।
হযরত নাসীরুদ্দীন চেরাগে দেহলী রাহ.-এরও পৈত্রিক নিবাস অযোধ্যায়। বলা হয়ে থাকে যে, তাঁর জন্মও হয়েছিল অযোধ্যায়। বংশীয় সূত্রে তিনি হোসাইনী সাইয়েদ। অর্থাৎ সে আমলে অযোধ্যায় সাইয়েদগণও বসতি স্থাপন করেছিলেন। সুতরাং এখানে এক বা একাধিক মসজিদ থাকা খুবই স্বাভাবিক। এতে আশ্চর্যের কী আছে?
বিবাদের সূচনা
মোঘল-আমলের ইতিহাসে রাম-মন্দির ও বাবরি মসজিদ বিতর্কের কথা পাওয়া যায় না। মোঘল-শাসন দুর্বল হওয়ার পর আওয়াধে নবাবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসনও যখন দুর্বল হল তখন এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ঘটে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলেই (১৭৭২-৮৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে এখানে শান্তিরক্ষা বাহিনী নিয়োগ করা হয়। এর ব্যয়ভার ছিল নবাবের উপর। একপর্যায়ে বাহিনীর সদস্যসংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হয়, যার ব্যয়ভার বহন করা নবাবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইতিহাসে আছে, হেস্টিংস তখন বেগমদের গহনা ছিনিয়ে নিয়ে এই অর্থ উসূল করেছিল। এ থেকে বোঝা যায়, নবাব তখন সম্পূর্ণূরূপে ইংরেজ-কৃপাধীন হয়ে পড়েছিলেন। লর্ড ওয়েলেসলির আমলে এই বাহিনীর সৈন্য-সংখ্যা দশ হাজার অতিক্রম করে, যাদের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য নবাবকে তার অর্ধেক এলাকা কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করতে হয়। লর্ড লরেন্সের সময় সেখানে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট অবস্থান করতে থাকেন, যিনি সেনা-সহায়তায় রাজ্য-শাসনেরও মালিক-মোখতার হয়ে উঠেছিলেন। লর্ড ডালহৌসির সময় নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কার্যত পুতুল নবাবে পরিণত হন। এ আমলের বিস্তারিত ইতিহাস যেকোনো ইতিহাস-গ্রন্থেই পাওয়া যাবে। খোদ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার ‘মছনবিয়ে হুযন-আখতার’ কাব্যে লিখেছেন-
‘‘ওয়াজেদ আলী ইবনে আমজাদ আলী শোনাবে এখন তার দুঃখের কাহিনী। রাজ্য-শাসনের যখন হল দশ বছর, তখন ডুবল ভাগ্য তারকা।’’
গভর্নরের ফরমান এল-ছেড়ে দাও মসনদ সালতানাতের। শাহে আওয়াধ বলা হত যাকে, এই হল পরিণাম তার হুকুমতের।
ডালহৌসির পত্রে ছিল লেখা, প্রজারা তোমার নারাজ। আর তুমি হলে এক ব্যর্থ রাজা।
‘‘এই পত্র নিয়ে এসেছিল জেনারেল ওটার্ম। সাথে ছিল জবরদস্ত ইংরেজ ফৌজ, এসেছিল যেন ছুটে দরিয়ার মৌজ।’’
সাইয়েদ কামালুদ্দীন হায়দার হাসানী আল হোসায়নী আলমাশহাদী তার ‘‘কায়সারুত তাওয়ারীখ ইয়া তাওয়ারীখের আওয়াধ’’ কিতাবের দ্বিতীয় খন্ডে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সাথে লর্ড ডালহৌসি, রেসিডেন্ট জেনারেল সিলম্যান ও জেনারেল ওটার্ম প্রমুখের আচরণের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
এই সময়ই অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে, যার পরিণতিতে আঠার শ পঞ্চান্ন সালে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এর পিছনে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, এ অঞ্চলের শাসন-ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে হলে এখানকার অধিবাসীদের মাঝে দন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করতে হবে। আওয়াধের কর্তৃত্ব হস্তগত করার পর থেকেই অযোধ্যা তাদের অপতৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। দিল্লীতে মুসলিম-শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২০৫ খৃস্টাব্দে। এরপর থেকে মুসলমানরা সেখানেই আবাদ হয়েছেন সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করেছেন, ইমাম-মোয়াযযিন নিয়োগ করেছেন, মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা এবং দরবেশদের জন্য খানকা নির্মাণ করেছেন, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, মুদাররিস নিয়োগ দিয়েছেন। একইভাবে অযোধ্যায় মুসলমানদের আগমনের পর এখানেও মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এই শহরকে হিন্দুরা পবিত্র স্থান মনে করত। আওয়াধের কর্তৃত্ব দখল করার পর ইংরেজদের হাতে অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ এল।
তারা রাজ্য-ক্ষমতা দখল করছিল মুসলমানদের কাছ থেকে তাই হিন্দুদের সমর্থন ও সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল। তারা হিন্দুদের উত্তেজিত করার জন্য প্রচার করতে থাকল যে, অযোধ্যার অধিকাংশ মসজিদ হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে কিংবা তাদের কোনো পবিত্র স্থানে নির্মিত। এই পুস্তিকাতেই আলেকজান্ডার কেনিংহামের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তাতেও এ বিষয়টি পাওয়া যাবে। অন্যদিকে ইংরেজরাই তাদের গেজেটিয়ার ও প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্টসমূহে ঐসব পবিত্র স্থান সম্পর্কে লিখত যে, এগুলো বিরান হয়ে বন-জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। পরে সেগুলো নিছক অনুমানের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়েছে। এ জাতীয় বক্তব্যের একটি উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করা, তারা যেন হিন্দুদের দাবি মেনে না নেয়।
ইংরেজদের কুটকৌশলী সমর্থন মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের দিকেই বেশি ছিল। তারা ব্যাপকভাবে প্রপাগান্ডা করল যে, মুসলমান যেখানেই যায় সেখানকার অধিবাসীদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করে এবং তাদের উপাসনালয় ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করে।
এইসব মিথ্যাচার প্রমাণ করার জন্য যদি কোনো দায়িত্বহীন ঐতিহাসিক কিংবা ইসলামী বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিম লেখকের উদ্ধৃতি কিংবা অনির্ভরযোগ্য বইপত্রের বিবরণ উপস্থিত করা হয় তবুও একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের চিন্তা করা উচিত যে, বাস্তবে যদি এটাই হত মুসলমানদের নীতি তাহলে কি আজ গোটা ভারতবর্ষে একটি মন্দিরও দেখা যেত? মুসলিম-বাহিনী তো কাশ্মীর থেকে রাসকুমারী পর্যন্ত এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত গোটা ভূখন্ড জয় করেছিল। এসব অঞ্চলে এত প্রাচীন মন্দির তাহলে কীভাবে রয়ে গেল?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন অমুসলিমকে যেসব অধিকার দিয়েছেন তা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। পাঠক দেখেছেন যে, আহলে কিতাব সম্প্রদায়, অর্থাৎ যাদের কুরআন মজীদের উপর ঈমান নেই, তবে কুরআনে উল্লেখিত কোনো আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী, তাদের সম্পর্কে ইসলামের বিধান এই যে, তারা ইসলামি হুকুমতের প্রতি ওয়াফাদার ও বিশ্বস্ত থাকলে তাদের উপাসনালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিরাপদ থাকবে এবং তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। আর ধর্মত্যাগে বাধ্য করার তো প্রশ্নই আসে না। এদের নারীদেরকে মুসলিম পুরুষগণ বিবাহ করতে পারে এবং তাদের যবেহকৃত প্রাণী ও তাদের হালাল খাবার মুসলমানরা খেতে পারে।
কিছু সম্প্রদায় আছে, যারা উপরোক্ত কোনো আসমানী কিতাবকে স্বীকার করে না তবে অন্য কোনো ঐশী গ্রন্থে বিশ্বাসের দাবি করে। যেমন ছাবি, মাজূছি (অগ্নিপুজারী), হিন্দু ও বৌদ্ধ। মুসলমান তাদের নারীদের বিয়ে করতে পারে না এবং তাদের যবেহকৃত পশু খেতে পারে না। তবে ইসলামি হুকুমতের প্রতি ওয়াফাদার হলে অন্য সকল ক্ষেত্রে তারা আহলে কিতাবের মতোই অধিকার ভোগ করবে। অর্থাৎ তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু নিরাপদ থাকবে এবং তাদের মন্দির ও উপাসনালয় অক্ষুণ্ণ থাকবে।
আমাদের রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে তাঁকে এই পয়গাম দেওয়া হয়েছে যে, আপনার দায়িত্ব শুধু পৌঁছে দেওয়া। লোকেরা যদি গ্রহণ না করে তাহলে এর দায় আপনার নয়। এদের হিসাব নেওয়ার দায়িত্ব আমার। (সূরা মাইদা : ৯৫; সূরা গাশিয়া : ২৬)
ইসলামের এই উদার নীতির পরও ইংরেজ বেনিয়ারা এই প্রপাগান্ডা করেছে যে, মুসলমানরা অন্য ধর্মের লোকদের জোরপূর্বক মুসলমান বানায় আর তাদের উপাসনালয় ভেঙ্গে মসজিদ তৈরি করে।
মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে শরীয়তের অনেক শর্ত-শরায়েত আছে। জবরদখলকৃত জমিতে মসজিদ বানানো সম্পূর্ণ নাজায়েয। ফকীহগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এই যে, আল্লাহর রেযামন্দি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, যেমন যশ ও খ্যাতির জন্য যে মসজিদ বানানো হয় কিংবা যে মসজিদ হারাম উপার্জন দ্বারা বানানো হয় তা শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মসজিদে দিরার’ হিসেবে গণ্য। (তাফসীরাতে আহমাদিয়া পৃ. ২৮৩; মাদারিক আলাল খাযিন, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৬৫)
অর্থাৎ তা মুসলমানদের নয়, মুনাফিকদের মসজিদ।
ফকীহগণ আরো বলেছেন, ‘যে জমিতে অন্যের হক আছে তাতে হক্বদারের সম্মতি ছাড়া মসজিদ বানানো হলে ঐ মসজিদকে বাতিল ঘোষণা করে হকদার তার হক্ব উসুল করতে পারবে।’
এটা এভাবেও বোঝা যায় যে, প্রতিবেশিত্ব বা অংশীদারত্বের কারণে যে জমির উপর কারো হক্বে শোফ‘আ আছে তাতে হক্বদারের সম্মতি ছাড়া মসজিদ বানানো জায়েয নয়। (ফতহুল কাদীর খন্ড : ২,পৃষ্ঠা : ৮৭৫)
তেমনি কোনো ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় নিয়ত করল যে, নিজের ঘরবাড়ি মসজিদ বানিয়ে যাবে এবং মৃত্যুর সময় অসিয়তও করে গেল, কিন্তু অসিয়তে একথা ছিল না যে, পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশকে মসজিদ বানানো হবে, এক্ষেত্রে ওয়ারিছরা সম্মত না হলে এই অসিয়ত কার্যকর করা যাবে না। কারণ এই সম্পদে ওয়ারিছদের হক্ব রয়েছে। হুকুকুল ইবাদ থেকে আলাদা না করে মসজিদ বানানো সহীহ হয়নি। (ফাতাওয়া আলমগীরী ২/৪৫৬)
বাই ফাসিদের মাধ্যমে কেনা জমিতে মসজিদ বানানো জায়েয নয়। (ফতহুল কাদীর ২/৮৭৫)
তেমনি যেকোনো নাজায়েয তরীকায় প্রাপ্ত জমিতে মসজিদ বানানো জায়েয নয়। যেমন কারো ঘর দখল করে মসজিদ বা জামে মসজিদ বানানো হলে তাতে নামায পড়া নাজায়েয। (ফাতাওয়া আলমগীরী ৬/২১৪)
মসজিদ সম্প্রসারণের প্রয়োজনে রাস্তার কিছু অংশ যদি মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এ কারণে পথচারীদের অসুবিধা হয় তাহলে তা জায়েয নয়। (ফাতাওয়া আলমগীরী ২/৪৫৬)
মসজিদ নির্মাণ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হল জমি হালাল তরীকায় গৃহীত হওয়া। হালাল তরীকার ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে যে, মসজিদের জমিতে কারো কোনো প্রকারের হক না থাকা। হিদায়া কিতাবে বলা হয়েছে, কেউ যদি এমন কোনো ঘরকে মসজিদ বানায়, যার নীচে ভূগর্ভস্থ কক্ষ আছে কিংবা ওপর তলায় ঘর আছে তো মাঝের ঘরটির মালিকানা ত্যাগ করে মসজিদ বানালেও তা মসজিদ হবে না। সুতরাং মালিক ইচ্ছে করলে তা বিক্রি করতে পারবে এবং তার মৃত্যুর পর ওয়ারিছরা ঐ ঘরের মালিক হবে। কারণ এই ঘরের (কিছু অংশে, যেমন ছাদ ও মেঝে) বান্দার হক ও মালিকানাও যুক্ত থাকায় তা সম্পূর্ণ আল্লাহর জন্য হয়নি। অথচ মসজিদে কারো কোনো ধরনের হক থাকতে পারে না। (হিদায়া)
ফকীহগণ সর্বদা এই নীতি অনুসরণ করেছেন। সমকালীন ফতোয়ার কিতাবেও এ ধরনের অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেমন ফতোয়ায়ে রেজভিয়াতে এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। অতএব গোটা মসজিদ বান্দার হক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া অপরিহার্য। কোনো অংশে কারো মালিকানা অবশিষ্ট থাকলে মসজিদ হবে না।’ (ফতোয়ায়ে রেজভিয়া ৬/৪৫৩)
এক প্রশ্নে বলা হয়েছে, মুসলমানরা হিন্দু জমিদারের নিকট থেকে জমি কিনে মসজিদ বানাতে চান। কারণ মুসলমানদের কাছে মওরূসি জমি ছাড়া এমন কোনো জমি নেই, যেখানে মসজিদ বা জামে মসজিদ বানানো যায়। কিন্তু ঐ হিন্দু জমিদার তার জমি বিক্রি করতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় মুসলমানরা কী করবেন?
জবাবে বলা হয়েছে যে, ঐ হিন্দু যদি জমি বিক্রি না করে তাহলে মুসলমানরা ঘরেই নামায পড়বে। (ফতোয়া রিজভিয়্যাহ ৬/৪৬১)
কয়েক ব্যক্তির মালিকানাধীন জমিতে এক শরীক অন্য শরীকদের অনুমতি ছাড়া মসজিদ বানাতে পারবে না। এমন জমিতে মসজিদ বানানো হলে তাতে নামায পড়ার ছওয়াব পাওয়া যাবে না; বরং তাতে নামায না পড়াই উচিত। (মজমুআয়ে ফতওয়া মাওলানা আবদুল হাই-আদাবুল মাসাজিদ মুফতী মো. শফী পৃ. ২৫)
তদ্রূপ না-বালিগের জমিতে মসজিদ বানানো জায়েয নয়। (তাতিম্মা ইমদাদুল ফাতাওয়া-আদাবুল মাসাজিদ মুফতী মোহা. শফী পৃ. ২৫)
কোনো পতিতা হারাম উপার্জন দ্বারা মসজিদ বানালে তা মসজিদ হবে না এবং এতে কোনো ছওয়াবও হবে না। (মজমুআয়ে ফতওয়া মাওলানা আবদুল হাই পৃ. ২৬৮)
মোটকথা, মসজিদ বানানোর জন্য শরীয়তের বিধানেই যখন এই শর্ত আছে যে, জমির মালিকানা বৈধ উপায়ে হাসিল হতে হবে, কারো হক নষ্ট করা যাবে না এবং জোরজবরদস্তি করা যাবে না, তখন কীভাবে সম্ভব যে, মুসলিম বিজেতা ও শাসকগণ মন্দির ভেঙ্গে ভেঙ্গে মসজিদ বানাতে থাকবেন? এমন কিছু হলে তো আলিম ও ফকীহগণই সবার আগে প্রতিবাদ করবেন!
হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতে কোনো অসুবিধা নেই যে, মুসলিম শাসক ও সেনাপতিগণ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো মন্দির ধ্বংস করেছেন। তবে কী ধরনের মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে তা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ মন্দির ভেঙ্গে ঐ স্থানে মসজিদ বানানোর দাবি কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না।
শরীয়তের হুকুমের তোয়াক্কা না করে কেউ যদি কোথাও এমন কোনো মসজিদ বানিয়েও থাকে তবে তা ফকীহ ও আলিমগণের কাছে মসজিদ বলে স্বীকৃত হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। সুতরাং রাজনৈতিক স্বার্থে মন্দিরের জায়গায় মসজিদ বানানোর প্রপাগান্ডা যতই করা হোক ঐতিহাসিকভাবে তা প্রমাণ করা কখনো সম্ভব নয়।
ইংরেজ বেনিয়াদের কাছে সত্য-মিথ্যার পরোয়া ছিল না, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মনে মুসলিম-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে তারা পূর্ণ সফল হয়েছে। বস্ত্তত অযোধ্যার মসজিদ-মন্দির বিতর্ক ইংরেজ বেনিয়াদের প্রপাগান্ডারই ফসল।
একজন ঐতিহাসিকের প্রশ্ন করার অধিকার আছে যে, এই বিতর্ক মোঘল আমলে কেন হয়নি? তর্কের মানসিকতায় কেউ বলতে পারেন যে, ঐ সময় হিন্দুরা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল তাই তারা উচ্চবাচ্য করেনি, কিন্তু ইতিহাস বলে, এই জবাব বাস্তবসম্মত নয়। কারণ আকবর থেকে শুরু করে পরবর্তী মোঘল শাসকদের দরবারে বড় বড় রাজপুত সর্দার প্রভাবশালী অবস্থানে ছিলেন। দরবারে ও সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন কৃতিত্বের জন্য বহু পদ ও পদবীও তারা লাভ করেছিলেন, কিন্তু কখনো তারা অযোধ্যার মতো পবিত্র স্থানে মন্দির-অবমাননার অভিযোগ উত্থাপন করেননি; বরং একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, আজকের অযোধ্যা যত গুরুত্বপূর্ণ ঐ সময় তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এবং ঐ দিকে তীর্থ-যাত্রারও রেওয়াজ ছিল না। বৃটিশ আমলেই এই স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং মন্দির ধ্বংসের প্রসঙ্গ সৃষ্টি হয়। ষ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
টীকা : ত্রেতা : সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি-এই চার পৌরাণিক কালের দ্বিতীয় কাল, যা ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর বলা হয়ে থাকে।