রবিউল আউয়াল ১৪৪৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৪

মজলুম হওয়ার সুফল ধরে রাখি

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

জুলুম আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত ঘৃণিত হারাম কাজ। আল্লাহ তাআলা জুলুম করেন না এবং তিনি জুলুম ও জুলুমকারীকে পছন্দও করেন না। হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلى نَفْسِي، وَجَعَلْتُه بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا، فَلَا تَظَالَمُوا.

আমার বান্দারা! আমি নিজের জন্য জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের ক্ষেত্রেও জুলুম হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা একে অপরের প্রতি জুলুম করো না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭

জুলুমের পরিণতি বড় ভয়াবহ। জালেম তো মনে করে, জুলুম ও নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে সে মজলুমদের ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে এবং সফল হয়ে গেছে; অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

قُلْ یٰقَوْمِ اعْمَلُوْا عَلٰی مَكَانَتِكُمْ اِنِّیْ عَامِلٌ فَسَوْفَ تَعْلَمُوْنَ مَنْ تَكُوْنُ لَهٗ عَاقِبَةُ الدَّارِ اِنَّهٗ لَا یُفْلِحُ الظّٰلِمُوْنَ.

(হে নবী!) আপনি বলে দিন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আপন স্থানে নিজেদের কাজ করতে থাক, আমিও কাজ করছি। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কে লাভ করবে দুনিয়ার (শুভ) পরিণাম। নিশ্চয় জালেমরা সফল হবে না। -সূরা আনআম (৬) : ১৩৫

জালেমকে আল্লাহ কখনো কখনো ছাড় দেন, তবে ছেড়ে দেন না। কিন্তু হতভাগা জালেম এ ছাড় পেয়ে আরো উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে। সে ভেবে দেখে না, তার আগেও বহু জালেম ছিল, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

اَوَ لَمْ یَعْلَمْ اَنَّ اللهَ قَدْ اَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهٖ مِنَ الْقُرُوْنِ مَنْ هُوَ اَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَّ اَكْثَرُ جَمْعًا.

সে কি জানে না, আল্লাহ তার আগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এমন এমন ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা ছিল তার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং বেশি জনবলের অধিকারী? -সূরা কাসাস (২৮) : ৭৮

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تَحْسَبَنَّ اللهَ غَافِلًا عَمَّا یَعْمَلُ الظّٰلِمُوْنَ، اِنَّمَا یُؤَخِّرُهُمْ لِیَوْمٍ تَشْخَصُ فِیْهِ الْاَبْصَارُ مُهْطِعِیْنَ مُقْنِعِیْ رُءُوْسِهِمْ لَا یَرْتَدُّ اِلَیْهِمْ طَرْفُهُمْ، وَ اَفْـِٕدَتُهُمْ هَوَآءٌ.

তুমি কিছুতেই আল্লাহকে জালেমদের কৃতকর্ম সম্পর্কে বেখবর মনে করো না। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত ঢিল দিচ্ছেন, যেদিন চোখগুলো বিস্ফারিত হয়ে থাকবে। তারা নিজেদের মাথা ঊর্ধ্বে তুলে দৌড়াতে থাকবে। তাদের দৃষ্টি পলক ফেলার জন্য ফিরে আসবে না। (ভীতি বিহ্বলতার কারণে) তাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪২-৪৩

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ. قَالَ: ثُمَّ قَرَأَ: وَ كَذٰلِكَ اَخْذُ رَبِّكَ اِذَاۤ اَخَذَ الْقُرٰی وَ هِیَ ظَالِمَةٌ اِنَّ اَخْذَهٗۤ اَلِیْمٌ شَدِیْدٌ.

আল্লাহ জালেমকে অবকাশ দেন। এরপর যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন আর তাকে ছাড়েন না। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত পাঠ করেন-

وَ كَذٰلِكَ اَخْذُ رَبِّكَ اِذَاۤ اَخَذَ الْقُرٰی وَ هِیَ ظَالِمَةٌ اِنَّ اَخْذَهٗۤ اَلِیْمٌ شَدِیْدٌ.

[এমনই হয় তোমার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদসমূহকে পাকড়াও করেন এ অবস্থায় যে, তারা জুলুমে লিপ্ত। নিশ্চয় তাঁর পাকড়াও অতি মর্মন্তুদ, অতি কঠিন। -সূরা হূদ (১১) : ১০২] -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৩

তাই সবারই কর্তব্য জুলুম থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষত যাদের ওপর আল্লাহ তাআলা যমীনের শাসনভার ন্যস্ত করেছেন তাদের এ বিষয়ে আরো বেশি সতর্ক থাকা উচিত। মুআয ইবনে জাবাল রা.-কে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়েমেনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন তখন তাকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ করেছেন-

وَاتَّقِ دَعْوَةَ المَظْلُومِ، فَإِنَّهٗ لَيْسَ بَيْنَهٗ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ.

মজলুমের বদদুআ থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো আড়াল নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৯৬

শাসকের আশেপাশে যারা থাকে, তাদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের সম্পর্কেও হাদীস শরীফে কঠিন ধমকি রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

اسْمَعُوا، هَلْ سَمِعْتُمْ أَنَّهٗ سَتَكُونُ بَعْدِي أُمَرَاءُ، مَنْ دَخَلَ عَلَيْهِمْ فَصَدَّقَهُمْ بِكَذِبِهِمْ، وَأَعَانَهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ، فَلَيْسَ مِنِّي وَلَسْتُ مِنْهُ، وَلَيْسَ يَرِدُ عَلَيَّ الْحَوْضَ، وَمَنْ لَمْ يَدْخُلْ عَلَيْهِمْ، وَلَمْ يُصَدِّقْهُمْ بِكَذِبِهِمْ، وَلَمْ يُعِنْهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ، فَهُوَ مِنِّي وَأَنَا مِنْهُ، وَسَيَرِدُ عَلَيَّ الْحَوْضَ.

قال الترمذي : هذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ.

শোন! তোমরা কি শুনেছ, আমার পরে বিভিন্ন শাসক আসবে; যে ব্যক্তি তাদের কাছে গিয়ে তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিপাদন করবে এবং তাদের জুলুম-অত্যাচারে তাদের সহযোগিতা করবে, সে আমার নয় এবং আমিও তার নই। সে হাউযে (কাউসারে) আমার কাছে আসতে পারবে না। আর যে তাদের কাছে যাবে না, তাদের মিথ্যাকে সত্য প্রতিপাদন করবে না এবং তাদের জুলুম-নির্যাতনে তাদের সাহায্য করবে না, সে আমার এবং আমিও তার। সে হাউযে আমার কাছে আগমন করবে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪২০৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২২৫৯২২৫৯

মোটকথা, জালেমকে ও জালেমের দোসরদেরকে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত ঘৃণা করেন। অপরদিকে মজলুমের প্রতি তিনি বিশেষ করুণা বর্ষণ করেন। তাঁর ও মজলুমের মাঝে তিনি কোনো আড়াল রাখেন না। মজলুমের দুআ তিনি কখনো ফিরিয়ে দেন না। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

  ثَلاَثَةٌ لاَ تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ، وَالإِمَامُ العَادِلُ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ، يَرْفَعُهَا اللهُ فَوْقَ الغَمَامِ، وَيَفْتَحُ لَهَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ، وَيَقُولُ الرَّبُّ: وَعِزَّتِي لأَنْصُرَنَّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِينٍ.

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ.

অর্থাৎ তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ইফতারের আগ পর্যন্ত রোযাদারের দুআ, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ এবং মজলুমের দুআ। তার দুআকে আল্লাহ মেঘের ওপরে নিয়ে যান, তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেন আর আল্লাহ বলেন, আমার ইযযতের কসম! কিছু বিলম্বে হলেও অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫২

মজলুমের প্রতি আল্লাহ সাহায্যের ওয়াদা করেছেন। কিছুটা বিলম্বে হলেও আল্লাহ মজলুমকে সাহায্য করেন এবং সবশেষে তাকেই বিজয়ের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে জালেমকে পরাস্ত হতেই হয় এবং তার সমস্ত কূটকৌশল ভেস্তে যায়। ইতিহাসে এর বহু নজির আছে। কুরআন মাজীদে ফেরাউন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِی الْاَرْضِ وَ جَعَلَ اَهْلَهَا شِیَعًا یَّسْتَضْعِفُ طَآىِٕفَةً مِّنْهُمْ یُذَبِّحُ اَبْنَآءَهُمْ وَ یَسْتَحْیٖ نِسَآءَهُمْ اِنَّهٗ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِیْنَ، وَ نُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَ نَجْعَلَهُمْ اَىِٕمَّةً وَّ نَجْعَلَهُمُ الْوٰرِثِیْنَ، وَ نُمَكِّنَ لَهُمْ فِی الْاَرْضِ وَ نُرِیَ فِرْعَوْنَ وَ هَامٰنَ وَ جُنُوْدَهُمَا مِنْهُمْ مَّا كَانُوْا یَحْذَرُوْنَ.

নিশ্চয় ফেরাউন ভূমিতে উদ্ধত হয়ে উঠেছিল এবং তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের এক দলকে দুর্বল করে রেখেছিল। তাদের পুত্রদের সে জবাই করত আর তাদের নারীদের জীবিত ছেড়ে দিত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের একজন। আর আমি চাচ্ছিলাম, সে দেশে যাদের দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, তাদেরকে নেতা বানিয়ে দিতে এবং তাদেরকে (সে দেশের ভূমি ও সম্পদের) উত্তরাধিকারী করে দিতে। এবং (চাচ্ছিলাম,) সে দেশে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করতে আর ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যদেরকে সেই জিনিস দেখাতে, যার আশঙ্কা তারা তাদের (অর্থাৎ বনী ইসরাইলের) দিক থেকে করছিল।  -সূরা কাসাস (২৮) : ৪-৬

মজলুমের প্রতি মহান রাব্বুল আলামীনের যে বিশেষ করুণা ও সাহায্যের ওয়াদা- এটা মজলুমের মহা প্রাপ্তি, যেটা সে কেবল মজলুম হওয়ার কারণেই লাভ করেছে। আর এটাই মজলুম হওয়ার সুফল। তবে এ সুফল লাভ করা ও ধরে রাখার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, যেগুলো পূরণ করা জরুরিনতুবা সুফল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। নিম্নে এ ধরনের কিছু শর্ত ও করণীয় বিষয় উল্লেখ করা হল-

১. তাকওয়া, সবর ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা

আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিছুটা বিলম্বে হলেও তিনি মজলুমকে সাহায্য করবেন। তাই সংকটকালীন সময়টুকুতে তার করণীয় হল হতাশ ও ধৈর্যহারা না হওয়া; বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা, সবর করা এবং তাকওয়া অবলম্বন করা।

এ বিষয়গুলো যে কোনো সময়েই জরুরি; তবে মজলুম অবস্থায় আরো বেশি জরুরি। কুরআন মাজীদে মজলুমদেরকে এসব বিষয়ে বিশেষভাবে তাকীদ করা হয়েছে।

ফেরাউন যখন বনী ইসরাইলকে হত্যার ঘোষণা দিল তখন মূসা আলাইহিস সালাম তাদের এই বলে নসীহত করলেন-

اسْتَعِیْنُوْا بِاللهِ وَ اصْبِرُوْا اِنَّ الْاَرْضَ لِلهِ یُوْرِثُهَا مَنْ یَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ  وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِیْنَ.

তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও ও ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় ভূমি আল্লাহরতিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর শেষ পরিণাম মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকে। -সূরা আরাফ (৭) : ১২৮

অতএব মজলুমকে আল্লাহর নাফরমানী ও সবধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তি জুলুমের শিকার হলে ব্যক্তিকে গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে আর জাতি জুলুমের শিকার হলে পুরো জাতিকে গুনাহ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

২. জুলুম থেকে পরিত্রাণের পর আল্লাহর শোকর করা এবং তাঁর হুকুম মোতাবেক চলা

মজলুমিয়াতের সুফল এবং আল্লাহর করুণা ধরে রাখার জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে জালেমের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। অতএব এখন কর্তব্য হল, আল্লাহর শোকর করা, বাকি জীবন তাঁর হুকুম মোতাবেক চলা এবং নাফরমানীতে লিপ্ত না হওয়া। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে মুক্তির সুসংবাদ দেওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়েও সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহ তোমাদের মুক্ত করবেন, এরপর দেখবেন তোমরা কেমন আমল কর। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قَالُوْۤا اُوْذِیْنَا مِنْ قَبْلِ اَنْ تَاْتِیَنَا وَ مِنْۢ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا قَالَ عَسٰی رَبُّكُمْ اَنْ یُّهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَ یَسْتَخْلِفَكُمْ فِی الْاَرْضِ فَیَنْظُرَ كَیْفَ تَعْمَلُوْنَ.

তারা (বনী ইসরাঈল) বলল, আমরা আপনার আগমনের আগেও নির্যাতিত হয়েছি এবং আপনার আগমনের পরেও। তিনি (মূসা) বললেন, শীঘ্রই তোমাদের রব তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দেবেন এবং এ দেশে তোমাদেরকে (তাদের) স্থলাভিষিক্ত করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন আমল কর। -সূরা আরাফ (৭) : ১২৯

কিন্তু হতভাগা বনী ইসরাইল সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করল। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ جٰوَزْنَا بِبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ الْبَحْرَ فَاَتَوْا عَلٰی قَوْمٍ یَّعْكُفُوْنَ عَلٰۤی اَصْنَامٍ لَّهُمْ  قَالُوْا یٰمُوْسَی اجْعَلْ لَّنَاۤ اِلٰهًا كَمَا لَهُمْ اٰلِهَةٌ  قَالَ اِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُوْنَ، اِنَّ هٰۤؤُلَآءِ مُتَبَّرٌ مَّا هُمْ فِیْهِ وَ بٰطِلٌ مَّا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ، قَالَ اَغَیْرَ اللهِ اَبْغِیْكُمْ اِلٰهًا وَّ هُوَ فَضَّلَكُمْ عَلَی الْعٰلَمِیْنَ.

আমি বনী ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। এরপর তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছল, যারা তাদের মূর্তিপূজায় রত ছিল। (তখন) বনী ইসরাইল বলল, মূসা! এদের যেমন দেবতা আছে, তেমনি আমাদের জন্যও কোনো দেবতা বানিয়ে দিন। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় তোমরা মূর্খ লোক!নিশ্চয় এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তারা যা করছে সবটাই ভ্রান্ত। তিনি (আরো) বললেন, আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য খুঁজে আনব? অথচ তিনিই তোমাদের সমগ্র বিশ্ববাসীর  ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন? -সূরা আরাফ (৭) : ১৩৮-১৪০

সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতে আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনি বনী ইসরাইলকে কিতাবের মাধ্যমে এ কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ঘোর অহংকার প্রদর্শন করবে। দুইবারই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে অন্য পরাক্রমশালী জাতি দ্বারা ধ্বংস করেছেন এবং চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করেছেন। সেইসঙ্গে তাদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন-

وَ اِنْ عُدْتُّمْ عُدْنَا  وَ جَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكٰفِرِیْنَ حَصِیْرًا.

যদি তোমরা পুনরায় (তা-ই) কর, তবে আমিও আবার (তা-ই) করব। আর আমি জাহান্নামকে কাফেরদের জন্য কারাগার বানিয়ে রেখেছি। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮

আমাদের অবস্থা যেন কখনো এই বনী ইসরাইলের মতো না হয়। বরং আমরা যেন সাহাবায়ে কেরামের অনুসারী হই। সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-

اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَ لِلهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ.

তারা এমন যে, আমি যদি দুনিয়ায় তাদের ক্ষমতা দান করি, তবে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে। সব কিছুর পরিণতি আল্লাহরই হাতে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৪১

৩. সীমালঙ্ঘন না করা ও সীমালঙ্ঘনে সহযোগিতা না করা

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আল্লাহ তাআলা মজলুমকে অনুমতি দিয়েছেন, সে জুলুম থেকে রক্ষা পেতে এবং নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে ন্যায়সঙ্গতভাবে চেষ্টা-তদবির এবং প্রতিবাদ ও প্রতিহত করতে পারবে। এটা করতে গিয়ে সে যদি মারাও যায়, সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে।

কাবুস ইবনে মুখারিক তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি নবীজীর নিকট এসে বলল-

أَرَأَيْتَ إِنْ أَتَانِي رَجُلٌ يَأْخُذُ مَالِي؟

যদি কেউ আমার কাছে এসে আমার সম্পদ (অন্যায়ভাবে) নিয়ে যেতে চায়, তাহলে আমি কী করব?

নবীজী বললেন-

تُذَكِّرُه بِاللهِ.

তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

সে বলল, তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও যদি সে বিরত না হয়? নবীজী বললেন-

تَسْتَعِينُ عَلَيْهِ بِالسُّلْطَانِ.

তার বিষয়ে বাদশার কাছে সাহায্য চাইবে।

লোকটি বলল, যদি বাদশা দূরে থাকেন? নবীজী বললেন-

تَسْتَعِينُ عَلَيْهِ بِالْمُسْلِمِينَ.

তাহলে সাধারণ মুসলমানদের কাছে তার বিরুদ্ধে সাহায্য চাইবে।

লোকটি বলল, যদি মুসলমানদের কেউ তখন আমার কাছে না থাকে আর এরই মধ্যে সে আমার সম্পদ নিয়ে যেতে চায়?

তখন নবীজী বললেন-

فَقَاتِلْ حَتَّى تَحْرُزَ مَالَكَ، أَوْ تُقْتَلَ فَتَكُونَ فِي شُهَدَاءِ الْآخِرَةِ.

তাহলে (তার সাথে) লড়াই করবে; এতে হয় তুমি তোমার সম্পদ রক্ষা করতে পারবে আর না হয় মৃত্যুবরণ করবে, ফলে তুমি আখেরাতে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৫১৪

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল-

يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَأَيْتَ إِنْ جَاءَ رَجُلٌ يُرِيدُ أَخْذَ مَالِي؟

আল্লাহর রাসূল! কেউ যদি এসে (অন্যায়ভাবে) আমার সম্পদ নিয়ে যেতে চায়?

তিনি বললেন-

فَلَا تُعْطِه مَالَكَ.

তাকে তুমি তোমার সম্পদ দেবে না।

লোকটি বলল-

أَرَأَيْتَ إِنْ قَاتَلَنِي؟

যদি সে আমার সাথে লড়াই করে?

তিনি বললেন-

قَاتِلْهُ.

তাহলে তুমিও তার সাথে লড়াই করবে।

সে বলল-

أَرَأَيْتَ إِنْ قَتَلَنِي؟

যদি সে আমাকে মেরে ফেলে?

তিনি বললেন-

فَأَنْتَ شَهِيدٌ.

তাহলে তুমি শহীদ।

সে বলল-

أَرَأَيْتَ إِنْ قَتَلْتُه؟

যদি আমি তাকে মেরে ফেলি?

তিনি বললেন-

هُوَ فِي النَّارِ.

তাহলে সে জাহান্নামী। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪০

সাঈদ ইবনে যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِه فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دِينِه فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دَمِه فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِه فَهُوَ شَهِيدٌ.

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.

যে তার সম্পদ রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। যে তার দ্বীন রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। যে তার প্রাণ রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। এবং যে তার পরিবার রক্ষায় মৃত্যুবরণ করবে সে শহীদ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৭৭২

তবে সেইসঙ্গে আল্লাহ তাআলা সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, জালেমের প্রতিও সীমালঙ্ঘন করা যাবে না; বরং তার সঙ্গেও ইনসাফ ও ন্যায়ের আচরণ করতে হবে।

মক্কার মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কত নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। কত সাহাবীকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। তাদেরকে ঘরছাড়া, দেশছাড়া, সম্পদছাড়া এবং পরিবারছাড়া করেছে। মসজিদে হারাম, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রবেশের অনুমতি ছিল, সেখানেও তাঁদের যেতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ হল, তোমরা তাদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করবে না। আর কেউ যদি সীমালঙ্ঘন করতে চায়, তাকে তোমরা সাহায্য করবে না। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ اَنْ صَدُّوْكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اَنْ تَعْتَدُوْا وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ شَدِیْدُ الْعِقَابِ.

অর্থাৎ তোমাদেরকে মসজিদে হারামে (প্রবেশ করতে) বাধা দিয়েছিল, এই কারণে (বাধাদানকারী) সম্প্রদায়ের প্রতি তোমাদের যে শত্রুতা, তা যেন তোমাদেরকে (তাদের প্রতি) সীমালঙ্ঘন করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ায় পরস্পরকে সাহায্য করবে; গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা। -সূরা মায়িদা (৫) : ২

আরো ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِیْنَ لِلهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوْا اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমরা একমাত্র আল্লাহর জন্য (তাঁর বিধানের) পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকারী (এবং) ইনসাফের সঙ্গে সাক্ষ্যপ্রদানকারী হয়ে যাও। আর কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ইনসাফ কর; এটাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। আর আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। -সূরা মায়িদা (৫) : ৮

সীমালঙ্ঘন থেকে বাঁচার উপায়

ক. পারতপক্ষে লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত না হওয়া

ইসলাম ঝগড়া-বিবাদ পছন্দ করে না। তাই লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়ে অন্য কোনো উপায়ে যদি জুলুম থেকে আত্মরক্ষা করা এবং নিজের হক আদায় করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই করা কর্তব্য। বরং যে ব্যক্তি সাধারণ দুনিয়াবী কোনো বিষয়ে লড়াই-ঝগড়া থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নিজের হকের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়, তার জন্য হাদীসে মহা পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে। আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا.

যে ব্যক্তি হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করে আমি তার জন্য জান্নাতের পাদদেশে একটি প্রাসাদের যিম্মাদারি নিলাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮০০

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ، وَلَا عَفَا رَجُلٌ عَنْ مَظْلَمَةٍ إِلَّا زَادَهُ اللهُ بِهَا عِزًّا، وَلَا تَوَاضَعَ عَبْدٌ للهِ إِلَا رَفَعَهُ اللهُ.

কোনো সদকা সম্পদ কমায় না। কেউ কোনো জুলুম ক্ষমা করে দিলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই এর মাধ্যমে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আর কোনো বান্দা আল্লাহর জন্য বিনয়ী হলে আল্লাহ তাকে উঁচু করে দেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭২০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২০২৯

খ. জালেম থেকে বদলা নিতে চাইলে অবশ্যই শরীয়তের যাবতীয় নীতি ও বিধান রক্ষা করে নিতে হবে, তবে ক্ষমার আচরণ করাটাই সর্বোত্তম

জালেমের প্রতি নিজেদের মনের ঝাল মেটানোর জন্য যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বা কাজ করা হয়, এর দ্বারা কিন্তু মজলুমিয়াতের সুফল কমে যায়। জালেম থেকে বদলা নিতে চাইলে বদলা নেওয়ার সুযোগ আছে, তবে অবশ্যই তা হবে শরীয়তের সীমারেখার ভেতরে থেকে। জালেম থেকে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শরীয়তের কোনো নীতি ও বিধান লঙ্ঘন করা যাবে না। বরং শরীয়তের যাবতীয় উসূল ও আহকাম রক্ষা করেই প্রতিশোধ নিতে হবে। আর কেউ যদি ক্ষমার আচরণ করে তবে তার জন্যও রয়েছে প্রতিদান। ইরশাদ হয়েছে-

وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَةٍ سَیِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَ اَصْلَحَ فَاَجْرُهٗ عَلَی اللهِ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَ، وَ لَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ مَا عَلَیْهِمْ مِّنْ سَبِیْلٍ، اِنَّمَا السَّبِیْلُ عَلَی الَّذِیْنَ یَظْلِمُوْنَ النَّاسَ وَ یَبْغُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ  اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ، وَ لَمَنْ صَبَرَ وَ غَفَرَ اِنَّ ذٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْاُمُوْرِ.

মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ। তবে যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপোষ-নিষ্পত্তি করে নেয়, তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায়। নিশ্চয় তিনি জালেমদের পছন্দ করেন না।

যারা নিজেদের ওপর জুলুম হওয়ার পর (সমপরিমাণে) বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এরূপ লোকদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।

আর যে ধৈর্যধারণ করে ও ক্ষমা করে দেয়, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত দৃঢ় মনোবলের কাজ। -সূরা শূরা (৪২) : ৪০-৪৩

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَ لْیَعْفُوْا وَ لْیَصْفَحُوْا اَلَا تُحِبُّوْنَ اَنْ یَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ  وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

তারা যেন ক্ষমা করে ও মার্জনা করে। তোমরা কি চাও না, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন? আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা নূর (২৪) : ২২

গ. মজলুম যেন জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়

মজলুম যদি জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে মজলুমিয়াতের সমস্ত সুফল একদম বরবাদ হয়ে যায়। তখন মজলুম আর মজলুম থাকে না, বরং সে নিজেও জালেম হয়ে যায়। ফলে জালেমের যত শাস্তি ও ধমকি কুরআন-সুন্নাহ্য় বর্ণিত হয়েছে, সব তার ওপরেও পতিত হবে।

জালেম হয়তো কারো থেকে অন্যায়ভাবে জমি আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু যখন সুযোগ আসল তখন মজলুম জালেমের গোটা বাড়িই জ্বালিয়ে দিল। এতে তার পরিবারের অন্যান্য নিরপরাধ লোকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হল।

জালেম হয়তো কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করল বা তার অঙ্গহানি করল। পরবর্তীতে মজলুম সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে জালেমকে জানেই মেরে ফেলল।

মনে রাখতে হবে, এই সবই জুলুম। এগুলোর কারণে মজলুমের মজলুমিয়াত তো নষ্ট হবেই, উল্টো এখন সে নিজেও জালেম। ফলে তাকেও এখন জুলুমের শাস্তি ভোগ করতে হবে- দুনিয়াতে এবং আখেরাতে।

জালেম যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, তাহলে তার থেকে কিসাস ও বদলা নেওয়ার অধিকার আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। নিহত ব্যক্তির অভিভাবক ও ওয়ারিসগণ সরকারকে বলে ও আদালতে গিয়ে কিসাস গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোনো ধরনের সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। যেমন : শরীয়তের বিধান ও আইন অমান্য করা, হত্যাকারীর পরিবার বা তার দলের অন্য কাউকে হত্যা করা বা নির্যাতন করা ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِیْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ وَ مَنْ قُتِلَ مَظْلُوْمًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِیِّهٖ سُلْطٰنًا فَلَا یُسْرِفْ فِّی الْقَتْلِ  اِنَّهٗ كَانَ مَنْصُوْرًا.

তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, যার হত্যা আল্লাহ হারাম করেছেন, তবে যথাযথ কারণ হলে (ভিন্ন কথা)। আর যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় আমি তার অভিভাবককে (কিসাস গ্রহণের) অধিকার দিয়েছি। সুতরাং সে যেন হত্যার বিষয়ে সীমালঙ্ঘন না করে। সে তো সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৩

সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন-বিক্ষোভ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও স্থাপনা ধ্বংস, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এবার তো দেখা গেল, আন্দোলন চলাকালে ও সরকার পতনের পরও এ ধারা বেশ কয়েকদিন অব্যাহত ছিল। ইসলামের শিক্ষা হলÑ مَلَكْتَ فَأَحْسِنْ অর্থাৎ সুযোগ পেলে, তো সদ্ব্যবহার কর। সুযোগের অসদ্ব্যবহার অন্যায়। কিন্তু এসব মুহূর্তে কত জায়গায় কতভাবে যে সুযোগের অন্যায় ব্যবহার হতে থাকে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কে না জানে, কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিক না কোনো ব্যক্তি, না কোনো সরকার। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিক হল সমগ্র জাতি। সুতরাং এগুলো মস্তবড় আমানত। এগুলো ধ্বংস করা বা নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে জুলুম, আমানতের খেয়ানত এবং আত্মসাৎ। এটা কবীরা গুনাহ। কেউ এমনটা করে থাকলে তার কর্তব্য হল অনুতপ্ত হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা করা। সেইসঙ্গে নিয়ে যাওয়া জিনিস ফেরত দেওয়া আর ভাঙচুর বা ধ্বংস করে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়াঅবশ্য ইতিমধ্যে কেউ কেউ নিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র ফেরত দিয়েছেন, যা প্রশংসনীয়।

জুলুমের এ ধারা বন্ধ হোক

আমাদের এ অঞ্চলে যারাই ক্ষমতায় আসে, প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম করে। ক্ষমতার পালাবদল হয়, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না। আজকে যে মজলুম, কালকেই সে জালেম। কেউ বেশি জুলুম করে, কেউ কম জুলুম করে। কিন্তু জুলুম আছেই। বলি, এভাবে আর কতকাল? এবার অন্তত জুলুমের ধারা বন্ধ হোকসমাজে শান্তি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হোক।

এভাবে যদি পালাক্রমে আমাদের এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করতেই থাকে এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এই ধারা চলতেই থাকে, তাহলে বহিঃশত্রুদের কাছে আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে। তখন আমাদের আর কোনো শক্তি থাকবে না। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের জন্য দুআ করতে গিয়ে বলেছেন-

وَأَنْ لَا يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ.

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেন তাদের ওপর বাইরের এমন কোনো শত্রু চাপিয়ে না দেন, যারা তাদের সমষ্টিকে বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস করে দেবে।

উত্তরে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَأَنْ لَا أُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، يَسْتَبِيحُ بَيْضَتَهُمْ، وَلَوِ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مَنْ بِأَقْطَارِهَا -أَوْ قَالَ مَنْ بَيْنَ أَقْطَارِهَا- حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا، وَيَسْبِي بَعْضُهُمْ بَعْضًا.

যে পর্যন্ত না তারা (অর্থাৎ মুসলিমরা) একে অপরকে ধ্বংস করবে ও বন্দি করবে, আমি তাদের ওপর বাইরের এমন কোনো শত্রু চাপিয়ে দেব না, যারা তাদের সমষ্টিকে বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম হবে, যদিও বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন তাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়ে চেষ্টা করে না কেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৮৯

ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত

ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী (৫৭৮-৬৫৬ হি.) রাহ. তাঁর ভাষ্যগ্রন্থে এ হাদীসের ব্যাখ্যা করে লিখেছেন-

وحاصلُ هذا أنه إذا كان من المسلمين ذلك تفرَّقت جماعتُهم، واشتغل بعضُهم ببعض عن جهاد العدو، فقويت شوكةُ العدو، واستولى، كما شاهدناه في أزماننا هذه في المشرق والمغرب، وذلك أنَّه لما اختلف ملوكُ الشرق وتجادلوا استولى كافرو الترك على جميع عراق العجم، ولما اختلف ملوكُ المغرب وتجادلوا استولت الإفرنجُ على جميع بلاد الأندَلُس، والجُزُرِ القريبة منها، وها هم قد طمعوا في جميع بلاد الإسلام، فنسألُ اللهَ أن يتدارك المسلمين بالعفو والنصر واللطف.

সারকথা এইÑ মুসলমানরা যখন এমনটা  করবে তখন তাদের ঐক্য ভেঙে যাবে এবং তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই ছেড়ে একে অপরের পেছনে লেগে থাকবে। ফলে শত্রুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে এবং তারা মুসলমানদের পরাভূত করে ফেলবে। যেমনটা আমরা আমাদের এ যুগে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে দেখতে পেলাম। প্রাচ্যের (মুসলিম) বাদশারা যখন পরস্পর বিবাদ ও কলহে লিপ্ত হল তখন তাতারীরা সমগ্র পারস্য (ইরাক) দখল করে ফেলল। আর পাশ্চাত্যের (মুসলিম) বাদশারা যখন পরস্পর দ্বন্দ্ব ও কলহে জড়াল তখন ইংরেজরা সমগ্র আন্দালুস ও পাশর্^বর্তী দ্বীপগুলো দখল করে নিল। আর এখন তো তারা গোটা মুসলিম বিশ্বই গ্রাস করে নেওয়ার ইচ্ছা করেছে। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ক্ষমা করুন, তাদের প্রতি দয়া করুন এবং তাদের সাহায্য করুন। -আলমুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম, আবুল আব্বাস কুরতুবী ৭/২১৮

সেজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-

وَ اَطِیْعُوا اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَ تَذْهَبَ رِیْحُكُمْ وَ اصْبِرُوْا اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পরে বিবাদ করো না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব নিঃশেষ হয়ে যাবে। তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। -সূরা আনফাল (৮) : ৪৬

আমাদের এই ভুল কবে ভাঙবে? আর কতকাল পরে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরব?

আরেকটা কথা। সোশ্যালিজম ও কমিউনিজমের অসারতা বুঝতে ইউরোপীয়দের প্রায় সত্তর বছর লাগল। এখন এ পশ্চিমা গণতন্ত্রের অসারতা বুঝতে আমাদের আর কত বছর লাগবে? যে গণতন্ত্র দেশের জনগণকে একটা অনিবার্য দলাদলি ও বিরোধ-বিভেদের দিকে ঠেলে দিল এবং দেশের মানুষকে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করে ফেলল, সে গণতন্ত্রের ভ্রান্তি বুঝতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? আর কত হানাহানি, রক্তপাত ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর আমরা বুঝতে পারব, আমরা আসলে ভুল পথে চলেছি? এখনো কি সময় হয়নি আল্লাহর দিকে ফিরে আসার? এখনো কি সময় হয়নি আল্লাহর আইনের দিকে প্রত্যাবর্তন করার?

اَلَمْ یَاْنِ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ، وَ لَا یَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ، وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ.

ঈমানদারদের কি এখনো সেই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে- আল্লাহর স্মরণের প্রতি এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি? এবং তারা ওদের মতো হবে না, যাদের ইতিপূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যখন তাদের ওপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন  তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল। এবং তাদের অনেকেই (চরম) অবাধ্য। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৬

اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِیَّةِ یَبْغُوْنَ، وَ مَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ یُّوْقِنُوْنَ.

তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধান চায়? আর বিশ্বাসী মানুষদের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কে আছে? -সূরা মায়িদা (৫) : ৫০

তাই আসুন! আমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করি। আল্লাহর আইনের ছায়ায় একত্রিত হই। সবধরনের জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করি এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পাঠ গ্রহণ করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন- আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

 

advertisement