রবিউল আউয়াল ১৪৪৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৪

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ॥
সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. হাফেজ্জী হুজুর স্মারকগ্রন্থেতাঁর নূরিয়া-জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তখন নূরিয়ায় আসতেন সপ্তাহে দুই-এক দিন। আসার কথা নয়, এমন একদিন মাগরিবের সময় দেখি- হুজুর মসজিদে। কিছুটা অবাক হলাম। এরপর মাগরিবের নামায শেষ করে এই ভেবে কামরায় চলে গেলাম যে, হুজুরের নামায শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণ কামরায় গিয়ে মুতালাআ করতে থাকি।

কামরায় গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন তালিবুল ইলম এসে জানাল, হাফেজ্জী হুজুর রাহ. পুকুর ঘাটে বসে আছেন। আমাকে সেখানে যেতে বলেছেন।

হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সাধারণত মাগরিবের নামাযের পর দীর্ঘক্ষণ আওয়াবীন পড়তেন। কিন্তু সেদিন নামায সংক্ষিপ্ত করেছেন, এরপর পুকুর ঘাটে গিয়ে বসেছেন- বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল।

আমি সেখানে গিয়ে হুজুরের সঙ্গে সালাম-মুসাফাহার পর তাঁর পায়ের কাছে মাটিতে বসে গেলাম। আরজ করলাম, আজ হঠাৎ হুজুরের নূরিয়ায় আসা এবং মাগরিবের পর আওয়াবীন সংক্ষেপ করে ঘাটলায় বসাÑ এসব কারণে মনে হচ্ছে হয়তো হুজুরের কোনো পেরেশানী আছে!

তিনি বললেন, হাঁ পেরেশানী হচ্ছে। আমার কানে এসেছে- অমুক অমুক শিক্ষক মাদরাসা থেকে চলে যেতে চাচ্ছেনএ বিষয়ে আমার কোনো কথা নেই, কোনো পরোয়াও নেই। আমি শুধু বলতে এসেছি, আপনি কিন্তু যাবেন না।

হুজুরের এই কথায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম! কতটুকু স্নেহ করলে তিনি আমাকে এই কথাটুকু বলার জন্য এখানে চলে এসেছেন! তখন আমার উত্তর শুনে হুজুর নিশ্চিন্ত হলেন, এরপর চলে গেলেন।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. যতদিন দুনিয়ায় ছিলেন, পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. মাদরাসায়ে নূরিয়া ছেড়ে যাননি। হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকালের ৩ বছর পর, ১৪১০-১১ হিজরী শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিকে, ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে তিনি পূর্ণ এক বছরের ছুটি চেয়ে নূরিয়া থেকে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেই ছুটিকেই তিনি স্থায়ী ছুটি হিসেবে গ্রহণ করেন। (পৃ. ৩৭১-৩৭২)

নূরিয়া-পরবর্তী জীবন

নূরিয়া থেকে চলে আসার পর তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর দ্বিতীয় ছাহেবযাদা হাফেয উবায়দুল্লাহ ছাহেব রাহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা-ই-আরাবিয়া মিফতাহুল উলূমে ২/৩ মাস থাকেন। মাদরাসাটি ঢাকার আলুবাজার সুবেদারঘাট জামে মসজিদ সংলগ্ন।

উল্লেখ্য, হাফেয উবায়দুল্লাহ ছাহেব রাহ. যেই হজ্বের সফরে বিমান দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন, সেই সফরে যাওয়ার আগে তিনি মাদরাসাটির সম্পূর্ণ যিম্মাদারি হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর কাছে সোপর্দ করে যান।

এখানে দুই-তিন মাস খেদমত করার পর হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অন্যতম খলীফা ও জামাতা হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের দাওয়াতে মিরপুরের মুসলিম বাজার এমদাদিয়া মাদরাসায় যোগদান করেন। সেখানে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষক হিসেবে খেদমত করেন। মাদরাসাটি তখন ছিল হেদায়াতুন্নাহু জামাতপর্যন্ত। হুজুর সেখানে হেদায়াতুন্নাহুকিতাবের দরস দেন।

সেবছর প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর হাজ্বী সিরাজুদ্দৌলা সাহেবের উপর্যুপরি অনুরোধে তিনি মুহাম্মাদপুরের জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ায় চলে আসেন। তবে মুসলিম বাজার মাদরাসায় তখনো আসা-যাওয়া করে দরস করাতেন। এভাবে একটানা আরো কয়েক বছর দরস করিয়েছেন। পরবর্তীতে সেখানে আরো ৩/৪ বছর সহীহ বুখারীর কিছু অংশ পড়িয়েছেন। সেটা ২০০০ থেকে ২০০২/৩ সালের কথা।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর তিনি জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় খেদমত করেন। সেটা ছিল ১৪১১/১২ হিজরী শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি থেকে ১৪১৫/১৬ হিজরী শিক্ষাবর্ষের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ে তিনি সেখানে সহীহ বুখারী ২য় খণ্ড, সহীহ মুসলিম ১ম খণ্ড, ইলমুস সিগাহ, হেদায়াতুন্নাহু ইত্যাদি কিতাবের দরস প্রদান করেন। সেইসঙ্গে প্রায় দুই বছর মুহতামিম হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন হযরত মাওলানা সুলাইমান নুমানী ছাহেব, হযরত মাওলানা আযীমুদ্দীন ছাহেব, হযরত মাওলানা আবদুর রায্যাক ছাহেব (মানিকগঞ্জী হুজুর) ও মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম প্রমুখ উলামায়ে কেরাম

১৪১৫/১৬ হিজরী শিক্ষাবর্ষের শেষে যখন তাঁর উস্তায শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. জানতে পারেন যে, তিনি আগামী বছর জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় থাকবেন না, তখন খুব মহব্বতপূর্ণ ভাষায় তাঁকে জামিয়া রাহমানিয়ায় খেদমত করার দাওয়াত দেন। সেমতে ১৪১৬/১৭ হিজরী শিক্ষাবর্ষ মোতাবেক ১৯৯৬ সালে তিনি জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ায় যোগদান করেন।

একই সময় ঢাকার প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া হুসাইনিয়া আশরাফুল উলূম বড় কাটরা মাদরাসায়ও দুটি দরসের যিম্মাদারি গ্রহণ করেন। সহীহ বুখারী ২য় খণ্ড ও হেদায়াতুন্নাহু। প্রেক্ষাপট ছিল এই যে, তিনি যখন জামিয়া মুহাম্মাদিয়া থেকে চলে আসেন তখন বড় কাটরা মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অন্যতম খলীফা হযরত মাওলানা আবদুল বারী ছাহেব রাহ.। তিনি হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-কে বড় কাটরায় নিতে খুব আগ্রহী ছিলেন। ওদিকে পাহাড়পুুরী হুজুর রাহ.-এর আব্বাজান হযরত মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব রাহ. যেহেতু একসময় বড়কাটরায় শিক্ষকতা করেছেন, সেজন্য এই মাদরাসার প্রতি হুজুরেরও একধরনের টান ছিল। সেজন্য তিনি জামিয়া রাহমানিয়ার সাথে সাথে বড় কাটরার দাওয়াতও কবুল করেন।

সেসময় দুপুরের দিকে বড় কাটরায় গিয়ে বুখারী সানী পড়াতেন। আসরের আগে পড়াতেন হেদায়াতুন্নাহু। এরপর জামিয়া রাহমানিয়ায় এসে মাগরিবের পর বুখারী সানী দরস করাতেন। এভাবেই চলেছে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।

১৯৯৯ সালে হযরত মাওলানা আবদুল বারী ছাহেব রাহ. বড় কাটরা থেকে চলে যান। তখন হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-ও সেখান থেকে রুখসত নিয়ে নেন।

২০০০ সালের কথা। সেবছর জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ায় দাওরায়ে হাদীসের সবক শুরু হয়। এসময় মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আবদুর রউফ ছাহেব রাহ. শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. ও হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-কে ওখানে বুখারী পড়ানোর জন্য জোর আবদার করেন। তাঁরা সেই আবদার মঞ্জুর করেন। সেমতে হযরত শাইখুল হাদীস ছাহেব রাহ. পড়াতেন বুখারী ১ম খণ্ডের কিছু অংশ। পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. সম্পূর্ণ ২য় খণ্ড।

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. তখনো জামিয়া রাহমানিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে পড়াতেন। অর্থাৎ ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছর তিনি জামিয়া রাহমানিয়ায় শায়খে সানী হিসেবে দরসের খেদমত করেছেন।

এভাবে ২০০০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তিনি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে লালমাটিয়ায় দরস করিয়েছেন। ২০০৯ থেকে এমন হয় যে, তিনি যেটুকু পড়াতে পারেন পড়ান; বাকিটুকু তাঁর পক্ষ থেকে পড়ান তাঁর মেজো ছাহেবযাদা মাওলানা আবরারুযযামান ছাহেব। এভাবে ২০১৪ সালে তিনি সর্বশেষ দরস করাতে পেরেছেন। তবে তখন তিনি খুবই অসুস্থ। ফলে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাগজে কলমে যিম্মাদারি তাঁর নামে থাকলেও যিম্মাদারি পালন করেছেন তাঁর ছাহেবযাদা মাওলানা আবরারুযযামান ছাহেব। অদ্যাবধি তিনিই এই খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন

কুরআনের খেদমত ও নূরিয়া কায়দা

বাংলাদেশে কুরআনের খেদমত ও খাদেমে কুরআন তৈরির লক্ষ্যে যে সকল মনীষী জীবনব্যাপী মেহনত করে গেছেন তাঁদের অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.। তৎকালীন বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠার এক মহান স্বপ্ন নিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর অনেক শাগরিদ, মুরীদ ও সোহবতধন্য মনীষীরাও পরম আবেগে গ্রহণ করেছিলেন এই চেতনা। কুরআনের খেদমত ও মক্তব প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে তাঁরাও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কেউ কেউ পুরো জীবন ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন এই কাজের জন্য। তন্মধ্যে হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব সাহেব রাহ. ও হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রাহ. প্রমুখ মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সদর সাহেব হুযূর হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ. ও হযরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর মতো মহান ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানেই তখন নূরানীনাদিয়ানামে সহজে কুরআন শিক্ষার দুটি পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। যে দুই পদ্ধতিতে এদেশে লাখ লাখ শিশু কিশোর এবং সব বয়সের অসংখ্য নারী-পুরুষ বিশুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ শিক্ষা লাভ করে।

নূরানী ও নাদিয়ার মাঝে কিছু নিয়ম ও চিন্তাগত পার্থক্য থাকার বিষয়ে কেউ কোনো আপত্তি পেশ করলে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বলতেন, ‘একই নদীতে একাধিক গুদারাঘাট থাকলে সাধারণ মানুষের উপকার হয়। যে যার পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী ঘাট ব্যবহার করে নদী পার হওয়ার সুযোগ পায়।’  মূলত এজাতীয় চিন্তা থেকেই তখন নূরিয়া পদ্ধতিনামে আরেকটি শিক্ষা পদ্ধতি প্রস্তুত করা হয়। যার জন্য হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. নিজেই লোক ঠিক করে দেন। আপন দুই জামাতা হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. ও হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাহেব দামাত বারাকাতুহুমকে এই কাজের দায়িত্ব দেন। তাঁরা হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর নির্দেশ ও নির্দেশনায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। বর্তমানের নূরিয়া কায়দাসেই মেহনতেরই প্রকাশিত রূপ।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর দ্বিতীয় ছাহেবযাদা হাফেয উবায়দুল্লাহ ছাহেব রাহ. ইন্তেকালের আগে ঢাকার আলুবাজারস্থ যে মাদরাসাটির যিম্মাদারি হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর ওপর ন্যস্ত করে যান, সেই মাদরাসায় কেবল মক্তব ও হেফয বিভাগের পড়াশোনা ছিল। এখন পর্যন্ত এই দুই বিভাগই আছে। কিন্তু এই ছোট্ট মাদরাসাটি ছিল হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর চিন্তা ও স্বপ্নের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. নূরিয়া মাদরাসায় থাকাকালেই এখানের যিম্মাদারি পালন করতে শুরু করেন। নূরিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের পর কয়েক মাস স্বতন্ত্রভাবে এখানে থাকেন। পরবর্তীতে অন্যান্য মাদরাসায় যোগদান করলেও এখানে আসা-যাওয়া অব্যাহত রাখেন এবং প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় বিষয় তদারকি করেন।

১৯৮০/৮১ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর নির্দেশে যখন নূরিয়া কায়দাপ্রস্তুত করা হয় তখন থেকেই এই মাদরাসায় সেই কায়দা পড়ানো হয়।

নতুন একটি কিতাব নূরিয়া কায়দাবাচ্চাদের কিতাব। তাছাড়া বিশেষ একটি লক্ষ্য সামনে রেখে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। তাই শুরু থেকেই এর পাঠদান পদ্ধতি বিষয়ে স্বতন্ত্র তাদরীব বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেজন্য হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর নির্দেশে ১৯৮১ সালের রমযানে হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম প্রথম প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এরপর নূরিয়াসহ অন্য অনেক জায়গায় নিয়মিত এই প্রশিক্ষণ হতে থাকে। সেইসঙ্গে কায়দার ভেতরেও বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে থাকে।

১৯৯৫ সালে, হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. যখন জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায়, তখনকার কথা। পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. এই কায়দাও এর পাঠদান পদ্ধতি বিষয়ে নতুনভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার অংশ হিসেবে মুআল্লিম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেন। তখন একবার জামিয়া মুহাম্মাদিয়াতেই তাঁর একান্ত তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ হয়। সেখানে ১৭/১৮ জন মুআল্লিম অংশগ্রহণ করেন। এরপরের রমযানে প্রশিক্ষণ হয় কুমিল্লার পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম মাদরাসায়। তারপর ঢাকার আলুবাজারস্থ মাদরাসা-ই-আরাবিয়া মিফতাহুল উলূম’-এ। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রতি রমযান মাসে এখনো এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. একসময় কুরআনের খেদমতকে ব্যাপক ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সেজন্য ১৪০৫ হিজরীর ২১ যিলকদ মোতাবেক ১৯৯৫ সালের ৮ মার্চ আল-মারকাযুল ইলমী বাংলাদেশনামে একটি ইদারা প্রতিষ্ঠা করেন।

শুরুর দিকে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। তাই আলুবাজার মাদরাসাতেই তার দাপ্তরিক কার্যক্রম চলতে থাকে। সেইসঙ্গে তিনি বড় পরিসরের একটি জায়গা খুঁজতে থাকেন এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রতিষ্ঠানটির কবুলিয়্যাতের জন্য দুআ ও রোনাযারী করতে থাকেন। তখন ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন দিকে জমি দেখা হয়।

একপর্যায়ে ২০০০ সালে ঢাকার পাশর্^বর্তী জেলা মানিকগঞ্জে  অল্প একটু জমি সংগ্রহ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা হয় মোট ৮৯ শতাংশ জায়গা।

২০০৪ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে সেখানে মাদরাসা দারুল কুরআনপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি আল-মারকাযুল ইলমী বাংলাদেশ’-এর প্রধান দফতর এখন সেখানেই আছে।

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. আল-মারকাযুল ইলমীর অধীনে তাঁর শায়েখ ও মুরশিদ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর বিপ্লবী মিশন ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠা’-এর স্বপ্নই পূরণ করতে চেয়েছেন। সেজন্য যতদিন হায়াত ছিল, শক্তি সামর্থ্য ছিল- কাজ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি নিজ হাতে কোদাল নিয়ে মাটি কেটেছেন।

এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে এখন দেশের অনেক জায়গায় নূরিয়া পদ্ধতিতেকুরআন শিক্ষার কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন জায়গায় রমযান মাসে এবং বছরের অন্যান্য সময়েও মুআল্লিম প্রশিক্ষণের কাজ অব্যাহত আছে।

এছাড়া ঢাকা জেলার ধামরাই থানাধীন সুয়াপুর ইউনিয়নে হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. তাঁর দীর্ঘদিনের জমানো অর্থ দিয়ে ৩২ শতাংশ জমি খরিদ করেন। ২০০৯ সালের দিকে সেখানেও একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। এর নাম দেন হাফেজ্জী হুজুর রাহ. মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা ও মুসলিম শিশুশিক্ষা কেন্দ্রসেখানে এখন মক্তব ও হিফযখানার সাথে সাথে কিতাব বিভাগেরও কয়েকটি জামাত শুরু হয়েছে।

এই দুটি মাদরাসা ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অনেক মাদরাসা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রধান মুরব্বি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে-

পাহাড়পুর এমদাদুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা, কুমিল্লা।

মাদরাসা-ই-আরাবিয়া মিফতাহুল উলূম, আলুবাজার, ঢাকা।

পশ্চিমগাঁও জামিউল উলূম ইসলামিয়া (ডেমরা মাদরাসা), ঢাকা। এবং

গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা।

উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও তিনি আরো অনেক মাদরাসা, মসজিদ ও মক্তবের পৃষ্ঠপোষক, তত্ত্বাবধায়ক ও উপদেষ্টা হিসেবে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।

মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও আদীব হুজুরের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। যা যেকোনো রসমী সম্পর্ক থেকে একেবারেই ভিন্ন।

বাইআত ও খেলাফত

১৯৭২ সালের শেষ কিংবা ১৯৭৩ সালের শুরুর দিকের কথা। তখন তিনি মাদরাসায়ে নূরিয়ার নবীন শিক্ষক। সেসময় একদিন লালবাগ শাহী মসজিদে আসর নামাযের পর যখন সবাই একে একে চলে গেলেন, তখন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাঁকে একান্তে ডাকলেন। কাছে যাওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে প্রথমে বাইআত করে নিলেনএরপর বারো তাসবীহের ওযীফা ও জরুরি কিছু মামূল দিলেন।

এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর ১৪০০ হিজরীর ২৮ যিলকদ মোতাবেক ১৯৮০ সালের ৮ অক্টোবর, মাদরাসায়ে নূরিয়ার মসজিদে তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন।

এছাড়া ছাত্র যামানা থেকেই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. ছিলেন পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর সর্ববিষয়ের মুরব্বি। ইলমী, আমলী, যাহেরী, বাতেনী সকল বিষয়ে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সঙ্গেই পরামর্শ করতেন। তাঁর নির্দেশনা মেনেই যিন্দেগী পরিচালনা করতেন।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জীবদ্দশায় তিনি কেবল তাঁর সঙ্গেই ইসলাহী সম্পর্ক রাখেন। হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকালের পর এই সম্পর্ক রাখেন তার মুহতারাম আব্বাজান হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অন্যতম খলীফা মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব রাহ.-এর সাথে।

ইসলাহী মেহনত

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. নিয়মতান্ত্রিক ইসলাহী মেহনত অর্থাৎ খানকাহী তারতীবে ইসলাহী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন না ঠিক; তবে বহু আলেম ও তালিবুল ইলম তাঁর থেকে ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধি বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। নিয়মিত তাঁর কাছে চিঠি লিখতেন। তাঁর দেওয়া মামুল অনুযায়ী আমল করতেন। এভাবে তিনি আলেম ও তালিবুল ইলমদের জন্য মেহনত করতেন, তাদের যাহেরী-বাতেনী উন্নতির জন্য খুব ফিকির করতেন। তবে সচরাচর কাউকে বাইআত করতেন না।

আলেম ও তালিবুল ইলমদের মজলিসে তিনি যেসব বিষয়ে বয়ান করতেন তন্মধ্যে ছিল- কম কথা বলা, বেহুদা সময় নষ্ট না করা, অনর্থ গল্প-গুজব না করা, অযথা ঘুরাফেরা না করা, জাগতিক তারাক্কির বিষয়ে বেশি ফিকির না করা, গীবত পরিহার করা, মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা, সুন্নত ও নফল নামাযের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। এছাড়া ছোট বড় সব ধরনের গোনাহ পরিহার করার বিষয়ে খুব জোর দিতেন। এবিষয়ে কুরআন মাজীদের একটি আয়াত প্রায়ই তিলাওয়াত করতেন। আয়াতটি হল-

وَ ذَرُوْا ظَاهِرَ الْاِثْمِ وَ بَاطِنَه.

তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয় ধরনের গোনাহ ছেড়ে দাও। -সূরা আনআম (০৬) : ১২০

বলতেন, তালিবুল ইলমের চোখ, কান ও মুখ হল ইলম হাসিলের রাস্তা। আর কলব হল ইলম থাকার জায়গা। অতএব এগুলোকে গোনাহ দ্বারা নাপাক করো না। কারণ ইলম অত্যন্ত গায়রতওয়ালা। নাপাক ও গান্দা জায়গায় ইলম থাকতে পারে না।

ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি তারগীব বা উৎসাহের পন্থা অবলম্বন করতেন। সহজে কাউকে ভর্ৎসনা-তিরস্কার করতেন না। অনেক তালিবুল ইলমকে তিনি তাহাজ্জুদের চিল্লা (অর্থাৎ একটানা চল্লিশ দিন তাহাজ্জুদ আদায় করা)-এর মামুল দিতেন। তাহাজ্জুদের রুটিন তৈরি করতে বলতেন। এরপর খোঁজ নিতেন- কে কতদিন তাহাজ্জুদ পড়েছে! যে পঁয়ত্রিশ দিন পড়েছে তাকেও মাশাআল্লাহ বলতেন, উৎসাহ দিতেন। যে পাঁচদিন পড়েছে তাকেও মাশাআল্লাহ বলতেন, উৎসাহ দিতেন। কাউকেই ভর্ৎসনা বা তিরস্কার করতেন না।

তালিবুল ইলমদের ক্ষেত্রে যে দরদ ও ব্যথা নিয়ে তিনি ইসলাহের ফিকির করতেন তার নজির মেলা ভার। তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় যেতেন। তালিবুল ইলমদেরকে অত্যন্ত দরদমাখা ভাষায় নসীহত করতেন। এমন এমন নির্দেশনা দিতেন এবং ইসলাহের বিষয়ে এমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন যে, তারা ফিকিরমান্দ হত। ইসলাহের জরুরত অনুভব করত।

তাঁর সাদামাটা বয়ানেও তালিবুল ইলমরা বিমোহিত হত। তাঁর কথায় আত্মোন্নয়নের পথ খুঁজে পেত।

তিনি একটা কথা খুব বলতেন-আমি তো জাতিকে দিতে চাই; কিন্ত আমি যে খালি দামান-শূন্য আঁচল।এই কথায় যে কী আবেগ ও মায়া ছিল! ছিল কী গভীর আবেদন আর বিনয়সিক্ত আকুতি! এ বাক্য শুনলে যে কারো হৃদয় স্পন্দিত হয়ে উঠত। শ্রোতা নিজেকে ভালো মানুষ ও দ্বীনের মুখলিস খাদেম হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করত। বাস্তবেই এ  ছিল সৎ ও যোগ্য উত্তরসূরি তৈরির এক ইনকিলাবী বাক্য।

প্রসঙ্গ : ব্যক্তিজীবন

ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব কম কথা বলতেন। বেশি পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেনঅন্যদের মাধ্যমে তিলাওয়াত করিয়ে শুনতেন। নফল ও সুন্নত নামাযের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। বিশেষ করে ছোট-বড় যেকোনো প্রয়োজনে সালাতুল হাজতের ব্যাপারে ছিলেন খুবই যত্নশীল।

মুআমালা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সবসময় খুব পরিচ্ছন্ন থাকতেন। ছোট থেকে ছোট হিসাবও খাতায় লিখে রাখতেন।

কারো দোষ-ত্রুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন না। সামনে পড়লে হেকমতের সঙ্গে শোধরানোর ফিকির করতেন। প্রয়োজন অনুযায়ী সতর্ক করতেন।

তিনি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করতেন। সেজন্য ঘরের বাজার-দ সদাই পর্যন্ত নিজেই করতেন। পারতপক্ষে নিজের কোনো কাজ কাউকে করতে দিতেন না

স্বভাবগতভাবেই তিনি খুব লাজুক ছিলেন। তাঁর কথাবার্তা, চলাফেরা, আচার-আচরণ এবং নিজের সন্তান, ছাত্র ও অধীনস্তদের শাসন-তারবিয়তের ক্ষেত্রে সেই লাজুকতার রূপ ফুটে উঠত।

১৯৭৫ সালে তিনি প্রথম বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে সফর করেন এবং হজ্ব আদায় করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে একবার এবং ২০০৬ সালে আরেকবার হজ্ব করেন। এছাড়া বেশ কয়েকবার উমরা পালন করেন।

রচনা ও তাসনীফ

আজীবন শিক্ষকতা ও মানুষ গড়ার মেহনতের পাশাপাশি কয়েকটি কিতাব রচনা করেন তিনি। তন্মধ্যে নূরিয়া কায়দাআল-হাদী ইলাস সরফপ্রকাশিত হয়েছেআর স্বহস্তে লিখিত মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ডের কিছু অংশের তাকরীর পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জীবদ্দশায় তাঁর বক্তব্য ও নির্দেশনা অবলম্বনে তাহরীকে খেলাফতনামে একটি রিসালা প্রস্তুত করেছেন। পরবর্তীতে কয়েকটি উপলক্ষ্যে তাঁর উস্তায, শায়খ ও শ্বশুর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. এবং তাঁর মুহতারাম আব্বাজান হযরত মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব রাহ. ও তাঁর মুহতারামা আম্মাজান রাহ. সম্পর্কে স্মৃতিচারণামূলক তিনটি দীর্ঘ লেখা ইমলাবা অনুলিখন করিয়েছেন। এই তিনটি লেখা একত্রে হযরত হাফেজ্জী হুজুর এবং আমার আব্বাজান রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমনামে তাঁর জীবদ্দশায়ই প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর কয়েকজন শাগরিদ

তাঁর অসংখ্য শাগরিদদের মাঝে একান্ত প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ হলেন হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব (আদীব হুজুর) দামাত বারাকাতুহুম।

তাঁর শাগরিদদের মাঝে আরো আছেন-

* হযরত মাওলানা হিফযুর রহমান ছাহেব (মুমিনপুরী হুজুর) দামাত বারাকাতুহুম।

* হযরত মাওলানা আবদুর রাযযাক ছাহেব (মানিকগঞ্জী হুজুর) দামাত বারাকাতুহুম।

* তাঁর শায়খ ও মুরশিদের ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর দামাত বারাকাতুহুম।

* হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জামাতা]।

* হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [দারুর রাশাদ, মিরপুর]।

* হযরত মাওলানা কারী আবুল হুসাইন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [রেডিও বাংলাদেশ]।

* মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [লালবাগ জামিয়া]।

* মুফতী মুজিবুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [জামিয়া নূরিয়া]।

* হযরত মাওলানা যুবায়ের আহমাদ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ]।

* হযরত মাওলানা আবদুল হাই ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম [উত্তরা] প্রমুখ।

পরিবার ও সন্তানাদি

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ছিলেন তাঁর শায়খ ও মুরশিদ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর ছোট জামাতা। ১৯৭৩ সালের ২৪ মে বৃহস্পতিবার বাদ এশা, লালবাগ শাহী মসজিদে, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাঁর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মুহতারামা তাইয়েবা খাতুনকে তার কাছে বিয়ে দেন। বিয়ে পড়ান হুজুর নিজেই।

অত্যন্ত মুবারক এই দাম্পত্য জীবনে তাদের ছিল ৩জন ছেলে ও ৯জন মেয়ে। বড় ছেলে হযরত মাওলানা আশরাফুযযামান ছাহেব আল-মারকাযুল ইলমী বাংলাদেশ’-এর পরিচালক এবং হাজারীবাগ বাইতুর রসূল মাদরাসার উস্তায। মেজো ছেলে হযরত মাওলানা আবরারুযযামান ছাহেব জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া ও জামিয়া নূরিয়ার উস্তাযুল হাদীস। ছোট ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান হাজারীবাগ বাইতুর রসূল’-এর শিক্ষানবিশ উস্তায।

বড় মেয়ে নাফীসা ছোটবেলায়ই ইন্তেকাল করেন। বাকি আট মেয়ের সবাই আলেমা, কয়েকজন হাফেজা ও আলেমা। তাঁদের সবারই বিয়ে হয়েছে আলেমের কাছে।

পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর মোট ৩৮ জন নাতি-নাতনি বর্তমান। তাদের বড়রা সবাই মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। ছোটরা ঘরেই দ্বীনী পরিবেশে প্রতিপালিত হচ্ছে।

তাঁর মুহতারামা সহধর্মিনী গত ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ঈসায়ী তারিখে ৬৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আলা মাকাম নসীব করুন- আমীন।

ওফাত

অসংখ্য আলেমের উস্তায, আজীবন কুরআন ও হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মনীষী গত ২৫ যিলকদ ১৪৩৭ হিজরী মোতাবেক ২৯ আগস্ট ২০১৬ ঈসাব্দ, সোমবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ৬৮ বছর বয়সে ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়া ছেড়ে চিরস্থায়ী আখেরাতের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। সেদিনই বাদ এশা তাঁর স্মৃতিময় প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া আশরাফাবাদে বিপুল সংখ্যক উলামা-তলাবার অংশগ্রহণে নামাযে জানাযা আদায় করা হয়। জানাযা শেষে তাঁর শায়খ ও মুরশিদ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কবরের কাছেই দাফন করা হয়।

رَحِمَهُ اللهُ تَعَالى رَحْمَةً وَاسِعَةً، وَأَدْخَلَه فِيْ فَسِيْحِ جِنَانِه. اَللّهُمَّ اكْتُبْهُ عِنْدَكَ مِنَ الْمُحْسِنِيْنَ، وَاجْعَلْ كِتَابَه فِي عِلِّيِّيْنَ، وَاخْلُفْهُ فِي أَهْلِه فِي الْغَابِرِيْنَ، وَلَا تَحْرِمْنَا أَجْرَه، وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَه.

 

এই লেখা প্রস্তুত হয়েছে যেভাবে :

এই লেখা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে হযরতের বড় ছাহেবযাদা মাওলানা আশরাফুযযামান সাহেবের সাথে সরাসরি ও ফোনে সুদীর্ঘ কয়েকটি মজলিসে কথা বলে। এরপর হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর বক্তব্য অবলম্বনে প্রস্তুতকৃত কিতাব হযরত হাফেজ্জী হুজুর এবং আমার আব্বাজান রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমথেকে অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর স্মৃতিচারণা বিষয়ে হযরতের মেজো ছাহেবযাদা মাওলানা আবরারুযযামান সাহেবের লেখা পাণ্ডুলিপি (পরবর্তীতে প্রকাশিত কিছু কথা কিছু স্মৃতি’) ও হযরতের তৃতীয় জামাতা হযরত মাওলানা ইমরান হুসাইন কাসেমী সাহেবের লেখা পাণ্ডুলিপি (পরবর্তীতে প্রকাশিত মূল্যবান কিছু আমানত’) থেকেও অনেক সহায়তা নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে হাফেজ্জী হুজুর রাহ. স্মারকগ্রন্থথেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে ইস্তিফাদা করা হয়েছে।

কিছু কিছু তথ্য যাচাই ও পরিমার্জনের ক্ষেত্রে হযরতের দীর্ঘদিনের সহকর্মী হাফেজ্জী হুজুর রাহ. স্মারকগ্রন্থ’-এর সম্পাদনা সহযোগী হযরত মাওলানা ফারুক আহমদ ছাহেব, হযরতের মেজো ভাই হযরত মাওলানা আবদুল আউয়াল ছাহেব ও নূরিয়ার মক্তবে সুদীর্ঘকাল খেদমতকারী হযরত মাওলানা মাতলূবুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সঙ্গে সরাসরি ও ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। আর নূরিয়া কায়দাপ্রস্তুতের কাজে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথা বলার উদ্দেশ্যে নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে তাঁর বাড়িতে সফর করা হয়েছে। এই বড় মানুষদের আন্তরিক সহযোগিতার কৃতজ্ঞতা আদায় করা বাস্তবিক অর্থেই কঠিন। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে তাঁর শায়ানে শান মোতাবেক জাযা দান করুন- আমীন।

লেখা শেষে হযরতের বড় দুই ছাহেবযাদাকে আদ্যোপান্ত দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করা হয়েছে। জাযাহুমুল্লাহু জামিয়ান আহসানাল জাযা। 

 

 

advertisement