রবিউল আউয়াল ১৪৪৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৪

হেরার আলো॥
এ আলোয় আবার উদ্ভাসিত হোক পৃথিবী

মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

যখন জাবালে নূরে চড়লাম তখন সেই গুহার পাশে দাঁড়ালাম, গারে হেরা নামে যা সমধিক প্রসিদ্ধ। মনে মনে বললাম, এটা তো সেই পবিত্র স্থান, যেখানে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম ওহী লাভ করেছেন। এখানে অবস্থানকালে প্রিয় নবীকে রব্বে কারীম নবুওত দান করেছেন।

এখান থেকেই সেই সূর্য উদিত হয়েছে, যার রশ্মি গোটা জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্ধকার পৃথিবীকে আলো ঝলমলে সোনালী প্রভাত উপহার দিয়েছে। পৃথিবী পেয়েছে নতুন জীবন।

জগৎসংসারের স্বাভাবিক রীতি হচ্ছে- রাত পোহায়, ভোর হয়। পৃথিবী একটি নতুন দিবস লাভ করে। এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘটনার এ প্রবাহে না থাকে কোনো চাঞ্চল্য, না থাকে কোনো বৈচিত্র্য। রাতের আঁধারে নিদ্রায় বিভোর জাতি দিনের আলোতে জেগে উঠলেও অন্তর্জগতে সেই আলো কতটুকু পৌঁছুতে পারে! চর্মচক্ষু জেগে উঠলেও অন্তর্চক্ষু তাতে কতটুকু আলো পায়! জীবনের একেকটি বসন্ত ঘিরে এমন কত রাতদিন পার হয়ে যায়, তার হিসাবই বা কজন রাখে!

কিন্তু এই গুহা থেকে সত্যিই এমন একটি সুবহে সাদিক উদিত হয়েছিল, যার আলোয় গোটা বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠেছিল। যার আভা মানবজাতির হৃদয়-জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই প্রভাত থেকেই ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল। পৃথিবী সভ্যতার পথ খুঁজে পেয়েছিল।

এ দিনের পূর্বে কী ছিল? এর আগে মানব জাতির স্বাভাবিক জীবনপ্রকৃতি স্থবির ছিল। জীবন-ভূবনের প্রতিটি কপাটে বড় বড় তালা ঝুলছিল। ভারি ভারি তালা ঝুলতে থাকা একটি শেকলে জীবনজগৎ আটকে ছিল।

চিন্তার জগতে বিরাট জট ধরেছিল। আর তার দরজায় ঝুলছিল মজবুত তালা। বড় বড় জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, দার্শনিক-চিন্তাবিদ সকলে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন সে তালা খুলে মানব-চিন্তাকে আজাদ করতে।

মানুষের হৃদয়-দুয়ারও ছিল তালাবদ্ধ। তা থেকে মুক্ত করতে সময়ের সকল সংস্কারক নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন। মন মানসিকতা ও চিন্তা চেতনা এভাবে অবরুদ্ধ রইল, কুদরতের লীলা-কারিশমা ও ইহিহাসের নানা শিক্ষা-পাঠ তাদেরকে সে রুদ্ধতা থেকে উদ্ধার করতে পারল না। প্রতিভা বিকল ছিল। তা কার্যকর করতে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, দীক্ষা কার্যক্রম এবং সামাজিক বিভিন্ন উদ্যোগ ও তৎপরতা সমর্থ হল না। বিদ্যাপীঠের উপস্থিতি ছিল; কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ তা ফলপ্রসূ বানাতে অক্ষম হলেন

আইন আদালত ছিল, কিন্তু তা ছিল জুলুমের বাজারে বন্ধক দেওয়া। ফলে তাতে মজলুমের আহাজারি ছিল অরণ্যে রোদন। পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় নানা অসঙ্গতি ছিল, কিন্তু সমাজবাদী ও সমাজপতিগণ তার সুরাহায় অপারগ ছিলেন। রাজা ও রাজ দরবার সবই ছিল, কিন্তু গরীব অসহায়কে সে পথ এড়িয়ে চলতে হত। খেটে খাওয়া মজুর, হাড্ডিসার কৃষক, বঞ্চিত জনতার জন্য নিষেধ ছিল সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার।

বিত্তশালী ছিল, ছিল বিত্ত বৈভবের ছড়াছড়ি। কিন্তু অসহায়ের ক্ষুধার যন্ত্রণা, তার স্ত্রীর এক টুকরো বসনের আর্জি আর দুধের শিশুর আর্তনাদ সে তালায় আঘাত হানতে পারত না।

অনেক বড় বড় বিপ্লবী সংস্কারক অনেক শ্লোগান নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, আইন অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু শেকলে পেঁচানো মানবাধিকারের তালাগুলোর একটিও তারা খুলতে সক্ষম হননি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

কেন? এত চেষ্টা প্রচেষ্টার পর কী জন্য এই ব্যর্থতা? এর উত্তর হচ্ছে, তালা খুলতে তো তারা এগিয়ে এসেছেন। তাদের হাতে কখনোবা কোনো চাবিও ছিল; কিন্তু তালার সঠিক চাবিটি তাদের কাছে ছিল না। আর এ তালা তার চাবি ছাড়া খোলাও সম্ভব না। এই তালার জন্য যে চাবি বরাদ্দ, তা-ই এতে ব্যবহার করতে হবে। অথচ এক্ষেত্রে তাদের পদক্ষেপ ছিল ভুল। তারা তালা খুলতে নিজের বানানো চাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ফলে ব্যর্থ হয়েছেন।

কেউ কেউ সেই তালা খুলতে না পেরে তা ভাঙতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু সেই প্রচেষ্টা উল্টো বুমেরাং হয়েছে। তার হাতুড় ভেঙে গেছে। হাত জখম হয়েছে।

হাঁ, পৃথিবীর অবস্থা তখন এমনটাই ছিল। এমন সময় সভ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন জনমানবশূন্য তৃণলতাহীন একটি শুষ্ক পাহাড়ের চূড়ায় অখ্যাত একটি গুহার ভেতর থেকে সেই সুবহে সাদিক উদিত হল, যা এতদিনের এতসব জটিলতা সমাধান করে ফেলল নিমিষেই। বড় বড় রাজত্বের রাজধানীতে যা হতে পারেনি। বিশাল বিশাল গবেষণাগারে যা হয়ে ওঠেনি। সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী শিল্প সাহিত্যের আসরেও যা সম্ভব হয়নি।

মহান রাব্বুল আলামীন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালাতের মাধ্যমে গোটা মানবজাতির প্রতি মহা অনুগ্রহ করেছেন। তিনি মানব জাতির সামনে সেই দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছেন, যা তারা হারিয়ে বসেছিল। মানব সভ্যতা হারিয়ে যাওয়া সেই চাবি হাতে ফিরে পেল। আর তা হচ্ছে- ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমান। আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান এবং পরকালের প্রতি ঈমান।

প্রিয় নবী এ চাবি দিয়ে শতশত বর্ষব্যাপী আবদ্ধ তালা একটি একটি করে মুহূর্তেই খুলে দিলেন। মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত হল। স্বাধীনতা ফিরে পেল।

নবীজী যখন এ চাবি চিন্তার দরজায় ঝুলে থাকা তালায় রাখলেন। চিন্তার সকল জট খুলে গেল। ভাব ও ভাবনার সন্দেহ সংশয় দূর হয়ে গেল। মানুষ নতুনভাবে চিন্তা করতে শিখল। তার চিন্তাশক্তি যোগ্যতা অর্জন করল- কীভাবে গোটা জগৎসংসারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহান রবের কুদরতের নিশানাগুলো থেকে উপকৃত হওয়া যায়। মহান স্রষ্টার কুদরত দেখে কীভাবে তাঁর সন্ধান লাভ করা যায়। শত শক্তির দেয়াল ভেদ করে কীভাবে এক শক্তির মালিকের পরিচয়-ঔজ্জ্বল্য নসীব হয়। সে অনুভব করতে পারল শিরক ও মূর্তি পূজার অসারতা। মুক্তি লাভ করল অবাস্তব চিন্তা-দর্শনের গোলামী থেকে।

অথচ এ যাবৎকাল পর্যন্ত মুক্তভাবে এ বিষয়ে চিন্তা করার অধিকারটুকু তার ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানব সভ্যতা সম্মানজনক এ পদবী থেকে বঞ্চিত ছিল।

নবীজী এই চাবির মাধ্যমে মানুষের অন্তর্জগতের তালা খুলে দিলেন। ঘুমন্ত হৃদয় জেগে উঠল। মৃত অনুভূতি স্পন্দন ফিরে পেল।

শতাব্দী কালজুড়ে বল্গাহীন দাপিয়ে বেড়ানো উদ্ধত প্রবৃত্তি, যা এতদিনে নফসে আম্মারাহয়ে উঠেছিল, আজ সেই নফসই নফসে লাউয়ামায় রূপান্তরিত হল। আর দেখতে না দেখতে তা উন্নীত হল নফসে লাউয়ামাথেকে নফসে মুতমাইন্নায়। ফলে অন্তরে কোনো বাতিল ও অন্যায় অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগ রইল না। কোনো ধরনের অনাচার ও পাপাচার মেনে নেওয়া তার জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ল।

ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, পাপী ব্যক্তি নিজ থেকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ধরা দিচ্ছেন। নিজের অপরাধ স্বীকার করে কঠিন শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করে নিচ্ছেন। অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার দরুন এক নারী সাহাবী  নবীজীর নিকট এসে নিজ থেকে সঙ্গেসারশাস্তির দরখাস্ত করলেন। নবীজী পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় তার শাস্তিকে কিছুদিনের জন্য প্রলম্বিত করলেন। সাহাবিয়া বাড়িতে ফেরত চলে গেলেন।

নবীজী তাকে গৃহবন্দী করলেন না। কোথাও আবদ্ধ করে রাখলেন না। তার তদারকির জন্য কাউকে নিযুক্ত করলেন না। কোনো সিআইডি তার জন্য বরাদ্দ দিলেন না। এমনকি পরবর্তীতে নির্ধারিত সময়ে হাজির করার জন্য তার জন্য কোনো পুলিশও মোতায়েন করলেন না।

সে নারী যথাসময়ে মদীনায় উপস্থিত হন। সেই নির্মম মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে নবীজীর সামনে নিজেকে উপস্থিত করলেন। নবীজীকে বারবার বলতে থাকলেন আমার ওপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করুন। তার নিশ্চিত জানা ছিল, সাধারণ মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা এ শাস্তি কতটা ভয়াবহ। পাথরের আঘাতে আঘাতে তাকে হত্যা করা হবে। তবুও তিনি অপরাধের গ্লানি বয়ে বেড়াতে চাচ্ছিলেন না। চাচ্ছিলেন না এ পাপের বোঝা নিয়ে কাল কিয়ামতের দিন রাব্বুল আলামীন আহকামুল হাকিমীনের সামনে দাঁড়াতে।

তেমনিভাবে ইরান বিজয়ের সময় এক দরিদ্র সৈনিকের কব্জায় কিসরার সোনার মুকুট এসে পড়ে। তিনি মুকুটটি কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আমিরের হাতে সোপর্দ করেন। যাতে কোনো লৌকিকতা ব্যতীত যথাস্থানে আমানতটি পৌঁছে যায়।

মানুষের অন্তর্জগৎ তালাবদ্ধ থাকার দরুন তা শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। তাতে ইবরত গ্রহণের কোনো উদ্ভিদ জন্মাত না। আল্লাহর ভয় তাতে জাগ্রত হত না। দিলে কোনো নম্রতা স্থান পেত না। এই চাবি যখন তাদের অন্তর্জগতের বদ্ধ দুয়ারে রাখা হল মুহূর্তে হৃদয়-উদ্যান সজীবতা ফিরে পেল।

ফলে আমরা দেখতে পাই, এই অন্তরগুলোই আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা ও ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে। আল্লাহর দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুদরতের নাম ও নিশানা থেকে ইবরত হাসিল করছে। মাজলুমের কষ্ট দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়ছে। গরীবের প্রতি নাক সিটকানোর পরিবর্তে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সৌহার্দ সম্প্রীতি ও  ভালবাসার বিরল দৃষ্টান্ত তারা প্রতিস্থাপন করছে।

তেমনিভাবে নবুওতের এই চাবি যখন মানুষের খোদাদাদ প্রতিভাকে স্পর্শ করল, মুহূর্তে তা বারুদের মতো জ্বলে উঠল। অথচ এতদিন হয়তোবা তা  আস্তাকুঁড়ে পচছিল কিংবা মানুষের উপকারে আসার পরিবর্তে ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছিল। মানবপ্রতিভা সঠিক দিক নির্ধারণ করে স্রোতের মতো ছুটতে থাকল। ফলশ্রুতিতে এতদিন যাদের প্রতিভা বকরি চারণে হারিয়ে যাচ্ছিল তারাই আজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জাতির নেতৃত্ব দিল এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যাপৃত হল।

গতকাল পর্যন্ত যিনি একটি গোত্রের কিংবা একটি অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ অশ্বারোহী হিসেবে বিবেচিত হতেন আজ তিনি অনন্য প্রাচুর্য ও প্রতিপত্তি সম্পন্ন পরাশক্তিগুলোর বিজেতার বেশে অবতীর্ণ হচ্ছেন।

এই চাবি দিয়েই নবীজী পাঠশালাগুলোর তালা খুলেছেন এবং তাতে নতুন চলৎশক্তি সঞ্চার করেছেন। ফলে তাতে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়েছে এবং প্রাণোদ্দম পরিলক্ষিত হয়েছে। অথচ জ্ঞানের বিপন্নতা এবং শিক্ষকদের বিপর্যস্ততা এত দূর গড়িয়েছিল যে, এ বিষয়ে না শিক্ষক সমাজের কোনো আগ্রহ ছিল, আর না ছাত্র সমাজের।

নবীজী এসে ইলমের প্রয়োজনীয়তা বয়ান করেছেন। আহলে ইলমের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করেছেন। এবং জ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্পষ্ট করেছেন। ফলে পাঠশালাগুলোর উত্তরোত্তর উন্নতির ক্ষেত্রে সমাজের সকল স্তর থেকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছে। মুসলিম সমাজের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি মসজিদ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়; বরং প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিবেচনা করতে লাগলেন। কেননা তার ধর্মই তাকে ইলম অন্বেষণের জন্য সবচেয়ে বেশি তাগিদ করেছে।

 প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই চাবির মাধ্যমে আইন-আদালতের স্থবিরতার অবসান ঘটিয়েছেন। ফলে নিয়ম-নীতি জানা প্রতিটি ব্যক্তি এ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ  হতে পেরেছিলেন যে, একেক জনকে ন্যায়পরায়ণ বিচারক হিসেবে বিবেচনা করা যেত। এঁরা ছিলেন প্রকৃত মুসলিম। শুধু আল্লাহর জন্যই তারা সত্য সাক্ষ্য দিতেন।

সমাজে যখন আল্লাহর সামনে উপস্থিতি, আল্লাহর কিতাবের প্রতি বিশ্বাস এবং পরকালে জবাবদিহিতার মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন ন্যায় ও ইনসাফের প্রাবল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বেইনসাফি এবং অন্যায় অবিচার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। মিথ্যা সাক্ষ্য ও জুলুমের ফয়সালা বিলুপ্ত হতে চলেছে।

পারিবারিক রীতিনীতি এতটা অধঃপতিত হয়েছিল- পিতা-পুত্রের মাঝে, ভাই-ভাইয়ের মাঝে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অনবরত সংঘাত সংঘর্ষ বেঁধেই থাকত। ব্যাপারটি পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত না, পরিবার থেকে বিস্তৃত হতে হতে গোত্র ও সমাজের বিস্তীর্ণ অঙ্গনেও তা ছড়িয়ে পড়ত।

এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মনিব-ভৃত্যের মাঝে, শাসক-শাসিতের মাঝে, মালিক-শ্রমিকের মাঝে, বড়-ছোটর মাঝে, মোটকথা সকল স্তরে। অবস্থা এমন ছিল, সবাই কেবল নিজের পাওনাটুকু নিয়ে ব্যস্ত থাকত। নিজের অংশ থেকে চুল পরিমাণ কম পড়ুক তা বরদাশত করতে পারত না। অপরদিকে অপরের হক প্রদান করার ক্ষেত্রে ছিল খুবই সংকীর্ণ। কিছু খরিদ করতে গেলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। এই ব্যক্তিই যখন অন্যকে কিছু বুঝিয়ে দিত তখন যত কম করে দেওয়া যায়Ñ তাতে সে তৎপর হয়ে উঠত। কুরআনের ভাষায়-

الَّذِيْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَي النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ.

যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়। -সূরা মুতাফফিফীন (৮৩) : ২-৩

নবীজী এসে সামাজিক পারিবারিক ব্যবস্থাপনার জটগুলো খুলে দিলেন এই চাবির মাধ্যমে। পরিবার ও সমাজে ঈমানের বীজ বপন করলেন। মানুষকে স্রষ্টার অসন্তুষ্টির ব্যাপারে সতর্ক করলেন। শোনালেন আল্লাহর ফরমান-

يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَّ نِسَآءً وَ اتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَ الْاَرْحَامَ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا.

হে লোকসকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার ওসীলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় করনিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। -সূরা নিসা (০৪) : ১

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবার ও সমাজের প্রতিটি সদস্যের ওপর ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তেমনিভাবে তিনি নতুনভাবে পারিবারিক অবকাঠামো এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ঢেলে সাজিয়েছেন। তা ছিল ন্যায় ও ইনসাফ, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি, প্রেম ও ভালবাসা এবং সততা ও নিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক অবকাঠামোকে তিনি ন্যায়ের প্রতীক বানিয়েছেন। সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে আমানতদারির ব্যাপক চর্চা এবং খোদাভীতির গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন। ফলে সে সমাজের প্রতিটি কর্ণধার এবং দায়িত্বশীল মহল পরহেযগারী ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রাজ্যপতি নিজেকে রাজ্যের খাদেম ও সেবক ভাবতে শিখেছেন। গোত্রপতি নিজেকে গোত্রের সদস্যদের সেবক মনে করেছেন। জনপ্রতিনিধিগণ নিজেদেরকে অনাথ এতীমের পৃষ্ঠপোষক ছাড়া অতিরিক্ত কিছু ভাবতেন নাযদি নিজের ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ থাকত, তাহলে রাষ্ট্রের সম্পদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কিন্তু যদি ততটুকু সামর্থ্য না থাকত তখন প্রয়োজন পূরণ মাফিক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু গ্রহণ করে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন।

 এই ঈমানের বদৌলতে ধনী ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মাঝে দুনিয়ার প্রতি অনীহা এবং আখেরাতের প্রতি আকর্ষণ পয়দা করেছেন। তাদেরকে বলেছেন, সম্পদ মূলত আল্লাহর; আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তোমাকে কেবল নিজ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের করার প্রতিনিধি বানিয়েছেন-

وَ اَنْفِقُوْا مِمَّا جَعَلَكُمْ مُّسْتَخْلَفِيْنَ فِيْهِ .

আল্লাহ যে সম্পদে তোমাদেরকে প্রতিনিধি করেছেন, তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ৭

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَّ اٰتُوْهُمْ مِّنْ مَّالِ اللهِ الَّذِيْۤ اٰتٰىكُمْ.

(হে মুসলিমগণ!) আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তাদেরকেও দাও। -সূরা নূর (২৪) : ৩৩

আল্লাহর রাস্তায় এবং আল্লাহর বান্দাদের মাঝে খরচ না করে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার ব্যাপারে তিনি তাদেরকে সতর্ক করেছেনÑ

وَ الَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَ الْفِضَّةَ وَ لَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْم، يَّوْمَ يُحْمٰي عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوٰي بِهَا جِبَاهُهُمْ وَ جُنُوْبُهُمْ وَ ظُهُوْرُهُمْ هٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ.

যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির সুসংবাদদাও। যেদিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, তাদের পাঁজর ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে (এবং বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তার মজা ভোগ কর। -সূরা তাওবা (০৯) : ৩৪-৩৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নববী পয়গাম ও দাওয়াতের মাধ্যমে যে জনগোষ্ঠী প্রস্তুত করেছেনতাদের বৈশিষ্ট্য হত- তারা আল্লাহর ওপর সাচ্চা ঈমান রাখতেন। ভালো কাজ পছন্দ করতেন। কল্যাণের পথে অগ্রগামী হতেন। আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত থাকতেন। আমানতের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। দুনিয়ার ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দিতেন। ইহবাদ ও বস্তুবাদকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। নিজের এসলাহ ও আত্মিক উৎকর্ষতার প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগী হতেন। অন্তর থেকে একথা বিশ্বাস করতেন, এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের উপকারের জন্য আর আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য, পরকালের জন্য।

ফলে এমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিরা যখন ব্যবসার অঙ্গনে অবতীর্ণ হতেন তখন  হতেন অত্যন্ত সৎ ও সত্যবাদী এবং আমানতদার ও ঈমানদার। যদি শ্রমপেশা অবলম্বন করতেন হতেন কঠোর পরিশ্রমী ও পরার্থপর। সম্পদশালী হলে হতেন বিনয়ী ও উদারহস্ত। গরীব ও সম্বলহীন হলে ধৈর্যধারণকারী, ভদ্র ও আত্মমর্যাদাশীল জীবনসংগ্রামী হয়ে ওঠতেন। এমন ব্যক্তিরা যখন আদালতের চেয়ারে বসতেন তখন হতেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারক। ক্ষমতার অধিকারী হলে হতেন ন্যায়নিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থ শাসক। যখন মনিব হতেন তখন অত্যন্ত দয়া ও কোমল আচরণের অধিকারী হতেন। আর যখন জনগণের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব তাদের কাঁধে অর্পিত হত তখন অত্যন্ত চৈতন্য ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতেন।

প্রিয় পাঠক! এ বৈশিষ্ট্যগুলোই ছিল ইসলামের সেই সোনালী সমাজের ভিত্তি। এগুলোর ওপরই গড়ে উঠেছিল ইনসাফপূর্ণ আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের মজবুত ইমারত। সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল ব্যক্তির স্বভাব চরিত্র, রুচি প্রকৃতি ও তার জীবন-যাপনের চিত্র। এবং এ বৈশিষ্ট্যগুলোই হয়ে উঠেছিল ঐ গোটা সমাজের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র।

এ সমাজের আয়নায় ভেসে উঠত- ব্যবসায়ীদের সততা ও আমানতদারি। এর গরীব সদস্যের আত্মমর্যাদাবোধ ও অক্লান্ত পরিশ্রম। শ্রমিকের মেহনত ও কল্যাণমুখী মানসিকতা। গরীবের প্রতি বিত্তশালীর সহানুভূতি ও মমত্ববোধ। বিচারকের বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতা। শাসকবর্গের সত্যনিষ্ঠা ও পরোপকারের স্পৃহা। মনিবের বিনয় ও নম্রতা এবং ভৃত্যের কর্মচাঞ্চল্য ও আন্তরিকতা। আর প্রতিফলিত হত রক্ষণাবেক্ষণকারী আমলাদের পূর্ণ আমানতদারি ও আন্তরিকতা।

ইসলামী সমাজে যেভাবে তার সদস্যদের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিফলিত হত, তেমনিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রও এসকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করত; বরং এগুলোই ছিল রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। ফলে রাষ্ট্র সঠিক পথে পরিচালিত হত। নীতি ও বিশ্বাসকে ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ঠুনকো চিন্তার ওপর প্রাধান্য দিত। জনসাধারণের সম্পদ শুষে নেওয়ার পরিবর্তে তাদের চিন্তা-চেতনা ও নীতি নৈতিকতা বিনির্মাণে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখত।

যার ফলাফল ছিল- ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন যাপনের প্রতিটি অঙ্গন সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পরার্থপরতার ফুলে সুশোভিত ছিল। আর সেই সুবাসে গোটা সমাজ মৌ মৌ করত।

প্রিয় পাঠক! হেরা গুহায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ কথাগুলো আমি ভেবে যাচ্ছিলাম। আমি এতে এতটাই তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম- কিছু সময়ের জন্য আমি নিজ অস্তিত্বের ব্যাপারেও অচিন হয়ে পড়েছিলাম। আমার চিন্তামগ্নতা আমাকে আমার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ  থেকে পৃথক করে ফেলেছিল। আমার দৃষ্টিতে তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল ইসলামী সমাজের চিত্রগুলো। আমি তার সৌন্দর্য অবলোকন করছিলাম আর বিমোহিত হচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি সেই সমাজের মাঝেই অবস্থান করছি এবং সেই নির্মল ও নিষ্কলুষ পরিবেশে শ্বাস গ্রহণ করছি।

এভাবে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে আমার বাস্তব জীবনের চিত্র; আমি যে পরিবেশ থেকে শ্বাস গ্রহণ করি। আমি বললাম, আজও যে দেখছি জীবনের সফলতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কপাটে কিছু নতুন কিসিমের তালা ঝুলছে! আমার সমাজ এত শত-সহস্র সমস্যায় জর্জরিত, যার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফলে বিভিন্ন সংকট বেড়েই চলেছে। তাহলে কি এই অবস্থাতেও সেই পুরোনো চাবি দিয়ে এই নতুন তালা খোলা সম্ভব?!

আমার অন্তরে এই প্রশ্ন জাগ্রত হল বটে, কিন্তু আমি বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তালাগুলোকে আমি সঠিকভাবে পরখ না করব ততক্ষণ পর্যন্ত উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে না। এই চিন্তা থেকে যখন আমি তালাগুলো আবার দেখতে লাগলামআমার সামনে সকল বাস্তবতা সুস্পষ্টরূপে ধরা দিল।

আরে এই তালাগুলো তো নতুন কিছু নয়! সেই পুরাতন তালাগুলোই; শুধু রং-রূপ পরিবর্তন করে জেঁকে বসেছে। তালাবদ্ধ থাকার কারণে যে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে, সেই জটিলতাগুলোও আজকে নতুন নয়।

আজকের মূল সংকট ব্যক্তির পরিশুদ্ধির অনুপস্থিতি। সকল সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। কেননা ব্যক্তি হচ্ছে সেই স্তম্ভ, যার ওপর ভর করে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মিত হয় এবং দাঁড়িয়ে থাকে।

আজ সমাজে বসবাসকারী সদস্যবর্গের অবস্থা হল- অর্থ ও ক্ষমতা ব্যতীত কোনো কিছুকে সে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। স্বার্থ ও প্রবৃত্তি ব্যতীত কোনো কিছুতে তার আগ্রহ নেই। তাকে ততটুকু পাওয়া যায়, যতটুকু তার স্বার্থ থাকে। ফলে ইহজগতের মূল্য ও মর্যাদা তার দৃষ্টিতে বাস্তবতার চাইতে অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়।

আজ মানব জীবনে স্বার্থ ও প্রবৃত্তির গোলামী সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সে নিজেকে তার রব থেকে, রবের আনুগত্য থেকে, নবীগণের রিসালাত ও আদর্শ থেকে, আখেরাতের বিশ্বাস ও জাবাবদিহিতা থেকে বিলকুল বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ব্যস এতটুকুই হচ্ছে একজন ব্যক্তির অবক্ষয়। আর এর থেকেই সমাজ ধ্বংসের সূত্রপাত। আর এটাই হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য দায়ী।

এই ব্যক্তি যখন ব্যবসা করে তখন তার মাধ্যমে পণ্য মজুদকরণ, ভেজালকরণ ও অধিক মুনাফা লাভের লোভাতুর মনোভাব প্রকাশ পায়। সস্তার সময় পণ্য মজুত করে আর মূল্যবৃদ্ধি করে মাল বাজারে ছাড়ে। এভাবে সে জনগণকে ক্ষুধা ও নানাবিধ ভোগান্তিতে ফেলে কষ্ট দেয়।

এ ব্যক্তি যখন দরিদ্র হয় তখন দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নিজে কোনো ন্যায্য পরিশ্রম করার পরিবর্তে অপরের মেহনতের ফসল মুফতে খেতে উদ্যত হয়। ফলে যদি মজদুরি করে তখন নিজের দায়িত্বটা ঠিকমতো আদায়ে অবহেলা করে; আবার পারিশ্রমিক পুরোটাই বুঝে নিতে চায়। যদি সম্পদশালী হয় তখন চূড়ান্ত কৃপণ ও রুক্ষ হয়ে ওঠে। আর যদি ক্ষমতা লাভ করে, তখন দুর্নীতি ও লুটতরাজ আরম্ভ করে। যদি মালিক হয়, তখন একজন জালেম ও স্বার্থপর সত্তার রূপ ধারণ করে; যে নিজের স্বার্থ ও প্রাচুর্য ব্যতীত কিছুই দেখতে চায় না। যখন আমলা হয় তখন সে দুর্নীতি এবং প্রতারণার আশ্রয় নেয়। যখন মন্ত্রী অথবা মন্ত্রিপরিষদের প্রধান হয় তখন উদর ও প্রবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতির কোনো ধার ধারে না; শুধু নিজের ও নিজ দলের লাভের কথাই চিন্তা করে।

যদি নেতা বনে যায় এবং উন্নয়ন-বান্ধব হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে তখন তার কল্যাণ চিন্তা নিজ জাতি ও রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে অগ্রসর হতে পারে না। নিজের দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির নামে অন্যায় আধিপত্য কায়েম করে। অন্য কারো সম্মান ও মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে সে বিলকুল পরোয়া করে না। যদি হাতে আইনের দণ্ড থাকে তখন জুলুমের নীতি অবলম্বন করে। জনগণের কাঁধে মোটা অঙ্কের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়।

যদি প্রতিভায় সৃষ্টিশীলতা থাকে তখন ক্ষয় ও লয়ের উপকরণ আবিষ্কার করতে থাকে। বিষাক্ত গ্যাস উদ্ভাবন করে, যা মানবজাতিকে ধ্বংস করে ছাড়ে। যুদ্ধবিমান ও মারণাস্ত্র ট্যাঙ্ক তৈরি করে, যা বসতির পর বসতি উজাড় ও ভস্ম করে দেয়।  এমনকি তার আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় না কোনো জীব-জন্তু কোনো বৃক্ষলতা।

যখন এই শ্রেণির মানুষকে এই ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার ও ব্যবহার করার শক্তি দেওয়া হয় তখন সাজানো গোছানো পরিপাটি শহর মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দেয়। বিরান ভূমিতে পরিণত করে ফেলে জনমানুষের আবাস ও স্বপ্ন।

মোটকথা, যখন ভালো মানুষের সমষ্টিতে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন যেমনিভাবে সমাজে সে জাতির বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ প্রতিফলিত হয়। তেমনিভাবে দুষ্ট প্রকৃতির কিছু লোকের সমষ্টিতে গড়ে ওঠা একটি সমাজও অনিবার্যভাবে সেসকল দুষ্ট লোকের সকল অন্যায় ও অপকর্মের ধারক-বাহক হয়ে থাকে। তাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতকরণও হবে, অন্যায্য মুনাফাও থাকবে। বঞ্চিত গোষ্ঠীর বিশৃঙ্খলাও থাকবে, শ্রমিকের কর্মে ফাঁকি এবং অধিক পারিশ্রমিকের দাবিও থাকবে। সম্পদশালীর লিপ্সার জীবাণু তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। রাষ্ট্রনায়কদের জুলুম নির্যাতন সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। মালিকপক্ষের অন্যায় অবিচার বিস্তার লাভ করবে। শ্রমিকের খেয়ানত, আমলাদের দুর্নীতি ব্যাপক হবে। মন্ত্রীদের ভোগবাদ আর নেতাদের জাতীয়তাবাদও খেল দেখাবে। আইন বিভাগের অন্ধত্ব এবং বিজ্ঞানীদের বিচ্যুতি তামাশার শিল্প প্রদর্শন করবে। সম্পদশালীদের রুক্ষতা গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ছেয়ে ফেলবে।

এ-ই হচ্ছে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সূত্র; যা থেকে সকল অন্যায়, অসাধুতা, সংকট, সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যার দরুন মানবতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। অনিষ্টের এই গোড়ার নাম হচ্ছে- বস্তুবাদের লিপ্সা কিংবা ইহবাদ ও তার প্রকাশকেই সবকিছু মনে করা। ব্ল্যাক মার্কেটিং এরই অনিবার্য ফল। ঘুষের দৌরাত্ম্য এরই একটি ক্ষুদ্র প্রকাশ মাত্র। সুদ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এরই অভিশাপ। পণ্যের মজুতকরণ এরই শিক্ষা।

আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিক, চিন্তাবিদ এসকল সংকটের কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান বের করে আনতে পারেননি। একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তারা অন্য আরেকটি মসিবতে ফেঁসে যাচ্ছেন। একটি গিঁট খুলতে গিয়ে নতুন গিঁট তৈরি করছেন। এমনকি আজ যদি এই কথা বলি তাহলে অত্যুক্তি হবে না, তাদের এ সমাধান প্রকল্প আরো অসংখ্য সংকট সৃষ্টি করছে। 

তারা ভেবেছে, হয়তোবা রাজতন্ত্র এসকল সমস্যার মূল; কাজেই তা খতম করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করল। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হল না; স্বৈরতন্ত্র আবিষ্কার হল। এতে দেখা গেল আরো বেশি সমস্যা। এভাবে একটার পর আরেকটা মতবাদ নিয়ে চলেছে আর চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছে।

তেমনিভাবে কখনো পুঁজিবাদকে গ্রহণ করা হল। এতে সমস্যা আরো জটিল হল। কমিউনিজম ও স্যোশালিজমকে সমস্যার সমাধান হিসেবে মনে করা হল; কিন্তু অবস্থা যা ছিল তা থেকে উত্তরণ হল না। ক্ষেত্রবিশেষে তা আগের চেয়ে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করল।

কেন? এজন্য যে, এসকল পরিবর্তন ও সংস্কার ওপরে তো হতে থাকে, কিন্তু সমস্যার যে গোড়া অর্থাৎ ব্যক্তির পরিশুদ্ধি ও তার পরিচর্যা- তা অধরাই থেকে যায়। ব্যক্তির পরিবর্তন ও তার পরিশুদ্ধির প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বাস্তবতা থেকে উদাসীন থাকা হয়।  ফলে ব্যক্তির মাঝে বক্রতা থাকার কারণে সমাজও বক্রভাবেই গড়ে ওঠে।

আমি তো বলি, যদি এসকল চিন্তাবিদ এবং সংস্কারক এই বাস্তবতা সুচারুরূপে উপলব্ধিও করে ফেলেন, সকল অনিষ্টের সূত্রপাত যেখান থেকে হয় ধরতে পারেন, তখনো এর নিরাময় তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি মেনেও নেই, তাদের হাতে সচেতনতা তৈরির যথেষ্ট কার্যকর মাধ্যম রয়েছে এবং এই যুগটাই হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ। তথাপি তাদের কাছে সেই শক্তি নেই, যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে অন্যায় প্রবণতা থেকে মুক্ত করে কল্যাণের দিকে, ধ্বংসের পথ থেকে সরিয়ে বিনির্মাণের পথে তারা ধাবিত করতে পারবেন। কেননা তাদের মন ও মননে এবং চিন্তা ও চেতনায় আত্মাকে খোরাক দেওয়ার গুরুত্ব নেই। তাদের হৃদয় ঈমান থেকে মাহরূম। তাদের কাছে অন্তরাত্মাকে খোরাক দেওয়া এবং তাতে ঈমানের বীজ রোপন করার উপকরণ নেই। তাদের হাত থেকে সেই ধন ফসকে গিয়েছে, যা আবদ ও মাবুদতথা মালিক ও গোলামের মাঝে সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করেএ জীবনের সাথে অন্য জীবনেরসম্পর্ক জুড়ে দিতে পারে। জীবন, জগৎ আর অন্তর্জগতের মাঝে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে জ্ঞান ও আখলাকের সমন্বয় ঘটাতে পারে।

আসলে তাদের আধ্যাত্মিক দীনতা, বস্তুবাদিতার অন্ধত্ব  এবং চিন্তার প্রবঞ্চনা তাদেরকে এত দূরে নিক্ষেপ করেছে যে, মানব সভ্যতা ধ্বংস ও বরবাদ করার সর্বশেষ তীরটি পর্যন্ত তূনীরে জমা করে রাখতে চায় তারা। আল্লাহ না করুন, যদি এই সময়ে দুনিয়ার যুদ্ধবাজ শক্তিগুলো এই ধরনের মারণাস্ত্র নিয়ে ময়দান গরম করে, নির্ঘাত এই নব আবিষ্কার ও আবিষ্কারের এই উৎকর্ষ মানবতা ও সভ্যতাকে মিসমার করে ছাড়বে।

 

[মাসিক আলফুরকান, রবিউল আখির ১৩৭১ হি./ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঈ., পৃ. ২১-২৮

ভাষান্তর : মাওলানা আশিক বিল্লাহ তানভীর]

 

 

advertisement