অন্যায় সালিশ, গর্হিত প্রচারণা
দ্বীনের বুনিয়াদি বিষয়গুলোর ব্যাপক চর্চা প্রয়োজন। কারণ সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে ইসলাম-বিদ্বেষী চক্র দ্বীনের অকাট্য ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়েও মিথ্যা প্রপাগান্ডার দুঃসাহস পেয়ে যায়। একই সাথে সর্বস্তরের মুসলমানের সতর্কতা ও সচেতনতাও অতি প্রয়োজন। যেন বর্ণচোরা গোষ্ঠীর নিত্যনতুন অপকৌশল চিহ্নিত করতে ভুল বা বিলম্ব না হয়।
কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি মুসলিম জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের কথা জানা আছে বলেই ইসলাম বিদ্বেষী চক্র সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর উপর আক্রমণ করে না। কখনো তারা শরীয়তের আইনকে অস্বীকার করে, কখনো ইলমে ফিকহকে অস্বীকার করে, কখনো ইসলামের ফতোয়া-ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে। এভাবে একেক সময় একেকভাবে কুরআন-সুন্নাহর আহকাম ও বিধিবিধানই তাদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের লক্ষবস্ত্ত হয়ে থাকে।
আমাদের দেশেও অনেক লোক (সম্ভবত নিজের অজান্তেই) ঐসব ইসলাম-বিদ্বেষী সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং তাদের বিষাক্ত চিন্তাধারার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে লিপ্ত। সম্প্রতি ফতোয়ার বিষয়ে যেসব প্রপাগান্ডা হচ্ছে তার স্বরূপ বুঝতে হলে ইসলামের ফতোয়া-ব্যবস্থা ও ফতোয়ার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অপরিহার্য। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার দারুত তাসনীফ থেকে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বইপুস্তকের পাশাপাশি দীর্ঘ গ্রন্থও প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। এই মুহূর্তে আমরা তিনটি লেখা পাঠকবৃন্দের খেদমতে পেশ করছি। প্রথম লেখাটি মারকাযুদ দাওয়াহর মুদীর ও দারুল ইফতার রঈস হযরত মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেবের একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ নিবন্ধ, যা দৈনিক আমার দেশে (১৪ ফেব্রুয়ারি ১১ ঈ.) প্রকাশিত হয়েছিল।
গ্রাম্য মাতবর ও শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের ভুল সালিশকে ফতোয়া বলে প্রচার করার মূর্খতাপ্রসূত কিংবা দুরভিসন্ধিমূলক যে অপকর্ম এখন প্রকাশ্যে হচ্ছে সে সম্পর্কে উপরোক্ত নিবন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় লেখাটি আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের ফতোয়া বিষয়ক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া প্রাসঙ্গিক কয়েকটি প্রশ্ন ও তার উত্তর। যেসব ভুল ও বিভ্রান্তির ভিত্তিতে ফতোয়া নিষিদ্ধ করে রায় দেওয়া হয়েছিল এখানে সেগুলোর স্বরূপ উন্মোচিত করা হয়েছে। তাঁর পূর্ণ প্রবন্ধটি অচিরেই বই আকারে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয় লেখাটি হচ্ছে আলকাউসারের নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ছাহেবের একটি নিবন্ধ, যাতে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, ভুল সালিশের উপর তো প্রতিবাদ আছে, কিন্তু যিনা-ব্যভিচার এবং নগ্নতা ও অশ্লীলতা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। তাহলে কি অশ্লীলতার বিস্তারই এই সব তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য?
আমরা পাঠকবৃন্দের কাছে দুআর দরখাস্ত করছি, আল্লাহ তাআলা যেন আপিল বিভাগের দায়িত্বশীলদের সঠিক ফয়সালার তাওফীক দান করেন এবং পূর্বের ‘বাতেল’ রায়কে বাতিল করার সৎসাহস প্রদান করেন।
আশার কথা এই যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতেও ঐ রায়টি ভুল। বিগত ৯ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তাঁর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক যায়যায় দিন পত্রিকার শিরোনামটি ছিল এই-ফতোয়া কারা দেবে সেটি নির্দিষ্ট করুন
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসলামিক বিচারের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যাতে ফতোয়া না দিতে পারে এবং ফতোয়া বা ইসলামিক আইনে সিদ্ধান্ত দিতে যোগ্য ব্যক্তি কারা তা সুনির্দিষ্ট করার জন্য আলেম-ওলামাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফতোয়া কারা দেবে, সেটা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। যে সে যেখানে সেখানে তো ফতোয়া দিতে পারে না। সেটা একমাত্র সত্যিকার এই শিক্ষায় শিক্ষিতরাই দিতে পারে।’ (দৈনিক যায়যায় দিন, ৯ ফেব্রুয়ারি, বুধবার ২০১১, শেষ পৃষ্ঠা)
একই দিনের দৈনিক আমাদের সময়ে তাঁর বক্তব্যকে ‘কোট’ করা হয়েছে এভাবে-‘শুধু শিক্ষিত আলেমরাই ফতোয়া দিন’। বলা হয়েছে, ‘গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের জাতীয় সম্মেলনে ভাষণকালে এ আহবান জানান।’
সুতরাং প্রধানমন্ত্রীরও জানা আছে, ফতোয়া দেওয়া বিজ্ঞ আলিমের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য না আইনী ব্যক্তি হওয়া জরুরি, না সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া। তেমনি ফতোয়া নিষিদ্ধ করার বিষয় নয়; বরং তা অযোগ্য লোকের হস্তক্ষেপ থেকে পবিত্র রাখা কর্তব্য। সম্মানিত বিচারপতিদের কাছে অন্তত এটুকু উপলব্ধি কি আমরা আশা করতে পারি না?-সহ-সম্পাদক
হেনার মৃত্যু, ফতোয়া ও কিছু কথা
মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ
সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়ায় হেনা নামের এক তরুণীর দুঃখজনক মৃত্যুর খবর সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সরেজমিনে ঘটনাটির সত্যাসত্য যাচাই করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে যে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এরপর গ্রাম সালিশে ধর্ষক ও ধর্ষিতা উভয়কে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হয়। ঘটনার এক পর্যায়ে হাসপাতালে নেয়ার পর তরুণী হেনা মৃত্যু বরণ করে। তবে ঘটনাটির বর্ণনায় বলা হয় যে, ফতোয়ার কারণে হেনার মৃত্যু হয়েছে। মর্মান্তিক ঘটনাটি এবং এর সঙ্গে ফতোয়াকে জড়িত করার বিষয়ে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক. প্রথমেই যে বিষয়টি বলা দরকার সেটি হচ্ছে ইসলামী শরীয়তে ধর্ষকের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি আদালত ইচ্ছা করলে ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ষককে ‘চরম সন্ত্রাসী আচরণে’র দায়ে মৃত্যুদ পর্যন্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু ধর্ষিতার জন্য কোনো শাস্তির প্রশ্ন তো নেইই; বরং সে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহানুভূতি ও সুবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। মুসলমান সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, রাষ্ট্রের তরুণী-যুবতী তথা নারী সমাজের সম্ভ্রমের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া।
দুই. সংবাদপত্রে ঘটনা বর্ণনায় স্পষ্টতই বোঝা যায়, হেনার ওপর শাস্তি প্রয়োগের তথাকথিত বিচারকাজটি পরিচালনা করেছে গ্রামের মাদবর-মোড়ল প্রভাবিত গ্রাম্য সালিশ। মাদবর-মোড়লরা তাদের সামাজিক প্রভাবের কারণে ওই সালিশে দুইজন অর্ধ শিক্ষিত মৌলভী সাহেবকে যুক্ত করে নেয়। এতে কেউ কেউ ‘বিচারের’ পুরো প্রক্রিয়াটিকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রচার করার সুযোগ পেয়ে যায়। অথচ দেশের আলেমসমাজ বারবার বলে এসেছেন, গ্রাম্য সালিশের সঙ্গে ফতোয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্ধ শিক্ষিত মৌলভী সাহেব তো দূরে থাক, সাধারণ পর্যায়ের কোনো মাওলানা সাহেবেরও ফতোয়া দেয়ার অধিকার নেই। ফতোয়া দিতে পারেন কেবল ফিকহ-ফতোয়া বিষয়ে উচ্চতর ইসলামী জ্ঞান অর্জনকারী এবং এ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিত্বদের কাছে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ব্যক্তি।
ইসলামে ফতোয়ার বিষয়টিকে এজন্যই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, এর মাধ্যমে মুসলমানদের জীবনের সব শাখা-প্রশাখার কর্মকারে শুদ্ধাশুদ্ধি সাব্যস্ত হয়। ফতোয়া কেবল বিবাহ-তালাকের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, নামাজ-রোজা, আয়-উপার্জন, লেনদেন, আচার-আচরণ থেকে নিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রেই হালাল-হারাম চিহ্নিত হয় ফতোয়ার মাধ্যমে। এজন্যই ফতোয়া মুসলিম জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
কয়েক বছর ধরে এদেশে গ্রাম্য সালিশের বিভিন্ন ঘটনাকে ‘ফতোয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আক্রমণের লক্ষবস্ত্ত বানানো হচ্ছে। অবমাননা করা হচ্ছে ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষাকে। কথায় কথায় বলা হচ্ছে, ‘ফতোয়ার শিকার’। ‘ফতোয়াবাজি’ নামক নতুন শব্দ বানিয়ে গালির অর্থে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক ও দ্বীনধর্মের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তিন. শেষ যে প্রসঙ্গটি সবার সামনে থাকা দরকার সেটি হচ্ছে ফতোয়া এবং কাজা (বিচার) দুটি পৃথক বিষয়। ফতোয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমের মতামত। আর কাজা (বিচার) হচ্ছে রাষ্ট্রের বিচারবিভাগ কর্তৃক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়। আর সে রায় বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের। সুতরাং শরীয়তের হদ-তাযীর তথা বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের দ বিধি সম্পর্কে বিচারিক রায় দেয়া বা তা বাস্তবায়ন করা কোনো মুফতির (প্রকৃত অর্থেই ফতোয়াদানকারী) কাজ নয়; বরং এটি বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব। সে প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, কোনো নারী বা পুরুষ ব্যভিচারে জড়িত হলে তার ওপর শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও আদালতের। ফতোয়া বা মুফতিকে এর সঙ্গে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এটা তাদের কাজও নয়।
ফতোয়া ও তার পরিধি এবং ফতোয়া ও সালিশের পার্থক্য না বুঝে সরাসরি ফতোয়াকে আক্রমণ করা মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী। এক্ষেত্রে বুঝে না বুঝে ফতোয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, ফতোয়া নিষিদ্ধের দাবি তোলা এবং ফতোয়াকে নারী নিগ্রহের কারণ মনে করা চরম নির্বুদ্ধিতা। নারীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ফতোয়ার ভূমিকাই প্রধান। আমরা চাই হেনার মতো আর কোনো নারীর এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু না ঘটুক। একই সঙ্গে সব মহলের প্রতি ফতোয়া ও ইসলামী যে কোনো পরিভাষার ক্ষেত্রে আচরণ ও উচ্চারণে সংযত হওয়ার প্রতি আন্তরিক অনুরোধ করি।
ফতোয়া সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
প্রশ্ন : আইনানুগ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতের নাম ফতোয়া-এ কথা কি সঠিক?
উত্তর : কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের একজন বিচারপতি বলেছিলেন যে, ফতোয়া হচ্ছে আইনানুগ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মত। ফতোয়ার এই নতুন সংজ্ঞা তিনি এজন্য প্রদান করেছিলেন, যাতে গোটা দেশের সকল দারুল ইফতা এবং মুফতী ছাহেবান কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াসমূহকে বে-আইনী সাব্যস্ত করা যায়। বলাবাহুল্য, যখন মূল কথাটিই অশুদ্ধ তখন এর উপর ভিত্তি করে যা বলা হচ্ছে তা শুদ্ধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ফতোয়া একটি আরবী শব্দ এবং শরীয়তের একটি পরিভাষা। কোনো আরবী অভিধানে, কিংবা শরীয়তের পরিভাষার উপর লিখিত কোনো গ্রন্থে ফতোয়ার এই সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। আরবী ভাষার নির্ভরযোগ্যতম প্রাচীন গ্রন্থ আলকামূসুল মুহীত, মাজদুদ্দীন ফাইরোযাবাদী (মৃত্যু : ৮১৭ হি.) খ : ৪, পৃষ্ঠা : ৫৪০) ও লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর আফ্রিকী (মৃত্যু : ৭১১ হি.) খ : ১৫, পৃষ্ঠা : ১৪৮ পরিষ্কার বলা হয়েছে-
الفتوى ما أفتى به الفقيه.
অর্থাৎ কারো প্রশ্নের উত্তরে ফকীহ (ফিকহ ও ফতোয়া-বিশেষজ্ঞ) শরীয়তের যে বিধান বর্ণনা করেন তা-ই ফতোয়া।
আহমদ আলফাইয়ুমী (মৃত্যু : ৭৭০ হি.) তাঁর ফিকহ ও ফতোয়া বিষয়ক অভিধান ‘আলমিসবাহুল মুনীরে’ (পৃষ্ঠা : ২৩৯) বলেছেন, ‘কোনো ইস্তিফতার জবাবে আলেমের বাতলানো বিধানের নাম ফতোয়া।’
যদি আইনানুগ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতের নাম ফতোয়া হত তাহলে এখানে বলা হত-
ما حكم به القاضي/الحاكم
অর্থাৎ ফতোয়া কাযী বা বিচারকের ফয়সালাকে বলা হয়। (নাউযুবিল্লাহ)
ফতোয়া ও কাযার পার্থক্য এতই পরিষ্কার যে, একজন সাধারণ মানুষও এই দুয়ের মাঝে ভুল করে না। মাসআলা জানার প্রয়োজন হলে মুফতীর কাছে যায়, আর আইনগত নিষ্পত্তির প্রয়োজন হলে আদালতের শরণাপন্ন হয়।
‘‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা’য় মুফতী শব্দের অধীনে বলা হয়েছে যেÑMufti, Arabic MUFTI, an Islamic Legal authourity who gives a formal Legal opinion (Fatwa) in answer to an inquiry by a private individual or judge ... (খ : ৮, পৃষ্ঠা : ৩৯৪)।
তদ্রূপ সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে (যা মূলত লাইডেন থেকে প্রকাশিত Shorter Encyclopaedia of Islam অবলম্বনে সংকলিত) বলা হয়েছে, ‘‘ফতোয়া : ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতী (Juriscconsult) কর্তৃক প্রদত্ত বা প্রকাশিত বিধানকে ফাতওয়া বলা হয়। বিচারক বা ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দান ফাতওয়ার উদ্দেশ্য। এই ফাতওয়ার অনুসরণে বিচারক মোকদ্দমার বিচার করেন এবং ব্যক্তি তাহার ব্যক্তিগত জীবন সুনিয়ন্ত্রিত করেন। (খ : ২, পৃষ্ঠা : ১৭)
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘‘ফতোয়া (ফতওয়া বা ফাতওয়া) আরবী শব্দ। ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতী (Juriscconsult) কর্তৃক প্রদত্ত বা প্রকাশিত বিধান। এর উদ্দেশ্য একজন বিচারক বা একজন ব্যক্তি কর্তৃক উত্থাপিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দান।’’ (৭/৭৩)
কারো যদি এ প্রসঙ্গে কোনো অস্পষ্টতা থাকে তাহলে উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলি দ্বারা তা নিরসন হয়ে যাওয়া উচিত। তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিত যে, মুফতী শরীয়তের বিধান বর্ণনাকারী ও শরঈ আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা, তিনি বিধান প্রয়োগ ও বাস্তবায়নকারী নন।
উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোতে বিচারপতির জন্যও শরীয়তের বিধানের ক্ষেত্রে মুফতীর শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘আদাবুল কাযী’র (বিচারকের বিচার-বিধি)র একটি স্বীকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা এই যে, বিচারপতি যদি মাহির (বিশেষজ্ঞ) আলিম না হন তাহলে তাঁকে শরীয়তের বিধান জানার জন্য মুফতীর শরণাপন্ন হতে হবে।
ফতোয়া ও বিচারের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য এ বিষয়টিও লক্ষ করা যায় যে, অনেক মাহির আলিম একই সাথে মুফতীও ছিলেন এবং বিচারপতিও ছিলেন। বিচারপতি হিসাবে তার আইনগত ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তার ঐসব সিদ্ধান্তই ‘বিচারিক রায়’ বলে গণ্য হয়েছে, যা তিনি বিচারপতি হিসেবে প্রদান করেছেন। পক্ষান্তরে তিনিই যখন মানুষের প্রশ্নের উত্তরে মাসআলা বর্ণনা করেছেন তখন তা বিচারপতি নন এমন মুফতীদের ফতোয়ার মতো নিছক ফতোয়া বলেই গণ্য হয়েছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা ‘ইফতা’র দায়িত্বও দান করেছেন, কাযা বা বিচারের দায়িত্বও। প্রথম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব বিধিবিধান বর্ণনা করেছেন তা ফতোয়া হিসাবে গণ্য। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তা কাযা বা বিচার বলে গণ্য।
হাদীসের কিতাবে দু ধরনের সিদ্ধান্তই বর্ণিত আছে। তবে প্রথমোক্ত বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে
أفتى رسول الله صلى الله عليه وسلم بكذا
শব্দে আর শেষোক্ত বিষয়গুলি
قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم بكذا
শব্দে।
ইমাম ইবনুত তাল্লা’ (৪৯৭ হি.) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালাসমূহের একটি সংকলন প্রস্ত্তত করেছেন, যার নাম
أقضية رسول الله صلى الله عليه وسلم
এতে শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিচারিক রায়গুলি উল্লেখিত হয়েছে।
পক্ষান্তরে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু বলেছেন তা ফতোয়া, আছার ও হাদীসের কিতাবসমূহে সংকলিত হয়েছে।
মুফতী দ্বীনের ও শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও মাহির হয়ে থাকেন। তার কোনো আইনী ক্ষমতা থাকে না। বিচার করা কিংবা কোনো শাস্তি কার্যকর করার অধিকারও তার নেই। এমনকি কোনো আলিমকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ করা হলেও তিনি শুধু শরীয়তের বিধান বর্ণনা করারই অধিকারী হবেন। বিচার কিংবা শাস্তি কার্যকর করার অধিকার তার থাকবে না। বিচার হচ্ছে বিচারকের কাজ আর শাস্তি কার্যকর করা রাষ্ট্রের অনুমোদিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ।
মুফতীর ফতোয়ায় আইনী দিক শুধু এইটুকু যে, তিনি যেহেতু শরীয়তের বিধান বর্ণনা করেন আর প্রত্যেক মুসলিম শরীয়তের বিধান পালনের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকেই মুকাল্লাফ বা আদিষ্ট তাই নিজের ঈমানের দাবিতে হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার ভয়ে ফতোয়া অনুযায়ী আমল করতে বাধ্য। তবে শুধু এই আইনী দিকটির কারণে বিচার করা ও শাস্তি কার্যকর করার অধিকার মুফতী লাভ করে না; বরং এর জন্য বিচার বিভাগ রয়েছে।
প্রশ্ন : যোগ্য আলেমের ফতোয়া প্রদানের অধিকার লাভের জন্য কি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া জরুরি? ইসলামে বিচারের মতো ফতোয়ার জন্যও কি আমীরুল মুমিনীন বা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ লাভের প্রয়োজন আছে?
উত্তর : মুফতী এমন একটি পদবি, যার জন্য সরকারী নিয়োগের প্রয়োজন নেই। কেননা ফতোয়ার জন্য আইনী ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না।
পূর্বে উসূলুল ইফতা ও আদাবুল মুফতী সংক্রান্ত কিতাবের উদ্ধৃতিতে মুফতীর গুণাবলি ও শর্তসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে এমন কোনো কথা নেই যে, ফতোয়া প্রদানের জন্য মুফতীকে রাষ্ট্রের অনুমোদিত ব্যক্তি বা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে। ঐসব গুণাবলি ও শর্তসমূহের সারকথা এই যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে ফতোয়ার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা এবং ফিকহ-ফতোয়ার মাহির স্বীকৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার এ যোগ্যতার স্বীকৃতি থাকতে হবে।
উপরোক্ত যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে শরীয়তের পক্ষ থেকে শুধু অনুমতি প্রাপ্তই নন; বরং আদিষ্টও বটে। এজন্য অন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। যেমনটি কুরআন শিক্ষা দান, তাফসীর বর্ণনা, হাদীস ও ফিকহ শিক্ষাদান, সীরাতুন্নবীর আলোচনা, ওয়াজ-নসীহত, তাযকিয়া-তরবিয়ত ও দ্বীনী বিষয়ে রচনা ও সংকলনের জন্য সরকারের অনুমতি ও নিয়োগের প্রয়োজন হয় না।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু করে ইসলামী খেলাফত ও রাজ্য-শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত কাযী ও হাকিমের নিয়োগ খলীফা বা তার অনুমোদিত সুলতানের পক্ষ থেকে হওয়া আবশ্যক ছিল। কেননা, সরকারী নিয়োগ ব্যতীত কেউ এ দায়িত্ব পালন করতে পারত না। অন্যদিকে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব ফকীহ ও মুফতীগণ নিজেরাই পালন করতেন। সাধারণ মানুষ তাদের শরাণাপন্ন হত আর তারা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা এই ছিল যে, কোথাও কোনো অযোগ্য লোক ফতোয়া দিলে স্বীকৃত ফকীহ ও মুফতীগণের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্র তাকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করত।
ইমাম সাদ উদ্দীন হারেছী, যিনি একজন কাযী ছিলেন তিনি বলেন, ফতোয় দেওয়া তো একটি নেক আমল। (এটি তো বিচার নয় যে,) এর জন্য সরকারী অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। সালাফের কর্মপন্থাও এই ছিল যে, এ বিষয়ে সরকারী অনুমোদনের অপেক্ষা করা হত না। (আলআদাবুশ শরইয়্যাহ, ইবনে মুফলিহ (মৃত্যু : ৭৬৩ হি.) ৩/৩৯০)
জামিয়া বাগদাদ ও জামিয়া ছানআয় শরীয়ত ও হুকুক এবং ফিকহে মুকারানের অধ্যাপক ড. আবদুল করীম যাইদান রাহ. তাঁর কিতাব ‘উসূলুদ দাওয়াহ’-এর مَنْ مَنْ لَهُ حَقُّ الإِفْتَاءِ لَهُ حَقُّ الإِفْتَاءِ
(ফতোয়া প্রদানের অধিকার কার?) শিরোনোমের অধীনে লেখেন-
كُلُّ مَنْ كَانَ أَهْلاً لِأَنْ يَكُوْنَ مُفْتِياً كَانَ أَهْلاً لِأَنْ يُفْتِي، سَوَاءٌ عُيِّنَ مُفْتِياً أَوْ لَمْ يُعَيَّنْ.
অর্থাৎ যে মুফতী হওয়ার যোগ্য সেই কেবল ফতোয়া দিতে পারেন। তাকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক বা না হোক। (উসূলুদ দাওয়াহ ১৬১)
ড. আবদুল করীম যাইদান আরো বলেছেন, যে ফতোয়া প্রদানের যোগ্য কিন্তু মুফতী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত নন তারও সরকারের অনুমতি ছাড়াই ফতোয়া দেওয়ার অধিকার আছে। কেননা, ফতোয়ার অর্থ হল আল্লাহর বিধান ও শরীয়ত বর্ণনা করা এবং তা প্রচার করা। অতএব তা যোগ্য ব্যক্তির অন্যতম দ্বীনী দায়িত্ব। আর কোনো দ্বীনী দায়িত্ব পালনে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরো বলেছেন, আমাদের এমন কোনো নযীর জানা নেই যে, ফতোয়া প্রদানের পূর্বে কেউ সরকারের অনুমতি নিত।
তিনি আরো বলেন, ফতোয়া প্রদানের অধিকার লাভের জন্য সরকারের অনুমোদন শর্ত নয়। কিন্তু ফতোয়া প্রদানকারী বাস্তবেই এ কাজের যোগ্য কি না-তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন স্বীকৃত আলিম ও ফকীহগণের স্বীকৃতি। (উসূলুদ দাওয়াহ পৃষ্ঠা : ১৬২)
ফতোয়ার ভিত্তি যোগ্যতা, সরকারী নিয়োগ নয়। এজন্য কে ফতোয়া প্রদানের যোগ্য, কে যোগ্য নয় তা যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এর জন্য উসূলুল ফিকহ ও আদাবুল মুফতী ও মুসতাফতী সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহে কিছু নিদর্শনও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একথা বলা হয়নি যে, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যাথার প্রয়োজন নেই। কারণ ফতোয়া তো তিনিই দিবেন যিনি সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত!
একটু ভেবে দেখুন, শরীয়তে কাযীর মতো মুফতীও যদি সরকারীভাবে নিযুক্ত হতেন তাহলে উপরোক্ত আলোচনা অর্থহীন হয়ে যায়। বিচারকের ক্ষেত্রে কে বিচারের যোগ্য, কে যোগ্য নয়-সাধারণ মানুষের জন্যও তা নিরূপণের কোনো উপায়-নিদর্শন বলা হয়নি; বরং সেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, সরকারী নিয়োগ ছাড়া বিচারের কোনো বৈধতা নেই।
ফতোয়া প্রদান বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা কী-এ সম্পর্কে ‘আলফকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ’ কিতাবে খতীব বাগদাদী (মৃ. : ৪৬৩ হি.) লেখেন-
على الإمام أن يفرض لمن نصب نفسه لتدريس الفقه والفتوى في الأحكام، ما يغنيه عن الاحتراف والتكسب، ويجعل ذلك في بيت مال المسلمين.
অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হল যারা ফিকহের তালীম-অধ্যাপনা ও ফতোয়া প্রদানের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে তাদের জন্য এ পরিমাণ ভাতা প্রদান করা যেন তারা জীবিকার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকে। আর এ ভাতা মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে দেওয়া হবে। (২/৩৪৭)
এরপর তিনি খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর ওই ফরমান বর্ণনা করেন, যা তিনি হিমসের গভর্ণরকে লিখেছিলেন।
، انظر إلى القوم الذين نصبوا أنفسهم للفقه وحبسوا في المسجد عن طلب الدنيا فأعط كل رجل منهم مئة دينار يستعينون بها على ما هم عليه من بيت مال المسلمين، حين يأتيك كتابي هذا، فإن خير الخير أعجله، والسلام عليك.
অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে ফিকহের খেদমতের জন্য নিয়োজিত করে এবং দুনিয়ার উপার্জন বাদ দিয়ে নিজেদেরকে মসজিদে (যা তখনকার মাদরাসা ও দারুল ইফতা ছিল) আবদ্ধ রাখে তাদের প্রত্যেককে মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে এক শত দিনার করে প্রদান করুন। আমার পত্র পাওয়ার পর অনতিবিলম্বে এই আদেশ পালন করবেন। কেননা সর্বোত্তম নেক কাজ হল যা দ্রুত করা হয়। ওয়াসসালাম। (২/৩৭৪)
এখানে আরবী শব্দ نَصَبَ نَفْسَهُ বা ْ نَصَبُوْا أَنْفُسَهُمْ
শব্দগুলো লক্ষ্য করুন, যার অর্থ যে/যারা নিজেকে/নিজেদেরকে এই কাজে নিয়োজিত করেছে। অর্থাৎ ফিকহ ও ফতোয়ার খেদমতের জন্য সরকারের নিয়োগ আবশ্যক নয়। যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি সরকারী অনুমতি ছাড়াই এ কাজে নিয়োজিত হতে পারে।
ওমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর ফরমান সম্পর্কেও চিন্তা করা যায়। ফিকহ ও ফতোয়ার খেদমতে যারা নিয়োজিত আছে, তাদের মধ্যে কারা সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত আর কারা নিয়োগপ্রাপ্ত নয়-এ বিষয়টি যাচাই করার কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন, যারা এ খেদমতে নিয়োজিত তাদেরকে বাইতুল মাল থেকে ভাতা প্রদান করুন। সৌভাগ্যবান ও সচেতন রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত এমনই হয়ে থাকে!
প্রশ্ন : ইসলামে ‘হদ’ ও ‘তাযীর’ নামে বিভিন্ন অপরাধের যেসব শাস্তি রয়েছে একজন মুফতীর পক্ষে কি কোনো অপরাধীর উপর সেসব শাস্তি কিংবা অন্য কোনো শাস্তি কার্যকর করার অধিকার আছে? শরীয়তের দৃষ্টিতে সালিশী দরবারের মাধ্যমে অপরাধীর উপর কোনো শাস্তি প্রয়োগ বা কার্যকর করার অধিকার আছে কি? আশা করি হদ ও তাযীরের সংজ্ঞা ও পরিচয়ও উল্লেখ করবেন।
উত্তর : অন্যায়-অপরাধ রোধ করার জন্য শরীয়তে বিভিন্ন শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। এগুলি মৌলিকভাবে দুই প্রকার : ১. ঐ সব শাস্তি, যা শরীয়তের পরিভাষায় ‘হদ’ নামে পরিচিত। এর বহুবচন ‘হুদুদ’। অর্থাৎ ঐসকল শাস্তি, যার ধরন, পরিমাণ ও কার্যকর করার পদ্ধতি, সবকিছুই শরীয়ত পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছে। যেমন ব্যভিচারের হদ, মিথ্যা অপবাদের হদ, চুরির হদ, ডাকাতির হদ, ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়ার সাজা ইত্যাদি।
২. ঐ সকল শাস্তি, যাকে ‘তা’যীর’ বলে। অর্থাৎ কিছু অপরাধ এমন আছে যেগুলোর কারণে শরীয়তে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে শাস্তির ধরন ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়নি, এটা দায়িত্বশীল বা কর্তৃপক্ষের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন বিনা ওজরে অব্যাহতভাবে নামায না পড়ার শাস্তি, রমযানের মর্যাদা বিনষ্ট করার শাস্তি, ঘুষ খাওয়ার শাস্তি, দুর্নীতি ও পণ্যে ভেজাল দেওয়ার শাস্তি ইত্যাদি।
তা’যীরের একটি প্রকার আছে, যাকে ‘তাদীব’ বলে। অর্থাৎ ঐ সামান্য শাস্তি, যা অধীনস্তদের তরবিয়তের জন্য পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করার অনুমতি অভিভাবকদের দেওয়া হয়েছে। যেমন পিতা সন্তানদের শাসন করেন।
তাদীব পর্যায়ের সামান্য শাসনের অনুমতি তো অভিভাবকদের রয়েছে, যদিও মাত্রা রক্ষা করা ও শরীয়তের সীমার ভিতরে থাকা সর্বাবস্থায় জরুরি, কিন্তু তাযীরের প্রথমোক্ত প্রকার, (যা এক ধরনের হুদুদই বটে) এবং হুদুদ, কিসাস কার্যকর করার অধিকার সাধারণ জনগণের নেই। এই শাস্তিগুলো কার্যকর করা সরকারের দায়িত্ব। অন্য কেউ যদি এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করে তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
মুফতী হুদুদ-তাযীরের মাসাইল বর্ণনা করতে পারেন, কিন্তু তা কার্যকর করার অধিকার না মুফতীর আছে, না মুসতাফতির। এটা সরকারের কাজ। এজন্য প্রত্যেকের কর্তব্য, এ ধরনের বিষয় সরকারের উপর ন্যস্ত করা। সরকার যদি ভাগ্যবান হয় তাহলে ইসলামী হদই প্রয়োগ করবে, অন্যথায় অন্য কোনো শাস্তি কার্যকর করবে।
হুদুদ-কিসাস প্রয়োগ করা সরকারের কাজ, অন্যরা তা প্রয়োগ করতে পারে না-এটি শরীয়তের একটি স্বীকৃত বিধান, যা সকল ফিকহী মাযহাবের ফতোয়া। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। হাদীস ও ফিকহ উভয় ধরনের কিতাবেই তা বিদ্যমান রয়েছে।
দেখুন :
১. ইবনে আবী শাইবা (২৩৫ হি.) : আলমুসান্নাফ খ : ১৪, পৃষ্ঠা : ৪৪১
২. আলকাসানী (৫৮৭ হি.) : বাদায়েউস সানায়ে খ : ৭, পৃষ্ঠা : ৫৭
৩. ইবনে রুশ্দ (৫৯৫ হি.) : বিদায়াতুল মুজতাহিদ খ : ২, পৃষ্ঠা : ৪৪৪-৪৪৫
৪. আননাবাবী (৬৭৬ হি.) : রওযাতুত তালিবীন খ : ১০, পৃষ্ঠা : ২৯৯
৫. আলমওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়াইতিয়্যাহ খ : ১৭, পৃষ্ঠা : ১৪৪-১৪৫।
ফিকহ ও ফতোয়ার এই বিধানটি খুবই প্রসিদ্ধ এবং মাদরাসার তালিবে ইলমদেরও তা জানা থাকে। কারণ মাদরাসার পাঠ্যসূচিভুক্ত কিতাবসমূহেও এই বিধান বিদ্যমান রয়েছে।
‘মুখতাসারুল কুদুরী’ যা মাদরাসার তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে পড়ানো হয় তাতে এই বিধান বলা আছে। তদ্রূপ হিদায়া ও অন্যান্য কিতাবে, যা উপরের শ্রেণীতে পড়ানো হয়, এই বিধানটি দলীল-প্রমাণসহ বিদ্যমান রয়েছে।
হেদায়া কিতাবে (খ : ২, পৃষ্ঠা : ৫১১) পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘হদ’ কার্যকর করা ‘ওয়ালি’র দায়িত্ব। (ওয়ালি অর্থ আমীরুল মুমিনীন বা তার নিয়োগকৃত আইনী ব্যক্তি) এমনকি কোনো মনিব তার কৃতদাসের উপরও ওয়ালীর অনুমতি ব্যতিরেকে হদ প্রয়োগ করতে পারবে না।
হিদায়া কিতাবে (খ : ৩, পৃষ্ঠা : ১৪৪, বাবুত তাহকীম) আরো বলা হয়েছে, ‘হুদূদ-কিসাস প্রয়োগ করার জন্য কাউকে হাকাম (শালিশ) বানানো দুরস্ত নয়।’ বোঝা গেল যে, সালিশী দরবার হুদূদ বা কিসাস প্রয়োগ করার অধিকার রাখে না।
অতএব যার মাদরাসার পাঠ্যভুক্ত কিতাবসমূহ পড়ার সুযোগ হয়েছে সে এমনকি আলিম হতে না পারলেও এই বিধানটি তার জানা থাকে। ফলে হুদুদ প্রয়োগকারী শালিসের সমর্থন দেওয়ার মতো ভুল তার হওয়ার কথা নয়।
বিভিন্ন জায়গায় দোররা মারার যে ঘটনাগুলো ঘটছে সে সম্পর্কে পত্র-পত্রিকার রিপোর্টিং সঠিক হলে বোঝা যাবে যে, জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এবং সরকার দলীয় লোকদেরও জানা নেই যে, সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ, তদ্রূপ হুদূদ-কিসাস প্রয়োগ করা সালিশী দরবারের কাজ নয়, আদালতের কাজ। এজন্য করণীয় হচ্ছে, শিক্ষা-মাধ্যম ও প্রচার-মাধ্যম ব্যবহার করে সর্বশ্রেণীর মানুষকে শরীয়তের এই বিধান সম্পর্কে অবগত করা। পাশাপাশি পশ্চিমা ফৌজদারি আইনকানুন বাতিল করে আল্লাহর উপর ভরসা করে শরীয়তের ফৌজদারি আইন প্রতিষ্ঠা করা। যাতে আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তিসমূহ অকার্যকর না হয়ে যায়। কারণ আল্লাহর হুদূদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য কোনো ভূখন্ডের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
প্রশ্ন : বিভিন্ন সালিশী রায়ের উপর ‘ফতোয়া’ শব্দের যে প্রয়োগ হচ্ছে তা কি সঠিক?
উত্তর : জ্বী না। ঠিক নয়। এটা একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, সালিশী করার অধিকার কে রাখে এবং কাকে সালিশ বানানো যায়। কিন্তু সালিশী করার অধিকার রাখে, এমন কোনো ব্যক্তিকে যদি সঠিক পন্থায় সালিশ বানানো হয় এবং তিনি সঠিক পন্থায় সালিশীর দায়িত্ব পালন করেন তবুও তার রায়কে ‘ফতোয়া’ বলা যাবে না। একে ‘কাযা’ও বলা হবে না; বরং এটা ‘হুকুম’ বা ফয়সালার একটি প্রকার, যাকে ফিকহের পরিভাষায় ‘তাহকীম’ বলা হয়।
সাধারণ পরিভাষাতেও একে ফতোয়া বলা হয় না এবং এ ধরনের বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরাও মনে করে না যে, তারা ফতোয়ার মজলিসে আছে কিংবা ফতোয়ার উপর আমল করছে। তাছাড়া দেশে অনেক ফতোয়া বিভাগ আছে, কোথাও এ ধরনের বৈঠকের আয়োজন করা হয় না। কোনো মুফতীর ফতোয়ার ভিত্তিতে কিংবা এ ধরনের বিচার বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা যদি কোনো ফতোয়া বিভাগের শরণাপন্ন হয়ে ইসলামী শরীয়তে বিচার-বৈঠক কিংবা সালিশী দরবারের মাধ্যমে বিচার করার হুকুম জেনে নিত তাহলে ফতোয়া বিভাগ থেকে তাদেরকে এই ফতোয়াই প্রদান করা হত যে, হুদুদ ও তাযীরের ক্ষেত্রে সালিশী দরবার চলে না। এর জন্য আদালত প্রয়োজন। কোনো সালিশ বা সালিশী দরবারের মাধ্যমে কাউকে দোররা মারা কিংবা অন্য কোনো শাস্তি প্রদানের অধিকার নেই। (হেদায়া ৩/১৪৪; ইমদাদুল ফাতাওয়া)
বোঝা গেল, কোনো সালিশী দরবারকে ফতোয়া-বৈঠক বলা অপরাধ। বাস্তবতা এই যে, যদি ফতোয়ার উপর আমল করা হত তাহলে কোনো সালিশী দরবারের মাধ্যমে কাউকে দোররা মারা হত না এবং অন্য কোনো শাস্তিও কার্যকর হত না।
আমাদের দেশের প্রচলিত আইনেও সালিশী সম্পর্কে বিভিন্ন নীতিমালা রয়েছে। আমার জানা মতে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও কোনো সালিশ কিংবা পঞ্চায়েতের শাস্তি কার্যকর করার অধিকার নেই। আজকাল সালিশী দরবারের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করার শরীয়তপরিপন্থী ও বে-আইনী তৎপরতার যেসব ঘটনা ঘটছে তা মূলত সালিশী বিচারব্যবস্থার ভুল প্রয়োগ। ফতোয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি একে ফতোয়ার ভুল ব্যবহার বলাও ঠিক হবে না। আজ পর্যন্ত কোনো দারুল ইফতা কিংবা কোনো মুফতীর ফতোয়ার ভিত্তিতে এমন কোনো অঘটন ঘটেনি। যা কিছু ঘটছে সবই গ্রামের মূর্খ লোকদের মাধ্যমে হচ্ছে, যাদের ফিকহ ও ফতোয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই এবং রাষ্ট্রীয় আইন সম্পর্কেও যারা অজ্ঞ। এসব ঘটনার সাথে ফতোয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ একটি পরিভাষাকে জড়ানো ইসলাম-বিদ্বেষীদের একটি ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্র।
প্রশ্ন : ৫. ফতোয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর : এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হল:
১. ফতোয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সম্পূর্ণ মানবাধিকার পরিপন্থী একটি কাজ। কারণ ফতোয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় নির্দেশনা জানা ও জানতে চাওয়া মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। ফতোয়া জিজ্ঞাসা এবং ফতোয়া প্রদানের অধিকার যে মানুষের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার, তা আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় স্বীকৃত। এখানে আমরা শুধু একটি ধারা উল্লেখ করছি।
ধর্মীয় স্বাধীনতা :
৪১/(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে। (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান)
ফতোয়া ছাড়া সাধারণ মুসলমানের ইসলামী শরীয়ত পালন করার কোনো উপায় নেই। তদ্রূপ ইসলাম ও শরীয়তের বিধিবিধানের প্রচার-প্রসারের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং সর্বশ্রেণীর জনগণের জন্য সহজ ও উপযুক্ত মাধ্যম হচ্ছে ফতোয়া। এজন্য এটি মুসলমানদের একটি সাংবিধানিক অধিকারও বটে।
উপরন্তু বাস্তবতা এই যে, একমাত্র ইসলামী শরীয়তই সকল হকদারকে তার হক যথাযথভাবে প্রদান করেছে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই হচ্ছে-
اعط كل ذي حق حقه
প্রত্যেক হকদারকে প্রাপ্য হক প্রদান কর। এজন্য কোনো সমাজে যদি ফতোয়ার সঠিক চর্চা ও প্রচলন হয় তাহলে নাগরিকদের মধ্যে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হবে। এজন্য সরকার যদি মানবাধিকার রক্ষা এবং হকদারকে প্রাপ্য হক প্রদানের বিষয়ে উদ্যোগী হন তাহলে সম্মানিত মুফতীদের ফতোয়ার ব্যাপক প্রচার-প্রসারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দেশের মিডিয়াগুলোকেও এই কাজে ব্যবহার করা কর্তব্য।
২. এটি দ্বীন ও শরীয়তের বিরুদ্ধে মারাত্মক বিদ্রোহ। এর উদ্দেশ্য হল, মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিমুখ করা। সরকারিভাবে ইসলামী বিধান কার্যকর না থাকায় একদিকে শরীয়তের অধিকাংশ বিধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর সামান্য যা অবশিষ্ট আছে সেটুকুও ইসলামের শত্রুরা মুছে দিতে চায়।
৩. এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। এর উদ্দেশ্য হল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা। শুধু ইসলামী বিশ্ব নয়; পুরো দুনিয়ার বিপরীতে এখানে ফতোয়া নিষিদ্ধ করার মতো হীন আইন প্রণয়নের ষড়যন্ত্র চলছে। নাউযুবিল্লাহ।
প্রশ্ন : ৬. ফতোয়া প্রদান বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব কী?
উত্তর : এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব হল :
১. প্রচার-মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মাঝে ফতোয়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের অন্তরে মুফতীর প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা তৈরি করা।
২. ফতোয়া বিভাগ ও ফতোয়া অনুশীলনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কিতাব ও প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করা।
৩. ফতোয়ার ব্যাপারে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করা।
৪. মুফতীগণের জন্য মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে ভাতা প্রদান করা।
৫. কোনো অযোগ্য ব্যক্তি ফতোয়া দিলে স্বীকৃত আহলে ফতোয়ার পরামর্শক্রমে তাকে এই ভুল কাজ থেকে বিরত রাখা।
(দেখুন : আলফকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ ২/৩২৪-৩২৫; ফাতাওয়া শামী ৫/৯৩; আলমওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়াইতিয়্যাহ ৩২/৪৫-৪৬)
৬. অবিলম্বে ফতোয়াবিরোধী সকল প্রোপাগাইন্ডা বন্ধ করা।
৭. নিয়মতান্ত্রিকভাবে দ্বীন ও শরীয়তের শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া শুধু তরজমা পড়ে কিংবা সিডি দেখে দ্বীনী বিষয়ে মত প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
৮.ফতোয়ার মতো দ্বীনী মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা সম্পর্কে ‘ফতোয়াবাজি’, ‘ফতোয়ার শিকার’ জাতীয় অবমাননাকর শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
নূরজাহান থেকে হেনা : মোটা দাগের তিন ভুল
শরীফ মুহাম্মদ
মৌলভীবাজারের নুরজাহান থেকে শরীয়তপুরের হেনা। গ্রাম্য সালিশের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার দুটি নারী। প্রায় দু যুগের এ দুই নারীর মাঝে আরও কয়েকজন থাকতে পারেন। নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক, অশালীন জীবন ও যৌন বিশৃঙ্খলা এবং দাম্পত্যের ভাঙ্গা-গড়ার সালিশের শাস্তিতে এ নারীদের মৃত্যু হয়। প্রায় প্রতিটি ঘটনার সময় মিডিয়া, এনজিও ও সুশীলরা সরব হন। পাশাপাশি প্রাজ্ঞ আলেমরাও জানান, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে ডিঙ্গিয়ে এভাবে শাস্তি কার্যকর করা যায় না। এভাবে গ্রাম্য সালিশের ঘটনায় নারীর ওপর শাস্তি বিষয়ে প্রচারণা ও পদক্ষেপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে এর সঙ্গে বিচারবিভাগও যুক্ত হয়ে পড়েন। বেদনাদায়ক এসব ঘটনায় ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোটা দাগে তিনটি ভুল বারবার চোখে পড়ছে।
এক.
নারীর অবৈধ সম্পর্ক বিষয়ে নারীর ওপর শাস্তি প্রয়োগ করার সালিশী ঘটনাকে প্রতিবারই ‘ফতোয়া’ ও ‘ফতোয়াবাজি’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। শাস্তিপ্রাপ্ত নারীদের দুর্ভোগ, অবমাননা ও মৃত্যুর জন্য ফতোয়াকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে দিতে এখন বিচারবিভাগ থেকেই সব রকম ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দশ বছর আগে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ থেকে ‘সব রকম ফতোয়া’ নিষিদ্ধ করে একটি রায়ও দেওয়া হয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে।
সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতে আবার তার শুনানি চলার কথা রয়েছে। অথচ আলেমরা বলছেন, গ্রাম্য সালিশ ও ফতোয়া এক বিষয় নয়। কেবল ‘দাম্পত্য ও যৌন বিষয়’ সম্পর্কিত ধর্মীয় বিধিনিষেধকেই ফতোয়া বলা হয় না। ফতোয়ার পরিধির মধ্যে মুসলমানদের জীবনের সবদিক ও শাখা অন্তর্ভুক্ত। ফতোয়া নিষিদ্ধ হওয়ার মানে ধর্মীয় বিষয়ে জানতে চাওয়া ও জানাতে চাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। এটা হতে পারে না। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় এবং মুসলমানদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু বিজ্ঞ আলেমদের এসব কথায় মিডিয়া, সুশীল সমাজ, এনজিও, বিচারবিভাগের একটি অংশ এবং বর্তমান সরকারের আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত একটি গোষ্ঠী কান দিতে একদম নারাজ। তারা ‘ফতোয়ার’ ওপরই খাপ্পা। দেখা যাচ্ছে, ফতোয়াকে গালি দিতে না পারলে এবং ফতোয়া নিষিদ্ধ করতে না পারলে তাদের পেটের ভাতই হজম হচ্ছে না। অথচ নুরজাহান-হেনাদের মৃত্যুর কারণ যে গ্রাম্য সালিশ তার সঙ্গে ফতোয়ার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।
দুই.
দ্বিতীয় ভুলটি হলো, গ্রাম্য সালিশের সীমাবহির্ভুত ক্ষমতা চর্চা। নিজেদের এলাকার কোনো বিরোধ, জটিলতা, অসামাজিকতা ও অন্যায় প্রতিরোধে ন্যায়সঙ্গত ও সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নেয়াই সালিশগুলোর প্রধান কাজ। কোনোভাবেই শাস্তি বা দন্ড কার্যকর করা তাদের কাজ হতে পারে না। এটা সালিশের ক্ষমতার বাইরের বিষয়। এর জন্য রাষ্ট্রের বিচারবিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ রয়েছে। বিজ্ঞ মুফতীগণ বলেছেন, ফতোয়ার ভিত্তিতে কোনো প্রকার দন্ড ও ফৌজদারি শাস্তি কার্যকর করতে পারে না কোনো গ্রাম্য সালিশ। কিন্তু তারপরও সালিশ পরিচালক গ্রাম্য মাতবর, মোড়লরা নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক’ বিষয়ে তড়িঘড়ি করে নিজেরাই দন্ড কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে একদিকে পক্ষপাতিত্ব ও অন্যায়-জুলুমের অভিযোগ ওঠেছে। অপরদিকে অভিযুক্ত নারী ও পুরুষের মাঝে প্রকাশ্য শাস্তিতে নারীর অবমাননা ও কষ্টের বোঝা অনেক ভারি হয়ে ওঠেছে। প্রকাশ্যে শাস্তির অবমাননার কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। নুরজাহানের ঘটনাটি ছিল শাস্তি পরবর্তী আত্মহত্যারই ঘটনা। সর্বোপরি এভাবে শাস্তি প্রদান আইন ও বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও অপরাধ হয়েছে। গ্রাম্য সালিশের স্থানীয় পরিচালকরা এসব দন্ড কার্যকর করার সময় স্থানীয় দু’ একজন মৌলভী সাহেবকে যুক্ত করে নেওয়ায় তাদের দন্ডদানের সিদ্ধান্তটিকেই ফতোয়া হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ পেয়েছেন। পরবর্তীতে মিডিয়া, এনজিও, সুশীল সমাজ, বিচার বিভাগ ও সরকারের কোনো কোনো মহলও অন্যায় ও অবিবেচনাপ্রসূত সেই শাস্তিদানের ঘটনাকে ‘ফতোয়া’ হিসেবে তুলে ধরে বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। এ ধরনের শাস্তি দিয়ে তারা প্রথমে আইন ভেঙ্গেছেন, দ্বিতীয়ত নারীর ওপর বিশেষভাবে জুলুম করেছেন, তৃতীয়ত শয়তানী শক্তিগুলোকে ফতোয়ার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
তিন.
তৃতীয় যে ভুলটি এসব ক্ষেত্রে করা হচ্ছে, সেটি হল ভুল পদ্ধতিতে শাস্তিদানের ঘটনা এবং এতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পর প্রচারণা, প্রবণতা ও উন্মাদনার বিষয়টি পুরোপুরি বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের বিশৃঙ্খলা ও চূড়ান্ত অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি উসকে দেওয়া হচ্ছে। যেন একটি সমাজে, একটি গ্রামে অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া কোনো নর-নারীর জন্য কোনো অন্যায়ই না। এটা যেন সহজাত। এতে যেন কেউ কোনোভাবেই বাধা দিতে না পারে, কেউ যেন অন্যায় দৈহিক সম্পর্ককে প্রতিরোধ করতে না পারে-সে রকম একটি আবহ তৈরি করা হচ্ছে। বর্তমানে এটাই বেশিমাত্রায় হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশের পক্ষ থেকে দন্ড দেওয়া ও তা কার্যকর করা অন্যায়। ঠিক আছে। কিন্তু এদেশের মুসলিম একটি সমাজে, একটি গ্রামে যৌন শৃঙ্খলার যে চিত্র থাকে সেটি যদি কারো কারো মাধ্যমে আহত ও আক্রান্ত হয় তাহলে কি তাদেরকে কিছুই বলা যাবে না? বলতে হবে-তাদের কোনো অন্যায় হয়নি? ধর্মীয় বিধিনিষেধের বিষয় তো আছেই। তাছাড়াও যদি চিন্তা করি-বাবা-মা, বউ-বাচ্চা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামীণ যে খোলামেলা জীবন, যে সমাজ সেখানে পরোয়াহীন যৌন বিশৃঙ্খলায় কোনো তরুণ-তরুণী, লিপ্ত হলে তার গতিরোধ করার গরজ সৃষ্টি হওয়া উচিত কি না। যারা গ্রামের বিচার-সালিশ করেন এক্ষেত্রে তাদের কি নিয়মতান্ত্রিকভাবে উদ্যোগী হওয়া অপরাধ? দন্ড দেওয়া ও কার্যকর করা অপরাধ ঠিক আছে। কিন্তু এর মানে তো এটা নয় যে, অবৈধ সম্পর্কে লিপ্তরা নিরীহ এবং তাদের কোনো অন্যায়ই নেই। অথচ মিডিয়া, সুশীল ও পন্ডিতদের প্রচারণায় এরাই এখন আশকারা পাচ্ছে।
অন্যায় অন্যায়ই। ভুল দন্ড দেওয়াও অন্যায়, অন্যায় সম্পর্কে জড়ানোও অন্যায়। একটি গ্রামীণ সমাজের মধ্যে সেটা অনেক বড় অন্যায়। ভুল দন্ডের বিরুদ্ধে মুখের ফেনা তুলে ‘ভুল সম্পর্ক’ নিয়ে নীরব থাকলে বিষয়টা মেলে না।
যারা নারীর ওপর নিগ্রহ বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন, অবশ্যই তাদের দায়িত্ব সবটুকু নিয়েই ভূমিকা রাখা। মূর্খতা, পক্ষপাতিত্ব ও মতলবী প্রচারণার বাইরে আসা। ফতোয়া কাকে বলে ভালোভাবে জানা উচিত। গ্রাম্য সালিশগুলোর কর্মপরিধি ও আওতা ঘোষণা করা উচিত। অবৈধ যৌনাচারের গতিরোধক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ শক্তিশালী করা উচিত।
নুরজাহান থেকে হেনা পর্যন্ত অবাঞ্চিত মৃত্যুর যেসব ঘটনা পত্রপত্রিকায় এসেছে তা অবশ্যই মর্মান্তিক এবং তা ঘটতে দেওয়া যায় না। এর জন্য দরকার মোটা দাগের তিন ভুল থেকে বের হয়ে আসা। তা না হলে বাতাসে ছড়ি ঘুরবে, তলোয়ারে ঝনঝন শব্দ উঠবে, কিন্তু গোটা যুদ্ধটাই হবে ভুল ময়দানে। আর এতে স্বার্থ হাসিল হবে ধর্মদ্রোহী মতলববাজদের, নুরজাহান-হেনাদের নয়।