মুহাররম ১৪৪৬   ||   জুলাই ২০২৪

দান বিনয় ও দয়া

জাভেদ চৌধুরী

মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত আলেম, বক্তা ও রাজনীতিবিদ। আল্লাহ তাআলা শাহ সাহেবের মাঝে প্রোথিত করেছিলেন হৃদয়গ্রাহী ও প্রভাব সৃষ্টিকারী বয়ান করার শক্তি। মানুষ তাঁর জন্য পাগল ছিল।  দুদিনের খাবার সঙ্গে নিয়ে মানুষ তাঁর বয়ান শুনতে আসত। শাহ সাহেবও দুদিন ধরে বয়ান করে যেতেন। নামায ও খাওয়ার বিরতি দিয়ে আবার বয়ান শুরু হয়ে যেত।

শাহ সাহেব ভারত বিভাগের বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, হিন্দু ও মুসলমানরা মিলে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করুক। তারপর ভাই ভাই হয়ে থাকুক। তিনি প্রকাশ্য বক্তৃতায় নিজ মতামত ব্যক্ত করতেন। মানুষ তার বক্তৃতা শুনত, কিন্তু কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগকে ভোট দিত। শাহ সাহেবের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তান গঠিত হয়। শাহ সাহেব পাকিস্তানে হিজরত করেন। মুলতানে বসতি স্থাপন করেন।

একবার মুলতানে একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, শাহ জী, আপনি পাকিস্তানের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানে কেন এসেছেন?

শাহ সাহেব খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন, আপনার ছেলে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। আপনি বিয়েতে রাজি না। আপনি বিবাহের তীব্র বিরোধিতা করলেন, কিন্তু এই বিরোধিতা সত্ত্বেও আপনার ছেলে বিয়ে করে ফেললে আপনার কী করা উচিত?

এর পরে শাহ সাহেব বললেন, আত্মীয়তার পর সেই মহিলা আপনার পুত্রবধু হবে। পুত্রবধুকে আপনার মেনে নিতেও হবে, সম্মানও করতে হবে।

শাহ সাহেব বলেন, আমি পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলাম; কিন্তু আমার বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তান হয়ে গেছে। এখন এটি আমার দেশ। আমি এই দেশের ততটাই সম্মান করি, যতটা সম্মান এদেশে বসবাসকারী অন্যরা করে। একথা শাহ সাহেবের বিচক্ষণতার প্রমাণ বহন করে।

কয়েকদিন আগে এক বন্ধু আমাকে আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর একটি খুব সুন্দর উক্তি এসএমএস করেছিল। আমি যখন থেকে এই উক্তিটি পেয়েছি, তখন থেকে অভিভূত হয়ে আছি। আমি আমার ঝুলি খুলে শাহ সাহেবের জন্য দুআ করছি। শাহ সাহেব বলেন, আমি জীবনভর দুজন মানুষকে খুঁজছি, কিন্তু আমি এদেরকে পাইনি। প্রথমত ওই ব্যক্তি, যে দান করা সত্ত্বেও দরিদ্র। দ্বিতীয়ত ওই ব্যক্তি, যে জুলুম করা সত্ত্বেও আল্লাহর পাকড়াও থেকে বেঁচে গেছে।

এই উক্তিটি কথার কথা নয়। এটি একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান। আপনি যদি আপনার জীবনে এই দুটি নীতি অনুসরণ করেনদান করেন এবং জুলুম করা থেকে বেঁচে থাকেন, তবে আপনি একটি গৌরবময় এবং প্রশান্তির জীবন যাপন করবেন। বিশ্বাস করুন, আপনি আল্লাহর রাস্তায় যদি খরচ না করেন, আপনি যতই ধনী হোন না কেন, আপনি সারা জীবন গরীবই থাকবেন। আপনার হাত সর্বদা অন্যের সামনে পাতা থাকবে। আপনি জালেম হলে, যত শক্তিশালীই হোন না কেন, আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবেন না। এটি আমার জীবনের অভিজ্ঞতাও এবং পর্যবেক্ষণও।

আমি দেশে এমন কয়েক ডজন লোককে চিনি, যাদের বদনাম আছে, যাদের কর্ম ও ধান্ধা ভুল। বিপদ তাদের দিকে পূর্ণ শক্তিতে ধেয়ে আসে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে চায়। সরকার তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে। তাদের বিরুদ্ধে আইন করা হয়। বিচারকেরা তাদের বিরুদ্ধে রায় দেন। তাদের জন্য জেল প্রস্তুত হয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়ে যায়; কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তারা বেঁচে যায়। পৃথিবীর সব কষ্ট তাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। খোঁজ নিলে দেখবেন, তাদের শত ত্রুটি থাকলেও তারা দান-খয়রাত করে। তাদের দস্তরখান উদার। তারা প্রতি মাসে কয়েক ডজন বিধবা, এতীম, নিঃস্ব, অসুস্থ ও অসহায়দের সাহায্য করে। এই সাহায্য তাদেরকে মসীবত থেকেও বাঁচায় এবং সম্পদও বৃদ্ধি করে।

এক ফকীর একজন বুযুর্গের সামনে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করে। একইসাথে দুআ কেের, আল্লাহ আপনাকে বাদশাহ বানান।

বুযুর্গ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বাদশাহ হতে চাও?

ফকির হয়রান হয়ে জবাব দিল, জনাব, আমি কয়েক প্রজন্ম ধরে ফকীর। আমি কীভাবে বাদশাহ হতে পারি?

বযুর্গ বললেন, চলো আমরা একটি পরীক্ষা করি। আমি তোমাকে সফলভাবে বাদশাহ বানাতে পারলে তুমি আমাকে হজ্ব করাবে। আমি ব্যর্থ হলে সারা জীবন তোমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেব।

ফকির মেনে লিন। বুযুর্গ তাকে বললেন, তোমার জেবে কত টাকা আছে?

লোকটি টাকা গুনল। ৩০ রুপি ছিল। বুযুর্গ তাকে মিষ্টির দোকানে পাঠালেন। ৩০ রুপির জিলাপি কিনতে বললেন। সামনে বেকার শ্রমিকেরা বসা ছিল। বুযুর্গ আদেশ করলেন, এই জিলাপিগুলো শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করে দাও।

ফকীর লোকটি শ্রমিকদের মধ্যে জিলাপি বণ্টন করে এল। বুযুর্গ তাকে সাথে বসিয়ে আহার করালেন। বললেন, তুমি বাড়ি চলে যাও। ত্রিশ দিন অপেক্ষা করো। দেখো আল্লাহর পক্ষ থেকে কী বার্তা আসে।

ফকীর চলে গেল। তৃতীয় দিন দৌড়তে দৌড়তে বুযুর্গের কাছে এল। খুশিতে সে লাফাচ্ছিল। বুযুর্গ কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ফকির বললগত মাসে এক কেরানি ভিক্ষার সময় প্রাইজবন্ড দিয়েছিল। আমি ওই বন্ড তুলে রেখেছিলাম। আজ সেই বন্ড প্রকাশ হয়েছে। আমি বসে বসেই তিন লাখ রুপির মালিক হয়ে গিয়েছি।

বুযুর্গ মুচকি হেসে বললেন, এই বন্ডের মালিক তুমি নও। যে তোমাকে বন্ড দিয়েছিল সে-ই এর মালিক। তুমি বন্ডের মালিক খোঁঁজো। এই অর্থ তাঁকে পৌঁছে দাও। অপেক্ষা করো আল্লাহর পক্ষ থেকে কী পয়গাম আসে।

এই আইডিয়া ফকিরের কাছে খুব খারাপ লাগল। তবুও সে কেরানিকে খুঁজে বের করল। বন্ড নিয়ে তার কাছে পৌঁছে গেল। কেরানি ফকিরের সততা দেখে বিস্মিত হল। সে ফকিরকে নিয়ে ডিসি অফিসে গেল। সেখানে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি রেজিস্ট্রি করল। ফকিরকে পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার বানিয়ে নিল এবং সরকারি কন্ট্রাক্ট নেওয়া শুরু করল।

তারা দুজনে একসাথে কাজ করত। কেরানি কন্ট্রাক্ট নিত আর ফকির কাজ করাত। এই কোম্পানি শ্রমিকদের তিন বেলা খাবার দিত। কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেল। কেরানি ও ফকির উভয়েই ধনী হয়ে গেল। তারা ওই বুযুর্গকে প্রতি বছর হজে¦ পাঠাত। সন্ধ্যায় ফকিরদেরকে দাঁড় করিয়ে বাদশাহ হওয়ার পদ্ধতি বলত। এই কোম্পানি আজও আছে। এখানে এখন কেরানি ও ফকিরের সন্তানেরা কাজ করে। এই কোম্পানি ত্রিশ রুপি দান করার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এটি এখন পর্যন্ত ডজন ডজন লোককে বাদশাহদের মতো জীবন দিতে সক্ষম হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক লোককে জানি, যারা মূর্খও, অযোগ্যও এবং অসতর্কও; কিন্তু তাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে।

আমি যখনই খোঁজ করেছি, এই অনুগ্রহ লাভের পেছনে সর্বদা দান-খয়রাত পেয়েছি। এরা উদার হৃদয় ও হাতখোলা। আমি আরেকটি জিনিসও দেখেছি, মানুষ দান করার সাথে সাথে বিনয় অবলম্বন করলে সম্পদও মেলে, সম্মানও মেলে। কারণ, ধনাঢ্যতা যেমন দানশীলতার সাথে সম্পর্কিত, তদ্রূপ সম্মানও বিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনি যত বেশি নত হন, ততই আপনার সম্মান বাড়তে থাকে। এ ব্যাপারে আউলিয়ায়ে কেরামের উপমা দেখুন। আউলিয়া কেরামের মাঝে বিনয় থাকে। তাদের কবর হাজার বছর পর্যন্ত আবাদ থাকে। তারা উদার দিল এবং খোলা হাতের হয়ে থাকেন। তাদের মৃত্যুর পরও তাদের দরবারে লঙ্গরখানা চলতে থাকে। বাদশাহরা ধন-সম্পদ নিয়ে তাদের দরবারে হাজির হন।

এখন জুলুমের কথা বলি। আমার মরহুম বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু শেখ আবদুল হাফিজ রাওয়ালপিন্ডি এক রেল কর্মচারীর কথা বলতেন। এই ভদ্রলোক রাওয়ালপিন্ডিতে থাকতেন। মুলতানে এক ব্যক্তি খুন হয়। পুলিশ ওই খুনের কেসে ভদ্রলোককে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দাঁড় করানো হয়। আইনজীবী ও বিচারক জানতেন, তিনি নির্দোষ। কিন্তু সেই ভদ্রলোক বলতেন, নিশ্চিত আমার মৃত্যুদণ্ড হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

বন্ধুরা তার সাথে দেখা করতে গেল। মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে তার দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ জিজ্ঞেস করল। সে উত্তর দিল, পাকিস্তান হওয়ার সময় আমি রেলের টিটি ছিলাম। ভারত থেকে মুহাজিরদের ট্রেন আসছিল। অমৃতসর থেকে এক ট্রেন ভর্তি যাত্রী নিলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলে স্টেশনে এক সুন্দরি মেয়েকে দৌড়াতে দেখি। আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরি এবং ট্রেনে উঠিয়ে নিই। তাকে আমার বগিতে বসিয়ে দিই। সে নববধু ছিল। দাঙ্গায় তার পুরো খানদান মারা পড়েছিল। সে জান বাঁচিয়ে কোনো রকম স্টেশনে পৌঁছেছে। আমাদের ট্রেন অমৃতসর থেকে লাহোর এবং লাহোর থেকে রওয়ালপিণ্ডি আসছিল। আমি তাকে রওয়ালপিণ্ডি পর্যন্ত আসতে আমার বগিতে আশ্রয় দিই। লাহোর ছাড়তেই আমার নিয়ত খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করলাম। সে মানল না। আমি তার সাথে জোরাজোরি শুরু করলাম। মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গেল। দরজা খুলে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ল। ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে মারা গেল। সেদিন থেকে আমি অপরাধবোধে ভুগছি। আমি তার খুনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ খুনের শাস্তি অবশ্যই আমাকে ভুগতে হবে। আজ সেই শাস্তি পেয়েছি। আমি ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছি।

আপনার কাছে আমার অনুরোধ, দান করুন, বিনয় অবলম্বন করুন, জুলুম করা থেকে বেঁচে থাকুন। আল্লাহ আপনার জন্য সুখ, সম্মান ও নিরাপদ জীবনের দরজা খুলে দেবেন। এটি জীবনের এক রহস্য।

 

[এক্সপ্রেস নিউজ (১৬ জুন ২০২৪) থেকে অনুবাদ করেছেন, ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]

 

 

advertisement