মুহাররম ১৪৪৬   ||   জুলাই ২০২৪

একটি সুন্দর সকাল

ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল

মাঝে মাঝে এমন সৌভাগ্য নসীব হয়, যা কল্পনাকেও হার মানায়। স্থবির পৃথিবী চঞ্চল হয়ে ওঠে। আল্লাহর রহমতে আপ্লুত হয়ে থাকি। খোদা তুমি বান্দাকে এত ভালবাসো। এভাবে বান্দার হাত ধরো। এর পরও এমন উদাসীনতার চাদর জড়িয়ে থাকি।

অন্য দশটা সকালের মতোই শুরু হয়েছিল আজকের সকাল। নামাযের পর পায়চারি করছি। জুনের ভ্যাপসা গরমে কিছুটা নাজেহাল অবস্থা। সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় দিগন্তজোড়া সবুজে কিছুটা ফুরফুরে লাগছিল। মারকাযের আঙ্গিনা পার হচ্ছিলাম। যে জায়গাটির দিকে প্রতিবারই সমীহ ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাই সেদিকে তাকালাম। যেই মানুষটির কারণে এই জায়গাটার প্রতি এমন সমীহ দৃষ্টি সেখানে তিনি বসে আছেন। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন। রু, মুগ্ধতা, মহব্বত সব মনের মধ্যে একসাথে বিরাজ করছিল। আমি চোখ-কান খাড়া করে সলাজ মৃয়মান হয়ে চলে যাচ্ছি। এমন সময় মনে হল, আমাকে তিনি ডাকছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। সালাম দিলাম। হালপুরসি করলেন। হারপুরসিটা সবসময় একতরফা। তাঁর সামনে গেলে উচ্ছলিত আবেগ খুব কমই নিজ থেকে কথা বলতে দেয়।

হযরতপুর বাইতুল আমান বড় মসজিদে বুয়েট থেকে তাবলীগের জামাত এসেছে। সাথীরা সেখানে গিয়ে বয়ান করার অনুরোধ করেছেন। হুজুর আমাকে বললেন, তুমি আধুনিক সময়ের মানুষ। আধুনিক মানুষদের বয়ান করতে তুমি যাও। আমি তো পুরোনো মানুষ। তাও গ্রামের পুরোনো মানুষ। আমি কী বয়ান করব?

দায়িত্বশীলকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা হয়েছে তাদের সাথে।

বলল, সাথীদের বলেছি, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে হুজুর আসবেন।

হুজুর বললেন, যার ঔষধ খেতে হয় তার জন্য তো সুস্থতা আপেক্ষিক বিষয়। রাত দুটায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। এরপর আর চোখ লাগে না, অনেক পরে চোখ লেগেছিল, তাও অল্প সময়ের জন্য। এরপর ফজরের জন্য প্রস্তুতি। যার সকালে ওঠার জন্য এত কসরত করতে হয়, তার স্বাস্থ্যের কী হালত হবে!

হুজুর আমাকে বললেন, তুমিও চলো।

এমন সুযোগ হাতছাড়া কে করে? হুজুরের সঙ্গে যাব। দ্বীনী এক মজলিসে যাব। ওযু করে নেব ভাবছি। একজন পবিত্র মানুষের সঙ্গে যাত্রা! মনের আবিলতা যাই থাকুক বাহ্যিক পবিত্রতা তো অন্তত জরুরি। খুব অল্প সময়ে হুজুর প্রস্তুত হয়ে গেলেন। গাড়ি পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল।

চারজনের ছোট্ট কাফেলা সাদা গাড়িতে চড়ে বসি। বরকতময় সকাল, নেককার মানুষের সঙ্গ, অন্তরে আল্লাহর স্মরণ, সেইসঙ্গে সাদা-শুভ্র পরিচ্ছন্ন গাড়ি পঙ্কীল জীবনকে অর্থবহ মনে হতে থাকে। হৃদয়ে যেন খরস্রোতা ভারত-পাকিস্তানকে বিভক্ত করা পুঞ্চ নদী বয়ে যাচ্ছিল। যার এক প্রান্তে পাপ আর অন্ধকার, অপর প্রান্তে পুণ্য আর আলো। আল্লাহ! আল্লাহ!! মানুষের জীবন কতইনা বৈপরীত্যের সমাহার। এত কিছুর পরও আল্লাহর কী কুদরত!

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِخَوَاتِيمِهَا.

শেষ পরিণতির হিসেবেই সব আমলের বিবেচনা। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৯৩

এককথায়, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।

গাড়িতে উঠে হুজুর দুআ পড়লেন

بِسْمِ اللهِ، الْحَمْدُ لِلهِ

سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَ مَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَ وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ.

الْحَمْدُ لِلهِ، الْحَمْدُ لِلهِ، الْحَمْدُ لِلهِ،

اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ،

سُبْحَانَكَ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ.

গাড়ি স্টার্ট হল। আধা কাচা আধা পাকা রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করল। পাপ মানুষের জীবনে আসে ইঞ্জিনের স্টার্ট এর মতো করেই। স্টার্ট নেওয়ার জন্য ইঞ্জিন তো সবসময়ই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু স্টার্ট তখনই হয় যখন চাবির ঘর্ষণ পায়। নফ্স তো অজন্ম মানুষকে পাপের জন্য ফুসলাতে থাকে। শয়তান অনবরত নফসকে হাওয়া দেয়। কিন্তু সে পাপ আপনা-আপনি হয়ে যায় না। পাপের পথে মানুষের চেষ্টা এই চাবি দেওয়ার মতো। পাপের পথে চেষ্টা ও উদ্যোগই মানুষকে এ কাদায় নিমজ্জিত করে।

রওনা দেওয়ার আগে হুজুর স্মিত হেসে বলেছিলেন, তুমি তো আটকা পড়ে গেলে! গাড়িতে দুটি আটকে পড়ার গল্প শোনাব।

আমার মন বলছিল, সারা জীবনই তো এভাবে আটকে থাকতে চাই।

গাড়ি পাকা রাস্তায় উঠলে হুজুর আটকে পড়ার গল্প বলতে শুরু করলেন। এক ছেলে পড়তে চাচ্ছিল না। অনেক দুষ্টুমি করছিল। বাবা তাকে নিয়ে চারদিক খোলা এমন একটি ঘরে আটকালেন। আটকালেন মানে তাকে রেখে বললেন, তুমি আটকা! ওর খেলার সাথীরা এসে উঁকি দেয়। খোঁচাখুঁচি করে। ঢিল ছোড়ে। ছেলেটি রেগে গিয়ে ওদেরকে ধাওয়া করে। ঘর থেকে বেরিয়ে তাদেরকে অনেক দূর তাড়া করে। কিন্তু এরপরই আবার ফিরে আসে আর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, বাবা না আমাকে আটকে রেখেছেন! আমার তো আবার সেই ঘরে ফিরে যেতে হবে!

এক পাঠান চোর ধরেছে। ওকে ঘরের মধ্যে রেখে বলল, এখানেই বসে থাক, কোথাও যাবে না।

তাকে মারার জন্য পাঠান গেল আরো লোক আনতে। একজনকে বললে সে জানতে চাইল, চোর কি বেঁধে এসেছ?

সে বলল, না। ওকে ঘরে রেখে এসেছি; বাঁধিনি।

ওই লোক বলল, চোর কি এতক্ষণ বসে থাকবে?

পাঠান চিন্তায় পড়ে গেল। তারপর বলল, সমস্যা নেই, চোর কোথাও যাবে না। কারণ সেও পাঠান।

হুজুরের গল্প বলা শেষ হল। নির্মল সকালের এই নির্মল কৌতুকে সবাই হাসল। এক-দেড় কিলোমিটারের পথ, গল্প, কথা আর নীরবতায় কেটে গেল। মসজিদে পৌঁছতেই তাবলীগের সাথী ভাইয়েরা এস্তেকবাল করলেন। ইমাম সাহেব সাথীদের নিয়ে মুজাকারা করছিলেন। হুজুরকে দেখে উঠে এলেন। সাথীরা সবাই দাঁড়াতে চাচ্ছিলেন। হুজুর ইশারায় সবাইকে বসতে বললেন। সাথীদের সঙ্গে হুজুর এমনভাবে বসলেন, নতুন কেউ এসে হুজুরকে সাথীদের থেকে ভিন্ন করতে পারবে না।

হুজুর আলোচনা শুরু করলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। বললেন, বুয়েট বা এধরনের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সঙ্গে যখন বসি তখন একটি জিনিস খেয়াল করি, প্রায় সবার মাশাআল্লাহ দাড়ি-টুপি ও সুন্নতি লেবাস। দাড়ি-টুপি ছাড়া সবে দ্বীনের পথে আসার চেষ্টা করছে এমন সাথী খুব কম দেখা যায়। এ থেকে বুঝে আসে, নতুন সাথী তৈরিতে মেহনত কম হচ্ছে। খবর পেয়েছি, এখন শুধু পুরোনো সাথীদের মধ্যে মেহনত হয়। পুরোনোদের কেউ মসজিদে না এলে শুধু তার কাছেই যাওয়া হয়।

এমন হলে হবে না, আমাদেরকে নতুন সাথীদের মাঝে মেহনত করতে হবে। মাসে যদি একজন নতুন সাথীও তৈরি করি, তবুও বছরে ১২ জন নতুন সাথী তৈরি হবে। আমরা শুধু নতুন সাথী তৈরি করব না; যারা দাওয়াতের নামে ভুল করছে, সেসব সাদপন্থী ভাইদেরকেও দাওয়াত দেব। সাদপন্থীদেরটা দাওয়াত নয়, বিদআত।

মানুষকে দাওয়াত দেব। নিজেও মজবুত থাকব। অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশ দ্বীনের ওপর চলা সহজ করে দেয়। এক লোক থানভী রাহ.-এর কাছে নিজের ছেলের ব্যাপারে অভিযোগ করল, স্কুলে পড়ে। দ্বীন-ধর্ম পালন করে না।

সে স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রই ছিল মুসলমান। থানভী রাহ. বললেন, ছেলেকে হিন্দু স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

হিন্দু স্কুলে গিয়ে সে দেখল, হিন্দু ছাত্ররা ইসলামকে গাল দেয়। নবীজীর অবমাননা করে। মুসলমানদের অবমাননা করে। এবার সে মজবুত হয়ে গেল। ঠিকমতো নামায-কালাম পড়ে। ইসলামকে জানার চেষ্টা করে। ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ হয়ে হিন্দুদের জবাব দেয়।

হুজুর আমাকেও কিছু বলতে বললেন, হুজুরের সামনে কথা বলব, আমার তো মৃয়মান দশা, কম্পিত কণ্ঠে বলা শুরু করলাম, হামদ ও সালাতের পর, যারা প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীনের চর্চা করে তাদেরকে দেখলে সূরা কাহফের সেই সাত যুবককে মনে পড়ে

اِنَّهُمْ فِتْیَةٌ اٰمَنُوْا بِرَبِّهِمْ وَ زِدْنٰهُمْ هُدًی.

তারা ছিল একদল যুবক, যারা নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে হেদায়েতে প্রভূত উৎকর্ষ দান করেছিলাম। সূরা কাহফ (১৮) : ২৩

তাঁরা কুফরের পরিবেশে ঈমান এনেছিলেন। আল্লাহ তাঁদের ঈমান বৃদ্ধি করেছেন। হুজুর বয়ানের মধ্যে মজবুতির কথা বলেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে এই যুবকেরা যে দুআ পড়েছিলেন, মজবুতির জন্য সে দুআ আমরাও পড়তে পারি।

সারা জীবন গুন গুন করে আওড়ানো দুআটির প্রথম অংশ হুজুরের সামনে ভুলে গিয়েছিলাম। হুজুর মনে করিয়ে দিলেন। তাঁদের দুআটি ছিল

رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً وَّ هَیِّئْ لَنَا مِنْ اَمْرِنَا رَشَدًا.

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আপনার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত নাযিল করুন এবং আমাদের এ পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য কল্যাণকর পথের ব্যবস্থা করে দিন। সূরা কাহফ (১৮) : ১০

আল্লাহর রহমত আর হেদায়েত থাকলে আমাদের আর চিন্তা কী? হুজুর বয়ানে থানভী রাহ.-এর ঘটনা শুনিয়েছিলেন। মনে হল, ঘটনাটি জীবনে প্রথম শুনেছি। যারপরনাই চমৎকৃত হয়েছি। প্রতিকূল পরিবেশকে ইতিবাচক কাজে লাগিয়ে হেদায়েতের পথে দৃঢ় থাকতে হবে।

আলোচনা শেষ হল, হুজুর সবার সাথে মুসাফাহা করলেন। নতুন নতুন তাবলীগে সময় লাগাচ্ছেন এমন দুই ভাইকে মারকাযে দাওয়াত দিলেন। পুরোনো সাথীদের তাদেরকে সময় করে নিয়ে আসতে বললেন।

পৃথিবীর বড় বৈশিষ্ট্য হল

كُلُّ مَنْ عَلَیْهَا فَانٍ.

সব বিলীন হয়ে যাওয়া। বেদনা যেমন এখানে শেষ হয়ে যায়। আনন্দও শেষ হয়ে যায়। দেখতে না দেখতে সুন্দর সকালের সুন্দর মজলিসটিও শেষ হয়ে গেল। গাড়ি এগিয়ে চলল মারকাযের দিকে। গ্রামের পিচঢালা পথের দুপাশে সবুজের সমারোহ পার হয়ে মারকাযে পৌঁছলাম। আর শেষ হয়ে গেল সান্নিধ্যের সুন্দর একটি সকাল। রয়ে গেল সৌরভ আর ঘ্রাণ। 

 

 

advertisement