মুহাররম ১৪৪৬   ||   জুলাই ২০২৪

ফিলিস্তিন ইস্যু
ফাঁদে কে পড়ল? হামাস নাকি ইসরাইল!

ওয়াসআতুল্লাহ খান

[ওয়াসআতুল্লাহ খান। সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিবিসি উর্দূ ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলাম লেখক। তূফানুল আকসা শুরুর পর তিনি ফিলিস্তিন-হামাস নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন।

যার প্রতিটি লেখাই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তাঁর দুটি লেখা মাসিক আলকাউসার-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল। লেখাদুটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

এক.

আরব দেশগুলোর সেনারা ইসরাইলের ওপর একযোগে চতুর্মুখী আক্রমণ করে বসলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইসরাইল কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? ৭ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে ইসরাইলের সেনাবাহিনী এরই অনুশীলন করে আসছিল। ১৯৪৮-৪৯ সালে এমনটিই ঘটেছিল। নবগঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রটি সেবার আরব দেশগুলোর সম্মিলিত সেনাজোটের অগ্রযাত্রাকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের জুনেও ইসরাইল মাত্র পাঁচ দিনে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর ইসরাইলের জন্য এক সারপ্রাইজ ছিল যখন মিসর ও সিরিয়া দুই দিক থেকে অতর্কিত হামলা করে বসে। যদিও এক সপ্তাহের ব্যবধানেই ইসরাইল পরিস্থিতি সামলে নিতে সক্ষম হয় এবং আমেরিকার সর্বাত্মক সহযোগিতায় আরবদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়।

১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননের একটি গোষ্ঠীর সহযোগিতায় পিএলওকে বৈরুত থেকে সফলভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং লেবাননের দক্ষিণ উপত্যকাটিকে পরবর্তী আঠার বছর পর্যন্ত বাফার জোন হিসেবে ব্যবহার করে। এই সময়ের মধ্যে ইসরাইল নিজেদের অনাহূত অতিথি হিসেবে দক্ষিণ লেবানন আর্মিও গড়ে তোলে। কিন্তু মে ২০০০-এ ইরান ও সিরিয়ার মদদপুষ্ট হিযবুল্লাহ মিলিশিয়া বাহিনীর অব্যাহত বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পেরে ইসরাইল দ্রুতই লেবাননের দক্ষিণ উপত্যকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আর ইসরাইলের পশ্চাদপসরণের সাথে সাথে দক্ষিণ লেবানন আর্মিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। আঠার বছর কব্জা করে রাখার মূল্য ইসরাইলকে এক হাজার সেনার মৃত্যু দিয়ে মেটাতে হয়। 

জুলাই ২০০৬-এর এক অভিযানে হিযবুল্লাহ যখন চারজন ইসরাইলী সেনাকে হত্যা ও দুজনকে অপহরণ করে নিয়ে আসে তখন ইসরাইল হিযবুল্লাহকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে দক্ষিণ লেবাননে পূর্ণ শক্তি দিয়ে আকাশ ও স্থল অভিযান চালায়। কিন্তু এবার ইসরাইলকে প্রাপ্তির চেয়ে পরিশোধই করতে হয় বেশি। কারণ হিযবুল্লাহর ছোঁড়া রকেট ও মিজাইল ইসরাইলের উত্তর সীমান্ত অতিক্রম করে তেলআবিব ও হায়ফায় আঘাত হানতে লাগে। হিযবুল্লাহকে সমপর্যায়ের মেনে নিয়ে যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হওয়া এবং কোনোভাবে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়া ছাড়া ইসরাইলের সেবার কিছুই করার ছিল না।

সময়ের সাথে হিযবুল্লাহর শক্তিও বেড়েছে। বর্তমান অবস্থা এই যে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে উত্তর ইসরাইল হিযবুল্লাহর অব্যাহত রকেট হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে। ইসরাইলের প্রায় ২ লক্ষ বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আর গাজার সাথে যুদ্ধে জড়ানোর দায়ে ইসরাইল হিযবুল্লাহর সাথে আরেকটি বড় যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা তৈরি করে রেখেছে। আপাতত শুধু আকাশ পথের হামলা ও হিযবুল্লাহর কমান্ডারদের ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানোর মধ্যেই তার প্রতিউত্তর সীমিত রয়েছে।

ইসরাইলের সেনা গোয়েন্দার চোখে ফিলিস্তিনীদেরকে কখনও সামরিকভাবে এত শক্তিশালী হিসেবে দেখা হয়নিযাকে ইসরাইল নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করতে পারে; বরং ইসরাইলের পাঠ্যসূচিতে ফিলিস্তিনীদেরকে পিছিয়ে পড়া এক আধুরা জনগোষ্ঠী হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। যারা শুধু সন্ত্রাসী। পূর্ণ শক্তি দিয়ে কোনো যুদ্ধে লড়ার মতো নয়। ফলে শহরাঞ্চলের শক্তিশালী কোনো বাধা-বিগ্রহ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রশিক্ষণ ইসরাইলী বাহিনীকে দেওয়া হয়নি। ফিলিস্তিনীদেরকে প্রতিহত করার জন্য তাদেরকে বরং একটি পুলিশ বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরাইলের নিয়মিত স্থল সেনার সংখ্যা মাত্র সোয়া এক লক্ষ। আর অবশিষ্ট সামরিক শক্তি দেশের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের তিন বছরের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা আইনের অধীনভুক্ত। এদের অধিকাংশই তিন বছরের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের মেয়াদ পূর্ণ করে নিজ নিজ পেশা ও প্রতিষ্ঠানে ফিরে যায়। আর খুব কমসংখ্যকই সামরিক চাকরি গ্রহণে ইচ্ছুক হয়।

এই প্রেক্ষাপটের বিচারে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ কখনও ভাবতেও পারেনি যে, হামাস কিংবা ইসলামী জিহাদের মতো কোনো গোষ্ঠী ঘরোয়াভাবে তৈরি দুয়েকটি রকেট হামলা চালানো ছাড়া ইসরাইলের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে, কিংবা এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে, ইসরাইলের ভেতর ঢুকে একটি আনুষ্ঠানিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করবে।

অতীতে ইসরাইলের আলফাতাহ, পপুলার ফ্রন্ট কিংবা বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর জোট পিএলও-এর অভিজ্ঞতা ছিল। তাদের ভালো করেই জানা ছিল, ফিলিস্তিনের গেরিলা কিংবা আত্মঘাতী বাহিনী বেশির চেয়ে বেশি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করে ছোট ও সীমিত পরিসরে কোনো হামলা করে উধাও হয়ে যায়। অথবা কোথাও বোমা হামলা করে বসে, কিংবা ইসরাইলের কোনো অতিথি বিমান অপহরণের চেষ্টা করে। যেন এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। 

সময় গড়ানোর সাথে সাথে ইসরাইল এ ধরনের তড়িৎ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছে। কারণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে পিএলও যখন ইসরাইল ও আমেরিকার মনগড়া শর্ত অনুযায়ী নিজেদের অস্ত্র জমা দিয়ে দিল এবং বিনিময়ে যা কিছু পাওয়া গেছে তাকে অদৃষ্টের লিখন বলে গ্রহণ করে নিল, তখনই ইসরাইলের সামরিক নেতাদের মন থেকে শেষ সংশয়টুকুও দূর হয়ে গেল যে, এখন থেকে আর কখনও ফিলিস্তিনীরা এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না যে, তারাও একটি সামরিক হুমকি হতে পারে।

ইসরাইল নিজেদের অপরাজেয় হওয়াকে তার পশ্চিমা জোট ও আরব বিশে^র মনে এতটাই বদ্ধমূল করে দিতে সমর্থ্য হয়েছে যে, খোদ ফিলিস্তিনীদের সাবেক জোট রাষ্ট্র্রগুলোও এই অব্যাহত প্রোপাগান্ডা মেনে নিতে লাগল যে, ফিলিস্তিনীরা কারো জন্যই কোনো বড় শঙ্কার কারণ হতে পারে না। এর ফলে ফিলিস্তিনীদের প্রতি আরব শাসকরাও আগের মতো ইজ্জত-সম্মান ও সমমর্যাদার পরিবর্তে তাদেরকে করুণার চোখে দেখা শুরু করল।

আরবরা যখন দেখল, খোদ পিএলও-এর নেতৃত্বে থাকা ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষও কার্যত ইসরাইলকে এক অপরাজেয় শক্তি মনে করে ব্যবস্থাপনাগতভাবে তাদের বি দল হতেও প্রস্তুত, তখন আরব দেশগুলো অব্যাহত লোকসানের ফিলিস্তিনী পক্ষপাত পরিহার করে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ইসরাইলের সাথে নিজেদের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিষয়াদির সুরাহা করতে আরম্ভ করল।

প্রথমে মিসর ও পরে জর্ডান সন্ধি করেছে। এরপর উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের শর্ত মানিয়ে নেওয়া ছাড়াই ইসরাইলের সাথে হাত মিলিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী দক্ষিণ ইসরাইলের ভেতর ঢুকে কয়েক ঘণ্টা যাবৎ যে তাণ্ডব চালিয়েছে, এতে করে ইসরাইলের দীর্ঘদিনের এই সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি মাটিতে মিশে গিয়েছে যে, ফিলিস্তিনীরা না ঠিকমতো নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে জানে আর না কোনো আক্রমণাত্মক অভিযান চালাতে পারে। হামাসের অভিযানের পর থেকে পরবর্তী বাহাত্তর ঘণ্টা ইসরাইলের সেনা ও সেনা এস্টাবলিশমেন্ট পুরোপুরি সম্মোহিত অবস্থায় ছিল। তারা এটাই বুঝে উঠতে চেষ্টা করছিল যে, তাদের সাথে আসলে কী ঘটে গেল।

গাজার প্রতি কদমে কদমে বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, তিন দিকে কাঁটাতার দিয়ে গাজাকে ঘিরে রাখা আর সেখানকার যেকোনো অস্বাভাবিক কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে জানার জন্য সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থাকার পরও কীভাবে তা ঘটল।  

এখন প্রশ্ন হল, হামাস কি তাহলে ইসরাইলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে ভুল অনুমান করেছিল? নাকি ৭ অক্টোবর ইসরাইলকে গাজায় ফাঁসানোর জন্য হামাস যে ফাঁদ পেতেছিল, ইসরাইল তাতে আশানুরূপভাবেই ফেঁসে গেছে আর সারা বিশ্ব এখন ইসরাইলকে মজলুম মনে করার পরিবর্তে তার প্রকৃত রূপ দেখতে পেরেছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পরবর্তী কলামে খোঁজার চেষ্টা থাকবে।

 

দুই.

কে কার ফাঁদে পা দিল

বিশ্বে এখন এই চর্চাও শুরু হয়েছে যে, ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলের ওপর আক্রমণের সময় অনেক বেসামরিক, সেনা ও বিদেশিকে হত্যা করে এবং ইসরাইলের সাথে ভবিষ্যতে কড়া দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে আড়াই শ-এর মতো লোককে বন্দী করে হামাস কি মূলত ইসরাইলকে এক লাখের বেশি ফিলিস্তিনীকে শহীদ ও আহত করা এবং জাতি নিধন ও পশ্চিমা এস্টাবলিশমেন্টকে মজলুম ইসরাইল-এর নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে?

নাকি হামাস ইসরাইলের সম্ভাব্য প্রতিউত্তরের বিষয়টি অনুমান করার ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলের শিকার হয়ে পুরো গাজা ভূখণ্ডই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিয়েছে?

আর নাকি হামাস সুপরিকল্পিতভাবেই ইসরাইলকে কোনো ফাঁদে ফাসিয়ে দিয়েছে? যেন গোটা বিশ্ব ইসরাইলের রক্তপিপাসু চেহারাটা দেখতে পারে। যে চেহারাটি ফিলিস্তিনীরা বিগত শতাব্দী ধরেই দেখে অভ্যস্ত।

পূর্ববর্তী কলামে বলার চেষ্টা করেছি যে, ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দাদের চোখে ফিলিস্তিনীরা কখনই তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল না। তাদের মূল আশঙ্কা ছিল প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো। বিভিন্ন উপায়ে এদেরকেও তারা নিজেদের অনুগামী বানিয়ে নিয়েছে। ফলে ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের সাথে কী করছে, কিংবা জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনীরা নিজেদের ভবিষ্যত ও অস্তিত্বকে কতটুকু সচল বা বাঁচিয়ে রাখতে পারবে এসব বিষয়ে তাদের কোনো  ভ্রূক্ষেপই ছিল না।

অসলো (Oslo) চুক্তির  আড়ালে পিএলওকে এক অনাহূত অতিথির পর্যায়ে নিয়ে আসার পর ইসরাইলের প্রতিরক্ষা অধিদপ্তর নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল যে, হামাস কিংবা ইসলামিক জিহাদের মতো কোনো গোষ্ঠীর ইসরাইলের মতো অপরাজেয় সামরিক শক্তির সাথে লড়ে আত্মহুতি দেওয়ার চিন্তা করাও সম্ভব নয়। তাই এসব গোষ্ঠী কিংবা এদের পদক্ষেপকে গভীরভাবে দেখা অযথা সময় নষ্ট করার শামিল।

শক্তির নেশাই যখন মুখ্য হয় তখন শক্তিমান ভুলেই বসে যে, দাসত্ব বা জুলুমের শেকল ঢিলা করার জন্য দুর্বলও কখনও অত্যন্ত কৌশলী ও মরিয়া হয়ে উঠতে পারে।

৭ অক্টোবর ইসরাইলের এই অহংকার চূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সামরিক বিবেচনায় অতি দুর্বল একটি দলের হাতে নিজেদের অপরাজেয় হওয়ার গর্ব ধূলিসাত হতে দেখে ইসরাইল ক্রোধে জ্বলে উঠল। আর পরিণতির তোয়াক্কা না করেই পূর্ণ শক্তি নিয়ে গাজায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। লক্ষ্য যেন শুধু প্রতিশোধ নেওয়াই নয়; বরং গোটা ভূ-খণ্ডই জনশূন্য করে ফেলা।

কথায় আছে, রাগের শুরু হয় প্রতিশোধ থেকে আর শেষ হয় অনুতাপ দিয়ে। প্রবাদটি মানুষের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। রাগ যেহেতু হুঁশ ও অনুভূতি নষ্ট করে দেয়, তাই অতি রাগের মাথায় নেওয়া সর্বোত্তম পদক্ষেপটিও ক্রোধান্বিত ব্যক্তির গলার কাঁটা হয়ে যেতে পারে। ভিয়েতনাম, ইরান ও আফগানিস্তান তো সম্মুখসারির দৃষ্টান্ত। এগুলো ছিল এমন কিছু ফাঁদ, যার আশঙ্কা একটি পরাশক্তিকে অসহায়ের মতো লেজগুটিয়ে পালাতে কিংবা কোনো উপায়ে প্রাণে বেঁচে ফিরতে বাধ্য করেছিল।

ইসরাইল যেহেতু শত্রুকে ধৈর্যের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা করার পরিবর্তে গোটা জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে চলেছে, তাই তার গভীরভাবে ভাবার এতটুকুও ফুরসত হয়নি যে, হামাসকে যদি সে নিশ্চিহ্ন করতে না পারে, তাহলে এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? অথবা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই বা কী হবে?

ইসরাইল গাজার অবকাঠামো ধ্বংস করে হামাসকে এই সুযোগ করে দিয়েছে যে, তারা ধ্বংস্তুপের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে অলিগলিতে লড়াই করে অনুপ্রবেশকারী ইসরাইলী বাহিনীকে নিজেদের মতো ব্যস্ত রাখতে পারে। সবসময় দৌড়ের ওপর রেখে তাদেরকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে।

কোনো ভবনকে অবরুদ্ধ করে শত্রুকে খুঁজে বের করে আনা সহজ হয়ে থাকে। কিন্তু ভবনই যদি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, তাহলে কোনোভাবেই জানা সম্ভব হয় না যে, কোন স্তুপের নিচে বা আড়ালে শত্রু লুকিয়ে আছে।

স্টালিনগ্রাড অবরুদ্ধ করে রাখার পর যখন জার্মানের সেনারা তা ধসিয়ে দিল তখন তারা বুঝতে পারল, এর এক একটি ধ্বংসস্তুপই তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সুনশান বিরান বাড়িগুলো তাদের জন্য ফাঁদে পরিণত হয়েছে। দক্ষ গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য এর চেয়ে উত্তম যুদ্ধ-পরিবেশ আর হতেই পারে না। রাশিয়ানরা নিজেদের পূর্ণ ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত জার্মানের নাৎসি বাহিনীকে এতটাই সংকীর্ণ করে তুলল যে, তারা সামরিক পদক্ষেপ ভুলে সবসময় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরীচিকায় ফেঁসে গেল। রাশিয়ানদের অকল্পনীয় প্রাণহানি ঘটলেও তারা  নিজেদের ঘর ও ভূমির জন্য লড়াই করছিল আর জার্মানরা অপরাজেয় হওয়ার গর্ব নিয়ে লড়ছিল। যার ফলাফল আপনারা দেখেছেন, স্টালিনগ্রাডে জার্মানদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল।

মুশকিল হল, খড়কুটার স্তুপের মধ্যে একটা সীমা পর প্রযুক্তিও আর কাজে আসে না।

ইসরাইলের নেতৃবৃন্দ সাধারণ জনগণকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করে নিজেদের মুশকিলকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে যে, তারা এবার হামাসের নামগন্ধও দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দেবে। অথচ যুদ্ধের আট মাস পর গাজার অবকাঠামোকে পরিপূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া এবং তেইশ লক্ষ বনী আদমকে গৃহহীন করা সত্ত্বেও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-এর ধারণা, হামাস গাজায় যেসব সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল, তার ৮০ ভাগই এখনও নিরাপদ ও অক্ষত আছে এবং হামাসের ৬৫ ভাগ সেনাশক্তি এখনও আগের মতোই আছে। আর যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্থান পূরণের জন্য হাজার হাজার লোক প্রস্তুত রয়েছে।

এ কারণেই ইসরাইল যখন ঘোষণা দিল, উত্তর গাজা ও গাজা নগরী হামাস থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত করা হয়েছে এবং এসব অঞ্চল এখন পরিষ্কার তখনও এসব অঞ্চল থেকে ইসরাইলের ওপর রকেট হামলা চালানো হচ্ছে। হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের পদাতিক ও আর্টিলারি বাহিনীকে গেরিলা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে চলেছে। ফলে যেসব অঞ্চল পরিষ্কার হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেসব অঞ্চলেই ইসরাইলকে আরো দুই থেকে তিন বার করে সেনা প্রেরণ করতে হচ্ছে।

ইসরাইল কর্তৃক জাবালিয়ার সর্ববৃহৎ আশ্রয়শিবিরটিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বোমা হামলা ও গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হাসাপাতালগুলোও বারবার অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। কিন্তু এর পরও আক্রমণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। হামাস যেন মৌচাকের হুল ফোটানো মৌমাছির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। যারা একবার মানুষের গালে বসে পরক্ষণেই উড়ে যায়। এরপর আবার নাকের ডগায় ঘুরঘুর করতে থাকে। হাত দিয়ে পিটিয়ে মানুষ নিজের চেহারা লাল বানিয়ে ফেললেও মৌমাছি কিন্তু ঘুরঘুর করে উড়তে থাকে।

ইসরাইলের রাগ ও উত্তেজনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই রাগের বশবর্তী হয়ে ইসরাইল যেসব নিষ্ঠুর ও অমানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে, তার সুবাদে সাধারণ বিশ্ব জনমত প্রথম বারের মতো দেখতে পারছে যে, ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের সাথে বিগত ৭৫ বছর ধরে কী করে আসছে।

আজ পর্যন্ত ইসরাইল যতগুলো যুদ্ধের মুখোমুখী হয়েছে, সবকটিতেই নিজেকে এক অবরুদ্ধ ও মজলুম রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার গাজা যেন তার চেহারার সব পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। এর টুকরোগুলো এখন ববিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভকারীদের মাঝে বণ্টিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ শুধু প্রথমবারের মতো বিশ্ব জনমতকেই পাল্টে দেয়নি; বরং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও ইসরাইলের নিঃশর্ত সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রেও বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

এতদিন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদীরা ইসরাইলে এসে এই প্রতিশ্রুতির কারণে বসতি স্থাপন করছিল যে, এটি একটি পূর্ণ নিরাপদ ও শেষ দুর্গ। কিন্তু অতি দুর্বল একটি গোষ্ঠী যেভাবে দুর্গটিতে ফাটল ধরিয়ে দিল, তাতে ইসরাইলের প্রায় ২ লক্ষ বাসিন্দা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে। অথচ এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়েই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল যে, এটি হবে এমন এক নিরাপদ রাষ্ট্র, যেখানে ইহুদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। আর এখানকার আরবরা হয়তো দেশান্তরিত হয়ে যাবে, নতুবা ইহুদী বসতি স্থাপনকারীদের অব্যাহত আগমনধারায় তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হামাসের অস্তিত্ব যদি বিলুপ্ত না হয়, তাহলে এটি হামাসের বিজয় বলে বিবেচিত হবে। আর ইসরাইল যদি হামাসকে পরিপূর্ণ নির্মূল করতে না পারে, তাহলে এটি হবে তাদের পরাজয়ের ডংকা। এই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে ইসরাইল ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ তাদের আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারীরা টুঁটি চেপে না ধরবে। ইসরাইলভক্তরাও জানে, প্রতিটি যুদ্ধই একদিন না একদিন বন্ধ করতেই হয়। তবে এটি ভিন্ন কথা, আমেরিকার এই অনুভূতিটা হল গাজার ৪০ হাজার প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর।

যেকোনো প্রতিরোধ আন্দোলন সাময়িকভাবে দমানো যেতে পারে, রূপরেখা  ও ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু সামষ্টিক বা আংশিক লক্ষ্য পূরণ হওয়া ছাড়া তা শেষ হয় না। কোনো দর্শন বা মতবাদের স্বভাবজাত মৃত্যু তো হতে পারে, কিন্তু তাকে হত্যা করা যায় না।  

 

 

advertisement