বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১১
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সবকিছু ছিলো একটি প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে। এখন আশার প্রদীপ জ্বলেছে। এখন প্রথম কাজ হলো হযরত পাহাড়পুরী হুযূরকে খোশখবর দেয়া ও দু‘আ নেয়া। বুধবার বা‘দ আছর মারকাযুদ্-দাওয়ায় হুযূরের মজলিস হয়। সেখানে হাযির হলাম। বয়ানের মধ্যে হুযূর তাঁর অধম শাগিরদের প্রতি এমন শফকত ও মুহববতের ‘ইযহার’ করলেন যে মনে মনে শুধু বললাম, তুমি কবুল করো হে আল্লাহ!
এখান থেকে হুযূর লালমাটিয়া মাদরাসায় যাবেন। মাগরিবের পর সেখানে তাঁর বুখারী শরীফের দরস। ভাবলাম, লালমাটিয়া যাওয়ার পথে গাড়ীতে কথা বলবো। কিন্তু আছরের পর হুযূর বললেন, আপনাকে আমার স্থলবর্তীরূপে রেখে যাচ্ছি; তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলুন।
সুতরাং সঙ্গে আর যাওয়া হলো না। পরের দিন লালমাটিয়ায় মাগরিব পড়লাম এবং হুযূরের দরসে বসলাম, আর তখন গায়বি তারবিয়াতের একটি কোমল স্পর্শ লাভ করে অভিভূত হলাম।
দরসে ছুলহে হোদায়বিয়ার হাদীছ চলছে। হিজরতের পর একে একে ছয়টি বছর পার হয়েছে! আল্লাহর ঘরের বিরহে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ও তাঁর প্রিয় ছাহাবা কেরামের দিল তখন কেমন বে-চায়ন বে-কারার তা শুধু আল্লাহ জানেন!
এর মধ্যে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব খাব দেখেন, ছাহাবা কেরামকে নিয়ে তিনি মসজিদুল হারামে দাখেল হয়েছেন। বাইতুল্লাহর চাবি গ্রহণ করেছেন এবং তাওয়াফ ও ওমরাহ আদায় করেছেন। নবুওয়তের খাব তো সত্য খাব। তাই তিনি ওমরার নিয়তে বাইতুল্লাহর সফরের ঘোষণা দিলেন। মদীনায় তাতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো এবং সাজ সাজ রব পড়ে গেলো।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুল হোলায়ফা থেকে ওমরার ইহরাম গ্রহণ করলেন এবং দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মক্কার নিম্নাঞ্চলে হোদায়বিয়ায় তাঁবু স্থাপন করলেন। সেখানে ছোট্ট একটি জলাশয়ে খুব সামান্য পানি ছিলো, যা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো। ছাহাবা কেরাম তাঁকে পানির অভাব ও পিপাসার কথা জানালেন। তিনি তূণীর থেকে একটি তীর নিয়ে বললেন, এটা সেখানে নিক্ষেপ করো। তাই করা হলো, আর আল্লাহর কসম, পানি এমনভাবে উৎসারিত হলো যে, সবাই তৃপ্ত হলো, কিন্তু পানি শেষ হলো না।
মক্কার কোরায়শকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্তা পাঠালেন যে, আমরা শুধু বাইতুল্লাহর নিয়তে এসেছি। লড়াই করার কোন উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কিন্তু কোরায়শ তাঁকে বাঁধা দিলো। ছাহাবা কেরামের জোশ-জাযবা তখন এমন ছিলো যে, জান দেবেন, তবু আল্লাহর ঘর যিয়ারত করবেন। কিন্তু রক্তপাত আল্লাহর নবীর পছন্দ ছিলো না। তিনি তো এসেছেন ইহরামের অবস্থায় শুধু আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে। তাই তিনি কোরায়শের সব শর্ত মেনেই সন্ধি করলেন। আর আয়াত নাযিল হলো-
انا انا فتحنا لك فتحا مبينا
অবশ্যই আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।
ছাহাবা কেরামের জন্য বাহ্যত পরাজয়মূলক এ সন্ধি মেনে নেয়া এত কষ্টকর ছিলো যে, বুখারী শরীফে বর্ণনার লফয হলো-
حتى كاد بعضهم يقتل حتى كاد بعضهم يقتل بعضا غما
কষ্টের আতিশয্যে যেন একে অন্যকে খুন করে ফেলেন।
সন্ধির শর্তমতে এবছর বাইতুল্লাহ যিয়ারাত করা যাবে না, আগামী বছর করতে হবে। তাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবা কেরামকে বললেন, যাও, নহর করো এবং হলক করো। কিন্তু তাঁরা দুঃখে বেদনায় এমনই আত্মহারা ছিলেন যে, কেউ উঠলেন না, এমনকি তিনি তিনবার বললেন। তবু যখন কেউ উঠলো না তখন তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার তাঁবুতে গেলেন এবং লোকদের থেকে যে আচরণ পেলেন তা বললেন।
হযরত উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ, আপনি কি তাই চান? তাহলে এখনই যান এবং কাউকে একটি শব্দও না বলে নিজে নহর করুন এবং হাল্লাককে ডেকে হলক করুন।
স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করে আল্লাহর নবী তাই করলেন। আর তা দেখে ছাহাবা কেরামও তাঁকে অনুসরণ করলেন।
এই ছিলো দরসের বিষয়। আনন্দে কৃতজ্ঞতায় আমি উদ্বেলিত হলাম। আমার বিশ্বাস হলো যে, হজ্বের সফরের তারবিয়াতের জন্যই আল্লাহ তাঁর গোনাহগার বান্দাকে এই মুবারক দরসে হাযির করেছেন।
আমি অন্তরের অন্তস্তল থেকে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, গতকাল যদি হুযূরের দু‘আ নেয়া হয়ে যেতো তাহলে তো আজ এখানে আসা হতো না। গতকাল ভেবেছিলাম, এত দূর এসেও দু‘আ ও বিদায় নেয়া হলো না; একদিন পিছিয়ে গেলো, অথচ হাতে সময় খুব অল্প। আজ ভাবলাম, আমার ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়াটাই ছিলো আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ। জীবনে বারবার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, আল্লাহ আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ করেন না, তবে আমাদের প্রয়োজন পূর্ণ করেন। আমরা বুঝতে পারি না, তাই ব্যথিত হই। বুঝতে পারলে আমাদের জীবনের অনেক জটিলতা দূর হয়ে যায় এবং দিলে ইতমিনান নছীব হয়।
এশার নামাযের পর খিদমতে হাযির হলাম। তিনি আমাকে দেখলেন, আর আমি দেখলাম, আমাকে দেখতে পেয়ে তাঁর মুখমন্ডলে আনন্দের উদ্ভাস। হুযূর সবাইকে তাড়াতাড়ি বিদায় করছেন দেখে বললাম, হুযূর, আমি আপনার সঙ্গে মিরপুর যাবো এবং পথে কথা বলবো। হুযূর বললেন, তাহলে তো খুব ভালো হয়, কিন্তু আপনার কষ্ট হবে না?!
আমি বললাম, এমন কষ্ট কি আর সবসময় নছীবে হয়!
গাড়ীতে হুযূরকে প্রথমে ঘটনার প্রথম অংশটি বললাম। তিনি বললেন, যা করেছেন ঠিক করেছেন। ইনশাআল্লাহ এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে বারবার বাইতুল্লাহর যিয়ারত নছীব করবেন।
আমি বললাম, হুযূর, আপনার কি মনে পড়ে, আপনি যখন আল্লাহর ঘরে গেলেন, আপনাকে আমি নৌকায় নদী পার করেছিলাম?
তিনি বললেন, এ ঘটনা কি ভুলে যাওয়ার মত!
আমি বললাম, ঐ সময় আপনি যে মুলতাযামে দু‘আ করেছিলেন সেই দু‘আর বরকতে এবারও ইনশাআল্লাহ আমি আল্লাহর ঘরে যাচ্ছি।
হুযূর কিছুটা যেন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে?! তখন আমি ঘটনার পরবর্তী অংশটুকু বললাম।
হুযূর আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে কত বার যে আলহামদু লিল্লাহ বললেন! আল্লাহর বান্দা সকলেই ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে, আমিও বলি, কিন্তু ওষ্ঠ থেকে কণ্ঠ, কণ্ঠ থেকে হৃদয় এবং হৃদয় থেকে তার গভীরতম প্রদেশ, এই দীঘ পথটুকুর রহস্য কি আমরা অতিক্রম করতে পারি?! যারা পারে তাদের ‘আলহামদু লিল্লাহ’ শ্রোতার অন্তরেও ঈমান ও বিশ্বাস এবং শোকর ও কৃতজ্ঞতার শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। তেমনি এক শীতলতা আমার হৃদয়ে তখন অনুভূত হলো। আমিও মনে মনে বললাম, ‘আলহামদু লিল্লাহ’!
হুযূর বললেন, আপনি এমন এক খোশখবর শুনিয়েছেন যে, আমার খুশির কোন সীমা নেই। নিজের হজ্ব হলেও হয়ত এর চেয়ে বেশী খুশি হতো না। আল্লাহর ঘরে আপনার যাওয়া মানে তো আমারই যাওয়া।
হুযূরের পাক যবান থেকে যেন দু‘আর ফুল ঝরছিলো, আর আমি অাঁচল ভরে তা গ্রহণ করছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন-
وتزودوا فان خير الزاد التقوى
تزودوا فان আর তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো, তবে সর্বোত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া।
তো যাদের নিজেদের তাকওয়া নেই তাদের জন্য তো আল্লাহর মুত্তাকী বান্দাদের ছোহবত ও দু‘আই হলো সর্বোত্তম পাথেয়।
হুযূর যত কথা বললেন, যত উপদেশ দিলেন তা এখানে লিখতে গেলে তো এক দফতর হয়ে যাবে। ব্যস, তাঁর নছীহতের খোলাছা ছিলো-
فلا فلا رفث ولا فسوق ولا جدال فى الحج
হজ্বের সফরে অশ্লীলতা, পাপাচার ও বিবাদের কোন অবকাশ নেই।
তারপর হুযূর যা বললেন এবং যে কথাটি আমাকে অভিভূত করলো তা এই-
‘ইনশাআল্লাহ এই সফরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে আছি, এমনকি আপনি নিজেও ‘দেখতে’ পাবেন!
এ কথা হুযূর কেন বললেন? কী এর অন্তর্নিহিত মর্ম? তিনি কি বলতে চেয়েছেন যে, আমার দু‘আ আপনার সঙ্গে থাকবে এবং আপনি তা অনুভব করতে পারবেন? নাকি তাঁর কথার মর্ম এই ছিলো যে, আমার দেহ তো এখানে পড়ে থাকবে মজবূরির কারণে, নইলে হাকীকত তো এই যে, হজ্বের কাফেলা যত পথ অতিক্রম করবে এবং যখন যেখানে অবস্থান করবে, আমার কলব ও রূহ কাফেলার সঙ্গে সেই পথ অতিক্রম করবে এবং সেখানে অবস্থান করবে? কিংবা তিনি কি আরো গভীর কোন রহস্যের জগতে প্রবেশ করেছিলেন, যা বোঝার সাধ্য আমার নেই? জানি না, তবে তাঁর পবিত্র মুখের এ বাণী আমাকে এমন এক আত্মিক শক্তি দান করলো যা বান্দাকে পরমাত্মার সঙ্গে পরম নৈকট্যের ঊর্ধ্বজাগতিক অনুভূতি দান করে। আমার বিশ্বাস, একথা হুযূর নিজে বলেননি, তাঁর যবান থেকে উচ্চারিত হয়েছে মাত্র। এ আশ্বাসবাণী আসলে তাঁর যিনি পর্দার আড়াল থেকে সর্বসময় সকলকে সঙ্গ দান করেন। বাকি এ সঙ্গশক্তি যে বান্দা যত বেশী অনুভব করতে পারে সে তত কামিয়াব।
গাড়ী চলছিলো সুদূর বাংলাদেশের একটি সড়কে, কিন্তু আমার মনে হলো, হুযূরের সঙ্গে আমি যেন চলেছি মক্কা-মদীনার প্রশস্ত কোন সড়কে! সেই রকম আলো! সেই রকম বাতাস! সেই রকম সুবাস! কবি যে বলেছেন-
তোমার মুখ ঝলসে দেয় মরুর যে তপ্ত বাতাস/ তাতে মজনু পায় লায়লার যুলফের সুবাস।
এত দিন মনে হতো, এটা কবি-কল্পনার বিলাস, কিন্তু আজ এ পবিত্র সান্নিধ্যে মনে হলো, সম্ভব; সবই সম্ভব, হৃদয়ে যদি থাকে অনুভূতি অনুভব, কিংবা যদি থাকে পবিত্র সঙ্গ কোন জীবন্ত হৃদয়ের।
মিরপুরে হুযূরের ঘরের সামনে গাড়ী থামলো। তিনি গাড়ী থেকে নামলেন এবং আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তাঁর বুকের উত্তাপে এবং হৃদয়ের স্পন্দনে আমার মনে হলো ...।
হুযূর সবসময় যেমন করে বলেন তেমনি স্নেহসিক্ত, তেমনি বিশ্বাস ও প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে এবারও বললেন, ‘আপনাকে আল্লাহর হাওয়ালা করলাম, আপনাকে আল্লাহর হিফাযতে দিলাম।’ এইটুকু বলার জন্যই তো প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রয়োজন একজন মানুষের, জীবন্ত হৃদয় ও যিন্দাদিল একজন মানুষের। এ প্রয়োজ অতীতে ছিলো, এখনো আছে, সামনেও থাকবে। এরপর তুমি বিশ্বাস করতে পারো যে, পুরো সফরে তুমি নিশ্চিন্ত নিরাপদ ছোট-বড় সবকিছু থেকে, এমনকি শয়তানের হামলা ও নফসের ধোকা থেকেও। আল্লাহর হাওয়ালা ও হিফাযতে থাকা কোন কিছু কি নষ্ট হতে পারে কখনো! অথচ আশ্চর্য, সফরের জন্য আমরা কত নিরাপত্তার আয়োজন করি, এই একটি ছাড়া! আমরা বুঝতে পারি না, এই নিরাপত্তা ছাড়া অন্য সব নিরাপত্তা অর্থহীন। বিমানের উড্ডয়নলগ্নে জরুরি নিরাপত্তার ব্যবস্থাগুলো যখন খুব গুরুত্বের সাথে বুঝিয়ে দেয়া হয় তখনও আমার মনে হয়, আমরা আকাশের উচ্চতায় উড্ডয়ন করছি ভূমির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে, ‘আকাশ’ থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করার কথা একবারও মনে আসে না!
তো বলছিলাম, তুমি যখন নূরানি কলব ও নূরানি যবান থেকে উচ্চারিত
استودع الله دينكم وأمانتكم وخواتيم أعمالكم
এর নিরাপত্তাবেষ্টনী গ্রহণ করবে তখন তুমি সমস্ত বিপদ-মুছীবত থেকে নিরাপদ হয়ে গেলে, তুমি নিজে যদি এই নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে বের হয়ে না আসো।
বুকের মধ্যে পরম এক আশ্বাসের শীতলতা ধারণ করে ফিরে এলাম, আর মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকেই বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে আমার সফর শুরু হয়ে গেলো।
কাফেলার আমীর ইমাম সাহেব জানালেন, বিশ তারিখের ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, নতুন তারিখ হলো ছাবিবশে ডিসেম্বর, বা ছয়ই যিলহজ্ব। অর্থাৎ একেবারে শেষ তারিখ। এর পর আর কোন ফ্লাইটের জিদ্দায় অবতরণের অনুমতি নেই। খুব দুশ্চিন্তার বিষয়। এমনিতেই ফ্লাইটের বিশৃঙ্খলার কারণে বহু মুসাফিরের সফর এবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিক্ষুব্ধ হাজী ছাহেবদের মিছিল নাকি বের হচ্ছে এবং .. এবং বলতে লজ্জা করে, ঘেরাও-ভাঙ্গচুরও হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করা এবং বিক্ষোভ করা স্বাভাবিক এবং যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের চেষ্টায় ত্রুটি থাকা নিন্দনীয়, কিন্তু হাজী ছাহেবান এবং ভাঙ্গচুর, এ দু’টো একত্র হয় কীভাবে?! হজ্বের সফর তো ইশক ও মুহববতের সফর, পবিত্র ভূমির পবিত্র সফর এবং মাওলার ঘরে বান্দার সফর! এখানে তো হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন হবে ভয়-ভীতির স্পন্দন! এখানে তো শঙ্কায় আশঙ্কায় বুকটা শুধু দুরু দুরু করবে যে, আমার না-পাকি ও নাফরমানির কারণে মাহরূমি নেমে আসছে না তো! আমি তো জানি, আমার মত গান্দা ইনসান ও অপবিত্র মানুষ আল্লাহর ঘরের হাযিরির উপযুক্ত কিছুতেই নয়। এ পথে যা কিছু বাধা ও প্রতিবন্ধকতা তা তো আমারই নাফরমানির কারণে। সুতরাং আমাকেই বেশী বেশী ইস্তিগফার করতে হবে, যাতে সমস্ত অপবিত্রতা ও গান্দেগি সত্ত্বেও মাওলায়ে করীম তাঁর ঘরের জন্য কবুল করে নেন।
মোটকথা চেষ্টা ও দৌড়ঝাঁপ করা ঠিক আছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও ঠিক আছে। কিন্তু ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ আমার এ পরিচয়ের পবিত্রতা ও মর্যাদা তো আমাকে রক্ষা করতে হবে প্রতিটি আচরণে ও উচ্চারণে। আমাকে তো ভাবতে হবে, আমারই গোনাহ ও গান্দেগি আমার মাহরূমির কারণ কি না, বরং যারা আমার সঙ্গী, তাদেরও মাহরূমির কারণ কি না? আল্লাহর আশিক বান্দারা যুগে যুগে এভাবেই চিন্তা করেছেন। তাঁরা এমন ভয় ও সন্ত্রস্ততার মধ্যে থাকতেন যে, আমার গোনাহ যেন আমার এবং সবার হজ্ব বরবাদ হওয়ার কারণ না হয়। তাই দিন-রাত ইস্তিগফার করতেন নিজের জন্য এবং মুসলমান ভাইদের জন্য।
কথিত আছে, একবার মরুভূমিতে এক হজ্বের কাফেলা পথ হারিয়ে ফেললো। সবাই উটের কাফেলার পথপ্রদর্শককে দোষারোপ করতে লাগলো, মিয়াঁ, পথ চেনো না তো কাফেলার দায়িত্ব কেন নিয়েছো? কেউ বলে, আচ্ছা রকম শায়েস্তা করো বেটাকে!
ঐ যামানার এক বুযুর্গ কাফেলায় ছিলেন। এমনই সাধারণ লেবাস-সুরত যে, আলাদা করে চেনার উপায় নেই। তিনি বললেন, ভাই কেন তোমরা এই বেচারাকে দোষারোপ করছো! দোষ তো আমার, আমি হলাম আসল পথভ্রষ্ট। আমারই কারণে তোমাদের এ দুর্গতি। তোমরা আমাকে ফেলে রেখে অগ্রসর হও, তাহলেই তোমরা পথপ্রাপ্ত হবে।
কাফেলা ছিলো উটের যামানার। তাই এতটুকু কথাতেই লোকেরা ভুল বুঝতে পেরে ইস্তিগফার ও রোনাযারি শুরু করলো, আর ঐ বুযুর্গ ছালাতুল হাজাত পড়ে এভাবে মুনাজাত করলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার পথভ্রষ্টতার কারণে তুমি এই কাফেলাকে পথভ্রষ্ট করো না। হে সকল পথহারা পথিকের পথপ্রদর্শক! আমাদের পথ দেখাও। তোমার ঘরের সঠিক পথে আমাদের নিয়ে চলো।
মুনাজাত শেষ হলো না, রহমতের বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ আসমান অাঁধার করে মেঘ জমলো, আর একটি গুরুগম্ভীর আওয়ায ভেসে এলো ‘দক্ষিণের টিলাকে বামে রেখে চলতে শুরু করো।’ গায়বের এ আওয়ায কেউ শুনলো না। কারণ শোনবার মত কান কারো ছিলো না। শুনলেন শুধু ফাটা পুরানা লেবাসের ঐ বুযুর্গ। তিনি কাফেলার পথপ্রদর্শককে নিরালায় ডেকে পথ বলে দিলেন, আর বললেন, দয়া করে আমার কথা প্রকাশ করো না।
কাফেলার পথপ্রদর্শক দ্বিধায় পড়ে গেলো। কারণ তার ধারণার সঙ্গে বুযুর্গের কথা মিলে না। তবু সে কাফেলাকে বুযুর্গের বাতানো পথেই নিয়ে চললো। অনেক দূর যাওয়ার পর সে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো, ‘পেয়ে গেছি, পথ পেয়ে গেছি! এই যে, এখান থেকেই আমরা ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম।’
আল্লাহওয়ালাদের যিন্দেগিতে এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যে, বিপদে, দুর্যোগে, সঙ্কটে, প্রতিকূলতায় আগে তাঁরা নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করতেন এবং তাওবা ইস্তিগফারে লেগে যেতেন। তাঁদের তাওবা ইস্তিগফারের বরকতে আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মুশকিল আসান করে দিতেন। এ যুগে আমরা যারা আল্লাহর ঘরের যাত্রী হতে চাই, আমাদের মধ্যে এরূপ চিন্তা -চেতনা জাগ্রত হওয়া আরো বেশী আবশ্যক। কারণ অতীতে আল্লাহর পেয়ারা বান্দারা যা চিন্তা করতেন সেটা ছিলো তাদের বিনয় ও আত্মবিলোপ, পক্ষান্তরে আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হলো আসল হাকীকত।
একটি একটি করে দিন পার হয়। প্রতিদিন উদ্বেগজনক খবর আসে, আর হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুতর হয়। তবু নিজেকে শান্ত সমর্পিত রাখার চেষ্টা করি। আমার আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই তো হবে! সুতরাং সবকিছু আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে আত্মপ্রস্ত্ততিতে নিয়োজিত থাকাই আমার কর্তব্য।
তাই আমি মাদরাসার নিয়মিত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে কিছু কিছু করে আহকাম ও মাসায়েলের কিতাবও পড়তে লাগলাম। বিশদ মাসায়েলের জন্য অনেক কিতাব রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মু‘আল্লিমুল হুজ্জাজ (বাংলা অনুবাদ) আমার কাছে বেশ উপকারী মনে হয়েছে। সংক্ষিপ্ত আকারে দিনওয়ারি আমলগুলো বুঝে নেয়ার জন্য আমাদের কাফেলার আমীর মাওলানা ইয়াহয়া ছাহেবের তৈরী করা তালিকাটি উপযোগী মনে হয়েছে। তবে আমার অভিজ্ঞতা এই যে, সাধারণ লোকের পক্ষে সবচে’ নিরাপদ হলো মাসআলা সংক্রান্ত যে কোন সমস্যায় কোন বিজ্ঞ আলিমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তার কথামত আমল করা।
হজ্বের হাকীকত ও ফাযায়েল সম্পর্কে সবচে’ উপকারী মনে হয় শায়খুল হাদীছ মাওলানা যাকারিয়া রহ.-এর ফাযায়েলে হজ্ব এবং মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর আরকানে আরবা‘আ (হজ্ব-অধ্যায়)। এ দু’টি বই আল্লাহর ঘরের প্রত্যেক মুসাফিরের অবশ্যই পড়া উচিত, যাতে পূর্ণ উপলব্ধির সঙ্গে এবং আজর ও ছাওয়াবের পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে হজ্বের প্রতিটি আমল আদায় করা সম্ভব হয়। এই সফরনামার পরিশিষ্টে উক্ত কিতাবদু’টির কিছু কিছু উদ্ধৃতি পেশ করার ইচ্ছা আছে, যাতে পাঠক হজ্বের হাকীকত ও ফযীলত কিছুটা হলেও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।
শুক্রবার তেইশে ডিসেম্বর, সকালে বের হলাম বোনদের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিতে। একজন ধানমন্ডি, একজন উত্তরা, একজন নাখালপাড়া। যার কাছে যাই সেই কান্নার কারণে কথা বলতে পারে না। সবার একই আব্দার, একই আকুতি, আল্লাহর ঘরের গিলাফ ধরে তাদের জন্য যেন দু‘আ করি, আল্লাহ যেন তাদেরও আল্লাহর ঘরের যিয়ারত নছীব করেন। সবার একই মিনতি, আলস্নাহর নবীর রওযা শরীফে যেন তাদের সালাম পেশ করি। ওদের অশ্রুস্নাত চোখের করুণ দৃষ্টি আমাকে অস্থির করে তুললো। একজন বড় ভাই- যেমনই হোক- বিশেষ করে যখন বাবার স্নেহছায়া মাথার উপর থাকে না, তখন বোনদের জন্য যে কত বড় সান্ত্বনা তা বুঝতে হলে এই রকম দৃশ্য অবলোকন করা প্রয়োজন। নিজেকে আমার তখন খুব ক্ষুদ্র মনে হলো। বড় ভাইয়ের কাছে বোনদের দাবী তো খুব বেশী নয়। একটু স্নেহ, যাতে রয়েছে পিতৃত্বের কিঞ্চিৎ ছায়া; একটুখানি হাসি, যাতে রয়েছে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনার উদ্ভাস। পরম নির্ভরতার সঙ্গে একজন বোন যখন বলতে পারে, ‘আমার ভাই’! তখন তার চোখে মুখে আশ্বাস ও আশ্বস্তির যে ‘ঝিলিমিলি’ ফুটে ওঠে তার কোন তুলনা নেই। কিন্তু এ জগত সংসারে কোথায় এখন সে ভাই! আফসোস তেমন আদর্শ বড় ভাই আমি কখনো হতে পারিনি। বোনদের সুখে দুঃখে তেমন করে পাশে দাঁড়াতে পারিনি। তবু তারা আমাকে ভালোবাসে, ভক্তি করে। বোন সিদ্দীকা, মৃত্যুর ঠিক আগেও আববা যার কথা ভুলেননি, প্রায় বলে, ‘আপনি আসলে, আপনার দু’টো কথা শুনলে আমার দুঃখ-কষ্ট অর্ধেক দূর হয়ে যায়। ভাইয়ের বুকে বোনের জন্য স্নেহ-মায়া থাকে বা না থাকে, বোনের অন্তরে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার ঝর্ণাধারা সতত বইতে থাকে। যা বললাম তা হলো সাধারণ চিত্র, বিপরীত চিত্রও আছে সংসারে কিছু না কিছু।
অন্য বোনেরা বাড়ীতেই ছিলো, বিদায়ের সময়ও তারা পাশে ছিলো।
মনটা কিছুতেই মানছিলো না। তাই পাহাড়পুরী হুযূরের সঙ্গে আবার দেখা করার উদ্দেশ্যে জুমার নামায পড়লাম আলুবাজার মাদরাসা মসজিদে। তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার কথা হুযূর শুনেছেন, তবে এখন হয়ত আমাকে আশা করেননি। দেখে খুব খুশী হলেন। সেদিন যা যা বলেছিলেন প্রায় সবগুলো কথা আবার বললেন। আর একটি কিতাবের নাম নিয়ে মক্কা শরীফে পাওয়া যায় কি না দেখতে বললেন। কিতাবটির নাম বাহজাতুন্-নূফূস। কিতাব ও ছাহিবে কিতাব সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিলো না, তবে জানা ছিলো, কার কাছে জানা যাবে? তিনি মাওলানা আব্দুল মালিক। ফোন করে জেনে নিলাম, এটি দু’খন্ডে বুখারী শরীফের সংক্ষিপ্ত একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। মুছান্নিফ হলেন ‘মুসলিম স্পেন’-এর সপ্তম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলিম ইবনে আবী জামরাহ রহ.।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যে কোন উপায়ে হুযূরের জন্য কিতাবটি অবশ্যই আনার চেষ্টা করবো।
হজ্বের সফরে রওয়ানা হওয়ার আগে আমার দস্তরখানে একবার শরীক হওয়া, এটি আমার বন্ধু ইমাম সাহেবের পুরানা আদাত, আর এবার তো আমি তার রীতিমত হজ্বের মুক্তাদি। আমার স্ত্রী তাই আয়োজনটা একটি আড়ম্বরপূর্ণ করলেন। এমনিতেই আমার বন্ধু দস্তরখানে কম খেয়ে কারো মনে কষ্ট দিতে পারেন না, তার উপর সেদিন সবকিছু এমন স্বাদের হলো যে, অবস্থা দেখে আমাকে বলতেই হলো, ‘নিজেকে কষ্ট দিয়ো না’।
দস্তরখানের শুরু থেকে শেষ, কোন আলামতেই বুঝতে পারিনি যে, তিনি কত বড় আনন্দের খবর নিয়ে এসেছেন। আমার উৎকণ্ঠা ছিলো, তবু জিজ্ঞাসা করিনি যে, ভিসার কী খবর? এখনো ভিসা না হওয়া আসলেই অনেক বড় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়।
খাওয়া ও দাওয়া দু’টোই সুসমাপ্ত করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে তিনি বললেন, আলহামদু লিল্লাহ, খানা বড় স্বাদের হয়েছে। তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন, আমাদের ভিসা হয়ে গেছে, আলহামদু লিল্লাহ।
আমিও বললাম, ‘আলহামদু লিল্লাহ’। কিন্তু এমন ‘সুস্বাদু খবরটি কি ‘স্বাদের’ দস্তরখানের আগে বলা যেতো না! এটাই আমার প্রিয় বন্ধুর ‘আন্দায’। খবর স্বাদের হোক, বা বিস্বাদের, তিনি বলেন বেশ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে। তারপর বললেন, পাসপোর্ট ও টিকেট ইনশাআল্লাহ আগামীকাল বিকালে আমার হাতে পৌঁছবে। সন্ধার পর হাজী ছাহেবান মালীবাগ চৌধুরিপাড়া নূর মসজিদে একত্র হবেন। তখন পাসপোর্ট ও টিকেট যার যার হাতে দেয়া হবে এবং সফর সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হবে।
তিনি বললেন, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ফাহীমকে দিয়ে পাসপোর্ট ও টিকেট পাঠিয়ে দেবো।
আমি বললাম, বলো কী! প্রিয়তমের ঘরে যাওয়ার টিকেট হাতে নেয়ার জন্য নিজে যাবো না! এতটুকু যদি না করি, মুহববতের লাজ তাহলে রক্ষা হয় কীভাবে! হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.কে তো দেখেছি, পাসপোর্ট হাতে আসার পর চোখের পানি ছেড়ে দিতেন, ভিসা লাগানো পৃষ্ঠায় চুমু খেতেন, বিমানের টিকেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখতেন। তাঁকে এমনও বলতে শুনেছি, ‘আমাকে নিয়ে যাও, আমি নিজে ভিসার জন্য কাতারে দাঁড়াবো।’
আসলে এটা হচ্ছে ইশকের ‘দীওয়ানাপন’ এবং প্রেমের আবেগ-উচ্ছ্বাস। তুমি যদি এখানে যুক্তি তালাশ করো তাহলে এর জবাব নেই।
দু’বছর আগে আমার স্ত্রী, মেয়ে ও মেয়ের জামাই যখন হজ্বের সফরে গেলো তখনো ইমাম সাহেব বলেছিলেন, তাদের পাসপোর্ট-টিকেট পাঠিয়ে দেবেন। আমি বলেছিলাম, না, আমি নিজেই এসে নিয়ে যাবো। তারপর স্ত্রীকে বললাম, আমি একাই গিয়ে নিয়ে আসতে পারি, কিন্তু তুমিও সঙ্গে চলো। আল্লাহর ঘরে যাওয়ার টিকেট যদি একটু এগিয়ে গিয়ে নিয়ে আসো, আল্লাহ খুশী হবেন; তুমিও আনন্দ পাবে। আমরা দু’জন গিয়েছিলাম। সেদিন আমাদের যে আনন্দ হয়েছিলো! পাসপোর্ট টিকেট হাতে পেয়ে যে শিহরণ জেগেছিলো তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, তুমি যদি এভাবে না বোঝাতে, আজকের এ আনন্দ-শিহরণটুকু অনুভব করার সুযোগ আমার হতো না।
অনেকগুলো জরুরি কাজ সেরে উত্তরা থেকে ইমাম সাহেবের বাসায় যেতে রাত দশটা হয়ে গেলো। আমি যাবো, শুনে অনেকেই নাকি অপেক্ষা করেছিলেন। আমার প্রিয় ছাত্র তেজগাঁও জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া-এর বিশিষ্ট উস্তায মাওলানা আবুল বাশারও এসেছিলেন দেখা করতে, দু‘আ নিতে (আসলে দু‘আ দিতে)। শুনে খুব খারাপ লাগলো।
ইমাম সাহেব এবারও সবকিছু ধীরে সুস্থে করলেন। প্রথমে হালকা একটা দস্তরখানের ব্যবস্থা করলেন, ভিতরের উচ্ছ্বাস ভিতরেই রেখে দস্তরখান থেকে ফারেগ হলাম। তারপর বিভিন্ন কথা বলে আমার ধৈর্যের আরেকটু পরীক্ষা নিয়ে পাসপোর্ট-টিকেট হাতে দিলেন। আমি হাতে নিলাম এবং রোমাঞ্চিত হলাম। আল্লাহর ঘরে যাওয়ার টিকেট যখনই হাতে আসে, মনে মনে বলি, আমি যেন এর মর্যাদা রক্ষা করতে পারি।
সউদিয়া এবার হাজী ছাহেবানের জন্য সহজ ব্যবস্থাই করেছে বলতে হয়। অর্থাৎ ফিরতি টিকেটও এখান থেকেই নিশ্চিত করে দিয়েছে। একুশে জানুয়ারী সকাল সাতটায় আমাদের জিদ্দা থেকে বিমানে আরোহণ করতে হবে। এ ব্যবস্থাটা আমার কাছে ভালো মনে হলো। কেননা পিছনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ফেরার সময় জিদ্দা বিমানবন্দরে হাজী
ছাহেবানকে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।
বাংলাদেশ বিমানেও এ ব্যবস্থা হয়েছে কি না, জানতে পারিনি। এই একটি বিষয়ে এবারের জন্য সউদিয়া ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে বাংলাদেশের হজ্বযাত্রীগণ অনেক বেশী কৃতার্থ হবেন যদি সউদিয়া ও জিদ্দা বিমানবন্দরের লোকেরা আচরণে উচ্চারণে কিঞ্চিৎ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ ঘটাতে পারেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, এ বিষয়ে তাদের দারিদ্র্য যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদেরও দায়দায়িত্ব রয়েছে। তারপরো, আল্লাহ যে মর্যাদায় তাদের বড় করেছেন সেটার প্রকাশ থাকাই তো কাম্য। এখানে এ প্রসঙ্গটা না এলেই হয়ত ভালো হতো। কিন্তু এটা হলো মনের ভিতরের অনেক ‘জমা’ থেকে সামান্য ‘খরচ’, যা মনের অগোচরে কলমের ডগা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য একটা বিষয় আমাদেরও বুঝতে হবে যে, সউদি আরবে এবং মক্কা-মদীনায় রক্তে ও বংশে সবাই আরব নয়; অনেকেই শুধু লেবাসের আরব। এমনকি কেউ কেউ রক্তসূত্রে খাছ বাংলাদেশের মানুষ। তাদের নিকট পূর্বপুরুষ ছিলো আইনের ফেরারী। সুতরাং সবার কাছ থেকে অভিজাত আরবীয় আচরণ আশাও করা যায় না। তবে ভালো-অভালো যাই হোক তারা আল্লাহর ঘরের পড়শী এবং নবীর শহরের বাসিন্দা। যদি কারো কোন আচরণ পছন্দ না হয় তাহলে আমরা তা উদারভাবে গ্রহণ করে যেন প্রমাণ করতে পারি যে, সকল অর্থেই আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আশেকান; আমরা মেহমানে খোদা ও মেহমানে রাসূল। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, আমরা শুধু মেহমান নই, আশিক মেহমান এবং গোলাম মেহমান। আমাদের আচরণে উচ্চারণে এ তিনটি পরিচয়েরই সমান প্রকাশ থাকতে হবে। কেউ যদি আমাদের কষ্ট দেয় তার হিসাব আল্লাহর কাছে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, আবার মাফও করে দিতে পারেন। আমরা কামনা করবো, আল্লাহ যেন তাদের মাফ করে দেন, আর আমাদের উত্তম বিনিময় দান করেন।
রোববার ফজরের পর সাঈদ দেখা করে জানালো, আজ তার ফ্লাইট। আমার অনেক কথা বলার ছিলো, অনেক কথা জানার ছিলো, কিন্তু সময় ছিলো না। তাই ফী আমানিল্লাহ বলে তাকে বিদায় জানালাম। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন তাহলে বহু বছর পর দু’ভাইয়ের হয়ত আবার দেখা হবে হিজাযের ভূমিতে।
যে কোন ভাবে হোক, অতীতকে আমার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। অতীতের সময় না হোক, অন্তত অতীতের স্মৃতি। কিন্তু অতীত আমাদের জীবন থেকে খুব দ্রুতই মুছে যায়; সময় যেমন তেমনি তার স্মৃতিও। আমরা বেঁচে থাকি অতীত-বঞ্চিত একটি জীবন নিয়ে। অতীতকে বাদ দিয়ে কীভাবে হতে পারে সুন্দর বর্তমান এবং সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যত?!
ছাত্রদের কাছ থেকে জলসা করে বিদায় নিতে সবসময় আমার কেমন যেন একটা সঙ্কোচ হয়। তাই পিছনে কখনো এটা করিনি। এবার মনের অবস্থা হলো অন্যরকম। ইচ্ছে হলো, তালিবে ইলমদের মজলিসে দু’টো কথা বলে, দু‘আ চেয়ে বিদায় নেই। এশার পর মজলিস হলো। আমি তাদের সম্বোধন করে বললাম-
‘ইনশাআল্লাহ আগামীকাল সকাল দশটায় হজ্বের নিয়তে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে আমার সফর শুরু হবে। এ কথা তো আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই যে, আমার মত গোনাহগার ও সিয়াকার বান্দার কোন হক ও অধিকার নেই এবং কোন ছালাহিয়াত ও যোগ্যতা নেই আল্লাহর ঘরে যাওয়ার, কিন্তু আল্লাহ বড় মেহেরবান। তিনি নেককার বান্দাকে যেমন ডাকেন আরো নেককার বানানোর জন্য তেমনি বদকার বান্দাকেও ডাকেন নেককার বানানোর জন্য। তো মেহেরবান আল্লাহ আবার তাঁর এ গোনাহগার বান্দাকে ডাক দিয়েছেন, সুযোগ দিয়েছেন তাঁর পাক ঘরে হাযির হওয়ার। দয়া করে তোমরা সবাই আমার জন্য দু‘আ করো, যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দয়া ও রহমত এবং করুণা ও মেহেরবানি অব্যাহত রাখেন। আল্লাহ যেন আমাকে হজ্বে মাবরূর নছীব করেন। হজ্বের সফরের সমস্ত হক আদায় করার এবং আদব রক্ষা করে চলার তাওফীক দান করেন। আল্লাহ যেন সমস্ত গোনাহ থেকে পাক ছাফ করে নেককার ইনসান ও পবিত্র মানুষ বানিয়ে তোমাদের মাঝে আবার ফিরিয়ে আনেন। দেখো, আমি যদি নেককার ও পবিত্র হয়ে ফিরে আসতে পারি তাহলে তোমাদেরই লাভ। কারণ আমার নেকি ও পবিত্রতা তখন তোমাদের মধ্যেও নেকি ও পবিত্রতা এনে দেবে। সুতরাং আমার জন্য দু‘আ করলে তোমাদেরই লাভ। আমি তো মাদরাসাতুল মাদীনাহর ছাত্র-শিক্ষক-যিম্মাদার সকল তালিবে ইলমের জন্য দু‘আ করি, আল্লাহ যেন সকলকে দীদারে বাইতুল্লাহ ও যিয়ারাতে নবীর সৌভাগ্য দান করেন। আল্লাহর ঘরে গিয়েও এ দু‘আ করবো ইনশাআল্লাহ।
তবে عالم تصور বা কল্পনার জগত বলে একটি বিষয় আছে। হাদীছ বর্ণনায় ছাহাবা কেরাম একটি কথা বলে থাকেন-
كأني أنظر إلى وجه رسول الله صلى الله عليه كأني أنظر إلى وجه رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو يفعل أو يقول كذا.
আমি যেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র চেহারা দেখতে পাচ্ছি এমন অবস্থায় যে তিনি এটা করছেন বা এটা বলছেন...।
এক্ষেত্রে আমরা শুধু এতটুকুই বলি যে, ছাহাবী এখানে আসলে বর্ণিত হাদীছটি তার সুস্পষ্টরূপে মনে থাকার কথা বোঝাতে চাচ্ছেন। কথা সত্য, কিন্তু এই সাধারণ সত্যের আড়ালে আরো গভীর কোন সত্য লুকিয়ে আছে।
হাদীছ বর্ণনার এই উসলূবটির তাৎপর্য চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে, কল্পনার মাধ্যমে আসলে তিনি সেই মজলিসের উপস্থিতির স্বাদ গ্রহণ করছেন। আত্মার শান্তির জন্য এবং আত্মিক উন্নতির জন্য এটা কত কল্যাণকর তা জানেন শুধু আত্মার জগতের অভিসারীরা।
আল্লাহ মানুষকে একটি বিরাট শক্তি দান করেছেন, কল্পনাশক্তি। দিলে যদি শাওক ও মুহববত এবং আকাঙ্ক্ষা ও তামান্না থাকে তাহলে কল্পনায়ও তুমি বিচরণ করতে পারো পবিত্র ভূমিতে, মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায়। কল্পনার জগতে নিজেকে তুমি পেতে পারো আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করা অবস্থায় এবং সোনার মদীনায় নবীজীর রাওযায় সালাম পেশ করা অবস্থায়। কল্পনায় বিচরণের এ স্বাদ ও শান্তি এবং এই আত্মিক প্রশান্তি আল্লাহর পেয়ারা বান্দারা সবসময় পেয়ে থাকেন। মদীনায় একদল ছাহাবা পড়েছিলেন মজবূর অবস্থায়, কিন্তু তাঁদের দিলে জিহাদের শাওক ও শাহাদাতের তামান্না ছিলো। তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, ‘তারা মদীনায় পড়ে থাকলেও প্রত্যেক ঘাঁটিতে এবং প্রত্যেক উপত্যকায় তারা আমাদের সঙ্গে ছিলো। মজবূরি (শুধু) তাদের (দেহ)কে মদীনায় আটকে রেখেছে।’
তোমাদের অন্তরে যদি শাওক ও মুহববত থাকে, হজ্বের কাফেলায় শরীক হওয়ার তামান্না থাকে তাহলে তোমরা নিয়ত করো এবং আল্লাহর দেয়া কল্পনাশক্তির সাহায্যে চলো আমার সঙ্গে হজ্বের কাফেলায়। ইনশাআল্লাহ আমি তোমাদের সঙ্গ অনুভব করবো আল্লাহর ঘরের তাওয়াফে, মিনা আরাফার অবস্থানে এবং মদীনায় রাওযা শরীফের যিয়ারাতে। দেখবে, তোমরাও এক আশ্চর্যরকম রূহানি লয্যত ও আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করবে।
এসব কথা তোমাদের বলার সাহস আমার হতো না, কিন্তু পাহাড়পুরী হুযূর সেদিন আমাকে বলেছেন, ইনশাআল্লাহ সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে থাকবো এবং আপনিও তা অনুভব করতে পারবেন।
আবেগের প্রবাহে তালিবে ইলমদের উদ্দেশ্যে আরো অনেক কথা বলা হলো, আর তারাও অন্তর দিয়ে দু‘আ করলো।
সফর থেকে ফিরে আসার পর বেশ কিছু তালিবে ইলম বলেছে, এ কথাগুলো তাদের অনেক উপকারে এসেছে। তারা কল্পনাশক্তির স্বাদ ও শান্তি অনুভব করতে পেরেছে। এমনকি কেউ কেউ স্বপ্নে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে এবং ইহরামের লেবাসে আরাফায় অকূফ করতে দেখেছে, আর একজন তালিবে ইলম দেখেছে, আমার সঙ্গে সে রাওযা শরীফে সালাম পেশ করছে।
আমার নিজের অবস্থা কী ছিলো? পবিত্র ভূমির প্রতিটি স্থানে আমি আমার হুযূরের ছোহবত এবং আমার তালিবানে ইলমের সঙ্গ কেমন অনুভব করেছি, স্বপনে ও জাগরণে?! হৃদয়জগতের সে মাধুর্য হৃদয়েই সঞ্চিত থাক।
সেদিন রাতে ঘুমুতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঘুম আসে কই! দীদার যখন আসন্ন তখন কি ঘুম আসতে পারে?! চোখের পাতা এক হতে পারে?!
চোখ লেগে আসে, আবার খুলে যায়। কখনো চমকে জেগে ওঠি, কখনো জেগে চমকে ওঠি, আর ভাবি, ‘রাত পোহাবার কত দেরী?!’
ইশক ও মুহববতের হাকীকত তো আমার জানা নেই, কিন্তু জীবনের প্রথম সফরে এক আশিক বান্দার ছোহবত তো আল্লাহ দান করেছিলেন! ইশকের মউজ ও প্রেমের তরঙ্গ-জোয়ার দেখার সৌভাগ্য তো হয়েছিলো। আতরের দোকান থেকে আতরের কিছু সুবাস তো তুমি পাবেই। শরাবের জলসায় যদি যাও, তোমাকেও পেয়ে বসবে নেশার কিছু না কিছু আমেজ।
সেই নেশার আমেজেই যেন আমার বিনিদ্র রাত ভোর হলো। ফজর পড়লাম নূরিয়া মাদরাসায়। নামাযের পর গিয়ে দাঁড়ালাম হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর কবরের সামনে। আল্লাহওয়ালাদের কবর থেকে ফায়য ও ফায়যান জারি হয়, এসব উচ্চমার্গীয় তত্ত্ব বোঝার সাধ্য আমার কোথায়?! তবে সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে অদ্ভুত এক কম্পন অবশ্যই অনুভব করলাম। বাইতুল্লাহর আশিক এবং মদীনাহর প্রেমিক আজ এখানে মাটির নীচে শুয়ে আছেন। কিন্তু কল্পনায় অনুভবে আমার সামনে একে একে উদ্ভাসিত হলো পঁচিশ বছর আগের সেই সব মধুর দৃশ্য! এই নূরানি মানুষটির নূরানি ছায়ায় আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেছি! আরাফার ময়দানে তাঁর দু’হাত
অনুসরণ করে আমিও দু’হাত উপরে তুলেছি! এই ‘প্রায় নিষ্পাপ’ বুড়ো মানুষটিকে মিনায় জামারার পথে
আমি একবার কোলে নিয়েছি! এই আশিকে নবীর পিছনে দাঁড়িয়ে নিজের পাপী অস্তিত্বকে আড়াল করে
আমি রাওযা শরীফে সালাম পেশ করেছি!
এখন কালো গিলাফ আছে, সবুজ গম্বুজ আছে, কিন্তু যার ছোহবতে আদাবে ইশকের সবক হাছিল করার সুযোগ ছিলো তিনি তো আর মাটির উপরে নেই। ‘উপর ও নীচের’ এই অমোঘ বিধান তো আমারও জন্য অপেক্ষা করছে! এখান থেকে এই চিরসত্য অনুভূতিটুকু গ্রহণ করে যদি আমি আজ আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হতে পারি তাহলেই ধন্য আমার জীবন।
ভিতরের অব্যাখ্যাত এক তাগিদে কখনো কখনো আমি আগে যিয়ারত করি হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর কবর, তারপর আববার কবর। আজও তাই করলাম। আববার কবরের সামনে যখন দাঁড়ালাম, অন্তরের কান্না এবং চোখের পানি রোধ করা আর সম্ভব হলো না; তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করলাম আওয়াযকে সংযমের মধ্যে রাখতে। কবরবাসীর প্রিয়জন যখন যিয়ারাতে আসে এবং সালাম পেশ করে, কবরবাসী নাকি তাকে চিনতে পায়, তার কথা শুনতে পায়! তাহলে তো বাবা আমাকে চিনতে পারছেন, আমার সালাম শুনতে পাচ্ছেন এবং আমার উপস্থিতি দ্বারা শান্তি লাভ করছেন, এ অনুভূতি কত বড় শান্তির, কত বড় সান্ত্বনার!
وإنا أن شاء الله وإنا أن شاء الله بكم لاحقون.
বলে সালাম নিবেদন করার পর খুব ধীর শান্ত আওয়াযে সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করলাম। আমার সৌভাগ্য যে, আববার মৃত্যুর সময়ও আমি সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করেছিলাম। তার রূহ ‘পারওয়ায’ করেছিলো ঠিক যখন তিলাওয়াত করছি-
سلام قولا من رب رحيم
আজ তাঁর কবরের সামনে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করতে করতে যখন এই আয়াতের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন ‘কষ্টের ও আনন্দের সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আল্লাহর নবী যে বলেছেন,
ألا إن للموت سكرات ألا إن للموت سكرات
(শোনো, মউতের কিন্তু সাকারাত ও যন্ত্রণা রয়েছে।)
এ সতর্কবাণীর কঠিন সত্য যেমন সেদিন প্রত্যক্ষ করেছি তেমনি এ সুসংবাদেরও প্রতিফলন দেখেছি যে, সূরা ইয়াসীনের তিলাওয়াত সাকারাতুল মাউতকে আসান করে দেয়।
কান্না ও অশ্রুর সংযমের মাঝে অনেক কষ্টে তিলাওয়াত শেষ করলাম। কিন্তু অবশেষে আবেগের উচ্ছ্বাস এমনই চরমে পৌঁছলো যে, আল্লাহ মাফ করুন, নিজের অজান্তেই কান্নার আওয়ায হলো।
এমন সময় হঠাৎ অন্যরকম এক ভাবের উদয় হলো, কিংবা আমি যেন জাগরণ
ও তন্দ্রার এক মিশ্র স্তরে উপনীত হলাম। সামনের কবরটি যেন আমার সামনে উন্মুক্ত! ঐ তো বাবা আমার হাস্যোজ্জ্বল নূরানি চেহারায় শায়িত! তিনি যেন বললেন, যাও বাবা, আল্লাহর ঘরে যাও। আমার জন্য তাওয়াফ করো, ওমরা করো। কবরে থেকেই আমি তোমার ওমরা-তাওয়াফের খোশখবর পাবো।
মৃত্যুশয্যায় আববার একটি আকুতির কথা মনে পড়লো। শুয়ে ছিলেন; শুয়েই তো থাকতেন দিন-রাত একটি শিশুর চেয়েও অসহায় হয়ে। চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। হঠাৎ বলে উঠলেন, আবেগকম্পিত কণ্ঠে যেন শিশুর আব্দারের ভাষায়, যে আব্দারের অধিকার বান্দাকে, মৃত্যুপথের যাত্রী বান্দাকে স্বয়ং আল্লাহ দান করেছেন; তিনি বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনে আমারে আপনের ঘরের দীদার করাইছেন। এখন সোজা জান্নাতে আমারে আপনের নিজের দীদার করাইবেন।’
দীদারে বাইতের অনুগ্রহ যারা লাভ করেছে দীদারে রাববুল বাইতের আশা তারা করতেই পারে। আববার কবর থেকে ফিরে আসার সময় আমিও আল্লাহর কাছে মিনতি জানালাম, হে আল্লাহ, তোমার বান্দার আব্দার তুমি রক্ষা করো। তুমি ছাড়া কে রক্ষা করবে?! তুমি ছাড়া কে রক্ষা করতে পারে। হে আল্লাহ, সেটা ছিলো মৃত্যুপথের যাত্রী তোমার এক বান্দার আব্দার, আর হে আল্লাহ, এটা হলো বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তোমার দুয়ারে এক সন্তানের মিনতি। মাটির নীচের বাবার জন্য মাটির উপরের অসহায় সন্তান আর কী করতে পারে এই মিনতিটুকু ছাড়া! এ মিনতি তুমি তো রক্ষা করতে পারো হে আল্লাহ। তুমি তো আরো অনেক বেশী দান করতে পারো হে আল্লাহ!
ইচ্ছে করছিলো, বাবার কবরের সামনে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি, আরো কিছু চোখের পানি ফেলি। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো, তিলাওয়াত করবো ততক্ষণই তো বাবার ভালো লাগবে! কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে। সময় ফুরিয়ে আসে। তখন ইচ্ছে থাকলেও কি আর থাকা যায়!
হযরত হাফেজ্জী হুযূর এবং আববার কবর যিয়ারাত করে আশ্চর্য এক ভালো লাগা মনটাকে যেন আচ্ছন্ন করলো। হৃদয়ের মধ্যে একটি বিগলিত অবস্থা সৃষ্টি হলো। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।
মাওলানা তাক্বী উছমানী বলেছেন, অন্তরে যে সব চিন্তা উদিত হয় সেগুলো আল্লাহর প্রেরিত মেহমান। সেগুলোর কদর করা কর্তব্য। আববার কবর থেকে ফেরার পথে হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ মনে একটি চিন্তা উদিত হলো; হজ্বের সফরনামা লেখার চিন্তা। বান্দা কি চিন্তাও করতে পারে, যদি আল্লাহ দান না করেন! কেন জানি মন বলছে, পাহাড়পুরী হুযূর এবার অনুমতি দেবেন। তবে মনে মনে ভাবলাম, আমি নিজে অনুমতি চাইব না। আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিককে বলবো, বিষয়টি হুযূরের কাছে পেশ করার জন্য। মনে হলো, এটাই উত্তম হবে।
বাসায় এসে দেখি, কোন কোন ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে আলাদা দেখা করার জন্য। একজন ডায়েট বিস্কিটের ছোট্ট একটি প্যাকেট দিলো পথে খাওয়ার জন্য। একজন খুব সঙ্কোচের সঙ্গে পাঁচটি রিয়াল দিলো, যেন মক্কা শরীফে সর্বপ্রথম সেটা খরচ করি। কয়েক জন খামে করে চিঠি দিলো, যেন হারাম শরীফে বসে খুলে পড়ি। একেকজনের একেক আচরণ, একেক উচ্চারণ; সবই সুন্দর, সবই মধুর এবং ভালোবাসার ঊষ্ণতায় ভরপুর। একজন, যে কখনো তেমন করে কাছে আসেনি সে ‘এখনো জোনাকি জ্বলে’ পড়ে জেনেছে বাদাম আমার প্রিয়। হযরত যওক ছাহেব শহর থেকে আমার জন্য বাদাম আনতেন। তাই সে একটি কৌটায় করে
বাদামের দানা দিলো। আমি সস্নেহ তিরস্কার করতে গিয়েও তার মুখের দিকে
তাকিয়ে পারলাম না। জাযাকাল্লাহ বলে কৌটাটা নিলাম। বললাম না যে, বাবা, বাদাম এখন আমার স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। সফরে
ওর বাদাম খেয়েছি অল্প অল্প, আর দু‘আ করেছি অনেক অনেক।
এক তালিবে ইলম আমার হাত ধরে শুধু কাঁদলো। কিছু বলতে পারলো না। তার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু পড়লো আমার হাতের উপর।
মনোবিজ্ঞানীরা অশ্রুর বিভিন্ন প্রকার করেছেন; শোকের, আনন্দের, কৃতজ্ঞতার এবং ভালোবাসার। কোন অশ্রু কেমন তাও তারা বলেছেন। আমি চোখের অশ্রুর বিশেষজ্ঞ নই। আমি শুধু তার অশ্রুর উষ্ণতা অনুভব করলাম,
আর মনে মনে বললাম, মনের কথা তুমি বলতে পারোনি, আমিও শুনতে পাইনি, তবে যিনি শুনতে পেয়েছেন তিনি যেন গ্রহণ করেন তোমার মনের আকুতি এবং তোমার হৃদয়ের মিনতি।
এই সব দেখে মনে হলো, হতাশার কোন কারণ নেই। আল্লামা ইকবাল যা চেয়েছেন, কলবের গরমি এবং রূহের তড়প, সামান্য হলেও এখনো তা আছে আগামী দিনের ‘ওয়ারিছান’-এর
মধ্যে। যিন্দা তামান্না এখনো ‘ধড়কন’ পয়দা করে তাদের দিলে। তবু কেন যে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ি মাঝে মাঝে! কেন যে মনে হয়, আমরা শুধু উঁচু থেকে ঢালের দিকে নেমে যাচ্ছি; ঢাল থেকে উঁচুতে উঠতে পারছি না। আমিই যখন পারি না, আমার ছাত্ররা পারবে কীভাবে?!
কক্সবাজার থেকে আমাদের ছাত্র মনছূর এবং দূরের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো কয়েকজন ফোন করে দু‘আ চাইল। কীভাবে খবর পেয়েছে বুঝলাম না।
প্রস্ত্ততি নেয়ার সময় কমে আসছে, কিন্তু একজন দু’জন করে আসা বন্ধ হচ্ছে না। ফিরিয়ে দিতেও মন সায় দিচ্ছে না। কীভাবে দেবো;
আমার মন যে বলছে, এই সব ‘অবুঝদের’ উছিলায় হয়ত আমার মত ‘বুঝদারদের’ নৌকা পার হবে!
ভিতরের কামরায় গিয়ে দেখি, আমার দুই মেয়ে প্রয়োজনীয় সামান গোছাতে ব্যস্ত।
প্রথমেই দেখলাম, ওরা আমার ব্রিফকেসটি বাতিল করে দিয়েছে সেটির জীর্ণদশার কারণে। আমি বললাম, দেখো, আজ পঁচিশ বছর ধরে, সাফফানাকে বললাম, তোমার জন্মেরও আগে থেকে এটি বাইতুল্লাহর সফরে আমার সঙ্গী। আজ যদি
শুধু জীর্ণদশার কারণে না নেই তাহলে কি এর কষ্ট হবে না! ‘সবকিছুই তো তাঁর হামদের তাসবীহ পড়ে, কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পারো না।’ আমরা যেমন আল্লাহর ঘরে যাই, এরাও তো আল্লাহর ঘরে যায়!
লোবায়না বললো, কিন্তু আববু, সফরে এটা তোমার কষ্টের কারণ হতে পারে।
আমি বললাম, হোক, তবু সঙ্গে নেবো। একে ফেলে যাওয়াতে শরী‘আতের কোন
বাধা নেই, গোনাহেরও কিছু নেই। কিন্তু আমি যে আমার হৃদয়ের অনুভূতির কাছে দায়বদ্ধ!
প্রিয় পাঠক, হজ্বের সফরনামায় কী লিখতে হয় এবং কী লিখতে হয় না, ভালো করে আমার জানা নেই। সুতরাং এসব কথায় তোমার যদি ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, দয়া করে ক্ষমা করো।
আমার নিজের কোন ব্যাগ নেই। লোবায়নার
ব্যাগে সামান ভরা হলো। চাদর, সুয়েটার, ইহরামের নতুন একজোড়া তোয়ালে, আরো কাপড়-চোপড়। তারপরো দেখা গেলো সামানের তুলনায় ব্যাগটা বড়। সাফফানার ব্যাগটি আকারে উপযোগী। আমি কিছু না ভেবে সামানগুলো সাফফানার ব্যাগে দিতে বললাম। বলেই দেখি, একটি মুখে হাসি, একটি মুখ অাঁধার। কোন মুখে
কথা নেই, তবে দুই জোড়া হাত কাজ করে যাচ্ছে। আমি কাউকে সম্বোধন না করে বললাম, যার ব্যাগ
সঙ্গে যাবে তাকে ভুলবো না, যার ব্যাগ সঙ্গে যাবে না তাকে মনে রাখবো।
মনে হলো দু’জনই তাতে খুশী হলো। আমিও কেমন বোকা, ব্রিফকেসের ‘মন’ রক্ষা করছি, অথচ মেয়ের মন ভেঙ্গে বসে আছি!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)