মুহাররম ১৪৪৬   ||   জুলাই ২০২৪

সন্তানের জীবনে পিতার পরহেযগারির সুফল

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

কুরআন মাজীদে কৃতজ্ঞ মুমিনের সুন্দর একটি দুআ উল্লেখ করা হয়েছে-

رَبِّ اَوْزِعْنِيْۤ اَنْ اَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْۤ اَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَ عَلٰي وَالِدَيَّ وَ اَنْ اَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضٰىهُ وَ اَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِيْ اِنِّيْ تُبْتُ اِلَيْكَ وَ اِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাওফীক দান করুন, যেন আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নিআমত দিয়েছেন তার শোকর আদায় করতে পারি এবং এমন সৎকর্ম করতে পারি, যাতে আপনি খুশি হন এবং আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যেও সৎকর্মপরায়ণতা দান করুন। আমি আপনার কাছে তওবা করছি এবং আমি আনুগত্য প্রকাশকারীদের অন্তর্ভুক্ত। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫

দুআটিতে প্রথমে তিনটি বস্তু প্রার্থনা করা হয়েছে। এরপর দুটি প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়েছে।

প্রার্থিত বস্তু তিনটি হল-

১. নিজের ও পিতামাতার প্রতি আল্লাহপ্রদত্ত নিআমতের শোকরগোযারির তাওফীক।

২. আল্লাহর পছন্দসই নেক কাজের তাওফীক।

৩. সন্তানাদির মধ্যে সালাহ ও সৎকর্মপরায়ণতা।

আর প্রতিজ্ঞেয় বিষয়দুটি হচ্ছে-

১. আমি তওবা করেছি এবং আল্লাহ্-অভিমুখী হয়েছি।

২. আমি আল্লাহর আনুগত্যকারী।

এখানে সন্তানের ইসলাহ ও সংশোধন কামনার আগে নিজে কৃতজ্ঞ মুমিন হওয়া এবং আল্লাহর ইবাদতগোযার বান্দা হওয়ার তাওফীক চাওয়া হয়েছে এবং সন্তানের সালাহ ও সৎকর্মপরায়ণতা কামনার পর নিজের আল্লাহমুখী হওয়া এবং আল্লাহর আনুগত্য করার অঙ্গিকার করা হয়েছে। অর্থাৎ সন্তানের সালাহ ফালাহ (সাধুতা ও সফলতা) প্রার্থনা করার আগে ও পরে নিজের সাধুতা ও ধার্মিকতা প্রকাশ করা হয়েছে। এখান থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সন্তানের ফালাহ ও সালাহের ক্ষেত্রে পিতার আমলের অনেক প্রভাব রয়েছে। পিতার সালাহ, শোকরগোযারি, তওবা ও আনুগত্যের দ্বারা সন্তান অনেক উপকৃত হয়। এর মাধ্যমে সন্তানের জীবনে প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। আরো খুশির ব্যাপার হল- সেই কল্যাণ কেবল দ্বীনী বিষয়ে নয়; বরং পার্থিব জীবনেও প্রকাশ পায়।

পিতার ঈমান-আমল-এখলাছের সুফল দুনিয়ার জীবনেই লাভ হয়। এর কল্যাণে সন্তানের জীবনে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জিত হয়। আলকুরআনেই রয়েছে এর সত্যায়ন।

কুরআন মাজীদে খাযির আলাইহিস সালাম ও মূসা আলাইহিস সালামের সফর ও কথোপকথন সংক্রান্ত একটি শিক্ষণীয় ঘটনা বিবৃত হয়েছে। সেখানে এসেছে, পথিমধ্যে তাঁরা দেখেছেন, একটা প্রাচীর পতনোম্মুখ। হেলে আছে, পড়ে যায় যায়। আল্লাহ তাআলা খাযির আলাইহিস সালামের মাধ্যমে প্রাচীরটাকে দাঁড় করিয়েছেন। পতন থেকে রক্ষা করেছেন। প্রাচীরটি ছিল দুই এতীম শিশুর। প্রাচীরকে কেন হেফাযত করা হল? এর জবাব শুনুন খাযির আলাইহিস সালামের যবানে। কুরআনের ভাষায়-

وَاَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلٰمَيْنِ يَتِيْمَيْنِ فِي الْمَدِيْنَةِ وَكَانَ تَحْتَهٗ كَنْزٌ لَّهُمَا وَ كَانَ اَبُوْهُمَا صَالِحًا فَاَرَادَ رَبُّكَ اَنْ يَّبْلُغَاۤ اَشُدَّهُمَاوَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّكَ .

আর প্রাচীরটি; এটি ছিল এই শহরে বসবাসকারী দুই এতীমের। এর নিচে তাদের গুপ্তধন  ছিল  এবং  তাদের  পিতা  ছিলেন একজন সৎলোক। সুতরাং আপনার প্রতিপালক চাইলেন, ছেলেদুটো প্রাপ্তবয়সে উপনীত হোক এবং নিজেদের গুপ্তধন বের করে নিক। এসব আপনার প্রতিপালকের রহমতেই ঘটেছে।  -সূরা কাহফ (১৮) : ৮২

আয়াতটিতে বলা হয়েছে, এতীম শিশুদ্বয়ের পতনোম্মুখ প্রাচীরকে পতন থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন তাদের পিতা মহোদয়ের সালাহ ও ধার্মিকতার বরকতে। সুতরাং বোঝা যায়, সন্তান পিতার তাকওয়া ও দ্বীনদারির সুফল দুনিয়াতেই লাভ করতে থাকে। এর বদৌলতে সন্তানের জীবন সুখময় ও শান্তিময় হয়। খ্যাতিমান তাবেয়ী, খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. বলেন-

مَا مِنْ مُؤْمِنٍ يَمُوتُ إِلَّا حَفِظَهُ اللهُ فِي عَقِبِه وَعَقِبِ عَقِبِه.

কোনো সৎলোক মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর সন্তানাদি ও পরের প্রজন্মের হেফাযত করেন। -আলইতিবার, ইবনে আবিদ্ দুনইয়া, বর্ণনা ৭১; তারিখে দিমাশক, ইবনে আসাকির ৩১/২২২; জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম ১/৪৬৭

সুতরাং আমি যদি সন্তানের কল্যাণ কামনা করি, কলিজার টুকরোকে ফুল ও আলো হিসেবে দেখতে চাই, সর্বোপরি প্রিয় সন্তানের ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তি এবং স্বস্তি ও সফলতার প্রত্যাশী হই, তাহলে প্রথমে আমার নিজের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। নিজেকে শোধরাতে হবে। আমার জীবনকে তাকওয়া ও পরহেযগারিতে সজ্জিত করতে হবে। আমার সালাহ ও ধার্মিকতার মাধ্যমে আমার সন্তান দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সালাহ ও ফালাহ অর্জনে এগিয়ে যাবে।

মশহুর তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির রাহ. বলেন-

إِنَّ اللهَ لَيُصْلِحُ بِصَلَاحِ الْعَبْدِ وَلَدَه، وَوَلَدَ وَلَدِه، وَيَحْفَظُه فِي دُوَيْرَتِه، وَالدُّوَيْرَاتِ الَّتِي حَوْلَه مَا دَامَ فِيهِمْ

ব্যক্তির সালাহ ও ধার্মিকতার কল্যাণে আল্লাহ তাআলা তার সন্তানাদি ও তাদের পরের প্রজন্মকে সালাহ ও ধার্মিকতা দান করেন এবং তার ঘরবাড়ি ও তার আশপাশের ঘরবাড়ির হেফাযত করেন, যতক্ষণ সে তাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, বর্ণনা ১১৮৬৬; আয্যুহ্দ ওর্য়া রাকাইক, ইবনুল মুবারক, বর্ণনা ৩৩০

তাই সন্তানের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য কোনো কোনো মনীষী নামাযের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ. একবার তাঁর ছেলেকে লক্ষ করে বলেছেন-

لأزيدن في صلاتي من أجلك،رجاء أن أُحْفَظَ فيك.

তোমাকে আল্লাহ হেফাযত করবেন- এ আশায় আমি নামাযের পরিমাণ বাড়িয়ে দিই। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম ১/৪৬৭

সুতরাং সন্তানকে আদর্শ ও আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করব। উল্লিখিত আয়াতের বার্তা গ্রহণ করব এবং সে আলোকে নিজের জীবন পরিচালনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। সাথে দুআটি বেশি বেশি পড়ব-

رَبِّ اَوْزِعْنِيْۤ اَنْ اَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْۤ اَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَ عَلٰي وَالِدَيَّ وَ اَنْ اَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضٰىهُ وَ اَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِيْ اِنِّيْ تُبْتُ اِلَيْكَ وَ اِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাওফীক দান করুন, যেন আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নিআমত দিয়েছেন তার শোকর আদায় করতে পারি এবং এমন সৎকর্ম করতে পারি, যাতে আপনি খুশি হন এবং আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যেও সৎকর্মপরায়ণতা দান করুন। আমি আপনার কাছে তওবা করছি এবং আমি আনুগত্য প্রকাশকারীদের অন্তর্ভুক্ত। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫ 

 

 

advertisement