মুহাররম ১৪৪৬   ||   জুলাই ২০২৪

কুরবানী : কোনো সংস্থা বা কসাইকে মূল্য পরিশোধ করে নয়, কুরবানী করুন নিজ ব্যবস্থাপনায় পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে

১৪৪৫ হিজরীর ঈদুল আযহা তথা কুরবানীর ঈদ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ পশু কুরবানী করেছে। যদিও নতুন করে বেড়ে ওঠা দারিদ্র্য ও আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই বছরে অনেকেই কুরবানী করতে পারেননি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কয়েক লক্ষ পশু অবিক্রিতও থেকে গেছে। তবুও শহরে ও গ্রামে দেশের সকল অঞ্চলে কুরবানীর পশুর হাটে হাটে যাওয়া, দাম-দর করা, পশু পছন্দ করা, বাড়িতে এনে কয়েকদিন আদর-যত্নে লালন-পালন করা এবং নিজেরা উপস্থিত থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করা, গোশত বিলি-বণ্টন, পাড়া-পড়শি আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রশ্রেণিকে দানসহ যাবতীয় কাজ সতস্ফূর্তভাবে আগের মতোই করতে দেখা গেছে বৃহত্তর মুসলিম জনসমাজকে। এটিই কাম্য।

কিন্তু কয়েক বছর থেকে একটি বিষয় উদ্বেগেরে সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে, এদেশের কোনো কোনো সংস্থা এবং কিছু মানুষের মধ্যে অপ্রয়োজনেই পশ্চিমা চিন্তা সওয়ার হয়েছে। পশ্চিমের অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সাধারণত খোলামেলা কুরবানী করার সুযোগ থাকে না। ফলে সেখানকার মুসলমানগণ বাধ্য হয়েই কোনো সংস্থা বা কসাইয়ের দোকানে কুরবানীর হিস্যা অনুযায়ী টাকা জমা দিয়ে আসেন। তাঁদের পক্ষ থেকে ওই সংস্থা বা কসাই পশু ক্রয় করে নির্ধারিত সময়ে গোশতের প্যাকেট টাকাদাতার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এদেশেও কয়েক বছর থেকে নিজের কুরবানী নিজে না দিয়ে কোনো সংস্থাকে টাকা দিয়ে দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দুই প্রকার পদ্ধতি নাকি চালু আছে :

এক. সংস্থাকে টাকা দিয়ে দিল। তারা  কুরবানী দিয়ে কোনো এলাকায় বণ্টন করে দিল।

দুই. যাদেরকে টাকা দেওয়া হল, তারা টাকাদাতার পক্ষে পশু ক্রয় করে যবেহ দিয়ে সেটির গোশত নির্ধারিত সময়ে টাকাদাতার কাছে পৌঁছে দিল। এর জন্য একটি সার্ভিস চার্জ নিল।

এসবের জন্য কোনো কোনো সংস্থাকে বেশ মুখরোচক ও শ্রুতিমধুর বিজ্ঞাপন দিতেও দেখা গেছে, আপনার কুরবানীর কোনো ঝামেলা কোনো ঝঞ্ঝাটই সইতে হবে না। এসব কিছুই আমাদের কাঁধে ছেড়ে দিন। নির্ধারিত সময়ে কুরবানীর গোশত পৌঁছে যাবে আপনার বাড়িতে। এমন আরো কত কী। এ যেন অনলাইনে অর্ডার করলেই গরম গরম বার্গার-স্যান্ডউইচ ডেলিভারি বয়ের মাধ্যমে বাড়িতে পেয়ে যাওয়ার মতো!

আসলেই কি কুরবানী বিষয়টি এমন? না, একেবারেই নয়। কুরবানী হচ্ছে শিআরে ইসলাম। ইসলামের অন্যতম প্রতীক। সামর্থ্যবান মুসলিমগণ নিজ পছন্দের পশু আল্লাহর নামে কুরবানী করবে। নিজ হাতে পশু যবেহ করবে। তা না হলে অন্তত জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকবে। ত্যাগ ও খুশির একটি মিশ্র অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত হবে। এরপর পশুর গোশত প্রস্তুতকরণ অথবা কাছে থেকে প্রস্তত করানো এবং বিলিবণ্টন প্রক্রিয়া নিজ দায়িত্বে আঞ্জাম দেবে। এগুলো শুধু আবহমান কাল থেকে চলে আসা রীতিই নয়; বরং এগুলো ইসলামের শিক্ষাও বটে। শহরের পশু যবেহের স্থানগুলো এবং গ্রাম অঞ্চলের পাড়া-মহল্লায় ঈদুল আযহার দিনগুলোতে এ দৃশ্য ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যে প্যাকেজ ও ফ্যাশনেবল কুরবানীর আয়োজন শুরু হয়ে গেছে, তাতে কি এসবের কোনো কিছু থাকে? এসবক্ষেত্রে ইসলামের এ অন্যতম শিআরটি দৃশ্যমান হওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি?

পশ্চিমের দেশগুলোতে তো আইনি জটিলতা রয়েছে। চাইলেও অনেকের পক্ষে নিজ হাতে, নিজ দায়িত্বে পশু কুরবানী করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমাদেরও কি এ সংস্কৃতি চালু করতে হবে? যারা কুরবানীর টাকা নিয়ে কুরবানীদাতার ঘরে গোশত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন বিষয়টি আরো গভীরভাবে তাদের ভেবে দেখা উচিত এবং কুরবানীদাতাদেরও এসব ক্ষেত্রে এত অলসতা ও গুরুত্বহীনতার পরিচয় না দেওয়া উচিত। দয়া করে বৃদ্ধাশ্রমের মতো এসকল বিদেশী কালচার এদেশে জোর করে টেনে আনবেন না। সবকিছুকে এত সহজ প্যাকেজভুক্ত ও অতি আধুনিক বানিয়ে ফেলবেন  না। কুরবানী দিন দায়িত্বশীলতার সাথে, নিজে উপস্থিত থেকে, নিজ আয়োজনে।

আরেকটি বিষয়, নিজ কুরবানী কি নিজে না করে কোনো সংস্থাকে দান করে দেওয়া উচিত?

আপনি নিজের ওয়াজিব কুরবানী নিজে দিচ্ছেন। আরো কিছু নফল কুরবানী কারো মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্রদের জন্য করাচ্ছেন। যাদের মাধ্যমে দিচ্ছেন, তারা যদি বিশ্বস্ত হয়, তাহলে সেটি তো ভালো কথা। কিন্তু আপনার ওয়াজিব কুরবানীটিই যদি কোনো সংস্থাকে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যান, তাহলে কি সেটি শরীয়তের শিক্ষাকে পূর্ণ করছে? ইসলামের দৃষ্টিতে কুরবানী হচ্ছে আল্লাহর যিয়াফত। বান্দা সেদিন আল্লাহর মেহমানদারি গ্রহণ করে। আল্লাহর অনেক নেক বান্দা ১০ যিলহজে¦র প্রথম আহার গ্রহণ করেন নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে। তো তথাকথিত আধুনিক কুরবানী ব্যবস্থাপনাগুলোতে এসবের কি কোনো অস্তিত্ব আছে? সুতরাং প্রত্যেকটি ইবাদত তার মেযাজ ও শান অনুযায়ী শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

এখানে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, উপরোক্ত নিবেদন যথাযথ পন্থায় শরীয়তের চাহিদা অনুযায়ী কুরবানী আদায়ের জন্য করা হয়েছে। অন্যের মাধ্যমে কুরবানী করা হলে কুরবানীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যাওয়া বা না হওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ওয়াজিব আদায় হয়ে যাওয়া এক বিষয় আর একটি ইবাদত যথাযথ পন্থায় সুন্নত মোতাবেক এবং শরীয়তের রুচি-প্রকৃতি অনুযায়ী করা ভিন্ন বিষয়।

 

নতুন হিজরীবর্ষ : মোবারক হো হিজরী ১৪৪৬

 

আলহামদু লিল্লাহ, আমরা একটি হিজরীবর্ষ সমাপ্ত করে নতুন বর্ষে পদার্পণ করেছি। এটি ১৪৪৬ হিজরী।

اَللّٰهُمَّ أدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ وَالْإِيْمَانِ، وَالسَّلَامَةِ والْإِسْلاَمِ، وَجِوَارٍ مِّنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِّنَ الرَّحْمنِ.

হিজরী সন মুসলিমদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সন। এটি শুধু আরবদের বর্ষই নয়; বরং ইসলামী গণনাপঞ্জিও বটে। হিজরী সনের মাহাত্ম্য, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস নিয়ে মাসিক আলকাউসারে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

বর্তমানে পশ্চিমা ও পৌত্তলিক সংস্কৃতির প্রভাবে নববর্ষ উদ্যাপনের বহু অর্থহীন ও শিরকী পন্থায় অভ্যস্ত হয়েছে মুসলিমগণ। অন্যদের অন্ধ অনুকরণ, নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে একটি জাতিকে দ্রুতই দূরে সরিয়ে দেয়।

আসলে একজন মুসলিমের নতুন বর্ষে কী ভাবা উচিত এবং কী করা উচিতএর সুস্পষ্ট উত্তর হচ্ছে, মুহাসাবা তথা আত্মপর্যালোচনা করা গত বছরে নিজের জীবনের ভালো-মন্দের যথাযথ মূল্যায়ণ করা। ভালো অর্জনগুলোর জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর মন্দ কাজগুলোর জন্য তাওবা-ইস্তিগফার ও যথাযথ প্রতিকার গ্রহণ করা। সাথে সাথে নতুন বছরে ভালো কিছু করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া। আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। সততা, নিষ্ঠা ও সৎ সাহসিকতার সাথে হক ও ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকায় প্রত্যয়ী হওয়া।

সকলকে হিজরী নববর্ষের মোবারকবাদ।

 

ফিলিস্তিন যুদ্ধ : জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাশের পরও থামছে না ইসরাইলী বর্বরতা

 

গত ১০ জুন ২০২৪ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হয়েছে। যদিও বিগত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়ার পরও এ আমেরিকার ভেটোর কারণেই পাশ হতে পারেনি। ওসব প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দিলে এবং ইসরাইলকে নিঃশর্ত নিরঙ্কুশ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলে অনেক আগেই এ যুদ্ধ থেমে যেত। কিন্তু ইসরাইলের কোনো অন্যায়ই জো বাইডেন ও আমেরিকার চোখে ধরা পড়ে না। তাদের সকল হত্যা, নির্যাতন ও বর্বরতা আমেরিকা ভালো কাজ হিসেবেই ধরে নেয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে এসবের পক্ষে সাফাইও গেয়ে থাকেন।

এরই মধ্যে আমেরিকা-ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গাজায় ইসরাইলী বর্বরতার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি এবং ইসরাইলী গণহত্যা বন্ধের পক্ষে বক্তব্যও আসতে থাকে। তার সাথে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক ইসরাইলকে যুদ্ধ থামানোর নির্দেশ। সম্ভবত এসব কারণেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট একান্ত বাধ্য হয়েই জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব এনেছেন। আমেরিকা বলছে, ইসরাইল এ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। হামাসের উচিত তা মেনে নেওয়া। যেহেতু প্রস্তাবটি অনেকটা একপেশে ছিল, তাই আমেরিকা হয়তো ভেবেছে, হামাস এর বিরোধিতা করবে। কিন্তু হামাসের রাজনৈতিক শাখা কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। তারা আবারও জানান দিয়েছে, তারা শান্তির পক্ষে।

যাইহোক, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তো পাশ হয়েছে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু ইসরাইলের মুরব্বি ও প্রধান মদদদাতা আমেরিকা তো প্রস্তাব পাশের সময়ই বলেছে, এতে ইসরাইলের সম্মতি রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কি গাজায় গণহত্যা বন্ধ হয়েছে? তা তো হয়নি। এখনো প্রায় প্রতিদিনই শহীদ করা হচ্ছে মজলুম আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। মুসলমানদের প্রধান উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহাও ঠিকমতো পালন করতে দেওয়া হয়নি ফিলিস্তিনবাসীকে। তাহলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের কী দাম রইল। জাতিসংঘ, আমেরিকা এবং ইসরাইলের অন্যান্য মদদদাতারা চুপ করে আছে কেন? কারও কি কোনো শক্তি নেই- ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার? ইসরাইল কি এখন সবাইকে ছাড়িয়ে পরাশক্তি হয়ে গেছে? নাকি এসব লোক দেখানো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তামাশামাত্র।

আর মুসলিম নেতাদের কথা বলে লাভই বা কী? তারা তো নিজ ক্ষমতা আকড়ে থাকতে ব্যস্ত। যতদিন মুসলিম দেশগুলোর জনগণ এসব বিলাসিতা ও অবিচারে লিপ্ত ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ফুঁসে না উঠবে ততদিন তো তারা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। মুসলিম জাতি ও সমাজের দুঃখ-কষ্ট দেখার সময় কোথায় তাদের?!

 

 

advertisement