যিলহজ্ব ১৪৪৫   ||   জুন ২০২৪

ফিরে আসার গল্প
কাদিয়ানী চক্রান্তের শিকার এক নারীর কথা

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ফেতনার যামানা। নিত্য নতুন ফেতনা জন্ম নিচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বাতিলপন্থীরা মুসলমানদের ওপর সামষ্টিকভাবে আগ্রাসন চালানোর পাশাপাশি কৌশলে ঈমান হরণের নানা পথও আবিষ্কার করছে। আরো অবাক বিষয় হল, দ্বীনদার ঘরের সন্তানদের কেউ নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে, মা-বাবার অজান্তে কেউ ধর্ম পরিবর্তন করে বসছে। একদিকে যেমন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন; ঈমান বিধ্বংসী অনেক কিছু শেখানো হচ্ছে স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিগুলোতে। অন্যদিকে সন্তানের সঠিক তরবিয়তের প্রতি মাতা-পিতার মনোযোগের অভাব।

অধমের সাথে আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি যেহেতু অনেক শিক্ষণীয়, সেই সঙ্গে তাতে মাতা-পিতার প্রতি একটা সতর্কবার্তাও রয়েছে। এজন্য পাঠকদের সামনে ঘটনাটি তুলে ধরছি-

এক রাতে বাড়ি পৌঁছে দেখি, আমাদের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব ঘরের দরজায় বসা।

জিজ্ঞেস করলাম, এমন সময় কী মনে করে এসেছেন?

তিনি বললেন, আপনার সঙ্গে খুবই জরুরি একটা কথা আছে। এলাকার এক লোক। জুমার দিন সবার আগে মসজিদে আসে। মসজিদের প্রায় সকল দ্বীনী প্রোগ্রামেই অংশগ্রহণ করে। আজ দুপুরে খুব পেরেশান অবস্থায় সে আমার কাছে এসেছিল। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটার বিয়ের কথা চলছিল তার এক খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। দেখাদেখি ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সব শেষ। বিয়ের তারিখও নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। আকদের আগের রাতের ঘটনা। হঠাৎ বর পক্ষের লোকজন এসে হাজির। ছেলে, ছেলের মা-বাবা, দুই বোন, ফুফু আরো কয়েকজনআগ থেকে কোনো কথা ছাড়া হঠাৎ এমন উপস্থিতিতে মেয়ের বাবা বেশ অবাকই হলেন। তারা এসেছে অন্যরকম এক প্রস্তাব নিয়ে। বিয়ের জন্য তারাই কাজী ঠিক করবে। অর্থাৎ তারা যে কাজী নিয়ে আসবে তাকে দিয়েই বিয়ে পড়াতে হবে। এ অঞ্চলের একটা প্রথা হল, বিয়েতে মেয়ে পক্ষ কাজী ডাকে এবং আনুষঙ্গিক খরচাদি মেয়ে পক্ষই বহন করে।

মেয়ের বাবা আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলেন না। বললেন, আচ্ছা, এতই যখন ইচ্ছা, কাজী আপনারাই ডাকেন। তবে ফি ও অন্যান্য যে খরচাদি আছে তা কিন্তু আমরা দেব।

এতক্ষণে তাদের মতলব স্পষ্ট হল। তারা বলল, আসলে আমরা আহমদী (কাদিয়ানী), এজন্যই মূলত আমরা কাজী ডাকছি। আপনাদের কাজীর মাধ্যমে আমাদের বিয়ে সহীহ হবে না।

মেয়ের বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। পাত্র কাদিয়ানী! কাদিয়ানী তো শুনেছি কাফের। যারা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী মানে না। আমি আমার মেয়েকে কোনো কাফেরের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারব না।

এবার পাত্রপক্ষ যা বলল, তাতে মেয়ের বাবার জ্ঞান হারানোর জোগাড়। আপনি আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। সে-ও আহমদী (কাদিয়ানী)। তার মেয়ে, যে কি না তারই ঘরে খেয়ে-পড়ে বড় হয়েছে, তার থেকেই শিক্ষা নিয়ে মানুষ হয়েছে, সে নাকি কাদিয়ানী!

লোকটা ইমাম সাহেবকে বলেন, আমি তৎক্ষণাৎ আমার মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি সত্যি?

যে মেয়ে কখনো আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে পারেনি, আমার এ প্রশ্নের উত্তরে সে সাফ সাফ বলল, হাঁ, আমি আহমদী হয়ে গেছি।

এ বাক্যগুলো ছিল আমার তিন ছেলে আর ওদের আম্মুর জন্য কিয়ামততুল্য। আমার তখন খুব মন চাচ্ছিল, মাটি ফেটে যাক, আর আমি তাতে দাফন হয়ে যাই।

এরপর আর কী! আমি পাত্রপক্ষের সঙ্গে ঝগড়া করে কোনোমতে ওদেরকে তাড়ালাম।

মেয়েকে বললাম, একথা তুমি কী করে বলতে পারলে?

সে বলল, আমার খালাতো ভাই -যার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা- মাঝে মাঝে কাদিয়ানীদের লেখা ছোট ছোট লিটারেচার আমাকে দিয়ে যেত। পড়তে বলত। সেসব পড়েই একসময় মনে হল...!

আমি তাকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু কোনো কাজ হল না।

রাতটা সবার খুবই বিষণ্নতায় কাটল। কারো ঘুম হল না। ওর ভাইয়েরা মন খারাপ করে বসে ছিল। গলা দিয়ে খাবারও ঢুকল না কারো।

পরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই ইমাম সাহেবের কাছে দৌড়ে আসেন তিনি। তার সঙ্গে এক্ষুনি যেতে বলেন। কিন্তু ইমাম সাহেব বলে দিয়েছেন, খতীব সাহেব বড় আলেম। তিনি মাদরাসা থেকে রাতে ফিরবেন। তিনি ফিরলে তাকে নিয়ে আমরা আপনার বাসায় যাব।

এতক্ষণে বুঝে এল- এই রাত-দুপুরে কেন ইমাম সাহেব আমাকে তলব করছেন। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। আমি দু-চার লোকমা মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। প্রথমে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে নিলাম। পুরো বিশ্বের সকল মানুষের হেদায়েতের জন্য দুআ করলাম। বিশেষ করে এই মেয়েটির জন্য। সব শেষে বললাম, হে রব! খতমে নবুওতের আকীদা সংরক্ষণে বের হচ্ছি। তুমি আমাদের সাহায্য করো।

লোকটার বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে নয়টা বেজে গেল। প্রথমে মেয়ের বাবার সঙ্গে কিছু কথা হল। এরপর সবাইকে ডাকা হল। মেয়ে ও তার মাকে পর্দার ওপাশে বসতে বললাম। এপাশে মেয়ের বাবা, তিন ভাই, আমি আর ইমাম সাহেব।

সবাই শান্ত হয়ে বসার পর আমি বলা শুরু করলাম, পুরো উম্মতে মুসলিমা এ বিষয়ে একমত যে, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। তাঁর পরে আর কাউকে নবুওত দেওয়া হবে না। তাঁর পরে যে কেউ যে কোনো ধরনের নবী দাবি করবে, সে মিথ্যাবাদী। আপনার কি এই আকীদায় কোনো সন্দেহ আছে?

মেয়েটা পর্দার ওপাশ থেকে বলে উঠল, মৌলভী সাহেব! আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি। আপনি আমাকে আগে সেগুলোর জবাব দিন। প্রথমে বলুন, নবী আর রাসূলের মধ্যে কী পার্থক্য?

আমি বললাম, নবী আর রাসূলের মাঝে পার্থক্য তো স্পষ্ট। রাসূলকে নতুন শরীয়ত দেওয়া হয়। তার ওপর আসমানী কিতাব নাযিল হয়। আর নবী তাঁর পূর্বে আসা রাসূলের শরীয়ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। আরেকভাবে বললে বলা যায়, প্রত্যেক রাসূল নবী হয়ে থাকেন, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল হন না।

মেয়েটা এবার বলল, আমি মির্জা সাহেবকে রাসূল নয়, নবী মানি। সেও এমন নবী, যাকে শরীয়ত দেওয়া হয়নি; বরং তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান এনে তাঁর রেখে যাওয়া কাজই করে গেছেন। যেমনটা আগের নবীগণ করতেন।

আমি উত্তরে বললাম, আপনার এ কথার অর্থ দাঁড়াল, এখন যে কেউ দ্বীনের কাজ করবে সে-ই নবী হয়ে যাবে। এভাবে তো অনেক আলেম ও তাবলীগী ভাইয়েরাও নবী হবে।

আমি আরো যোগ করলাম, আচ্ছা, তাহলে আল্লাহর নবীর এ কথার কী অর্থ হবে- আমিই শেষ নবী। আমার পরে আর কোনো নবী নেই।

মেয়েটা বলল, এখানে নবী দ্বারা সেই নবী উদ্দেশ্য, যাকে শরীয়ত দেওয়া হবে। অর্থাৎ শরীয়ত দেওয়া হবে- এমন নবী আর আসবে না। সুতরাং শরীয়তবিহীন নবী এখনো আসতে পারে। সে হিসাবে মির্জা সাহেবও একজন নবী। শরীয়তবিহীন নবী।

আমি বললাম, শরীয়ত দেওয়া হয় এমন নবীকে তো রাসূল বলে; কিন্তু হুযুর সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে আমিই শেষ নবী... এ হাদীসে নবী শব্দটা স্পষ্ট করে বলেছেন। সুতরাং বোঝা যায়, রাসূল তো দূরের কথা; তাঁর পর কোনো নবীও হবে না। আরেকটা বর্ণনা শুনুন, সহীহ বুখারীতে এসেছে-

আমার ও পরবর্তী নবীদের উদাহরণ হল এমন ব্যক্তির মতো, যে অত্যন্ত চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করল। তবে প্রাসাদের এক কোণায় একটি ইট পরিমাণ জায়গা খালি রেখে দিল। মানুষ এসে প্রাসাদ দেখতে লাগল এবং (তার সৌন্দর্য দেখে) মুগ্ধ হতে লাগল। আর বলতে লাগল, কেন এই ইটের খালি স্থানটি পূর্ণ করা হয়নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৮৬

এছাড়া কুরআন কারীমেও এসেছে-

وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ.

...কিন্তু সে আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের মধ্যে সর্বশেষ। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০

এসকল আয়াত ও হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সব ধরনের নবুওতের দরজা বন্ধ।

এবার সে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বলল, ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আপনার কী আকীদা?

আমি সরলভাবেই বললাম, ঈসা আলাইহিস সালাম তো আল্লাহর একজন নবী; যাঁকে আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের চক্রান্ত থেকে রক্ষার জন্য জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নেন। কিয়ামতের আগে আগে তিনি আবার দুনিয়ায় আসবেন। দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এ ঘটনাগুলো হাদীসের বর্ণনায় আছে। আর এমনটাই আমার আকীদা।

এবার মেয়েটা স্বভাবত অন্য কাদিয়ানীদের মতোই বলল, মির্জা সাহেবই ঈসা আলাইহিস সালাম।

আমি বললাম, মির্জার জন্ম তো (পশ্চিম ভারতের পশ্চিম প্রদেশের) কাদিয়ান নামক গ্রামে। সেখানেই সে বেড়ে ওঠে। তার জীবন সেখানেই অতিবাহিত হয়।

ওদিকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে অনেক হাদীসেই আছে- তিনি শাম দেশের পূর্ব দামেশক শহরের জামে মসজিদের পূর্ব মিনারে  অবতরণ করবেন।... এরপর বাবে লুদ্দ নামক জায়গায় তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং দুনিয়াতেই তাঁর মৃত্যু হবে।

তাছাড়া দাজ্জালের আলামতগুলোও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সফর করবে। অনেক ইহুদী তার সঙ্গী হবে। তার সাথে জান্নাত-জাহান্নাম থাকবে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৩৭)

এখন দেখেন, মির্জা কাদিয়ানীর মাঝে এসবের একটা আলামতও তো পাওয়া যাচ্ছে না।

মেয়েটা বলতে লাগল, ঈসা আ. যে দাজ্জালের মোকাবেলা করবে সেটা একটা সুপার পাওয়ার। আর তার এক চোখ কানা হওয়ার অর্থ হল, সে অন্ধের মতো হক উপলব্ধি করতে পারবে না।

আমি এর জবাবে বললাম, আরবী ভাষায় একটা প্রসিদ্ধ নীতি হল, যতক্ষণ পর্যন্ত শব্দ দ্বারা মূল অর্থ বোঝানো যায় ততক্ষণ এর রূপক অর্থ গ্রহণ করা যায় না। আর যদি ধরেও নিই যে, দাজ্জাল অর্থ, কোনো সুপার পাওয়ার। তাহলে মির্জা কোন্ সুপার পাওয়ারের মোকাবেলা করল? বরং সে নিজেই (নিজের ভাষ্যমতে) ইংরেজদের লাগানো চারাইংরেজ শাসনামলকে সে খোদায়ী রহমত বলে আখ্যা দিত। -মাজমুআয়ে ইশতেহারাত ২/১৯১, ১৯৮

মেয়েটা এবার কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, মির্জা সাহেব মূলত মাহদী।

ওর এমন বারবার মোড় ঘোরানো দেখে একটু আফসোসই হতে লাগল। আমি ধৈর্য সহকারে উত্তর দিয়ে গেলাম- আরে ইমাম মাহদীর ব্যাপারে তো অনেক সূত্রে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হবেন ফাতেমা রা.-এর বংশধর। তাঁর বাবার নাম হবে আবদুল্লাহ। মক্কায় তওয়াফ করা অবস্থায় মানুষ তাঁকে চিনে ফেলবে।

এদিকে মির্জা কাদিয়ানীকে দেখেন, সে মুঘল বংশের। কাদিয়ানে জন্ম। মক্কা মুকাররমা কখনো দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। কোনো ইহুদীর সঙ্গে তার কখনো মুকাবেলা হয়নি। (দ্র. কিতাবুল বারিয়্যা, রূহানী খাযায়েন ১৩/১৬২)

যাইহোক, কথা চলতে থাকল। আমি ঠান্ডা মাথায়, দরদী ভাষায় মেয়েটার সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আজ তো সঙ্গে কোনো কিতাব আনতে পারিনি। সব কথা মৌখিকই হল। সবশেষে এই সিদ্ধান্ত হল যে, আমি মেয়েটাকে ঈসা আ. ও ইমাম মাহদী আ. সম্পর্কে বলা হাদীসগুলোর সঠিক রেফারেন্স এনে দেখাব। সাথে সাথে কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটা লিফলেট- খতমে নবুওত ও বুযুর্গানে উম্মত-এর জবাব দেব। এ দুই কাজ যদি করতে পারি, তাহলে মেয়েটা কালিমা পড়ে ফিরে আসবে। আমি তার এ প্রস্তাব গ্রহণ করলাম।

রাত তখন বারোটা বাজে। আমরা ফিরে এলাম। আসার আগে মেয়ের বাবাকে বললাম, মেয়ে ফিরুক বা না ফিরুক আপনি কোনোভাবেই এই ছেলের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন না। সে সম্মতি জানাল।

পরদিন সকালে উঠেই আমি কিতাব ঘাঁটাঘাঁটিতে নেমে পড়লাম। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হলাম, হযরত হোসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.-এর কিতাব আলখালিফাতুল মাহদী ফিল আহাদীসিস সহীহাহ থেকে। যা জামিয়া মাদানিয়া লাহোরের মুখপত্র মাসিক আনওয়ারে মদীনাতে অনুবাদসহ ছেপেছিল।

আমি খুঁজে খুঁজে পত্রিকার ঐ সংখ্যাগুলো বের করলাম। ইমাম সাহেবকে দিয়ে বললাম, এই পত্রিকাগুলো ওই মেয়েটার কাছে পৌঁছাবেন। তাকে পড়তে বলবেন। এরপর আমি বাসা থেকে মাদরাসায় চলে এলাম। সেখানে আমার উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা নাঈমুদ্দীন ছাহেবের সঙ্গে পুরো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। তিনিও অনেক গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টা গ্রহণ করলেন এবং যতদূর সম্ভব আমাকে সহায়তা করলেন। আমি তাকে বললাম, আজ রাতে এশার পর মেয়েটার সঙ্গে চূড়ান্ত ফায়সালা হবে, আপনিও যদি আমাদের সঙ্গে যান খুব ভালো হবে।

প্রথমে তিনি বললেন, আমি তোমাকে প্রস্তুত করে দিচ্ছি তুমিই যাও। কিন্তু আমি বারবার তাগাদা দেওয়ায় অবশেষে তিনি রাজি হলেন।

রাতে আমরা মাদরাসার কাজ শেষ করে উস্তাযকে সোজা আমার বাসায় নিয়ে এলাম। খানা-দানা শেষ করে ইমাম সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ফের সেই লোকের বাসায়। কলিংবেল বাজাতেই তিনি দরজা খুললেন। তাকে আজ বেশ খুশি খুশি লাগছে। সে আমাদের হাতে কিতাবাদি দেখে বলল, এগুলোর মনে হয় আর প্রয়োজন হবে না। মেয়েটা আমার রাতেই সবকিছু বুঝে গিয়েছিল। সকালে আপনি আবার যে পত্রিকাগুলো পাঠালেন সেগুলো পড়ে তো একদম নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, সে এতদিন ভুল পথে ছিল। এখন তাকে একটু কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে দিন।

আমি তার বাবার এসব কথা শুনে খুব খুশি হলাম। আমরা গতকালের মতো আবারও বসলাম। ওপাশে মেয়ে তার মাকে নিয়ে বসল। এরপর উস্তাযে মুহতারাম সংক্ষেপে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় খতমে নবুওত ও কাদিয়ানিয়্যাত সংক্রান্ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেন। যার খোলাসা হল-

পরকালে নাজাত পাওয়ার একমাত্র উপায় হল, আকীদা। আকীদা সহীহ না হলে পরকালে নাজাত অসম্ভব। ফেতনায় ভরা এ যুগে সহীহ আকীদা শেখা এবং সচেতন থাকা আরো জরুরি।

এরপর তিনি কাদিয়ানীয়্যাত নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। ইলমী আলোচনা এড়িয়ে প্রথমে তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তিকে অনুসরণের আগে তার পারিপাশির্^ক অবস্থাদি সম্পর্কে জানতে হয়। তার জীবনাচার, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদি দেখতে হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখুন, তিনি দাওয়াতের শুরুতেই তার জীবনকে রেখেছেন। নবুওতপ্রাপ্তির আগ পর্যন্ত মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করত। তাঁকে আলআমীন তথা বিশ্বাসী বলে ডাকা হত। তিনি বলেছিলেন, দেখো, আমি নবুওতের জীবন শুরু করার আগে তোমাদের মাঝে লম্বা একটা সময় অতিবাহিত করেছি। [দ্র. সূরা ইউনুস (১০) : ১৬]

এভাবে হুযুর একটি সুন্দর মাপকাঠি দাঁড় করালেন। কাউকে অনুসরণ করার আগে তার জীবনাচার  দেখা। এরপর বললেন, যদিও ধরে নিই যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমনের পূর্বেই মির্জা কাদিয়ানী নবী দাবি করেছে তাহলেও এ মাপকাঠি দিয়ে মাপলে সে নবী হতে পারবে না। চলুন, এ মাপকাঠি দিয়ে মির্জা সাহেবকে একটু মাপি। দেখবেন, তার পুরো জীবনের অবস্থা এমন যে, সে একজন মুজাদ্দিদ, ঈসা, মাহদী বা নবী হওয়া তো দূরের কথা, তাকে একজন সাধারণ মুসলমানও মনে হয় না।

সে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত ছিল, মিথ্যা দাবি আর মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী করত।

সে ধোঁকা দেওয়ায় ছিল ওস্তাদ। একবার ৫০ খণ্ডের একটা কিতাব লেখার ইচ্ছা করল। যার নাম বারাহীনে আহমাদিয়্যাএজন্য সে মুসলমানদের থেকে চাঁদা তুলেছিল। এরপর মাত্র চার খণ্ড লিখে শেষ করে দিল। খরিদদাররা যখন বলল, আর লেখেন না কেন? সে আরেক খণ্ড লিখল। বলল, প্রথমে তো পঞ্চাশ খণ্ড লেখারই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এখন পাঁচ খণ্ডেই তা শেষ করছি। কেননা ৫০ আর ৫ এর মাঝে শুধু শূন্যের পার্থক্য। এজন্য পাঁচ খণ্ড দ্বারা সেই ওয়াদা পূর্ণ হয়ে যাবে। (দ্র. রূহানী খাযায়েন, খ. ২১, পৃ. ১১)

সে গালি দেওয়ায় অভ্যস্ত ছিল। বিরোধীদের তথা সাধারণ মুসলমান ও উলামায়ে কেরামকে অনেক শক্ত ভাষায় গালি দিত।

এছাড়াও সে আল্লাহ তাআলার শানে অপমানসূচক কথা বলেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবী-রাসূল এবং গত হওয়া বুযুর্গানে দ্বীনের ব্যাপারে সে অশালীন ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর শব্দ ব্যবহার করেছে।

তার আরেকটা বড় সমস্যা হল, সে প্রচুর পরিমাণে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করেছে।

এতটুকু বলে হুযুর ব্যাগ থেকে সীরাতুল মাহদী নামে একটা বই বের করলেন। লেখক মির্জা কাদিয়ানীর ছেলে মির্জা বশীর আহমদ।

সে বই থেকে হুযুর ধরে ধরে দেখিয়ে দিলেন, আসলে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী চরিত্রের বিচারে কেমন ছিল? জীবনাচার ও অন্যান্য বিষয়গুলো কত জঘন্য ছিল। যেমন- মির্জা কাদিয়ানীর হিস্ট্রিয়া বা মস্তিষ্কবিকৃতি জনিত সমস্যা ছিল। (দ্র. সীরাতুল মাহদী ১/১৫, ৩৪০)। সে সারা জীবনে একবারও হজ্ব করেনি, ইতেকাফও করেনি, কোনোদিন যাকাতও আদায় করেনি। [দ্র. সীরাতুল মাহদী, ১/৬২, ৬২৩ (নতুন সংস্করণ)]

চিন্তা করে দেখুন, এ-ই হল কাদিয়ানীদের মাহদী ও মাসীহের শান!

মির্জা সাহেবের আরেকটা বদ অভ্যাস ছিল, বেগানা মহিলাদের থেকে খেদমত নেওয়া। (দ্র. সীরাতুল মাহদী ১/৭৮৯, ৭৯০)

এ তো ছিল মির্জা সাহেবের জীবনের কিছু দিক, যা তার ছেলেই লিখেছে। মির্জা সাহেবের মৃত্যুও হয় খুবই লজ্জাজনক অবস্থায়। সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। (দ্র. সীরাতুল মাহদী ১/১১; হায়াতে নাসীর, পৃ. ১৪)

উস্তাযে মুহতারাম হযরত নাঈমুদ্দীন ছাহেব দলীল দেখিয়ে দেখিয়ে এসব তথ্যগুলো তাদের সবাইকে শুনিয়ে যাচ্ছিলেন, তারাও খুব বিস্ময়ের সাথে শুনছিল। সেইসাথে মির্জার ওপর লানত করছিল।

এরই মাঝে ওপাশ থেকে মেয়েটা বলে উঠল, এখন আমার অন্তর থেকে পুরোপুরি দ্বিধা কেটে গেছে। আমি এসব বিষয় একদমই জানতাম না। আমি আপনাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি মির্যাইয়্যাত (কাদিয়ানী ধর্ম) থেকে তওবা করলাম

এরপর উস্তাযে মুহতারাম মেয়েটাকে কালিমা পড়িয়ে দিলেন। তার থেকে ওয়াদা নিলেন, সে সামনে খতমে নবুওতের একজন মুবাল্লিগা হবে। তাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিতাব হাদিয়া দিলাম। এরপর দুআর মাধ্যমে মজলিস শেষ হল। আমরা খুশিতে তাদের বাড়ি থেকে ফিরে এলাম। মেয়ের বাবা আর ভাইয়েরা আমাদের অনেক কৃতজ্ঞতা জানাল।

এই পুরো ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হল, পিতা-মাতা যেন সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দেয়। তাদের এত বেশি স্বাধীনতা না দেয় যে, তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এমনকি দ্বীন-ঈমানও বরবাদ হয়ে যায়। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

[মাসিক আনওয়ারে মদীনা লাহোর, (জানুয়ারী ১৯৯৮) থেকে ভাষান্তর : মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ]

 

 

advertisement