যিলহজ্ব ১৪৪৫   ||   জুন ২০২৪

আত্মপ্রচার : ধ্বংস করে ঈমান ও আমল

মাওলানা ইমদাদুল হক

কিছুদিন আগে এক দস্তরখানে শরীক হয়েছিলাম। দস্তরখানে অন্যান্য মেহমানও ছিলেন। যখন আমাদের সামনে দস্তরখান পেশ করা হয় তখন মেহমানদের একজন পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেগুলোর ছবি তুলতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য, তিনি সেগুলো অন্যত্র পোস্ট করবেন। তখন আরেক মেহমান এ ভাইকে ছবি তুলতে নিষেধ করেন।

কোথাও মেহমান হলাম। মেহমানদারীতে কী কী পরিবেশন করা হল, এটি ছবিসহ অন্যদের জানানোর মানে কী?!

আসলে শুধু খাবার-দাবার নয়, স্মার্ট ফোনের কল্যাণে ইবাদাত-বন্দেগী, আমল-আখলাক, হজ্ব-ওমরা, দান-উপহার, দ্বীনী মেহনত, কোনো অনুষ্ঠানে কিছু বলা বা তাতে শরীক হওয়াসহ যাবতীয় কাজকে আমরা আত্মপ্রচারের বাহন বানিয়ে ফেলছি। হজ্বে বা ওমরায় যাচ্ছি, তো প্রথমে ইহরাম পরেই নিজের ছবি পোস্ট করে দিচ্ছি। মীনা আরাফার ছবি পোস্ট করছি। এমনকি বাইতুল্লাহ ধরে বা তার সামনে দাঁড়িয়ে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এবং পোস্ট করছি। আহ! এত হতভাগা হলাম- যে বাইতুল্লাহ সকল শিরকের মূলোৎপাটনকারী ও তাওহীদ-ইখলাসের নিদর্শন, যাকে আল্লাহ আমার ঘর বলেছেন, সেটিকে আমি নিজের প্রচারের জন্য ব্যবহার করছি!

এত বড় দুঃসাহস আমার যে, নবীজীর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযাকে আত্মপ্রচারের জন্য ব্যবহার করছি! ইহরাম এত পবিত্র ও মহিমান্বিত, যা দিয়ে আমার পাপ মোচন করে আমি নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হব, সেটিকেও আমি আত্মপ্রচারের জন্য ব্যবহার করছি!

দ্বীনী বা দুনিয়াবী বড় কোনো ব্যক্তির সাথে বসলাম, সাথে বসার একটি ছবিও তুলে নিলাম, এরপর তা পোস্ট করছি।

এক ভাই একজনের একটি পোস্ট দেখাল। একজন আরেকজনকে একটি কিতাব হাদিয়া দিয়েছেন। হাদিয়া-বাক্য লিখতে গিয়ে প্রাপকের নামের শুরুতে কিছু শ্রদ্ধা-বাক্য লিখে প্রাপকের নাম লেখেন। প্রাপক লেখাটির ছবিসহ তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে। সাথে এটাও লিখে দেন যে, হাদিয়াদাতা অধমের নামের শুরুতে কিছু লকব লাগিয়ে দেন। অধম এগুলোর যোগ্য নয়। আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের জন্য কবুল করুন। লকবের যোগ্য হই বা না হই, লেখাটির ছবি তুলে পোস্ট করার কী প্রয়োজন? সাথে আবার নিজের বিনয় বাক্যও জুড়ে দিলাম! এভাবে যে আরো কতভাবে আমরা আত্মপ্রচার করছি তার হিসেব নেই।

এটা জরুরি নয় যে, এসব ক্ষেত্রে সবারই আত্মপ্রচারের নিয়ত থাকে। কেউ হয়তো কোনো মাকসাদ ছাড়াই শুধু রেওয়াযের তালে করে। কারো হয়তো শুধু বিষয়টার ব্যাপারে নিজের লোকদেরকে অবগত করাই উদ্দেশ্য থাকে। যদিও তরীকা ভুল অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এটা তো হল অন্যের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, যা উচিতও বটে। আমার বলার উদ্দেশ্য আমরা প্রত্যেকে কি আত্মসমালোচনা করব না, নিজ নিয়তের যাচাই করব না? নিজের সন্দেহযুক্ত কাজগুলোর ভালো ব্যাখ্যা দাঁড় না করিয়ে তার মধ্যে কী খারাবি লুকিয়ে থাকতে পারে, সেদিকে নজর রাখাই তো মুমিনের কাজ।

যেসব লোক দুনিয়াবী বিষয় দিয়ে আত্মপ্রচার ও প্রসিদ্ধির নেশায় মত্ত; ফলোয়ার, ভিওয়ার বাড়ানোই নিজের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য, তারা তো ধোঁকার মধ্যেই আছে- জানা কথা। কিন্তু আমরা তো দ্বীন, ঈমান, আখেরাত বুঝি, আখেরাতকে আমাদের মাকসাদ বলি এবং সে হিসেবে দ্বীন ঈমান পালনে ব্রত হই। কিন্তু দ্বীন পালন করতে গিয়ে দ্বীন-আমল দিয়ে ফেমাস-প্রসিদ্ধি কামাই- এটা যে আমার জন্য বরবাদির কারণ- সেটি আমার বুঝে আসে না কেন?

আত্মপ্রচার একপ্রকার শিরকে খফী

আত্মপ্রচার যে কত ভয়ংকর, ধ্বংসাত্মক- মনে হয় আমরা আজ এর অনুভূতিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। বরং আত্মপ্রচার আজ আমাদের কাছে এত মোহনীয় ও চাকচিক্যময় হয়ে উঠেছে যে, এটি আজ প্রায় সবার নিকট ফ্যাশন-এ পরিণত হয়েছে। এটির মধ্যে যে খারাবী আছে- তাও আমাদের অনেকের বোধগম্য নয়। তাই যে যা দিয়ে আত্মপ্রচারের সুযোগ পাই, নির্দ্বিধায়, বরং মনের লোভ, স্বাদ ও আনন্দ নিয়ে প্রচার করছি। অথচ আত্মপ্রচার ভয়ংকর গুনাহ ও মারাত্মক ধোঁকা।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আত্মপ্রচারকে শিরক বলেছেন। আত্মপ্রচার যে কত ভয়ংকর গুনাহ তা বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ঠ যে, তা আল্লাহর জন্য না-করে আত্মপ্রচারের জন্য করা, অথবা আল্লাহর জন্য করল, সাথে আত্মপ্রচারও থাকল, তাহলে আত্মপ্রচারকে আল্লাহর সমকক্ষ ও শরীক বানিয়ে নিল। যেমন মুশরিকরা দেবদেবীকে শরীক বানায়। ইবাদত হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য; কিন্তু মুশরিকরা তাতে আল্লাহর পরিবর্তে অথবা আল্লাহর সাথে সাথে দেবদেবীকেও শরীক বানায়। তেমনিভাবে দ্বীন দ্বারা আত্মপ্রচারকারীও তার আমল দিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে অথবা আল্লাহর সাথে আত্মপ্রচারকেও শরীক বানায়।  

আল্লাহ তাআলা সূরা কাহ্ফের শেষে বলেন-

فَمَنْ كَانَ یَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْیَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا.

সুতরাং যে-কেউ নিজ রবের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ রবের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে। -সূরা কাহফ (১৮) : ১১০

রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করার কথা বললে তো সবার সামনে এ অর্থ ভেসে ওঠে যে, আল্লাহর ইবাদতে কোনো দেবদেবীকে শরীক না করা। এ অর্থ তো আপন স্থানে ঠিক আছে। কিন্তু সাহাবা তাবেয়ীন ও পরবর্তী মুফাসসিরীন কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আরো একটি শিরকের কথা বলেন। তারা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রিয়ার কথাও বলেন। ইমাম তাবারী রাহ. বলেন- 

وقوله: (وَّ لَا یُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا) يَقُوْلُ: وَلَا يَجْعَل لَهُ شَرِيْكاً فِيْ عِبَادَتِهِ إِيَّاهُ، وَإِنَّمَا يَكُوْنُ جَاعِلاً لَهُ شَرِيْكاً بِعِبَادَتِهِ إِذَا رَاءَى بِعَمَلِهِ الَّذِيْ ظَاهِرُهُ أَنَّهُ لِلهِ، وَهُوَ مُرِيْدٌ بِهِ غَيْرَهُ. وَبِنَحْوِ الَّذِيْ قُلْنَا فِيْ ذَلِكَ قَالَ أَهْلُ التَّأْوِيْلِ.

অর্থাৎ সে যেন তার ইবাদতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে। আর শরীককারী তখনই হবে, যখন সে বাহ্যত দেখাবে যে, আমল সে একমাত্র আল্লাহর জন্য করছে, অথচ তার নিয়ত ভিন্ন। -তাফসীরে তাবারী ১৫/৪৪০

তো লক্ষ করি, আল্লাহর সাথে শরীক না করার কথা বললে তো সবার মনে এটাই আসে যে, তার সাথে কোনো দেবদেবীকে শরীক না করা। কিন্তু মুফাসসিরীন এখানে রিয়ার কথাও বলছেন। উদ্দেশ্য- এটিও একপ্রকার শিরক। আল্লাহর নিকট আমল গ্রহণযোগ্য হতে হলে তা রিয়া থেকেও মুক্ত হতে হবে।

এ আয়াতের শানে নুযূলে মুফাসসিরগণ এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন, যা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি নেক কাজ করি, দান-সদকা করি, আবার এটাও চাই যে, মানুষ তা জানুক ও দেখুক। আমি জিহাদ করি, আবার এটাও চাই যে, মানুষ আমার বীরত্ব দেখুক। তখনই আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন। (দেখুন- প্রাগুক্ত)  

 নবীজী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাদেরকে এ বিষয়টি কত পরিষ্কারভাবে বুঝিয়েছেন-

مَنْ صَلَّى يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ صَامَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ تَصَدَّقَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ.

যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামায পড়ে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য রোযা রাখে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য সদকা করে, সে শিরক করল। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪০

পৃথিবীতে যত গুনাহ বা অপরাধ আছে, সবচেয়ে গুরুতর গুনাহ হল শিরক। শিরক দুই ধরনের। এক হল, প্রকাশ্য শিরক। যেমন আল্লাহর সাথে দেবদেবী বা অন্য কাউকে শরীক করা। আরেকটি হল, গুপ্ত শিরক। সেটি হল আল্লাহর সাথে নিজের আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রশংসাকে শরীক করা। উভয়টিকে হাদীসে শিরক বলা হয়েছে। অবশ্য উভয়টির বাহ্যিক বিধানাবলিতে ব্যবধান আছে।

তবে উভয়টির যে কোনোটি কোনো আমলে থাকলে আল্লাহ তার সে আমল ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। এমনকি কোনো আমলে যদি আল্লাহ্ও উদ্দেশ্য থাকে, তবে সাথেসাথে আত্মপ্রচারও, সে আমলটিও পুরোটাই আল্লাহ বাতিল করে দেবেন। এমন করবেন না যে, যতটুকু আল্লাহর জন্য করা হয়েছে ততটুকু তিনি কবুল করবেন, বাকিটা বাতিল করে দেবেন। 

একবার সাহাবী উবাদা ইবনে ছামেত রা., আবুদ দারদা রা. ও শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. শামের জাবিয়ার মসজিদে একত্র হন। অন্য লোকজনও তাদের কাছে গিয়ে বসেন। তখন সাহাবী শাদ্দাদ রা. বলেন- হে লোক সকল! আমি তোমাদের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, যে বিষয়টি সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন। অর্থাৎ গুপ্ত মনস্কামনা ও শিরক।

তখন সাহাবী আবুদ দারদা রা. ও উবাদা ইবনে ছামেত রা. বললেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেননি যে, আরব উপদ্বীপে শয়তান তার ইবাদত (শিরক) থেকে নিরাশ হয়ে গিয়েছে? (তাহলে শিরকের কী ভয় করেন?) আচ্ছা, হে শাদ্দাদ, গুপ্ত মনোবাসনা তো বুঝলাম যে, নারী ও দুনিয়ার অন্যান্য লালসা, কিন্তু সেই শিরকটি কী, যা আপনি আমাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করছেন?

তখন তিনি বললেন, আচ্ছা বল তো, যে ব্যক্তি নামায পড়ে অন্যকে দেখানোর জন্য, রোযা রাখে অন্যকে দেখানোর জন্য বা সদকা করে অন্যকে দেখানোর জন্য, সে কি শিরক করেনি?

তাঁরা বললেন, হাঁ, আল্লাহ তাআলার শপথ! সে শিরক করেছে। তখন শাদ্দাদ রা. বলেন, আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি-

مَنْ صَلَّى يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ صَامَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ تَصَدَّقَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ.

যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামায পড়ে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য রোযা রাখে, সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য সদকা করে, সে শিরক করল।

তখন আউফ ইবনে মালিক রা. জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, আল্লাহ তাআলা কি এমন করবেন না, আমলটির মধ্যে যতটুকু আল্লাহর জন্য ছিল ততটুকু কবুল  করবেন আর যতটুকুতে শিরক করা হয়েছে ততটুকু বাদ দিয়ে দেবেন? তখন শাদ্দাদ বলেন- না, আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

مَنْ أَشْرَكَ بِيْ شَيْئًا فَإِنَّ حَشْدَهٗ عَمَلَهُ قَلِيْلَهُ وَكَثِيْرَهُ لِشَرِيْكِهِ الَّذِيْ أَشْرَكَ بِهِ وَأَنَا عَنْهُ غَنِيٌّ.

কেউ যদি কোনো আমলে আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করে, তাহলে তার আমল কম-বেশি পুরোটাই তার সে শরীকের জন্য, যার জন্য সে শরীক করেছে। আর আমি তার থেকে অমুখাপেক্ষী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪০

قال الهيثمي رحمه الله في مجمع الزوائد ১০/২২০ : وفيه شهر بن حوشب، وثقه أحمد وغيره، وضعفه غير واحد، وبقية رجاله ثقات

এ হাদীসটি পড়ি এবং নিজেদের সাথে মেলাই, আর চিন্তা করি, না জানি কত শিরকে আমি লিপ্ত আর আমার আমল কয়টাই টিকবে?

আত্মপ্রচার দাজ্জাল থেকেও ভয়ংকর ফেতনা

সাহাবী মাহমুদ বিন লাবীদ রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় করি শিরকে আসগরকে  (ছোট শিরক)। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, শিরকে আসগর কী, ইয়া রাসূলুল্লাহ

নবীজী ইরশাদ করেন, রিয়া। আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন যখন মানুষের আমলের প্রতিদান দেবেন তখন তাদেরকে বলবেন, তোমরা দুনিয়াতে যাদেরকে দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কি না? -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৬২৯।

একদিন কয়েকজন সাহাবী নিম্ন আওয়াজে পরস্পরে কথা বলছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে বললেন, তোমাদেরকে তো পরস্পর কানাঘুষা করতে নিষেধ করা হয়েছে?

তারা বললেন- হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তওবা করছি। আমরা তো দাজ্জাল নিয়ে কথা বলছি। তার বিষয়ে খুব ভয় পাচ্ছি।

তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هو أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ مِنَ الْمَسِيحِ عِنْدِي؟ قُلْنَا : بَلَى

তোমাদের ব্যাপারে আমি দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয়টি বেশি ভয় করি- তা কি বলব না?

তারা বললেন, অবশ্যই বলুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!

তখন তিনি বললেন-

الشِّرْكُ الْخَفِيُّ، أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يعْمَلُ لِمَكَانِ رجُل .

তা হল গুপ্ত শিরক। মানুষ আমল করবে অন্যকে দেখানো বা তার থেকে সম্মান পাওয়ার জন্য। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১২৫২

(إسناده ضعيف لربيح بن عبد الرحمن وكثير بن زيد، وبقية رجاله ثقات رجال الصحيح)

লক্ষ করি, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুপ্ত শিরককে কেন দাজ্জাল থেকে বেশি ভয়ংকর মনে করেন? দাজ্জাল বিশেষ একটি সৃষ্টি, নির্দিষ্ট সময় আসবে। সে পৃথিবীতে দেড় বছরও থাকবে না। এ সময় যারা পৃথিবীতে থাকবে, তারাই শুধু তার ফেতনার সম্মুখীন হবে। তাও আবার সে সময়ের সব মানুষ নয়। কিন্তু গুপ্ত শিরক তথা রিয়া ও প্রসিদ্ধি কামনা তো যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো মুমিনের অন্তরে ঢুকে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে দাজ্জাল থেকেও বেশি ভয়ংকর বলেছেন।

সাহাবী মাহমুদ ইবনে লাবীদ থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ، قَالُوْا وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ؟ قَالَ: أَنْ يَقُوْمَ أَحَدُكُمْ يُزَيِّنُ صَلَاتَهُ جَاهِدًا لِيَنْظُرَ النَّاسُ إِلَيْهِ، فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَاِئِر.

তোমরা গুপ্ত শিরক থেকে খুব ভয় কর।

সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! গুপ্ত শিরক কী?

নবীজী বলেন, সেটি হল, তোমাদের কেউ সুন্দর করে নামায পড়ে, আর চায় মানুষ যেন তা দেখে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৪৮৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৯৩৭

সর্বপ্রথম জাহান্নামের আগুন জ্বালানো হবে আত্মপ্রচারকারীদের দ্বারা

আত্মপ্রসিদ্ধি অন্বেষী আলেম, শহীদ ও দানবীরের হাদীস তো আমরা অনেকেই জানি। তবে হাদীসটি জামে তিরমিযী ও অন্যান্য কিতাবে যে আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে সেটি জানলে হৃদয়ে আরো বেশি রেখাপাত করবে।

শামের শুফাই ইবনে মাতি একদিন মদীনায় এলেন। মদীনার মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখেন, একজনকে ঘিরে অনেক লোক সমবেত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে এই লোক?

লোকেরা বলল, তিনি আবু হুরায়রা।

সুফাই বলেন, আমি তাঁর নিকটবর্তী হলাম। এমনকি তাঁর সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি লোকদেরকে হাদীস শোনাচ্ছেন। যখন হাদীস শোনানো শেষ হল এবং সবাই চলে গেল, তিনি একাকী হলেন। আমি তখন বললাম, আমি আপনার কাছে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করছি, আপনি আমাকে একটি হাদীস শোনান, যা আপনি ভালোভাবে শিখেছেন এবং বুঝেছেন।

আবু হুরায়রা রা. বললেন- হাঁ শোনাব। আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাব, যা আমি ভালোভাবে শিখেছি এবং বুঝেছি। এই বলে তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আমরা এভাবে কাটালাম। এরপর তার হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি বললেন, অবশ্যই আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস শোনাব, যা নবীজী এই মসজিদে আমাকে শুনিয়েছেন। তখন তিনি আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই বলে তিনি আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে তিনি তাঁর চেহারা মুছে নিলেন এবং বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন হাদীস শোনাব, যা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এই মসজিদে শুনিয়েছেন। তখন আমরা দুজন ছাড়া মসজিদে আর কেউ ছিল না। এই বলে তিনি আবার বেহুঁশ হয়ে যান এবং উপুড় হয়ে পড়ে যান। আমি তাঁকে দীর্ঘ সময় হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখি। এরপর তাঁর হুঁশ ফেরে। এরপর তিনি বলেন, নবীজী আমাকে বলেছেন-

যেদিন কেয়ামত হবে এবং আল্লাহ তাআলা বান্দাদের মাঝে ফয়সালার জন্য অবতরণ করবেন তখন প্রত্যেক উম্মত হাঁটু গেড়ে অবনত হয়ে থাকবে। এ সময় সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ডাকবেন, তারা হল একজন আলেম, একজন শহীদ ও একজন ধনী। তখন আল্লাহ তাআলা কুরআনের আলেমকে বলবেন, আমি কি তোমাকে আমার রাসূলের ওপর যা নাযিল করেছি তা শেখাইনি?

আলেম বলবে- অবশ্যই, হে আমার রব।

আল্লাহ তাআলা বলবেন, তাহলে তুমি কী আমল করেছ?

সে বলবে, আমি দিন-রাত সবসময় কুরআন কারীম পড়তাম, তা দিয়ে নামায পড়তাম, তার উপর আমল করতাম।

তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আর ফেরেশতাগণও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি চেয়েছ- যেন তোমাকে বিরাট আলেম বলা হয়; আর তা বলাও হয়েছে।

এরপর ধনীকে আনা হবে। তাকে আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমি কি তোমার ওপর দুনিয়া এত প্রশস্ত করে দেইনি যে, তোমাকে কারো মুখাপেক্ষী হতে হয়নি?

সে বলবে- হাঁ, অবশ্যই, হে আমার রব!

আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমি যা দান করেছি তাতে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি আত্মীয়তার হক আদায় করতাম এবং দান-সদাকা করতাম। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। ফেরেশতাগণও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি চেয়েছ- তোমাকে যেন দানবীর বলা হয়; আর তা বলা হয়েছেও।

এরপর আল্লাহর রাস্তার শহীদকে আনা হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন, তুমি কী উদ্দেশ্যে শহীদ হয়েছ?

সে বলবে, আপনি আপনার রাস্তায় জিহাদ করতে বলেছেনতাই আমি লড়াই করেছি এবং শহীদ হয়েছি।

আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। ফেরেশতাগণও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি চেয়েছ- যেন তোমাকে বীর ও সাহসী বলা হয়; আর তা বলা হয়েছেও।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাঁটুতে চাপ দিয়ে বলেন-

يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، أُولَئِكَ الثَّلَاثَةُ أَوَّلُ خَلْقِ اللهِ تُسَعَّرُ بِهِمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

হে আবু হুরায়রা! এই তিনজনই আল্লাহ্ তাআলার প্রথম মাখলুক, যাদের দিয়ে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৮১

এরপর সুফাই শামে ফিরে আসেন এবং হযরত মুআবিয়া রা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হাদীসটি শোনান। তখন মুআবিয়া রা. বলেন, যদি এদের সঙ্গে এমন করা হয়, তাহলে অন্য মানুষদের অবস্থা কী হবে! এরপর তিনি এমনভাবে কাঁদেন যে, বর্ণনাকারী বলেন, আমরা ভেবেছি তিনি মারা যাবেন। আমরা বলতে লাগলাম, এই লোক (সুফাই) খারাপ কিছু নিয়ে এসেছে। এরপর মুআবিয়া রা.-এর হুঁশ ফিরে আসে। তিনি তাঁর চেহারা মুছে নেন। এরপর বলেন, আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন-

مَنْ كَانَ یُرِیْدُ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا وَ زِیْنَتَهَا نُوَفِّ اِلَیْهِمْ اَعْمَالَهُمْ فِیْهَا وَ هُمْ فِیْهَا لَا یُبْخَسُوْنَ،اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ لَیْسَ لَهُمْ فِی الْاٰخِرَةِ اِلَّا النَّارُ وَ حَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِیْهَا وَ بٰطِلٌ مَّا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুনিয়ার ভোগ-সামগ্রী ও চাকচিক্য চায়, তার জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তাদের কৃত আমল সব বাতিল হয়ে যাবে। -সূরা হুদ (১১) : ১৫

(অর্থাৎ মানুষের প্রশংসাপ্রত্যাশীরা যেহেতু দুনিয়ার চাকচিক্যই চেয়েছে, তাই আখেরাতে তাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই থাকবে না এবং তাদের সব আমল বাতিল হয়ে যাবে।)

এরপর হযরত মুআবিয়া রা. জাহান্নাম থেকে পানাহ চেয়ে এই আয়াত তিলাওয়াত করেন-

اَنَّمَاۤ اِلٰهُكُمْ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَمَنْ كَانَ یَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْیَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا.

[নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাতের আশা করে, সে যেন নেক আমল করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। সূরা কাহ্ফ (১৮) : ১১০] -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৮২

অর্থাৎ ইলাহ যেহেতু একজনই, তাই আমল দ্বারা তিনিই উদ্দেশ্য হতে হবে। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করা যাবে না। শরীক করা মানে হল, তাকেও ইলাহ বানানো। রিয়া বা আত্মপ্রসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দ্বীনের কাজ করা মানে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শরীক করা। তাই সাহাবী মুআবিয়া রা. এ আয়াতটি পড়েন। এ আয়াতকে তো আমরা সাধারণত মুশরিকদের ক্ষেত্রে বলে থাকি। কিন্তু হযরত মুআবিয়া রা. এ আয়াতকে আত্মপ্রচারকারীদের ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগ করেন। এ থেকে তো বোঝা যায়, আত্মপ্রচার গুপ্ত শিরক হওয়া সাহাবীদের নিকট কত পরিষ্কার ছিল।

আজ আমরা একে শিরক তো মনেই করি না, এমনকি ন্যূনতম গুনাহও মনে করি কিনা সন্দেহ! তাই আজ আমরা সকলেই এ ধরনের আত্মপ্রচারের যা-ই পাই, তা দিয়ে আত্মপ্রচারে ভেসে যাচ্ছি এবং কে কার চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও ভাইরাল হতে পারি- এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকি।

হাদীসটি নিয়ে আরেকটুু চিন্তা করি, আবু হুরায়রা রা. তিন তিনবার কেন বেহুঁশ হয়ে গেলেন? মুআবিয়া রা. কেন এত কাঁদলেন?

আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, তিনি এই হাদীস ভালোভাবে শিখেছেন এবং বুঝেছেন। তো তিনি কী বুঝেছেন? তরজমা বুঝেছেন? হাদীসটি কত সূত্রে বর্ণিত তা সংকলন করেছেন? আমরাও তো বলি, আমরা হাদীসটি ভালোভাবে শিখেছি এবং বুঝেছি। তাহলে তিনি তিনবার বেহুঁশ হলেন আর আমরা বেহুঁশ হই না- কেন?

আসলে তিনি হাদীসটি অন্তর দিয়ে বুঝে তার শিক্ষা অন্তরে গেঁথে নিয়েছেন। তাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। আর আমরা হাদীসটিকে একটি আরবী ইবারত মনে করে অনুবাদ করে মেধা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। তাই হাদীসটি আমার স্মৃতিতে রয়ে যায়, অন্তরে যায় না। তাই বেহুঁশ তো পরের কথা, ভয়ও সঞ্চার হয় না।

এই হাদীস থেকে আরো একটি বিষয় বোঝা যায়কেউ যদি প্রসিদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো দ্বীনী কাজ করে, তাহলে সে প্রসিদ্ধ ও ভাইরাল হয়েও যেতে পারে। কেননা, হাদীসে তিনজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে-

وَقَدْ قِيْلَ لَكَ.

অর্থাৎ তুমি যে প্রচার-প্রসিদ্ধি চেয়েছ, তা হয়েছে। 

আরবের প্রসিদ্ধ দানশীল হাতেম তায়ী-এর পুত্র আদী ইবনে হাতেম রা. মুসলমান হওয়ার পর একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, আমার আব্বার কী অবস্থা? (অর্থাৎ তার যে দানশীলতা, তা দ্বারা তিনি আখেরাতে উপকৃত হবেন কি না?)

নবীজী উত্তরে বলেন, তোমার পিতা একটি জিনিস চেয়েছিল এবং তা পেয়েছে। (আখেরাতে সেগুলো তার কোনো উপকার করবে না।) -মুসনাদে আহমাদ ৪/২৫৮, হাদীস ১৮২৬২

অর্থাৎ রাবী বলেছেন যে হাতেম তায়ী আত্মপ্রসিদ্ধি চেয়েছে, আর সে প্রসিদ্ধ হয়েছেও।

আরো একটু চিন্তা করা দরকার, আমার প্রসিদ্ধি কি হাতেম তায়ীর মতো এত স্থায়ী ও বিস্তৃত হবে, নাকি আমাকে শুধু আমার দেশের কিছু লোক বা অন্যান্য দেশের কিছু লোক চিনবে, আর এই প্রসিদ্ধির মেয়াদ হয়তো দশ বছর বিশ বছর বা সর্বোচ্চ পঞ্চাশ বছর। তো হাতেম তায়ীর সামনে তো আমি কিছুই না।

হায়! আল্লাহ তাআলা আমাকে ঈমান, আমল দান করেছেন, সাহাবী, তাবেয়ী, আসলাফ-আকাবিরের পথে উঠিয়েছেন। আর আমি তা থেকে বিচ্যুত হয়ে হাতেম তায়ীর পথ ধরছি এবং তার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছি! আরো ভয়ংকর হল, আমি এতে খুবই আনন্দিত ও উৎফুল্ল হচ্ছি!

এক্ষেত্রে আরো বোঝা দরকার, এধরনের প্রসিদ্ধ হওয়ার অর্থ আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হওয়া নয়। এমন মনে করা চরম ভুল। তাহলে তো হাতেম তায়ী সবচেয়ে বেশি মাকবূল ও প্রিয়পাত্র হবে। বরং এধরনের ব্যক্তি নিজের প্রসিদ্ধি দেখে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হয়ে কখনো এই কাজ থেকে ফিরে আসার ও তওবা করার চেষ্টাও করবে না। তখন-

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِیْنَ اَعْمَالًا،اَلَّذِیْنَ ضَلَّ سَعْیُهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ یُحْسِنُوْنَ صُنْعًا.

-এই আয়াতের আওতায় পড়ে যাবে। (সূরা কাহফ ১০২-১০৪) আয়াতটির অর্থ এই-

[বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেই সব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত দৌড়-ঝাঁপ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, অথচ তারা মনে করে তারা খুবই ভালো কাজ করছে।]

এক হাদীসে এসেছে-

مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلَا فِيْ غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِيْنِهِ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সম্পদের লোভ ও মর্যাদার লোভ, একজন মুমিনের দ্বীনকে যেভাবে ধ্বংস করে, দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়েও একটি বকরির পালকে তত ধ্বংস করতে পারে না। -মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৫৬ (হাদীস ১৫৭৮৪)

দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে যদি একটি বকরির পালে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে পুরো পালকে যে শেষ করে দেবে- জানা কথা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সম্পদের লোভ ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনকে এর চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে।

আহ! নেকড়ে থেকে পালানোর জন্য মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিন্তু আমরা নেকড়েকে কোলে তুলে নিচ্ছি এবং মনের ভেতর পুষছি। তাই যা হওয়ার হচ্ছে; আমার প্রায় সব আমলই বিনষ্ট ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।

আত্মপ্রচার কেবলই ধোঁকা

দুনিয়াটা হল ধোঁকার বস্তু। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে একাধিকবার দুনিয়াকে ধোঁকার বস্তু বলেছেন। আল্লাহ তাআলার দেওয়া শক্তি-সামর্থ্য, সময় দুনিয়া অর্জনের পেছনে নিঃশেষ করে খালি হাতে মৃতের খটিয়ায় ওঠা কত বড় ধোঁকার জীবন, তা তো বলার প্রয়োজন নেই।

দুনিয়ার ধোঁকার আরেক বস্তু হল আত্মপ্রচারের নেশা। যে আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে পেতাম, যে আমল দ্বারা জান্নাত পেতাম, সে আমল দ্বারা আল্লাহ ও জান্নাত না নিয়ে মানুষের প্রশংসা নিলাম; এর চেয়ে অজ্ঞতা ও ধোঁকার বিষয় কী হতে পারে? আর এজন্য বরাদ্দকৃত শাস্তি তো আছেই।

আচ্ছা, আমাকে যদি পৃথিবীর সকল মানুষ চেনে, তাতে আমার কী লাভ হল? তাতে কি আমার সকল পেরেশানী দূর হয়ে যাবে? শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে? আমি দুনিয়া-আখেরাতে সফল হয়ে যাব? একটু চিন্তা করি, যা পোস্ট করার কারণে আমি ফেমাস হয়ে গেলাম, সেটি পোস্ট করার আগের দিন আমি যে মানুষটি ছিলাম, পরের দিনও তো সে মানুষটিই আছি। আমার নিজের মধ্যে কী পরিবর্তন এসে গেল? হাঁ, শুধু এতুটুকু হল যে, এখন আমাকে বা আমার কাজটি মানুষ জানছে। আল্লাহ ও জান্নাত বাদ দিয়ে মানুষের কমেন্ট নিচ্ছি, এতে নিজের মহামূল্যবান সম্পদ জান্নাত নিজেই নষ্ট করছি, বদলায় নিচ্ছি মানুষের সাময়িক প্রশংসা, যার দু-পয়সাও মূল্য নেই।

একদিন গ্রামের এক সহজ-সরল লোক খুব চমৎকার বললেন। তিনি বললেন, ভাই, মানুষ আমাকে চিনলে আমার কী ফায়দা হবে? এর দ্বারা কি দুই টাকার মরিচও কিনতে পারব?

খোদ হাতেম তায়ীর কথাই চিন্তা করি, নিজের এত সহায়-সম্পত্তি নিজে না রেখে, সন্তান-সন্ততির জন্য না রেখে আত্মপ্রসিদ্ধি ও মানুষের প্রশংসার জন্য নিঃশেষ করেছে, কিন্তু তার সে জগৎজোড়া প্রসিদ্ধি তার ও তার পরিবারের দু-পয়সার কাজে আসছে? আমরা তার নামে প্রবাদ তৈরি করছি, আর সে জাহান্নামে জ্বলে জ্বলে মরছে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. তাঁর কিতাবুয-যুহ্দ-এ সালেহ ইবনে খালিদ হতে বর্ণনা করেন-

إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَعْمَلَ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَيْرِ فَأَنْزِلِ النَّاسَ بِمَنْزِلَةِ الْبَقَرِ إِلَّا أَنَّكَ لَا تَحْقِرْهُمْ.

যখন তুমি কোনো নেককাজ করার ইচ্ছা কর, তখন মানুষকে গরুর স্তরে রাখবে। বাকি তাদেরকে তুচ্ছ ভাববে না। -কিতাবুয যুহ্দ, ইমাম আহমাদ ৩/৩১৯

অর্থাৎ মানুষ কি কোনো নেককাজ করতে গিয়ে গরুর প্রতি লক্ষ রেখে করে যে, গরু আমাকে দেখছে, কি দেখছে না? গরু থাকে গরুর জায়গায় আর মানুষ থাকে মানুষের জায়গায়। মানুষ আপন গতিতে তার কাজ করে যায়। তেমনিভাবে মানুষ কি গরু-ছাগলের প্রশংসা কুড়ানোর কথা কোনোদিন চিন্তা করে! সারা পৃথিবীর সব গরু মিলে যদি কারো প্রশংসা করে, এতে কি সে কোনো ধরনের আনন্দ অনুভব করবে, নাকি নিজের জন্য এটা লজ্জাজনক মনে করবে?

ঠিক তেমনিভাবে কোনো নেক কাজ করতে গিয়ে এ কৌশল অবলম্বন করলে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর কোনো চিন্তাই আসবে না।

সালেহ ইবনে খালেদ-এর বক্তব্যে আত্মপ্রসিদ্ধির হাকীকত ও বাস্তবতা যেমন ফুটে উঠেছে, সাথে সাথে তার থেকে বাঁচার উপায়ও বের হয়েছে। অর্থাৎ কোনো নেক আমল করতে গেলে মানুষের প্রশংসাকে এমন প্রাণীর প্রশংসা মনে করলে আর আত্মপ্রসিদ্ধির কামনা আসবে না- ইনশাআল্লাহ। 

 

 

advertisement