যিলহজ্ব ১৪৪৫   ||   জুন ২০২৪

জুমাপূর্ব বয়ান
‖ আমানত ও খেয়ানত

হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী

الْحَمْدُ لِلهِ، الْحَمْدُ لِله نحمده ونستعينه، ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلله فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لاشريك له، وأشهد أن سيدنا ومولانا محمدا عبده ورسوله، صلى الله تعالى عليه وعلى آله وأصحابه وأزواجه وأهل بيته أجمعين.

أما بعد، فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم.

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللهَ وَ الرَّسُوْلَ وَ تَخُوْنُوْۤا اَمٰنٰتِكُمْ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ،   وَّ اَنَّ اللهَ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِیْمٌ.

وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِه فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ، إِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ.

আমি আপনাদের সামনে কুরআন কারীমে বর্ণিত সূরা আনফালের একটি আয়াত তিলাওয়াত করেছি। পুরো কুরআন কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোথাও আদেশ করেছেন, কোথাও নিষেধ করেছেন। কোথাও পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনা বর্ণনা করেছেন, কোথাও ভবিষ্যতের কোনো সংবাদ দিয়েছেন; নিকটবর্তী ভবিষ্যত বা দূরবর্তী ভবিষ্যত। এ জগতের পরের জগতের কোনো সংবাদ বা কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ের কোনো সংবাদ আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন।

উদ্দেশ্য শুধু ঘটনা বর্ণনা করা নয় বা কেবল ভবিষ্যতের সংবাদ দেওয়া নয়; বরং উদ্দেশ্য হল, এগুলো দ্বারা মানুষ যেন উপদেশ গ্রহণ করে, আপন আপন যিন্দেগী দুরস্ত করে, জীবন পরিশুদ্ধ করে। পেছনের ঘটনা শুনে নসীহত হাসিল করে।

তো যে আয়াত তিলাওয়াত করা হল, এখানে আল্লাহ তাআলা একটি বিষয় নিষেধ করেছেন। কাকে করেছেন? আল্লাহ বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا.

দুনিয়ার সকল মানুষকে নয়, বরং তাঁর ঈমানওয়ালা বান্দা যারা, বিশেষ করে তাদেরকে একটা কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। তার বিপরীত কাজ সম্পর্কে আরেক জায়গায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদেশ করেছেন। এখানে বর্জনীয় বিষয়টি উল্লেখ করে তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আরেক জায়গায় করণীয় উল্লেখ করে তা করার আদেশ করেছেন। আদেশটা কী?

اِنَّ اللهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهْلِهَا،  وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ.

(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মাঝে বিচার করবে, ইনসাফের সাথে বিচার করবে। -সূরা নিসা (০৪) : ৫৮

আল্লাহ একটি করণীয় বিষয়ে আদেশ দিচ্ছেন- তোমরা আমানত যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দাও। আমানত রক্ষা কর। পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ কর।

আর অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরেকটি বিষয় থেকে নিষেধ করছেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللهَ وَ الرَّسُوْلَ وَ تَخُوْنُوْۤا اَمٰنٰتِكُمْ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ،   وَّ اَنَّ اللهَ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِیْمٌ.

হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনে-শুনে তোমাদের আমানতের খেয়ানত করো না। জেনে রেখ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা এবং (জেনে রাখ যে,) আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান। -সূরা আনফাল (০৮) : ২৭-২৮

আমার ঈমানদার বান্দারা! তোমরা আল্লাহর আমানত, রাসূলের আমানত ও পরস্পরের আমানতের মধ্যে খেয়ানত করবে না।

এ আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা তিন প্রকার আমানতের কথা বললেন। বললেন যে, এ তিন প্রকার আমানতে তোমরা খেয়ানত করো না :

ক. আল্লাহর আমানত।

খ. রাসূলের আমানত।

গ. পরস্পরের আমানত।

এগুলোতে খেয়ানত করবে না।

আমানতের খেয়ানত যারা করে, সাধারণত জেনেশুনেই খেয়ানত করে।  এজন্য আল্লাহ সঙ্গেসঙ্গে বলছেন-

وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.

সাবধান, জেনে বুঝে আমানতের খেয়ানত তুমি করো না। যদি অজান্তে হয়ে যায়, সেটা অন্য কথা। আল্লাহর আমানত, রাসূলের আমানত, তোমাদের পরস্পরের আমানত। জেনেশুনে খেয়ানত কর না।

খেয়ানতের বড় কারণ

মানুষ আমানতের খেয়ানত করে- ধন সম্পদের মায়ায়, সন্তান-সন্ততির মায়ায়। এজন্য আল্লাহ তাআলা সঙ্গে সঙ্গে বলছেন-

وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ.

এই যে ধন-সম্পদ আর সন্তান-সন্ততির মায়ায় পড়ে তোমরা আমানতের খেয়ানত করছ, জেনে নাও, ভালো করে জেনে নাও- এই সম্পদ ও সন্তান কী জিনিস? এই ধন-সম্পদের মোহে, সন্তান-সন্ততির মায়ায়, পরিবার-পরিজনের মহব্বতে পড়ে তুমি যে খেয়ানত করছ, আমানত নষ্ট করছ, এই সম্পদ আর সন্তান হল ফিতনা -পরীক্ষার বস্তু।

ফিতনা শব্দের তিন অর্থ

ফিতনা আরবী শব্দ। যার তিনটা অর্থ :

এক. পরীক্ষা।

দুই. আযাব ও শাস্তি।

তিন. আযাব ও শাস্তির কারণ।

পুরো কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ফিতনা শব্দ এ তিন অর্থের কোনো  একটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে তিনটি অর্থই হতে পারে।

সম্পদ ও সন্তান আল্লাহর পরীক্ষা

যদিও সম্পদ ও সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত, নিঃসন্দেহে অনেক বড় নিআমত। কিন্তু কেমন নিআমত? আল্লাহ বলেন, এই নিআমতও কখনো কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার বিষয় হয়। আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ দিলেন, সন্তান-সন্ততি দিলেন- এটাই মানুষের জন্য পরীক্ষার বিষয়। এই হল এক অর্থ।

সম্পদ ও সন্তান কখনো শাস্তি

ফিতনা শব্দের আরেক অর্থ শাস্তি। এই সম্পদ ও সন্তানই কখনো কারো জন্য শাস্তি হয়ে যায়। গলার বেড়ি হয়ে যায়, পায়ের জিঞ্জির হয়ে যায়। সন্তান যদি অসৎ হয়, অশান্তির কারণ হয়। তার দুর্র্বৃত্তপনায় মা-বাবা অতিষ্ট হয়ে যান। সন্তানের কারণে বাবার জীবন বিপন্ন হয়। বাবা ছেলেকে আর সহ্য করতে পারে না। ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে। আর সম্পদের কারণে তো জীবনও চলে যায়। এভাবে সম্পদ ও সন্তান মানুষের জন্য আযাব হয়ে যায়।

সন্তান ও সম্পদ ছিল নিআমত, কিন্তু কখনো কখনো এ নিআমতই আযাবে পরিণত হয়।

সম্পদ ও সন্তান কখনো শাস্তির কারণ

সম্পদ ও সন্তান কখনো কখনো শাস্তির কারণ হয়ে যায়। এই সন্তানের কারণে বাবার অনেক সাজা ভোগ করতে হয়। মালের কারণে মালওয়ালাকে অনেক শাস্তি ভোগ করতে হয়। কারো দুনিয়াতেই, কারো দুনিয়াতে না হলে আখেরাতে। যেমন, যারা মালের যাকাত আদায় না করবে, আল্লাহ বলেছেন-

وَ الَّذِیْنَ یَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَ الْفِضَّةَ وَ لَا یُنْفِقُوْنَهَا فِیْ سَبِیْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِیْمٍ، یَّوْمَ یُحْمٰی عَلَیْهَا فِیْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوٰی بِهَا جِبَاهُهُمْ وَ جُنُوْبُهُمْ وَ ظُهُوْرُهُمْ هٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ.

যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, তাদের পাঁজর ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে (এবং বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তার মজা ভোগ কর। -সূরা তাওবা (০৯) : ৩৪-৩৫

আল্লাহ বলেন, যারা স্বর্ণ ও রুপা সঞ্চয় করে রাখবে, সম্পদের যাকাত না দেবে, এ সম্পদ তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কারণ হবে। তা কীভাবে? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ দিয়েছেন-

এ সম্পদগুলো মারাত্মক বিষধর সাপে পরিণত হবে, হাশরের  ময়দানে তাদের পিছে পিছে ধাওয়া করতে থাকবে আর বলতে থাকবে, আমিই তোমার মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। যদিও আমাকে তুমি সাপ হিসেবে দেখছ, আমি সাপ নই, তোমার সম্পদ সাপে রূপান্তরিত হয়েছে, আমি তোমার কষ্টার্জিত সম্পদ! মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছ, রক্ত পানি করেছ আমার জন্য, হালাল-হারামের পরোয়া করনি, যাকাত দাওনি- আমিই তোমার সেই মাল।

বুখারী শরীফের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এক সাপ হা করে তাকে ধাওয়া করতে থাকবে, অবশেষে অপারগ হয়ে তার হাত সেই সাপের মুখের মধ্যে দিয়ে দেবে।

সাপটা কেমন? সে সাপের বর্ণনা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে দিয়েছেন-

مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَه مُثِّلَ لَه مَالُه يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَه زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ -يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ- ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمَّ تَلاَ: وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ الآيَة.

যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে সম্পদের যাকাত আদায় করল না, কিয়ামতের দিন এ সম্পদ দুই বিষদাঁত বিশিষ্ট এক বিষধর সাপে পরিণত হবে, যা তার গলা পেঁচিয়ে ধরে দুই চোয়ালে ছোবল হানতে থাকবে আর বলতে থাকবে, আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চয়...। -সহীহ বুখারী, হাদীস  ১৪০৩

সাপ যখন অতি বিষাক্ত হয়ে যায়, তার মাথার পশম পড়ে যায়। এই সাপের মাথার পশম পড়ে যাবে।

তো দুনিয়াতেও ধন-সম্পদ কারো কারো জন্য আযাবের কারণ হয়ে যায়। কারো কারো জন্য আখেরাতে।

আল্লাহ বলেন, কীসের মায়ায়, কীসের মোহে পড়ে এই আমানতের খেয়ানত তুমি করছ বান্দা!

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا.

ও ঈমানওয়ালারা! কালেমা যারা পড়েছ! আমার কাছে আসতে হবে এ বিশ্বাস যারা করেছ!...

আমানতের খেয়ানত যদি তুমি না কর, জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে তোমার জন্য তোমার রবের কাছে বিরাট পুরস্কার রয়েছে। বিরাট বড় প্রতিদান রয়েছে। আমানত যদি তুমি রক্ষা কর, তো তোমার জন্য আমার কাছে আছে বিরাট বড় পুরষ্কার।

আমানত মুসলিমের বৈশিষ্ট্য

মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য আমানত। ঈমানের বৈশিষ্ট্য ছিল আমানত। মুসলমান আমানতের মধ্যে খেয়ানত করতে পারে না। এ আমানতের বোঝা তো আমরা নিজেরাই কাঁধে তুলে নিয়েছি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّا عَرَضْنَا الْاَمَانَةَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ الْجِبَالِ فَاَبَیْنَ اَنْ یَّحْمِلْنَهَا وَ اَشْفَقْنَ مِنْهَا وَ حَمَلَهَا الْاِنْسَانُ اِنَّهٗ كَانَ ظَلُوْمًا جَهُوْلًا.

আমি এ আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতের সামনে। তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শঙ্কিত হল। আর তা বহন করে নিল মানুষ। বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ। -সূরা আহযাব (৩০) : ৭২

আসমানের সাহস নেই, যমীনের সাহস নেই, পাহাড় পর্বতের সাহস নেই আমার আমানতের বোঝা বহন করার। আল্লাহ বলেন, ইনসান! তোমরাই তো নিয়েছ আগে বেড়ে এ আমানতের বোঝা। আল্লাহ! আমরা রক্ষা করব আমানত।

اِنَّهٗ كَانَ ظَلُوْمًا جَهُوْلًا.

বড় ছেলে ও মেজো ছেলেকে বাবার একটা বোঝা নেওয়ার জন্য বলা হল। রাজি হল না। ছোট্ট ছেলে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে আগে বেড়ে বলল, বাবাজান! এ বোঝা আমাকে দিন, আমি নেব মাথায়। বাবার কত মায়া কত সোহাগ সেই ছেলে পাবে!

এজন্যই ইনসান আশরাফুল মাখলুকাত। এই মানুষের জন্যই সবকিছু। আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত সব মানুষের জন্যই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমানত হল ঈমানের বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে ঈমান আছে, সে আমানতের খেয়ানত করতে পারে না।

لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَه.

যার মধ্যে আমানত নেই, তার ঈমান নেই। -শুআবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদীস ৪০৪৫

আল্লাহর নবীর হাদীস, যার মধ্যে আমানত নেই, আমানত যে রক্ষা করে না, খেয়ানত করে, আল্লাহর নবীর ভাষা- লা ঈমানা, তার মধ্যে ঈমান নেই! প্রকৃত ঈমানদার তাকে বলা যাবে না- যার মধ্যে আমানতদারি নেই। আমানত মুসলমানদের, ঈমানওয়ালাদের বৈশিষ্ট্য ছিল। আজ মুসলমান তাদের বৈশিষ্ট্য ভুলে গেছে।

মহাকবি ইকবালের ভাষায়-

سبَق پھر پڑھ صداقت کا، عدالت کا، شجاعت کا + لیا جائے گا تجھ سے کام دنیا کی امامت کا

ও মুসলিম সমাজ! সততা, ইনসাফ ও বীরত্বের সবক আবার পড়।

পৃথিবী আবার তোমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে।

اِنِّیْ جَاعِلٌ فِی الْاَرْضِ خَلِیْفَةً.

আমি পৃথিবীতে এক খলীফা বানাতে চাই। -সূরা বাকারা (০২) : ৩০

আমাদের আদি পিতা আদম আ. আল্লাহ তাআলার খলীফা হয়ে পৃথিবীর হুকুমতের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। কোথায় আমাদের সেই সম্পদ। খেলাফতের সম্পদ আমাদের হাত থেকে চলে গেছে। রাজত্ব যদি আল্লাহ কাউকে দান করেন, তার কী করতে হবে? কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ.

তারা এমনÑ যদি যমীনে তাদেরকে আমি ক্ষমতা দান করি, তাহলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৪১

আল্লাহ যখন ক্ষমতা কাউকে দেবেন, তার প্রথম কাজ হল, নামায কায়েম করা।

কোথায় নামায! মুসলমানের অফিসে নামায নেই, বাজারে নামায নেই, সমাজে নামায নেই, বাড়িতে নামায নেই, পরিবারে নামায নেই। রাষ্ট্রপরিচালক যিনি হবেন, প্রথম দায়িত্ব-  اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ নামায কায়েম করবেঈমানের পরেই হল নামাযের স্থান। দ্বিতীয় দায়িত্ব وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ  যাকাত আদায় করবেاَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ  সৎ কাজের আদেশের প্রথম দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে, অর্থ মন্ত্রণালয় আছে, আমর বিল মারূফ নাহী আনিল মুনকারের কোনো মন্ত্রণালয় নেই- আ-হ!

لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَه.

আমানতদারি ছিল মুসলমানের বৈশিষ্ট্য। কথার আমানত, কাজের আমানত, জানের আমানত, মালের আমানত, ইজ্জত-আব্রুর আমানত। বিশাল আমানত। এজন্য মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, এই যে কুরআনের আয়াত, শুধু এই একটি আয়াতের ওপর যদি মুসলমানরা আমল করতে পারে, তাদের জীবন সংশোধনের জন্য, দুনিয়ার শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য একটি আয়াতই যথেষ্ট।

سبَق پھر پڑھ صداقت کا، عدالت کا، شجاعت کا + لیا جائے گا تجھ سے کام دنیا کی امامت کا

ও মুসলিম সমাজ! সততা, ইনসাফ ও বীরত্বের সবক আবার পড়।

পৃথিবী আবার তোমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে।

ও মুসলমান! সবক ভুলে গেছ। আমানতের সবক ফের পড়। আবার ধর আমানত। তোমার থেকে আবারো দুনিয়ার রাজত্ব পরিচালনার কাজ নেওয়া হবে। এই পৃথিবীর ইমামতির কাজ তোমার থেকেই নেওয়া হবে। যেমনি নেওয়া হয়েছিল আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে, নেওয়া হয়েছিল উমরে ফারূক রা. থেকে। উমরে ফারূক রা.-এর সেই হুকুমত, দশ বছর তিনি হুকুমত করেছিলেন। এই পৃথিবীর অর্ধেক দুনিয়া উমরে ফারূক রা.-এর হাতে ইসলামের পতাকাতলে এসে গিয়েছিল। রোম সম্রাট, পারস্য সম্রাট সবাই পরাভূত, সবাই শেষ। কী ছিলেন উমর? কোথায় থাকতেন উমর? সুউচ্চ রাজপ্রাসাদে? আলীশান ইমারতে? না, ঝুপড়ির মধ্যে থাকতেন। কী ছিল তাঁদের শক্তি। কী ছিল মুসলমানের শক্তিমত্তার রহস্য? মুসলমানের মধ্যে আমানতদারি ছিল। আমানতের শক্তি তাদের ছিল। এ শক্তিই তাদেরকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে আসীন করেছিল।

খায়বারের ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের আচরণ

খায়বার যুদ্ধ হয়ে গেল। খায়বারের যমীনে মুসলমানদের বিজয় নিশানা উড়তে থাকল। খায়বার এখন মুসলমানদের অধীনে। যুদ্ধের পর খায়বারবাসী একটা প্রস্তাব দিল- এ যমীন আপনাদের। এ যমীন এখন আপনাদের মালিকানাধীন। তবে যেহেতু এটি কৃষিপ্রধান যমীন। এ যমীনে আপনারা ফল ফসলই তো চাষাবাদ করবেন। এ চাষাবাদের জন্য আপনাদের তো মজদুর প্রয়োজন। মজদুর হিসেবে আমাদেরকেই রেখে দিন না। আমরা এখানে চাষাবাদ করব। ফল ফসল যা হবে, অর্ধেক আপনারা মদীনায় নিয়ে যাবেন। বাকি অর্ধেক আমাদের শ্রমের মজুরী হিসেবে আমরা রেখে দেব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে এভাবেই চুক্তিবদ্ধ হলেন। যেহেতু এধরনের চুক্তি সর্বপ্রথম খায়বারে হয়েছিল, এজন্য এ চুক্তিকে ইসলামের পরিভাষায় মুখাবারা বলা হয়।

এর পরের বছর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা.-কে খায়বারে পাঠালেন। তিনি সেখানে গিয়ে প্রথমে সমস্ত সম্পদ দুই ভাগে ভাগ করলেন। একটা অংশ নিজে নিলেন, আরেক অংশ তাদের দিলেন। কিন্তু ইহুদীরা বলল, আপনি তো আমাদের কাছ থেকে বেশি নিয়ে গেলেন।

এ শুনে ইবনে রওয়াহা রা. বললেন, ঠিক আছে, আমার অংশটি তোমরা নাও, আর তোমাদের অংশটি আমাদের দিয়ে দাও।

আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা.-এর এত সুন্দর আচরণ দেখে তারা মুগ্ধ হল এবং অকপটে স্বীকার করে নিল যে, এই কারণেই, এই আমানতের কারণেই আজ সারা দুনিয়ায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিজয়ের ডংকা বাজছে। এই আমানতের কারণেই ইসলামের পতাকা সারা দুনিয়ায় বিস্তার লাভ করছে। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৪১০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫১৯৯)

জানলে কী হবে, যদি না মানি

তিনটি আমানতের কথা আল্লাহ বললেন। আল্লাহর আমানত, রাসূলের আমানত, পরস্পরের আমানত। আমাদের জানা আছে অনেক কিছুই। কিন্তু শুধু জেনে কী হবে, যদি জানা বিষয়গুলো অজানার মতো হয়ে যায়। আমলে না আসে। কত জানা জিনিস, জেনেও যেন জানি না। চোখ থেকেও অন্ধ। মন দিয়ে শুনুন, তিন আমানতের সবক আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দিচ্ছেন।

আল্লাহ তাআলার আমানত : কুরআন

আল্লাহ তাআলা সর্ববৃহৎ যে আমানত আমাদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন, তা  আল্লাহর কিতাব। কুরআন মুসলমানদের কাছে আল্লাহ তাআলার সর্ববৃহৎ আমানত। কোথায় আমাদের কাছে আল্লাহ তাআলার সেই আমানত। আপনার সন্তানের বইয়ের র‌্যাকে সমস্ত বই আছে, নেই শুধু কুরআন। আপনার ঘরে সব কিছু পড়া হয়। পড়া হয় না শুধু কুরআন। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে হুকুম করেছেন, তোমরা কুরআন পড়। স্বয়ং যাঁর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও আল্লাহ হুকুম করছেন-

اُتْلُ مَاۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ مِنَ الْكِتٰبِ.

(হে নবী!) ওহীর মাধ্যমে আপনার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তা তিলাওয়াত করুন। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫

নবীজী কুরআন তিলাওয়াত করতেন। প্রত্যেক রমযান মাসে শুরু থেকে নিয়ে সেই রমযান পর্যন্ত যে পরিমাণ কুরআন অবতীর্ণ হত, জিবরীল আ.-এর সাথে সে অংশ দাওর করতেন। নবীজী তিলাওয়াত করতেন, জিবরীল শুনতেন। জিবরীল তিলাওয়াত করতেন, নবীজী শুনতেন। এভাবে প্রত্যেক রমযান মাসে তাঁরা কুরআন একে অপরকে শোনাতেন। প্রতি বছর জিবরীল নবীজীকে একবার শোনাতেন, কিন্তু নবীজীর ওফাতের আগের রমযানে জিবরীল দু-বার শোনালেন। নবীজী চিন্তা করলেন, এ বছর জিবরীল আমাকে দু-বার শোনালেন কেন? মনে হয়, আমার বিদায়ের সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে।

কুরআন রাসূলেরও আমানত

কুরআন কার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমেই তো পেয়েছি। কুরআন রাসূলেরও আমানত। নবীজী বলেন, আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস আমানত রেখে গেলাম- আল্লাহর কিতাব আর আমার সুন্নাহ।

আমানতের প্রথম কাতারেই কুরআন ও সুন্নাহ। কোথায় আমাদের সমাজে কুরআন সুন্নাহর আমানত। ছেলে বি. এ. পাশ করলে মনে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। মনে যেন খুশি ধরে না। কিন্তু আমার ছেলে কুরআন পড়নেওয়ালা হল না; কেন আমার মনে ব্যথা নেই, কেন কোনো দুঃখ নেই?

মুখেও কুরআন, বুকেও কুরআন

এজন্যই হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বলতেন, তোমার ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাও, ডাক্তার বানাও; যা কিছু বানানোর বানাও কিন্তু আগে তাকে কুরআনওয়ালা বানিয়ে নাও। তোমার সন্তানের মুখে যতক্ষণ কুরআন না আসবে, তোমার সন্তানের বুকে যতক্ষণ আল্লাহর কালাম না আসবে, দুনিয়ার কোনো পড়া তার মুখে তুমি দিও না।

হাফেজ্জী হুজুর রাহ. প্রবর্তিত এক বছর মেয়াদী মক্তব শিক্ষা কার্যক্রম

এমন শিক্ষা সিলেবাসও আলহামদু লিল্লাহ আমাদের দেশে চালু আছে যে, একটা ছেলে আলিফ-বা-তা-ছা থেকে শুরু করে পূর্ণ ত্রিশ পারা কুরআন মাত্র এক বছরে শিখে ফেলতে পারে। আমাদের এ মিফতাহুল উলূম মাদরাসায় এ ব্যবস্থা চালু আছে। এক রমযানের পর একটি শিশু কিছুই জানত না। আলিফ-বা-তা-ছা থেকে পড়া শুরু করে, পরবর্তী রমযান আসার আগেই সে ত্রিশ পারা কুরআন সহীশুদ্ধরূপে পড়নেওয়ালা হয়ে যায়।

তারপরও আমরা কীসের অপেক্ষায় বসে আছি? কেন বিলম্ব করছি? কেন নিজেদের সন্তানদেরকে বঞ্চিত করছি? কীসের বাধা?

কেন এই খেয়ানত আমরা করে যাচ্ছি? কোন্ ভরসায় এ খেয়ানত আমরা করে যাচ্ছি? আগে তো কুরআন শরীফ শেষ করতে দুই-তিন বছর লেগে যেত। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কত চোখের পানি এজন্য ছিল যে, কত গরিব মানুষ, তাদের সন্তানকে অর্থের অভাবে দুই-তিন বছর লাগিয়ে কুরআন পড়াতে পারে না। সেই সামর্থ্য তার  নেই। আবার অনেকের সামর্থ্য আছে, কিন্তু তিন বছর লাগানোর ইচ্ছা নেই।  মুসলমান তো! কুরআন তাকে শিখতেই হবে। মুসলমান সন্তানের বুকে আর মুখে সবার আগে যেন কুরআন চলে আসে, সেজন্য হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে অনেক দুআ-কান্নাকাটির পরে মাত্র এক বছর মেয়াদী এ মক্তব শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেন। এটা হাফেজ্জী হুজুর রাহ. শুরু করে দিয়ে গেছেন।

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি কামরাঙ্গীরচর নূরিয়া মাদরাসায় এ পদ্ধতি চালু করে গেছেন। তারপর সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তা ছড়িয়ে পড়েছে। এ পদ্ধতি সামনে আসার পর অভিভাবকগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে যে, এখন আর আমার সন্তানকে কুরআন শেখার জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর সময় দিতে হয় না। এ পদ্ধতিতে ত্রিশ পারা কুরআন, চল্লিশটা হাদীস, মওত পর্যন্ত ঈমান ও ইসলাম নিয়ে টিকে থাকার একান্ত প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, মাত্র এক বছরে একটি শিশুকে শিক্ষা দিয়ে দেওয়া হয়।

আছে তো সম্পদ। কিন্তু আমরা দেখতে রাজি নই, চোখ খুলতে রাজি নই। আমাদের এখানে রোযার পরে যারা আলিফ-বা-তা-ছা শুরু করেছে, আগামী রোযার আগে দেখবেন, এদের ত্রিশ পারা কুরআন পড়া হয়ে গেছে। সবার না হোক, শতকরা আশিজনের হয়ে যাবে। যাদের স্মরণশক্তি খুব দুর্বল এমন কিছু ছেলে বাদ থাকতে পারে। কিন্তু তাদেরও পরের বছরের অর্ধেক যেতেই হয়ে যায়। এ বছর ছিল মক্তবে, রোযার পর দেখা যাবে সে হিফযখানায় চলে গেছে।

এত সুন্দর এত ফলপ্রসূ একটি ব্যবস্থা এখানে চালু আছে, কিন্তু আমাদের এদিকে কোনো খেয়াল নেই। আমরা খোঁজ নিই না। স্কুলের খবর নিই, কোন্ স্কুলের পড়াশোনা ভালো সেই খবর তো ঠিকই নিই, কিন্তু কুরআনের শিক্ষা কোথায় ভালো, সেই খবর আমরা নিই না। আসলে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব নেই মুসলমানদের কাছে।

কুরআনের এ আমানত কেন আমরা রক্ষা করছি না; হাশরের ময়দানে এর নালিশ হবে, বিচার হবে। বিচারটা দেবেন কে? আল্লাহর দরবারে নালিশ করবেন কে? স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে উম্মতের বিরুদ্ধে নালিশ করবেন।

وَ قَالَ الرَّسُوْلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوْمِی اتَّخَذُوْا هٰذَا الْقُرْاٰنَ مَهْجُوْرًا.

আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে বিলকুল পরিত্যাগ করেছিল। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৩০

অর্থাৎ, আল্লাহ! ও আমার রব! আমি আমার উম্মতের কাছে কুরআনের আমানত রেখে এসেছিলাম। এরা কুরআনের আমানত রক্ষা করেনি। সবকিছু তাদের সামনে ছিল, কুরআন ছিল তাদের পিছনে।

আমানতের তালিকায় সর্বপ্রথম কুরআন ও সুন্নাহ। এ আমানতের প্রথম দাবি হল, কুরআন সহীহভাবে তিলাওয়াত করা। এটি সবার জন্য জরুরি। আল্লাহ তাআলা এ কুরআন সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য দেননি। কুরআন সবার জন্য। সবাইকে আলেম হতে হবে এটা জরুরি না; কিন্তু সবাইকে সহীহ-শুদ্ধ কুরআন পড়নেওয়ালা হতে হবে। এটি মুসলমানমাত্র তার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত যিম্মাদারী।

দ্বিতীয় পর্যায়ের আমানত

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আমানত হল, প্রথম কাতারের আমানত। দ্বিতীয় পর্যায়ের আমানত হল, পরস্পরের আমানত। প্রথম প্রকারের মতো এ আমানতেরও খেয়ানত করা যাবে না। এখন আমার-আপনার যিম্মাদারী হল, নিজেদের হিসাব নেওয়া। আমাদের দ্বারা কত আমানতেরই না খেয়ানত হয়ে যাচ্ছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, আবার সূর্যাস্তের পর পরবর্তী ভোর পর্যন্ত কত আমানতের খেয়ানতই না আমি করে যাচ্ছি।

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

اسْتَفْتِ قَلْبَكَ، وَاسْتَفْتِ نَفْسَكَ.

إسناده ضعيف من أجل الزبير أبي عبد السلام.

তোমার সম্পর্কে তুমি তোমার নিজেকেই জিজ্ঞেস কর। -মুসনাদে আহমাদ, বর্ণনা ১৮০০৬

তোমার অবস্থা অন্যের কাছে জিজ্ঞেস করার আগে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখ না! দেখবে, কত খেয়ানত তোমার থেকে হয়ে যাচ্ছে।

পারস্পরিক আমানত

পারস্পরিক আমানত কী কী? জান- মাল-ইজ্জত-সম্মানের আমানত, কথা ও কাজের আমানত, দায়িত্বের আমানত।

চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে পুরো ইউনিয়নের দায়িত্ব আমানত। হাশরের ময়দানে তাকে কোনো ছাড় না দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি তোমার আমানত রক্ষা করেছ, নাকি রক্ষা করনি?

জানের আমানত- মনিবের কাছে গোলামের জীবন আমানত, দোকান মালিকের কাছে কর্মচারির জীবন আমানত।

শিক্ষকের কাছে ছাত্র : কোটি টাকার  আমানত

মাদরাসার শিক্ষকের কাছে ছাত্রের জীবন আমানত। বাবা-মা সন্তানকে রেখে যায় মাদরাসায়। তারপর এ ছাত্রের জীবনটা তার শিক্ষকের কাছে এক অমূল্য আমানত হয়ে যায়। শুধু পড়া দেওয়া আর পড়া নেওয়াই শিক্ষকের কাজ না। ছাত্রের জীবনটাকে তৈরি করে দেওয়া, ছাত্রের জীবনটাকে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা শিক্ষকের যিম্মাদারী। ছাত্রের পুরো জীবনটাই শিক্ষকের কাছে আমানতএ আমানতের হেফাযত করা শিক্ষকের ঈমানী যিম্মাদারী।

দশ হাজার টাকা যদি কেউ আমার কাছে আমানত রাখে, সত্যিকার অর্থে যদি আমি আমানতদার হই, আমার তখন ঘুম আসে না, হায় হায় দশ হাজার টাকার আমানত, কীভাবে রক্ষা করি, কিভাবে রক্ষা করি!

কিন্তু এ দশ হাজার টাকার চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ দামি আমানত হল, আমার কাছে আমার ছাত্র। একজন ছাত্রের জীবনের মূল্য কত? মাত্র দশ হাজার টাকা? দশ লক্ষ টাকা? কোটি টাকা দিয়েও কি একটি জীবনের মূল্য দেওয়া সম্ভব? কিন্তু এত দামি এক আমানত আমাদের যিম্মায়, আমরা সেই আমানত রক্ষার খেয়াল করি না।

আমার বেখেয়ালিতে, আমার অবহেলায় একজন তালিবুল ইলম যদি নষ্ট হয়ে যায়, আমার কাছে একটি জীবনের আমানত ছিল, আমি সেই আমানতের খেয়ানত করলাম, আমি সেই আমানত নষ্ট করলাম।

মালের আমানত

শুধু শিক্ষক ছাত্রের বিষয় নয়, জানের আমানতের অনেক শাখা আছে। একইভাবে মালের আমানতেরও অনেক সুরত আছে। দোকানদার ক্রেতা থেকে বিশ টাকা নিল, বিনিময়ে বিশ টাকা সমপরিমাণ পণ্য না দিয়ে কিছু কম দিল। মনে মনে ভাবল, আমি জিতে গেলাম, আমার লাভ হয়ে গেল।

না, না, এখানে আসলে খেয়ানত হয়ে গেল। মালের আমানতের খেয়ানত হয়ে গেল। লেনদেনে আদান-প্রদান যেন সমান সমান হয়, কম না হয়, সেজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম কী সুন্দর কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন! বলেছেন-

اَرجِح

একটু বাড়িয়ে দাও।

এক কেজির টাকা নিয়েছ, বিনিময়ে এক কেজি পণ্যই দাও, কিন্তু একটু বাড়িয়ে দাও। যেন অন্তত সমান সমান হয়।

একটু বাড়িয়ে দেওয়ার দ্বারা আল্লাহ পাক যে কী পরিমাণ খুশি হন, সেটা আমি-আপনি কল্পনাও করতে পারব না। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতে কত যে বাড়িয়ে দেবেন, সেটা আমরা অনুমানও করতে পারব না। যারা আমানত রক্ষা করে চলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমানত রক্ষার সুফল তারা দুনিয়াতেই কেমন পাচ্ছে। আর আখেরাত তো সামনে আছেই।

আমানতের বিশেষ মাসআলা

আমানত কত ভারী জিনিস, মাসআলা শুনুন! কেউ আপনার কাছে এক হাজার টাকা আমানত রাখল। আপনার যিম্মাদারী হল, যে টাকা সে আপনার কাছে আমানত রেখেছে, ঠিক সেই টাকাটাই আপনি সময়মতো তাকে পৌঁছাবেন। যদি আপনি সেই টাকা খরচ করে ফেলেন, আর অন্য এক হাজার টাকা তাকে পরিশোধ করেন, আল্লাহর খাতায় আপনি খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবেন। দশ বছরও যদি আপনার কাছে আমানত থাকে, সেই টাকা সেভাবেই পড়ে থাকবে। টাকা যে কাগজে মোড়ানো, সে কাগজেই মোড়ানো থাকবে। যে সুতা দিয়ে বাঁধা সেই সুতা দিয়েই বাঁধা থাকবে।

আমানতের টাকা বেঁধে রাখার সুতাটাও আমানত। আমানতদাতা যে কাগজ ও যে সুতা দিয়ে বেঁধে আপনাকে দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই আপনাকে রাখতে হবে।

খেয়ানত বেড়ে যাওয়ার কারণে আজ মুসলিম জাতির অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ কারো কাছে আমানত রাখতে চাইলেও তাকে বিশ্বাস করতে পারে না, তার ভয় হয়, আমানতের টাকা ফেরত পাবে কিনা। অথচ একটা সময় মুসলমানের অবস্থা এমন ছিল যে, অমুসলিমদের মাঝে একজন মুসলমান থাকলে সেই মুসলমানের কাছে আমানত রাখার জন্য সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সবাই জানত, ও মুসলমান। মুসলমান আমানতের খেয়ানত করে না।

আমি একজন আলেম, আমার দ্বারাও খেয়ানত হতে পারে। আমি নামাযী, আমিও খেয়ানত করি। লেবাসে পোশাকে আমি বড় দ্বীনদার, আমিও খেয়ানত করি। যেখানে যাবেন সেখানেই খেয়ানত।

আজকের আলোচনার সারাংশ হল, আমানতের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা অনেক কথাই কুরআনে বলেছেন। অনেক কথাই আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। যাদের আমানতের ত্রুটি আছে, তারা আজকে তওবা করি। আল্লাহর ঘরে বসে তওবা করি-

ও খোদা! আর আমানতের খেয়ানত করব না। খেয়ানতকারীদের তালিকা থেকে আমার নামটা তুমি সরিয়ে নাও খোদা! তাওফীক দাও, এখন থেকে আর যেন খেয়ানত না করি- আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا أنِ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْن.

 

 

advertisement