যিলকদ ১৪৪৫   ||   মে ২০২৪

একটুখানি শীতল পানি

মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

চলছে অসহনীয় দাবদাহ। তাপমাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে বৃষ্টির জন্য হাহাকার। দুর্বিষহ গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। প্রচণ্ড গরমে  জীব-জন্তু, পাখ-পাখালিসহ চারপাশের প্রাণীকুলের স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টের সম্মুখীন কৃষক-শ্রমিক ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষগুলো। তাদের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে।

আহা, এক পশলা বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে সবাই আকাশের দিকে। বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির জন্য সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করা হচ্ছে। সূর্যের তাপ ও গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা রকমের রোগ-ব্যাধিও। ঝুঁকিতে পড়ছে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও দুর্বল শ্রেণির মানুষের জীবন-প্রাণ। হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর সংবাদও ছাপা হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়।

গরমের তীব্রতাকে হাদীসের ভাষায় বলা হয়েছে-ফাইহু জাহান্নাম- জাহান্নামের উত্তাপ।

একটু ভাবনার বিষয়, যেদিন মহান মালিকের হুকুমে সূর্য  মাথার একেবারে কাছাকাছি হবে, সেদিন কীভাবে সহ্য করা যাবে? কে আমায় রক্ষা করবে? হাঁ, সেদিন আল্লাহর ওসব বান্দাগণ ঠিকই রক্ষা পাবেন, আমলনামাকে যারা সাজাতে পেরেছেন নেক আমল দিয়ে।

এই প্রচণ্ড গরমে মুমিনের জন্য রয়েছে দ্বীনের মৌলিক বিধি-বিধান পালনের পাশাপাশি কিছু নেক আমলের সুবর্ণ সুযোগ। সেটি হল, ‘সাকইয়ুল মা-পানি পান করানো বা জনসাধারণের জন্য পানির ব্যবস্থা করা।

এই মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা লাভ করতে পারি। বেঁচে যেতে পারি সেদিনের বিপদ থেকে। প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَيُّمَا مُؤْمِنٍ سَقَى مُؤْمِنًا شَرْبَةً عَلَى ظَمَأٍ، سَقَاهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الرَّحِيقِ الْمَخْتُومِ.

যে মুমিন কোনো মুমিনকে পিপাসার্ত অবস্থায় এক ঢোক পানি পান করাবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে মোহর করা পানি থেকে পান করাবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১১০১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৪৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৮২

পথিককে পানি পান করানো বা খরাপ্রবণ এলাকায় পানির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কিংবা পানির যথাযথ ব্যবস্থা নেই- এমন পরিবারের পানির প্রয়োজন পুরা করার মাধ্যমে আমরা এ আমলে অংশগ্রহণ করতে পারি।

বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একবার এক লোক কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ল। তখন একটি কূপে নেমে সেখান থেকে পানি পান করল। কূপ থেকে উঠে রওনা হওয়ার সময় লোকটি দেখতে পেল, একটি কুকুর পিপাসায়  কাতরাচ্ছে এবং জিহ্বা বের করে ভেজা মাটি চাটছে। এ দেখে লোকটি বলল-

لَقَدْ بَلَغَ هَذَا مِثْلُ الَّذِي بَلَغَ بِي، فَمَلَأَ خُفَّه، ثُمَّ أَمْسَكَه بِفِيهِ، ثُمَّ رَقِيَ، فَسَقَى الكَلْبَ، فَشَكَرَ اللهُ لَه، فَغَفَرَ لَه.

হায়রে, কুকুরটিও বুঝি আমার মতো পিপাসার্ত হয়ে পড়েছে! তারপর নিজের চামড়ার মোজার মধ্যে পানি নিয়ে কুকুরের মুখে দিল এবং পানি পান করিয়ে কুকুরের পিপাসা নিবারণ করল। কাজটিকে আল্লাহ তাআলা এতই পছন্দ করলেন যে, তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল, চতুষ্পদ জন্তুর (প্রতি অনুগ্রহের) মাঝেও কি আমাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- 

فِي كُلِّ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ.

প্রত্যেক প্রাণীর (প্রতি দয়া-মায়ার) মধ্যেই রয়েছে সওয়াব ও প্রতিদান। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৬৩, ২৪৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪৪

সহীহ বুখারীতে উল্লিখিত ওই পাপাচারী নারীর কথাও স্মরণ করা যায়, যিনি পথিমধ্যে পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেছেন। তাই পূর্বসূরিদের কেউ কেউ বলতেন, যার গুনাহ বেড়ে যায়, সে যেন বেশি বেশি মানুষকে পানি পান করায়। (দ্র. তাফসীরে কুরতুবী ৭/২১৫)

এই সহজ আমলটি এতই গুরুত্বপূর্ণ, যা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া নিজের মরহুম পিতা-মাতা ও পূর্বসূরিদের জন্য ঈসালে সওয়াবেরও চমৎকার মাধ্যম। একবার সাহাবী সাদ ইবনে উবাদা রা. এসে নবীজীকে বলেছিলেন, আল্লাহর রাসূল! আমার আম্মা ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে কোনো সদকা করতে পারি? নবীজী বললেন, অবশ্যই পার!

তিনি বললেন, তাহলে কোন্ সদকা উত্তম? অর্থাৎ, আম্মার পক্ষ থেকে আমি কী সদকা করব, সেটাও বলে দিন!

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

سَقْيُ الْمَاءِ.

পানি পান করানো। (জনসাধারণের জন্য পানির ব্যবস্থা করা।)

বর্ণনাকারী বলেন, তিনি একটি কূপ খনন করে বললেন, ‘এটা উম্মে সাদের নামে ওয়াকফ করা হল।’ (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৮৪৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৮১)

শুধু তাই নয়, অন্যকে পানি পান করানো স্বতন্ত্র সদকা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

فِي ابْنِ آدَمَ سِتُون وثلاثُ مَائةِ سُلامَى- أَو عَظم أَو مَفصِل- عَلَى كُل واحدٍ فِي كُل يَومٍ صَدقةٍ، كُل كَلمةٍ طَيبةٍ صَدقةٍ، وعَونُ الرَّجُل أَخاهُ صَدقةٌ، والشُربَةُ مِن الْمَاءِ يَسقِيها صدقةٌ، وإِماطَة الأذى عَن الطَريقِ صَدقة.

আদম সন্তানের দেহে তিন শ ষাটটি হাড় বা গ্রন্থি রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির জন্য প্রত্যেক দিন সদকা রয়েছে। প্রতিটি উত্তম কথাই সদকা। এক ভাইয়ের পক্ষ থেকে অন্য ভাইকে সাহায্য করা সদকা। এক ঢোক পানি পান করানো সদকা। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়াও সদকা। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৪২২

পানি পান করানো ও পানির ব্যবস্থা করার ফযীলতের কথা যেমন হাদীসে এসেছে, তেমনি পানি থেকে বাধা দিলেও কঠিন হুমকির কথা এসেছে। সহীহ বুখারীর বর্ণনা। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তিন ব্যক্তির দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হল-

رَجُلٌ كَانَ لَه فَضْلُ مَاءٍ بِالطَّرِيقِ، فَمَنَعَه مِنَ ابْنِ السَّبِيلِ.

চলার পথে যার কাছে প্রয়োজন-অতিরিক্ত পানি ছিল, কিন্তু তা থেকে সে পথিককে দান করেনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৫৮

আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। অনেক সময় বিভিন্নভাবে জনগণের পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দিত! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এব্যাপারে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেনও না। তাদের একজন হল-

وَرَجُلٌ مَنَعَ فَضْلَ مَاءٍ فَيَقُولُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ: اليَوْمَ أَمْنَعُكَ فَضْلِي كَمَا مَنَعْتَ فَضْلَ مَا لَمْ تَعْمَلْ يَدَاكَ.

...এবং ওই লোক, যে প্রয়োজন-অতিরিক্ত পানি আটকে রেখেছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, যা তুমি নিজে সৃষ্টি করনি, তার প্রয়োজন-অতিরিক্তটা তুমি যেভাবে আটকে রেখেছ, আজ আমিও আমার দয়া ও করুণা আটকে রাখব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৪২

এছাড়াও আরো বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্নভাবে এবিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

পিপাসার্তকে পানি পান না করানোকে আল্লাহ তাআলা নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেছেন, সে যেন আমাকে পানি পান করায়নি। হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ডেকে বলবেন-

يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ، فَلَمْ تَسْقِنِي، قَالَ : يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ، قَالَ : اسْتَسْقَاكَ عَبْدِي فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِه، أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَه وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي.

হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে পানি পান করাব, আপনি তো সারা জাহানের প্রভু! তিনি বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে, তা আমার কাছে পেতে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৯

পানি পান করানোর কিছু উপায়

বিভিন্নভাবে লাভ করতে পারি পানি পান করানোর এই গুরুত্বপূর্ণ  সওয়াব।

মসজিদ ও দ্বীনী কোনো আয়োজন-অনুষ্ঠানে, পথের ধারে, হাঁট-বাজার ও মার্কেটে, হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ইত্যাদিতে; যেখানে মানুষ সহজে পানি পায় না বা পানির জন্য উদগ্রীব থাকে। বোতলজাত করে বিশুদ্ধ পানি যেমন বিতরণ করা যায়, তেমনি ফিল্টার জাতীয় কিছুও বসানো যায়। সামর্থ্যবানদের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতির মাধ্যমে নলকূপ বা পানির কল বসানোও সম্ভব। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নগর ও শহরের বিভিন্ন স্থানে পানি পরিশোধন ও সরবরাহের যথাযথ ব্যবস্থা করে দেওয়া চমৎকার কাজ। পানি সরবরাহে কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াও তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পর দেখলেন, এখানে সুপেয় পানি পান করার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেবল এক ইহুদীর রূমানামক কূপ ছাড়া আর কোনো পানির ব্যবস্থা নেই, যার পানি অনেক চড়া মূল্যে বিক্রি করা হয়। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কূপটি ব্যক্তি মালিকানা থেকে সরিয়ে আম জনতার জন্য উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন। ঘোষণা দিলেন-

مَنْ يَشْتَرِي بِئْرَ رُومَةَ فَيَجْعَلَ دَلْوَه مَعَ دِلاَءِ الْمُسْلِمِينَ بِخَيْرٍ لَه مِنْهَا فِي الْجَنَّةِ؟

অর্থাৎ, কে রূমানামক কূপটি কিনে সাধারণ মুসলিমদের জন্য  উন্মুক্ত করে দেবে? এবং এর বিনিময়ে জান্নাতে আরো উত্তম পুরস্কার লাভ করবে?

একথা শুনে উসমান রা. এই কূপ খরিদ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করলেন। (দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৭০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫১১, ৫৫৫)

প্রিয় পাঠক!

সময়ের বিবেচনায় কিছু কাজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। বাংলায় যাকে বলা হয় সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।তীব্র গরম ও দাবদাহের এই মৌসুমে জীবন-জীবিকার জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষগুলোর মুখে একটুখানি শীতল পানি তুলে দিয়ে অথবা জনসাধারণের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে নিজেকে শামিল করে নিতে পারি সৌভাগ্যবানদের কাতারে। লাভ করতে পারি আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও অনুগ্রহ। আল্লাহ তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement