শাওয়াল ১৪৪৫   ||   এপ্রিল ২০২৪

যে মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে

ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় যখন দেশবাসী আপন আপন কাজে মগ্ন, তখনই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি নামের বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের ভয়াবহতার খবরে দেশবাসী হতভম্ব হয়ে পড়ে। রেস্তোরাঁয় পরিপূর্ণ একটি দালান মুহূর্তে জাহান্নামের রূপ ধারণ করে। আগুনের ভয়াবহতা দেখে দেশবাসী ভেবেছিল, মনে হয় আগুনই তাদের গ্রাস করেছে। কিন্তু যখন আগুন নিভে গেল, পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন সবাই মেটাতে গেল, তখনই বিশৃঙ্খল এক দেশের বিভৎস রূপ বেরিয়ে এল সবার সামনে। মানুষগুলো আগুনে পুড়ে মরেনি; মরেছে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। অফিস বানানোর অনুমোদন নিয়ে তৈরি হওয়া এই ইমারতে চলছিল অনেকগুলো রেস্তোরাঁ। ইমারতটিতে অগ্নিনিরাপত্তা যথাযথ ছিল না। ফলে মানুষগুলো আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। অনেক প্রতিশ্রুতির দেশে বেঘোরে প্রাণ হারাল ৪৬ জন বনী আদম।

অন্যান্য সময়ের মতো এই অগ্নিকাণ্ডের পরও সবাই সরব হয়ে উঠল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কাঠগড়ায় দাঁড় করাল। সংস্থাগুলো নিজেদের দায় ভুক্তোভোগীদের ওপর চাপাল। শহরব্যাপী রেস্তোরাঁয় রোস্তোরাঁয় অভিযান চলল। গ্রেফতার, জরিমানা আর আগুনের আতংকে রেস্তোরাঁগুলো ফাঁকা হয়ে গেল। ভোগ-বিলাসের ঢাকা শহর কিছুটা শ্বাস ফেলল। বুদ্ধিজীবীরা মোটা দাগে নানা অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করে দিলেন। এরপর দিন চলে গেল, আমরাও ভুলে গেলাম তিমির রাতের আগুনের কথা। নিহত মানুষের কথা।

আগুনকেন্দ্রিক এই হৈ হুল্লোড়ের মাঝে হঠাৎ করেই সামনে আসে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত এক নারী সাংবাদিকের লাশ নিয়ে টানাটানির বিষয়টি। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের এই সাংবাদিকের লাশ দাবি করে কুষ্টিয়ার খোকসার পেশায় রাজমিস্ত্রি সবুজ শেখ। কিন্তু তার দাবিতে বাগড়া দেয় রমনা কালিমন্দিরের সভাপতি। সবুজ শেখের কথায় মনে হল, এ তারই কন্যা; কিন্তু রমনা মন্দিরের সভাপতির বক্তব্য, সাংবাদিকের নাম এবং তার সহকর্মীদের কথায় কেমন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। এরপর বেশ সময় লাশ পড়ে থাকে। সবাই প্রতীক্ষায় থাকে ঘটনার সমাধানের। ডিএনএ টেস্টের পর দেখা যায়- এ সবুজ শেখেরই মেয়ে। গ্রামে নাম ছিল বৃষ্টি খাতুন। এ নামে তার এনআইডি আছে। বৃষ্টি খাতুন কী করে অভিশ্রুতি হয়ে গেল- এ নিয়ে চলে অন্তহীন আলোচনা।

সাংবাদিকেরা খুঁজতে থাকে বৃষ্টি খাতুন থেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হয়ে ওঠার পেছনের গল্প। গল্প অনেক দীর্ঘ। সেই গল্পের মধ্যে আছে, জন্মসূত্রে মুসলমান মেয়েটিকে শৈশবে অনেকটা নাস্তিক হিন্দু শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া। সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা থেকে লেখালেখি শুরু করা। লেখালেখি চর্চা করে এমন মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। নিরাপত্তার অজুহাতে ছদ্ম নাম ব্যবহার করা। দরিদ্র একটি পরিবারের মেয়ের উচ্চাভিলাস। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এসে হিন্দু পরিচয় দেওয়া। বেনারশের এক হিন্দু পরিবারে জন্ম, বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারে লালিত পালিত হওয়ার গল্প প্রচার করা। পূজা-অর্চনা ও মন্দিরে যাতায়াত। একের পর এক প্রেমে জড়িয়ে পড়া এবং প্রেম ভেঙ্গে যাওয়া।

দৃশ্যের শেষ পর্যন্ত যেতে যেতে আমরা দেখি, মেয়েটি আর মুসলমানই থাকেনি। যদিও লাশ নিয়ে প্রকৃত বাবা ও রমনা কালিমন্দিরে দীর্ঘ টানাটানির পর লাশ মুসলিম কবরস্থানেই সমাহিত হয়েছে। ধর্মত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাওয়া কারও লাশ মুসলিম কবরস্থানে দাফন কিছুতেই সমীচীন নয়। সেজন্য মুসলমানদের কবরস্থানে দাফনে বাধা আসাটাই ছিল স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী প্রশাসনের প্রস্তুতিও ছিল। রাতের অন্ধকারে পুলিশ মোতায়েন ছিল। সতর্ক পাহারা ছিল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল, মুসলিম জনতার পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসেনি। মনে হল, দীর্ঘদিন ধরে শক্তিমানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম-বিরোধী তৎপরতা দেখতে দেখতে সব গা সওয়া হয়ে গেছে। রাজনীতিকভাবে শক্তিহীন হয়ে আজকের বাংলাদেশে শুধুই বেঁচে থাকা, আত্মমর্যাদাবোধ বিদায় নিয়ে নির্বীর্য কিছু মানুষের সমষ্টি হয়ে উঠেছে এই বাংলাদেশ।

যে বেদনা থেকে আজ অভিশ্রুতির কথা লিখতে বসেছি তা হল, মেয়েটির ধর্ম ত্যাগ করে জাহান্নামের ইন্ধন হওয়ার পেছনের মূল দায়টা বাবা-মায়ের। অবোধ বয়সে মেয়েটির বাবা তাকে তুলে দিয়েছেন এক হিন্দু শিক্ষকের কাছে। তখন মেয়েটির কোমল মনে পৌত্তলিকতা ছায়া ফেলে। সে হিন্দুদের মন্দিরে যাতায়াত শুরু করে। তার মনে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব ফেলে। একপর্যায়ে সে হিন্দু ধর্মকেই বেছে নেয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্টের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলামের দৃষ্টিতে, বৃষ্টি থেকে অভিশ্রুতির যাত্রা চমকপ্রদ এক মনোজাগতিক রূপান্তর। এই পরিবর্তনের সূচনায় তিনি দেখছেন স্কুলশিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তীকে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে বৃষ্টির জীবনে। অবচেতন মনে সনাতন ধর্মের প্রতি আকর্ষণ, ব্রাহ্মণ্য রীতির প্রতি প্রীতি, বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহের জন্মও শিক্ষকের জীবন-আদর্শের প্রভাবে। -প্রতিদিনের বংলাদেশ, ১৮ মার্চ ২০২৪

সেক্যুলার সিলেবাসে সন্তানকে পড়তে দেওয়া অভিভাবকদের জন্য এ ঘটনায় চিন্তার অনেক বিষয় আছে। কোমলমতি সন্তানদেরকে কোথাও দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, কাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমাদের একটু ভুল সিদ্ধান্তই কাল হয়ে উঠতে পারে আমার সন্তানের জন্য। হারিয়ে যেতে পারে চিরমুক্তির পথ তাওহীদ থেকে।

দুনিয়ার অল্প সময়ের জীবন পাড়ি দিয়ে পরকালই আমাদের মূল গন্তব্য। সেই গন্তব্যে যেন সব ঠিকঠাক থাকে, সেজন্য পৃথিবীর এত আয়োজন। অভিভাবকের একটু অবহেলায় যেন সন্তানের পরকাল নষ্ট না হয়। সন্তান যেন জাহান্নামের ইন্ধন না হয়। হাদীস শরীফে এসেছে-

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ.

প্রত্যেক শিশু ফিতরতের (স্বভাবজাত ঈমান) ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী বানায় অথবা খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৫

মুসলমান হয়েও যেন আমার কৃতকর্মের দ্বারা, আমার ভুল কর্মনীতি বা ভুল সিদ্ধান্তের দ্বারা আমার সন্তানের পরকাল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ দিকটি সামনে রেখেই সন্তানকে নিয়ে আমাদের সব পরিকল্পণা ও স্বপ্ন সাজাতে হবে।

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً ۚ اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.

হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে যখন হেদায়েত দান করেছ তারপর আর আমাদের অন্তরে বক্রতা সৃষ্টি করো না এবং একান্তভাবে নিজের পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান কর। নিশ্চয়ই তুমিই মহাদাতা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا.

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ হতে দান করুন নয়নপ্রীতি এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানান। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪

رَبِّ اَوْزِعْنِیْۤ اَنْ اَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِیْۤ اَنْعَمْتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنْ اَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضٰىهُ وَ اَصْلِحْ لِیْ فِیْ ذُرِّیَّتِیْ اِنِّیْ تُبْتُ اِلَیْكَ وَ اِنِّیْ مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ.

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাওফীক দান করুন, যেন আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নিআমত দিয়েছেন তার শোকর আদায় করতে পারি এবং এমন সৎকর্ম করতে পারি, যাতে আপনি খুশি হন এবং আমার জন্য আমার সন্তানদেরকেও (সেই) যোগ্যতা দান করুন। আমি আপনার কাছে তাওবা করছি এবং আমি আনুগত্য প্রকাশকারীদের অন্তর্ভুক্ত। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫

স্মরণ করি নবীজীর শেখানো দুআ-

اَللّٰهُمَّ لَا تَجْعَل مُصِيْبَتَنَا فِيْ دِيْنِنَا، ولَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا، وَلَا مَبْلَغَ عِلْمِنَا، ولَا تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لَّا يَرْحَمُنَا.

হে আল্লাহ, আমাদেরকে দ্বীন সংশ্লিষ্ট কোনো মসীবত দেবেন না, দুনিয়াকে আমাদের সবচেয়ে বড় ভাবনা ও সাধনার বস্তু বানাবেন না, আমাদের ওপর এমন কাউকে চাপিয়ে দেবেন না, যে আমাদের প্রতি দয়া করবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০১৬১

সবশেষে কুরআনের এই আয়াত স্মরণ করি-

وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ اتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّیَّتُهُمْ بِاِیْمَانٍ اَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ مَاۤ اَلَتْنٰهُمْ مِّنْ عَمَلِهِمْ مِّنْ شَیْءٍ  كُلُّ امْرِئٍۭ بِمَا كَسَبَ رَهِیْنٌ    .

যারা ঈমান এনেছে এবং সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দেব এবং তাদের কর্ম হতে কিছুমাত্র হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের বিনিময়ে বন্ধক রয়েছে। -সূরা তূর (৫২) : ২১

হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন এবং আমাদের সন্তানদের ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অনুগামী করুন। আমাদেরকে জান্নাতে একত্রিত করুন। 

 

 

advertisement