সময়ের স্রোতে আবার বয়ে যেতে লাগলো জীবনের দিন-রাত!
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সময়ের স্রোতে আবার বয়ে যেতে লাগলো জীবনের দিন-রাত! কতবার চাঁদ উঠলো এবং চাঁদ অস্ত গেলো! কতবার পূর্ণিমা-অমাবস্যার পালাবদল হলো! এভাবে একটি, দু’টি করে পাঁচটি বছর পার হলো। এ দীর্ঘ সময়ে, কত ভোরে কত সন্ধ্যায়, কত দুপুরে কত মধ্যরাতে আনন্দের কত স্বপ্ন দেখা হলো এবং স্বপ্নভঙ্গের কত বেদনা সইতে হলো! সব কথা এখানে যদি লেখা সম্ভব হতো, তাতে আনন্দ-বেদনার অসংখ্য ফুল দিয়ে বড় সুন্দর একটি মালা তৈরী হতো! কিন্তু সব কথা কি বলা যায়! আনন্দের, বেদনার সব কাহিনী কি প্রকাশ করা যায়! সেই কবে কোন্ দেশের কবি বলে গেছেন, ‘বাগানের সব ফুল মানুষের জন্য নয়/ কিছু ফুল হে মালী, রেখে দিয়ো বাগানের জন্য।’
রামাযানের তখনো দু’মাস বাকি। আকাশের কোণে রজবের চাঁদ দেখা দিলো। এই চাঁদ দেখে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম বলেছেন-
اللهم بارك لنا في رجب و شعبان, و بلغنا رمضان
হে আল্লাহ, রজব ও শা‘বানে আমাদের জন্য বরকত দান করম্নন, আর আমাদেরকে রামাযানে পৌঁছে দিন।
নবীজীর দিলে রজব-শা‘বানের বরকত লাভের এই যে ব্যাকুলতা; তিনটি চাঁদের দূরত্বে থেকেও রামাযানকে বরণ করার এই যে আকুতি, উম্মতের হৃদয়কে তা স্পর্শ না করে কি পারে!
রজবের চাঁদ দেখে অধম উম্মতির গোনাহগার যবানেও তাই উচ্চারিত হলো-
اللهم بارك لنا في رجب و شعبان, و بلغنا رمضان
সেই সঙ্গে এবার যুক্ত হলো দীদারে বাইতুল্লাহ ও যিয়ারাতে মাদীনাহর ব্যাকুলতা। হৃদয়ের গভীর থেকে বারবার তাই এ মিনতি উচ্চারিত হলো, ‘তোমার অশেষ রহমতে হে আল্লাহ, আমার জীবনে রামাযান যেন আসে এবং আসে তোমার ঘরের ডাক! পাঁচ বছর তো পূর্ণ হয়েছে হে আল্লাহ! তোমার দয়া ও দানের আশায় ভিখারী তাই আবার অাঁচল পেতেছে হে আল্লাহ!
***
ভোর হয়, সন্ধ্যা হয়। রজবের চাঁদ ধীরে ধীরে পূর্ণ হয় এবং একসময় পূর্ণিমার আলোঝলমল চাঁদে পরিণত হয়।
নির্জন রাতে জোসনার আলো গায়ে মেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার বড় ভালো লাগে; নিজেকে বড় স্নিগ্ধ ও পবিত্র লাগে। কে যেন তখন খুব কাছে ডাকে! কী যেন এক মধুর সুর হৃদয়ের তারে ঝঙ্কার তোলে, ‘এ চাঁদ যার, এ জোসনা যার, তুমি তাঁর, তিনি তোমার!’ নিজেকে তখন চাঁদের মত উজ্জ্বল, জোসনার মত সিণগ্ধ মনে হয়।
এবার রজবের চাঁদ উঠলো; একফালি চাঁদ পূর্ণিমার চাঁদ হলো; আকাশ থেকে এত আলো, এত জোসনা ঝরলো, কিন্তু আমার জন্য আলোর কোন ইশারা এলো না। কেন এলো না? এমন তো হয়নি!
যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হতো, দুরম্ন দুরম্ন বুকে একটি ডাকের প্রতীক্ষা শুরম্ন হতো এবং .. এবং আমার মাওলার ডাক এসে যেতো! কিন্তু এবার এলো না! পূর্ণিমার চাঁদটা ধীরে ধীরে ছোট হলো, জোসনার আলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো, তবু ডাক এলো না! তবু আলোর কোন ইশারা দেখা গেলো না।
কী হলো? কেন এমন হলো? বান্দার গোনাহ ও গান্দেগি এবং বে-আদবি ও বে-হুরমতির তো কোন শেষ নেই; কিন্তু আল্লাহ তো মাফ করে দেন। তিনি যে ক্ষমাসুন্দর, চিরকরম্নণাময়! তিনি যে- ويعفو عن كثير
তিনি মাফ করেন বলেই তো বান্দা বেঁচে যায়। গলিয-গান্দেগিতে সারা জীবন ডুবে থেকেও পার পেয়ে যায়। তাঁর যদি দয়া না হতো, তাঁর যদি মায়া না হতো, বান্দার তাহলে কী উপায় হতো! তাঁর দয়া, মায়া ও করম্নণা আছে বলেই বান্দার কাছে কালো গিলাফের ডাক আসে এবং আসে সবুজ গম্বুযের আহবান! কিন্তু তিনি যদি ধরে বসেন, কোন অন্যায়-বিচ্যুতি, কোন বে-আদবি ও বে-হুরমতির জন্য পাকড়াও করে বসেন, তাহলে তো বান্দার কোন উপায় থাকে না। এজন্যই তো এত আশা ও আশ্বাসের পরও বান্দার অন্তরে থাকে কিছু আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠা, কিছু ভয়-ভীতি!
রজবের চাঁদ যত ক্ষয় হতে থাকে, আমার মনে ভয় তত বাড়তে থাকে।
প্রথমে আশা ছিলো প্রবল, সঙ্গে ছিলো কিছু উৎকণ্ঠা! রজবের চাঁদ যখন পূর্ণিমা পার হলো, অন্তরে তখন আশা ও আশঙ্কার দোলা একই রকম অনুভূত হলো। পূর্ণিমার চাঁদ যখন ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে লাগলো, শঙ্কা ও আশঙ্কার কালো কালো মেঘে হৃদয়ের আকাশটা ততই যেন ছেয়ে যেতে লাগলো।
একবার ভাবি, সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। দিলের তড়প ও বে-কারারি যখন চরম হবে, মাওলার ডাক তখন অবশ্যই আসবে। ব্যাকুল বান্দার আকুল মিনতি দয়াময় আল্লাহ কি না শুনে পারেন! শেষ পর্যন্ত মেহেরবান মাওলার ডাক না এসে কি পারে!
আবার ভাবি, তিনি তো বে-নেয়ায, বে-মোহতাজ! তিনি তো ‘মাওলা আমার কাদের গনী’! একটি অন্যায়, একটি বিচ্যুতি, আদবের একটি বরখেলাফি যদি তিনি পাকড়াও করে বসেন, তাহলে! আমারও কি পাকড়াও হয়ে গেলো?! আমার কিসমতে কি তবে মাহরূমি নেমে এলো?! হে আল্লাহ! হে মেহেরবান তুমি দয়া করো, তুমি মাফ করো।
আশা ও আশঙ্কার দোলায় এভাবে রজবের দিনগুলো পার হলো এবং পশ্চিম দিগমেত্ম শা‘বানের চাঁদ উঠলো। আমার হৃদয়-আকাশের পশ্চিম দিগমেত্ম তখনো সেই একফালি চাঁদের উদয় হলো না। আসলে বলতে হয়, চাঁদ উঠেছিলো, কিন্তু আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। মেঘের আধারে তাই আমি চাঁদের হাসি দেখতে পাইনি।
কখনো আশা, কখনো নিরাশা, কখনো স্থিরতা, কখনো অস্থিরতা, এভাবে দিন-রাত পার হতে হতে রামাযান এসে গেলো। কিন্তু আল্লাহর ঘরে যাওয়ার কোন উপায় আমার হলো না।
পরিচিত-অপরিচিত কতজনের ডাক আসে। কত জন আমার কাছে বিদায় নিতে আসে! ইহরামের সাদা লেবাসে লাববাইক বলে আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হয়। তাদের চেহারায় অনুরাগের আনন্দের কী উদ্ভাস! কী উচ্ছ্বাস!
রামাযানের তিনচার দিন আগে হঠাৎ কী মনে হলো, বিমানবন্দরে গেলাম। বিমান, বা সউদিয়ার কোন ফ্লাইট ছিলো না। যে দৃশ্য দেখবো ভেবেছিলাম তা হলো না। অসময়ে আসাটা আমারই ভুল। কিন্তু আমি তো ভেবে চিমেত্ম আসিনি! নিজের অজামেত্ম ভিতরের আহবানে এসেছি! হঠাৎ দেখি, সাদা লেবাসে কয়েকজন মানুষ! না না, কয়েক জন ফিরেশতা! মুখে অবশ্য দাড়ি নেই, তা ফিরেশতাদের হয়ত দাড়ি থাকে না। দূর থেকে ফিরেশতাদের দেখে মনের ভিতরে কী যেন হলো! চিন চিন করে একটু যেন ব্যথা! একটু যেন জ্বলন! একটু যেন দহন! কিসের! ঈর্ষার! বঞ্চনার! আমি জানি না। ধীরে ধীরে তাদের কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি আল্লাহর ঘরে যাচ্ছেন?! বোকার মত প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের যেমন জবাব হতে পারে তেমন জবাবই পেলাম। অসন্তুষ্ট হলাম না, তবে ব্যথিত হলাম। তবু তাদের কাছে দু‘আ চাইলাম।
আমার কী মনে হয়, জানো বন্ধু! ঐ দু‘আ চাওয়াটা আল্লাহর পছন্দ হয়েছিলো এবং হয়ত সেজন্যই ভিতরের আমি এভাবে তখন আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলো। সেদিন বিমানবন্দরে ‘জনতার মাঝে নির্জনতা’ কাকে বলে বুঝতে পেরেছিলাম। কত মানুষ ছিলো! কত শোরগোল ছিলো! কিন্তু আমার জন্য কেউ ছিলো না, কোন আওয়ায ছিলো। সেই নীরবতায়, সেই নির্জনতায় আমি যেন একেবারে বিগলিত হয়ে গেলাম! আসলে একটু আঘাতের প্রয়োজন হয় এবং আঘাত যখন আসে তখন শান্ত চিত্তে তা গ্রহণ করতে হয়।
আমি গ্রহণ করলাম। বলা ভালো, আকাশের করম্নণায় আমি তা গ্রহণ করতে পারলাম। সামান্য একটু আঘাতে হৃদয় বিগলিত হলো। জনতার মাঝেও নির্জনতার এবং কোলাহলের মাঝেও নীরবতার আশ্চর্য এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করলো। আমি কাঁদলাম। এমন কান্না, এমন চোখের জল, বহু দিন তা থেকে আমি বঞ্চিত ছিলাম। ভিতরের জ্বলন-দহন সব যেন শীতল হয়ে গেলো। সমর্পিত চিত্তে আমি বললাম, এটাই যদি হয় হে আল্লাহ, তোমার ইচ্ছা, খুশিমনেই আমি তা গ্রহণ করবো। শুধু তুমি যেন আমার প্রতি রাজি-খুশী থাকো হে আল্লাহ!
রামাযান এসে গেলো, আমার ডাক এলো না। এবার বুঝি আল্লাহর ঘরে আর যাওয়া হলো না! ‘আল্লাহর ইচ্ছা’, ভেবে মন একবার শান্ত হয়, ‘নিজের মাহুরূমি’, ভেবে মন আবার হয়ে পড়ে অশান্ত। এভাবে মনের শামিত্ম-অশামিত্ম এবং স্থিরতা-অস্থিরতার মধ্যে যখন চলছে আমার প্রতিদিনের সেহরি-ইফতার তখনো আমি জানি না, কী পরম সৌভাগ্য ‘একটি ফুলের তোড়া’ হয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য! রামাযানের চার কি পাঁচ তারিখে সেহরির সময় সালমান ফোন করলো, আজ ইফতার করবে আমার সঙ্গে। সালমান এলো; সঙ্গে আনলো একটি ফুলে তোড়া। অবাক কা-! ফুল বা ফুলের তোড়া সে তো কখনো আননে না! কী একটা বলতে গিয়ে কী যেন ভেবে বিরত থাকলাম। হাসিমুখেই ফুলের তোড়া গ্রহণ করলাম। তখনো জানতাম না, এ ফুলের তোড়া এ হাত দিয়ে আসলে ‘তিনি’ প্রেরণ করেছেন এবং এ ফুলের তোড়া গ্রহণ করার মাধ্যমে আসলে আমি আমার পরম সৌভাগ্যকেই বরণ করছি! বন্দার প্রতি মাওলা তাঁর ‘বান্দানাওয়াযি’ কতভাবেই না প্রকাশ করেন! শুধু নেককার নয়, গোনাহগার বান্দার প্রতিও। গাফেল বান্দা তবু বোঝে না! তবু তাঁর দরবারে কৃতজ্ঞতায় লুটিয়ে পড়ে না!
সালমান বললো, ‘আমার তিজারতের শরীকদার শহীদুল ইসলাম তার মরহূম আববার হজ্জে বদল করাতে চান। তিনি আমাকে যাবতীয় ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তো আপনি যদি রাজি হন, তিনি খুব খুশী হবেন, আমারও ইতমিনান হবে।’
সুবহানাল্লাহ! ভিখারীকে আমন্ত্রণ, রাজদরবারে, ফুলের তোড়া প্রেরণ করে! এত মায়া, এত আদর, এত সমাদর!
প্রিয় পাঠক! একটি কথা বলতে ইচ্ছে করে তোমাকে। আমার প্রতি, তোমার প্রতি, নেককার-বদকার প্রতিটি বান্দার প্রতি জীবনের বিভিন্ন পর্বে, বিভিন্ন উপলক্ষ বিভিন্নভাবে আল্লাহ তাঁর আদর-মায়া প্রকাশ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, চিন্তার সীমাবদ্ধতায় সবকিছুকে বান্দা ‘স্বাভাবিক’ মনে করে। ফলে মাওলার আদর-সমাদরের যে জান্নাতি স্বাদ, তা থেকে বান্দা বঞ্চিত হয়।
একবারের ঘটনা, আমাদের গ্রামে খুব সাধারণ একজন মানুষ, ভোরের অাঁধারে ফজরের জামাতে শরীক হতে মসজিদে চলেছে। অন্ধকার ছিলো, ঝড়-বৃষ্টি ছিলো এবং পথ ছিলো কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। বেচারা পড়ে গিয়ে জল-কাদায় একাকার! অনেক কষ্টে সে ঘরে ফিরে এলো। কাপড় বদলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার সে রওয়ানা হলো। এ অবস্থায় এমন ‘ঝড়-জল’ মাথায় করে বের হতে তাকে নিষেধ করা হলো।
গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটি, লেখা-পড়া না জানা একেবারে সাধারণ মানুষটি বললো, ‘আলস্নায় যারে আছাড় দেয় তারেই পুরস্কার দেয়। এই আছাড়ের স্বাদ যে কত, তোমরা কী বুঝবা!’
আমার ছাত্র, এক মাদরাসার যিম্মাদার। অর্থনৈতিক সঙ্কটে বেশ পেরেশান ছিলো। একটি বিয়ের দওয়াতপত্র পেলো। তার কিছু সমস্যা ছিলো, তবু এই ভেবে দাওয়াতে শরীক হলো যে, মেযবান খুশী হবেন। সেখানে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা ও পরিচয়। মাদরাসার সঙ্কটের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘সমসত্ম ঋণ আমি পরিশোধ করে দেবো।’ দু’দিন পর তিনি সব ঋণ পরিশোধ করে দিলেন।
আমার ছাত্রদের কাছ থেকে কত সময় কত শিক্ষা যে আমি পেয়েছি! সে বলেছিলো, ‘বান্দাকে আল্লাহ কত ইয্যত করেন! একেবারে দাওয়াপত্র পাঠিয়ে করয আদায় করে দেন!’
প্রিয় পাঠক! এটা যে সাধারণ একটি বিবাহের সাধারণ একটি দাওয়াতপত্র ছিলো না, বরং পেরেশান বান্দার পেরেশানি দূর করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো দাওয়াতপত্র ছিলো, তদ্রূপ আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া এবং জল-কাদায় একাকার হওয়া যে কোন দুর্ঘটনা ছিলো না, বরং আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কার ছিলো এভাবে সবাই কি ভাবতে পারে? সবকিছুতে যারা আল্লাহর দয়া ও দান এবং আল্লাহর আদর-সমাদর অনুভব করতে পারে জীবন তাদের সর্বদা জান্নাতি স্বাদে পরিপূর্ণ থাকে। এই স্বাদ আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে নছীব করেন, আমীন।
ফিরে আসি আগের কথায়। আমি যেখানে ভেবেছি, এবারও বুঝি রামাযানে আল্লাহর ঘরে যাওয়া নছীব হলো না, সেখানে আমার আল্লাহ ওমরার পরিবর্তে একেবারে হজ্বের দাওয়াত পাঠালেন! সুতরাং আমার আনন্দের পরিমাণ কেমন হতে পারে! আর যদি ভাবতে পারি ফুলের তোড়াটি ছিলো মাওলার পক্ষ হতে হজ্বের দাওয়াতপত্র!
হে আল্লাহ, তুমি কত মহান! তুমি কত মেহেরবান!
আনন্দের ‘অভিঘাত’ থেকে যখন কিছুটা আত্মস্থ হলাম তখন শুধু বললাম, আলহামদু লিল্লাহ ওয়া জাযাকুমুল্লাহ। বললাম, আর পরম মমতায় ফুলের তোড়াটিকে আলতো করে চুমু খেলাম।
মাগরিব পড়লাম মাদবরবাজার মসজিদে। এ মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের বহু সুখ-দুঃখের স্মৃতি। দক্ষিণ দিকে প্রথম কাতারের কোণের স্থানটি আমার বড় প্রিয়। জানালার পাশেই কবরসত্মান। এখানে শুয়ে আছেন আল্লাহর কিছু বান্দা; তিনিও যার জমির উপর এ মসজিদ। আল্লাহ তাঁকে এবং মাটির নীচের সমসত্ম মুমিনীন-মুমিনাতকে চিরশামিত্ম দান করম্নন, আমীন।
এই মসজিদে জানালার কাছে আমার প্রিয় স্থানটিতে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে একবার মুনাজাত করেছিলাম আল্লাহর দরবারে। তখন আমি ছিলাম ভীত-সন্ত্রসত্ম, বিপর্যসত্ম ও বিধ্বসত্ম। কারণ, জীবনে আল্লাহর ঘরের প্রথম সফর ছিলো এমনি এক রামাযান মাসে। হযরত হাফেজ্জী হুযুরের আদেশ ছিলো হজ্ব পর্যন্ত আল্লাহর ঘরে থাকার, কিন্তু আমি নির্বোধের মত ফিরে এসেছিলাম মাত্র পাঁচ দিনের মাথায়। এই একটি ভুল যথেষ্ট ছিলো সারা জীবনের মাহরূমির জন্য। কিন্তু মাওলা যে আরহামুর-রাহিমীন! তিনি যে ভালোবাসেন বান্দাকে এবং তার ভুল করাকে, যদি বান্দা অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা করে। আমরা যদি ভুল না করতাম তাহলে তো আল্লাহ আমাদের বিলুপ্ত করে এমন কাউম পয়দা করতেন যারা ভুল করে এবং অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে।
তাই আমার সারা জীবনের মাহরূমির মত ভুলকেও মেহেরবান আল্লাহ মাফ করে দিলেন এবং সে বছরই একেবারে শেষ সময়ে হজ্বের ব্যবস্থা করলেন। লিবিয়া দূতাবাসের পক্ষ থেকে হজ্বের দাওয়াত এলো। আমি আবার ভুল করলাম; সামাজতান্ত্রিক দেশের দাওয়াত মনে করে তা ফেরত দিলাম। প্রাণপ্রিয় মুরম্নবিব হযরত পাহাড়পূরী হুযূরের তিরস্কারে যখন হুঁশ হলো তখন আমার কী যে পেরেশান অবস্থা! কী যে বিপর্যসত্ম দশা! যেন লুণ্ঠিত কাফেলার সর্বহারা এক মুসাফির! তখন আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম এই মসজিদে জানালার পাশে ঠিক এই স্থানটিতে। সেদিনের সেই মুনাজাত ও অশ্রম্নপাত এখনো আমার মনে পড়ে। সেই মুনাজাতের প্রাপ্তি ও তৃপ্তি এখনো আমার অন্তরে প্রশামিত্মর শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। এখানে এসে যখন বসি, নিজের অজ্ঞাতেই ফিরে যাই আমার পঁচিশ বছর আগের জীবনে, আশ্চর্যরকম অশ্রম্নঝরা মুনাজাতের সেই মুহূর্তটিতে। এখানে এসে সেই মধুর স্মৃতি স্মরণ করে এখনো আমি শামিত্ম পাই; এখনো আমার মনে এ সান্তবনা জাগে যে, তুমি যত বড় ভুল করো, অন্যায় করো, যদি অনুতপ্ত হৃদয়ে দু’ফোটা অশ্রম্নজল নিবেদন করতে পারো, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দেবেন। বান্দাকে মাফ করতে তিনি তো কারো পরোয়া করেন না!
মেহেরবান আল্লাহ সেদিন আমার মুনাজাত ও ফরিয়াদ কবুল করেছিলেন এবং আল্লাহর ঘর থেকে বের হয়ে আমি আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। সেদিনই ছিলো ভিসাপ্রাপ্তির শেষ দিন। অবিশ্বাস্য উপায়ে ভিসা হলো এবং এক ঘণ্টা পর আমি আল্লাহর ঘরে ‘উড়াল’ দিলাম।
তখন থেকে প্রতি পাঁছ বছর পর আল্লাহ আমাকে তাঁর ঘরে ডাকছেন। যখনই ডাক আসে, আমি এই মসজিদে দক্ষিণ দিকের এই স্থানটিতে এসে শোকরানা আদায় করি।
এবারও হজ্বে বাইতুল্লাহর দাওয়াত পেয়ে আমি ছুটে এলাম এই মসজিদে আমার এই প্রিয় স্থানটিতে। শামিত্মতে, আনন্দে, প্রশামিত্মতে ও পরিতৃপ্তিতে হৃদয় আমার পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। দয়াময়ের প্রতি শোকরে ও কৃতজ্ঞতায় অন্তর আমার আপস্নুত হলো। তোমার অক্ষম বান্দা কীভাবে তোমার শোকর আদায় করবে হে আল্লাহ! গোনাহগার বান্দাকে তুমি কবুল করো হে আল্লাহ! তোমার ডাকে লাববাইক বলে পাক দিলে তোমার ঘরের চৌকাঠে যেন হাযির হতে পারি সে তাওফীক দাও হে আল্লাহ!
এবং আল্লাহ তাওফীক দান করলেন, এমন ভাবে যা আমার কল্পনায়ও ছিলো না। এমনই হয়। আল্লাহ এমনই করেন। বান্দা যত গোনাহগার, যত সিয়াহকার হোক যখন সে আল্লাহর দয়া ও রহমতের উপর ভরসা করে, আল্লাহর তার আশা পূর্ণ করেন, আল্লাহ তার আব্দার মঞ্জুর করেন, কখনো বিলম্বে, কখনো অবিলম্বে, কখনো দুনিয়াতে, কখনো আখেরাতে।
মধ্যরামাযানে পূর্ণিমার চাঁদ যখন মুঠি মুঠি জোসনা ছড়ায়, সালমান আবার এলো এবং জানতে চাইল, আমার যাওয়া ঠিক আছে কি না? কত কঠিন প্রশ্ন! আমার যাওয়া ঠিক আছে কি না, তা তো আমি জানি না, জানেন শুধু আল্লাহ! আমি তো শুধু নিয়ত করেছি এবং প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে শুরম্ন করেছি। আশা করি, আল্লাহ তাঁর গোনাহগার বান্দার নিয়ত পুরা করবেন। তবে তিনি যা ফায়ছালা করেন তাতেই আমি রাযি, তাতেই আমি খুশী! তিনি যদি বলেন, এসো হে বান্দা, আমার ঘরে এসো! আমি বলবো, লাববাইকা ইয়া রাব, বান্দা হাযির!
সব ইনতিযাম হয়ে যাওয়ার পর তিনি যদি বলেন, এবার থাক বান্দা! আমি বলবো, আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা হে আল্লাহ! আমি তো শুধু চাই আপনার সন্তুষ্টি!
আমি কী করে বলবো, আমার যাওয়া ঠিক আছে কি না? মাওলার ফায়ছালা তো তিনি ছাড়া কেউ জানে না! এমনও তো হতে পারে, শেষ মুহূর্তে সবকিছু তিনি থামিয়ে দিলেন! হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ক্ষেত্রে যেমন হলো এই তো কয়েক বছর আগে। কাফেলা তৈয়ার হলো, সমসত্ম ইনতেযাম সম্পন্ন হলো। কিন্তু হঠাৎ করে সউদী হুকূমত হজ্বের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পেলো এবং এমন মানুষকেও ভিসা দিতে অস্বীকার করলো! এখনো আমার কানে বাজে তাঁর সেদিনের সেই কথাটি, ‘যালিমের বিচার আল্লাহ করবেন, আমি আল্লাহর ফায়ছালা মেনে নিলাম। তারা শুধু আমার জিসিমকে রম্নখতে পারবে, আমার দিলকে নয়।’
আবার এমন হওয়াও কি অসম্ভব যে, ঘরের পরিবর্তে ঘরওয়ালা নিজেরই কাছে ডেকে নিলেন! কত বার কতজনের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, দূর অতীতে এবং নিকট অতীতে!
গত বছর কী হলো! আল্লাহর এক বান্দী ঢাকা বিমানবন্দরে ঠিক বিমানে আরোহণের মুহূর্তে ইহরামের অবস্থায় বিমানের সিঁড়িতে মৃত্যুবরণ করলেন!
আমি কীভাবে বলবো, আমার যাওয়া ঠিক আছে কি না? মনের ঢেউ মনেই গোপন রেখে সালমানকে শুধু বললাম, দু‘আ করো, আল্লাহ যেন তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী সবকিছু করার তাওফীক দান করেন। আল্লাহর রিযা ও সন্তুষ্টিই হলো মুমিনের যিন্দেগির মাকছূদ।
হৃদয়ে আনন্দের প্রবাহ এবং কলবে খুশির মউজ নিয়ে বিশে রামাযান সন্ধ্যায় ই‘তিকাফে বসলাম। আমার জীবনের অল্প ক’টি ই‘তিকাফের মধ্যে এমন শামিত্ম ও প্রশামিত্মর ই‘তিকাফ খুব কমই নছীব হয়েছে। সুদূর বাংলাদেশের এক মসজিদে বসেও মনে হয়েছে, আমিও আছি মসজিদুল হারামে আল্লাহর ঘরের সামনে! মনের কল্পনায় লক্ষ মানুষের তরঙ্গে মিশে গিয়ে আমিও তাওয়াফ করছি আল্লাহর ঘর!
জীবনে কখন যে কী হবে! সুখের বা দুঃখের, কখন যে কোন্ ঘটনা ঘটবে, কেউ কি তা বলতে পারে?! এমন আনন্দের মধ্যে হঠাৎ যেন একটি সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো! নিজের সঙ্গে করা একটি ওয়াদার কথা মনে পড়ে গেলো।
বিগত আওয়ামী আমলে দেশের আলেমসমাজ যখন .... তখন একপর্যায়ে মারকাযে ইসলামীর প্রধান, মুফতি শহীদুল ইসলামকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। কারানির্যাতন অবশ্য রাজনীতির অনিবার্য উপসর্গ, তাতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাই সাঈদ মেছবাহ, রাজনীতির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক! সে তো শুধু মারকাযে কাজ করতো এবং ঐ রাত্রে সেখানে উপস্থিত ছিলো। শুধু এই কারণে মুফতী শহীদুল ইসলামের সঙ্গে তাকেও কারাগারে যেতে হলো। আম্মা-আববার জন্য ঐ দিনগুলো ছিলো চরম কষ্টের ও বেদনার। আমার ভাই আমার অনিচ্ছায় মারকাযে যোগ দিয়েছিলো, কিন্তু যখন বিপর্যয় নেমে এলো তখন সবকিছু আমাকেই বহন করতে হলো। এমন দিন আল্লাহ যেন আর কখনো না দেখান, আমীন।
দীর্ঘ সাত মাস অনেক ঝড়-ঝাপটা গেলো এবং বহু দৌড়-ঝাঁপের পর মুফতি শহীদুল ইসলাম মুক্তি লাভ করলো এবং আমার ভাইও ছাড়া পেলো। মুফতি শহীদ কয়েক দিনের মধ্যেই ওমরার ছফরে আল্লাহর ঘরে চলে গেলো, কিন্তু কারাগারের সঙ্গীকে সঙ্গে নেয়ার কথা তার মনে হলো না।
মুফতি শহীদ আমার প্রিয় ছাত্র। তার গুণ ও যোগ্যতার আমি কদর করি। কিন্তু তার এ আচরণ আমার জন্য ছিলো বড় কষ্টের কারণ। অন্তত আমি তার স্থানে হলে এটা করতাম না, করতে পারতাম না। শুধু আমার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে যাকে এত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তাকে আমি ভুলতাম না, ভুলতে পারতাম না। মুফতি শহীদ এর পরো অনেক বার আল্লাহর ঘরে গিয়েছে, কিন্তু আমার ভাইয়ের কথা তার মনে পড়েনি। এটা আমাকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছিলো। কত সহজেই আমরা কত কিছু ভুলে যাই, যা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়; আবার কত সামান্য বিষয় সারা জীবন আমরা মনে রাখি, যা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের স্মৃতি ও বিস্মৃতি দু’টোই বড় অদ্ভুত!
যাই হোক, সেদিন মনে মনে আমার এই প্রতিজ্ঞা ছিলো, আল্লাহ তাওফীক দিলে ভাইকে আমি আল্লাহর ঘরে পাঠাবো। তার পর কয়েক বছর পার হলো। এর মধ্যে দু’বার আল্লাহর ঘরে আমার যাওয়া হলো, কিন্তু নিজের সঙ্গে করা সেই ওয়াদা পুরা করার তাওফীক হলো না, আমার ভাইয়েরও সউদী আরব ছেড়ে আসার পর আল্লাহর ঘরে যাওয়ার সুযোগ হলো না।
এবার ই‘তিকাফের অবস্থায় হঠাৎ মনে হলো, এই হজ্বে বদলে আমি তো আমার ভাইকে পাঠাতে পারি! তাহলে তো বহু দিনের সেই আত্মপ্রতিজ্ঞা রক্ষা হয়, আমার ভাইয়েরও যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ নছীব হয়!
আবার অন্যরকম ভাবনাও মনকে পেরেশান করলো; পাঁচ বছর পর আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের এবং ঊনিশ বছর পর হজ্বে বাইতুল্লাহর এই যে গায়বি ইনতিযাম, এটা গ্রহণ না করা কি ঠিক হবে? আমি ভুল চিন্তা করছি না তো? আমার তো নির্বুদ্ধিতার পূর্বইতিহাস রয়েছে!
অদ্ভুত এক দোদুল্যমনতায় পড়ে গেলাম। একবার ভাবি, আমিই যাই। আল্লাহর ঘরে গিয়ে আমার ভাইয়ের জন্য দু‘আ করি, তাকেও যেন আল্লাহ তাওফীক দান করেন।
আবার ভাবি, কত বছর হলো আমার ভাই আল্লাহর ঘর দেখেছে! আমার উছিলায় যদি তার এ সৌভাগ্য হয়, কত ভালো হয়! আল্লাহ যদি কবুল করেন, আমারও ডাক আসতে পারে; এবার না হলে আবার, আবার না হলে অন্যবার!
বড় কষ্টকর এক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! এর মধ্যে স্বপ্নে দেখি; আমি ইহরামের লিবাস পরেছি, আবার একজনকে ইহরাম ধারণে সাহায্য করছি। ঘুম থেকে জেগে মনে হলো, আমি আসমানের ইশারা পেয়ে গেছি! এই হজ্বে বদলে আমার ভাই যাক। ইনশাআল্লাহ এর মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি।
হে আল্লাহ! আমার শাওক ও মুহববতের কথা তুমি জানো। তোমার ঘর তাওয়াফের জন্য, ছাফা-মারওয়ার দৌড়ের জন্য; মিনা, আরফা, মুযদালিফার অকূফের জন্য এবং তোমার পেয়ারা হাবীবের রওযা শরীফের যিয়ারাতের জন্য দিল আমার বে-চায়ন, বে-কারার! কিন্তু হে আল্লাহ! আমার ভাইয়ের কথা তুমি জানো। তার খুশির জন্য নিজের খুশি আমি কোরবান করতে চাই। তাতে কি তুমি খুশী হবে না হে আল্লাহ?!
এই মুনাজাতের পর আমার দিলে পূর্ণ সুকূন ও সাকীনা এসে গেলো। আমি স্থির সিদ্ধামেত্ম পৌঁছলাম যে, এটাই আমার কর্তব্য এবং এটাই আমি করবো।
শবে কদরে সালমান মসজিদে এলো দেখা করতে। কথাটা তাকে বললাম। সে খুব অবাক হলো, তবে মুখে কিছু বললো না। আমার ইচ্ছার উপর কিছু না বলারই সে চেষ্টা করে। কিন্তু তার চোখের চাহনিতে বেদনার ছাপ ছিলো সুস্পষ্ট। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, অনেক চিন্তা-ভাবনার পরই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আশা করছি, এতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে।
সে বললো, যদিও আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তবু আপনি যা বলবেন সেভাবেই হবে। সে আরো কিছু কথা বললো, আর আমি তার মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে দিলাম।
‘শবে কদর’ যারা বুঝতে পারে, ‘সৌভাগ্যের’ রাত যারা চিনতে পারে, কেমন হয় সে রাতে তাদের হৃদয়ের আনন্দা-জোয়ার! তাদের দিলের মৌজ-বাহার! আমাদের না আছে সেই জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান, না আছে সেই দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি! আমরা শবে কদর চিনি সাতাশ তারিখ দিয়ে। সেটুকুই যদি মেহেরবান আল্লাহ কবুল করে নেন!
এবার সাতশ তারিখের রাতটি আমার জন্য ছিলো বড় শামিত্মর, বড় প্রশামিত্মর! আকাশের তারারা যেন আমার সঙ্গে কথা বলেছে! শেষ রাতের অসত্মপ্রায় চাঁদটি যেন আমাকে একটু হাসি উপহার দিয়েছে! আমার মন বলেছে, করম্নণার শিশিরে সে রাতে আমি সিক্ত হয়েছি। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
***
রামাযান বিদায় নিলো। ঈদের আনন্দ নিয়ে শাওয়ালের চাঁদ উঠলো। সেই চাঁদ দেখে কেন জানি আমার খুব কান্না পেলো। শাওয়ালের চাঁদ পঁচিশ বছর আগে একবার কাঁদিয়েছে, আজ আবার কাঁদালো; তবে দুই কান্নায় পার্থক্য ছিলো। সেদিন ছিলো অনুতাপের কান্না, আজকের কান্না ছিলো হৃদয়ের প্রশামিত্মর! আজকের কান্না ছিলো যেন আকাশ থেকে ঝরা শিশির!
ঈদের আনন্দ আমার জীবনে আগে যাই ছিলো, এখন আছে শুধু মায়ের হাতে ফিরনি-শেমাই। সেই আনন্দের স্বাদটুকু গ্রহণ করার সময় আম্মাকে বিষয়টি খুলে বললাম।
সব শুনে আম্মা নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর যা বললেন তাতে যেমন ছিলো মাতৃহৃদয়ের মমতা তেমনি ছিলো ‘মা কে দিল কী দু‘আ’। আর এটাই আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ!
দু’দিন পর সাঈদকে নিয়ে আম্মার সামনে বসলাম। আগে কখনো বলিনি, কাউকে না। এই প্রথম আমার ভাইকে বললাম, মুফতি শহীদ যে তোমাকে ফেলে আল্লাহর ঘরে গেলো তাতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো। তখন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেভাবেই পারি, তোমাকে আল্লাহর ঘরে পাঠাবো। আমার সামনে এখন সেই সুযোগ এসেছে। তুমি যদি রাজি হও তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার হজ্বের ব্যবস্থা হতে পারে।
আমার কথা শুনে সাঈদ শুধু বললো, ‘আগের দিকে হলে আমার জন্য ভালো হয়, যাতে হজ্বের পরেই ফিরে আসতে পারি।’
আমি বললাম, এখন তো কাফেলার মাধ্যমেই তারিখ হয় এবং সে হিসাবেই যেতে হয়। তাছাড়া সময় যা আছে তাতে হয়ত আগের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবু আমি চেষ্টা করবো।
সাঈদ রাজি হলো, আমি খুশি হলাম এবং আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। আমার এ ভাইটির আমার উপর কিছু ইহসান আছে। এখন আমি যদি তার হজ্বে বাইতুল্লাহ সামান্য একটু ওছিলাও হতে পারি, নিজের জন্য সৌভাগ্যই মনে করবো।
আমার স্ত্রী-পুত্র কন্যারা শুনে যদিও অবাক হলো তবে আমার প্রতি তাদের আস্থা ছিলো যে, যা কিছু করছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করছি এবং ইনশাআল্লাহ তাতেই খায়র হবে।
সব ঠিকঠাক হলো। আমি আমার প্রিয় বন্ধু মাওলানা ইয়াহয়া জাহাঙ্গিরকে বললাম, আমার পরিবর্তে সাঈদকে তোমার কাফেলায় পাঠাবো ঠিক করেছি। সব শুনে সেও অবাক হলো এবং সেণহ-তিরস্কারে মিশিয়ে অনেক কিছু বললো। বলারই কথা। ঊনিশ বছর পর একটা সুযোগ এলো দু’জনের একসঙ্গে হজ্ব করার। সেটাও আমি হাতছাড়া করছি। তবে তার শেষ কথাটি ছিলো, ‘তোমার চিন্তা-ভাবনা বোঝার সাধ্য আমার নেই। তবে এটা জানি যে, তুমি চিন্তা ছাড়া কিছু করো না। ঠিক আছে, তাই করো।’
একেবারে শেষ তারিখে সাঈদকে আবার জিজ্ঞাসা করে তার নামে টাকা জমা দিলাম এবং স্বসিত্ম লাভ করলাম যে, আল্লাহর ইচ্ছায় বিষয়টির একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি হলো। কিন্তু কয়েকদিন পর আমি যখন নিশ্চিত এবং নিশ্চিন্ত তখন হঠাৎ, শুধু হঠাৎ নয়, একেবারে অকস্মাৎ আম্মার মাধ্যমে জানলাম, সাঈদের হজ্বে যাওয়ার অন্য ব্যবস্থা হয়েছে। তার সম্পর্কে আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
ইয়া রাব, এখন তাহলে কী হবে?! ‘আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই’, সে তো ভালো কথা। আমার চাওয়া তো শুধু এইটুকু যে, যেভাবেই হোক, আল্লাহর ঘরে তার যাওয়া হোক।
কিন্তু এখন হজ্বে বদলের কী উপায় হবে?
আল্লাহর হিকমত আল্লাহ জানেন। এত বছর আমার ভাইয়ের কোন ব্যবস্থা হলো না, এবারই হলো! তাও একেবারে শেষ তারিখে তার নামে টাকা জমা দেয়ার পর!
সত্যি কথা যদি বলি, আমি কষ্ট পেলাম। কিন্তু আমি তো জানতাম না, আমরা কেউ জানি না, তাকদীর আমাদের জন্য কী লিখে রেখেছে! তবে এই বিশ্বাসটুকু রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য যে, যা কিছু হয় শেষ পর্যন্ত আমাদের ভালোর জন্যই হয়।
আম্মা বললেন, ‘আমি দু‘আ করি, তুই নাম পরিবর্তন করে নিজের জন্য চেষ্টা কর’।
বলতে যাচ্ছিলাম, ‘এখন শেষ মুহূর্তে কীভাবে তা সম্ভব’? বলতে বলতেও থেমে গেলাম। ভাবলাম, মা যখন দু‘আ করছেন, চেষ্টা তো করে দেখি; মায়ের দু‘আয় সন্তানের ভাগ্য খুলে যেতে কতক্ষণ!
হে আল্লাহ, তোমার হিকমত ও রহস্য বোঝবে, সে সাধ্য বান্দার কোথায়?! হে আল্লাহ, তোমার কুদরত তো অনেক দেখেছি আমার এই গোনাহগার যিন্দেগিতে; এবার নতুন করে দেখাও না তোমার কুদরতের নতুন কোন কারিশমা।
জানতাম, অনেক দেরী হয়ে গেছে। দৃশ্যত এখন করার কিছু নেই। তবু বন্ধু মাওলানা ইয়াহয়া জাহাঙ্গিরকে নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিতে যোগাযোগ করলাম। তারা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং পূর্ণ সৌজন্য রক্ষা করে, যা আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এখন করার কিছু নেই। কারণ ছবিসহ কাগজপত্র চলে গিয়েছে ঐ নামে। সুতরাং এখন অন্য নামে অন্য কেউ যেতে পারে না।
ট্রাভেল এজেন্সির দফতর থেকে যখন বের হচ্ছি, আমার চোখ থেকে তখন অঝোরে অশ্রম্ন ঝরছে। কেমন বিপদ হলো! সালমানকে কী বলবো?! যারা হজ্বেবদলের দায়িত্ব দিয়েছে তাদেরই বা কী বুঝ দেবো?! যেন অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম! চারদিকে শুধু অন্ধকার!
বন্ধু জাহাঙ্গির, কোথায় একটু সান্তবনা দেবে, না, উল্টো তিরস্কারে তিরস্কারে আরো পেরেশান করে তুললো। আমি চুপ করে থাকলাম। এ ছাড়া কীই বা করার ছিলো!
খুব ইচ্ছে করছিলো, জাহাঙ্গির যদি আমাকে একটু কামরাঙ্গির চরে পৌঁছে দিয়ে যেতো, কিন্তু মুখ ফুটে বললাম না। এত তিরস্কার শুনে আর বলতে ইচেছ করলো না। তবে সে নিজে যদি বলতো, খুশী হতাম।
সে চলে গেলো তার বাসায়; আমি রওয়ানা হলাম আমার ঠিকানায়। একা একা মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিলো, তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই।
মুখের ভাষা যখন হারিয়ে যায়, মনের ভাষা তখন প্রাণ ফিরে পায়। আমাদের মসজিদে আমার সেই প্রিয় স্থানটিতে এসে আবার দু’হাত তুলে মুনাজাত করলাম। ‘হে আল্লাহ, যা কিছু হলো, আমি জানি না কেন হলো? আমি তো আমার ভাইয়ের কল্যাণ চেয়েছি! এখন তুমি আমাকে উদ্ধার করো হে আল্লাহ! তুমি যদি বান্দাকে তোমার ঘরে নিতে চাও তাহলে দুনিয়ার কোন নিয়ম-কানুন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না! সুতরাং তুমি ইচ্ছা করো হে আল্লাহ! পাঁচ বছর তো হয়ে গেছে হে আল্লাহ! আমি না হয় ভুল করেছি, কিন্তু তুমি তো হে আল্লাহ, বান্দার ভুল মাফ করতে পারো। মাফ করা এবং দয়া করাই তো তোমার শান! তুমি যে গফুরম্নন-রাহীম!’
একটা করে দিন পার হয়, আর আমার বুকের ‘ধুকধুকানি’ আরো বাড়ে।
কয়েকদিন পর, যখন আশার শেষ আলোটুকুও নিভে গেছে, তখন প্রিয় বন্ধু জাহাঙ্গিরের ফোন এলো। তার কণ্ঠস্বরের উচ্ছ্বাসে আমার বুকটা কেমন করে উঠলো! ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে যাবো, তার আগেই সে বললো, ‘আবু! তোমার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেছেন, তোমার ডাক এসে গেছে!
ডাক এসে গেছে! আলহামদু লিল্লাহ!
‘আবু’ এই ডাকটা ওর মুখে শুনি ত্রিশ বছরের বেশী; বড় ভালো লাগে; আজ লাগলো বড় মধুর! আবেগের উচ্ছ্বাসে, আনন্দের তরঙ্গে আমি তখন আত্মহারা! ‘আলহামদু লিল্লাহ’ ছাড়া আর কিছু উচ্চারণ করা সম্ভব হলো না। রিসিভার ধরে শুধু বসে থাকলাম। জাহাঙ্গির বললো, কী, এত বড় খোশখবর শুনালাম, মিঠাই খাওয়াবে না!
মানুষ কেন যে ‘মিষ্টি’র মত মিষ্টি শব্দটি বাদ দিয়ে ‘মিঠাই’ বলে ভেবে পাই না। যাক, আমি বললাম, এমন সুসংবাদে শুধু মিষ্টি! ইনশাআল্লাহ, যামযামের পাড়ে তোমাকে প্রাণভরে যামযাম পান করাবো।
আহ! আবার তাহলে তৃষ্ণার্ত প্রাণ শীতল হবে যামযামের সুশীতল পানিতে!
ট্রা্ভেল এজেন্সির মালিক মাওলানা রফীক ও মাওলানা বশীর, দু’জনই আমার বন্ধু ইয়াহয়া জাহাঙ্গিরের ছাত্র। সে তাদের জিজ্ঞাসা করলো, এ অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হলো? তারা বললেন, আমরা তো নিশ্চিত ছিলাম যে, এখন আর কিছু হওয়ার আশা নেই। তবু আপনাকে যেন ‘চেষ্টা করেছি’ বলতে পারি, সে জন্য একটা ফেক্স করলাম, আর আমাদের অবাক করে দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, ‘আজকের মধ্যে হলে হতে পারে’।
আসলে আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন, কোন কিছু তখন অসম্ভব থাকে না, আর আল্লাহ যখন ইচ্ছা না করেন, কোন কিছু তখন সম্ভব হয় না। সম্ভব ও অসম্ভব, এদু’টি হলো আল্লাহর ইচ্ছার দুই প্রামেত্মর নাম। যেমন হাদীছ শরীফের দু‘আয়া বলা হয়েছে-
اللهم لا مانع لما أعطيت و لا معطي لما منعت
হে আল্লাহ, তুমি যা দান করো তা রোধ করার কেউ নেই; আর তুমি যা রোধ করো তা দান করার কেউ নেই।
***
বিমানবন্দরের পাশে আশকোনায় আমাদের স্থায়ী ‘হাজীক্যাম্প’। হাজী শব্দটির সঙ্গে তাঁবু শব্দটি বেশ মানিয়ে যেতো। কিন্তু কেন জানি সুযোগ পেলে ইংরেজি শব্দ ছাড়া আমাদের তৃপ্তি হতে চায় না। তাই তো সফরের এই প্রামেত্ম ঢাকায় হলো হাজীক্যম্প, আর ঐ প্রামেত্ম জিদ্দায় হলো হজ্বটার্মিনাল। এই দেখো, অভ্যাসের দোষে আবার শব্দের পিছনে পড়ে গেলাম! আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, টীকা গ্রহণের কথা। ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ওখানে ছিলাম। শুধু টীকাগ্রহণের জন্য হলে বলা যায়, লম্বা সময়, আর হজ্বের দীর্ঘ সফরের প্রারম্ভ বিবেচনা করলে বলতে হয়, সামান্য সময়। তো এই দীর্ঘ সময়ে, কিংবা এই সামান্য সময়ে যা কিছু দেখেছি, শুনেছি; যা কিছু অনুভ করেছি এবং শিক্ষা গ্রহণ করেছি তা সবই লেখার মত বিষয়। সবার জন্যই তাতে রয়েছে শিক্ষার উপকরণ। সেখানে দেখেছি কিছু মানুষের বিনয়, সংযম, আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর ঘরের প্রতি আশ্চর্য প্রেমব্যাকুলতা। দেখেছি আর ভেবেছি, আমি কেন হতে পারি না এমন! আবার দেখেছি অনেকের অনেক কিছু। দেখেছি আর ভেবেছি, মানুষ এমন হয় কেন?! যাদের সামনে রয়েছে আল্লাহর ঘরের দীদার এবং যিয়ারাতে মদীনার সৌভাগ্যের হাতছানি তাদের আচরণে উচ্চারণে কেন থাকবে না একটু বিনয়, একটু সংযম! ত্যাগ ও আত্মত্যাগের কিছু সৌন্দর্য! বলতে তো ইচ্ছে করে অনেক কিছু, কিন্তু এখানে আমি আল্লাহর ঘরের দুই মুসাফিরের দু’রকমের দু’টি ঘটনা বলেই ক্ষান্ত হবো। যোহরের নামায পড়লাম হাজীক্যাম্পের মসজিদে। সুন্দর মসজিদ। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন ও ভাবগম্ভীর। এখন আবার মসজিদের পবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাজীদের ইহরামের শুভ্রতা। আল্লাহর ঘরে আজকে যাদের রওয়ানা তাদের অনেকে ইহরামের লেবাসে হাযির হয়েছেন জামাতে। তাদেরই একজনের পাশে নামায পড়তে কী যে শামিত্ম ও প্রশামিত্মর অনুভূতি হলো! একজন ফিরেশতার পাশে একজন মানুষ, কেমন লাগে ভাবতে! আর ফিরেশতাটির আচরণ যদি হয় ফিরেশতারই মত! মুখের দাড়ি যদি হয় ঠিক কাশফুলের মত!
নামাযের পর দু‘আ চাইলাম। ওমা! চাইলাম দু‘আ, আর পেলাম ঝরঝর কান্না! একটু স্থির হয়ে বললেন, ‘জীবনে কত গোনাহ করেছি। এখন তো হায়াত শেষ। আল্লাহর ঘর ‘দেখন’ কি হায়াতে ‘কুলাইব’! বাবা, আপনে আমার জন্য দু‘আ করেন, আলস্নায় যেন্ আমারে কবুল করে।’
আছরের পর ক্যাম্প থেকে বের হবো, দেখি মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে দেখি, ফিরেশতার মত সেই মানুষটি, যোহরের জামাতে যার পাশে দাঁড়িয়েছি, ‘আল্লাহর ঘর দেখন কি হায়াতে কুলাইব’ বলে যাকে অমন করে কাঁদতে দেখেছি, তিনি শুয়ে আছেন জানাযার খাটে!
দ্বিতীয় ঘটনাটি থাক আর! জীবনে যা কিছু সুন্দর ও প্রীতিকর, আমি তাই শুধু বলতে চাই; যা অসুন্দর ও অপ্রীতিকর তা বলে আমারই বা কী লাভ, পাঠকেরই বা কী উপকার?
***
সময় যখন আরো ঘনিয়ে এসেছে তখন খুব উদ্বেগজনক খবর এলো। বাড়ী ভাড়া নিয়ে নাকি গুরম্নতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগের বছর ভবন-ধ্বসে কিছু হাজীর মর্মামিত্মক মৃত্যু ঘটেছিলো। তাই সউদী সরকার এবার বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ কোন বাড়ীর অনুকূলে ছাড়পত্র দিচ্ছে না। এদিকে বাংলাদেশী এজেন্সিগুলোর চেষ্টা থাকে, যত কম ভাড়ায় বাড়ী পাওয়া যায়। মাঝখানে আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের হয় বিপদ-পেরেশানি। এখন প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শুধু ঘর ভাড়া না হওয়ার কারণে অনেকের হজ্ব থেকে বাদ পড়ার। আমাদের কাফেলাও পড়েছে সে আশঙ্কার মধ্যে। কারণ আমাদের ট্রাভেল এজেন্সি এখনো ‘তাছরীহা’ বা ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে পারেনি। আসলে বাইতুল্লাহর শুরম্ন থেকে শেষ পর্যন্ত যত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিপদ-পেরেশানি আসে, সেগুলোর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে, বাইতুল্লাহর মুসাফিরকে তারবিয়াত করা, যেন প্রতিমুহূর্ত সে আল্লাহর অভিমুখী এবং আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী থাকে। কিন্তু আমাদের তো অব্যবস্থার শেকায়েত করতে করতেই অন্য কিছু ভাবার অবসর থাকে না।
***
এখন কাফেলা বলতে যা বোঝায়, আমাদের কাফেলা অবশ্য তা নয়। আমার প্রিয় বন্ধু মাওলানা ইয়াহয়া জাহাঙ্গির, আল্লাহর অনেক বান্দা তাকে মুহববত করেন। তারা তার সঙ্গে হজ্ব করতে চান। কারণ হজ্বকে তিনি একটি ইবাদত মনে করে হাজীদের যথাসাধ্য খিদমত করেন এবং সকলের ‘যথাযথ’ হজ্ব আদায়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। এজন্য হাজীদের থেকে কোন আর্থিক সুবিধা তিনি গ্রহণ করেন না। এ বছরও এভাবে বার-তেরজন তার সঙ্গী হয়েছেন হজ্ব আদায়ের জন্য। এরাই হলো তার কাফেলা। আমিও শরীক হয়েছি সেই কাফেলায়।
বিশে ডিসেম্বর হলো হলো আমাদের কাফেলার রওয়ানা হওয়ার তারিখ। মাত্র আছে সাত দিনি। তাই আমি প্রস্ত্ততি গ্রহণে মনোযোগী হলাম। প্রস্ত্ততি মানে ভিতরের প্রস্ত্ততি। বাইরের প্রস্ত্ততি ও উদ্যোগ-আয়োজন তো আমরা সবাই গ্রহণ করি এবং প্রয়োজন থেকে বেশীই করি। হজ্বের সফরের যেটা প্রকৃত প্রস্ত্ততি, তথা হৃদয় ও আত্মার প্রস্ত্ততি এবং কলব ও রূহের তৈয়ারি, সেবিষয়ে আমাদের খুব কমই খেয়াল থকে। হজ্বের আহকাম ও মাসায়েল এবং হাকীকত ও ফাযায়েল বলতে গেলে কিছুই আমাদের জানা থাকে না। আমরা জানি না, কেন হজ্ব করবো এবং কীভাবে করবো? এ দীর্ঘ সফর কীভাবে অতিবাহিত করবো? কীভাবে আল্লাহর ঘরের হক আদায় করবো এবং যিয়ারাতে মদীনার আদাব রক্ষা করবো? ফলে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হজ্বের সফর তো আমরা করি এবং যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করি, কিন্তু হজ্বের হাকীকত ও ফযীলত থেকে মাহরূম থাকি। এমনকি এমনও দেখা যায়, হজ্বের ফরযও অনেকের আদায় হয় না। এটা খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে কর্তব্য বা দায়-দায়িত্ব যাই বলি, আমাদের আলেম-সমাজেরই বেশী। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যেন সচেতনতা সৃষ্টি হয়, হজ্বের আহকাম ও মাসায়েল এবং হাকীকত ও ফযায়েল সম্পর্কে তারা যেন অবহিত হয় সে বিষয়ে আমাদেরই যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হওয়া অতী জরম্নরি। সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগেরও বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। আগে তো হজ্বপ্রশিক্ষণ নামে কোন কিছু ছিলো না; এখন কোন কোন আলিমের উদ্যোগে সামান্য কিছু হচ্ছে, তবে মানে ও পরিমাণে সমেত্মাষজনক পর্যায়ে পৌঁছতে এখনো অনেক দেরী। এটা হওয়া দরকার আরো ব্যাপক, আরো গভীর এবং আরো সুদূরপ্রসারী। খুব কাছের এক মাওলনা ছাহেবকে হারাম শরীফে বসে বলেছিলাম, অন্যসব কাজ রেখে আপনি ঢাকায় ‘মাদরাসাতুল হুজ্জাজ’ নামে একটি (আবাসিক) মাদরাসা করম্নন। সেখানে একচিলস্না, তিনচিলস্না এবং একসালের হজ্ববিষয়ক নেছাবের মাধ্যমে তালীম-তারবিয়াত হবে, যাতে ‘পরিপক্ব হাজী ছাহেব’ হয়ে একজন মানুষ আল্লাহর ঘরে হজ্বের সফরে যেতে পারে। এরকম একটি নমুনা-মাদরাসা কায়েম হয়ে গেলে অনেকেই তা অনুসরণ করবে এবং ইসলামের চার ইবাদতের মধ্যে সবচে’ মজলুম এই ইবাদতটি ইনশাআল্লাহ তার আসল হাকীকত ও রূহ ফিরে পাবে। এ বিষয়ে মাওলানা ছাহেবের সঙ্গে দীর্ঘ ও বিশদ আলোচনা হয়েছিলো। আল্লাহ যেন তাকে এবং কাউকে না কাউকে তাওফীক দান করেন, আমীন।
***
ওলামায়ে উম্মত লিখেছেন, হজ্বের পাথেয় বা রাহাখরচ যেন হালাল উপার্জন থেকে হয় এবং হজ্বে রওয়ানা হওয়ার আগে বান্দার যে সকল হক আমার কাছে রয়েছে তা যেন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। বান্দার হক আদায় না করা হলে হজ্ব হয়ত আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু হজ্বের হাকীকত, ফযীলত ও মরতবা হাছিল হওয়া কঠিনই বটে। ঘটনা বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর এক বান্দা জনৈক বুযুর্গের খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলো, হযরত, আমি হজ্বের নিয়ত করেছি। দু‘আ করম্নন, আল্লাহ যেন হজ্বে মাবরূর নছীব করেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী তোমার বোনদের প্রাপ্য মীরাছ আদায় করেছো? সে বললো, না, এখনো করা হয়নি।
তিনি বললেন, মিয়াঁ, এখনো করা হয়নি, তাহলে আর কবে করা হবে? যাও, আগে বোনদের মীরাছ আদায় করো, তার পর তাওফীক হলে হজ্ব করো।
লোকটি আরয করলো, হযরত, বোনদের মীরাছ আদায় করার পর তো আমার কাছে হজ্বের রাহাখরচ থাকবে না!
তিনি বললেন, ‘মিয়াঁ, তাহলে তো তোমার উপর হজ্ব ফরযই হয়নি!’
আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন, যারা খুব দরদ দিয়ে, মুসলমান ভাইয়ের প্রতি ‘নছীহত’ ও হিতাকাঙক্ষার নিয়তে কথা বলেন। তাদের সহজ-সরল ও সাদামাটা কথাও অন্তরে আলোড়ন ও জীবনে বিপস্নব সৃষ্টি করে। এটা তখন ছিলো, এখনো কিছু আছে। সামনেও কিছু না কিছু থাকবে।
এখানেও তাই হলো। আল্লাহর ঐ বান্দা বোনদের প্রাপ্য মীরাছ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আদায় করলো। তার পর প্রায় খালি হাতে পায়দল সফরে রওয়ানা হয়ে গেলো। কারণ রাহাখরচ যোগাড় হওয়ার জন্য ইনতিযার করার মত দিলের অবস্থা তার ছিলো না।
শেষ পর্যন্ত আল্লাহর বান্দা হজ্ব করলো এবং মক্কা শরীফেই তার ইনতিকাল হলো।
পরে ঐ বুযুর্গ তাকে স্বপ্নে দেখেন, এক শানদার বালাখানায় সে বসে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী অবস্থা? সে বললো, হযরত, আমি আপনার নছীহত মত বোনদের মীরাছ আদায় করে পায়দাল হজ্ব করেছি। কারণ আমার কাছে রাহাখরচ ছিলো না, আর দিলের তড়প ও বে-কারারির কারণে ইনতিযার করাও সম্ভব ছিলো না। হজ্বের পরেই আমার ইনতিকাল হয়। এ বালাখানা হলো আমার সেই পায়দাল হজ্ব। আমাকে বলা হয়েছে, তুমি যদি তোমার বোনদের মীরাছ আদায় না করে হজ্ব করতে, আর ঐ অবস্থায় মারা যেতে তাহলে তোমার হজ্ব কবুল হতো না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)