রমযান ১৪৪৫   ||   মার্চ ২০২৪

মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী রাহ.
উপমহাদেশের ইলমী ও দাওয়াতী ইতিহাসের এক জীবন্ত লাইব্রেরি
[জন্ম : ২৯ মে ১৯৪২, ওফাত : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ঈসাব্দ]

ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল

১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ছিল শুক্রবার। প্রিয় একজন মানুষ অসুস্থ। তাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে যেতে হল শহরে। রোগ অজানা। কারণ আরো অজানা। রোগের এমন অনিশ্চিত ও অস্থিরতার পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে শীতের প্রকোপ। জুমার পর পুরোনো কর্মক্ষেত্রে বসে আছি। এত দিন পরও সেখানে গেলে বসা যায়। ঠিক আগের মতোই একটা অনুভূতি কাজ করে। যদিও দিনকে দিন অপরিচয়ের পরিধি বাড়ছে। মানুষের জীবন এমনই। শুধুই হারিয়ে যাওয়া, বিস্মৃত হয়ে যাওয়া।

মাগরিবের পর বসে আছি। চেনাজনদের সঙ্গে কথা বলছি। এর মধ্যে ফোন বেজে উঠল। ওপাশের সঙ্গে যুক্ত হতেই মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ছাহেবের ছেলে বললেন, আব্বা তো কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। এর আগের শুক্রবারে স্ট্রোক করে হুজুর ভর্তি হয়েছিলেন আগারগাঁওয়ের নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। হুজুরের ছেলে বলেছিলেন, বাবা তো আইসিইউতে। দিনের বেলা শুধু এক ঘণ্টা আমাদেরকে ভেতরে যেতে দেয়। সুতরাং কারো দেখতে আসা উচিত হবে না। তাই দূর থেকে দুআই করছিলাম।

কয়েকদিনের অব্যাহত পেরেশানী, শীতের জবুথবু অবস্থা, সেই সঙ্গে এ সংবাদটি যোগ হয়ে দেহমনকে বিবশ করে দিল। জানাযা-কাফন-দাফনের প্রসঙ্গ এল। অপর প্রান্ত থেকে জানালেন, গোসল আলমারকাযুল ইসলামীতে হবে। জানাযা ও দাফনের সিদ্ধান্ত পরে।

ফোন রেখে ফিরে এলাম মনের জগতে। মন আমাকে টেনে নিয়ে গেল অনেক অতীতে। মাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ হল। ফরিদাবাদের মুহতামিম ছাহেব হুজুর বললেন আকাবিরদের পত্রিকা মাসিক নেয়ামত পুনরায় চালু করতে। নিজের অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতার কথা জেনেও নেমে পড়লাম। নেয়ামত সংশ্লিষ্ট পুরোনো মানুষগুলোকে খুঁজতে খুঁজতে মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ছাহেবকে পেয়ে গেলাম। মিরপুর সাড়ে এগারোর পোস্ট অফিস গলির বাসায় প্রথম দেখা। মনে ভয় ছিল, সংকোচ ছিল- এমন একজন জ্ঞানবৃদ্ধের সঙ্গে এই নবীন কথা বলবে কী করে। প্রথম সাক্ষাতে হুজুর এতটাই আপন করে নিলেন, মনে হল কোনো আত্মার আত্মীয়র সঙ্গে কথা বলছি। এর পরের পাঁচটি বছর শুধুই ঘনিষ্ঠ হওয়া। প্রতি মাসে একবার পত্রিকা প্রকাশের আগে লেখার জন্য যেতাম। পত্রিকা প্রকাশের পর সৌজন্য কপি ও সম্মানী নিয়ে আরেকবার যেতাম। কোনো কোনো মাসে আরো বেশি যাওয়া হত।

২০১৪-এর নির্বাচনের আগে দেশে প্রচণ্ড গণ্ডগোল। যখন তখন পেট্রোল বোমায় গাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। মানুষ ঝলসে যাচ্ছে। এমন কঠিন দিনগুলোতেও আমরা ছুটে যেতাম হুজুরের বাসায়। এক সন্ধ্যায় তো মিরপুর সাড়ে এগারো নামতেই আমাদের পেছনে বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ। কেন যেন দৌড় না দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে, কী দুঃসাহসই না করেছিলাম সেদিন।

আমাদের পেলে হুজুর সময় ভুলে যেতেন। নতুন কিছু লিখলে আমাদের দিয়ে পড়িয়ে শুনতেন। দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তবুও হুজুর লেখা শেষ না করে উঠতে দিতেন না। গল্প-আলাপচারিতা, আলোচনা-সমালোচনায় কখনো রাত দুইটা-আড়াইটা বেজে যেত। হুজুর বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তার ওপর ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো খাবার ও বিশ্রাম খুবই জরুরি। হুজুরের আহলিয়া বিষয়গুলো খুব কঠোরভাবে খেয়াল রাখতেন। তাই রাত হলে মেহমান বিদায় করে ঘুমানোর তাগাদা দিতেন। হুজুর বলে পাঠাতেন, এই তো শেষ।

হুজুরের নাতনি আফরা তখন ছোট। পাঁচ-ছয় বছর হবে হয়তো। একদিন হুজুরের কানে কানে এসে কী যেন বলল। হুজুর ছিলেন লেখা নিয়ে মগ্ন। বললেন, বুঝি না, জোরে বলো।

তবুও আফরা আস্তেই বলল। হুজুর এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, আহ হা, শুনি না তো! জোরে বলো।

এবার আফরা শিশুসুলভ চড়া গলায় বলল, নানু বলেছেন, মেহমান কখন যাবে?

হুজুরের তো জিহ্বায় কামড়। বললেন, ছি, ছি, মেহমানদের সামনে এভাবে বলতে নেই।

আহ কী দিনই না ছিল। হুজুর আমাকে ও আব্দুল মুমিন ভাইকে বলতেন, মানিকজোড়।

একদিন হুজুর আফরার সামনে বললেন, ওরা দুজন আমার দুটি কিডনি।

আফরা গাল ফুলিয়ে বলল, তাহলে আমি কী?

হুজুর বললেন, তুমি তো আমার হার্ট।

একবার হুজুরের সঙ্গে গল্প ও কাজে সারারাত চলে গেল আমাদের। তাহাজ্জুদের সময় হুজুর নামাযে দাঁড়ালেন। মাঝারি দৈর্ঘ্যরে নামায পড়লেন। এর মধ্যে হুজুরের ছেলে এসে বলল, বাবা আজ রাতে আমার ডিউটি। এখন বের হব।

ছেলে বের হয়ে যাওয়ার পর হুজুর আক্ষেপ করে বললেন, আমার ছেলের এখন তাহাজ্জুদ পড়ার কথা আর এখন সে যাচ্ছে রুটি-রুজির খোঁজে!

দিনগুলো কীভাবে চলে গেল। মনে হয়, এই তো সেদিন শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের অনুরোধে লিখলেন, শাহবাগ থেকে শাপলা চত্বর। রাহনুমা থেকে প্রকাশিত হল। তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেল। সেল্ফ সেন্সরশিপের অংশ হিসেবে প্রকাশক ছাপা বন্ধ করে দিল। হুজুরের মহানবী স্মারক করে দিলাম। জীবন সন্ধ্যায় মানবতার রাহনুমা সংস্করণের আয়োজন করলাম। লালকুঠিতে সীরাত মাহফিলে হুজুর অতিথি হয়ে এলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন মুন্সিগঞ্জের বেদে পল্লীতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা দিতে। বেদে সমাজের মাঝে দ্বীনী ও সেবামূলক কাজের জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্মেলন কক্ষে এর কমিটি গঠিত হয়েছিল। আমার ও আব্দুল মুমিন ভাইয়েরও একটি করে পদ ছিল। দৈনিক পত্রিকায় এ সংগঠনের সংবাদও প্রকাশিত হল।

এরপর একটা সময় আসে যখন শহর আর আমাকে ধরে রাখেনি। চলে আসি ঢাকার একটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। পড়াশোনার আড়ালে নিজেই আড়াল হয়ে যাই পরিচিতজনদের থেকে। দেখা না হতে হতে সজীব সম্পর্কগুলো ধুলোমলিন হয়ে যায়। অনেককে ভুলে গেলাম। অনেকে আমাকে ভুলে গেল। কিন্তু হুজুর এবং আমরা পরস্পরের স্মৃতিতে ছিলাম তাজা। পরিচিত কেউ গেলে হুজুর খোঁজ-খবর নিতেন। কখনো ফোনে কথা হত। কিন্তু দূরত্ব তো দূরত্বই। দূর থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে আর ফোনে কথা বলে সে দূরত্ব কি আর ঘোঁচে। গ্রামে আসার পর দুয়েকবারই দেখা হয়েছিল হুজুরের সঙ্গে।

যাইহোক এবার ফিরে আসি আজকের প্রসঙ্গে। হুজুরের জানাযা হবে আরজাবাদ মাদরাসায় বাদ এশা। দাফন হবে মিরপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্তানে। ফরিদাবাদ থেকে আমরা দুজন- আবদুল মুমিন ভাই আর আমি ছুটে চললাম। মানুষ বলে, দুঃখের দিনে পথ ফুরোয় না। তাড়া থাকলে ঢাকার জ্যাম অবধারিত বাগড়া দেয়। আমার অভিজ্ঞতাও অনেকটা এমনই। কিন্তু  আজ এমন কিছুই ঘটেনি। আল্লাহ বান্দাকে সব কষ্ট একসাথে দেন না। কঠিন সময়ের সঙ্গে জুড়ে দেন সহজ সময়। সিএনজি ঠিক সময় আরজাবাদ পৌঁছল। রাস্তা ছিল জ্যামমুক্ত। ড্রাইভার ছিল আন্তরিক। জানাযা তখনো আসেনি। গিয়ে দেখি, মারকাযুদ দাওয়াহ্র মাওলানা আনোয়ার হুসাইন ছাহেব ও মাওলানা মুস্তাকিম বিল্লাহ ছাহেব এসেছেন। আরো দুয়েকজন মানুষ দেখলাম জানাযার প্রতীক্ষায়। জানাযা শুরু হতে হতে প্রায় সাড়ে নয়টা। ইমামতি করেন হুজুরের ছোট ভাই উবাইদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। জানাযার আগে হুজুরের ছেলেরা মাসিক আলকাউসার ও নেয়ামতের লোকজনকে খোঁজ করছিলেন খুব করে। মনে হচ্ছিল, হুজুর অথবা হুজুরের পরিবারের ধারণা ছিল, এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে জানাযায় কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে। তাই আমি, আব্দুল মুমিন ভাই, মাওলানা আনোয়ার ছাহেব ও মাওলানা মুস্তাকিম ছাহেবকে দেখে হুজুরের ছেলে আস্বস্ত হলেন।

বিকেল চারটা বেজে চল্লিশ মিনিটে মৃত্যু। রাত সাড়ে নয়টায় জানাযা। জানাজানির সুযোগ হয়েছে কম। যারাও বা জানতে পেরেছেন তাদের জন্য এত অল্প সময়ে আরজাবাদ আসাও ছিল কঠিন। এমন কর্মমুখর ও খ্যাতিমান মানুষের এমন বিদায় আমাকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করতে শেখায়-

وَ كُلُّهُمْ اٰتِیْهِ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ فَرْدًا.

কিয়ামতের দিন প্রতিটি মানুষ আল্লাহর দরবারে একাকী হাজির হবে। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৯৫

তবে খুশির বিষয়, সুন্নত মোতাবেক তাড়াতাড়ি কাফন-দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেজন্য আমরা হুজুরের পরিবারের প্রতি শোকরগোযার।

লাশের গাড়ি রওয়ানা হল জান্নাতুল মাওয়ার দিকে। একটি অটো রিকশাতে চড়ে বসলাম মাওলানা শাকের হোসেন শিবলী, মাওলানা এহসান সিরাজ, মাওলানা আবদুল মুমিন ভাই এবং আমি। রিকশায় হুজুরের নানা স্মৃতিচারণাতেই কেটে গেল। নেয়ামতের প্রাক্তন সম্পাদক হিসেবে আবদুল মুমিন ভাই হুজুরকে নিয়ে নেয়ামতের একটি বিশেষ সংখ্যা করার কথা বললেন। সবাই সম্মতি জানাল। লেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। রিকশা কবরস্থানের দিকে যেতে যেতে আমি বলেছিলাম, সালে মুশতারাকে এক দরসে আমীনুত তালীম ছাহেব হুজুর জীবন্ত লাইব্রেরির উদাহরণ জানতে চেয়েছিলেন। সবাই চুপ করে ছিল। হুজুর আমার দিকে তাকালেন, আমি নিরুত্তর দেখে হুজুর বললেন, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ছাহেব হলেন, এ উপমহাদেশের ইলমী ও দাওয়াতী ইতিহাসের একজন জীবন্ত লাইব্রেরি।

দেখতে দেখতে আমরা জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থান গেটে হাজির। এই কবরস্থানের সামনে দিয়ে কত গিয়েছি। কখনো খেয়াল করেছি, কখনো করিনি। কখনো অজানা-অচেনা মায়্যেতকে সালাম দিয়েছি। আজ এখানে এসেছি শ্রদ্ধেয়, প্রবীণ, মুহসিন এক মানুষকে দাফন করতে। এ্যাম্বুলেন্স এসেছিল আমাদের আগেই। কবর প্রস্তুত ছিল। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানপাশের প্রথম গলি দিয়ে ঢুকে হাতের ডান পাশে শেষ সারির আগের সারির মাঝামাঝিতে হুজুরকে শায়িত করে আসি। কবরে নামার তাওফীক হয়েছিল। মাওলানা আনোয়ার ছাহেবও নেমেছিলেন কবরে। আর নেমেছিলেন হুজুরের ছেলে। আনোয়ার ছাহেব সুন্নত তরীকায় কবর কীভাবে হবে তার দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন পূর্ণ সময়।

আহ! এ কবরস্তানের সামনে দিয়ে কত গিয়েছি হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব বলে। এখন যাব হুজুরের কবরের দিকে তাকিয়ে। এসব কল্পনা, এসব দৃশ্য মাঝে মাঝেই কুড়ে কুড়ে খায়। এসব দৃশ্য বারে বারে আমাদেরকে মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সেদিন যখন নিজ হাতে হুজুরকে সমাহিত করে এসেছিলাম  সেদিন মৃত্যুর স্মরণে তাজা আল্লাহমুখী জীবন যাপনের শপথ করেছিলাম। আহ মাত্র ২৮ দিনের ব্যবধানেই সে শপথ শিথিল হয়ে এসেছে। শুধু এবারই না, গত বছর (২৫ জুন ২০২৩ ঈ.) যখন মেজো চাচাকে পৈতৃক নিবাস সৈয়দাবাদে দাদার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করে এসেছিলাম সেদিনও শপথ এমনই ছিল। কিন্তু হায় কোথায় শপথ আর কোথায় আমার জীবন!

হে আল্লাহ! তুমি হুজুরকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব কর। দ্বীনের তরে তাঁর নিবেদিত সব খেদমত কবুল কর। তার রচনাগুলোকে اَلْوَلَدُ الْمُخَلَّدْ-স্থায়ী সন্তান হিসেবে কবুল কর। সালাফের মতো উদ্যম, শক্তি ও সাহস আমাদেরকেও দান কর- আমীন! 

 

 

advertisement