রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

যদি ইসরাইল ও আমেরিকার নাম সুদান ও কম্বোডিয়া হত...!*

ওয়াসআতুল্লাহ খান

[ওয়াসআতুল্লাহ খান। সাংবাদিক এবং বিবিসি ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলামিস্ট। তার বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি চলমান বাস্তবতার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। মাসিক আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তা বাংলায় রূপান্তর করেছেনমাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ।]

জো বাইডেনের মধ্যে অন্তত একটি গুণ অবশ্যই আছে। তা হল, নিজের কথায় অবিচল থাকা। যেমন, গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের অতর্কিত হামলায় ৩ শ ইসরাইলি সৈন্যসহ প্রায় ১২ শ বেসামরিক লোক নিহত হয়। প্রায় আড়াই শ লোককে যিম্মি করে হামাস নিজেদের এলাকায় নিয়ে আসে। এ পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিল। কিন্তু এর পরেই পেছনের কুশীলবরা তৎপর হয়ে উঠল এবং গুজব ছড়ানো হল, হামাসের গেরিলা যোদ্ধারা হামলা চালানোর সময় কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করেছে। প্রায় ৪০ জন ইসরাইলি শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছে।

জো বাইডেন সত্যাসত্য যাচাই না করেই গুজবকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে এবং হামাসের গলা কেটে শিশু হত্যাকে বর্বরতা আখ্যা দিয়েছে। যদিও আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর ও খোদ হোয়াইট হাউস বারবার মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে, আঙ্কেল! যে ৪০ শিশুর গলা কাটা হয়েছিল মাশাআল্লাহ তারা আজও বেঁচে আছে। যেসব নারীকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করা হয়েছিল তাদের কেউ ইসরাইলি প্রশাসনের অপবাদ দেওয়ার পরও সামনে আসেনি। যদি এমন কিছু ঘটে, তাহলে আমরাই সবার আগে আপনাকে জানাব। আপনি দয়া করে শান্ত হোন এবং আমাদের ব্রিফিং অনুযায়ী চলুন।

জানি না, কেউ হয়তো জো বাইডেনকে এই সংবাদ দেওয়ারও চেষ্টা করেছে, কথিত ৪০ শিশুকে গলা কেটে হত্যা ও ১২ শ ইসরাইলির বাস্তব মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইল এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার ফিলিস্তিনীকে শহীদ করেছে। যার মধ্যে সাড়ে সাত হাজার শিশুও রয়েছে। যাদের অনেকেই ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছে। তাদের লাশও এখন দাফন করার মতো অবস্থায় নেই। এখনো এ অবস্থা অব্যাহত রয়েছে।

পাঠকের তো জানাই আছে, আশি বছরের একজন বৃদ্ধকে তার কল্পিত চিন্তার জাল থেকে বের করে আনা আট বছরের একটি শিশুকে লা-জওয়াব করে দেওয়ার চেয়েও বেশি কঠিন। শিশুকে তো কানমলা দিয়েও বোঝানো যায়, কিন্তু বৃদ্ধকে কী করবেন? বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন অবশ্য বাকি অপূর্ণতাও পূর্ণ করে দিয়েছেন। ৭ অক্টোবর হামলার পর তিনি প্রথমবারের মতো তেল আবিব গিয়ে ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য নেতানিয়াহুর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং  বলেছেন, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি একজন ইহুদী হিসেবেও তিনি আজ ভারাক্রান্ত।

গাজায় চলমান গণহত্যার সপ্তম সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে ইহুদীদের হানুকা উৎসব উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার পরবর্তী সকল রাষ্ট্রপতির মতো জো বাইডেন ইহুদী মেহমানদের সম্মেলনের কথা স্মরণ করে বলেছেন, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের শক্ত অবস্থানের দায়িত্ব নেবে। ইসরাইল না থাকলে আজ প্রতিটি ইহুদীই নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করত। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ৩৫ বছর আগে আমি সিনেটে বলেছিলাম, ইসরাইলকে আমরা বার্ষিক ৩ বিলিয়ন ডলারের যে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছি, তা আমেরিকার সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। আমি এ কথাও বলেছিলাম, জায়োনিস্ট হওয়ার জন্য ইহুদী হওয়া জরুরি নয়। আমিও একজন জায়োনিস্ট।

দুই সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত হানুকা উৎসবে এসব পরিকল্পনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ও পুনরাবৃত্তির পরও যদি কেউ বাইডেন প্রশাসনের ইসরাইল-নীতি বুঝতে না পারে, তাহলে আর কোনো দৃষ্টান্তই তাকে এই নীতি সম্পর্কে বোঝাতে পারবে না।

১৯৪৮ সালের জাতিগত নিধনের (জেনোসাইড) বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের কনভেনশনে আমেরিকা স্বাক্ষর করে রেখেছে। কনভেনশনে উল্লেখিত জাতি নিধনের সংজ্ঞা অনুযায়ী মানবজাতির বংশ, ধর্ম কিংবা জাতিগত কোনো দল বা গোষ্ঠীকে  পূর্ণ অথবা আংশিক নির্মূল করার লক্ষ্যে গৃহিত নিম্নোক্ত যেকোনো পদক্ষেপই গণহত্যা হিসেবে অভিহিত হবে। যথা :

১. উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্যদেরকে হত্যা করা।

২. ঐ গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করা।

৩. তাদের জীবনযাত্রায় এমন বিধিনিষেধ আরোপ করা, যার দরুন গোষ্ঠীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে।

৪. তাদের জন্মধারা রোধ করার লক্ষ্যে কোনো ব্যবস্থা আরোপ করা। 

৫. তাদের সন্তানদের জোরপূর্বক অন্যত্র স্থানান্তর করা।

উপরোক্ত পাঁচটি শর্তের মধ্যে ইসরাইল প্রথম তিনটি পূরণ করে চলেছে। একটি বিশেষ অঞ্চলে (গাজা উপত্যকা) বসবাসকারী ফিলিস্তিনীদের সামগ্রিকভাবে নির্মূল করার লক্ষ্যে বেপরোয়া বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণ করে চলেছে। ৭ অক্টোবর থেকে আজ পর্যন্ত তারা যে পরিমাণ গোলা-বারুদ বর্ষণ করেছে তার সমষ্টিগত শক্তি হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার চেয়েও আড়াই গুণ বেশি। খোদ আমেরিকার সিআইএ একথা স্বীকার করেছে, এখন পর্যন্ত গাজায় যত বোমা হামলা হয়েছে, তার শতকরা ৫০ ভাগ বেপরোয়া কিংবা লক্ষ্যহীন ছিল। এই বোমাগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তি বা স্থাপনা ধ্বংস করে দিতে পারে। যা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সামগ্রিকভাবে দৈহিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ।

৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল গাজায় খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও আশ্রয়শিবিরগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস করে চলেছে। যার একমাত্র লক্ষ্য জাতিগত নিধন। তাছাড়া সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে, যেন গাজার ২৩ লক্ষ অধিবাসী বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে দেশান্তরিত হয়। 

বাইডেন প্রশাসন এই জাতিগত নিধনের সবচেয়ে বড় সহযোগী। যুদ্ধ বন্ধের সব প্রস্তাবে সে ভেটো দিয়ে ইসরাইলকে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মার্কিন প্রশাসন গাজায় ব্যবহৃত শুধু সমরাস্ত্রই ইসরাইলকে সরবরাহ করছে না; বরং কংগ্রেসকে উপেক্ষা করে জরুরি অবস্থার আড়ালে গত সপ্তাহে ইসরাইলকে ট্যাঙ্ক ও কামানে ব্যবহারের ১৪ হাজার ভারি গোলা-বারুদের একটি চালানও পৌঁছে দিয়েছে।

এতকিছুর পরও এখন পর্যন্ত আমেরিকার প্রচারমাধ্যমগুলোতে কোনো খবর, নিবন্ধ কিংবা সম্পাদকীয়তে এমন একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি যে, ইসরাইল জাতিগত নিধনে লিপ্ত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে মিডিয়ায় যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা হল, ইসরাইল তার প্রতিরোধ-অধিকার প্রয়োগ করছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) আইন অনুযায়ী এটি জাতিগত নিধনের একটি পরিষ্কার ও স্পষ্ট মোকাদ্দমা। কিন্তু আমেরিকা ও ইসরাইলের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও পরিষ্কার নালিশেও তোতলানো শুরু হয়। অথচ দুটি দেশই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী রাষ্ট্রগুলোর তালিকাভুক্ত।

এর পরও যদি ইসরাইল ও আমেরিকার নাম সুদান, লাইবেরিয়া, কম্বোডিয়া বা সার্বিয়া হত, তাহলে আজ জো বাইডেন ও নেতানিয়াহুকে দি হেগ-এ অবস্থিত ক্রিমিনাল কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়াত।

যদিও গাজার তুলনায় ইউক্রেনে জাতিগত নিধনের অর্ধেক তৎপরতা চালানোর দায়ে জাতিসঙ্ঘ পুতিনের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এজন্য গ্রেফতারের ভয়ে ভ্লাদিমির পুতিন এমন দেশে যেতে পারে না, যে দেশ তাকে গ্রেফতার করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য।

(একটি বিদেশী দৈনিক থেকে অনূদিত।) 

 

টীকা :

* আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধাপরাধ আদালতে সুদান, কম্বোডিয়ার নেতাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। একই কায়দায় জো বাইডেন ও নেতানিয়াহুকেও সে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। কিন্তু তেমনটি হচ্ছে না। কারণ তারা দুজন যে দেশের নেতা সে দেশের নাম যে ইসরাইল ও আমেরিকা। -সম্পাদক 

 

 

 

advertisement