রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

একেবারে শেষ বেলায়

মাওলানা মাসউদুযযামান শহীদ

আল্লাহওয়ালাদের সোহবত মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। তাঁদের নেক দুআ ও নেক নযর হতভাগাকেও করতে পারে ভাগ্যবান ও ধন্য। আর যদি তাদের কাছে পৌঁছা যায় কোনো আল্লাহওয়ালার হাত ধরে, তাঁর কোনো নেক তামান্নার সাথী হয়ে!

প্রফেসর হযরত রাহ.। আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের সোহবতে ধন্য এক পরম সম্পদ। তাঁকে নিয়ে বলবেন যারা খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখেছেন, যারা তাঁর সম্পর্কে জানেন। আমার আছে একটি স্মৃতি। তাঁর সান্নিধ্যের ঘ্রাণ নেবার একটিমাত্র বলার মতো ঘটনা। তা-ই শুধু এখানে তুলে ধরি।

যেদিন তাঁর ইন্তেকাল হল, তার ঠিক ছয় দিন আগে, জুমাবার। সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমীনুত তালীম (মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক) ছাহেব আমার খোঁজ নিলেন। হুজুর বললেন জুমার জন্য প্রস্তুত হয়ে মাকতাবার সামনে থাকতে।

জুমার প্রস্তুতি নিয়ে মাকতাবার সামনে এসে দাঁড়ালাম। হুজুর এলেন। গাড়ি প্রস্তুত। হুজুর উঠলেন। ইশারা করলেন। গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল।

হুজুরের সঙ্গে কোথাও যেতে পারাটা আনন্দের। কিন্তু তখনো জানি না, আমি যাচ্ছি কি না, কিংবা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। যখন জানতে পারলাম, সীমাহীন পুলকিত হলাম।

***

উত্তরা ৩ নং সেক্টর জামে মসজিদ। এখানে আমরা জুমা আদায় করলাম। জুমার পর মসজিদে দুটি বিবাহের আকদ। প্রফেসর হযরতেরই মহব্বতের লোকদের ছেলে-মেয়ে পাত্র-পাত্রী। সুন্নত নামাযের পর হুইল চেয়ারে করে হযরতকে আনা হল, মেহরাবের সামনে। হযরতকে মাঝে অনেকদিন দেখিনি। খুব কাবু হয়েছেন। অশীতিপর মানুষ। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পাকাপোক্ত। কিন্তু তার মাঝেই কী এক দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে তাঁর মুখাবয়ব থেকে। দৃষ্টি রয়েছে অবনত। ঠোঁট দুখানি মৃদু নড়ছে। তাঁর শায়েখ হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সম্পর্কে যেমন শুনেছি, যিকিরে তাঁর ঠোঁট দুটো সব সময় নড়তে থাকত...।

আমীনুত তালীম ছাহেব এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলেন। হুজুরকে দেখে প্রফেসর হযরত কেঁদে ফেললেন। কী ছিল সেই কান্নার ভাষা, তা তো তখন বোঝা গেল না; হয়তো এখন কিছুটা বুঝে নেওয়া যায়!...

বিবাহের আকদ হচ্ছে, মসজিদে। সুন্নত তরীকায় যেন বিবাহটা হয় এমন আশায়। কিন্তু সেখানেই যদি মসজিদের আদবের খেলাফ কার্যকলাপ হয় তাহলে কি চুপ থাকার সুযোগ আছে? বিবাহের মজলিসের দৃশ্য ধারণের জন্য উপস্থিত লোকেরা একের পর এক যখন স্মার্টফোন উঁচু করছিলআমীনুত তালীম ছাহেব কঠিন ভাষায় এর প্রতিবাদ করলেন। হুজুর বললেন

স্মার্টফোন এই যামানার সবচে বড় ফিতনা। ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যবহারও মসজিদে নাজায়েযএটা স্বয়ং সেই হুজুরদের ফতোয়া, যারা অনিবার্য প্রয়োজনে কোথাও কোথাও ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন বা তাত্ত্বিকভাবে একে নিষিদ্ধ তাসবীরের মধ্যে গণ্য করেননি। কী সাংঘাতিক কথা! নবীজীর রওযায় গিয়েও স্মার্টফোন হাতে নিয়ে ভিডিও করতে থাকে। এটা নবীকে কেমন সালাম করা হল? এতে কি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হবেন? বাইতুল্লাহর সামনে গিয়েও ছবি তুলতে থাকে, ভিডিও করতে থাকে। এক ছবিতেই কি সব বরকত নিয়ে ফেলবেন?! বাইতুল্লাহ্য় হাযিরি, রওযায় নবীর যিয়ারতএসব হৃদয়ে ধারণের বিষয়। বরকত মোবাইলে নয়, দিলের মধ্যে ধারণ করুন। মসজিদুল হারাম, বাইতুল্লাহ, এমনিভাবে যেকোনো মসজিদ ও দীনী মাহফিলএসব জায়গায় ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যবহারও নাজায়েয। মসজিদের আদব রক্ষা করেন। বিয়ের মজলিস, সবাই মোবাইল নামান।

মনে রাখবেন, অনেক মুহাক্কিক আলেমের দৃষ্টিতে; বরং বলা যায় অধিকাংশ আলেমের নিকট ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যবহারও শুধু জরুরতের ক্ষেত্রেই বৈধ। তবে কোন কোন বিষয় জরুরতের আওতাভুক্ত, তাও নিজে ফায়সালা করবেন না। উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে জেনে নিবেন। তবে যে ক্ষেত্রগুলোর কথা আলোচনা করা হল তা যে কোনোভাবেই জরুরতের আওতায় আসে না, এতটুকু তো আশা করি সবাই বোঝেন।

আলহামদু লিল্লাহ, হুজুরের এ আলোচনা শুনে যারা মোবাইল উঠিয়েছিল সবাই মোবাইল নামিয়ে নিল।

বিবাহ পড়ালেন আমীনুত তালীম ছাহেব। দুটি আকদের মধ্যে প্রথমটির পর প্রফেসর হযরত দুআ করলেন। দ্বিতীয়টির পর দুআ করলেন আমীনুত তালীম ছাহেব। দেখলাম, হযরত মুনাজাতের জন্যও হাতদুটি স্বাভাবিকভাবে তুলতে পারছেন না। কোনোরকম হাত দুটো এক জায়গায় করে মুনাজাত করছেন। দেখে খুব মায়া হল।

***

বিবাহের মজলিস শেষে এক পক্ষের আপ্যায়নের আয়োজন হযরতের মাদরাসায়। মাওলানা হাবীব খান ছাহেব আমীনুত তালীম ছাহেবকে নিয়ে গেলেন দোতলায় হযরতের কামরায়। ওখানে মেহমানদারীতে অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষমান আরো অনেকেই রয়েছে। আমীনুত তালীম ছাহেবের পিছু পিছু সে কামরায় পৌঁছলাম। প্রফেসর হযরত বসা। আমীনুত তালীম ছাহেব প্রফেসর হযরতের সামনে এসে বললেন, ‘ইনি মাসউদুযযামান শহীদ। মারকাযুদ দাওয়াহ্য় থাকেন। আমার জন্য আর তার জন্য দুআ করেন, আল্লাহ যেন বরকতের যিন্দেগী দান করেন। কাসাল এবং গাফলত দূর করে দেন।হযরত দুআ করে দিলেন।

একটুপর একটি কাজের আলোচনা এল, যা আমার করার কথা ছিল। হুজুর তো জানেন আমার কী হালত। তাই বললেন, ‘দেখা যাক, হযরতের দুআর বরকতে যদি কিছু হরকত পয়দা হয়। হুজুরের এই কথাটা বারবার আমার কানে বাজতে লাগল। বুঝলাম, কী উদ্দেশ্যে আজকে এখানে আসা। নিশ্চেষ্ট নিষ্প্রাণ জীবনে আল্লাহ মেহেরবান যেন প্রাণের সঞ্চার করে দেন। বড়দের চেষ্টা এবং আল্লাহওয়ালাদের দুআ তো বৃথা যাবার নয়। আমার কাজটুকু করা যেন আমার নসীবে হয়!

কিছুক্ষণপর প্রফেসর হযরতকে দস্তরখান দেওয়া হল। হযরত তখন পর্যন্ত উপস্থিত লোকদের দিকেই মুখ করে বসা। আমীনুত তালীম ছাহেব বললেন হুইল চেয়ার বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে। যেদিকে হযরতের বিছানা। প্রফেসর হযরত এতে স্বস্তি পেলেন বোঝা গেল।

***

১৭-৪-১৪৪৫ হি.(২-১১-২০২৩ ঈ.), বৃহস্পতিবার। বাদ মাগরিব। কেন যেন মনটা আজ খুব নরম ছিল। খুব বেশি নামায, তিলাওয়াত ও যিকির-আযকার করতে মনে চাচ্ছিল। বড় কিছু ঘটার আগে মানুষ যেমন বুঝতে পারেবড় কারো বিদায় ঘনিয়ে এলেও হৃদয়ভূমিতে কম্পন জাগে। একটু সচকিত হলেই সেটা অনুভব করা যায়।

মসজিদ থেকে এসে নিজের কাজের জায়গায় বসলাম। ওয়ালিউল্লাহ ভাইকে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলাম। সালামের উত্তর নিয়ে তিনি একটু নীরব থেকে বললেন, আমাদের মুরব্বিরা তো চলে যাচ্ছেন। আমি পেরেশান হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন, কার ইন্তেকাল হয়েছে? বললেন, প্রফেসর হযরত...। শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। হায়! এমনই হতভাগা আমি! পেতে না পেতেই হারালাম!

ওয়ালিউল্লাহ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, হযরতের জানাযা কখন? বললেন, দশটায়। ঘড়িতে তখন সাতটা পাঁচ কি দশ। বললাম, আমি হযরতের জানাযায় যাব। তিনি বললেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন? বললাম, পারব ইনশাআল্লাহ। যদি আমি তাঁর জানাযা পড়া ছাড়াই তিনি মাটির নিচে চলে যান তাহলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারব না। তারপর তাকে সংক্ষেপে গত জুমার ঘটনাটা বললাম।

সময় কম ছিল, তবু রওয়ানা হয়ে গেলাম জানাযার উদ্দেশে। সারাটা পথ শুধু গত জুমাবারের ঘটনাটা স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগল। মহান মানুষটিকে আমি সামান্য সময়ের জন্য পেয়েছিলাম। আর এর সামান্য পরেই চিরদিনের জন্য তাঁকে হারালাম! কী রহস্য এর? এখানে কি আছে কোনো বার্তা?

আল্লাহ ব্যবস্থা করে দিলেন। অভাবনীয়ভাবে, খুব সহজে এবং খুবই দ্রুত পৌঁছে গেলাম জানাযাস্থলে, উত্তরা ফ্রেন্ডসক্লাব মাঠে।

হযরতের মুখখানি শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্য মাঠের প্রান্তসীমায় দীর্ঘ সারি। উত্তর দিক থেকে শুরু হয়ে সে লাইন পূর্বদিক পেরিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে গেছে পশ্চিমে। আমিও দাঁড়ালাম এ লাইনে। তবে এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় অপেক্ষার পর বুঝলাম, এখন জানাযার নামাযের জন্য কাতারে গিয়ে দাঁড়ানোই মুনাসিব। অতএব তাই করলাম।

জানাযা শেষ হল। জানাযার পর ময়দানে আমীনুত তালীম ছাহেবকে এক ঝলক দেখার সুযোগ পেলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা তালিবানে ইলম জামিয়াতুল উলুমের আসাতিযা কেরাম ও আমীনুত তালীম ছাহেবকে চারপাশ থেকে যেভাবে ঘিরে রেখেছিলদৃশ্যটা একদিকে বিব্রতকর, অন্যদিকে বলতে ইচ্ছে হয়, অভূতপূর্ব। নিঃশব্দ ঘিরে থাকা, একেবারে গা ঘেঁষে। যেন মৌমাছির দল ভিড় করেছে মৌচাকে!

প্রিয় মানুষদের এক নযর দেখার জন্য এভাবে ঘিরে ধরা উচিৎ নয়। এটা তাদের পছন্দ না, কষ্টও হয়। যদিও সব সময় তারা বাধা দেন না বা জোর করে সরিয়ে দেন নাতাদের স্বভাসুলভ উদারতা ও সহনশীলতার কারণে।

***

জানাযা শেষ করে মারকাযে পৌঁছতে রাত একটা হয়ে গেল। ফিরে এসেই সেই লেখাটিতে মন দিলাম, যে লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম প্রফেসর হযরতের জানাযার উদ্দেশে রওয়ানা করার আগে। এ সেই লেখা, আজ এক সপ্তাহ যাবত যাতে ডুবে আছি, কিন্তু কোনো কূল করতে পারিনি। আমীনুত তালীম ছাহেব চেয়েছিলেন গত জুমায় প্রফেসর হযরতের কাছ থেকে এসেই সোজা এই লেখা নিয়ে বসে যাই। যেন হযরতের দুআর বরকতটুকু ধরে রাখতে পারি। দুআ পাওয়ার প্রথম মুহূর্ত থেকেই হরকত শুরু করি।

নিজের গাফলতির কারণে সেদিন উত্তরা থেকে ফিরে সোজা মারকাযে না এসে বাসায় চলে গিয়েছিলাম। তারপর যদিও সেই রাতেই এসেছি মারকাযে এবং আলকাউসারেএসে লেখাটিতে মন দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একটা ছেদ তো পড়লই! যে কারণেই হয়তোবা গোটা একটি সপ্তাহ ব্যয় করেও লেখাটি শেষ করা গেল না। এমন ভুল আমরা করতেই থাকি এবং ভুগতেই থাকি।

জানি না, আজ লেখার টেবিল থেকে উঠে জানাযার ময়দানে হাযিরা দিয়ে এই যে আবার ফিরে এলাম সেই লেখার কাছে—  এতে করে আমার আগের ভুলের কাফফারা হবে কিনা। তবু চেষ্টা করলাম এবং সত্যিই লেখাটি একরকম শেষ করতে পারলাম।

প্রফেসর হযরতের খাস ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁর সোহবত পাওয়া শুরু করলাম, কিন্তু তা প্রলম্বিত হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আহ! আমার কিসমত! এখন চাওয়া এই, তিনি যে দুআ করেছেন হুজুরের অনুরোধেতা যেন ধরে রাখতে পারি। যেন অলসতা ও উদসীনতামুক্ত বরকতময় জীবনযাপন করতে পারি।

আল্লাহ প্রফেসর হযরত রাহ.-এর দারাজাত বুলন্দ করুন। মুরব্বিদের যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের ছায়া আমাদের ওপর দীর্ঘায়িত করুন। তাঁদের ছায়াবিহীন জীবন তো শূণ্যতার। আল্লাহর যত নেক বান্দা ছিলেন এই দুনিয়ায় এবং এখনো আছেনআমাদের বাঁচা ও মৃত্যু যেন তাঁদেরই মতো হয়। তাঁদের পাশেই হয় আমাদের কবর। তাঁদেরই সঙ্গে থাকি ময়দানে মাহশারে এবং জান্নাতের অনন্তকালীন জীবনে! কবুল করো হে আল্লাহ!

 

 

advertisement